কই কোথাও যাচ্ছি না তো!
শীর্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়
মোবাইল ফোনটা বাজছে।
বৃষ্টি পড়ছে ঝমঝমিয়ে, তাই প্রথমে শোনা যায়নি।
হ্যালো?
চেনা গলা। “কী করছ?”
“কিছুই না, এই এমনি...”।
শেষ হয় না কথাটা। বরং অবিরল বর্ষার ধারার মতোই কথার শেষ শব্দগুলো ধুয়ে যায়। জীবনের ঝাঁঝরি গলে ঝরে পড়ে
নীচে। ভাবতে ভাল লাগে যে ছোট ছোট কথার স্রোত এরপর নালা বেয়ে গিয়ে পড়ে নদীতে, নদী থেকে সাগরে...।
আসলে কিন্তু কথারা কোথাও যায় না। পাঁকে, আবর্জনায় দম বন্ধ হয়ে থাকা নর্দমার মধ্যে,
থকথকে ঘোলা কালো দুর্গন্ধ জলে মুখ ডুবিয়ে পড়ে থাকে। তা ছাড়া যে কথা কোনও সমাপ্তির
দিকে যায় না, তার আবার দাম কী! মনে রাখতে হবে, শেষ করা দরকার। খুব যদি নির্বোধ,
অসার কথা হয়, তা হলেও। কথা শেষ করতে হবে এবং এমনভাবে শেষ করতে হবে, যাতে মনে হয় যে
ওটাই শেষ কথা ছিল। এর পর আর একটা শব্দ খরচ করাও জরুরি নয়। ‘কখুকগ’-র বচ্চন সাহেবের
মতো, “ক্যাহ দিয়া না! বস, ক্যাহ দিয়া!”
কিন্তু ফোনের ও প্রান্ত বোধহয় শেষ না
হওয়া নিয়ে অত কিছু ভাবে না। পরের প্রশ্ন, “বাড়িতেই আছ তো?”
উত্তরে একটা নির্জীব
‘হুঁ’ ছাড়া বিশেষ কিছু বলার নেই। বাড়ি ছাড়া আর কোথায়। আর যাওয়ার নেই তো কোথাও! অথচ
একটা সময় ছিল, যখন সকালে বৃষ্টি নামলে মনে হতো, উফ, আজকের দিনটাও কেন রেহাই পাওয়া
যায় না! এমন একটা চমৎকার দিনে কেন বাড়িতে থাকা যায় না। অথচ সেই সময়টা সত্যিই যখন
একদিন না বলে কয়ে চলে এল, তখন আর কেন ভালো লাগে না! অথচ বৃষ্টি তো ঠিক সেই আগের মতোই। বারান্দার রেলিংয়ে বসে
ডানা ঝাড়তে ব্যস্ত ভেজা কাক, টবের ফুল গাছেদের বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে নেচে ওঠার
ছটফটানি, পাশের বাড়ির ছাদে মেলে রাখা শাড়ির ভিজতে ভিজতেই হঠাৎ দমকা হাওয়ায় ফুঁসে
উঠে উড়ে যাওয়ার ইচ্ছে – সব আগের মতো। আসলে তাদেরও কোথাও যাওয়ার নেই। গেরস্থের
উচ্ছিষ্টে অভ্যস্ত কাক, বাহারি টবের শেকড় বেঁধে রাখা ফুল গাছ, বা ছাদের তারে
আটকে পড়া শাড়ি - ওরাও কেউ কোথাও যাবে না।
সবই ওই শেষ না হওয়া কথার
মতোই। অথচ শেষ হওয়াটা খুব জরুরি। নাকি শেষ পর্যন্ত কোথাও না
পৌঁছতে পারাই একমাত্র সত্যি, বাকি সব বিভ্রম! সেই কারণেই, “কী, কোথায় যাচ্ছেন?”
প্রশ্নটা শুনলে বোধহয় এত অস্বস্তি হয়। কই, কোথাও যাচ্ছি না তো! বাজার যাচ্ছি, অথবা
মুদির দোকান, কিন্তু ফিরে আসব। ব্যাঙ্কের কাজ, এক্ষুনি ফিরে আসব। বেড়াতে যাচ্ছি,
ফিরতে তো হবেই। সান্ধ্যবাসরে ডেকেছে বন্ধু, কিন্তু সময়ের মধ্যে ফিরতেই হবে। আসলে
সবাই ফেরে। কিন্তু যার কোথাও যাওয়ার নেই, সে পড়ে লজ্জায়। কোথায় যাচ্ছেন শুনলে সিঁটিয়ে
গিয়ে বিব্রত হেসে বলে, “এই একটু...।” কথা শেষ হয় না। কারণ ঠিকমতো শেষটা তো আর হয় না। অথচ
ওটাই জরুরি। শেষটা।
No comments:
Post a Comment