Thursday, 13 November 2014

সালাহউদ্দীন আহমেদ - শ্রদ্ধা






(২৪ সেপ্টেম্বর ১৯২৪ - ১৯ অক্টোবর ২০১৪)

এক বিরল ঐতিহাসিক 
      
 সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ 

গত ১৯ অক্টোবর ২০১৪ আমাদের থেকে বিদায় নিয়েছেন বাংলার প্রবীণতম ইতিহাসবিদ সালাহউদ্দীন আহমেদ। তাঁর জন্ম ১৯২৪ সালে। শৈশব কেটেছে উত্তর বিহারের মতিহারিতে। স্কুলজীবন বাঁকুড়া, বিষ্ণুপুর, ফরিদপুর আর কলকাতায়। কলেজ কলকাতার রিপন ও প্রেসিডেন্সি। কৈশোর ও যৌবনে একদিকে বৃহত্তর বাংলার রূপ, অন্যদিকে মহানগর কলকাতার জীবন তাঁর স্বদেশপ্রেম, মানবতাবোধ ও ধর্মনিরপেক্ষতার চেতনাকে গড়ে তুলেছে।
মার্কসীয় ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে যোগ দিয়েছিলেন শ্রমিক আন্দোলনে। আবার মানবেন্দ্রনাথ রায়ের বিপ্লবী মানবতাবাদও তাঁকে টেনেছে। যৌবনে মহাত্মা গান্ধী আর প্রৌঢ় বয়সে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর হৃদয়ে বিশেষ স্থান করে নিয়েছিলেন।
শিক্ষকতা করেছেন জগন্নাথ কলেজ(১৯৪৮–৫৪), রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়(১৯৫৪–৭২), জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়(১৯৭২–৭৮) ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে(১৯৭৮–৮৪)। উচ্চতর গবেষণা করেছেন পেন্সিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, কিয়তো বিশ্ববিদ্যালয় ও সোয়াস-এ। ২০১১ সালে অভিষিক্ত হন বাংলাদেশের জাতীয় অধ্যাপকের মর্যাদায়।
মঞ্জুরী কমিশনের চেয়ারম্যান আবু মহামেদ হাবীবুল্লাহর আহ্বানে মঞ্জুরী কমিশনের খণ্ডকালীন গবেষণা পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এমফিল পর্যায়ে গবেষণার প্রস্তাব ও নিয়মকানুন তৈরিতে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭৮ সালে যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে। তাঁর আগ্রহে এই বিভাগে পিএইচডি পর্যায়ে গবেষণা বিস্তৃতি লাভ করে। ১৯৮৪ সালে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করেন। শেষ জীবনে(১৯৯৯) জাতীয় অধ্যাপকের মর্যাদা লাভ করেন; মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত সপ্তাহে দুদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার অব একসেলেনসে কাজ করতেন।
পঞ্চাশের দশক থেকেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সেমিনারে বহু প্রবন্ধ পাঠ ও বক্তৃতা দিলেও সালাহউদ্দিন আহমেদের প্রথম বই প্রকাশিত হয় বেশ দেরীতে– Social Ideas & Social Change in Bengal (১৯৬৫)- কলকাতা থেকে। তারপর দীর্ঘ বিরতি দিয়ে বের হতে থাকে তাঁর প্রবন্ধ সংকলনসমূহ – ‘Bangladesh: Tradition & Transformation (১৯৮৭); ‘বাঙালীর সাধনা ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’ (১৯৯২); ‘বাংলাদেশঃ জাতীয়তাবাদ, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র’(১৯৯৩); ‘Bengali Nationalism & Emergence of Bangladesh’ (১৯৯৪); ‘ইতিহাসের সন্ধানে’(১৯৯৫); ‘বাংলাদেশঃ অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ' (২০০০); ‘উনিশ শতকে বাংলার সমাজচিন্তা ও সমাজবিবর্তন'(২০০০); ‘বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সংকট’ (২০০২); 'India, Pakistan, Bangladesh: Perspective on History, Society & Culture' (২০০১, কলকাতা); ‘বরণীয় ব্যক্তিত্ব, স্মরণীয় সুহৃদ’ (২০০৩); ‘বাংলাদেশ কোন পথে’ (২০১২); ‘ইতিহাস, ঐতিহ্য, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র’ (২০১৩), ‘বঙ্গবন্ধু-বাঙ্গালিঃ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও সমকালীন ভাবনা' (যন্ত্রস্থ)।
