এসো 'শিক্ষিত'রা,
নিপুণ ভাবে মানুষ মারি
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য
হোস্টেল ও পারিবারিক জীবনের মধ্যে সব থেকে যে বড় ফারাকটা
আমাকে বিচলিত করেছিল তা একমাত্রিকতার ভয়াবহতা। হোস্টেলে প্রায় একই বয়সের সঙ্গী
সাথী বন্ধুরা, নানাজনে নানারকম হলেও মৌলিক ভাবে জীবন অভিজ্ঞতায় ও বোধে সকলেই বেশ
কাছাকাছি; পরিবারে নানা বয়স নানা রুচি নানা জ্ঞান ও সর্বোপরি অভিজ্ঞতার যে
বহুমাত্রিক দ্যোতনা, তার সঙ্গে অবশ্যই মেলে
না। ফলে, মনের পরতে যে বিচিত্র রূপশৈলী গড়ে ওঠার অবকাশ তা হোস্টেল জীবনে অবশ্যই
ব্যাহত হয়। স্কুলের ছোট ক্লাসে এই অভাবটা তীব্র হতে পারে, একটু বড় হয়ে গেলে ততটা
না হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তবে সদ্য স্কুল পাশ করা ছেলেমেয়েদের কলেজ হোস্টেলে ঢোকার
পর্বটা অনেকটা স্কুল পড়ুয়াদের মতোই।
স্কুলের ছয়ের ক্লাস থেকেই আমার হোস্টেল জীবন- আর সেভাবেই বড়
হতে হতে এই একমাত্রিকতার করালগ্রাস লব্ধ করেছি। জীবন যখন স্বতঃসারিত বৈচিত্র্য থেকে
বঞ্চিত হয়, তখন ভাল-মন্দ, সুখ-দুঃখ, সাদা-কালো সব একরৈখিক মাত্রায় জীবনকে ছেঁকে
ধরতে থাকে। এর থেকে মুক্তি পাওয়া বড় দায়। তখন আর উপায় থাকে না চরম নিষ্ঠুরতা ও উদগ্র
ভালবাসার কোনও মধ্যবর্তী আলো–আঁধারের তল্লাশ নেওয়ার। কারণ, একমাত্রিকতা তাকে
বৈচিত্রের হদিশ জানায়নি। সে এক কল্পিত একরোখা কোঠরের বাসিন্দা তখন।
কোরপান শাহের হত্যাকাণ্ড আমাকে এই কথাগুলো মনে পড়াল। এক
দুঃস্থ, মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষকে যে এইভাবে পিটিয়ে, তার যৌনাঙ্গ খুবলে ছিঁড়ে
হত্যা করা যায় তা দুঃস্বপ্নেও কজন ভাবতে পারে জানি না। কারা এই কাজটি করল? নীলরতন
সরকার মেডিকেল কলেজের আবাসিক পড়ুয়া ছাত্রদের একাংশ, যারা ভবিষ্যতের হবু চিকিৎসক।
আমরা যখন কলেজে পড়তাম তখন অধিকাংশ হোস্টেলে র্যাগিং ছিল এক নিয়মিত মান্য ব্যাধি।
হিন্দু হোস্টেলে বহু চেষ্টা করে একটা সময় আমরা র্যাগিং বন্ধ করেছিলাম। তখন অন্তত এই
কথাটা শুনতাম, মেডিকেল কলেজের হোস্টেলে র্যাগিং হয় না। বাস্তবিক হতও না। আমাদের
একটা ধারণা হয়েছিল, চিকিৎসার সঙ্গে যেহেতু মানবিকতার একটা গভীর সম্পর্ক আছে তাই
ডাক্তারি পড়া ছেলেমেয়েরা অমন নিষ্ঠুর মজায় নিজেদের সামিল করতে পারে না। মনে হয়, এই
অনুভবের একটা গ্রাহ্যতা ছিল। কিন্তু কোরপান শাহের হত্যাকাণ্ড আজ সে বিশ্বাসকে
চুরমার করে দিয়েছে। হোস্টেল জীবনের একমাত্রিকতা, চরম লোভ, দুর্বোধ্য এলিটিজমের
সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গরিব মানুষের প্রতি চূড়ান্ত ঘৃণা ও চিকিৎসাশাস্ত্রের মৌলিক
উপলব্ধির সঙ্গে পরিচয়হীন (না হলে মানসিক ভারসাম্যহীন কাওকে এ ভাবে খুন করা যায়?)
