Thursday 12 June 2014

সখী কথা


সংসার দিয়া কী হইব!

সুচিত্রা সরকার


অপেক্ষা করছি কখন কাননবালা, মানে বড় সখীর একটু অবসর মিলবে! যখন মিলল, তখন তিনি বিধ্বস্তপ্রায়! তবু কথা রাখলেন। বললেন তাঁর কৈশোর আর যৌবনের কথা।
‘সত্যিকারের বিয়াই তো আমার। খালি ঢাক বাজাইছে না আর পুরিত আইছে না। বিয়া না কি এইড্যা? সাত পাকও ঘুড়ছি কুঞ্জতে। আবার সিন্দুরও পড়ছি!’
এতোটুকু বলতেই আমার সাংবাদিক সত্তাটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। প্রশ্ন করলাম, ‘বয়স কতো তখন আপনার?
‘কি কইতাম। এক্কেরে ছুট! সবই তো বুঝোছ এহন! বুক উঠছে মালা চন্দনের দুই বছর পর। আর মাসিক হইছে পাঁচ বছর পরে।’
‘এতো ছোট বয়সে...?’
‘ছোটই তো। তয় বাবায় বিয়া দিতে চায় নাই। গুসাইর বাড়িত বাবার লগে আইতাম। গুসাই আমারে দেইখ্যা পছন্দ করছে। আগে তো আরো সুন্দর আছিলাম। বাবারে কইছে মালাচন্দন করনের কথা। বাবায় কইছে, আমি কি কইতাম, ওর মামাগোরে জিগাই।’
জিজ্ঞেস করার কারণও ছিলো। কাননবালার মামাদের কোনো সন্তান ছিলো না। এদিকে কাননবালাও তাঁর বাবার এক সন্তান। আর, তারা সকলেই জানতেন, গুসাই যে বিয়ের কথা বলছেন, তাতে করে আপাত সংসার, যাকে বলে ভর-ভরন্ত সংসার, সেটা তাদের মেয়ের করা হবে না।
কিন্তু গুসাই বাবা, মহা মহা প্রভু সে সময়টুকু কাননবালার বাবাকে দেননি। তারপর মালাবদল আর কপালে সিঁদুর!
মহাপ্রভু গত হয়েছেন অনেক বছর। তবু কাননবালা রঙিন শাড়ী আর দু’ হাতে দু জোড়া শাখা!
প্রশ্নটা আমার ভ্রুতে জায়গা করে নিতেই তিনি বললেন, ‘মহাপ্রভু কইছে, ‘আমার প্রভুর মরণ নাই। আমি দেহত্যাগের পরেও তোমরা শাখা-সিঁদুর পরতে পারবা’’! আগে সিন্দুরও পরতাম! কুনখানে বেড়াইতে গেলে সিন্দুর পইর‌্যা, শাখা পইর‌্যা যাইতাম। তারপর দেখি, আর সিঁদুর পরতে ভাল্ লাগে না। গোসাই থাকতেই সিঁদুর পড়া বন্ধ দিছি। আমার দেখাদেখি অন্যরাও সিন্দুর পরতো না।’
হায় হায়! কেমন সৃষ্টিছাড়া কথার ছিরি! বিয়ে করা বউ, সেও নাকি আবার মাথায় সিঁদুর পরে না। তাও বর বেঁচে থাকতেই? মহাপ্রভু কি তবে উত্তর আধুনিক ছিলেন? আচ্ছা, আচ্ছা দিদিমা, বলেন তো, ওনার বউ, মানে মা গোসাই উনিও কি আপনাদের মতোই সিঁদুর পরতো না? স্বামীর কল্যানের কথা ভাবতো না?
‘ মা পড়ত। আমরা পড়ি নাই। কেউ কিছু কয় নাই। কিন্তু ক্যান জানি  আর মন চাইত না সিন্দুর পড়তে!
স্বামী-স্ত্রীতে আর বাকি যেসব হয়, সেসব?
‘নাহ্, সেসব কিছু হয় নাই। প্রভুর ওইসব ভাব আসে নাই। আমরা শুধু আলিঙ্গন করছি!’
হুম! শুধুই আলিঙ্গন! মহাপ্রভুর শরীর আর আশ্রমের এক পাহাড় সমান কাজকে! অসম্মান আর অপমানকে।
পদ্ম’র মা ওদের সঙ্গেই রান্নার কাজ করতো। তিনি পাশে শুয়ে ছিলেন। ফোঁড়ন কাটলেন, ‘এক ঘরে থাকছে গোসাইর লগে, কি করছে, না করছে আমরা কি দেখছি নি?’ বলেই হিহি হাসি!
এরকম কত কত হাসি আর টিটকিরি প্রাপ্তি ঘটেছে ওদের জীবনে, কে জানে!

