Monday 2 March 2020

মধ্যবিত্ত ও সোশ্যাল মিডিয়া

ধর্ম ভেদাভেদ বিষবাষ্পে মধ্যবিত্ত আমরা কেউ কেউ ও সোশ্যাল মিডিয়া
উত্তান বন্দ্যোপাধ্যায়

বড় বড় রাজনৈতিক চালের ও জালের  খপ্পড়ে আমরা যারা আদার ব্যাপারী তারা পড়ব কেন! আরএসএস কী বলছে বা তাদের সামনের ও দূরের অ্যাজেন্ডা কী এটার জন্য আমাদের কোনও চুঁনোপুঁটির কাছে কেন নির্ভর করতে হবে বা কেন ওইদিকে যাব বা মন দেব। দরকারে তাদের কোনও তাত্ত্বিক লোকের কাছে যাব, তাদের কোনও লেখাপত্তর বই পত্রিকা সংগ্রহ করে নিজে জ্ঞান নেব। ইংরেজিতে ফটর্-ফটর্ শিখতে গেলে প্রজাতন্ত্রী টিভির বক্কাবাজি-ধমকবাজি  শুনব, মাওবাদীদের কথা জানতে গেলে তাদের পত্র-পত্রিকার খোঁজ করব, ইসলামী জেহাদিদের কথা কী তা জানতে হলে খোঁজ নেব কোথাও কোনও লাইব্রেরিতে তাদের কোনও পত্র-পত্রিকা থাকলে।

তো, আমরা এইসব গুরুত্বপূর্ণ লোকজন নিজেদের  মধ্যে কেন এইগুলো নিয়ে থোড়-বড়ি-খাড়া নিয়ে ঠ্যাসাঠ্যেসি করব বা ভার্চুয়াল দাঙ্গাসম দূষণ চালাব? আমরা তো কারও কোনও কাজেও লাগছি না। শুধুই খাবারের পরে মুখশুদ্দির জন্য এসব করা? নাকি কোনও স্বার্থ আছে!  তো, এবার তাহলে আমরা কী করব! সোশ্যাল মিডিয়াকে সুবিধা করে আমরা আমাদের বদামি ও ইতরামি করেই যাব, করেই যাব, করেই যাব।

কিন্তু মশাই!! সবাই সব জানতে পারছে, বুঝতে পারছে। প্রথম প্রথম বোঝা যেত না। এখন বোঝা যাচ্ছে। সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত কারণে অনেকেই আমরা দুনিয়াটাকে এক্সট্রাপোলেট করি। আমরা ঝগড়া করি, বা, তবু সম্পর্ক রাখি- অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে যে এটা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত কারণ বা স্বার্থ‌ে।  কিন্তু এই ব্যক্তিগত প্যারামিটারটা কয়েকজনের। স্বতঃস্বারিত নয়। তাই সেটাকে তারা সার্বজনীন করার চেষ্টা করে, কিন্তু এই অ্যাজেন্ডার কথাটা মুখে বলে না। এখন হয় কী, দীর্ঘদিন ধরে একই ধরনের ব্যবহার-ঘর্ষণে এগুলো আস্তে আস্তে উপরিতলে উঠে আসে। আসতে হবেই।
ধরুন একজন বামপার্টি ভোটদানকারী মনস্ক কোনও মানুষ। সে বামপ্রেমী, জ্যোতি বসু প্রেমী, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সদ্চরিত্র বলে স্বস্তি লাভ করেন। কিন্তু মুসলমান বিদ্বেষী। কোনও ক্ষমতাবান মুসলমান বলে নয়, সে গরিব মুসলমান হলেও। রঙের মিস্তিরি, রাজ মিস্তিরি হলেও। কেন? কারণ হিসেবে ভাবতে গেলে তখন অনেক কারণ পাবেন হয়তো। যেমন -
১) তারা (মুসলমানেরা)পূর্ববঙ্গে জোর করে হিন্দু নিধন করে বাদবাকি হিন্দু মানুষগুলোকে উচ্ছেদ করে উদ্বাস্তু করে এ দেশে পাঠিয়েছে (অথচ, অদ্ভূত দেখুন -  এই দেশের এপার বাংলার আদি বাঙালিও এমন আছেন যারা হিন্দু হলেও বাঙাল বিদ্বেষী। কেন এই মানসিকতা? যেহেতু বাঙালেরা খ্যেদানি খেয়ে এ দেশে এসে এখানে ওখানে জোর করে বেআইনি কলোনি করে বসবাস করতে শুরু করেছে এবং এ দেশের সম্পদে ভাগ বসিয়েছে, এদেশীয় ঘটিরা তাই(!) অবদমিত ও বিরক্ত হয়েছে- এই বয়ান)
২) জোর করে মুসলমানেরা ধর্মান্তরিত করেছে।
৩) তারা মন্দির ধ্বংস করেছে .... এইসব...

