আজকের মে দিবস
পল্লবী বন্দ্যোপাধ্যায়
পল্লবী বন্দ্যোপাধ্যায়
বহু বছর আগের কথা। লাল
তখন বঙ্গজীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ রং।
মে
দিবসে তখন ঘুম ভাঙত প্রভাতফেরীর গণসংগীতের সুরে। মোড়ে
মোড়ে স্টেজ বেঁধে লোকাল নেতা জ্বালাময়ী বক্তৃতায় আমাদের মনে করাতেন শ্রমিকের অধিকার। তারপর
অনেক জল হুগলি নদী দিয়ে বয়ে গেছে।
হুগলির
পূব এবং পশ্চিম পাড়ের কারখানাগুলোয় একে একে তালা পড়েছে। হাজার
হাজার গেট মিটিং, সমাবেশ, হরতাল করেও হাল ফেরেনি।
নিন্দুকে
বলেছে ইউনিয়ন নেতা মালিকপক্ষের সঙ্গে 'সেটিং'
করে নিজের ভাগ বুঝে নিয়েছেন। শ্রমিকেরা
কেউ পান বিড়ির দোকান দিয়েছে, কেউ রিক্সা কিনেছে,
কেউ ভিন রাজ্যে পাড়ি দিয়েছে, কেউ দেশে ফিরে গেছে। শ্রমিকের
গৃহিণী ঠিকে ঝি হয়ে গেরস্থ বাড়ির বাসন মাজতে শুরু করেছে।
তারপর ভারতে সোনার দিন এসেছে। লগ্নির
জোয়ার এসেছে। তথ্য
প্রযুক্তি শিল্পে কর্মসংস্থান হয়েছে কয়েক লক্ষ মানুষের। মোড়ে
মোড়ে ঝাঁ চকচক মল হয়েছে।
দলে
দলে ছেলেমেয়েরা দোকান রেস্তোরাঁ মাল্টিপ্লেক্সের কর্মী হবার সুবর্ণ সুযোগ পেয়েছে। ক্রমে
ভারতবর্ষ প্রথম বিশ্বের পছন্দের 'স্লেভ মার্কেটে'
পরিণত হতে পেরেছে।
এ
হেন জোয়ারের জল বাংলাকেও বাদ দেয়নি।
প্রচুর
ছোট ব্যবসায়ী অসংখ্য ছোটখাটো অফিস খুলে বসেছে। কর্মচারী
রেখেছে। এমপ্লয়ার
হয়ে উঠেছে। তারা
কেউ চিটফান্ড, কেউ মন্টেসরি স্কুল, কেউ আইটি, কেউ বুটিক, কেউ রিয়েল
এস্টেট সংস্থার মালিক।
সব
মিলিয়ে,
হোয়াইট কলার চাকরির সংখ্যা বিপুলভাবে বেড়েছে।
কারা এই হোয়াইট কলার চাকর? এরা প্রতিদিন সকালে উঠে ধোপদুরস্ত পোশাক পরে অফিস যায়। নির্দিষ্ট
সময়ের বহু পরেও অফিসে বসে কাজ করে কোনও ওভারটাইম ছাড়াই,
বছরের শেষে বসের/মালিকের কাছে মাইনে বাড়ানোর জন্য কাঁদুনি গায়,
ছুটির দিনে বাড়িতে বসে এবং কখনও অফিসে গিয়ে কাজ করে। ছোট
সংস্থাগুলোর কর্মীরা অনেকে এমনকি ঠিক সময়ে মাইনেও পায় না। এই
সংস্থাগুলোর বেশিরভাগ আবার পিএফ গ্র্যাচুইটির ধারও ধারে না। এবং
মালিকপক্ষের ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দ অনুযায়ী ধর্ম, জাতপাত, লিঙ্গের ভিত্তিতে যথেচ্ছভাবে কর্মীদের ডিসক্রিমিনেট
করে।
মজার ব্যপার হল,
এই সংস্থার কর্মীদের অধিকার নিয়ে ডান বাম কোনও পক্ষেরই কোনও মাথাব্যথা
নেই। কারণ,
নির্বাচনী ফান্ডে এই সংস্থার কর্ণধারেরা মুক্তহস্তে দান করে থাকেন এবং প্রয়োজনে নেতাদের
ব্যক্তিগত সুযোগ সুবিধার কথা মাথায় রেখে সেইমতো সেবার আয়োজনও করে থাকেন। সংস্থা
যদি হয় টিসিএস-এর মতো বড় নাম, তাহলে কর্মী ছাঁটাই-এর
খবর সাধারণের কর্ণগোচর হয়, অন্যথায় তাও না। সব
মিলিয়ে এই ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’র জমানায়ও সাদা কলারের বাবু বিবিরা বেশ অসহায়।
আসুন,
আজকের মে দিবস আমরা India Inc-এর কর্পোরেটদের উৎসর্গ
করি।
No comments:
Post a Comment