Monday, 21 March 2016

'Imagine All the People / Living Life in Peace'




পাগলা দাশু ও ন্যাশনালিজমের হাঁড়ি
অনুরাধা রায়
 
এতদিন অল্প লোকই জানত, কিন্তু ইদানীং ন্যাশনালিজম চর্চার হট্টগোলে রবীন্দ্রনাথের আন্টি-ন্যাশনাল পরিচয় জনসমক্ষে চলে এসেছে। কী লজ্জার কথা যে সিউডো-সেকিউলারদের ষড়যন্ত্রের ফলে ঐ হতচ্ছাড়ার লেখা ‘জনগণমন’ এখনও আমাদের জাতীয় সঙ্গীত! রবীন্দ্রনাথকে কাঠগড়ায় তুলতে তাই উদ্যোগ নিয়েছে ‘জবরজঙ্গী জাতীয়তাবাদী দল’। শেয়ালদা কোর্টে ধরে এনে পেটাতে পারলে ভাল হত। সেটা যেহেতু করা যাচ্ছে না, তাঁর বিরুদ্ধে মরণোত্তর সিডিশন চার্জ আনার দাবিতে মহামিছিলের তোড়জোড় করছে এই দলের ছাত্র সংগঠনের কলকাতা শাখা।

কোন কোন জায়গা থেকে মিছিল শুরু হবে, কোন কোন রাস্তা দিয়ে গিয়ে পৌঁছবে জোড়াসাঁকো,  কী কী স্লোগান দেওয়া হবে, দেশদ্রোহীরা বাধা দিতে এলে ইঁটের টুকরো, লাঠিসোঁটা ছাড়াও বোমা-বন্দুক ব্যবহার করা হবে কিনা – এসব আলোচনা চলছিল; এমন সময়ে তাদের সহপাঠী দাশু - ঢলঢলে প্যান্ট আর তাকিয়ার খোলের মত কোট পরা, একমাথা ঝাঁকড়া চুল, হাতে একটা মস্ত মিষ্টির হাঁড়ি - হন্তদন্ত হয়ে ওদের অফিস ঘরে ঢুকল। হাঁড়িটা টেবিলের ওপর রেখে বলল – ‘তোরা রবীন্দ্রনাথকে নেশন-বিরোধী বলছিস বটে, কিন্তু শোন, রবীন্দ্রনাথ যে স্বদেশ তথা দেশকে এত ভালবাসতেন সেটা তো নেশন থেকে খুব আলাদা ছিল না। পার্থ চ্যাটার্জি বলেছেন।’

কয়েকটা কপালে ভাঁজ পড়ল, কিছু ভুরু কুঁচকোলো। একজন জবরজঙ্গী বলল – ‘ছেড়ে দে, কে এক প্রাদেশিক স্তরের শিক্ষামন্ত্রী কী বলেছে---।’ দাশু – ‘আরে শিক্ষামন্ত্রী নয়, ইনি সমাজবিজ্ঞানী পার্থ চ্যাটার্জি, নেশন নিয়ে এঁর বিখ্যাত কাজ।’ জবরজঙ্গী - ‘ওঃ, নেতা নয়, সেলেব নয়, কে এক ফালতু লোক---, আমাদের বিরক্ত করিস না, দাশু; কাজ করতে দে।’ দাশু - ‘আরে, ওঁর ইন্টারন্যাশনাল ফেম!’ জবরজঙ্গী - ‘আমরা ইন্টারন্যাশনাল মানি না, ন্যাশনালিজম-এর বাইরে কিছু জানতে চাই না। ভাগ এখান থেকে।’

