Wednesday 7 October 2020

লেখালেখির অন্দরমহল

একুশ শতকের বাঙালি লেখকের ভবিতব্য

অর্ধেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়


'বাইরে লোক দেখানো অ্যারিস্টোক্রাসি এবং গণতান্ত্রিক আচরণে অন্তরে বর্বরতা– এটাই তো ভবিষ্যৎ আমাদের জন্যে তুলে রেখেছে। আর এই ক্রমে, ভাবুক ও স্বপ্নদর্শী ব্যক্তিদের জীবনের উৎকর্ষতা, সম্ভ্রম ও সারল্য প্রতিপালিত হবে একজন ভুঁইফোঁড়ের প্রতিষ্ঠা, সফলতা ও খ্যাতির নমনীয়তার মানদণ্ডের ভিত্তিতে। তার চেয়েও দুর্ভাগ্যের যেটা, অর্থ ও লৌহদণ্ডের ক্ষমতার সামনে, একজন প্রকৃত আদর্শবাদী ও ভাল মানুষকে চরম একাকীত্ব ও দারিদ্রের মধ্যে জীবনযাপন করতে হবে। এমনকি দাওয়াতখানার মহাভোজের দরজার বাইরে এরা ধামাধরা লোমওঠা কুত্তার মতো করজোড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য হবে, যাতে অন্তত জীবনধারনের জন্য ছুঁড়ে দেওয়া সামান্য হাড়টুকু চাটতে পারে।                                                        -  শার্লস মোররে (বুদ্ধিমত্তার ভবিষ্যৎ, ১৯০৫ সাল)।

নীরদচন্দ্র চৌধুরি তাঁর আত্মজীবনী লেখা প্রসঙ্গে বলেছিলেন যে, তত্ত্বমূলক গ্রন্থ রচনার ক্ষেত্রে ইতিহাস অনুসন্ধানে গবেষণার উপায় ও সামর্থ্য না থাকায়, তিনি নিজে যে ইতিহাসের মধ্যে দিয়ে জীবন অতিবাহিত করেছেন সেই অভিজ্ঞতাই লিখেছেন। আমরাও এখন এক যুগ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি, একটা ইতিহাস যাপন করছি, হয় জেনে-বুঝে নয়তো অজ্ঞানতার সঙ্গে। 

উনিশ শতকের নবজাগরণ থেকে আজ অবধি কেটে গেছে দু’শোর বেশি বছর। বিদগ্ধজন থেকে বুদ্ধিজীবীতে উত্তরণ-অবরোহনের নানা রঙের দ্যুতি ইতিহাস যাত্রার বাঁকে বাঁকে বিস্ময় সঞ্চয় করে রেখেছে। আমরা এগিয়ে চলেছি। এই পথের কোনও শেষ নেই। কিন্তু কোনও দিশা আছে কী– সেই প্রশ্নের সম্মুখীন হতেই হবে। দিশা থাকা কি সব সময়ে জরুরি, তাই নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। অনেকে বলতে পারেন, চিত্তের দুর্দমনীয় গতিতে যা সৃষ্টি হয় সেটাই তো স্বতঃস্ফূর্ত সভ্যতার ইমারত, সুখের পরাগভূমি। মনে রাখা জরুরি, অনাবিলভাবে শুধু আগাছার বনভূমি জন্মায় যেখানে আদিম অভ্যেসে পরাভূত প্রাকৃতিক জীবকুল বসবাস করে, সুসভ্য মানুষের পক্ষে তা অনুকূল নয়। দৃষ্টিনন্দন তো নয়ই। আজকাল যদিও সভ্য মানুষের মধ্যেও আদিম প্রবৃত্তির বিনাশরূপের আনাগোনা প্রায়শই দেখা যাচ্ছে, তা হলে বলতে হয় সেটা দিশাহীনতারই লক্ষণ। অশেষ গন্তব্যে ধাবমান দিশাহীন বাঙালি সমাজে যারা দিশারী, অন্ধকারের মধ্যে আলোকবর্তিকার মানদণ্ড যাদের হাতে শোভিত অর্থাৎ লেখকগোষ্ঠী– আজ তাদের অবস্থা কীরকম? তারা কি গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসানোর দল নাকি গ্রিম্পেন মায়ার থেকে নতুন ভবিষ্যতের ভাষ্য উদ্ধারকারী স্বাপ্নিক। নবজাগরণের ধারায় মানবতাবাদের নিরিখে শুধু যে সাহিত্য রচিত হয়েছিল ভুরি-ভুরি তা কিন্তু নয়। পক্ষান্তরে, ধর্ম, বিজ্ঞান, সমাজবোধ ও রাজনীতির দর্শনেও ছিল পালাবদলের অঙ্গীকার। বর্তমানে আরেক নবজাগরণের দোরে আমরা কড়া নাড়ছি। এই নবজাগরণ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার। মানবতাবোধ নয়, এখন ট্রান্সহিউম্যানিজমের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। তাই আজকের বাঙালি সমাজে লেখক বলতে শুধু সাহিত্য শিল্পের দলদাসদের মধ্যে এলাকা ভাগ করলে হবে না, এক্তিয়ারের সীমানা বিজ্ঞান ও দর্শনের উন্মুক্ত উদ্যানেও বিস্তার করতে হবে। সাহিত্য শিল্প সমাজ প্রগতির আবশ্যিক শর্ত হতে পারে, কিন্তু তা কখনওই যথেষ্ট নয়।

