টিম হান্ট ও একটি রসিকতার কাহিনি
সায়ন্তনী অধিকারী
টিম হান্টের নাম আমি আগে শুনিনি। যেমন আরও অনেক নোবেল জয়ীর
নামও শুনিনি। কিন্তু স্যার টিমের খ্যাতি সম্প্রতি কিছু বাড়ায় শুনতে বাধ্য হলাম আরও
অনেকেরই মতো।
স্যার টিম ইউসিএল’এর সাম্মানিক অধ্যাপক ছিলেন এই কিছুদিন
আগে অবধি। ৯ই জুন তিনি আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাংবাদিকতা বিষয়ক সম্মেলনে কথা বলার
সময় বলে বসেন যে ল্যাবরেটরিগুলিতে মহিলাদের উপস্থিতি সমস্যাজনক, কারণ, মহিলাদের
উপস্থিতিতে প্রেমের সম্ভাবনা বেশি, আর মহিলারা সামান্যতম বকুনি দিলেও কান্নাকাটি
বেশি করেন। এর পরেই অবশ্য হান্ট যোগ করেন যে তিনি নিছকই মজা করছিলেন, কিন্তু এই
স্বীকারোক্তি খুব একটা গ্রাহ্য হয়নি প্রথমদিকে। মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় ওঠে
এবং টিম হান্ট পদত্যাগ করেন। আর এরপরই শুরু হয় আরেক প্রস্থ আলোড়ন। টিমের কিছু
সহকর্মী ও ছাত্রছাত্রী লিখিত ভাবে জানান যে টিম মোটেই সেক্সিস্ট নন এবং মিডিয়া ও
কিছু অতি তৎপর ফেমিনিস্ট অকারণে তাঁর উপর এই লেবেল লাগিয়ে দিচ্ছে। অপরদিকে কেউ কেউ
এও বলেন যে একটি সাধারণ রসিকতাকে নিয়ে বেরসিকরা একজন বিজ্ঞানসাধকের জীবিকা কেড়ে
নিল। এ প্রসঙ্গে একটু দেখে নেওয়া যাক আসলে সমস্যাটা কোথায় হতে পারে।
দক্ষিণ কোরিয়ায় করা টিম হান্টের মন্তব্য নিয়ে আলোড়ন হওয়া
খুব অস্বাভাবিক নয়। একজন নোবেল জয়ী বিজ্ঞানীর কথা দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে পড়বে এটা কি
খুবই অপ্রত্যাশিত? আর রসিকতার মধ্যে দিয়েই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের
পলিটিক্যালি ইনকারেক্ট ধ্যান-ধারণার বীজ রোপণ ও লালন করা হয় সে বিষয়েও সন্দেহের বিশেষ
অবকাশ থাকে না। তাহলে, ‘শুধুমাত্র রসিকতা’ বলে বিষয়টিকে কতটা লঘু করে দেখানো যায়? এবং
একজন নোবেল প্রাপ্ত বিজ্ঞানী এ বিষয়টা বোঝেন না ভাবা হলে সম্ভবত তাঁর বুদ্ধিমত্তা
নিয়ে সংশয় পোষণ করা হয়, যা বেশ আপত্তিকর।
আসা যাক সোশ্যাল মিডিয়া সহ অন্য মিডিয়া সমূহতে প্রতিক্রিয়া
সংক্রান্ত প্রশ্নে। কনি সেন্ট লুইস বলে যে সাংবাদিক এই খবরটি ‘ব্রেক’ করেন, তার
উপর পরবর্তীকালে টিম হান্টের ‘ছাঁটাই’এর দায় চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু একজন
সাংবাদিক তাঁর কাজ করেছেন, তারপর যদি হান্ট চাকরি ছাড়েন, সে দায় কি সম্পূর্ণ রূপে
উক্ত সাংবাদিক বা তাঁর লেখার? প্রসঙ্গত অন্যান্য সাংবাদিকরাও অনেকেই এই খবরটি
পরিবেশন করেছেন, সর্বোপরি টিম নিজে স্বীকার করেছেন যে তিনি এই মন্তব্য করেছেন এবং
তিনি এ নিয়ে ক্ষমাপ্রার্থী; যদিও সঙ্গে জুড়ে দিতে ভোলেননি যে তিনি সত্যিই মজা করছিলেন
ও লঘু পাপে গুরু দণ্ড হল তাঁর, যদিও দণ্ডের দায় কারুর হলে সেটি কিন্তু ইউসিএল’এর,
সাংবাদিক বা অন্যান্য মানুষ যারা বিরক্ত হয়েছেন এ ধরনের মন্তব্যে, তাদের নয়।
এবার আসা যাক বিশ্ব ব্যাপী ফেমিনিস্টদের এর প্রতিক্রিয়াজনিত
সমস্যায়। ফেমিনিজম সম্ভবত এ সময়ের অন্যতম বহু বিকৃত ভাবধারা। অনেক মানুষই
ফেমিনিস্ট বলতে খুব রাগী, পুরুষবিদ্বেষী একদল মহিলার কথা ভাবেন। বাস্তবে কিন্তু
এমনটা নয়। ফেমিনিস্ট নিশ্চিত ভাবে একটি বহুধা বিভক্ত আন্দোলন, কিন্তু ফেমিনিস্ট
মানেই পুংবিদ্বেষ এটি শুধু অতিসরলীকরণই নয়, বরং সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। এবং শুধু নারী
নয় পুরুষ ফেমিনিস্ট দেশে বিদেশে সুলভ। এ বিষয়ে অনেক আলোচনার অবকাশ থাকে, তবে তার
যথাযথ স্থান এই লেখাটি নয়। শুধু এটুকুই বলা প্রয়োজন যে টিম সংক্রান্ত ঘটনার
প্রতিবাদে টুইটারে যে হ্যাশট্যাগ নির্মিত হয় – ‘ডিসট্রাক্টিংলি সেক্সি’ - তার
রসগ্রহণ করতে রসিক মানুষ টিম ও তাঁর সহযোগীরা ব্যর্থ হলেন কেন, এই নিয়ে প্রশ্ন
তোলা যায়। সম্ভবত টিম চাকরি খুইয়ে রসবোধজনিত সমস্যায় পড়েছেন। তাকে বিনম্রভাবে বলি,
ক্ষমা করবেন স্যার টিম, আপনার রসবোধ বুঝতে ঠিক একইভাবে আমাদেরও সমস্যা হয়েছিল।
আসলে আপনার রসিকতার কারণে মহিলাদের জন্য কাজের সুযোগ একটু হলেও হ্রাস পাবে এটাই
আশঙ্কার কারণ। আর ঠিক তাই আপনার চাকরি যাওয়া নিয়ে আনন্দ করতে পারছি না!
No comments:
Post a Comment