একটি ছবি ও আমাদের যাপন
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য
একটি ছবির কথা আজকাল প্রায়
সকলেই বিস্মৃত হয়েছেন- এমন একটি পূর্ণ দৈর্ঘ্যের বাংলা ছবি যার চিত্রনাট্য
সত্যজিৎ রায়’এর। ছবিটি, একভাবে দেখলে, এক আর্টিস্ট’এর গল্প- ‘জাগলারি আর্টিস্ট’। হারুন-আল-রশিদ।
অসাধারণ চরিত্রাভিনয়ে কামু মুখোপাধ্যায়। সম্ভবত, এতটা সময় ধরে একটি প্রধান চরিত্রে
কোনও ছবিতে এটিই তাঁর একমাত্র অভিনয়। ছবিটি দীর্ঘদিন কোথাও প্রদর্শিত হয় না। কোনও
আলোচনায় কোথাও উল্লেখ পাই না। ছবিটির পরতে পরতে নানাবিধ শ্রমের প্রতি এক নিবিড় মর্মস্পর্শী
উচ্চারণ। চায়ের কাপ ধোওয়া, টেবিল মোছা, চা-অম্লেট পরিবেশন, খদ্দেরদের নির্নিমেষ
আবদার পালন- এসবও যে শেখার ব্যাপার, তার আন্তরিক অনুরণন। আর জাগলারি? হাতের খেলা?
ব্যালান্সের চমক? এসবের পেছনে যে পরিশ্রম, ধৈর্য ও অনুশীলন আর তাকে কেন্দ্র করে এক
চলমান জীবিকা- তার কথাই তো এ ছবির মূল রসদ।
গত শতকের আশির দশকের গোড়ার
দিকে ছবিটি নির্মিত। ওপর ওপর দেখলে নিতান্তই একটি সাদামাটা কিশোর কাহিনি। কিন্তু
এই কিশোর মনই তো আমাদের তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় নিষ্করুণ এই চারপাশ থেকে প্রাণের
অভিমুখে। তাই ছবিটিকে মাঝে মাঝে মনে পড়ে। মনে পড়ে চারপাশের ক্রমশ উল্লাসে বধির হয়ে
আসা মননের অশ্রাব্য যন্ত্রণায়। উল্লাস তো আর শুধু চকিতে ছুটে যাওয়া বাইকের উদগ্র কর্কশ
শব্দ বা টিভি সিরিয়ালের উৎকট প্রলম্বিত দৃষ্টি–লালসা নয়, তা আজ প্রায় প্রতি সম্পর্কের
আনাচে-কানাচে। অর্থ, ক্ষমতা, দক্ষতার দাপটে উল্লাস প্রতিনিয়ত বিদীর্ণ করছে আমাদের সকলের
অস্তিত্ব-চরাচর। যেন, যদি থাকে এই ত্রিশক্তি তবে গ্রাহ্য নয় আর কিছু। যারা কিয়দংশ অর্জন
করতে পেরেছে এই শক্তির রেশ, তাদের দম্ভ, তেজে ভারি হয়ে থাকে আকাশ-বাতাস। সপাটে তারা
মিসাইলের বেগে এসে পড়ে আকুলি-বিকুলি করা অশক্ত মানুষদের মাঝখানে, তাদের রাগ, ঘৃণা,
ক্ষমতা প্রকাশের আতিশয্য নিয়ে। কর্পোরেট মিডিয়ায় এক মাস লেখা বেরয়নি, টিভি
চ্যানেলে সাতদিন দেখা যায়নি, খবরের কাগজে পনের দিন খবর নেই, সারা বছর কোনও ছবিতে
অভিনয়ের ডাক পাননি, রাজনৈতিক দলে সামনের সারিতে দেখা যাচ্ছে না, কয়েক মাস ধরে
ব্যবসায় লোকসান- অতএব, আপনি আপাতত নেই। আপনার স্রেফ কোনও অস্তিত্বই নেই। আপনাকে
কেউ মনে রাখছে না, আপনি মৃত। এই আশঙ্কায় এই শক্তিধরেরা আরও ভয়ানক।
অথচ, সাঁই সাঁই তাঁত বুনে
চলেছে কাপড়। কাপড়ের ওপর বাটিকের প্রিন্ট। মাথা নিচু করে টিমটিমে আলোয় জরি বসছে
কাপড়ের পাড়ে। ছোট ছোট কাঠের নানান অবয়বে হস্তনৈপুণ্যে তুলির আঁচড়। কোমর নুইয়ে
কাদামাটিতে ধানের চারা রোপণ। রাত জেগে লিখে চলা, পিঠের ব্যথা চাগিয়ে লিটল
ম্যাগাজিন সম্পাদনা। কবিতার কো্নও একটি লাইনে সারাদিন ধরে শব্দসন্ধান। সেনা
প্রত্যাহারের দাবিতে বছরের পর বছর অনশনে থাকা, নাকে পাইপ ঢুকিয়ে খাবার চালান। এইসব
নিবিড়, নীরব কাজের আজ হারিয়ে যাওয়ার দিন। উচ্চাশার ধুরন্ধর অলিগলিতে অনুচ্চারিত
সময়।
এই অনুচ্চারণগুলোকেই হারুন-আল-রশিদ
বাঁচিয়ে রাখেন। ফটিকচাঁদের চোখ দিয়ে আমরা নতুন করে দেখি এক অচিন ভুবন।
bhison bhalo laglo..rojkar er kothin jibon japoner opor alto chotobelar porosh..darun
ReplyDeleteporchhi ur mugdho hochchhi...ki nitol badhuni bakyer...proti ta shobdo jano joler opor alpona kete jachchhe...
ReplyDeleteReally appreciatable...
ReplyDelete