একুশ শতকের (পশ্চিমবাংলায় তো দশকের লেখক শতকের কবির বিভক্তিকরণ চলতি ব্যাপার, সুতরাং এখানে কাদের কথা বলা হচ্ছে সেটা সহজবোধ্য) বাঙালি লেখকের মধ্যে মূলত দু’ ধরনের চেতনাস্তর প্রচলিত। একদল বিভ্রান্ত, আরেক দল ফাঁপা। তথাপি একটি ক্ষুদ্রতম গোষ্ঠী আছে, চিন্তা-চেতনায় অগ্রসরমানতার যাবতীয় উপাদান যাদের মধ্যে বর্তমান। এদের আদর্শ মূলত নীরদচন্দ্র চৌধুরি-শিবনারায়ণ রায়-সমর সেন-অশোক সেন-অশোক মিত্র-দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়-ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়-দীপেন্দু চক্রবর্তী-প্রদ্যুম্ন ভট্টাচার্য-সিদ্ধার্থ ঘোষ-দীপেশ চক্রবর্তী-আশীষ লাহিড়ী-রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য-গৌতম ভদ্র-পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের চর্চাবোধ। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠের দল ভাগাভাগির প্রাবল্যে আজকাল এরা এতটাই একাকীত্ব ও উদাসীনতায় আচ্ছন্ন যে নিজের চর্যাবৃত্তের বাইরে গিয়ে উপযাচক হয়ে সমাজ-সক্রিয়তায় অংশ নিতে চায় না। বরং, যতদূর সম্ভব ভাবনাপ্রবাহের বয়ান নিভৃতে নিষ্কামভাবে লিখে যাওয়াতেই এদের সুখযাপন। কেননা, সেই লেখা প্রকাশ করার মতো প্রকাশক আজ যেমন আর নেই, তেমনই নিজের উদ্যোগে বই প্রকাশের সুযোগ থাকলেও একদিকে বিক্রির ক্ষুদ্র পরিচিত পরিসরের সমস্যা ও অন্যদিকে পাঠকের ভাঁড়ারে যে 'ভাঁড়ে মা ভবানির দশা' তাও সুবিদিত। সুতরাং, এদের আত্মপ্রকাশের প্রায় কোনও সম্ভাবনাই আজ আর পশ্চিমবঙ্গে নেই, নগণ্য কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া যাকে ধর্তব্যের অন্তর্গত না করাই শ্রেয় 

