Sunday, 25 August 2019

নির্বাচনী সংস্কারের গপ্পো

আশা আশঙ্কার দোলাচল
 সঞ্জয় মজুমদার

পৃথিবীর যে কোনও রাজনৈতিক দল প্রাথমিকভাবে কোনও না কোনও সামাজিক-রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সংকটকে সামনে রেখে আন্দোলন সংগঠিত করে। সংগঠিত আন্দোলনের ঝাঁজ ক্ষমতাসীন সরকারের দ্বারা তথাকথিত নিপীড়িত জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হলে এবং শেষমেশ ভোটের বাজারে প্রয়োজনীয় 'ভোট আদায় বা লুট করতে পারলে' ক্ষমতায় যাওয়া নিশ্চিত হয়। আমাদের দেশও এর ব্যতিক্রম নয়। শয়ে শয়ে বছর ধরে গণতন্ত্রের নামে ঔপনিবেশিক একনায়কত্বকে সহ্য করা ভারতবর্ষ স্বাধীনতার পর থেকেই 'মারি তো গণ্ডার লুটি তো ভান্ডার' নীতিতেই চলছে। নেহেরু-গান্ধী পরিবার, সংঘ পরিবার, দলিত পরিবার, বামপন্থী পরিবার- প্রায় প্রত্যেকেই সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রথম অধ্যায়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট পেয়েছে, তারপর ভোট আদায় করেছে এবং শেষমেশ লুট করেছে। সমস্যার শুরু দ্বিতীয় এবং তৃতীয় পদ্ধতিতে। ভোট আদায় এবং লুট করতে গেলে নীতি বহির্ভূতভাবে অপর্যাপ্ত অর্থের যোগান একমাত্র শর্ত।

কীভাবে অর্থ আসে?

স্বেচ্ছাকৃত দান, ক্রাউড ফান্ডিং, কুপন আর পার্টি পত্র-পত্রিকা বিক্রি, সদস্য সংগ্রহ, স্থানীয় ব্যবসায়ী এবং ঠিকাদারের কাছ থেকে টাকা নিয়ে অথবা সরাসরি প্রার্থীর হাতে ইন-কাইন্ড সুযোগ-সুবিধা এবং কর্পোরেট অনুদান।

অর্থ খরচ হয় কী করে?

দলীয় সংগঠন বিস্তার করার জন্য পরিকাঠামোগত যা কিছু করা দরকার- নির্বাচনী প্রচার মিছিল, খাবার-দাবার, যাতায়াত-ঘোরাঘুরি ও থাকার জায়গা, দলীয় কর্মীদের মাইনে-পত্তর, মুদ্রণ, ডিজিটাল ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে পাবলিসিটি, নির্বাচন চলাকালীন প্রার্থীদের হাতে নগদ, সোনা, মদের বোতল, এবং অন্যান্য সব বিনামূল্যের জিনিসপত্তর যেমন মোবাইল ফোন, টিভি, রেফ্রিজারেটর, কম্বল, সেলাই মেশিন ইত্যাদি দিয়ে। এছাড়া নির্বাচন কমিশনের হাত থেকে বাঁচার জন্য অনৈতিক খরচের নানা উদ্ভাবনীশক্তিও রাজনৈতিক দলগুলো বের করে ফেলেছে। যেমন, প্রার্থীরা পাবলিক ইউটিলিটি বিলের নাম করে কুপন বিলি করে জনগণের মধ্যে। কুপন নিয়ে আনন্দে আত্মহারা হওয়ার কিছু নেই। যদি ভোট দিয়ে ওই প্রার্থীকে জিতিয়ে আনা যায় তবেই কিন্তু কুপন ভাঙ্গিয়ে টাকা পাওয়া যাবে।

নির্বাচনের আগে টাকার উৎস ও খরচের খতিয়ান থেকে স্পষ্ট, স্থানীয় ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে কর্পোরেট দুনিয়া নির্বাচিত সরকারের কাছ থেকে সুযোগ-সুবিধা আদায় করেই ছাড়বে। এই আদায় করা ভোটের অধিকাংশ সুফল কারা ভোগ করবে সেটাও পরিষ্কার। দুর্নীতির প্রথম বীজ সংসদীয় গণতন্ত্রের গোড়াতেই পোঁতা হয়ে গেল। এরপর আসল গাছের গোড়ায় পরিকাঠামো আর পরিষেবার  নাম করে যতই সার দাও আর জল ঢালো, আগাছার গর্ভেই সে সব চলে যাবে। যাচ্ছে যে, সেটা প্রতিদিনের প্রকাশিত খবরে স্পষ্ট। নীতি নিয়ে আর কেউ বড়াই করে না। দুর্নীতি কতটা কমল বা বাড়ল, এর একটা তুলনামূলক আলোচনা চলতে থাকে।

