Monday, 13 January 2014

যা ভাবছি!


সাদা কালোর নির্মম ছক !
অধীশা সরকার


যে ঘরে আলো ঢোকে না সেখানে আমার এবং আমার অন্ধকারের বসবাস। আর আছে একটা পোষা ময়াল সাপ। হিলহিল করে বয়ে যায় পিচ্ছিল শরীরটা অগোছালো যত বই-খাতাপত্র-সিগারেট-দেশলাই-লাইটার-কাফকা-আখতারুজ্জামান-কাঁচি-ছুরি-সুইসাইডনোটের জঙ্গল পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে... কোনো আদিম অভ্যেসে। পাশের বাড়ির অসভ্য রেডিও থেকে "মেরে মেহবুব কায়ামৎ হোগি"-র সঙ্গে তাল মিলিয়ে এই অন্ধকার বাড়ির গর্ভ থেকে ভেসে আসা "রেন্ডির বাচ্চা... রেন্ডির বাচ্চা... রেন্ডির বাচ্চা...". রাত বাড়ছে। বাইকগুলোর গতি বাড়ছে। বাড়ির পাশের রাস্তা কেঁপে কেঁপে উঠছে চাকার ধমকে। খাটে শুয়ে পড়াটা ঘুমনোর জন্য নয়। খাটটাকে একটা নৌকো ভেবে নিয়ে চড়ে বসা। ভেবে নেওয়া, এই তো পালাচ্ছি। উত্তাল সমুদ্রে ভেসে যাচ্ছি, ঢেউয়ের ধাক্কায় উলটে যেতে যেতেও সামলে নিচ্ছি... এই তো বেশ পালিয়ে যাচ্ছি...
মনে কর যেন বিদেশ ঘুরে... মা'কে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে...
পাশের ঘরে আধখাওয়া চায়ের কাপ, ছড়িয়ে থাকা মুড়ি, চপের টুকরো, গোল করে রাখা চেয়ার-কুশন-মাদুর মোটেও আমার নয়। ওটা বেশ একটা স্টেজ। সাজানো আছে বিভিন্ন প্রপস। আমার অভিনয় শেষ। আমি বেরিয়ে গেছি। প্রপস গোছানো আমার কাজ না। আমি মেকাপ তুলছি। আমার জন্য নৌকোটা অপেক্ষা করছে।
কে যেন বলেছিল, "hell is other people"...? মনে পড়ছে না।

গ্রাউন্ড ফ্লোরের মেঝেটা স্টোনচিপস বসানো। ওপরের ঘরগুলো মার্বেলের। গ্রাউন্ড ফ্লোরটা সবচেয়ে আদিম এ বাড়ির, তবে সে তো অবভিয়াস, তাই না? ঠাকুর্দা ঠাকুমাকে নিয়ে সংসার শুরু করেছিল এই ঘরগুলোয়। ভয়ঙ্কর এক সংসার। যাক সে কথা। মেঝেটা স্টোনচিপসের। বাবা পরে রেনোভেট করার সময়ে নিচের তলাটা ভাড়া দেওয়ার জন্য বানিয়েছিল। আমি ভাড়া দিই না। কিন্তু থাকি।

মাঝে মাঝে আচমকা ঘরে ঢুকে আলো জ্বালিয়ে দেখি, মেঝেটা আর স্টোনচিপসের নেই। বড়বড় সাদাকালো চৌকো ছককাটা মেঝে, যেমন প্রাচীন বাড়িতে দেখা যায় পুরনো বা প্যারালাল সিনেমায়। অথবা, একটা দাবার বোর্ড। খেলা শুরু হয়েছে হয়তো। অথবা আটকে ছিল, ঘুঁটির অপেক্ষায়।

খেলোয়াড়দের মুখ দেখা যায় না। মৃদু বাতচিৎ শোনা যায়... আর পাওয়া যায় তামাকের গন্ধ। বেশিরভাগ সময়ই চুপচাপ... চিন্তার কি কোনো শব্দ হয়? কান পেতে শোনার চেষ্টা, এবং অপেক্ষা। এ ছাড়া আর কোনো কাজ নেই। যে মূহুর্তে ওই সাদাকালো ছকের ওপর পা পড়ল, তুমি বেমালুম ঘুঁটি বনে গেলে। হয় সাদা নয় কালো। এটুকুই চয়েস। বেছে নাও, চটপট, বেশী সময় নেই... তারপর চুপচাপ, নিষ্পাপ, সরল-সাদাসিধে এক ঘুঁটি হয়ে স্থির দাঁড়িয়ে থাকো। নড়বে না। খিলাড়ি বেছে নেবে তোমায় সময়মত। খেলার ঘাত ও প্রতিঘাত অনুযায়ী জায়গা বদল হতে থাকবে তোমার। তুমি তোমার নিজের ঘরে অপেক্ষা কর - ঝিম ধরা এক অপেক্ষা। যদিও, আসলে তোমার কোনো ঘর নেই। খেলা ঠিক করে দেবে কখন কোন ঘরে তুমি। তোমার মাধ্যমে হারজিৎ, কিস্তিমাৎ। সামান্য বোড়ে বা অসামান্য রানী - আসলে একটা ঘুঁটি - জড়পদার্থ। তুমি। না, মানে... আমি।