ইতিহাস অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে সালাহউদ্দীন আহমেদের প্রধান আগ্রহ বাঙালীর সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশধারার সূত্র অন্বেষণ ও মানচিত্র তৈরি। উনিশ শতকে তাঁর আইকন রামমোহন রায়, বিশ শতকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ভারতীয় মুসলমানদের অনগ্রসরতার কারণও তিনি বিশ্লেষণ করেছেন এবং মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রগতিশীল ধারাকে শনাক্ত করেছেন। তাঁর প্রত্যয়ঃ বাঙালী ধর্মীয়-বিবেচনায় বিভক্ত হলেও মূলত সমন্বয়বাদী চেতনার মানুষ। তাঁদের জীবনধারায়, আচরণে লৌকিক বিশ্বাস ও ধ্যান ধারণা প্রবল, ফলে হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান এক মোহনায় মিলতে পেরেছে। নানা বিভেদ ও বৈষম্য সত্ত্বেও বাঙালীর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অখন্ডতায় আস্থাশীল ছিলেন তিনি।
বিশ শতকের ষাটের দশক থেকে পূর্ব বাংলায় জাতীয়তাবাদী উত্থানও তাঁর ইতিহাস-গবেষণায় গুরুত্ব পেয়েছে। এ ক্ষেত্রে তাঁর আইকন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। তাঁর বিবেচনায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রকৃত বিকাশের জন্য অপরিহার্য হচ্ছে গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িকতার চর্চা। রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার ধর্ম এবং রাজনীতি উভয়কেই কলঙ্কিত করছে- এ কথা বারবার বলেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন মানবতার উপরে আর কোনো আদর্শ স্থান পেতে পারে না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর অবদানকে খাটো করে দেখার যে-কোনো প্রয়াসের প্রতিবাদ করেছেন তিনি। সালাহউদ্দীন আহমেদ যে-কোনো সাম্প্রতিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে ইতিহাসের বৃহত্তর পটভূমির ক্যানভাসে স্থাপন করে বিচার-বিশ্লেষণ করতেন। ব্যক্তির অভিজ্ঞতার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে তার থেকে সমসাময়িক ঐতিহাসিক ঘটনাসমূহের বিবরণ তৈরি করা– মৌখিক ইতিহাস চর্চার এ ধারাটিও বাংলাদেশে প্রবর্তন করেছিলেন সালাহউদ্দীন আহমেদ। ১৯৮৫ সাল থেকে ফোর্ড ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে মুস্তাফা নূর-উল ইসলাম, সরদার ফজলুল করিম ও এনামুল হককে সঙ্গে নিয়ে উক্ত প্রকল্প পরিচালনা করেন তিনি। ১৯৯০-এর মধ্যে ১২০ জন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন তাঁরা। এসব সাক্ষাৎকারে বাংলা ও বাঙালীর রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাসের মূল উপকরণ পাওয়া গেছে। পরে সুকুমার বিশ্বাসের সহযোগিতায় মুক্তিযুদ্ধ চেতনা বিকাশ কেন্দ্রের মাধ্যমে আরও কিছু সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন তিনি।
ইতিহাস-পরিষদ, বাংলাদেশ জাতিসংঘ সমিতি, এশিয়াটিক সোসাইটি, জাতীয় জাদুঘর, বাংলা একাডেমি প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। বঙ্গবন্ধু জাদুঘরের স্থাপনা থেকে তাঁর নিজের শেষ দিন পর্যন্ত ওই ট্রাস্টের চেয়ারম্যান ছিলেন সালাহউদ্দীন আহমেদ।

No comments:

Post a Comment