শ্রমিকদের মৃত্যু-পাহাড়ের ওপর বিশ্বকাপ উৎসব
গৌতম দাস
উপসাগরীয় অঞ্চলের ছোট্ট এক দ্বীপ-রাষ্ট্র কাতার। আয়তনে পশ্চিমবঙ্গের প্রায় ৮ ভাগের এক ভাগ। কিন্তু তৈল সম্পদের দৌলতে আরব দুনিয়ার ধনীতম দেশ। এখানেই চলছে বিশ্ব ফুটবলের রাজসূয় যজ্ঞ। ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং কৃষ্টির সঙ্গে ফুটবলের কোনও যোগসূত্র না থাকলেও আধুনিক ফুটবল সাম্রাজ্যের রাজকীয় দুর্নীতির সঙ্গে এই দেশের বর্তমান অধীশ্বরদের একটি গভীর এবং আত্মিক সম্পর্ক রয়েছে। এই সম্পর্কের মূল আড়কাঠি হচ্ছেন কাতারী ফুটবল সংস্থার প্রপিতামহ মোহাম্মদ বিন হাম্মাম। তিনি নির্মাণ কারবারের সঙ্গে যুক্ত অত্যন্ত ক্ষমতাশালী এক ধনকুবের। কাতারের বর্তমান রাজা এবং আল-থানি রাজ পরিবারের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা সুবিদিত। দেশের অর্থনৈতিক কাউন্সিলের উপদেষ্টাও তিনি।
২০১০ সালে রহস্যময় উপায়ে যখন কাতার ২০২২'এর বিশ্বকাপ আয়োজনের অনুমতি পায় তখন থেকেই একের পর এক মহা দুর্নীতির অভিযোগে নাস্তানাবুদ হতে থাকে বিশ্ব ফুটবলের ঠিকেদার এবং শাসন-কর্তা ফিফা। ২০১৪ সালে 'সানডে টাইমস' পত্রিকায় প্রকাশিত একটি তদন্তমূলক রিপোর্টে তথ্য প্রমাণ সহ ফাঁস হয়ে যায় ফিফার কর্তা-ব্যক্তিদের একের পর এক কেলেঙ্কারির কিসসা। মোহাম্মদ বিন হাম্মামের নিজস্ব কোম্পানি কেমকো'র মাধ্যমে ফিফার তদানীন্তন উপ-সভাপতি ওয়ার্নার'এর কাছে পৌঁছে গিয়েছিল এক মিলিয়ন পাউন্ড। বহুমূল্য উপঢৌকন, বিলাসবহুল বিমান যাত্রা এবং হোটেলের আতিথেয়তা- এসব মিলিয়ে খরচ হয়েছিল পাঁচ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এইসব দান খয়রাতির চটজলদি সুফলও মিলেছিল। সহজেই পকেটস্থ করা সম্ভব হয়েছিল আফ্রিকান, ক্যারিবিয়ান এবং ইউরোপীয় ফুটবল সংস্থার হোমরা-চোমরাদের। তারপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি। আদায় করে নিয়েছিলেন ২০২২'এ বিশ্বকাপ আয়োজনের ছাড়পত্র। কিন্তু আদায়ের পদ্ধতিটা জালিয়াতি এবং বেনিয়মের এমন নজির সৃষ্টি করেছিল যে 'দ্য গার্ডিয়ান' পত্রিকা ফুটবলের এই আমিরকে বলেছিল 'অপরাধচক্রের মূল পাণ্ডা'।
সে যাই হোক, এই আগ্রাসী ঘোড়া কেনাবেচায় ফুটবলের প্রতি অনুরাগ যে মুখ্য নয়, সেটা সকলেই বুঝেছিলেন। ওটা ছিল অছিলা মাত্র। আসল উদ্দেশ্য ছিল, নিজেদের অর্থনীতির পালে হাওয়া তোলা, অর্থাৎ, ইকনমিক বুম। সেই লক্ষ্যেই উপযুক্ত পরিকাঠামো গড়ে তোলার নামে গত ১০ বছরে কাতারে লগ্নি করা হয়েছে ২২০ বিলিয়ন ডলার। গড়ে উঠেছে সাতটি স্টেডিয়াম, একাধিক নতুন শহর, ১০০টির বেশি হোটেল, রেস্তোরাঁ, বিলাসবহুল আমোদ-প্রমোদের প্রেক্ষাগৃহ, রাজপথ, মেট্রো এবং ট্রাম পরিবহন ব্যবস্থা। ঝড়ের গতিতে চলা এই প্রকল্পের জন্য প্রযুক্তি ও লগ্নি ছাড়াও অপরিহার্য ছিল লক্ষ লক্ষ মানুষের দৈহিক শ্রম। তাতে কখনই খামতি হয়নি। অতি সস্তার শ্রম জোগান দেওয়ার জন্য অতিমাত্রায় সক্রিয় ছিল আফ্রিকা এবং এশিয়ার শক্তিশালী দালাল চক্র- যাদের গালভরা নাম 'রিক্রুটমেন্ট এজেন্সি'। