Sunday, 25 August 2019

নির্বাচনী সংস্কারের গপ্পো

আশা আশঙ্কার দোলাচল
 সঞ্জয় মজুমদার

পৃথিবীর যে কোনও রাজনৈতিক দল প্রাথমিকভাবে কোনও না কোনও সামাজিক-রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সংকটকে সামনে রেখে আন্দোলন সংগঠিত করে। সংগঠিত আন্দোলনের ঝাঁজ ক্ষমতাসীন সরকারের দ্বারা তথাকথিত নিপীড়িত জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হলে এবং শেষমেশ ভোটের বাজারে প্রয়োজনীয় 'ভোট আদায় বা লুট করতে পারলে' ক্ষমতায় যাওয়া নিশ্চিত হয়। আমাদের দেশও এর ব্যতিক্রম নয়। শয়ে শয়ে বছর ধরে গণতন্ত্রের নামে ঔপনিবেশিক একনায়কত্বকে সহ্য করা ভারতবর্ষ স্বাধীনতার পর থেকেই 'মারি তো গণ্ডার লুটি তো ভান্ডার' নীতিতেই চলছে। নেহেরু-গান্ধী পরিবার, সংঘ পরিবার, দলিত পরিবার, বামপন্থী পরিবার- প্রায় প্রত্যেকেই সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রথম অধ্যায়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট পেয়েছে, তারপর ভোট আদায় করেছে এবং শেষমেশ লুট করেছে। সমস্যার শুরু দ্বিতীয় এবং তৃতীয় পদ্ধতিতে। ভোট আদায় এবং লুট করতে গেলে নীতি বহির্ভূতভাবে অপর্যাপ্ত অর্থের যোগান একমাত্র শর্ত।

কীভাবে অর্থ আসে?

স্বেচ্ছাকৃত দান, ক্রাউড ফান্ডিং, কুপন আর পার্টি পত্র-পত্রিকা বিক্রি, সদস্য সংগ্রহ, স্থানীয় ব্যবসায়ী এবং ঠিকাদারের কাছ থেকে টাকা নিয়ে অথবা সরাসরি প্রার্থীর হাতে ইন-কাইন্ড সুযোগ-সুবিধা এবং কর্পোরেট অনুদান।

অর্থ খরচ হয় কী করে?

দলীয় সংগঠন বিস্তার করার জন্য পরিকাঠামোগত যা কিছু করা দরকার- নির্বাচনী প্রচার মিছিল, খাবার-দাবার, যাতায়াত-ঘোরাঘুরি ও থাকার জায়গা, দলীয় কর্মীদের মাইনে-পত্তর, মুদ্রণ, ডিজিটাল ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে পাবলিসিটি, নির্বাচন চলাকালীন প্রার্থীদের হাতে নগদ, সোনা, মদের বোতল, এবং অন্যান্য সব বিনামূল্যের জিনিসপত্তর যেমন মোবাইল ফোন, টিভি, রেফ্রিজারেটর, কম্বল, সেলাই মেশিন ইত্যাদি দিয়ে। এছাড়া নির্বাচন কমিশনের হাত থেকে বাঁচার জন্য অনৈতিক খরচের নানা উদ্ভাবনীশক্তিও রাজনৈতিক দলগুলো বের করে ফেলেছে। যেমন, প্রার্থীরা পাবলিক ইউটিলিটি বিলের নাম করে কুপন বিলি করে জনগণের মধ্যে। কুপন নিয়ে আনন্দে আত্মহারা হওয়ার কিছু নেই। যদি ভোট দিয়ে ওই প্রার্থীকে জিতিয়ে আনা যায় তবেই কিন্তু কুপন ভাঙ্গিয়ে টাকা পাওয়া যাবে।

নির্বাচনের আগে টাকার উৎস ও খরচের খতিয়ান থেকে স্পষ্ট, স্থানীয় ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে কর্পোরেট দুনিয়া নির্বাচিত সরকারের কাছ থেকে সুযোগ-সুবিধা আদায় করেই ছাড়বে। এই আদায় করা ভোটের অধিকাংশ সুফল কারা ভোগ করবে সেটাও পরিষ্কার। দুর্নীতির প্রথম বীজ সংসদীয় গণতন্ত্রের গোড়াতেই পোঁতা হয়ে গেল। এরপর আসল গাছের গোড়ায় পরিকাঠামো আর পরিষেবার  নাম করে যতই সার দাও আর জল ঢালো, আগাছার গর্ভেই সে সব চলে যাবে। যাচ্ছে যে, সেটা প্রতিদিনের প্রকাশিত খবরে স্পষ্ট। নীতি নিয়ে আর কেউ বড়াই করে না। দুর্নীতি কতটা কমল বা বাড়ল, এর একটা তুলনামূলক আলোচনা চলতে থাকে।