গোদের উপর বিষফোঁড়া, বিগত দু-বছর ধরে চলতে থাকা মোদি সরকারের 'নির্বাচনী সংস্কার' যা আমাদের দেশে নির্বাচন ঘিরে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে আরও বেশি অসুস্থ ও অস্বচ্ছ করে তুলেছে।

কী আছে এতে?

প্রথমত, কর্পোরেট অনুদান। আগে ছিল বিগত তিনটি আর্থিক বছরের অর্জিত লভ্যাংশের (নেট প্রফিট্) ৭.৫ শতাংশ যে কোনও দেশিয় কোম্পানি নির্বাচনী খাতে স্বীকৃত রাজনৈতিক দলকে দিতে পারত। ২০১৭'র ফিনান্স অ্যাক্ট'এ এই ক্যাপটা তুলে দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, কোম্পানির এ ক্ষেত্রে কোনও দায় থাকছে না এই ধরনের অনুদানকে প্রফিট্ অন্ড লস্ একাউন্ট'এ দেখানো। এমনকি কোম্পানির বোর্ড অফ ডিরেক্টরস্'এরও অনুমতির কোনও প্রয়োজন নেই। অতএব ভুতুড়ে কোম্পানি খুলে কালো টাকা খাওয়ানোর এক অভিনব পন্থা।

দ্বিতীয়ত, নাম-গোত্রহীন নগদ দান। যা ২০,০০০ থেকে নামিয়ে ২০০০  টাকায় আনা হয়েছে এবং এর জন্য কোনও রেকর্ড রাখার প্রয়োজন নেই। সিলিং ভ্যালুও হাপিস্। অতএব যত খুশি ২০০০'এর সমষ্টি করা যেতেই পারে। অদ্ভুত অর্থহীন এক পরিস্থিতি। নোটবন্দির ঘোষণা ভারতীয় রাজনীতিকে নেতা-ব্যবসায়ীর গোপন আঁতাত থেকে মুক্ত করতে পেরেছে এমন দাবি ক্ষমতাসীন সরকারও জোর গলায় করতে পারছে না। উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনেই তার প্রমাণ মিলেছিল। ২০১৬-১৭ অর্থবর্ষে আমাদের দেশের ছয়টি জাতীয় স্তরের রাজনৈতিক দলের সংগৃহীত আর্থিক অনুদানের ৪৬ শতাংশ এসেছে নাম-গোত্রহীন উৎস থেকে।

তৃতীয়ত, বিদেশি ফান্ডিং। এখনকার নিয়ম অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন স্বীকৃত রাজনৈতিক দলগুলো বিদেশি কোম্পানির কাছ থেকে নির্বাচনী খাতে অনুদান পেতেই পারে। বেশ ভয়ের ব্যাপার। ভারতের নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে বিদেশি শক্তি অনুদানের নামে যথেষ্ট প্রভাবিত করতে পারে। এবারের ফিনান্স বিলে গুরুত্বপূর্ণ একটি সংযুক্তিকরণ করা হয়েছে। তাতে বলা আছে, যত 'ফরেন ফান্ড' নির্বাচন কমিশন স্বীকৃত রাজনৈতিক দলগুলো ১৯৭৬ সাল থেকে নির্বাচনী খাতে পেয়ে এসেছে, সে সবের কোনওরকম তদন্ত করা যাবে না। বিজেপি এবং কংগ্রেস দুটি জাতীয় স্তরের রাজনৈতিক দল সহ অন্যদেরও মুখের হাসি এবং বুকের ছাতি দুটোই চওড়া হয়েছে। Foreign Contribution Regulation Act (FCRA), 1976'এর সূত্র ধরে নির্বাচন কমিশন নিজেই হৈচৈ শুরু করে দিয়েছে। লাভ হয়নি কিছুই।

