Friday, 6 March 2020

মুদ্রা যখন ডিজিটাল

ডিজিটাল জগৎ ও তার মুদ্রা
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য

(দেশের শীর্ষ আদালত ক্রিপটোকারেন্সির ওপর ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নিষেধাজ্ঞা বাতিল করেছে। প্রচলতি মুদ্রার পাশাপাশি ডিজিটাল মুদ্রাও এবার হয়ে উঠবে যাপনের অঙ্গ। মুদ্রার ধারণাই এবার পাল্টাতে চলেছে ব্লকচেন ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সার্বিক আলোকে। সদ্য প্রকাশিত 'আশায় বাঁচে চাষা: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও একুশ শতকের রাজনৈতিক অর্থনীতি' গ্রন্থে এ নিয়ে আলোচনার কিছু অংশ এখানে দেওয়া হল।)
  
আরও একটি প্রবণতা বহু কিছুর ঝুঁটি ধরে নাড়া দিতে চলেছে। তা হল সোশ্যাল মানি বা ‘সামাজিক মুদ্রা’র ধারণা। এতদিন আমরা সোশ্যাল মিডিয়ার কথা আলোচনা করেছি। এখন উঠে আসছে সোশ্যাল মানি নামক এমন এক আর্থ-সামাজিক ধারণা যা ইতোমধ্যে বাস্তব রূপও ধারণ করেছে। ক্রিপ্টোকারেন্সি-র একটা ধারণা আমরা পেয়েছি। বিটকয়েন-এর কথাও শুনেছি। এও শোনা যাচ্ছে, ফেসবুক অনতিবিলম্বেই আনতে চলেছে লিবরা নামক এক ডিজিটাল মুদ্রা। এর বাস্তব প্রভাব ও প্রতিপত্তি কী হবে তা দেখার আছে অবশ্যই। অবশ্য, বাঘা বাঘা কর্পোরেটরা এই লিবরা-র আগমনের পিছনে দাঁড়িয়েছে। যেমন, পেপাল, উবের, ভিসা, মাস্টারকার্ড, এমনকি ভোডাফোন-ও। কিন্তু সোশ্যাল মানি-র ধারণা কিছুটা ভিন্ন। যেমন যুগ পরম্পরায় মিডিয়ার ধারণা বদলেছে- যা আগে ছিল মালিকানা নিয়ন্ত্রণাধীন ও ওপর থেকে নির্গত এক প্রক্রিয়া, এখন এসে দাঁড়িয়েছে পরস্পর-মুখি, খোলামেলা, অংশীদারিত্ব অবয়বে, যাকে আমরা বলি সোশ্যাল মিডিয়া- ঠিক একইভাবে লক্ষ লক্ষ মুক্ত মুদ্রা অচিরেই আমাদের স্মার্ট ফোন জুড়ে চলাফেরা করবে। মুদ্রাও হয়ে উঠবে সোশ্যাল, সামাজিক। বলা হচ্ছে, এই ধরনের ডিজিটাল মুদ্রা সরকারি বা কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের কব্জা মুক্ত এমন এক অস্তিত্ব যা বিবিধ বাজার ও সামাজিক কৌমের ওপর ভরসা রেখেই চলাচল করবে। দাবি, স্মার্ট ফোন ও নেট দুনিয়া মারফত এই মুদ্রা শুধু লেনদেনকে সহজতর করবে না, বরং ব্যক্তি ও নানাবিধ সামাজিক গোষ্ঠীকে নানান ভাবে সক্ষম করে তুলবে। নানা ধরনের অ্যাপ ও যোগাযোগ মাধ্যমে যেভাবে মানুষে মানুষে সংযোগ রাষ্ট্র, জাতি ও দূরত্বের বাধাকে অতিক্রম করে সর্বব্যাপী হয়ে উঠছে, তাতে খুব স্বাভাবিক, এই ধরনের বহু সামাজিক উদ্যোগ ও প্রয়াসের বাস্তব আখ্যান তৈরি হবে। ইতিমধ্যেই এই ধরনের স্থানীয় মুদ্রা, নানান উদ্দেশ্যে বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলে সচল আছে। যেমন, জার্মানিতে চলে Chiemgauer- যা স্থানীয় উদ্যোগপতিদের দ্বারা স্থানীয় ভিত্তিক কর্মসংস্থান বাড়ানোর লক্ষ্যে কাজ করে। জাপানে চালু আছে Fureai Kippu, যা এক ধরনের সহমর্মিতামূলক মুদ্রা বয়স্ক নাগরিকদের সহায়তা করার উদ্দেশ্যে।১০  