গোদের উপর বিষফোঁড়া, বিগত দু-বছর ধরে চলতে থাকা মোদি সরকারের 'নির্বাচনী সংস্কার' যা আমাদের দেশে নির্বাচন ঘিরে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে আরও বেশি অসুস্থ ও অস্বচ্ছ করে তুলেছে।

কী আছে এতে?

প্রথমত, কর্পোরেট অনুদান। আগে ছিল বিগত তিনটি আর্থিক বছরের অর্জিত লভ্যাংশের (নেট প্রফিট্) ৭.৫ শতাংশ যে কোনও দেশিয় কোম্পানি নির্বাচনী খাতে স্বীকৃত রাজনৈতিক দলকে দিতে পারত। ২০১৭'র ফিনান্স অ্যাক্ট'এ এই ক্যাপটা তুলে দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, কোম্পানির এ ক্ষেত্রে কোনও দায় থাকছে না এই ধরনের অনুদানকে প্রফিট্ অন্ড লস্ একাউন্ট'এ দেখানো। এমনকি কোম্পানির বোর্ড অফ ডিরেক্টরস্'এরও অনুমতির কোনও প্রয়োজন নেই। অতএব ভুতুড়ে কোম্পানি খুলে কালো টাকা খাওয়ানোর এক অভিনব পন্থা।

দ্বিতীয়ত, নাম-গোত্রহীন নগদ দান। যা ২০,০০০ থেকে নামিয়ে ২০০০  টাকায় আনা হয়েছে এবং এর জন্য কোনও রেকর্ড রাখার প্রয়োজন নেই। সিলিং ভ্যালুও হাপিস্। অতএব যত খুশি ২০০০'এর সমষ্টি করা যেতেই পারে। অদ্ভুত অর্থহীন এক পরিস্থিতি। নোটবন্দির ঘোষণা ভারতীয় রাজনীতিকে নেতা-ব্যবসায়ীর গোপন আঁতাত থেকে মুক্ত করতে পেরেছে এমন দাবি ক্ষমতাসীন সরকারও জোর গলায় করতে পারছে না। উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনেই তার প্রমাণ মিলেছিল। ২০১৬-১৭ অর্থবর্ষে আমাদের দেশের ছয়টি জাতীয় স্তরের রাজনৈতিক দলের সংগৃহীত আর্থিক অনুদানের ৪৬ শতাংশ এসেছে নাম-গোত্রহীন উৎস থেকে।

তৃতীয়ত, বিদেশি ফান্ডিং। এখনকার নিয়ম অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন স্বীকৃত রাজনৈতিক দলগুলো বিদেশি কোম্পানির কাছ থেকে নির্বাচনী খাতে অনুদান পেতেই পারে। বেশ ভয়ের ব্যাপার। ভারতের নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে বিদেশি শক্তি অনুদানের নামে যথেষ্ট প্রভাবিত করতে পারে। এবারের ফিনান্স বিলে গুরুত্বপূর্ণ একটি সংযুক্তিকরণ করা হয়েছে। তাতে বলা আছে, যত 'ফরেন ফান্ড' নির্বাচন কমিশন স্বীকৃত রাজনৈতিক দলগুলো ১৯৭৬ সাল থেকে নির্বাচনী খাতে পেয়ে এসেছে, সে সবের কোনওরকম তদন্ত করা যাবে না। বিজেপি এবং কংগ্রেস দুটি জাতীয় স্তরের রাজনৈতিক দল সহ অন্যদেরও মুখের হাসি এবং বুকের ছাতি দুটোই চওড়া হয়েছে। Foreign Contribution Regulation Act (FCRA), 1976'এর সূত্র ধরে নির্বাচন কমিশন নিজেই হৈচৈ শুরু করে দিয়েছে। লাভ হয়নি কিছুই।