চতুর্থত, ইলেক্টোরাল বন্ড। উদারবাদের পরবর্তী যুগে জমি পাওয়াকে কেন্দ্র করে রিয়েল এস্টেট আর ম্যানুফ্যাকচারিং- এই দুটো ক্ষেত্র থেকেই নির্বাচনী খাতে রাজনৈতিক দলগুলোর ভাঁড়ারে সবচেয়ে বেশি টাকা আসছে। নির্বাচনের সময় টাকার বিনিময়ে জমি লেনদেনের ঢালাও অনুমতি রাজনৈতিক নেতারা বিল্ডারদের দিচ্ছেন। ভোটে জিতে এলে সুদে-আসলে ফেরত দেওয়ার পালা। ২০১২ থেকে ২০১৬'র মধ্যে আমাদের দেশের সমস্ত স্বীকৃত রাজনৈতিক দলের সর্বমোট ঘোষিত অর্থ ভাণ্ডারের ৯০ শতাংশ ছিল কর্পোরেট অনুদান। এর উপর ইলেক্টোরাল বন্ডের ধারণাটা নির্বাচনকে ঘিরে দুর্নীতি সংক্রান্ত সব উদ্বেগকে ছাপিয়ে গেছে। একজন ব্যক্তি, কিছু ব্যক্তিকে নিয়ে সমষ্টি অথবা কর্পোরেট স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার কিছু নির্দিষ্ট শাখা থেকে প্রতি মাসের প্রথম দশ দিনে ইলেক্টোরাল বন্ড কিনতে পারে। ১০০০, ১০০০০, ১০০০০০, ১০০০০০০ এবং এক কোটির গুণিতকে এই ইলেক্টোরাল বন্ডের মেয়াদ ১৫ দিন। টাকা দিয়ে কিন্তু কেনার অনুমতি নেই এবং ক্রেতাকে KYC ব্যাংকে জমা দিতেই হবে। নির্দিষ্ট SBI অ্যাকাউন্ট থেকে এরপর রাজনৈতিক দল এই বন্ড এনক্যাশ করে নেয়। আপাতদৃষ্টিতে বিষয়টার মধ্যে কোনও গণ্ডগোল নজরে পড়ে না। একদিকে দাতার নাম প্রকাশ করার কোনও প্রয়োজন নেই কোন রাজনৈতিক দলকে তিনি ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে টাকা দান করছেন এবং অন্যদিকে, রাজনৈতিক দলেরও কোনও বাধ্যবাধকতা থাকছে না কার কাছ থেকে এই পদ্ধতিতে টাকা পাচ্ছেন তা প্রকাশ করার। কিন্তু ডিজিটাল ট্রেইলের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল ঠিক টের পেয়ে যাবে কে কত টাকা দিচ্ছেন। অর্থাৎ, বিরোধী কোনও রাজনৈতিক দলকে আমি ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে নির্বাচনের সময় সাহায্য করতে চাইলেও পারব না। এই ধরনের code of secrecy নিশ্চিত করে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলেরই একমাত্র ইলেক্টোরাল বন্ড সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য জানার অধিকার থাকবে। কেউ চায় না ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলকে চটাতে। ব্যবসার ক্ষেত্রে সেটা আত্মহত্যা ছাড়া আর কিছু নয়। অতএব প্রথম থেকেই গণতন্ত্রের মৃত্যু অনিবার্য। আর, আদর্শ আর নীতি? অট্টহাসি।