আর এ দেশের মুসলমানেরা কেন অপছন্দের হিন্দুদের কাছে? সাধারণ বয়ানগুলো কী কী!
যেমন -
১) তারা নোংরা। গা দিয়ে বোঁটকা গন্ধ বেরোয়।
২) তারা বিছানায় বসে ভাত খায়, এঁটো মানে না।
৩) তারা আইন মানে না - একটা বাইকে বা স্কুটারে চারজন যায়, হেলমেট পরে না।
৪) ইন্ডিয়া হারলে রাজাবাজারে বা খিদিরপুরে বা মেটিয়াবুরুজে পাকিস্তানের ফ্ল্যাগ ওড়ায়
৫) ওরা গরু খায়।

যেটা বলতে মুখে বাধে ও মনে মনে পোষণ করা হয় তা হল, ওরা গরিব। ওরা অশিক্ষিত। ওদের মাথা মোটা।  ওরা দুর্বৃত্ত। ওরা দুর্বিনীত। ওরা দাঙ্গাবাজ। আস্তে আস্তে এই কথাটা ঘুরপাক খায় ও নির্মাণ হয় যে ইসলাম ধর্মটাই হিংসার।
স্বাভাবিকভাবেই একটা এইরকম সংস্কৃতি বা এইরকম দীক্ষায় নিপাট ছাপোষা মধ্যবিত্ত বাঙালি বাম ভোটার মানুষকেও এইসব সুড়সুড়িগুলো দিয়ে কাৎ করে দেওয়াটা  কঠিন ব্যাপার নয় যদি তারা তথ্য ও ইতিহাস সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবহিত না হয়ে থাকেন। তারপর তো আছেই বামপার্টির ভক্ত বলে সরকারি পার্টির সায় নেই বলে লোকাল স্তরীয় খাবলাখাবলি লড়াই ও আক্রোশ ও বামেদের নিজের নাক কেটে পরের যাত্রাভঙ্গ করে ভোটব্যাঙ্ক খুইয়ে ধাঁ। এ যেন এক মেটান্যারেটিভ মহাদার্শনিক সিদ্ধান্ত ও 'দ্যাখ কেমন লাগে' প্র্যাকটিশ- এখানেই হিন্দুত্ববাদীদের ইউএসপি। না হলে যেখানে তারা পোলিং এজেন্টই দিতে পারে না, যেখানে তাদের সংগঠন নেই সেখানে তারা এতগুলো সিটে জিতে গেল কী করে? মূল ক্ষেত্রটা এটাই। এই সুড়সুড়িটাই (সুবিধা ) ধর্ম নিয়ে সুড়সুড়ি দিয়ে ধর্মীয় নামি রাজনৈতিক দলগুলো ব্যবহার করে। আসলে মূল কারণ কিন্তু ক্ষমতা। আর ধর্ম জিগির কিন্তু কৌশল। তাদের তাই সব থেকে বড় শত্রু কে? সেক্যুলার ও বামেরা। স্বাভাবিক ভাবেই। আবার দেখুন এই সেক্যুলার ও বামেরাও কম ভেজালের নয় - তার জন্যই তো তারা হিন্দু হিন্দু হিন্দু হিন্দু করে করেকম্মে খাচ্ছে। এই তো ব্যাপার !

আবার প্রথম কথায় আসি। আমরা এদের বা এইসব রাজনৈতিক দলগুলো বা তাদের স্বার্থের অ্যাজেন্ডা নিয়ে কেন চলব? কাদের কে বোঝাচ্ছি? বার্নাড শ বলেছিলেন,  কোন অ্যাডাল্টকে কখনও কনভিন্স করা যায় না। আমি মানবিক, বন্ধুবৎসল হব আর কিছু লোকের রাজনৈতিক বিরুদ্ধ মতবাদের জন‍্য তাকে যতটা পারি গালাগালি দেব, ভিন্নধর্মীদের সব সময় দোষ খুঁজব, নিরীহ মানুষকে নির্যাতন করার জন্য যারা তাল খুঁজব, তবুও কাউকে শান্তি দেব না।

ডেলিবারেটলি যারা জাতধর্ম ভেদাভেদ তুলে অশ্লীল কথা বলেন, তারা নিজেরা নিজেদের বাড়ীতেও সেই সম্মানটুকু রাখেন কি অন্যদের প্রতি? এটাকেই বলে ভ্যয়ারিস্টিক অ্যাটিটিউড। ম্যেসোসিস্টিক এ্যটিটিউড।

তাই ঠিক করুন এসবের মধ্যে পা না বাড়ানো। কোনও উস্কানি নয়। ভার্চুয়ালিটিরও এক কৃত্রিম দাঙ্গাক্ষেত্র তৈরি করে দেওয়া হয়। সে ক্ষেত্রে একদম না উস্কানো। এটাই মনে মনে ঠিক করুন।

পাঁচশ বছর আগে কোন মুসলমান সম্রাট কটা মন্দির ধ্বংস করেছে বলে বা অশোক কলিঙ্গযুদ্ধে কতো মানুষকে খুন করেছে বলে আমি আমার পাশের পাড়ার শান্তপ্রিয় কতকগুলো মুসলমান সহনাগরিকদের নমাজ পড়ার জায়গাটা 'জয় শ্রীরাম' বলে ধ্বংস করতে পারি না।

একটা কথা। এগুলো নিয়ে আলোচনা হতে দিতে চান না কেন ?
১) ভারতবর্ষে কত শতাংশ মুসলমান আছে? ২০১১ আদমশুমারি কী বলে?
২)কত শতাংশ মুসলমান কর্মসংস্থান ও ব্যবসা বৃত্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত তার জনসংখ্যার অনুপাতে? এত কম কেন ? কে দায়ী তার জন্য?

শেষ করি একটি কবিতার খন্ডাংশ সংযোজন করে -

'ধোঁয়ায় ঢাকা বসন্ত আজ
গাইছে না কেউ প্রেমের গান

মানুষ থেকে পাল্টে সবাই
হিন্দু কিংবা মুসলমান।'

No comments:

Post a Comment