চতুর্থত, ইলেক্টোরাল বন্ড। উদারবাদের পরবর্তী যুগে জমি পাওয়াকে কেন্দ্র করে রিয়েল এস্টেট আর ম্যানুফ্যাকচারিং- এই দুটো ক্ষেত্র থেকেই নির্বাচনী খাতে রাজনৈতিক দলগুলোর ভাঁড়ারে সবচেয়ে বেশি টাকা আসছে। নির্বাচনের সময় টাকার বিনিময়ে জমি লেনদেনের ঢালাও অনুমতি রাজনৈতিক নেতারা বিল্ডারদের দিচ্ছেন। ভোটে জিতে এলে সুদে-আসলে ফেরত দেওয়ার পালা। ২০১২ থেকে ২০১৬'র মধ্যে আমাদের দেশের সমস্ত স্বীকৃত রাজনৈতিক দলের সর্বমোট ঘোষিত অর্থ ভাণ্ডারের ৯০ শতাংশ ছিল কর্পোরেট অনুদান। এর উপর ইলেক্টোরাল বন্ডের ধারণাটা নির্বাচনকে ঘিরে দুর্নীতি সংক্রান্ত সব উদ্বেগকে ছাপিয়ে গেছে। একজন ব্যক্তি, কিছু ব্যক্তিকে নিয়ে সমষ্টি অথবা কর্পোরেট স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার কিছু নির্দিষ্ট শাখা থেকে প্রতি মাসের প্রথম দশ দিনে ইলেক্টোরাল বন্ড কিনতে পারে। ১০০০, ১০০০০, ১০০০০০, ১০০০০০০ এবং এক কোটির গুণিতকে এই ইলেক্টোরাল বন্ডের মেয়াদ ১৫ দিন। টাকা দিয়ে কিন্তু কেনার অনুমতি নেই এবং ক্রেতাকে KYC ব্যাংকে জমা দিতেই হবে। নির্দিষ্ট SBI অ্যাকাউন্ট থেকে এরপর রাজনৈতিক দল এই বন্ড এনক্যাশ করে নেয়। আপাতদৃষ্টিতে বিষয়টার মধ্যে কোনও গণ্ডগোল নজরে পড়ে না। একদিকে দাতার নাম প্রকাশ করার কোনও প্রয়োজন নেই কোন রাজনৈতিক দলকে তিনি ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে টাকা দান করছেন এবং অন্যদিকে, রাজনৈতিক দলেরও কোনও বাধ্যবাধকতা থাকছে না কার কাছ থেকে এই পদ্ধতিতে টাকা পাচ্ছেন তা প্রকাশ করার। কিন্তু ডিজিটাল ট্রেইলের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল ঠিক টের পেয়ে যাবে কে কত টাকা দিচ্ছেন। অর্থাৎ, বিরোধী কোনও রাজনৈতিক দলকে আমি ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে নির্বাচনের সময় সাহায্য করতে চাইলেও পারব না। এই ধরনের code of secrecy নিশ্চিত করে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলেরই একমাত্র ইলেক্টোরাল বন্ড সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য জানার অধিকার থাকবে। কেউ চায় না ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলকে চটাতে। ব্যবসার ক্ষেত্রে সেটা আত্মহত্যা ছাড়া আর কিছু নয়। অতএব প্রথম থেকেই গণতন্ত্রের মৃত্যু অনিবার্য। আর, আদর্শ আর নীতি? অট্টহাসি।