কতগুলো ‘মেধাবী’ পাষণ্ডের এমন বিকারগ্রস্ততা। সত্যজিতের 'আগুন্তুক' ছবিতে মনমোহন মিত্র বলেছিলেন, 'সভ্য কে? যে আঙ্গুল দিয়ে একটা বোতাম টিপে গোটা শহরকে ধ্বংস করে দিতে পারে।'
মনে আছে, হিন্দু হোস্টেলে প্রথম রাতে বুদ্ধিদীপ্ত র্যাগিং’এর নামে কিছু মদ্যপ ছাত্রের হাতে লাঞ্জিত হওয়ার কথা। পরের বছর যারা নতুন এল তাদেরই আবার সেই গতবারের লাঞ্ছিতরা ছেঁকে ধরল একইভাবে। আমরা কেউ কেউ সেখানে উপস্থিত থেকে যথাসম্ভব চেষ্টা করেছি আক্রমণকারীদের প্রতিহত করতে। তাতে ফল হয়েছিল। একেবারে বন্ধ না হলেও র্যাগিং’এর মাত্রা অনেকটা কমেছিল। নতুনদের হেনস্থা অনেকটাই লঘু হয়ে এসেছিল। কথা ছিল, পরের বছর থেকে র্যাগিং একেবারে বন্ধ হবে। আশ্চর্য, যে নতুনরা আমাদের প্রতিরোধে অনেক কম হেনস্থা হল সেই তারাই পরের বছর সিনিয়র হয়ে গিয়ে নতুনদের র্যাগিং’এর উদ্যোগ নিল। আমরা সেই র্যাগিং থামাতে গিয়ে তাদের আক্রমণের মুখে পড়লাম। স্পষ্ট মনে আছে, এই র্যাগিং’এর মূল হোতা ছিল আগরতলা থেকে প্রেসিডেন্সির অর্থনীতি বিভাগে পড়তে আসা একটি ‘সরল সোজা মেধাবী’ ছেলে যে ত্রিপুরা রাজ্যের উচ্চ-মাধ্যমিক পরীক্ষায় সেবার প্রথম স্থান পেয়েছিল।
মনে আছে, হিন্দু হোস্টেলে প্রথম রাতে বুদ্ধিদীপ্ত র্যাগিং’এর নামে কিছু মদ্যপ ছাত্রের হাতে লাঞ্জিত হওয়ার কথা। পরের বছর যারা নতুন এল তাদেরই আবার সেই গতবারের লাঞ্ছিতরা ছেঁকে ধরল একইভাবে। আমরা কেউ কেউ সেখানে উপস্থিত থেকে যথাসম্ভব চেষ্টা করেছি আক্রমণকারীদের প্রতিহত করতে। তাতে ফল হয়েছিল। একেবারে বন্ধ না হলেও র্যাগিং’এর মাত্রা অনেকটা কমেছিল। নতুনদের হেনস্থা অনেকটাই লঘু হয়ে এসেছিল। কথা ছিল, পরের বছর থেকে র্যাগিং একেবারে বন্ধ হবে। আশ্চর্য, যে নতুনরা আমাদের প্রতিরোধে অনেক কম হেনস্থা হল সেই তারাই পরের বছর সিনিয়র হয়ে গিয়ে নতুনদের র্যাগিং’এর উদ্যোগ নিল। আমরা সেই র্যাগিং থামাতে গিয়ে তাদের আক্রমণের মুখে পড়লাম। স্পষ্ট মনে আছে, এই র্যাগিং’এর মূল হোতা ছিল আগরতলা থেকে প্রেসিডেন্সির অর্থনীতি বিভাগে পড়তে আসা একটি ‘সরল সোজা মেধাবী’ ছেলে যে ত্রিপুরা রাজ্যের উচ্চ-মাধ্যমিক পরীক্ষায় সেবার প্রথম স্থান পেয়েছিল।
অনেক সময় সাধারণ আলোচনায় আক্ষেপ করা হয় মানুষের ‘শিক্ষা’
নিয়ে- আমরা অধিকাংশরা ‘অশিক্ষিত’ তাই আমাদের কত দুর্দশা! সম্ভবত তাই, ‘শিক্ষিত’রা
পাশবিক উন্মাদনায় মেতে উঠে নির্দ্বিধায়
নৃশংস অত্যাচারে ফালা ফালা করে হত্যা করে ‘অশিক্ষিত’, ‘দরিদ্র’, ‘মানসিক
ভারসাম্যহীন’ সহ-নাগরিককে। পাড়ায় ‘চোর’ পিটিয়ে মারা আর হোস্টেলে ‘পাগল’ খুন
করা- মনের ভেতর পোষা সেই ‘র্যাগিং’ বস্তুটিই।
এর চরমতম বহিঃপ্রকাশ কার মধ্য দিয়ে কীভাবে প্রকাশ পাচ্ছে তার হদিশ কে দেবে?