ইলেক্টোরাল ট্রাস্টের মাধ্যমে কর্পোরেট দান রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য আদায় করা ২০১৩ সালে তৎকালীন ইউপিএ সরকার চালু করেছিল। ট্রাস্টগুলোর ক্ষমতা ভালোই ছিল। বিভিন্ন দেশিয় কোম্পানির কাছ থেকে আর্থিক অনুদান নেওয়া এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংগৃহীত অর্থ বিতরণ করার দায়িত্ব এদেরই ছিল। তথ্য বলছে, ২০১৭-১৮'এ এইরকম ২২টি নথিভূক্ত ইলেক্টোরাল ট্রাস্টের মোট সংগৃহীত অর্থের ৮৬ শতাংশই ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের পকেটে গেছে। ২০১৬-১৭'এ দেখা গেল, বিজেপি পার্টি তহবিলে নির্বাচনী খাতে সংগৃহীত সর্বমোট আর্থিক অনুদানের পরিমাণ ওই একই সময় জাতীয় স্তরের অন্যান্য পাঁচটি প্রধান রাজনৈতিক দলের সর্বমোট সংগৃহীত অনুদানের থেকে নয় গুণ বেশি। এই তথ্যগুলো খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রমাণ করে, কেন গেরুয়া শিবির নির্বাচনী খাতে আর্থিক অনুদান গ্রহণের সীমারেখা নির্ধারণে ভারতের নির্বাচন কমিশনের যাবতীয় প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। করবে নাই বা কেন? ২০১৯'এর লোকসভা নির্বাচনে ৬০ থেকে ৬৫ হাজার কোটি টাকা নির্বাচনী খাতে খরচা হয়েছে, ২০১৪এ যা ছিল ৩৫ হাজার কোটি টাকা। নির্বাচনের সময় প্রার্থী পিছু নির্বাচন কমিশন যে পরিমাণ বৈধ অর্থ বরাদ্দ করে থাকে, বাস্তব বলছে তাতে কিছুই হয় না। শুধু একজন প্রার্থীর নিজের নির্বাচনী কেন্দ্রে খরচের হিসেব, গোয়েন্দাগিরি করে দেখা যাচ্ছে, আজকের বাজারে প্রায় ১০ কোটি টাকার মতো। অতএব, রীতিমতো বিত্তবান এবং লোকলস্কর সহ বলবান না হলে ভারতের নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করা দিবাস্বপ্নের মতোই শোনায়। সাধারণ সংসারী সৎ এবং খেটে খাওয়া প্রার্থীর পক্ষে আমাদের দেশে রাজনীতি করা এবং ভোটে জিতে আসা সোজাসাপ্টা ভাষায় অসম্ভব। স্বচ্ছতা বা অস্বচ্ছতার প্রশ্নগুলো পাশে সরিয়ে রাখলে, অন্যান্য স্বীকৃত রাজনৈতিক দলগুলোও এই ইস্যুতে একই অবস্থানে যে আছে তা মৌনং সম্মতির মাধ্যমে বুঝিয়ে দিয়েছ। নির্বাচনী বিধি লাগু হওয়ার আগে থেকেই পয়সা রোজগারের এই অভূতপূর্ব সুযোগ প্রায় সোনার কাঠি ছোঁয়ার মতো।

আশার আলো একেবারেই যে নেই তাও ঠিক নয়। নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে কলুষমুক্ত করতে 'স্টেট ফান্ডিং' একটা সমাধান হতে পারে। ইউরোপ আমেরিকা আফ্রিকা এবং এশিয়ার অন্যান্য দেশের নির্বাচনে এটা পরীক্ষিত সত্য। আমাদের প্রধানমন্ত্রী বারেবারেই এই প্রস্তাব বিভিন্ন মহলে রাখছেন। কিছু বিধিনিষেধ এবং পূর্ব শর্ত মেনে নিলে, নির্বাচন কমিশন থেকে শুরু করে বিভিন্ন সরকারি কমিটি এবং কমিশন এই প্রস্তাবে সাড়াও দিয়েছে, যার মধ্যে অন্যতম দুটি হল, প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক পরিকাঠামো যথাযথ রক্ষা করা এবং আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে পূর্ণ স্বচ্ছতা বজায় রাখা। ২০১৭'র জনগণনা অনুযায়ী, প্রায় ১৩৪ কোটির দেশ আমাদের ভারত। ২০১৯'এর লোকসভা নির্বাচনে ৯০ কোটি ভোটারের ১০ কোটিই ছিলেন ১৮ থেকে ১৯ বছর বয়সী, দেশ গড়ার মূল কারিগর হিসেবে যারা কিনা ভবিষ্যতে চিহ্নিত হবেন। ডিজিটাল প্রযুক্তির যুগে এঁরা সবাই আগের প্রজন্মের তুলনায় অনেক বেশি সচেতন এবং তথ্যও রাখেন অনেক বেশি। সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে সমস্ত রকম নির্বাচনী দুর্নীতির খবর এঁদের কাছে খুব সহজেই পৌঁছে যাচ্ছে বিচার-বিশ্লেষণ সহ। কাউকে বোকা ভাবার কোনও কারণ নেই। ভারতের নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে বর্তমান প্রজন্মের কাছে গণতন্ত্রের উৎসব বলব, নাকি হিসাববিহীন অর্থ রোজগারের উৎসব হিসেবে চিহ্নিত করব, জানা নেই।

