মুক্তির স্বাদ
সিদ্ধার্থ বসু
আজকের পৃথিবীতে বর্ণ বৈষম্যের লাগাতার প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দেশেও ঢেউ উঠেছে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের। তাদের বিচার বোধের উপর একটা ধর্মীয় মোড়ক লাগিয়ে এমন প্রচার শুরু হয়েছে যেন এটাই ভারতবর্ষের আদর্শ। সেই আদর্শ ভারতের লক্ষ্যে পৌঁছনোর জন্য লাগাতার প্রচারে ব্যস্ত মিডিয়াওয়ালারা। ফলে, দেশ জুড়ে চলেছে দলিত, নিম্নবর্গ ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের উপর নানা ভাবে লাগাতার আক্রমণ। ভারতবর্ষে এই আক্রমণ যে নতুন, তেমনটা কিন্তু নয়। আগেও ভারতবর্ষে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের দাপট ও অত্যাচার দলিত, পিছড়েবর্গ ও সংখ্যালঘু মানুষদের উপর অব্যাহত ছিল। তার প্রমাণ মেলে ইতিহাসের পাতায়, লেখায়।
আজ যেমন দেশ জুড়ে আওয়াজ উঠেছে ‘ব্রাহ্মণ্যবাদ সে আজাদী’, ‘মনুবাদ সে আজাদী’, ঠিক তেমনই ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে নিচুতলার মানুষ সেদিন ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিবাদী হয়েছিল। ব্রাহ্মণ্যপন্থীরা তাদের প্রতিপত্তি বৃদ্ধির জন্য জনসাধারণের উপর যে লাগামছাড়া অত্যাচার শুরু করেছিল, তার হাত থেকে পরিত্রাণ পেতে তারা ধর্মঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করে যা জানায় তা জানা যায় 'ধর্মপূ বাজারে জাবিধান' গ্রন্থে:
মনেতে পাইয়া মর্ম সবে বলে রাখ
তোমা বিনে কে করে পরিত্রাণ।
এইরূপ দ্বিজগণ করে সৃষ্টি সংহরণ
এ বড় হইল অবিচার।
এই অত্যাচার ও উৎপীড়নের কথা বৈকুণ্ঠে পৌঁছল তাদের কাতর প্রার্থনার মধ্যে দিয়ে। জনগণের এই অবস্থার কথা শুনে ধর্মঠাকুর আর নিশ্চিন্তে বসে থাকতে পারলেন না। ব্রাহ্মণদের অত্যাচারের হাত থেকে নিপীড়িত মানুষকে বাঁচানোর জন্য তিনি যবন বা মুসলমানের রূপ ধরে পৃথিবীতে অবতরণ করলেন:
বৈকুণ্ঠে থাকিয়া ধর্ম মনেতে পাইয়া মর্ম
মায়ারূপে হইল খনকার
ধর্ম হইলা যবনরূপী শিরে পরে কাল টুপি
হাতে ধরে ত্রিকষ কামান।
চাপিয়া উত্তম হয় দেবগণে লাগে ভয়
খোদায় হইল এক নাম।
ব্রহ্মা হইল মোহাম্মদ বিষ্ণু হইল পেগম্বর
মহেশ হইল আদম
গনেশ হইল গাজী কার্তিক হইল কাজী
ফকির হইল মুনিগণ।
তেজিয়া আপন ভেক নারদ হইল শেখ
পুরন্দর হইল মৌলানা।
চন্দ্র সূর্য আদি যত পদাতিক হইয়া শত
উচ্চস্বরে বাজায় বাজনা।
পদ্যটির এই অংশ থেকে পরিষ্কার, ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের হাতে বৌদ্ধ ও নিম্নবর্ণের মানুষেরা অত্যাচারিত হয়ে তাদের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্যে নিরুপায় হয়ে দৈবশক্তির স্মরণাপন্ন হয়।