‘শিক্ষা’ তো একপ্রকার ‘অশিক্ষা’ও বটে!
মানুষ হিসেবে আমাদের স্তব্ধ করে দেওয়ার মতো নৃশংস, পশুদেরকে নিস্তব্ধ করে দেবার মতো "পাশবিক" এবং যদি লজ্জাবোধ থাকে তাহলে মুখ ঢেকে রাখার মতো এই অসম্ভব ঘটনা নিয়ে এরকম সুস্পষ্ট উচ্চারণকে কুর্ণিশ জানাই। এর সাথে ভাবতে বলবো, এটা একধরনের social psyche-ও বটে। বিশেষ আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এর নতুন করে নির্মিতি ঘটে। যদি পার্থ চ্যাটার্জির বিবেচনাকে - political society - মান্যতা দিই তাহলে আজকের বিশেষ রাজনৈতিক পরিবেশে আমাদের মানুষী অস্তিত্বকে টলিয়ে দেওয়া এরকম ঘটনা আরো দেখতে পারি।কিন্তু কথা তো বলতেই হবে - নিজের বিবেকের সাথে, সামাজিক মানুষের সাথে!
ReplyDeleteGiven the place I'm coming from, the words "educated" and "brilliant student" are increasingly becoming synonymous with "insanely selfish sociopaths". And that's intuitive, because the incentive systems of today's world prefers such people. It's a proven fact that clinical sociopaths make great CEO's. And we as a (global) society, don't seem to be very uncomfortable with that fact.
ReplyDeleteপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার উদ্দেশ্যই হল একদল অন্ধ আনুগত্য সম্পন্ন কর্মচারী তৈরি করা। তাই শিশুকে বোধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বা আগে থেকেই স্কুল নামক রোবট কারখানায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। প্রকৃতির শিক্ষা, শ্রমের শিক্ষা, বাস্তুতন্ত্রের হাতেকলমে শিক্ষার বদলে তারা অর্জন করে ধর্মীয় আনুগত্য, মন্ত্রতন্ত্র, অঙ্ক বিজ্ঞান সাহিত্যের মুখস্থবিদ্যা। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তাই অশিক্ষা নয়, কুশিক্ষাও।
ReplyDelete😡😡😡😡😡
ReplyDeleteআমিও ওই তথাকথিত শিক্ষিতদের থেকে সবসময় দূরে থাকি । ওদেরকে এক প্রকার অবজ্ঞা এবং ঘৃণাই করি । এই কারণে মুটে, মজুর, ফুচকাওয়ালা, মেথর, দর্জি, জুতা সেলাই করা এই সমস্ত মানুষদের সাথে কথা বলি, বন্ধুত্ব পাতাই এবং সেটা ভালও লাগে। ওদের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখি ।
“শিক্ষা তো একপ্রকার অশিক্ষাও বটে”। এর থেকে বড় সত্যি বোধহয় আর হয় না। তথাকথিত প্রথাগত শিক্ষা পেলেই যে আর প্রকৃত “শিক্ষিত” হওয়া যায় না তার তো ভুরি ভুরি উদাহরণ আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে। মাথা হেঁট হয়ে যায় এই কদর্য ব্যবহারের বহিঃপ্রকাশ দেখে। নিজেদেরই অপরাধী মনে হয়। কবে এর হাত থেকে মুক্তি পাবে সমাজ সেদিকে তাকিয়ে বসে আছি সারা জীবন! শুভবুদ্ধির উদয় একদিন হবে নিশ্চয়-এই আশা রাখি!
ReplyDelete