Friday, 16 August 2019

স্থানীয় সংরক্ষণ

জনপ্রিয়তার বাড়াবাড়ি
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য
অন্ধ্রপ্রদেশের মুখমন্ত্রী জগন রেড্ডি বিধানসভায় একটি বিল পাশ করিয়ে সে রাজ্যের সমস্ত সরকারি, আধা-সরকারি ব্যবসায়িক উদ্যোগ ও সংস্থার ওপর ৭৫ শতাংশ স্থানীয় লোক নিয়োগের বাধ্যবাধকতা আরোপ করেছেনএ নিঃসন্দেহে এক অভিনব ও অবিশ্বাস্য কাণ্ড! সবচেয়ে বড় কথা, এই বিধিব্যবস্থায় আগামী ভবিষ্যতে অন্ধ্র রাজ্যের সামগ্রিক লাভ ও ক্ষতি কতটা তা সম্ভবত খতিয়ে দেখা হয়নি, গোটা দেশের কথা না হয় মুলতুবিই রইল আশু কিছু লাভালাভ ও জনপ্রিয়তা অর্জনের আকাঙ্ক্ষাকেই এখানে সম্বল করা হয়েছে।
ইদানীং এ দেশে গত কয়েক বছরে তথাকথিত জনপ্রিয়তাবাদী রাজনীতির যে নতুন আঙ্গিক ও বিন্যাস দেখা যাচ্ছে, জগন রেড্ডির এই পদক্ষেপে তা আরও পরিস্ফুট হয়েছে। এর ফলে সামগ্রিক ভাবে অর্থনীতি ও রাজনীতির আঙ্গিনায় কী কী প্রভাব পড়তে পারে, সে আলোচনার আগে এই উদ্ভূত জনপ্রিয়তাবাদী রাজনীতির নতুনতর উপাদানগুলিকে একবার বাজিয়ে নেওয়া যাক।
গত দশ-পনের বছর আগেও রাজ্যে রাজ্যে শাসক ও বিরোধী দলগুলির মধ্যে প্রতিশ্রুতির প্রতিযোগিতা ছিল, কে কত বিশাল বিনিয়োগ ও বৃহৎ শিল্প স্ব স্ব রাজ্যে নিয়ে আসতে পারেএইসব শিল্প ও বিনিয়োগ আনার গল্প শুনিয়ে রাজনৈতিক দলগুলি শিল্পায়ন, উন্নয়ন, কর্মসংস্থান ও তৎপ্রসূত উজ্জ্বল ভবিষ্যতের এক ধরনের একবগগা ছবি এঁকে ভোট বৈতরণী পার হওয়ার চেষ্টা করত। তার জন্য দেশি-বিদেশি শিল্পপতিদের ডেকে রাজ্যে রাজ্যে বাৎসরিক মেলা ও মোচ্ছব করা হত, মৌ ও মৌতাতের গল্পে আমাদের মনপ্রাণও ভরে উঠতএখন সে দিন গিয়েছে। গত শতকের শেষ দশক থেকে শুরু হওয়া এই হিড়িক এই শতকের প্রথম দশকে এসে তার যাত্রা নির্বাপণ করেছে। এখন আর সে সব কথা কেউ বলে না। কারণ, দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে গেছে যে আধুনিক বৃহৎ শিল্প বা প্রভূত বিনিয়োগ এলে পুরনো কালের মতো তেমন তেমন কর্মসংস্থান আর হয় না, অতি-আধুনিক প্রযুক্তিতে সজ্জিত এ কালের শিল্পের পক্ষে তা সম্ভবও নয়। বরং, মুফতে পাওয়া জল-জঙ্গল-জমি নিয়ে এইসব আধুনিক শিল্প-কারবারীদের অন্যতর উদ্দেশ্য থাকে যা আখেরে চলমান জীবনকেই আরও বিধ্বস্ত করে, শ্রমজীবী মানুষকে আরও নিরন্ন ও বাস্তুহারা করে। আগুনে হাত পুড়িয়ে সে কথা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করে এখন কেউ আর তাই সে সব কথা মুখেও আনে না। বরং, এখন কোন দল কত জনমুখি প্রকল্প নিয়ে আসতে পারছে যা সরাসরি আপামর দরিদ্র মানুষের কাছে কিছু নগদ ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পৌঁছে দিতে সক্ষম, তারই এক নবতর প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। আর তার মৌলিক উদ্দেশ্যটাই হল, নির্বাচনে ক্ষমতা লাভ।