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল'এর একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, গত ১০ বছরে শ্রমিক হিসেবে সেখানে গিয়েছেন প্রায় কুড়ি লক্ষ মানুষ। এদের মধ্যে সিংহভাগই এসেছিলেন ভারত, নেপাল, বাংলাদেশ, শ্রীলংকা এবং ফিলিপাইনস থেকে। একটি সমীক্ষার রিপোর্ট বলছে, বিশ্বকাপ আয়োজনের প্রস্তুতি হিসেবে অট্টালিকাগুলো যতই আকাশচুম্বি হচ্ছে, তার থেকেও দীর্ঘতর হচ্ছে অভিবাসী শ্রমিকদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের নজির। ২০২১ সালে প্রকাশিত অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রায় ৬৭৫০ জন শ্রমিকের মৃত্যু ঘটেছে গত ১০ বছর ধরে চলা এই প্রকল্পে। তাদের সাম্প্রতিকতম রিপোর্ট বলছে, সংখ্যাটা প্রায় ১৫,০০০ ছাড়িয়ে যাবে। কিন্তু কেন এই মৃত্যু মিছিল? কীভাবে ঘটছে এত সংখ্যায় মৃত্যু? প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে কারা এই মৃত্যুর জন্য দায়ী?
এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই সচেষ্ট হয়েছিলেন 'ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস'এর সাংবাদিক মিহির বাসবদা। বহু কাঠখড় পুড়িয়ে যে তথ্য তিনি সংগ্রহ করেছেন তাতে দেখা যাচ্ছে, গত ১০ বছরে প্রায় ৩৩১৩ জন ভারতীয় শ্রমিকের মৃত্যু ঘটেছে সেখানে। অনেক খোঁজখবর করে মাত্র নয় জনের পরিবারের সঙ্গে তিনি যোগাযোগ করতে পেরেছিলেন। ২২ বছরের তরতাজা যুবক অখিলেশ কুমার বিহার থেকে প্লাম্বারের কাজ নিয়ে সেখানে গিয়েছিলেন। সঙ্গী ছিলেন তেলেঙ্গানার জগন সুরুকান্তি। পরিবারের হাল হকিকত জেনে খোস মেজাজেই তাঁরা সকালে কাজে বেরিয়েছিলেন গত বছর অক্টোবর মাসের কোনও এক দিনে। তারপর থেকে ফোনে তাদের সঙ্গে কোনওরকম যোগাযোগ করতে পারেননি তাদের পরিজনরা। ঠিকেদার সংস্থা কিছু জানায়নি। সহকর্মীরা ফোন করে জানান, এই হতভাগ্য দুজন জলের পাইপলাইনে কাজ করার সময় মাটির ধসের নিচে চাপা পড়ে মারা গেছেন। যে লুসাইল মারিন স্টেডিয়ামের চোখ ধাঁধানো পরিবেশে বিশ্বকাপের ফাইনাল হবে তারই অনতিদূরে জীবন্ত সমাহিত হলেন এই দুজন। ক্ষতিপূরণ দূর অস্ত। মৃতদেহ দেশে ফেরাতেই এই ঠিকেদাররা পাঁচ লক্ষ টাকা দাবি করে। মৃত্যুপুরীতে যাবার আগে ধার দেনা করে টাকা তুলতে হয়। আবার মৃতদেহ হয়ে ফিরে এলেও পরিবার নতুনভাবে সর্বস্বান্ত হয়।
গত সপ্তাহে 'ভয়েজ অফ আমেরিকা'র সাক্ষাৎকারে একজন নেপালি হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ঠিক এই কথাটাই বলছিলেন। তাঁর কথায়, 'বিমানবন্দর থেকে প্রতিদিনই আমরা কোনও না কোনও কফিনবন্দী দেহ ফিরে পাচ্ছি।' তিনি বলছিলেন, সুরেন্দ্র তামাং'এর কথা। প্রত্যন্ত নেপালি গ্রামের এই যুবক ছোটবেলা থেকেই ফুটবল পাগল। কিন্তু ভয়ঙ্কর দারিদ্র্য এবং বেকারত্বকে অবলীলায় পাশ কাটিয়ে সচ্ছল হবার লক্ষ্যে