Monday, 15 January 2018

কলেজ স্কোয়ার লিটল ম্যাগাজিন মেলা ২০১৮

জনজোয়ারে ভাসল লিটল ম্যাগাজিন মেলা
দেবলীনা ভট্টাচার্য

জনজোয়ারের মেলা
 
চারপাশে পেরেক আর কাঠকুটো ছড়ানো। ডেকরেটরের লোকেদের হাঁকডাক। কমলা সবুজ চেয়ারের জড়ো হওয়া। খোলা আকাশের নিচে লম্বা করে পেতে রাখা সাদা পাতার মতো টেবিল কী যেন লিখে রাখবে বলে অপেক্ষায়। আকাশি ছোট্ট এক মঞ্চ প্রায় প্রস্তুত। একটু একটু করে কাঠামোর ওপরে কাপড় পড়ছে, বাকি কাপড়ের প্রান্ত উড়ছে পর্দা হয়ে নতুন এক দৃশ্যের জন্ম দেবে বলে। বিগত কয়েক দিন ধরে চলা কোনও এক সাহিত্য সম্মেলনের আধখোলা মণ্ডপ লুটিয়ে পড়েছে একদিকে। কয়েকজন সবুজ মানুষ যাদের স্বপ্নের রঙ ফিকে হয় না কখনও, ব্যস্তসমস্ত হয়ে ঘোরাফেরা করছে এদিক ওদিক। সব বন্ধুকে জায়গা দেওয়ার জন্য টেবিলের ওপর আঁক কাটার হুজ্জতি চলছে তেড়েফুঁড়ে, অন্যদিকে কাঠামোয় কাপড়ের রং আর লুটোপুটি রোদ্দুর কলেজ স্কোয়ারের রেলিঙের প্রান্তগুলো ছুঁয়ে যাচ্ছে আরেকটা নতুন প্রাণের গল্প তৈরি হয়ে উঠবে বলে। এদিকে ব্যস্ততা বেড়ে উঠেছে চরমে। কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু করতে হবে লটারি কারণ আজ থেকেই শুরু হয়ে যাবে চারদিনের লাগাতার কর্মকাণ্ড। এতক্ষণে সবাই বুঝেছেন এটা কোনও মেলার সূচনা পর্বের বিবরণঃ একাদশতম সারা বাংলা লিটল ম্যাগাজিন মেলার একটা প্রাক-দৃশ্যকল্প। যেটা ইতোমধ্যে ঘটে গেছে গত ৩-৬ জানুয়ারি ২০১৮ এক নতুন পালাবদলের ঈঙ্গিত রেখে। উদ্যোক্তাঃ লিটল ম্যাগাজিন সমন্বয় মঞ্চ
কিছু খণ্ডদৃশ্য
মেলার জন‍্য প্রস্তুতি তেমন কিচ্ছু ছিল না। সম্বল বলতে ছিল হাতের মুঠোফোন আর জনাকয়েক লোকের উপস্থিতি। না আছে অর্থের সংস্থান না আছে লোকবল। এই হল লিটল ম্যাগাজিন সমন্বয় মঞ্চ যাঁরা আদতে স্বল্পপুঁজিকে সঙ্গে নিয়েই গত দশ বছর ধরে ছোটপত্রিকার জন্য মেলাটি করে চলেছেন একনাগাড়ে। এবারের প্রতিকূলতা আরও বেশি, আরও অন্যরকম। বাংলা একাডেমির মেলাকে সরাসরি বয়কট করেছেন তাঁরা। তবে কী মেলা হবে না? মেলায় লোক আসবে তো? সরকারি মেলার স্থানান্তরিত হওয়ার সমালোচনায় মুখর সমন্বয় মঞ্চের এই মেলা যাদের জন্য তাদের প্রাণের স্পর্শ পাওয়া যাবে তো? নাকি স্বপ্নফেরির তরীর এখানেই ভরাডুবি হবে? মাথাভর্তি এই গিজগিজে সংশয়গুলোকে সঙ্গে নিয়েই হঠাৎ একদিন চারজন তরুণ-তরুণীকে বিশেষ দায়িত্ব দিয়ে তৈরি হয়ে যায় মেলা কমিটি - দেবলীনা, শান্তনু, শালিনী ও শ্রেয়ণ। সাথে মোবাইলে তৈরি করা পোস্টার সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে প্রচার চলতে থাকে জোরকদমে। কিন্তু তারপর? তারপর সে এক ঘটনা ! কলকাতা শহরের পাঠক পড়ুয়াদের প্রাণভোমরা, ইতিহাস যেখানে লেপ্টে রয়েছে দেওয়ালে দেওয়ালে, সেই কলেজ স্ট্রিট সাক্ষী হয়ে যায় এক নতুনতর ইতিহাসের, নতুনতম পর্বের; কারণ #এখন_লিটল_ম্যাগাজিনের_যুগ
পাখির ডানার মতো
বিজ্ঞাপন দেওয়ার পয়সা নেই যেমন, তেমনি বিজ্ঞাপন যোগাড় করার সুযোগ‌ও বিশেষ নেই। ছোট পত্রিকার মেলায় কে দেবে বিজ্ঞাপন? তাছাড়া তারা সরকারি আনুকূল্য চায় না যেমন, তেমনি তারা কর্পোরেট এবং বিগ মিডিয়া বিরোধী। তবু আদর্শবাদী অভাবের সংসারেও জীবন যেমন চলতে থাকে, শত টানাটানি থাকলেও যেমন করে একটা জাদুর মায়ায় পত্রিকা প্রকাশিত হতে থাকে অনায়াসে সব সমস্যাকে পেছনে রেখে, তেমনি যূথবদ্ধ স্বপ্নের জোরে সব গোলমাল অভাবকে পেছনে ফেলে মেলা হয়ে ওঠে ইতিহাস। প্রচার ছাড়াই, বাইরের বিজ্ঞাপন ছাড়াই, নিজেরাই টাকা তুলে, চাঁদা দিয়ে, বিজ্ঞাপন দিয়ে স্যুভেনির বার করে নতুনের ভাবনায় জারিত এক একটা আগুনের গোলায় পাঠকের মন ও মননকে সেঁকে পুড়িয়ে পাকাপোক্ত করে তোলার জন্য একটি আস্ত মেলার আয়োজন করে ফেলে সহজেই।
উদ্বোধন করছেন মধুময় পাল

