নবরাত্রির রাত এবং ভবিষ্যতের সমাজমন
অয়ন মুখোপাধ্যায়
নবরাত্রির রাত মানেই আলো, ভক্তি, নাচ, ডান্ডিয়ার ছন্দ আর উৎসবের উত্তেজনায় ভেসে ওঠা মানুষের ভিড়। দেবীর শক্তির আরাধনা যেমন থাকে, তেমনই থাকে অদৃশ্য আবেগের তরঙ্গ। এ বছর সেই তরঙ্গে এক অদ্ভুত তথ্য উঠে এসেছে— নবরাত্রি চলাকালীন একটি নির্দিষ্ট কোম্পানির কনডোম বিক্রি বেড়েছে আঠারো গুন। প্রথম শোনায় এটি নিছক বাজারি পরিসংখ্যান মনে হতে পারে, কিন্তু এর ভেতরে লুকিয়ে আছে এক দীর্ঘ ইতিহাস ও বিবর্তনের ছাপ, যেখানে যৌনতা সমাজ মানসে বহুবার নতুন রূপ নিয়েছে। উসকে দিয়েছে অনেক প্রশ্ন।
ভারতীয় সভ্যতায় যৌনতাকে সব সময় অস্বীকার করা হয়নি। বহু বিশেষজ্ঞের মতে, প্রাচীন গ্রন্থ 'কামসূত্র' শুধু দেহের ভঙ্গি নয়, বরং সম্পর্ক, আবেগ এবং সামাজিক কাঠামোর পাঠ্য। কামকে তখন ধর্ম ও অর্থের মতোই জীবনের অপরিহার্য স্তম্ভ ধরা হত। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, প্রাচীন ভারতের তন্ত্র সাহিত্যও দেহ ও কামনার মাধ্যমে আধ্যাত্মিক মুক্তির কথা বলেছে। এর মানে, যৌনতা কোনও নিষিদ্ধ বিষয় নয়, বরং জীবনের এক স্বাভাবিক পরিসর। এমনকি মন্দিরের গায়ে যৌনতার পাঠ ভারতীয় ইতিহাসের এক অনন্য দলিল। অনেক গবেষকের মতে, সমাজের মানসেও তখন লজ্জা বা অপরাধবোধ এতটা প্রভাবশালী ছিল না।
কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে থাকে। মধ্যযুগে ধর্মীয় শৃঙ্খলা কঠোর হয়। হিন্দু সমাজে শাস্ত্রের নিয়ম, মুসলিম শাসনে শরিয়তি বিধান— দুটোই মিলিয়ে যৌনতাকে আড়ালে ঠেলে দেয়। বহু বিশেষজ্ঞ বলেন, এই সময়ে যৌনতা ধীরে ধীরে 'পাপবোধ' ও 'লজ্জা'র সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। মনোবিশ্লেষণের ভাষায়, যৌনতার দমন তখন সামাজিক কাঠামোর অংশ হয়ে দাঁড়ায়। ফ্রয়েড যেমন বলেছিলেন, দমন মানুষের অবচেতনে চাপে, আর সেখান থেকে নানা দ্বন্দ্ব, ভয় ও বিকৃতি জন্ম নেয়। (Three Essays on the Theory of Sexuality, 1905)। ভারতীয় সমাজে এই সময় সেই মানসিক দ্বন্দ্ব স্পষ্ট।
ঔপনিবেশিক যুগে এসে এই দমন পেল আইনি কাঠামো। ১৮৬১ সালে প্রণীত ভারতীয় দণ্ডবিধির ber notorious সেকশন ৩৭৭ সমলিঙ্গ সম্পর্ক ও 'অপ্রাকৃতিক' যৌনতাকে 'অপরাধ' ঘোষণা করল। বহু গবেষক বলেন, ভিক্টোরিয়ান নৈতিকতা ও ঔপনিবেশিক সংস্কার ভারতীয় সমাজে যৌনতার ওপরে এক নতুন ধরনের নিয়ন্ত্রণ চাপিয়ে দিল। এই আইন শুধু যৌন আচরণ নয়, যৌন পরিচয়কেও অদৃশ্য করে দিল। ভারতীয় সাহিত্যে সমলিঙ্গ প্রেম বা যৌন বৈচিত্র্যের উপস্থিতি বহু পুরনো— লোকগাথা, কবিতা, এমনকি পুরাণেও এর ছায়া পাওয়া যায়। কিন্তু ব্রিটিশ শাসনের আইন তাদের অপরাধে পরিণত করল। অর্থাৎ, যৌন বৈচিত্র্য যে ছিল, তার সামাজিক স্বীকৃতি ঔপনিবেশিক যুগে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