পৌঁছে গিয়েছিলেন কাতারে। ৪০ থেকে ৫০ ডিগ্রি তাপমাত্রার অসহ্য পরিবেশে কাজ করতে করতে ধীরে ধীরে অবসন্ন হয়ে পড়ছিলেন। ঠিকাদার সংস্থার চিকিৎসক বলেছিলেন, গ্যাস অম্বলের সমস্যা। যখন শয্যাশায়ী এবং মৃতপ্রায় অবস্থায় ফিরে এলেন ত্রিভুবন বিমানবন্দরে, ততক্ষণে তাঁর দুটি কিডনি বিকল হয়ে গিয়েছিল। তাঁর স্বপ্ন ছিল অনেক টাকা রোজগার করে বিশ্বকাপের ঠিক আগেই তিনি যখন বাড়ি ফিরবেন, স্মারক হিসেবে নিয়ে আসবেন তাঁর প্রিয় খেলোয়াড় লিওনেল মেসির ছবি-আঁকা একটি জার্সি। জাতীয় স্তরের একটি হাসপাতালে সুরেন্দ্র তামাং এখনও লড়ছেন। সম্ভবত তাঁর জীবনের কঠিনতম এবং শেষ লড়াই।
অসহনীয় দাবদাহ, ভয়ংকর আর্দ্রতা এবং কোনওরকম সুরক্ষা ব্যবস্থা ছাড়াই বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে দৈনিক প্রায় ১৮ ঘণ্টার বেশি কাজ করতে করতে যারা জীবনী শক্তি হারিয়ে ফেলেন এবং এই আধুনিক দাস ব্যবস্থা থেকে বিদায় নিয়ে দেশে ফিরতে চান তাদের জন্য পাকাপাকিভাবে একটি কাতারী আইনের শিকল রয়েছে। তার নাম কাফেলা ব্যবস্থা। ঠিকেদার বা নিয়োগকারী সংস্থার অনুমতি ছাড়া তাঁরা দেশে ফিরতে বা অন্য কোথাও কাজে যোগ দিতে পারেন না। প্রায় সমস্ত ক্ষেত্রেই তাঁদের পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করে নেওয়া হয় এবং নানান আইন কানুনের ফিকির দেখিয়ে এমনই ঋণগ্রস্থ করে রাখা হয় যে তাঁরা তাঁদের মালিকের ইচ্ছা ব্যতিরেকে বাড়ি ফিরতে পারেন না। কেউ কেউ আত্মহত্যা করেন। অনেকের রহস্যজনক মৃত্যু হয়। ঠিক কতজন সেখানে যান, কতজনের অস্বাভাবিক ভাবে মৃত্যু হয় এসব কোনও তথ্য সেখানকার ভারতীয় দূতাবাসের কাছে নেই। সেটাই 'ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস'এর রিপোর্টে বলা হয়েছে। অশালীন বৈভব এবং মধ্যযুগীয় বর্বরতার সঙ্গে তাল ঠুকছেন একজন বিশ্বমানের ভাঁড়। তিনি গিয়ানি ইনফ্যান্তিনো, ফিফা'র বর্তমান সভাপতি। তিনি বলেছেন, 'কয়েক হাজার শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে ঠিকই, তবে তাতে তাদের সম্মান এবং গৌরব দুটোই বেড়েছে।'
মানবতার বিরুদ্ধে এই ভয়ংকর অপরাধকে আড়াল করার জন্য যে চোখ ধাঁধানো আড়ম্বরের ব্যবস্থা করেছে কাতার কর্তৃপক্ষ, সেখানে যাতে কেউ বিন্দুমাত্র ব্যাঘাত না ঘটাতে পারে তার জন্য এক মাস আগেই তারা লাগু করেছে একটি ভয়ঙ্করতম আইন: যদি কেউ কোনওভাবে খেলার মাঠে বা বাইরে এমন কিছু বক্তব্য পেশ করে যা দেশের স্বার্থ ও সম্মানের বিপক্ষে যায়, তাহলে ১০,০০০ কাতারি মুদ্রা জরিমানা অথবা পাঁচ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে।
তবু বিশ্বের বৃহত্তম ক্রীড়া প্রদর্শনী চলছে। চলছে বীভৎস মজা।
ডাক্তার দাসকে অনেক ধন্যবাদ। এমন একটি দানবিক ফুর্তির ভয়াবহতার এই ছবি কি তথাকথিত ফুটবল প্রেমিকদের অতন্দ্র টিভি মাতলামি প্রশমিত করবে? নাকি এঁরাও মনে করেন, এভাবেই ভারত বিশ্ব কাপে নিজের অবদান রেখে চলবে?