দাশু ছাড়বার পাত্র নয়, বলতে লাগল - ‘জাতি কল্পিত জনগোষ্ঠী – বেনেডিক্ট আণ্ডারসনের এ কথাটা মেনে নিয়েও পার্থ চ্যাটার্জি তাঁর সঙ্গে বিরাট তর্ক করেছেন, বলেছেন তৃতীয় বিশ্বের জাতীয়তাবাদী কল্পনাকে পাশ্চাত্যের জাতীয়তাবাদী কল্পনার ছাঁচে ফেলে বোঝা যাবে না, তার বিশিষ্টতা বুঝতে হবেরাবীন্দ্রিক নেশন’ নিয়েও তাঁর লেখা আছে। সে সব নিয়ে তর্কও আছে। কিন্তু আপাতত কাজের কথাটা হল - রবীন্দ্রনাথ যখন ন্যাশনালিজমের বিরোধিতা করেছেন, তখনও তিনি দেশকে ভালবেসেছেন, আর সে দেশ তাঁর আন্ডারসন-বর্ণিত নেশনের মতই। আন্ডারসনের কতদিন আগেই তো তিনি বলেছিলেন দেশ ব্যাপারটা নিজের কল্পনা, কর্ম, সেবা তথা আত্মশক্তি দিয়ে গড়ে তোলবার
জনৈক জবরজঙ্গী - ‘আত্মশক্তি আমরাও দেখিয়ে দেব, যখন ওদের রাস্তায় ফেলে ঠ্যাঙাব, বুঝবে শক্তি কাকে বলে’। আরেকজন জবরজঙ্গী দাশুকে তেড়ে গিয়ে বলল - দেশ বা নেশন কল্পনার জিনিস! এইসব কথা বলেছে তোর কে এক ঘোড়েকা আন্ডার সন সাহেব, আর তার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথও? এটাই ত সবচেয়ে বড় প্রমাণ যে ব্যাটা আন্টি-ন্যাশনাল! আরে আমাদের ভারতমাতা স্মরণাতীত কাল থেকে রয়েছেন স্বমহিমায়, কল্পনা হতে যাবেন কোন দুঃখে?
দাশু চিংড়ি মাছের মত হাতপা ছুঁড়ে বলল – ‘যতই ভারতমাতা-টাতা বল, নেশন নিতান্ত আধুনিক একটা  ব্যাপার, আধুনিক পরিস্থিতির বিশেষ তাগিদ থেকে তার উদ্ভব। আধুনিকতা সাবেক যৌথ সমাজ ভেঙে দেয়, ব্যক্তিস্বতন্ত্রীকরণ ঘটায়, নিরাপত্তাহীনতার বোধ জাগায়তখন নতুন রকম যৌথতা খুঁজে নিয়ে মানুষ নিরাপত্তা পেতে চায়, আধুনিকতার সুযোগসুবিধেগুলোও নিতে চায়পুরনো আপাত-প্রাথমিক বন্ধনভিত্তিক জনগোষ্ঠীগুলোও আধুনিকতার চাপে নতুন করে কল্পিত হয় – ব্যাপকতর সংহততর ভিত্তিতে, যেমন ধর্ম বা জাত ভিত্তিক গোষ্ঠী আর নেশনের নতুন ধারণাটাও এমতাবস্থায় কল্পিত হয় কেন কীভাবে সেই কল্পনা - সেটা বেন আণ্ডারসন ভাল করে দেখিয়েছেন নেশন ধারণাটা কিন্তু পাশ্চাত্য থেকে আমদানি - খুব যে ন্যাশনালিজম করছিস, এই কথাটা ভাল করে মনে রাখিস। পাশ্চাত্যেও অবশ্য নেশনের ইতিহাস মোটে কয়েক শ’ বছরের, আর আমাদের এখানে তার উদ্ভব উনিশ শতক থেকে। তবে নেশন নিতান্ত আধুনিক হলেও তাকে এমন একটা ইতিহাস-ঐতিহ্য কল্পনা করে নিতে হয় যা আবহমান কালের সংহত, দৃঢবদ্ধ একটা নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত; যা প্রবল আবেগ-উচ্ছ্বাসের জন্ম দিতে পারে। একটা ‘রেট্রোস্পেক্টিভ মাইথলজিআর কি! একটু পড়াশোনা কর না, এরিক হবসবমের ‘নেশনস আণ্ড ন্যাশনালিজম’ বইটা অন্তত পড়
জবরজঙ্গী – ‘ওঃ, কোটপ্যান্ট পরে আমাদের দাশু খুব সাহেব হয়েছেন, ইংরিজি কপচাচ্ছেন! ওসব বিজাতীয় বই-ফই আমরা পড়ি না। কেন, আমাদের কি রামায়ণ-মহাভারত নেই? রামায়ণে কী বলেছে? 'জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী' ঐ জন্মভূমিই হল দেশ, আর ওটাই নেশন - আমাদের ভারতমাতা
দাশু কিন্তু জ্ঞান দিতেই থাকল - ‘দেশ, নেশন, রাষ্ট্র - এই ব্যাপারগুলো ঠিকঠাক বুঝতে হবে সব মোটেই এক জিনিস নয় রামায়ণের ওই জন্মভূমি বলতে তো শুধুই অযোধ্যা আর এই আমার  ফ্যামিলি তিন পুরুষ কলকাতায় কাটিয়েও এখনও দেশ বলতে ময়মনসিংহ বোঝে না? দেশ অস্পষ্ট একটা ব্যাপার নেশনকে ভূঃসীমানার দিক থেকে, জনসংখ্যার দিক থেকে অনেক স্পষ্ট হতে হয় নেশন-স্টেট হলে আরোই হতে হ্য় উত্তরে পাহাড় আর তিনদিকে সমুদ্রঘেরা একটা দেশ, যেখানে একটা আলগা সাংস্কৃতিক ঐক্যও বিরাজমান - এমন একটা ধারণা অবশ্য অনেক আগে থেকেই ছিল কারো কারো মনে কখনও তাকে বলা হত জম্বুদ্বীপ, কখনও ভারতবর্ষ, কখনও হিন্দুস্থান কিন্তু সেটা ১৯শ শতক থেকে তৈরি হয়ে ওঠা ভারতীয় নেশন নয় দেশ নিয়ে মানুষের গর্ব আর প্রেম থাকে; নেশন গর্ব আর প্রেমটুকু ধরে রাখতে চায়, কিন্তু তার সঙ্গে স্বার্থ গোছানোর ধান্দা করে সেজন্যই তো ভৌগোলিক সীমা বা জনসংখ্যার এত গুরুত্ব নেশনের কাছে এগুলোকে সে তার স্বার্থান্বেষণের কাজে লাগায় এই প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত অভিব্যক্তি রাষ্ট্র কিন্তু নেশনের সঙ্গে রাষ্ট্রের সরল সমীকরণ করা যাবে না দেখ না, ১৯৪৭-এর আগে পর্যন্ত আমাদের ন্যাশনালিস্টদের নেশন ছিল বটে, নিজস্ব স্টেট বা রাষ্ট্র তো ছিল না ইহুদিদের নেশন ছিল, কিন্তু রাষ্ট্র ছিল না বহুদিন পর্যন্ত সোশিও-লিঙ্গুইস্টিকসে 'ন্যাশনালিজম' আর 'নেশনিজম' এই দুটো আলাদা শব্দ ব্যবহার করেছেন জোশুয়া এ ফিশম্যান সামাজিক আদানপ্রদান আর সাংস্কৃতিক সংযোগের ভিত্তিতে একটা নেশন কল্পনা করা যায়, সেটা 'ন্যাশনালিজম' আর রাষ্ট্রের সঙ্গে অন্বিত নেশন যখন আত্মপরিচয়ের উS, তখন ব্যাপারটা 'নেশনিজম' তা আমি বলছি কী যে, রবীন্দ্রনাথ নেশনকে একটা সময়ে অবধারিতভাবে ধান্দাবাজি আর আগ্রাসনের সঙ্গে, বিশেষত রাষ্ট্রীয় শক্তির দাপটের সঙ্গে জুড়ে দেখেছিলেন, তাই তাকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন; কিন্তু ভারত নামে একটা কিছু কল্পনা করতে তাঁর ভালই লাগত তাঁর মত করে সেটা কল্পনা করেছিলেন তিনি, মূলত একটা সামাজিক-সাংস্কৃতিক কল্পনা একটা 'মহামানবের সাগরতীর', যেখানে সবাই 'দেবে আর নেবে মিলাবে মিলিবে যাবে না ফিরে' আসলে ওঁর ভারত অবশ্য বিশ্বমানবতা, বিশ্বজনীনতার আদর্শেরই প্রকাশ সেরা দেশপ্রেম এভাবেই দেশকে ছাপিয়ে যায়। যা হোক, যেটা বলতে এসেছিলাম রবীন্দ্রনাথকে ন্যাশনালিস্ট বলিস আর না বলিস, মিছিলটা তোদের স্রেফ ভিত্তিহীন তবে দুঃখ করিস না, মিছিল না করতে পারলেও, এই দেখ রসগোল্লা এনেছি, তোদের সবাইকে খাওয়াব