সুতরাং মূলস্রোতে ফিরে এলে দেখা যায়, লেখকদের মধ্যে যারা বিভ্রান্ত তারা দুটি উপদলে বিভক্ত। এক দল বৈষয়িকভাবে সফল, অন্য দল ব্যর্থ। বিভ্রান্ত দলটি মূলত একটি দ্বন্দ্বময়তার মধ্যে নর্তনকর্দন করে। একদিকে উনিশ শতকের মহীয়সী ঘনঘটা ও অন্যদিকে বিনয়-ঋত্বিক-শক্তির বোহেমিয়ানিজমের মধ্যেই সুনীল-শীর্ষেন্দু-জয় প্রমুখের সেলিব্রিটিসুলভ বৈভব অর্জন– এই যুগপৎ সাঁড়াশির চাপে এরা পিষ্ট। উনিশ শতকের অর্থনৈতিক অবস্থান থেকে আজকের অবস্থান একেবারে আলাদা। বাঙালি এই অর্থনৈতিক ভোলবদলের মধ্যে দেখেছে বঙ্কিম যুগ–রবীন্দ্র যুগ–কল্লোল যুগ। এই উন্মেষপর্বের জোয়ার কাটতে না কাটতেই বাঙালি সমাজে আছড়ে পড়েছে বামপন্থী-অতিবামপন্থী ভাবধারার প্রাধান্য। এই ভাবধারার সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করার মৌলিক চেষ্টায় একদিকে মানিক-সতীনাথ-কমলকুমার-মহাশ্বেতা-সন্দীপন-নবারুণ প্রমুখের সাহিত্যবীক্ষা, অন্যদিকে শরদিন্দু-সুনীল-শীর্ষেন্দু-সমরেশ-বুদ্ধদেব-জয়ের সাহিত্যখ্যাতি বাঙালির মননকে তোলপাড় করেছিল। এর মধ্যে থেকে সন্তোষ ঘোষ-শঙ্খ ঘোষ-অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত-ভাস্কর চক্রবর্তী-নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়-দেবেশ রায়-রামকুমার মুখোপাধ্যায়-মলয় রায়চৌধুরির ঘরানা অন্য ধারার, সে জন্য পূর্বোল্লিখিত ক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। বাঙালি পাঠক ও একুশ শতকের কবি-লেখক যশোপ্রার্থীদের মধ্যে এই ব্যাপ্তির কোনওটাকেই প্রত্যাখ্যান বা উপেক্ষা করার মতো স্পর্ধা কারও নেই– এমনই ছিল লেখনির গুণমান এবং সংখ্যার বিশালত্ব। কিন্তু এর মধ্যে একটা সংঘর্ষও ছিল– প্রাতিষ্ঠানিকতা বনাম প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা। ফলে, প্রাতিষ্ঠানিকতার মাধ্যমে সাহিত্যের বাজার শাসনের বাণিজ্য কৌশল ও প্রচারের মধ্যেই দেখা গিয়েছিল একটি উলটো স্রোত: লিটল ম্যাগাজিন। এই দ্বৈরথ ছিল জমজমাটি। পণ্য সাহিত্য বনাম মৌলিক সাহিত্য কীর্তির দুই যুযুধান পক্ষের মধ্যে থেকে কোনটা বাঙালি সংস্কৃতি ও রুচিবোধকে নিয়ন্ত্রণ করবে সেটাই ছিল দেখার। কেননা দুটোর মধ্যেই কিছু না কিছু মর্মবস্তু ছিল– তা ভোগবাদ সর্বস্ব লঘুকরণের হোক কিংবা গুরুগম্ভীর তেজস্ক্রিয় বিকিরণের। 

