হওয়া না হওয়া বিষয়ে দুটি-একটি কথা
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য
আবার বাজেট। প্রতি বছরের মতো। আর এই বাজেটকে কেন্দ্র করে
মিডিয়া ও রাজনৈতিক মহলে সেই তুমুল হৈ-হট্টগোল। সাধারণ মানুষও জুটে যান এইসব আলোচনা
তর্কবিতর্কে। অথচ এ যে ভূতের কেত্তন তা যারা বুঝতে পারেন, তাঁরা বেঁচে যান বাড়তি
সময়-খরচ থেকে। তবুও দুটো কৌতূহল থাকে সকলেরই মনে-প্রান্তরে, বিশেষত মধ্যবিত্ত
সমাজের – এক, আয়কর কতটা বাঁচানো যাবে আর তার জন্য এবারের বাজেটে কী কী দাওয়াই দেওয়া
হল; দুই, কোন কোন ভোগ্যপণ্যের ওপর কর চাপল বা কমল, তাতে করে কী কী কেনার সুবিধা বা
অসুবিধা হল। এছাড়া বাদবাকী বিষয়ে কী থাকল না থাকল তাতে আমজনতার কিছু আসে যায় না।
কারণ, বাজেট নিছক একটি আয়ব্যয়ের হিসেব, যা বছর চলতে চলতে পালটাতে থাকে নিত্য।
এবারের বাজেটে তেমনি হুল্লোড় শুরু হয়েছে। বিশেষত টেলিভিশন
আসাতে এ বেশ এক মজার ব্যাপার হয়েছে। ১৯৯২ সালে মনমোহন সিংহ যেবার বাজেট পড়লেন
সেবার মিডিয়ার একটা বাড়তি উৎসাহ ছিল। ওইবার প্রথম ভারতীয় অর্থনীতি এক বাঁক
পরিবর্তন করে। বিশেষ করে শিল্পপতি ও ধনী ব্যবসায়ীরা খুব উল্লাসে মেতেছিল। তারপর থেকে
বাজেট ভাষণ শোনা ও তা নিয়ে কূটকচালি বেশ রেওয়াজ হয়ে দাঁড়াল।
এবারের বাজেট অধিবেশন শুরুই হল জমি বিল নিয়ে। সরকারের মনোভাবে পরিষ্কার, তারা যে ভাবে হোক জমির ওপর কর্পোরেট দখলদারিকে
নিশ্চিত করবে। প্রধানমন্ত্রীর ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’র আওয়াজের পেছনে এই যুক্তিটাই প্রবলভাবে
ছিল। সারা পৃথিবী জুড়ে ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পে যখন মন্দা ও কোনোভাবেই তার
উজ্জীবনের সম্ভাবনা নেই তখন আগ বাড়িয়ে মোদী মশাই যে দুম করে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ বলে
দিলেন তার পেছনে অন্য গভীর রহস্য আছে। তারই কিছু আভাস এবারের প্রাক-বাজেট প্রস্তুতিতে
পাওয়া যাচ্ছে।
জমি নিয়ে এত তড়িঘড়ি কীসের? ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পে যখন মন্দা, স্বাভাবিক, তাকে
কেন্দ্র করে কর্পোরেট দানবেরা তেমন উৎসাহী হবে না। কিন্তু তার নাম করে যদি জমি
হাতানো যায় তবে সে তো সোনায় সোহাগা। আর এই চালটিই চেলেছেন মোদী সাহেব- শিল্প করার
নাম করে হাজার হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করে কার্যত কর্পোরেট বন্ধুদের হাতে তুলে
দেওয়া। সর্বত্র পড়তি মুনাফার হারের কারণে তথাকথিত পরিকাঠামো গঠনই এখন সাব্যস্ত
হচ্ছে বেশি হারে আর্থিক লাভালাভের উপায় হিসেবে, আর তাই জমিই দিতে পারে এ মোক্ষম
রস। চুলোয় যাক কৃষির ভবিষ্যৎ ও খাদ্য নিরাপত্তার হাবিজাবি। তাই এবারের বাজেটে
মালুম হচ্ছে, পরিকাঠামো গঠন ও তার উন্নয়নের জন্য প্রভূত অর্থ বরাদ্দ নিশ্চিত হবে।
আর এই পরিকাঠামো গপ্পের সাবেকি তালিকাটি হল – ৬ কি ৮ লেনের রাস্তা, আধুনিক