আবার অন্য স্থানে জাতের নামে যে বজ্জাতি, অর্থাৎ জাতপাতের ধুয়ো তুলে মানুষকে নির্মম হত্যার ঘটনা যে ভাবে আজকের সভ্যসমাজের চোখের সামনে ঘটে চলেছে দিনের পর দিন, সেই জাতপাতের বিরুদ্ধে হাকিমের সামনে কৃ্ষ্ণপুরের কৃষ্ণদাসী বৈষ্ণবীর গানে নতুন সুর শোনা যায়:
এই পাগলের দলে – এই দলে কেউ এস না রে ভাই,
কেউ এস না, বস’ না, কেউ ঘেষ না গায়।
এই দলেতে এলে পরে- জাতের বিচার নাই।
এই ভাববাদী চিন্তায় যে দলগত সম্প্রীতির চিত্র পাই তাই ভারতবর্ষের চিরকালীন ঐতিহ্য। তাকে আজ পদে পদে প্রতি মুহূর্তে লাঞ্ছিত হতে হচ্ছে। কীরকম ছবি ছিল আমাদের দেশে তার একটা সুন্দর ছবি পাওয়া যায় এই গানে:
এই দলেতে এলে পরে জাতের বিচার নাই।
এক পাগল উড়িষ্যাতে, চণ্ডালেতে আনে অন্ন ব্রাহ্মণেতে খায়।
এক পাগল চিত লাইতে শম্ভুচাঁদ গোঁসাই।
সে যে হিন্দুর গুরু, ব্রাহ্মণের শিব, মোসলমানের সাঁই।
আসল কথাটা সম্প্রীতি। সবাইকে নিয়ে বাঁচা, সবাই দেশমাতৃকার সন্তান, কোনও ধর্মীয় ভেদাভেদ নয়। সবার নিজের নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী যে যার ধর্ম পালন করবে, এটাই ভারতের মূল মন্ত্র। আজ সেখানে বিপদের সঙ্কেত। নিজের নিজের ধর্মাচারণ যেন অপরাধ। আবার কেউ যদি এসবের মধ্যে না থাকে তাতেই বা কি? এমন কথাও শোনা যায় সেই সময়:
জো হম নহীঁ গুজরাতে তুক্ষ্ম কৌঁ ক্যা ভাই।
সিরি নাহীঁ কুছ বংদগী কহু ক্যঁ ফুর মাঈ।। ( দাদূ / ক্ষিতিমোহন সেন )
অর্থাৎ, আমি যদি পূজা বা নেমাজ না করি, তবে হে ভাই, তোমার তাতে কী? / মাথা আপনি প্রণত না হয়, তবে বলো, কেন তোমার কথায় করি প্রণাম? এটা ভারতের আজকের ছবি মনে করিয়ে দেয় নাকি?
সেই সঙ্গে স্মরণ করিয়ে দেয় আজাদীর, স্বাধীনতার। মুক্তির আস্বাদ পেতে মানুষ ঘোষণা করেছিল:
অপনে সে তীঁ কাজ হৈ ভাবৈ তি ধরি মৈঁ জাই।
মেরা থা সো মৈঁ লিয়া লোগৌঁ কা ক্যা জাই।। ( দাদূ / ক্ষিতিমোহন সেন )
যে দিকে আমার খুশি আমি যাইব, আমার সঙ্গেই আমার প্রয়োজন। যা আমার ছিল তা আমি নিলাম, লোকের তাতে কি আসে যায়? এ কথার উৎস যে অত্যাচারের ফল তা বোধহয় বলার অপেক্ষা রাখে না।
আপন আপন বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধাশীল যেমন হব, তেমনি অন্যের বিশ্বাস ও তার আদর্শ, স্বাধীনতার প্রতিও সমান শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। সেই চিন্তাই আজকের ভারতে সব চেয়ে প্রয়োজন নয় কি?
Very stereotype write up.
ReplyDelete