ইলেক্টোরাল ট্রাস্টের মাধ্যমে কর্পোরেট দান রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য আদায় করা ২০১৩ সালে তৎকালীন ইউপিএ সরকার চালু করেছিল। ট্রাস্টগুলোর ক্ষমতা ভালোই ছিল। বিভিন্ন দেশিয় কোম্পানির কাছ থেকে আর্থিক অনুদান নেওয়া এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংগৃহীত অর্থ বিতরণ করার দায়িত্ব এদেরই ছিল। তথ্য বলছে, ২০১৭-১৮'এ এইরকম ২২টি নথিভূক্ত ইলেক্টোরাল ট্রাস্টের মোট সংগৃহীত অর্থের ৮৬ শতাংশই ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের পকেটে গেছে। ২০১৬-১৭'এ দেখা গেল, বিজেপি পার্টি তহবিলে নির্বাচনী খাতে সংগৃহীত সর্বমোট আর্থিক অনুদানের পরিমাণ ওই একই সময় জাতীয় স্তরের অন্যান্য পাঁচটি প্রধান রাজনৈতিক দলের সর্বমোট সংগৃহীত অনুদানের থেকে নয় গুণ বেশি। এই তথ্যগুলো খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রমাণ করে, কেন গেরুয়া শিবির নির্বাচনী খাতে আর্থিক অনুদান গ্রহণের সীমারেখা নির্ধারণে ভারতের নির্বাচন কমিশনের যাবতীয় প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। করবে নাই বা কেন? ২০১৯'এর লোকসভা নির্বাচনে ৬০ থেকে ৬৫ হাজার কোটি টাকা নির্বাচনী খাতে খরচা হয়েছে, ২০১৪এ যা ছিল ৩৫ হাজার কোটি টাকা। নির্বাচনের সময় প্রার্থী পিছু নির্বাচন কমিশন যে পরিমাণ বৈধ অর্থ বরাদ্দ করে থাকে, বাস্তব বলছে তাতে কিছুই হয় না। শুধু একজন প্রার্থীর নিজের নির্বাচনী কেন্দ্রে খরচের হিসেব, গোয়েন্দাগিরি করে দেখা যাচ্ছে, আজকের বাজারে প্রায় ১০ কোটি টাকার মতো। অতএব, রীতিমতো বিত্তবান এবং লোকলস্কর সহ বলবান না হলে ভারতের নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করা দিবাস্বপ্নের মতোই শোনায়। সাধারণ সংসারী সৎ এবং খেটে খাওয়া প্রার্থীর পক্ষে আমাদের দেশে রাজনীতি করা এবং ভোটে জিতে আসা সোজাসাপ্টা ভাষায় অসম্ভব। স্বচ্ছতা বা অস্বচ্ছতার প্রশ্নগুলো পাশে সরিয়ে রাখলে, অন্যান্য স্বীকৃত রাজনৈতিক দলগুলোও এই ইস্যুতে একই অবস্থানে যে আছে তা মৌনং সম্মতির মাধ্যমে বুঝিয়ে দিয়েছ। নির্বাচনী বিধি লাগু হওয়ার আগে থেকেই পয়সা রোজগারের এই অভূতপূর্ব সুযোগ প্রায় সোনার কাঠি ছোঁয়ার মতো।

আশার আলো একেবারেই যে নেই তাও ঠিক নয়। নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে কলুষমুক্ত করতে 'স্টেট ফান্ডিং' একটা সমাধান হতে পারে। ইউরোপ আমেরিকা আফ্রিকা এবং এশিয়ার অন্যান্য দেশের নির্বাচনে এটা পরীক্ষিত সত্য। আমাদের প্রধানমন্ত্রী বারেবারেই এই প্রস্তাব বিভিন্ন মহলে রাখছেন। কিছু বিধিনিষেধ এবং পূর্ব শর্ত মেনে নিলে, নির্বাচন কমিশন থেকে শুরু করে বিভিন্ন সরকারি কমিটি এবং কমিশন এই প্রস্তাবে সাড়াও দিয়েছে, যার মধ্যে অন্যতম দুটি হল, প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক পরিকাঠামো যথাযথ রক্ষা করা এবং আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে পূর্ণ স্বচ্ছতা বজায় রাখা। ২০১৭'র জনগণনা অনুযায়ী, প্রায় ১৩৪ কোটির দেশ আমাদের ভারত। ২০১৯'এর লোকসভা নির্বাচনে ৯০ কোটি ভোটারের ১০ কোটিই ছিলেন ১৮ থেকে ১৯ বছর বয়সী, দেশ গড়ার মূল কারিগর হিসেবে যারা কিনা ভবিষ্যতে চিহ্নিত হবেন। ডিজিটাল প্রযুক্তির যুগে এঁরা সবাই আগের প্রজন্মের তুলনায় অনেক বেশি সচেতন এবং তথ্যও রাখেন অনেক বেশি। সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে সমস্ত রকম নির্বাচনী দুর্নীতির খবর এঁদের কাছে খুব সহজেই পৌঁছে যাচ্ছে বিচার-বিশ্লেষণ সহ। কাউকে বোকা ভাবার কোনও কারণ নেই। ভারতের নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে বর্তমান প্রজন্মের কাছে গণতন্ত্রের উৎসব বলব, নাকি হিসাববিহীন অর্থ রোজগারের উৎসব হিসেবে চিহ্নিত করব, জানা নেই।

No comments:

Post a Comment