বলছেন প্রেমাংশু দাশগুপ্ত

বলছেন অনিন্দ্য ভট্টাচার্য

অনাড়ম্বর একটু অগোছালো নিপাট সাদামাটাভাবে মেলা শুরু হয়ে যায়। না আছে কোনও থিমে থেমে যাওয়া, না কোনও বিশেষ বার্তাবাহী কাপড় উড়িয়ে দেওয়া। প্রবেশপথের উন্মুক্ত দরজায় প্রথম দিনে লাগানো হয়নি কোনও পরিচয়পত্রও। তবু শুরু হয় প্রাণের মেলা, 'আরাত্রিক'এর সম্পাদক দুর্গাদাস মিদ্যা আর লিটল ম্যাগজিনের আপনজন মধুময় পালের হাত ধরে। জ্বলে ওঠে ছোট্ট বাতি। সেই ছোট্ট বাতির আলোয় ভরে ওঠে গোলদিঘির চারপাশের অন্ধকারটা। হঠাৎ যেন হেসে ওঠে অন্ধকারে মিশে থাকা অ-নাগরিক ধর্মপালের মূর্তিটাও। ছোট্ট টেবিলে পড়ে থাকা খাতাটা প্রাণের টানে চলে আসা একশো পঁচিশটা ম্যাগাজিনের নামে ভরে উঠতে থাকে ধীরে ধীরে। মাথার ওপর ছাউনি নেই, বাতাসের শীতলতা তবু লিটল ম্যাগ করিয়ে ছেলেবুড়ো কাউকেই কাবু করতে পারে না একটুও। মগজে ধরাতে পারেনা মরচে। প্রাণের উষ্ণতায় লিটল ম্যাগাজিনের যোদ্ধারা আস্তে আস্তে দানা বাঁধতে থাকে আন্দোলনের পথে একে অপরের সাথে ভাবনায় হাতে হাতে। টেবিল চেয়ারের পেছনে আটকানো কাপড়ে লিটল ম্যাগাজিনের নামেরা জেগে উঠতে থাকে একে একে। মাধোবাবুর পুকুর বা আজকের কলেজ স্কোয়ার যা বহু আন্দোলনের, রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক ইতিহাসের নীরব সাক্ষী; আর‌ একটি ইতিহাসের সাক্ষী হওয়ার জন্য মনে মনে তৈরি হতে থাকে। কলেজ স্কোয়ার নয়, হঠাৎ মনে হতে পারে এ যেন আরেকটি ট্রাফালগার স্কোয়ার যেখানে ভাবনার মুক্তির জন্য তথা লেখকের স্বাধীনতার জন্য কর্পোরেট আর বিগ মিডিয়ার দূরভিসন্ধিমূলক উদাসীনতাকে ব্যর্থ করার জন্য লিটল ম্যাগাজিনের অনড় অবস্থান সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানাতে থাকে।

