কৃষকেরা কিন্তু ছেড়ে কথা বলেন না!
সিদ্ধার্থ বসু
ভারতবর্ষের কৃষকরা বারবার তাঁদের ওপর অন্যায়ের প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে এসেছেন। প্রতিবাদ বিক্ষোভ থেকে বিদ্রোহে সামিল হয়েছেন। বারবার প্রলোভনের শিকার হতে হয়েছে। এই প্রলোভনের ফাঁদে পড়ে তাঁদের কী করুণ অবস্থা হয়েছে তার ছবি মেলে বাংলার লোককবির কথায়। লোককবি আবেদ আলী মিয়া কৃষকদের এই লোভের পরিণতির কথা ভেবে বলেছিলেন, 'কৃষকরা চাউল ত্যাগ করে লাভের আশায় পাটের ঝুঁকি নিয়েছিল, তাদের এমন একদিন আসবে যখন তাদের সেই পাটগাছের কাঠি খেতে হবে।' তিনি গান বেঁধেছিলেন,
'বুঝলি না তুই বুড়ার বেটা, আবেদের নয়কো ঝুটা
খেতে হবে পাটের গোড়া ঠিক জানিস মোর ভাষা
মনে করেছো নিব টাকা
যে আশা তোর যাবে ফাঁকা
পঁচিশের পয়া হবে তোর, ঋণে পড়বি ঠাসা
নিবি বটে টাকা ঘরে
পেটের দায়ে যাবে ফুরে
হিসেব করে দেখিস খাতা, যতো খরচের পাশা।'
নীলচাষ ও পাটচাষ নিয়ে কৃষকদের মধ্যে অধিক আয়ের যে রঙিন কল্পনার জগৎ গড়ে উঠেছিল, তা যে কত বিপজ্জনক ছিল, লোককবির অন্তর্দৃষ্টিতে তা সহজেই ধরা পড়েছিল। তাই তিনি কৃষকদের সতর্ক করেছিলেন। আজও কৃষকদের সুফল হবে এই আশ্বাস দিয়ে কৃষক বিল আনা হয়েছে এবং তা আইনে পরিণতি পেয়েছে। এই সুফলের লোভে কৃষক প্রলুব্ধ না হয়ে পথে নেমেছেন। যারা এই বিলে 'লাভ হবে কৃষকদের' বলে চিৎকার করছেন তাঁদের স্মরণ করাতে হয় আবদুল সামাদ মিয়ার লোককবিতা। যেখানে কবি বলেন,
'পাট আসিয়া যখন দেশেতে পৌঁছিল
পশ্চিমা এসে তখন দখল করিল
এখন তাদের হাতে দেখ পয়সা হইল
বাঙালীরে তারা দেখ কিছু না বুঝিল
না পাইত খাইতে যারা ছাতুয়ার গুঁড়া
বালামের ভাত খায় বুঝে দেখ তারা
না মিলে বাঙালীর রেঙ্গনের ভাত
বোবা হয়ে গেল দেখ বাঙালীর জাত।'
যখন সারা ভারতে নীলচাষের কারণে নীলকর সাহেবদের শোষণে কৃষক সমাজ দিশেহারা, তখন ১৮২৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর কলকাতার টাউন হলে কলকাতার বাবু আর ইংরেজ রাজকর্মচারীদের সামনে বক্তৃতা রাখলেন রাজা রামমোহন রায় ও প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর। এই মহতী সভায় রাজা রামমোহন রায় বললেন, বাংলা এবং বিহারের বিভিন্ন জেলা ঘুরে আমি দেখেছি, যে সব চাষিরা নীলচাষের কাজে যুক্ত, তাদের অবস্থা অন্যদের চাইতে অনেক ভালো। এই নীলকররা এ দেশের মানুষদের জন্য অনেক মহানুভবতার পরিচয় রেখেছেন। কী মহানুভবতার পরিচয় রেখেছিলেন নীলকররা তা অবশ্য জানা যায় না। রাজার এই বক্তব্যে উপস্থিত ইংরেজরা সাধুবাদ জানায়।