‘নিয়ে যা তুই তোর রসগোল্লার হাঁড়ি’ – এই বলে দু-একজন জবরজঙ্গী দাশুকে মারবার জন্য উঠল কিন্তু অন্য কেউ কেউ বলল – ‘ছেড়ে দে, ব্যাটা পাগলা!’ তাতে দাশু আরো উসাহ পেয়ে গেল। বলতে লাগল – ‘মূল কথা যেটা বলতে চাইছি তা হল – নেশন একটা কল্পনা! সেই কল্পনায় অতীত থেকে কিছু কিছু উপাদান নেওয়াই যায়, তবে মোটের ওপর ন্যাশনালিজমের ঐতিহ্য একটা বানিয়ে তোলা ব্যাপারই হয়। এইভাবে ঐতিহ্য কল্পনা করে তার ভিত্তিতে নেশন কল্পিত হয়। একেকজন একেকভাবে  সেই কল্পনা করতে পারে, ইতিহাসের নানা পর্বে কল্পনাটা পালটে পালটেও যেতে পারে এক ভারতেরই কল্পনা কতরকমের হতে পারে রবীন্দ্রনাথ নিজেই একেক সময়ে একেকভাবে ভারত কল্পনা করেছেন স্বদেশি পর্বে দেশমাতাকে নিয়ে তাঁর কত গান, কখনও সেই দেশমাতা প্রায় দেবী দুর্গা – ‘ডান হাতে তোর খড়গ জ্বলে, বাঁ হাত করে শঙ্কাহরণ’, ইত্যাদি। উত্তর-স্বদেশি পর্বে, মানে ওঁর উত্তর-ন্যাশনাল পর্বে এসে অবশ্য সাধারণ মানুষের সুখদুঃখ আশা-আকাঙ্ক্ষা, তাদের মানুষ হয়ে ওঠা ওঁর দেশকল্পনায় খুব বড় হয়ে ওঠে আরো দেখ, রবীন্দ্রনাথের কল্পনা, গান্ধির কল্পনা, নেহেরুর কল্পনা, আম্বেদকরের কল্পনার ভারত তো ঠিক এক নয় আবার লবটুলিয়ার ভানুমতী মেয়েটা এমন প্রশ্নও করে বসে – 'ভারতবর্ষটা কোনদিকে?' তারপর ধর, আজ একজন লোক ভারতীয় ভাবছে নিজেকে, কাল না-ও ভাবতে পারে ভারত নামে একটা নেশনের সদস্য ছিল কত মুসলমান, একটা ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে তাদের কারো কারো মনে হল একটা আলাদা নেশন চাই, তারা তাই পাকিস্তান হয়ে গেল তারও পরে পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মনে হল আবার আলাদা হয়ে যাবে তারা বাংলাদেশ হয়ে গেল তখন ধর্মের 'প্রাথমিক বন্ধনের' চেয়ে ভাষা ও সংস্কৃতির 'প্রাথমিক বন্ধন'ই তাদের বেশি জোরদার মনে হল আরো সাম্প্রতিক কালে দেখ না ক্রোট আর স্লাভরা কতদিন ধরে মিলেমিশে ছিল ইউগোস্লাভিয়ায়, এমনকি রক্তের সংমিশ্রণও কম হয়নি প্রায় দেড় লক্ষ মিশ্র বিয়ে ঘটেছে তাদের মধ্যে; তবু প্রায় রাতারাতি তাদের মনে হল তারা আলাদা এথনিসিটি, আলাদা নেশন আলাদা হয়ে গেল তারা, ইউগোস্লাভিয়াটাই ভেঙে গেল