মেলা চলে; নিন্দুকদের যাবতীয় ধারণাকে নস্যাৎ করে লেখক পাঠক সম্পাদক ও শুভানুধ্যায়ীদের ভিড় জমে ওঠে। কে বলে লোকে এখন পড়ে না? নতুন প্রজন্ম বাংলা বই পড়ে না? যারা বলে তারা কি জীবনেও এমন হতাশাই দেখে? মেলায় এরা কারা তবে, চারদিন ধরে যারা স্টলে স্টলে ঘুরে স্টলের ওপর ঝুঁকে পড়ে পত্রিকা বাছে, পছন্দের বিষয় আর লেখাগুলি খুঁজে নিতে? ওই টানটান সতেজ সটান মুখগুলো বুদ্ধিদীপ্ত চোখগুলো তো অন্য খবর দিচ্ছে আমাদের। ওরা কী ভিনগ্রহী তবে?
মেলার স্মারক পুস্তিকা

মেলা চলে; প্রথম দিনের চলমানতা কারও কারও অস্থিমজ্জায় হিমেল বাতাসের প্রকোপ বাড়িয়ে তোলে। পাঠকের ভিড় তাদের প্রাণের উষ্ণতা মেলাকে যত ওম্ দিতে থাকে অমনি তাদের ওই 'কারো কারো' হাড়ে কাঁপুনি ধরায় কখনও গোপন আগুনে পুড়তে থাকে তাদের মগজ। সাথে সাথে কারও কারও ফোনে আসতে থাকে মেলার ব্যর্থতার অপপ্রচারের খবরও। কিন্তু 'তাতে আমাদের কতটুকু ক্ষতি, কতটুকু ক্ষতি মিতে।' কারণ সব উত্তর পাঠকেরাই দেয়। সব গোপন ঈর্ষাকে ব্যর্থ করে পাঠকরাই ভিড় জমায় আর লেখক সম্পাদককে তৃপ্ত করে লাগাতার বিকিকিনি চলে। লম্বা লম্বা টেবিলগুলোর চারপাশে জমা ভিড়গুলো দেখে মনে হয় খুব শীতে মানুষ যেমন নিজেদের একটু সেঁকে নেওয়ার জন্য একপাশে জড়ো হওয়া মানুষগুলোর পাশে অনায়াসে বসে পড়ে তেমনই এইসব নিজজনেরা ভাবনার উত্তাপে সেঁকে নিতে চলে এসেছেন আপনজনের কাছে। মেলা চলে, চলতে থাকে। কত অনায়াসে গোপনতম অনুভূতিটুকু উঠে আসে হাতে হাতে ছোটপত্রিকার পাতা খুলে। কত পত্রিকা কত নাম কত ধরনের বিষয়ের কথা তারা বলে ! ভাবনার রেণুগুলো ছড়িয়ে পড়ে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে।
'একক মাত্রা'র তরুণ তুর্কি