'The History of Sexuality' (1976) গ্রন্থে ফুকো বলেছিলেন, যৌনতার ইতিহাস আসলে ক্ষমতার ইতিহাস। দমন মানে নিছক নীরবতা নয়, বরং রাষ্ট্র ও সমাজ দেহ ও কামনার ওপরে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতীয় প্রেক্ষাপটে ব্রিটিশ শাসনের আইন সেই নিয়ন্ত্রণের অন্যতম প্রতীক। তবে একই সঙ্গে গবেষকেরা সতর্ক করেন, ফুকোর তত্ত্ব সরাসরি সব সমাজে প্রযোজ্য নয়, ভারতীয় সংস্কৃতির বৈচিত্র্য ও জটিলতা আলাদা করে বোঝা জরুরি।
স্বাধীনতার পরে যৌনতার ইতিহাসে নতুন অধ্যায় শুরু হয়। প্রথম কয়েক দশক যৌনতা ছিল সামাজিক আড়ালের মধ্যে। পরিবার ও সমাজ যৌনতাকে আলোচনা-বহির্ভূত রেখেছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে শহুরে মধ্যবিত্ত সমাজে পরিবর্তন দেখা দেয়। জনস্বাস্থ্য আন্দোলন, গর্ভনিরোধ ক্যাম্পেন কনডোমকে স্বাভাবিক করে তোলে। স্বাধীনতার সত্তর বছর পর এসে ২০১৮ সালে সুপ্রিম কোর্ট সেকশন ৩৭৭ বাতিল করে ঘোষণা করে, প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে সম্মত যৌন সম্পর্ক ব্যক্তির মৌলিক অধিকার। এটি নিছক একটি আইনগত রায় নয়, বরং এক সামাজিক মনস্তাত্ত্বিক মুক্তি। বিশেষজ্ঞরা বলেন, এতকাল যে কামনাকে অপরাধ বলা হচ্ছিল, হঠাৎ তা স্বীকৃতি পেয়ে সমাজের মানসে বড় পরিবর্তন আনে। তবে অন্যদিকে অনেকে মনে করিয়ে দেন, আইন পাল্টালেও সমাজের মনোভাব একদিনে বদলায় না; গ্রামাঞ্চল ও রক্ষণশীল পরিবেশে যৌনতা এখনও লজ্জা ও অপরাধবোধে ঢাকা।
আজকের তথ্য প্রযুক্তির যুগ যৌনতার মানচিত্রকে আমূল পাল্টে দিয়েছে। সম্পর্ক আর কেবল সামাজিক সূত্রে বা পরিবারের উদ্যোগে গড়ে ওঠে না। টিন্ডার, বাম্বল, হিঞ্জ কিংবা গ্রাইন্ডারের মতো অ্যাপ মুহূর্তে নতুন পরিচয় এনে দেয়। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, এই প্রযুক্তি সম্পর্ককে করেছে দ্রুত, অভিজ্ঞতা-নির্ভর, মুহূর্তমুখি। প্রেম এখন অনেক বেশি অনুসন্ধান ও অভিজ্ঞতার খোঁজে, প্রতিশ্রুতির চেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে অভিজ্ঞতার বৈচিত্র্য। ই-কমার্স কনডোম কেনাকে করেছে সহজ ও লজ্জাহীন। আগে দোকানে গিয়ে কিনতে সংকোচ থাকত, এখন অনলাইন-ক্লিকে প্যাকেট পৌঁছে যায় বাড়িতে। সোশ্যাল মিডিয়া যৌন স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা নিয়ে সচেতনতা ছড়িয়েছে। তবে গবেষকদের মতে, এই পরিবর্তন সর্বজনীন নয়, ডিজিটাল বিভাজনের কারণে অনেক মানুষ এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত, বিশেষত গ্রামীণ বা দরিদ্র সমাজে।