কিন্তু, ইত্যবসরে উদার অর্থনীতিবাদ ও প্রযুক্তির আবির্ভাবের মধ্যে দিয়ে যে নয়া-বিনোদনের দুয়ার খুলে গেল তা একুশ শতকের লেখকদের মধ্যে জাগ্রত করল এক বিশাল বিভ্রান্তি। এই নয়া-বিনোদনকল্প পণ্য সাহিত্যের অন্তরেও যে শুদ্ধতা ছিল তাকে তো খোলাবাজারে খোলামকুচি করলই, সঙ্গে সঙ্গে পণ্যায়ন-সংস্কৃতির স্তম্ভ মজবুত করার জন্যে এমন এক প্রশ্ন জনমানসে প্রচার করল যে একুশ শতকের লেখকের মনে একটি সংশয় দেখা দিল। আসলে লেখক ‘যেমন ব্যষ্টির প্রকাশ, তেমনই সমষ্টিরও অন্তর্ভুক্ত’, ফলে সেও ভাবল যে, মহৎ সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে নিজের সময়ে যদি পয়সা করা কিংবা পাঠকের কদর পেয়ে বিখ্যাত হওয়াই না যায় তবে তার বিশিষ্টতা প্রমাণ হবে কী করে? এভাবেই সে এক চূড়ান্ত বিভ্রান্তির পথে পা বাড়াল– সে চর্চাহীন বোহেমিয়ানিজমকে গ্রহণ করল একদিকে, অন্যদিকে হাত বাড়াল দিশাহীন বাজার-নিয়ন্ত্রিত সৃষ্টির ভুলভুলইয়াতে। এখন সে আত্মসংযম, ইতিহাস-চেতনা, বিশ্ববীক্ষা ও প্রাজ্ঞতার মুক্তমনা সারস্বতচর্চার পরিশ্রমের চেয়ে ভাবের ঘরে চুরি করে ভিজে বেড়াল সেজে থেকে কার্যসিদ্ধির উপায় সন্ধানে নিবেদিতপ্রাণ হয়েছে। যেন জাতে মাতাল তালে ঠিক। অনেকে এদের প্রফেশনাল রাইটার বলে আখ্যায়িত করেন। আগেও এই প্রফেশনাল রাইটার ছিল। তবে আগের যুগের সঙ্গে এ যুগের পার্থক্য কিছুটা আগের যুগের বাইজি প্রথার সঙ্গে এ যুগের গণিকাবৃত্তির মতো হয়ে গেছে। আর এই প্রফেশনালিজমের ও পিঠে যেহেতু থাকে আত্মার ইচ্ছাকে বিসর্জন দিয়ে বাছবিচারহীন খরিদ্দারের দাবি মেটানোর আর্জি, সেহেতু ঘোমটার আর কোনও বালাই-ই আজ আর নেই। কোনও বিখ্যাত প্রকাশনা থেকে কটা বই আর খবরের কাগজে কিংবা বোকাবাক্সের পর্দায় ক’বার দেখা যাচ্ছে, কর্পোরেটিয় ধাঁচায় চকচকে সিভি প্রস্তুতির সে হিসেবে এখন লেখকরা বেশ পাকা হয়ে উঠেছেন ও সদর্পে ঘোষণাও করছেন। আফসোসের বিষয় এই যে, লিটল ম্যাগাজিনও এখন আর নিজেকে এই চোরাস্রোত থেকে রক্ষা করতে পারছে না। তারাও এখন হয় উনিশ শতক নয় নকশালবাড়ির মধ্যে প্রগতিশীলতা খুঁজছে ও বিভ্রান্ত হচ্ছে। ‘সাহিত্যের ইয়ারবুক’ খুললেই প্রায় দু’ হাজার পত্রিকার সন্ধান পাওয়া যাবে কিন্তু তার মধ্যে ক'টা পত্রিকা লিটলের ধর্ম-প্রবৃত্তি-চরিত্র অনুযায়ী কাজের কাজ করছে আর ক'টা যে-লেখকের লেখা কোনও পত্রিকাতেই ছাপানোর যোগ্য নয় কিন্তু তার সম্পাদনায় প্রকাশিত হচ্ছে, সে তথ্যতল্লাশ হৃদপীড়া ছাড়া আর কিছুই যে দিচ্ছে না। এরকমভাবেও যে সকলেই সফল হচ্ছে তা নয়। ব্যর্থদের তালিকাতে জমছে শুধুই তিতিবিরক্ত গ্লানিময় ক্ষোভ ও ক্রোধের খিস্তি-খেউড়ে নষ্ট জীবনের আখ্যানএ কথা এরা বুঝতেই পারছে না যে, বিভ্রান্তির স্থবির বৈকল্য আর অতীত ভাঙিয়ে পয়সা করার মনোভাব দিয়ে বৌদ্ধিক মুৎসুদ্দি থেকে মহাজন স্তর অবধি পৌঁছনো যায় কিন্তু পরিতৃপ্তিময় রসেবশে থাকা সৃষ্টিশীলের আনন্দের জীবন পাওয়া যায় না। এই গেল গেল রব কান পাতলেই বুকের ভেতর থেকে শোনা যায়।

