উষ্ণতার খোঁজে
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য
১৯ থেকে ২১ ডিসেম্বর ২০১৪
পুরুলিয়ার হরিপদ সাহিত্য মন্দির প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ১৩তম বার্ষিক লিটল ম্যাগাজিন
মেলা। বন্ধুবর কবি ঋত্বিক ঠাকুরের সঙ্গে ‘একক মাত্রা’র বেশ কিছু সংখ্যা নিয়ে মেলায়
বসেছিলাম দু’ দিন। এবারেই প্রথমবার। কী নিপুণ দক্ষতা ও অসীম আবেগে তাঁরা এ মেলার
আয়োজন করেন। বাইরে থেকে আসা সকলের থাকা খাওয়ার ভার নেন এঁরা, তার সঙ্গে মেলার
অন্যান্য খরচ তো আছেই, আর তার জন্য সংগঠকেরা সারা বছর ধরে নিজেদের রোজগার থেকে
অর্থ জমিয়ে এই কর্মকাণ্ডটি সমাধা করেন। একসঙ্গে বহু তরুণকে এ কাজে দেখে আরও ভাল
লাগল। ১৯ তারিখ প্রথম দিন বিকেল ৩-৩০’এ শুরু হওয়া মেলা ও সন্ধ্যে পর্যন্ত তেমন
লোকসমাগম না দেখে সংশয় হচ্ছিল কতটা কী দাঁড়াবে। সে ভুল ভাঙল রাত বাড়ার সাথে সাথে ও
পরদিন জনারণ্য দেখে। জমজমাট মেলা বলতে যা বোঝায় তারই স্পষ্ট উচ্চারণ। ‘একক মাত্রা’র
যে এত পাঠক আছেন পুরুলিয়াতে, সে ধারণাও ছিল না। কথায় কথায় জানলাম, পুরুলিয়া বাস
স্ট্যান্ড’এর কাছে কাজল চক্রবর্তী’র ম্যাগাজিন স্টলে নিয়মিত ‘একক মাত্রা’ পাওয়া
যায়। তেমন অনেক পাঠক এসেছিলেন যারা আমাদের কিছু সংখ্যা পেয়েছেন, আরও অন্য সংখ্যার
খোঁজে।
লিটল ম্যাগাজিন করিয়েদের সকলে
মিলে ধর্মশালায় থাকা, সেখানে প্রায় সারা রাত ধরে গান-বাজনা, আড্ডা, আলোচনা।
একসঙ্গে খাওয়া। নিমেষের মধ্যে সময়গুলো কোথা দিয়ে যেন ফুড়ুৎ উড়ে যায়। মেলা
প্রাঙ্গণের পাশেই সাহেব বাঁধ। চোখ জুড়নো বিস্তৃতি। মেলা তো সেই বিকেলে, তাই সকালগুলো
ছড়িয়ে পড়ে পুরুলিয়ার অপার সৌন্দর্যের নয়নাভিরাম অবলোকনে। আমরা আটজন তেমনই এক সকালে
দল বেঁধে চলে গেলাম দেউলঘাট। গোরা ও কংসাবতী নদীর সঙ্গমস্থলে আড়াই হাজার বছরের
পুরনো দুটি জৈন মন্দির (মতান্তরে, বৌদ্ধ তান্ত্রিক মন্দির) কালের সাক্ষী হয়ে
দাঁড়িয়ে আছে। সেই প্রাকৃতিক নিসর্গের কালগর্ভে সময় যেন কথা বলছে এক অলৌকিক ছন্দে।
মন্দিরের পাশেই পাঠক মহারাজের ছোট আস্তানা ও পুজোর স্থান। এক সাধ্বী বর্তমানে এই
আস্তানা চালান। সামান্য জীবনধারণের মধ্য দিয়ে কালের স্থাপত্যকে রক্ষা করে চলেছেন।
তিনিই দেখালেন নদীর ধার থেকে উঠে আসা পাথরের সিঁড়ি – যা নাকি আর্য ঋষিরা তৈরি
করেছিলেন এখানে তাঁদের তপোবনে সাধনার কালে। মনে হল, জঙ্গল ঘেরা সেই মায়াবী পরিসরে
সময় যেন আমাদের নিয়ে আছাড়িবিছারি খেলছে। তিরতির বয়ে চলা কংসাবতীর শরীরে বড় বড়
পাথরের চাঁই – সেও তো সময়ের গর্ভে এ গ্রহের আদি সৃষ্টির কালে এইভাবে পড়ে থাকা অনড়
স্তব্ধতা।
তিনদিনের মেলায় দু’ দিন
থেকেই ফিরব, তেমনই ভেবে গিয়েছিলাম। আশ্চর্য, এই দুদিনেই আমাদের সমস্ত কপি শেষ। এটা
ভাবিনি। এই অভাবিত সাড়া সত্যিই আপ্লুত করেছে। ধর্মশালা থেকে বন্ধুদের পিছনে ফেলে
যখন স্টেশনের পথে রওনা দিয়েছি তখন মেলা প্রাঙ্গণে শেষদিনের কর্মব্যস্ততা শুরু
হয়েছে। হাতে পত্রিকার কোনও কপি নেই তো কী হয়েছে, মেলার ওই উষ্ণতায় দু’ দণ্ড দাঁড়িয়ে
থাকা ও ঘুরে বেড়ানোটাও তো পরম পাওয়া।
ছবিঃ ঋত্বিক ঠাকুর।