জবরজঙ্গী - ‘চোপ, তুই বলতে চাস ভারতবর্ষটা আবার ভাগ হয়ে যাক? বুঝেছি, তুই পাকিস্তানপন্থী!’ দাশু – ‘আমি কিছুই বলতে চাই না, আর পাকিস্তানপন্থীও মোটেও নই। তোদের আসলে ভেতর থেকে দেশকে সৃষ্টি করে তোলার মত আত্মশক্তির অভাব আছে তো, তাই বাইরে (ভেতরেও)শত্তুর খাড়া না করলে নেশনও খাড়া করতে পারিস না। আমি শুধু ন্যাশনালিজমের ইতিহাসটা তোদের একটু বোঝাতে চাইছিইতিহাস বলে - জোর করে লাঠিয়ে পিটিয়ে কিন্তু কোন নেশনকে বেশিদিন ধরে রাখা যায় না! আলোচনা কর, তর্ক কর, দেখ বোঝাপড়ায় আসা যায় কিনা; তা নয় খালি গাজোয়ারি!’
জবরজঙ্গীরা এবার একেবারে খেপে গেল – ‘পড়াশোনা করানোর বদলে আমাদের কলেজ-ইউনিভার্সিটিগুলো এইসব দেশদ্রোহী আঁতেল তৈরি করছে, পাবলিক মানি নষ্ট করে! ঢের হয়েছে, এদের আর বরদাস্ত করা হবে না!’
দাশু – ‘আরে, পড়াশোনা করি বলেই ত এতসব শিখেছি!’