বিমানবন্দর, পরমাণু কেন্দ্র, শপিং মল, আধুনিকতম আবাসন প্রকল্প, আন্তর্জাতিক মানের
হোটেল, স্মার্ট সিটি ইত্যাদি ইত্যাদি – যা বিপুলাকার সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগের
ভারে জমি লুঠ ব্যতিরেকে গড়ে তোলা সম্ভবই নয়। কেন এই নিদান? কারণ, জমি ও পরিকাঠামো হল
এমন এক স্থায়ী চরিত্রের সম্পদ যা বহু বহুদিন পর্যন্ত উঁচু হারে আর্থিক লাভকে
সুনিশ্চিত করতে পারে। তাই, আজকের সার্বিক মন্দার মুখে দাঁড়িয়ে কর্পোরেট লাভালাভের
এই সুনিশ্চিতি একমাত্র জমি থেকেই সম্ভব। যে পরিকাঠামোর কথা পরিকল্পকেরা মাথায়
রাখেন (যেমনটি ওপরে বলা হল) তার সঙ্গে সাধারণ মানুষের জীবনযাপনের কোনও সম্পর্ক নেই।
সাধারণ মানুষের যাপনের সঙ্গে সম্পৃক্ত যে পরিকাঠামো তা বরাবর উপেক্ষিত ও অবহেলিত।
সে কথা অন্যত্র আলোচনা করা যাবে।
আরেকটি বিষয় নিয়ে
বেশ গরম নরম আলোচনা হচ্ছে – অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার। হঠাৎ করে গত এক-দু’ মাস অর্থমন্ত্রকের
তরফে বলা হচ্ছে আমাদের বৃদ্ধির হার ৬.৯ শতাংশে পৌঁছে গেছে। এই তো সেদিনও ৫ শতাংশের নিচে ছিল। এই
সংখ্যা নিয়ে জাগলারির অনেক কেচ্ছা আছে। চীনকে তো এ ব্যাপারে ওস্তাদ বলা হয়ে থাকে।
এইসব সংখ্যাতত্ত্ব যে বেশ হাস্যরসের কারণ হয়ে উঠেছে তা এদিক ওদিক কান পাতলেই মালুম
হচ্ছে। এইসব তালেগোলে হারিয়ে যাচ্ছে ভারতীয় অর্থনীতির মোদ্দা সমস্যাটি –
কর্মসংস্থান। এ ব্যাপারে গোল গোল কিছু কথা ছাড়া মৌলিক কার্যক্রমটি তো নেওয়াই হল
না।
বিশ্বব্যাপী ম্যানুফ্যাকচারিং
শিল্পের পতনের কারণে আজকের সময়ে যে কার্যক্রমটি নেওয়া বাঞ্ছনীয় ছিল তা কর্পোরেট
অনুগামী এনডিএ সরকারের পক্ষে নেওয়া সম্ভব নয়। তা অবশ্যই ছোট ও ক্ষুদ্র শিল্পের
বিকাশ। আর শিল্প বলতে এখানে ছোট ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্প নয়, বুঝতে হবে পরিষেবা শিল্প।
পশ্চিমি শিক্ষায় আলোকিত সাহেব মন এই ছোট শিল্পের কথা শুনলে কেমন জানি এক তাচ্ছিল্য
ও করুণার রস জারিত করে। এ যেন অক্ষমের আর্তনাদ। অথচ আমূল পরিবর্তিত অর্থনীতির ধমনী
দিয়ে বয়ে চলেছে এক অন্য স্রোত। বৃহৎ ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পের যুগ মূলত শেষ হয়েছে তা
স্বীকার করে নেওয়াটাই দস্তুর। পরিষেবা-ভিত্তিক শিল্পই এখন অর্থনীতির নিয়ন্তা। আর
তা প্রযুক্তিগত কারণে দিনে দিনে আরও ছোট ছোট অবয়ব নেবে যদিও পুঁজির মূল নিয়ন্ত্রণটা
থেকে যেতে পারে বড় কর্পোরেটের হাতে। কিন্তু এ এক অনিশ্চিতির পরিসর – কে কখন থাকবে
আর ডুববে তার নাগাল পাওয়া আজকের সময়রেখায় আন্দাজ পাওয়া একেবারেই দুরূহ। এই আবহে
জমিকে আঁকড়ে অর্থনীতিকে গতি দেওয়ার পরিকল্পনা মাঠেই মারা যাবে নির্ঘাত। মোদী
সরকারের ন’ মাসের মেয়াদে শুরুর সেই পুরনো দম ফুরিয়েছে বোঝাই যাচ্ছে। এবারের বাজেট
যদি তার এই ক’ মাসের কাজের অনুসারী হয় তবে অর্থনীতির আরও এক দফা নাভিশ্বাস উঠল
বলে।
No comments:
Post a Comment