এ রাজ্যে এমন বহু প্রকল্প আমরা দেখেছি। কিছুদিন আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেছেন ‘কৃষক বন্ধু স্কিম’ যার আওতায় প্রতি কৃষক প্রতি একর পিছু বছরে দুবার ৫০০০ টাকা করে পাবেন। শুধু এ রাজ্যেই নয়, এমন নানা ধরনের প্রকল্প এখন বিভিন্ন রাজ্যে দস্তুর হয়ে উঠেছে। যেমন, তেলেঙ্গানায় চালু আছে ‘রায়তু বন্ধু স্কিম’ যা প্রায় ৫৮.৩৩ লক্ষ কৃষককে প্রতি একর পিছু বছরে দুবার ৫০০০ টাকা করে দিচ্ছে। এই একই স্কিম ‘কালিয়া’ নামে ওড়িষ্যায় চালু করেছেন নবীন পট্টনায়েক। অন্ধ্রপ্রদেশেও চালু হয়েছে ‘রায়তু ভরসা’ প্রকল্প যার আওতায় কৃষকেরা বছরে ১২,৫০০ টাকা করে পাচ্ছেন বিভিন্ন রাজ্যে এই এখন চলতি রেওয়াজ। এর মূল কারণ দুটি। এক, সকলেই বুঝে গেছেন, আধুনিক শিল্পে দরিদ্র-পিছিয়ে পড়া মানুষের পক্ষে কাজ পাওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত কম; দুই, অতএব, তাঁদের জন্য প্রত্যক্ষ জনমুখি প্রকল্প না নিলে তা সামাজিক-রাজনৈতিক হিংসা ও অশান্তির বাতাবরণ তৈরি করবে এবং ভোটের বাজারেও সুফল পাওয়া যাবে না।
তাহলে যা হচ্ছে তা কি জনপ্রিয়তাবাদী রাজনীতির খিদমতগিরি? আমি বলব, একেবারেই নয়। উপরন্তু, এই ‘জনপ্রিয়তাবাদী’ শব্দবন্ধটি নিয়েই আমার আপত্তি আছে। এখানে আমি বরং একে ব্যবহার করেছি এর থোঁতা মুখ কিছুটা ভোঁতা করার জন্যই। তার কারণ, ‘জনপ্রিয়তাবাদী’ শব্দবন্ধটি আসলে উচ্চাসনে বসা এলিটদের এক ধরনের চালিয়াতি যারা মনে করেন, ঠিকঠাক ভাবে ‘উন্নয়নের পথে’ না এগোতে পেরে রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার কাছে (সোজা অর্থে, নির্বাচনী জয়-পরাজয়ের কাছে) রাজনৈতিক দলগুলির এ এক ধরনের আত্মসমর্পণ। আসলে তাঁরা ভাবতে পারেন না যে অমন ‘ঠিক করে দেওয়া’ ‘উন্নয়নের আসলি কোনও পথ’ নেই এবং গণতন্ত্রে সমস্ত শ্রেণি ও স্বার্থের কথা বিবেচনা করেই বহুজনগ্রাহ্য কিছু পথ নেওয়া হয় আর তার বিচার হয় নির্বাচনের ফলাফলের আলোকেই। আসলে গণতন্ত্রে যে ‘বহুজন হিতায় বহুজন সুখায়’ পথটিই গ্রহণ করার কথা, ‘জনপ্রিয়তাবাদী’ বলে তাকেই সাকুল্যে মস্করা করা হয়। কিন্তু মুশকিল হয়, যখন কেউ কেউ খেই হারিয়ে ফেলেন এবং অচিরে তার খেসারতও দেন
অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী জগন রেড্ডি মহাশয় সম্ভবত তাঁর জনপ্রিয়তাকে আরও তুঙ্গে তোলার জন্য তাঁর রাজ্যের সমস্ত সরকারি বা বেসরকারি সংস্থায় ৭৫ শতাংশ স্থানীয় সংরক্ষণের আইন পাশ করিয়েছেনআর এটা তাঁর দিকে ব্যুমেরাং হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ষোলোআনা। প্রথমত, বেসরকারি বা সরকারি অথবা যে কোনও সংস্থাই চলতে চায় দক্ষতা ও কর্মকুশলতার বিনিময়েসে কারণে ঠিকঠাক মানবসম্পদ নিয়োজন ও তাদের পরিচালনা একটি সংস্থার গুণগত কর্মক্ষমতা বৃদ্ধির পক্ষে অপরিহার্য। সে ক্ষেত্রে কর্মনিয়োজনের নীতিতে যদি ৭৫ শতাংশ সংরক্ষণের শর্ত আরোপ করা হয় তা কখনই অর্থনীতির বিচারে ও দক্ষতার মাপকাঠিতে কাঙ্ক্ষিত উপায় হতে পারে না। বহু ক্ষেত্রে দেখাই যেতে পারে, স্থানীয় স্তর থেকে তেমন তেমন উপযুক্ত মানবসম্পদ পাওয়া যাচ্ছে না বা যাদের নিতে বাধ্য করা হচ্ছে তাদের মান ও উৎপাদনশীলতা খুব নিম্নমানের। তা সামগ্রিক ভাবে সংস্থার পক্ষে এতটাই খারাপ হতে পারে যে ঝাঁপ গুটিয়ে অন্যত্র চলে যাওয়া ছাড়া তাদের আর কোনও গত্যন্তর নেই। যেমন ধরা যাক, একটি সংস্থা ঠিক করল, তারা ১০ জন নতুন লোক নেবে। তাহলে নতুন সংরক্ষণ নীতি অনুযায়ী তাদের ৮ জনই হবে স্থানীয় স্তরের। এবার এমনটা হতেই পারে, এই ৮ জনের মধ্যে অধিকাংশই নির্দিষ্ট সংস্থাটির জন্য অনুপযুক্ত। কিন্তু তা হলেও তাদের অন্যথা কিছু করার নেই। এ নিতান্তই ল্যাজেগোবরে অবস্থা। দ্বিতীয়ত, এই ধরনের সংরক্ষণের কথা এবার যদি বাকী রাজ্যগুলোও চিন্তা করতে শুরু করে তাহলে একেবারে সোনায় সোহাগা। ইতিমধ্যে মধ্যপ্রদেশ সরকার স্থানীয়দের জন্য ৭০ শতাংশ সংরক্ষণের কথা বিবেচনা করছে। তাহলে যেটা হবে, যেখানে যে ধরনের মানবসম্পদ দরকার সেই উপযুক্ত সম্পদ যদি না পাওয়া যায় তবে সেই সংস্থাগুলির ক্ষতি বিনে আর কোনও উপায়ন্তর থাকবে না, উপরন্তু, রাজ্যে রাজ্যে শিল্প বিকাশের তারতম্য থাকার দরুণ পিছিয়ে থাকা রাজ্যগুলি দুর্ভোগে পড়বে সবচেয়ে বেশি। সবচেয়ে বড় কথা, ভারত একটি বিবিধ মানবসম্পদ ভাণ্ডারের দেশ হিসেবে তার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলবে এবং রাজ্যে রাজ্যে তীব্র বাদানুবাদ ও লাঠালাঠি শুরু হওয়া অনিবার্যতা হিসেবে দেখা দেবেসর্বোপরি, গত ৭২ বছরের নানান কিসিমের বিভেদের রাজনীতির মাঝে আরেক বড় বিভেদ এসে আমাদের আক্রান্ত করবে। সর্বনাশের কথা, এই দ্বৈরথে এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে যাতায়াত করাই বিড়ম্বনার বিষয় হয়ে উঠবে। তৃতীয়ত, এমনতর উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে পঠনপাঠনের জন্য ছাত্রদের গতায়াতেও বাধা পড়বে। কারণ, স্থানীয়দের চাকরিগত সুবিধা দেওয়ার জন্য এবার বাইরের রাজ্য থেকে পড়তে আসা ছাত্রদের