অন্যদিকে, ফাঁপা দলটির মধ্যে কেবলমাত্র অসংযত আবেগের ছলাৎ-ছলাৎ আর জীবনে হতাশার দগদগে ঘা। যারা জীবনে কোনওদিন ‘স্বপনকুমারের রহস্যের বই পড়েনি’ তারাও আজ সাহিত্যশিল্পের পথে এসে স্লোগান দিচ্ছে ‘পাশ করিয়ে দেবার’। এটা দেখে বলা যায় যে, যতদিন এ দেশে গণতন্ত্রের একটা ধরতাই খোলস ও অপার্থিব সামাজিক মাধ্যম পরিচালনার জন্য দৈনিক আন্তর্জালিক অধিকোষস্থিতি বিদ্যমান ততদিন এদের প্রাধান্য উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে। জনজীবনে এমনিতে যে পরিমাণ নিরাপত্তাহীনতা দেখা যাচ্ছে– অর্থাৎ ডিগ্রিধারীর চাকরি নেই, ডাক্তারি পড়ে সম্মান নেই, ওকালতি পড়ে পসার নেই, ছোট ব্যবসার বাজার আর বড় ব্যবসার পুঁজি নেই কিন্তু বিলাসিতার পণ্যসামগ্রীর প্রদর্শনীতে ঘাটতিও নেই– তাতে করে নিজের বাজার দর বা কদর, পারতপক্ষে, নিজের চোখে বজায় রাখার একমাত্র পন্থা হল খোলা সাহিত্যের বাজারে ‘লাইক-কমেন্ট-শেয়ারের’ খ্যাতিলাভ। যাতে বোঝা যায় কিছু না কিছু তো করছে, অর্থাৎ বিপন্নতার খড়কুটোখানি হল এইরকম যে, 'যে লোকটা কোনো কর্মেরই নয় ঠাকুর তাহাকে বসিয়া থাকিতে দেন না, পাছে সে মাটি হইয়া যায়। যতরকমের বাজে কাজ করিবার ভার তাহারই উপরে।' আর এখানে সেই বাজে কাজটা হল Gone with the wind-এর মতো Trend-এ ভেসে যাওয়াআবার এ কথাও ঠিক যে, মূর্খের একপ্রকার সারল্যও থাকে, সাহসও থাকে আর চতুরের একদিকে থাকে মেকি বিনয় আর অন্যদিকে কানিং অ্যান্ড শ্রুডের মনোভাবযাদের মধ্যে সারল্য আছে তাদের ক্ষমা করা যায়, ভালোবাসা যায়। কেননা সাহসের বশে এরা অনেক সময় প্রতিবাদী হয়ে ওঠে এবং সমাজের এমন কিছু বিশৃঙ্খলার বিরুদ্ধে চেঁচামেচি করে যে একটা হুলুস্থুল ব্যাপারের অন্তত উপক্রম হয়। কিন্তু যারা চতুর তাদের বিনয়কে সহ্য করা আর ধূর্ততাকে শ্রদ্ধা করার মতো অন্যায় আর কিছুতে নেই। এরা হচ্ছে সেই কালসর্প যা সমাজের যাবতীয় যা কিছু মঙ্গলময় চেতনা তাকে বেচে দিয়ে আসতে পারে ও নামিয়ে আনতে পারে একটা সর্বনাশ।