নবরাত্রির রাতের কনডোম বিক্রির রেকর্ড আসলে এই পরিবর্তনের প্রতীক। উৎসব সব সময় মানুষের আবেগকে উচ্ছ্বাসে ভাসায়। সমাজবিজ্ঞানী এমিল দুর্খেইম এই অভিজ্ঞতাকে বলেছিলেন, collective effervescence— সমষ্টিগত আবেগের বিস্ফোরণ। নাচ, গান, ভিড়, রাতভর উচ্ছ্বাস মানুষের ভেতরে অবদমিত কামনাকে মুক্তি দেয়। আগে এই কামনা লুকিয়ে থাকত, ঔপনিবেশিক আমলে তা অপরাধ হত, স্বাধীনতার পরে ধীরে ধীরে স্বীকৃতি পেল, আর আজকের দিনে তা সুরক্ষা ও দায়িত্বের সঙ্গে প্রকাশিত হচ্ছে।
তবে প্রশ্ন রয়ে যায়, এই পরিবর্তন কি সত্যিই সর্বজনীন? শহরে কনডোম বিক্রি রেকর্ড গড়ছে, কিন্তু গ্রামে এখনও যৌন শিক্ষা নিয়ে অন্ধকার। সেখানে যৌনতা মানে ভয়, গুজব ও লজ্জা। বিশেষজ্ঞরা বলেন, যৌন সচেতনতার বৈষম্য সমাজকে বিভক্ত করে রেখেছে। আবার বাজার যৌনতাকে ভোগ্যপণ্য বানিয়েছে। বিজ্ঞাপন কনডোমকে করেছে আকর্ষণীয় ও 'কুল'— এটি একদিকে লজ্জা ভেঙেছে, কিন্তু অন্যদিকে যৌনতাকে কখনও কখনও শুধু ভোগবাদের সমার্থক করে তুলেছে।
তাহলে আগামীতে কী? অনেক সমাজতাত্ত্বিকের মতে, ভবিষ্যতের সম্পর্ক হবে আরও তরল, অস্থায়ী, অভিজ্ঞতামুখি, যাকে বলা হচ্ছে Liquid Modernity (Zygmunt Bauman, Liquid Love, 2003)। ডেটিং অ্যাপ ও প্রযুক্তি সম্পর্ককে আরও ব্যক্তি-স্বাধীন করবে, কিন্তু একই সঙ্গে নতুন বৈষম্যও তৈরি করবে। যৌন শিক্ষা ও সচেতনতা যদি সর্বস্তরে ছড়ানো না যায়, তাহলে সমাজে দ্বন্দ্ব আরও প্রকট হবে। আবার আশাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি হল, যুব সমাজ ইতিমধ্যেই যৌনতাকে লজ্জার বিষয় নয়, দায়িত্বশীল আনন্দ হিসেবে দেখছে।
নবরাত্রির আলোয় দাঁড়িয়ে এই পরিবর্তনের প্রতীকী ছবি আমাদের চোখে ভেসে ওঠে। গরবার মঞ্চ থেকে আলো ছড়িয়ে পড়ছে দূর রাতের অন্ধকারে। ঢাকের তালে নাচ থেমে গেলে ভিড়ের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে এক তরুণ-তরুণী, তাদের হাতে মোবাইলের ক্ষুদ্র আলো, ব্যাগের ভেতরে রাখা একটি ছোট্ট প্যাকেট, যা তাদের আগামীকে সুরক্ষিত রাখবে। আকাশে পূর্ণচন্দ্র উঠছে, হাওয়ায় মিশে যাচ্ছে পারফিউম আর ভিড়ের ঘামের গন্ধ, যেন দেবীর প্রতিমার ঠোঁটে ক্ষণিকের এক রহস্যময় হাসি খেলে যায়। সেখানে ভক্তি আর কামনা, আনন্দ আর দায়িত্ব, অতীতের দীর্ঘ দমন আর ভবিষ্যতের উন্মুক্ত স্বপ্ন— সব মিলেমিশে যায় এক অদ্ভুত বাস্তবতায়, যেখানে উৎসবই হয়ে ওঠে সমাজের নতুন মানসিকতার প্রতীক।