এই যুক্তিতে আটকানো হবে যে স্থানীয়দের যথেষ্ট পরিমাণে পড়াশোনার সুযোগ বাড়াতে হবে। ফলত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতেও স্থানীয়দের জন্য ৭৫-৮০ শতাংশ সংরক্ষণের দাবি উঠে যাবে। মুশকিল হল, কিছু রাজ্যে এমন ধরনের কিছু বিশেষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে যা ভারতবর্ষের অন্যত্র নেই, ফলে, সেখানেও এত বিপুল পরিমাণ সংরক্ষণের নীতি নিয়ে এগোলে তা আরও এক প্রস্থ বৈষম্য সৃষ্টি করার দিকে এগোবে যেমন, ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট (আইএসআই) ধরনের প্রতিষ্ঠান ও তাদের অধীন সেন্টারগুলি দেশে মাত্র পাঁচটি আছে (কলকাতা, দিল্লি, বেঙ্গালুরু, চেন্নাই ও তেজপুর)এবার যে পাঁচটি রাজ্যে তা অবস্থিত সেখানে যদি ছাত্র ভর্তিতেও স্থানীয়-সংরক্ষণ চালু হয় তাহলে অন্য রাজ্যের ছাত্ররা সেখানে অতি কম সংখ্যায় পড়ার সুযোগ পাবে ও যারা আবার সেখান থেকে পাশ করে বেরবে তাদের অধিকাংশ সেই রাজ্যেই চাকুরি পাওয়ার অধিকারী হবে এবং খুব কম সংখ্যক অন্য রাজ্যে (যদি সর্বত্রই চাকুরিতে সংরক্ষণ চালু হয়) চাকরি পাবে। ফলে, আইএসআই ও তাদের সেন্টার থেকে রাশিবিজ্ঞান ও অঙ্কের ভাল ছাত্ররা শুধু পাঁচটি রাজ্যেই চাকরি পাবে, বাকী রাজ্যগুলি ভাল রাশিবিজ্ঞানী পাওয়া থেকে বঞ্চিত হবে। এমন উদাহরণ ভুরি ভুরি দেওয়া যায়। চতুর্থত, এই প্রশ্নও উঠবে, স্থানীয় বলতে কাদের বোঝানো হচ্ছে? তারা কি সে রাজ্যের নির্দিষ্ট জাতি, যেমন অন্ধ্রে তেলেগু বা অসমে অসমীয়া অথবা পশ্চিমবঙ্গে বাঙালি, নাকি সে রাজ্যে দু-তিন পুরুষ ধরে বসবাসকারী অন্য জাতিগত সত্তার মানুষেরাও? এখানেও অস্পষ্টতা ও ধোঁয়াশা রয়েছে। যদি কোনও রাজ্যকে শুধুমাত্র একটি জাতিগত সত্তা দিয়ে চিহ্নিত করা হয়, তাহলে কিন্তু দ্বন্দ্ব-দ্বৈরথের এক ভয়ঙ্কর আবহে আমরা প্রবেশ করব। এক দেশ হিসেবে প্রতিটি রাজ্যে আমাদের সমঅধিকারের প্রশ্নটি সে ক্ষেত্রে মারাত্মক ভাবে ঘায়েল হবে।
তাই, এই ধরনের স্থানীয়-সংরক্ষণের বিরুদ্ধে গোড়াতেই আমাদের সতর্ক হওয়া দরকারএখন পর্যন্ত মাত্র একটি রাজ্যেই স্থানীয়দের জন্য ৭৫ শতাংশ সংরক্ষণের আইন পাশ হয়েছে। তবে রাজনৈতিক দলগুলির জনপ্রিয়তা অর্জনের প্রতিযোগিতা ও বাড়াবাড়িতে ছোঁয়াচে রোগের মতো এ আইন অন্যান্য রাজ্যেও চালু হতে বেশি দেরি হবে না। এ নিয়ে সারা দেশ জুড়ে অবিলম্বে তোলপাড় হওয়া দরকারএমত আইন দেশের সংবিধানকে লঙ্ঘন করে কিনা তাও দেখা উচিত। কারণ, যে কোনও বিচারেই তা সবিশেষ আত্মঘাতী ও গোটা দেশের পক্ষেও অর্থনৈতিক মানদণ্ডে অতীব ক্ষতিকর ও বৈষম্য সৃষ্টিতে যথেষ্ট প্রণোদায়ক।