এমতাবস্থায়, তাহলে কি আমরা বাংলা সাহিত্যে আরেক অন্ধকার যুগে প্রবেশ করতে চলেছি? ওয়াকিল আহমদ অন্ধকার যুগ সম্বন্ধে লিখেছিলেন- 'বাংলা সাহিত্যের কথিত ‘অন্ধকার যুগ’ মোটেই সাংস্কৃতিক বন্ধ্যাত্বের যুগ ছিল না। ধর্ম-শিক্ষা শিল্প চর্চার দায়িত্ব যাদের উপর ন্যস্ত ছিল, তারা সীমিত আকারে হলেও শিক্ষা সাহিত্য চর্চায় নিয়োজিত ছিলেন। তবে, কি হিন্দু কি মুসলমান কেউ লোকভাষা বাংলাকে গ্রহণ করেননি। বাংলা সাহিত্যের নিদর্শন না থাকার এটাই মুখ্য কারণ।' আর নয়া-অন্ধকার যুগে কি তবে বণিকি ইংরেজি-হিন্দির প্রভাব এবং বাংলায় একদিকে অতিলিখনের জঞ্জাল ও পক্ষান্তরে মূল্যবান রচনার নির্বাসন-আত্মগোপনে প্রকৃত মননকে মানুষ প্রত্যাখ্যান করবেন? তাহলে কি খড়ের গাদায় সূচ অনুসন্ধানের মতো করে একদিন চিন্তাশীল, মৌলিক সাহিত্য ভবিষ্যতের কোনও গবেষককে এই সময় থেকে খুঁজে নিতে হবে? এই কি তবে বিধিলিপি? এটা শুধু ভাবনার বিষয় নয়, মাঝে মাঝে কান্নারও আক্ষেপ হয়ে দাঁড়ায়।

প্রশ্ন হল, বিভ্রান্ত, ফাঁপা ও নির্বিকার গোষ্ঠীর মধ্যে থেকে সতেজ-টাটকা মনস্বীর দেখা মিলবে কী করে? আশীষ লাহিড়ী তাঁর ‘এই পঙ্ক কালচারের হেজিমনি ভাঙুন’ নিবন্ধে লিখেছেন যে, 'প্রথম কর্তব্য হল অবস্থার ভয়াবহ বহুমাত্রিক জটিলতাটা বোঝা। ... (এবং) মূলস্রোত-বাহিত পাঁকের বিপরীতে যত ছোট আকারেই হোক, আমাদের আসল সংস্কৃতির চর্চা বাড়ানো দরকার। কেরিয়ার করার জন্য নয়, মিডিয়ার শরণ না নিয়ে, নিছক ভালোবেসে। আমি নিশ্চিত যে, যে কোনো শুদ্ধ সংস্কৃতির নিবিষ্ট চর্চাই এই পঙ্ক-কালচারকে ঘা দেবে। যদি প্রতিনিয়ত আমরা প্রমাণ করতে পারি যে নিছক প্রকরণগত দিক থেকেও আমরা এই মুৎসুদ্দি বিকার-সংস্কৃতির চেয়ে বহুগুণে শ্রেষ্ঠ, সুরটা আমরা ঠিকঠাক লাগাতে শিখি, সম্-টা আমরা ঠিকঠাক জায়গাতে ফেলি, শুধু কারাওকে আর সিন্থেসাইজারের ভরসায় গান গাই না – তাহলে সমাজের ওপর তার একটা প্রভাব পড়তে বাধ্য।' নইলে স্বঘোষিত কবি-লেখকের সংখ্যাবৃদ্ধি হবে মাত্র, গুণপনা-প্রতিভা যে তিমিরে সে তিমিরেই রয়ে যাবে। 