পঞ্চসখীর সর্বকনিষ্ঠ সখী মঞ্জু। বাকিদের পেলেও হয়তো বলতাম। কিন্তু বিধি বাম। একজনের ভবতরী সাঙ্গ হয়েছে। আর বাকি দুজন ভেগেছে! হুম! স্রেফ ভেগেছে! দুজনেই নিজের পছন্দ করে পরে বিয়ে করেছে। আশ্রমে কি তাদের জায়গা মেলে?
মঞ্জু দিদি একটু ঠোঁটকাটা। বলেই ফেললেন, ‘আমার তো সস্তার বিয়া হইছে। কিছু দেওন- থুওন লাগছে না! এমন বিয়া আছে নি আর জগতে?
মঞ্জু দিদির বিয়ে হয়েছে ১৯৭১ সালে। মুক্তিযুদ্ধ চলছে। এদিকে সবাই বর্ডার পাড় হচ্ছে। বারো বছরের কিশোরীকে নিয়ে তার বাবা পড়লেন বিপদে। এক্ষেত্রেও উদ্ধারে এগিয়ে এলেন জগতের ত্রাতা মহাপ্রভু! চিন্তা কি, আমার সঙ্গে মালা চন্দন করা তোর মাইয়ারে!
তাই সই! আসলেই সস্তার! সেসময় হিন্দুরা ভিটে-ঘটি-মাটি সব সস্তায় বিকিয়ে দিয়েছে! এমনকি মঞ্জু দিকেও।
মঞ্জু দিকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনার মা গোসাইর তো ছেলে- পুলে হলো! আর আপনার যে কিছুই হলো না?
‘প্রভুর না হইলে জগত চলবো ক্যামনে? আর আমার?’ মঞ্জু দি প্রশ্নের মতো করে উত্তর দেয়! ‘ আমার সংসার নাই ভালই হইছে। সংসার দিয়া কি হইব। প্রভু কতো বড় সংসার দিয়া গেছে। এইখানে কতো দায়-দায়িত্ব!’
দায়িত্ব, না ছাতা! তাদের মহাপ্রভু যে বিনে পয়সায় পাঁচজন দাসী কিনেছে, এটা এখনো ঠাওরাতে পারেনি মঞ্জু দিরা! অথবা পারলেও প্রতিবাদের সাহস নেই। যদি ক্ষতি হয়! অথবা নরকবাস! বাপরে! এর চেয়ে এই নরকও অনেক ভালো!
নরক নয়? মালা চন্দনের পরপরই তাঁরা ঘরের কাজ সামলেছে ! একদিনে তিন-চার মন চালের ভাত রাধা! লোক খাওয়ানো। আশ্রমে ভক্তরা এলে, তাদের দেখাশোনা। পুকুরে মাছ পাহারা! আবার জমিতে চাষ-বাস!
কিন্তু খাওয়ার বেলা?  সেখানে বুড়ো আঙ্গুল! সবাইকে খাইয়ে খেতে বসলে, দেখা যেতো তাদের জন্য কিচ্ছুটি বাকি নেই। তবুতো পেটে দানা দিতে হবে। নইলে যে শরীর চলবে না। ওদের খাওয়ার আগ মুহূর্তে কোনো অতিথি এসে পড়লে, ভাগের ভাতটা অতিথির পাতেই উঠতো!

মহাপ্রভু। তারপর তাঁর ছেলে। তারপর তার ছেলে। তিন পুরুষের কাজ করছে সখীরা। আরেক প্রজন্মও বড় হতে চলেছে। যারা সখী-ফখীর চাল বোঝে না। যারা মঞ্জু আর কাননবালাকে শুধু কাজের লোক মনে করে!
রাতে খেতে বসে দেখলাম, মাছ ভাজা হয়েছে। কিন্তু আমার পাতে পড়লো না! কি কারণ?
ওগুলো গোসাইর পরিবারের। বাইরের কেউ খেতে পাবে না। সে যত বড় ভক্তই হোক!
আপনারা খান এগুলো?
মঞ্জু দি হাসলো, ‘না আমরা, ভক্তবৃন্দ যা খায়, তাই খাই। গুসাইগো সেবার পদ আলাদা!
কি বলি আমি?
সকাল হতেই আমার শহর, আমাকে তাড়া দিতে শুরু করলো। ব্যাগ গুসিয়ে নিলাম! মঞ্জু’দি দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল, লুকিয়ে! ফিসফিস করে বলল, একটা শাড়ি দিবি আমারে?
হুম! কেন নয়?
‘তাইলে চকলেট রঙের একটা ছোট ফুলওলা শাড়ি দিস!
মঞ্জুদির চোখের দিকে তাকালাম! এক ফোঁটা আবেগ নেই। জল নেই ওতে! সব জল আমার চোখে!

No comments:

Post a Comment