আমি বা তুমি। এই রাতবিরেতের কথোপকথন সেইসব অতীব ভাগ্যবান বন্ধুহীন প্রাণীদের জন্য যারা নিজেকে ভালবাসার শর্তে ধুম থ্রি বা চকোলেট মুস নিয়ে ঢ্যামনামো করছে না। "Love yourself" জাতীয় ঝিলমিলে বিজ্ঞাপন চোখে পড়লেই কেমন চনমন করে ওঠো না? মূর্খ যে তুমি, তা ওরা জানে, নাহলে আর দিনকে দিন লাভের খাতা মোটা হচ্ছে কী করে? অন্য কেউ ভালবাসতে না পারলে সান্ত্বনা পুরস্কার হিসেবে নিজেকে ভালবাসার বাতেলা। পকেটে রেস্ত না থাকলে ওই self-loveও চটকে যাবে, চৌকাঠের এক ইঞ্চি ভেতরে দাবার ছক, এক ইঞ্চি বাইরে শ্বাপদসঙ্কুল নাগরিক জঙ্গল। এইবার বল দেখি চাঁদ... কত ধানে কত চাল?

চালের হিসেব ঘুঁটির নয়, খিলাড়ির। ঘুঁটি তো জড়বস্তু। তার কোনো হিসেব নেই। বেহিসেব আছে? ভেবে দেখতে হবে। বেশী ভাবলে কপালের মাঝখানে চিনচিনে ব্যথা ইদানিং ছড়িয়ে পড়ছে কপালময়। কপালকুন্ডলা। শব্দটা শুনলেই ছোটবেলা থেকে চোখে ভেসে ওঠে কপাল ফুঁড়ে বেরিয়ে আসছে কুন্ডলি পাকানো সাপ - হাস্যকর !

ঘুঁটি কি ভাবে? ঘুঁটিও কি ভাবে? সাদা আর কালোর গোলোকধাঁধায় অকিঞ্চিৎকর মিশে থাকার প্রতিটা মিনিট খুব মন দিয়ে দেখে ও শোনে। দেখে নিজের ও অন্যের স্থানবদল। অবস্থানবদল। দেখে মারপ্যাঁচ, দেখে আঙ্গুলের নড়াচড়া, দ্বিধা, দ্বন্দ্ব, ভুল চাল, ভুল পথ। দেখে ফাঁদে পড়ে যাওয়া অভিমন্যুর লড়াই। দেখে চক্রব্যুহ। আচ্ছা... যদি জানত কিভাবে করতে হয়... পান্ডবরাও কি চক্রব্যুহ বানাত না? হয়তো ব্লুপ্রিন্টটা তৈরী করত অভিমন্যু নিজেই? একটা দাবার ছক আর একটা মারকাটারি গেম। হেরে গেলেই শহিদ, জিতে গেলেই ভিলেন? হাহাহা... হারজিৎ মানে প্রতারণা, মানে এভরিথিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ অ্যান্ড ওয়ার। ইন লাভ অ্যান্ড লোকশান। দ্য গেম ইজ অন।

খিলাড়ি খেলে নেশায়। ঘুঁটি, অভ্যেসে। বা স্বভাবে। স্বভাব তাকে ক্ষইয়ে দেয় রোজ একটু করে। স্বভাব তাকে ধ্বংশ করে, রোজ একটু করে। ঘুঁটিরা ক্লান্ত হয়। ঘুঁটিরা খেলা ছেড়ে পালাতে চায়। সাদা আর কালোর এই নির্মম ছক। মা... আমার ছুটি কবে হবে?

খেলা চলছে। আমি ছকের ওপর সাজানো ঘুঁটি হয়ে খেলা দেখছি। ইচ্ছে করলে কি খেলোয়াড় হতে পারতাম না? ইচ্ছেটাই করে না। আসলে হেরে বা জিতে যাওয়া একই ব্যাপার। দেখে যাওয়া - এই উত্তেজনাহীন দেখে যাওয়া - এরও আলাদা কোনো মানে নেই। শুধু সময় কাটানো। দাবার খেলোয়াড় বা ঘুঁটি, উভয়ই তো সময় কাটাচ্ছে। টাইমপাস। আর বিশেষ কিছু না।

No comments:

Post a Comment