অনেকের মনে প্রশ্ন জাগে, সমাজে প্রকৃত কবি-লেখকের পরিচয় কী, চরিত্রই বা কেমন? জয়া মিত্র একবার মহাভারত অনুসরণ করে বলেছিলেন যে, আত্মাকে দহন করে যিনি অস্থি প্রজ্বলিত করেন তিনিই কবি। একুশ শতকের বাঙালি লেখকের মধ্যে আজ মূলত কবি, তারপরে গল্পকার-ঔপন্যাসিক এবং সর্বশেষে প্রাবন্ধিকের দেখা মেলে। কিন্তু ক’জন আত্মাকে দহন করে অস্থি প্রজ্জ্বলন করেন সে কথা আমাদের জানা নেই। প্রকৃত লেখকের ধর্ম কী হওয়া উচিত তা নিয়ে বিতর্ক নেই। দুটি চরম বিপরীত চিন্তাধারার মধ্যেও এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী ভাবে মিলমিশ দেখা যায়। এই প্রসঙ্গে একদিকে মার্কস'এর ধারণা ও অন্যদিকে মার্কস-বিরোধীর ধারণা কী ছিল সেটা জেনে নেওয়া যাক। অ্যান্ডি ব্লুডেনের অনুলিখনে জানা যায় যে, 'Artistic creation is one of the ways of reflecting reality and, at the same time, of perceiving and apprehending it; it is also one of the strongest levers of influencing the spiritual development of humanity. The author of genuinely realistic works communicates his ideas to the reader not by didactic philosophising, but by vivid images which affect the reader’s consciousness and feelings by their artistic expressiveness.'অন্যদিকে নীরদচন্দ্র চৌধুরি বলেছেন যে, 'উপনিষদ, গীতা, কালিদাসের কাব্য, হোমার, এস্কিলাস, সোফোক্লেস, ইউরিপিডিস, প্লেটোর রচনা ছাপাখানার অস্তিত্বের অপেক্ষা না রাখিয়াও বাঁচিয়া আছে। সুতরাং, লেখক নশ্বর হইতে পারে, অমরও হইতে পারে। অমর হয় যাহারা পাঠকের চরিত্র ও মনকে গঠিত বা পুনর্গঠিত করিতে পারে; আর নশ্বর হইয়া যায় তাহারাই যাহারা জনসাধারণের আমোদের উপকরণ জোগায়।'

উদার-অর্থনীতি, খোলা বাজার ও প্রযুক্তির যুগে দুনিয়া যেখানে মানুষের পেরিফেরাল স্নায়ুতন্ত্রকে (যা মস্তিষ্কের মাধ্যমে ব্যক্তির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলিকে নির্ধারণ করে) বদলে দিয়ে মানবিকতর প্রজন্মের দিকে হাত বাড়িয়ে সাফল্য পেয়ে গেছে এবং এই ট্রান্সহিউম্যানিজমে ন্যানো প্রযুক্তি, জৈব প্রযুক্তি, তথ্য প্রযুক্তি এবং ইন্দ্রিয়তর বিজ্ঞানের ব্যাপক প্রয়োগ ঘটিয়ে অন্য দুনিয়ার জবানি রচনা চলছে, সেখানে একুশ শতকের বাঙালি লেখকের মন যদি শুধুমাত্র ঘ্যানঘ্যানে সিরিয়ালের মতো দিশাহীন দৌড় লাগাতে থাকে আর এখান থেকে সেখান থেকে অতীত ঘেঁটে এনে ভাবে চমক লাগিয়ে দিয়েছে, তবে আগামী পৃথিবী আমাদের স্রেফ কনজিউমারিজমের দাসত্বে বন্দি করবে। সিমুলেটেড বাস্তবতা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, অতিমানববুদ্ধি, থ্রি-ডি বায়োপ্রিন্টিং, মাইন্ড আপলোডিং, রাসায়নিক মস্তিষ্ক সংরক্ষণ এবং ক্রোনোনিক্সের মতো অত্যাধুনিক ব্যবস্থাপনার আঙ্গিকে লেখককে ভবিষ্যৎদ্রষ্টার স্বজ্ঞা অর্জন করতে হবে এবং জীবনের উত্থানপতনের নতুন ভাষায় জনমনকে দিতে হবে আবেগমথিত নাড়া। টি-২০ জ্যোতিষ সেজে থাকার দিন চলে গেছে। কেননা মানুষের মনে এখন শুধু অতীত ঐতিহ্যের মূর্তিপুজোটুকু আছে, চৈতন্যের ঘোরখানি আছে কিন্তু যাপনে বাস্তবায়ন নেই। তাই প্রতি মুহূর্তে আরও বেশি করে মুনাফাবাজের রক্ষণশীল সংস্কৃতির সঙ্গে লড়াই করে রক্ষা করতে হবে প্রগতিবাদকে। মনে রাখতে হবে, বাজার সব সময়ে মূর্খ ক্রেতা তৈরির পক্ষে কাজ করে, তা ক্রেতা নিজেকে যতই চালাক ভাবুক, বাজার তাকে বোকা বানাবেই। একইভাবে সে পাঠকমনেও অনুপ্রবেশ করাতে চায় খরিদ্দারের চরিত্র ও সংস্কৃতি। লেখকের কাজই তো পাঠককে এই দানবীয় অপসংস্কৃতি থেকে রক্ষা করা। এটাই চিরকালের দ্বন্দ্ব। শুধু যুগে যুগে নতুন অভিধায় ফিরে আসে। মার্কস বোধহয় এ জন্যই বলেছিলেন, 'Capitalist production is hostile to certain branches of spiritual production, for example, art and poetry.'তাই-ই সন্ধান রাখতে হবে বিশল্যকরণীর। মনে রাখতে হবে যে, শিল্পই হল একটি 'important weapon in the ideological struggle between classes.'। 