সকলে মিলে
 
সকলেই যখন আছেন

দিন গড়ায়। তারিখ এগোয়। দ্রুত গতিতে সময়ের কাঁটা দৌড়তে থাকে তিন চার পাঁচ হয়ে ছয়ের দিকে। আলোচনায় কবিতাপাঠে পথনাটকে গানে বিকিকিনিতে পাঠকের ভিড়ে মেলা জমতে থাকে। কখনও রোদের মিষ্টি কড়া হাসিতে ভিজে কখনও সন্ধ্যেবেলায় কৃত্রিম আলো মেখে হাসি মুখে লিটল ম্যাগাজিনের মানুষগুলো বেচাকেনা করে, কথা বলে। চলে আলাপ আদানপ্রদান। কখনও আগামী স্বপ্নের বীজ বপন হতে থাকে দ্রুততায় একে অপরের সাথে কখনও বা যৌথতায়। নাম-মুখ শুধু বদলে যায়। কখন‌ও সে 'একক মাত্রা', 'সন্দেশ', 'অনীক', কখন‌ও সে 'আখরপত্র', 'নিবিড়', 'মাস্তুল', 'আঙ্গিক', 'অপদার্থের আদ‍্যক্ষর', 'বিরূপকথা', 'কুবোপাখি' কিংবা 'ক্ষেপচুরিয়াস' হতে পারে, কিন্তু প্রতিবাদে প্রতিরোধে লালন করা স্বপ্নের প্রতি স্নেহের প্রকাশে কোথাও সবাই এক হয়ে যায়।
আরেক দিনের কথা
 
লিটল ম্যাগাজিনের নিজের লোকেরা নিজেরাই আলোচনা আড্ডায় গানে মেতে ওঠে অনায়াসে। কখনও সে মুখ জাহিরুল হাসানদার কখনও সে মুখ অনিন্দ্যদা চন্দ্রশেখরদা কিংবা অশোকেন্দুবাবুর। উঠে আসে লিটল ম্যাগাজিনের সমস্যার কথা মুহূর্তের হাত ধরে বক্তাদের জবানিতে। পুঁজিতন্ত্রের ফসল হলেও প্রযুক্তির হাত ধরেই পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সফলতা সম্ভব কিংবা থিঙ্ক গ্লোবাল অ্যাক্ট লোকালের মতো মতামতগুলো পাঠক-শ্রোতাদের নিয়ে যেতে থাকে ভাবনার গভীরে। জানায়, শিল্পী হোক বা লেখকের স্বাধীনতা, সবটাই মানুষের বাক্‌-স্বাধীনতার কথা বলে যা সক্রেটিসের সময় থেকেই বিপর্যস্ত বিপন্ন। তাই মঞ্চ থেকে প্রতিবাদের ডাক আসে যেন আর কোনও গৌরীলঙ্কেশ বা অভিজিত রায়ের কলম রক্তাক্ত না হয়ে ওঠে তার প্রতিরোধে।
'আয়না'র পথনাটক

নাটকের দর্শক

অতনুদা কিংবা প্রবীরদার মতো কবিদের সঞ্চালনে কবিরা সবার রং একাকার করে দিতে নিঃসঙ্কোচে মঞ্চে উঠে আসেন একে একে। একসময় সব কিছু মিলিয়ে জড়িয়ে নির্বিশেষ হয়ে ওঠে প্রাণের টানে। মেলা চলে নিজের গতিতে। কমিটি-টমিটির আর একসময় দরকার পড়ে না। গণআন্দোলনের শরিক লিটল ম্যাগাজিনের নিজের মেলায় সবাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজে থেকেই যুক্ত হয়ে যায় কোনও না কোনও ভাবে। 'আয়না' নাট‍্যগোষ্ঠীর পথনাটিকা দেখতে তাই উপচে পড়ে ভিড়। মঞ্চ থেকে প্রতুলদার একটা গান ঠান্ডা বাতাসে ভেসে আসতে থাকে -- 'ওদের আছে বন্দুক, মোদের আছে ক্ষুধা'। পাঠকের ক্ষিদের কাছে শাসকের বন্দুক ক্রমশ হেরে যেতে থাকে।
 প্রতুলদা ছাড়া মেলা অচল

No comments:

Post a Comment