এরপর বক্তব্য রাখেন প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর। তিনি বলেন, বিভিন্ন জেলায় আমার বেশ কিছু সংখ্যায় জমিদারি আছে। আমি দেখেছি ব্রিটিশদের বসবাস এবং নীলচাষ করার মধ্যে দিয়ে এ দেশের মানুষের প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়েছে। এতে করে জমিদারদের সম্পদ ও প্রতিপত্তি বেড়েছে, আর যেখানে নীলচাষ হয়নি সেখানকার তুলনায় যেখানে নীলচাষ হয়েছে সেখানকার চাষিদের অবস্থার কিছুটা হলেও উন্নতি হয়েছে।
নীল ও পাট চাষ করে কৃষকরা সত্যি সত্যি ফসলের দাম পাবেন কিনা এই চিন্তা তাঁদের ছাড়ছিল না। কৃষকরা কাজের উপযুক্ত দাম কোনওদিন কী পেয়েছেন? এ প্রশ্নের পাশাপাশি তাঁদের জমির অধিকার নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। খাজনা, বীজ, চাষ, বুনন, গাছ কাটা ও দাদনের ট্যাক্স বাবদ খরচখরচা করে বিঘে প্রতি আট থেকে বারো বান্ডিল নীল হয়। আট বান্ডিল নীলের সব খরচখরচা বাদ দিয়ে হাতে আসে মাত্র এক টাকা। বারো বান্ডিলে পাওয়া যায় মাত্র দু টাকা। চাষ ভালো না হলে দাদনের টাকাও শোধ হয় না। নীলকর সাহেবদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ বাংলার চাষি ঘুরে দাঁড়ায়। ছ' ফুটের শিকল দিয়ে নীলগাছ মাপা হবে। তারপর বান্ডিল হয়ে ওজনদারদের হাতে পড়ে আর সেখানেই মার খেতে হয় রায়তীদের। কিন্তু মুখে রা কাটার উপায় নেই। দিনের পর দিন এই অবিচার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে একদিন গর্জে উঠলেন বাংলার কৃষক চৌগাছার গ্রামে। ধিক ধিক করে জ্বলা আগুন প্রাণ পেল দিগম্বর বিশ্বাস ও বিষ্ণুচরণ বিশ্বাসের নেতৃত্বে। শুরু হল নীল বিদ্রোহ।
মহাজন ও জমিদারদের অত্যাচার থেকে বাঁচতে এক সময় এ দেশের সাঁওতাল কৃষকরা যে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন, সে বিষয়ে জানা যায়, '১৮৫৫ খ্রীষ্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গের সাঁওতাল কৃষক মহাজন ও জমিদার গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে এক লক্ষাধিক সৈন্যের এক বিরাট বাহিনী গঠন করিয়া সমতল ভূমির উপর দিয়া কলিকাতার দিকে অভিযান করিয়াছিল।' উদেশ্য ছিল, বড়লাটের কাছে তাঁদের উপর মহাজনদের অত্যাচারের প্রতিবাদ জানানো। কিন্তু এই কৃষক বিদ্রোহ দমনের জন্য ব্রিটিশ সরকার মিলিটারি নামায়। এই বিদ্রোহ প্রথমে মহাজন ও জমিদারদের শোষণ অত্যাচারের বিরুদ্ধে থাকলেও পরে তা সিঁধু, কানু, চাঁদ ও ভৈরবের নেতৃত্বে সাঁওতাল পরগণার স্বাধীনতা আন্দোলনের লড়াইতে পরিণত হয় । এই সাঁওতাল বিদ্রোহে রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের কপালে ভাঁজ পড়ে যায়। তাই ইংরেজ বাহাদুর যাতে এই বিদ্রোহীদের কড়া হাতে দমন করে, এই অভিপ্রায়ে শ্যামাচরণ সেনের 'সমাচার সুধাবর্ষণ'এ লেখা হয় 'সন্তালকুলের সর্বনাশ হউক'।