মুদ্রার প্রচলন ও তার ওপর আস্থা নির্ভর করে মানুষের পরস্পরমুখি সম্পর্ক ও লেনদেনের ওপর। নেপাল, ভূটান, বাংলাদেশ সীমান্তে উভয় দেশগুলিতেই সীমানা পেরিয়েও প্রতিবেশী বিদেশি দেশগুলির মুদ্রা কার্যকরী ভাবে বেশ সচল ও কার্যকর। এর কারণ, মানুষ তার লেনদেনের সুবিধার্থে ও পরস্পর-বাণিজ্যিক স্বার্থে এক ধরনের আস্থাকে ভরসা করেই এমত লেনদেনে সহমত হয়েছে। ঠিক একইভাবে বহু জায়গায় সামাজিক সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে নানাবিধ বিনিময় মাধ্যম বেশ চালুও আছে। ভার্চুয়াল দুনিয়ায় এক সর্বব্যাপী সংযোগ ও বিনিময় এই ধরনের সামাজিক ঐক্যমতের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা কোনও মুদ্রাকে যে নির্মাণ করে নিচ্ছে বা নেবে, তা অত্যন্ত স্বাভাবিক। মিডিয়া যদি সোশ্যাল হয়ে উঠতে পারে, মুদ্রাও অচিরে সেই পথেই এগোবে। আর তা হবে এক যুগান্তকারী ঘটনা। তা শুধু রাষ্ট্র ও কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের খবরদারিকেই ভাঙ্গবে না, রাষ্টের বিকল্প হিসেবে নেট দুনিয়াকে কেন্দ্র করে নব-উত্থিত কেন্দ্রীয় টেক-দৈত্যদের প্রভাবও হয়তো খর্ব করবে।  

কিন্তু এই সমস্ত প্রয়াসগুলি ও তাদের সম্ভাবনাসমূহ নির্ভর করছে কিছু জটিল আধারের ওপর যার ভবিষ্যৎ চলাচল সম্পর্কে অত নিশ্চিত করে বলাটা বেশ কষ্টসাধ্য। আমরা যত কিছু সম্ভাবনাময় উপাদানের কথা বলছি অথবা আয়ত্ত করার চেষ্টা করছি আগামী গতিময় পথকে, আমাদের বুঝতে হবে, এই সামগ্রিক উদ্যোগগুলি কিন্তু দাঁড়িয়ে আছে এমন এক আধারের ওপর যার ভিত্তি হল বড় পুঁজি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও যোগাযোগ-প্রযুক্তি। এই আধার হল আসলে এক সুবিস্তৃত যোগাযোগের ভূমি বা বলা ভাল, এক অন্তহীন সামাজিক বাজার যেখানে অযূত ক্রেতা বা মানুষ এসে ভীড় করেছে। এ তাবৎ এত বড় ভূমি এখনও পর্যন্ত বিশ্ব ইতিহাস, দেখা তো দূর অস্ত, কল্পনা পর্যন্ত করে উঠতে পারেনি। গত দু-এক দশকের সমস্ত প্রয়াস ও কর্মোদ্যোগ কিন্তু দাঁড়িয়ে আছে ওই কতিপয় বিশালাকার প্রাযুক্তিক-দৈত্য নির্মিত এক অতিকায় বাজারের ওপর ভর করেই। সে আমরা তাকে সোশ্যাল মিডিয়াই বলি বা অন্যথায় অন্য কোনও বিনিময়ের প্ল্যাটফর্মআমাদের সোশ্যাল মিডিয়ার আদিগন্ত প্ল্যাটফর্ম তো এখনও ট্যুইটার, ফেসবুক, লিঙ্কডিন বা হোয়াটসআপ, আর বিনিময়ের অন্যতম দোকানদারি অ্যামাজন, ফ্লিপকার্ট, তথ্য ঘাঁটার পরিসর গুগল বা উইকিপিডিয়ানিজেদের যা কিছু, তা এদের ওপর ভর করেই। অথবা, কিছু অ্যাপ, যা নির্দিষ্ট কিছু কাজ ও উদ্যোগের সম্ভাবনা বা কার্যক্রম তৈরি করে। এই সবের ওপর সওয়ারী হয়েই তবে না ভুবন জয়ের চিন্তা। তাই কেউ কেউ বলেন, যতই বাঘের পিঠে চাপুন না কেন, এর একটা অন্যদিকও আছে। তা হল, দৈত্য যত বড় হয় তার খুঁটিনাটি নজর তত সঙ্কুচিত হয়। তাই আপনি যদি এদের ঘাড়ে চড়েও বেড়ান কি দু-পাইস কামিয়েও ফেলেন, এদের কিচ্ছুটি যায় আসে না; আর আপনি আদার ব্যাপারী, জাহাজের খোঁজের আপনার প্রয়োজনটাই বা কী? কিন্তু সম্ভবত, এই কথাটি আজকের যুগে বলা যাবে না। কারণ, খুঁটিনাটি নজর করার জন্য দৈত্যের আছে সেন্সর ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, যারা আপন নিয়মেই খুব সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কাজ করে চলে, অর্থাৎ, নজরদারি চালাতে পারে। তবুও প্রশ্নটা অন্যত্র। আরও একটু জটিল মাত্রায়। হয়তো, দৈত্য বহু কিছুকে জেনে-বুঝেও উপেক্ষা করতে পারে। কারণ, তার অন্য এক অভিলাষ রয়েছে। সে অভিলাষ হল, বিশ্বের যাবতীয় যা কিছু, বিশেষত তথ্য, তাকে নিজের আওতায় আনা, পর্যবেক্ষণে রাখা, বিশ্লেষণ করা ও তার রকমফের ফলাফলকে নিজের কাজে লাগানো বা তা নিয়ে লাগাতার এদিক-ওদিক বাণিজ্য করা এই তার আধিপত্য-বিস্তারের প্রধান সড়ক। তাই তার পক্ষে আবার কোনও কিছুকেই উপেক্ষা করাও সম্ভব নয়। সে অনায়াসে গিলে ফেলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ছোট কারবারীদের।

No comments:

Post a Comment