সুতরাং, ব্যতিক্রমী শিল্পের দ্বারাই ধ্বংস করতে হবে অবক্ষয়ের অলাতচক্র। খেলোয়াড়-সঙ্গীতশিল্পীর মতো বিখ্যাত হবার বাসনা নিয়ে সেই সাধনার ফললাভ অসম্ভব। হয় ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে যাও নইলে আগাছার মধ্যে থেকেই বটবৃক্ষ হয়ে ওঠার নিমগ্ন চর্চায় মনোনিবেশ কর। ধৈর্য, স্থৈর্য ও প্রজ্ঞার গভীর সমুদ্রে যাওয়া প্রাকটিস কর, খ্যাপার মতো পরশপাথর খুঁজে ফিরলেই একদিন উদ্ভাসিত হবে অন্য দিগন্ত, বিকল্প ও আনকোরা চিন্তার হীরকখণ্ড। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ছোটগল্প ‘বোষ্টমী’-তে বলেছেন, 'আমি লিখিয়া থাকি অথচ লোকরঞ্জন আমার কলমের ধর্ম নয়।' স্রোতে ভাসা নয়, স্রোতের বিপ্রতীপে যাত্রাই হোক ভবিতব্য। এটা প্রার্থনা করি কিন্তু জানি যে, 'কামারের এক ঘায়ে অবস্থাটা একেবারে বদলে ফেলতে হলে যে-প্রজ্ঞাশীল রাজনৈতিক আন্দোলন ও সংগঠন চাই, সে জিনিসের সম্ভাবনা অদূর ভবিষ্যতে (নেই)। আপাতত ‘ওদের’ মুৎসুদ্দি সংস্কৃতির হেজিমনি ভেঙে কিছুটা পরিসর দখল করতে পারলেই মনে করব ‘অনেক দিয়েছ নাথ’।' 

 

গ্রন্থপঞ্জী:

1.    ১) আমার দেবোত্তর সম্পত্তি: নীরদচন্দ্র চৌধুরি

2.    ২) সংস্কৃতির বাংলা বাজার: আশীষ লাহিড়ী

3.    ৩) প্রবন্ধ সংগ্রহ: দীপেন্দু চক্রবর্তী

4.    ৪) নারীর পৃথিবী নারীর সংগ্রাম: সুপর্ণা লাহিড়ী বড়ুয়া

5.    ৫) L'avenir De L'intelligence: Charles Maurras

6.    ৬) গল্পগুচ্ছ: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

7.    ৭) Marx and Engels on Literature and Art – (Transcribed by) Andy Blunden.

তথ্যসূত্র:

1.    https://en.wikipedia.org/wiki/Transhumanism

2.    https://bn.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%82%E0%A6%B2%E0%A6%BE_%E0%A6%B8%E0%A6%BE%E0%A6%B9%E0%A6%BF%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%AF

2 comments:

  1. পড়লাম। ভালো লাগলো। বেশ সংগত প্রশ্ন তুলেছ। বাংলা বাজারের অবস্থা, আমাদের মেধা, মনন চর্চা ও সাহিত্য চর্চা কোনদিকে যাচ্ছে ও এর ভূত ভবিষ্যত সম্পর্কে অবগত করেছ। তবুও বুকে আশা রাখতে হবে, সুস্থ সংস্কৃতির চর্চা করে যেতে হবে। ভালোবাসা নিও।

    ReplyDelete