জবরজঙ্গী - ‘তাহলে, আর পড়াশোনার দরকার নেই! এতদিন যা হয়েছে, হয়েছে। এবার থেকে কলেজের ছাদের ওপর ন্যাশনাল ফ্ল্যাগ উড়বে পত পত করে, আমরা তাকে নমস্কার করে ‘বন্দে মাতরম’ গাইতে গাইতে ক্লাসে ঢুকব, তারপর আর কিছু না পড়লেও চলবে

দাশু যেন আরো উসাহ পেয়ে গেল, বলল – ‘বন্দে মাতরম গানটায় বঙ্কিমের দেশ তো নিছক বঙ্গমাতা, মোটেই ভারতমাতা নয়। 'সপ্তকোটি কন্ঠ কলকল'ই তার প্রমাণ। ওঁর বন্ধু নবীনচন্দ্র সেন অনুরোধ করেছিলেন – 'সপ্তকোটি'টা 'ত্রিংশ কোটি' করে দিন, আর বাংলা শব্দগুলোকে পালটে সংস্কৃত করে দিন, কারণ ওটা একদিন ভারতের জাতীয় সংগীত হবে। বঙ্কিমের প্রস্তাবটা মোটেই পছন্দ হয়নি। অথচ নবীনচন্দ্র নিজের 'পলাশীর যুদ্ধে'র ২য় সংস্করণে অনেক জায়গায় 'বঙ্গ' কেটে 'ভারত' বসিয়েছিলেন। বাঙালির নেশন কল্পনায় বাংলা আর ভারতের মধ্যে একটা টানাপোড়েন ছিল সেই গোড়া থেকেই; খুব সরাসরি ঝগড়া না হলেও সূক্ষ্ম প্রতিযোগিতা একটা ছিলইজাতীয়তাবাদীরা বাংলা আর ভারত দুটো নেশনই কল্পনা করেছিলেন, তবে নানাজনের কল্পনায় বা ইতিহাসে নানান পর্বে দুটো নেশনের শক্তির তারতম্য হয়ে যেত। আমাদের স্বাধীন জাতি-রাষ্ট্রটা কিন্তু ভারত না হয়ে বাংলা হবার সম্ভাবনা ইতিহাসে ছিলই। স্বাধীনতার ঠিক আগেও তো একটা অখণ্ড বাংলার প্রস্তাব উঠেছিল  

এইবার জবরজঙ্গীরা আর থাকতে পারল না, বেশ কয়েকজন মিলে দাশুকে মারতে উঠল। দাশু খোলা জানলা দিয়ে এক লাফে পালালোছুটতে লাগল উচ্চৈঃস্বরে জন লেননের গান গাইতে গাইতে – ‘Imagine there's no countries/It isn't hard to do/ Nothing to kill or die for/And no religion too/ Imagine all the people/ Living life in peace...এক জবরজঙ্গী সেদিকে তাকিয়ে বলতে গেল – ‘ওঃ, শুধু বিদেশি বই থেকে জ্ঞান ঝাড়ছে না, আবার বিদেশি গানও গাইছে! তাও যদি গলায় সুর থাকত!’ কিন্তু তার কথা শেষ হতে না হতেই টেবিলের ওপর প্রথমে একটা ফট করে আওয়াজ, তারপর গোটা ঘরটা দুমদাম শব্দে আলোড়িত হতে লাগল, চারদিকে হুলুস্থুল পড়ে গেল। দাশুর আনা হাঁড়িটার ভেতর থেকে কী যেন ফাটতে লাগল।
দাশু দূর থেকে চেঁচিয়ে বলল – ‘ওগুলো রসগোল্লা নয়, চিনেপটকা। পাকিস্তানের পাশাপাশি চিনও কিন্তু আছে। এটা মনে রাখলে আরো জোরদার হবে তোদের দেশপ্রেম, সেই ভেবেই এনেছিলাম!’

কিন্তু প্রবল গোলমালের মধ্যে দাশুর কথা কেউ শুনতে পেল না।


No comments:

Post a Comment