সাঁওতাল বিদ্রোহের আগে ১৮৪৫ সালে মারোয়াড়ী মহাজনদের শোষণ ও অত্যাচারে ভীল কৃষকরা বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। এই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন ভাংগ্রিয়া নামে এক ভীল সর্দার। এই বিদ্রোহে তাঁরা কোনও মহাজনকে হত্যা করেননি। শুধু তাঁদের নাক কান কেটে ছেড়ে দেন। এই বিদ্রোহের ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে মারোয়াড়ী মহাজনরা রাজস্থানের গ্রামাঞ্চল ছাড়েন।
ভীল কৃষকদের বিদ্রোহের পর আরেকবার কৃষকরা বিদ্রোহ ঘোষণা করেন ১৮৫২ সালে বোম্বাই প্রদেশের শোলাপুরে। শোলাপুরের গ্রামাঞ্চল মহাজনদের শোষণের মুক্তাঞ্চল ছিল। এই মহাজনদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল মারোয়াড়ী মহাজনরা। তাঁদের কাছে ঋণের দায়ে বহু কৃষক সর্বস্বান্ত হয়েছিলেন। এই মহাজনদের ঋণের ফাঁসে ক্রমাগত জড়িয়ে ভিটে মাটি ঘরবাড়ি খুইয়ে একদিন তাঁরা বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন। সর্বহারা কৃষকদের ভয়ঙ্কর আক্রমণের মুখে মারোয়াড়ী মহাজনরা পালিয়ে যান। পরে পুলিশের সাহায্যে আবার গ্রামে ফেরেন। পুলিশ বহু কৃষককে গ্রেফতার করে। গুজরাটেও মহাজনদের শোষণ ও অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচতে কৃষকেরা মহাজনদের আক্রমণ করেন। তাঁদের আক্রমণে অনেক মহাজন পঙ্গু হয়ে যান। তাঁদের লাঠির আঘাতে প্রাণও হারান বহু মহাজন।
মহাজন বা জমিদারদের অত্যাচার বন্ধ হলেও কৃষকদের উপর শোষণ ও অত্যাচার কিন্তু থামেনি। শুধু নামের পরিবর্তন হয়েছে মাত্র। মহাজন গিয়ে ফড়েরাজ কায়েম হয়েছে। ফড়েরাজের পিছনে থাকে রাজনৈতিক মদত। ফলে, ফসলের সঠিক দাম তারা কোনদিনও পান না। এখন নতুন কৃষি বিলে ফড়েদের হাত থেকে বেঁচে কোট-প্যান্ট পরা কর্পোরেট বাবুদের হাতে পড়ে তাদের জীবন কি আদৌ সুখের হবে? আবার নতুন জালে জড়িয়ে কৃষকরা আত্মঘাতী হবেন না তা কে বলতে পারে! অথবা, প্রবল বিদ্রোহেও ফেটে পড়তে পারেন।
লেখক প্রাচীন বাংলার গ্রামীণ ছড়ার উল্লেখ করে করে উনবিংশ শতাব্দর কিছু কৃষক বিদ্রোহের ছবি এঁকেছেন। তবে তাঁর ঘরের কাছেই 'নারকেলবেড়ের জঙ্গের' উল্লেখ করলে ভালো লাগতো। ১৮৩১ সালের নভেম্বরে অন্ত্যজ রায়তীরা তিতুমির, গোলাম মাসুদের নেতৃত্বে বাঁশের কেল্লাকে কেন্দ্র করে তদানিন্তন ব্রিটিশসেবী জমিদারকুল ও ইংরেজ ম্যাজিষ্ট্রট, পুলিশকে যথেষ্ট বেগ দিয়েছিল। অবশেষে বিদ্রোহীদের দমন করতে বারাকপুর থেকে সেনাবাহিনী আনাতে হয়েছিল। নদীয়ার ম্যাজিষ্ট্রেট আলেকজান্ডারের হেনস্তা প্রসঙ্গে,
ReplyDelete"সাহেবের বাঁচা ভার, বে একতার কল্লে কাজে কাজে।
জানে বাঁচ যদি, সাহেব পলাও হাতি চোড়ে।।
সাহেবের হল ভয়, অতিশয়, এসব দাড়া দেখে।
ফকিরের বুজরুগী আছে, কাজ কি হেথা থেকে।।
হাতিতে হয়ে সর, ম্যেজিষ্টার নদী হল পার।"