ReplyDeleteএই সত্য তুলে ধরার জন্য অনেক ধন্যবাদ। কজন খবর রাখে?
ReplyDeleteএই ঘটনা জানবার পর কাতারের আন্তর্জাতিক ফুটবল সম্পর্কে আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ আর.থাকছে না।এই চরম নিষ্ঠুরতা গণহত্যার চেয়ে কোন অংশে কম নয়। এ ঘটনার তীব্র নিন্দা করছি।আর লেখককে তার মানবিক উক্তকণ্ঠার সঙ্গে এই মর্মগ্রাহী সংবাদ পরিবেশনার জন্য জানাই অনেক অভিনন্দন। ভূমিকা- লেখককে ও জানাই আমার আন্তরিক ভালবাসা।
ReplyDeleteঅনেক অজানা তথ্য,ও বিশ্লষণ খুবই ভালো।
ReplyDeleteএই লেখা সবার পড়া উচিত।
এও এক হত্যালীলা।
খুব সুন্দরভাবে আপনি নেপথ্যের কুৎসিত রূপটা তুলে ধরেছেন। খুব ভালো লাগলো।
ReplyDeleteবিশ্বের ইতিহাসে রাজারাজড়া এলিটদের চোখ ধাঁধানো জৌলুস আর আড়ম্ভরের পিছনে এমনভাবেই অগণিত সাধারণ গরিব মানুষের বলি চড়ানো হয়।
ReplyDeleteআজকের আধুনিক সভ্য (?) সমাজে চূড়ান্ত লোকদ্যাখানো বিশ্ব মানবতার নামে সেই একই নারকীয় বলিদান হয়ে চলেছে অবলীলায়। অত্যন্ত জরুরী এই লেখাটির জন্য অনেক ধন্যবাদ ডঃ গৌতম দাস।
I THINK SOMEONE SHOULD BE BRAVE ENOUGH & WHO HAS THE ABILITY TO STAND IN AGAINST OF THIS BARBARIAL BRUTALITY IN THE INTERNATIONAL COURT FOR CRIMINAL JUSTICE & LABOR COURT IN AGAINST OF QATAR &FIFA ,GOLAK ROY USA
ReplyDeleteপরিকল্পিত গনহত্যা অত্যন্ত সহজ সরল ভাষায় সত্য ঘটনা পরিবেশনার জন্য
ReplyDeleteডাঃ দাস কে অনেক ধন্যবাদ জানাই .
অত্যন্ত গুরুতর বিষয়ে নিগূঢ়তর প্রতিবেদন! অভিনন্দন!
ReplyDeleteতবে, প্রতিক্ষেত্রে প্রামাণিক সূত্রের দাবি রাখে।
শুধু তো মন্তব্যের বিষয় নয়,__ এ সম্পর্কে ব্যাপক স্তরে অন্তত যতটা সম্ভব প্রচার আর চর্চার একটা সংস্কৃতি গড়ে তোলা প্রয়োজন বলে আমার মনে হয়। এ সেই সংস্কৃতি যা বর্তমান ধনকুবেরদের দুনিয়া আর তাদের তল্পিবাহকরা ভয় পায়।তবে যে সব মন্তব্য এখানে এসেছে তা যথেষ্ট ইতিবাচক।
ReplyDelete