বিহার কি আবারও পথ দেখাবে?
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য
গত দু’ শতকের ইতিহাসে
অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে অবিভক্ত বিহার বার বার রুখে দাঁড়িয়েছে, বিদ্রোহের ধ্বজা
হাতে নিয়েছে। তা ১৮৫৫ সালের সাঁওতাল বিদ্রোহই হোক কি ১৮৯৯'এর মুণ্ডা অভ্যুত্থান,
কিংবা ১৯১৭ সালের ঐতিহাসিক চম্পারণ সত্যাগ্রহ বা ১৯২০’র দশকের কিষাণ সভার সংগ্রাম,
অথবা ১৯৪২’এর ভারত-ছোড়ো আন্দোলন— জন অংশগ্রহণে বিহার সবসময়েই সামনের সারিতে দাঁড়িয়েছে,
স্ফুলিঙ্গকে দাবানলে পরিণত করেছে। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ১৯৭৪’এ জেপি’র ডাকে ‘সম্পূর্ণ
ক্রান্তি’ আন্দোলনই হোক কিংবা ১৯৮০’র দশকের গোড়ায় মধ্য বিহার জুড়ে অভূতপূর্ব কৃষক জাগরণ,
পারতপক্ষে একেকটা সময়ে স্থবির হয়ে পড়া মানুষের চৈতন্যের দিশারী হয়েছে বিহার।
আজ আবারও কি এই বিপন্ন
সময়ে বিহারের উঠে দাঁড়াবার পালা? গোটা দেশ যখন উত্থিত ফ্যাসিবাদের থাবার সামনে কতকটা
অসহায়, ছত্রভঙ্গ বা অন্তর্কলহেও দীর্ণ, তখনই বিহারের জনতা এক উপযুক্ত মুহূর্তে— যখন
ফ্যাসিবাদ এমনকী গরিব জনতার নির্বাচনী অধিকারকেও কেড়ে নিতে নির্বাচন কমিশনকে হাতের
পুতুল বানিয়ে একবগগা আক্রমণে মত্ত— রুখে দাঁড়িয়েছে। আজ ৯ জুলাই (২০২৫) বিহারের হাজারও
মানুষ পথে নেমে এসেছেন। এই জনসমাবেশ এক সর্বাত্মক বনধের রূপ পেয়েছে। শুধু তাই নয়, পাটনায়
‘ইন্ডিয়া’ জোটের নেতৃত্বে হাজার হাজার জনতা ঘেরাও করেছে নির্বাচন কমিশনের দফতর— তাদের
দাবি, অবিলম্বে SIR (Special Intensive Revision)’এর নামে কোটি কোটি গরিব, পরিযায়ী,
দলিত ও আদিবাসীদের নাম ভোটার লিস্ট থেকে বাদ দেওয়ার প্রক্রিয়া বন্ধ করতে হবে।
আমরা দেখেছি, গত মহারাষ্ট্র
বিধানসভা নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন রাতারাতি ভোটার তালিকায় জল মিশিয়ে রাজ্যে প্রাপ্তবয়স্ক
জনসংখ্যা থেকে ভোটারের সংখ্যাকে বাড়িয়ে এক অসাধু প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এনডিএ জোটকে
ক্ষমতায় আনে। এবারে তারাই বিহারে ভোটার লিস্ট থেকে রাতারাতি লক্ষ লক্ষ মানুষের নাম
বাদ দিয়ে আগামী বিধানসভা নির্বাচন তড়িঘড়ি সেরে ফেলতে উলটো কৌশল নিয়েছে। বলাই বাহুল্য,
এই প্রক্রিয়াটি ভোটারদের, বিশেষত প্রান্তিক এবং দুর্বল শ্রেণির মানুষকে, ভোটাধিকার
থেকে বঞ্চিত করার এক সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র।
১) সময় নিয়ে প্রশ্ন ও উদ্দেশ্যমূলক
নির্বাচনের এত কাছাকাছি সময়ে এই ধরনের ব্যাপক সংশোধন
প্রক্রিয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। নির্বাচন কমিশন হঠাৎ করে প্রায় ২২ বছর
পর এই ধরনের নিবিড় সংশোধন প্রক্রিয়া শুরু করেছে, যেখানে ২০০৩ সালের পর আর এমন
ব্যাপক সংশোধন হয়নি। স্পষ্ট যে, এই প্রক্রিয়াটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনকে
ব্যাহত করতে এবং একটি নির্দিষ্ট দলকে সুবিধা পাইয়ে দিতেই করা হচ্ছে। বিহারে
যেহেতু আর কয়েক মাসের মধ্যেই নির্বাচন, তাই এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য যে
সময়সীমা দেওয়া হয়েছে, তা সম্পূর্ণ অবাস্তব। এত কম সময়ে প্রায় ৮ কোটি ভোটারের
তথ্য যাচাই করা অসম্ভব।
২) বিপুল সংখ্যক ভোটারের নাম বাদ পড়ার আশঙ্কা
বিহারের মোট ভোটারের প্রায় ৩৭ শতাংশই পরিযায়ী শ্রমিক,
যারা রাজ্যের বাইরে কাজ করেন। উৎসবের সময় তাঁরা বাড়িতে আসেন। বর্তমান নির্দেশিকা
অনুযায়ী, তাঁদের নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে জন্ম শংসাপত্র বা অন্যান্য কঠিন নথি জমা
দিতে হচ্ছে। অনেক পরিযায়ী শ্রমিক, দলিত, মহাদলিত এবং অন্যান্য প্রান্তিক মানুষের
কাছে এই ধরনের নথি না থাকায় তাঁরা ভোটাধিকার হারাতে পারেন। সুপ্রিম কোর্টে দাখিল
করা আবেদনগুলিতেও উল্লেখ করা হয়েছে যে, প্রায় ৩ কোটি ভোটারের নাম বাদ পড়তে
পারে।
৩) নথিপত্র নিয়ে সমস্যা এবং প্রান্তিক মানুষের উপর প্রভাব
আধার কার্ড, রেশন কার্ড, বা মনরেগা কার্ডের মতো সহজলভ্য
নথিগুলিকে বৈধ প্রমাণ হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে না। বিহারের গ্রামীণ এলাকার দরিদ্র
মানুষের কাছে জন্মের শংসাপত্র বা ১৯৮৭ সালের আগেকার সরকারি পরিচয়পত্রের মতো নথি
থাকা অত্যন্ত বিরল। এমন বহু মানুষ আছেন যারা বহু বছর আগেই তাঁদের পরিবারের
সদস্যদের হারিয়েছেন, তাঁদের পক্ষে বাবা-মায়ের জন্ম শংসাপত্র বা অন্যান্য নথি জোগাড়
করা অসম্ভব। এর ফলে এই প্রক্রিয়াটি প্রান্তিক ও অশিক্ষিত মানুষদের জন্য বিরাট
সমস্যা তৈরি করবে এবং তাদের ভোটাধিকার কেড়ে নিতে পারে।
৪) প্রক্রিয়াগত ত্রুটি ও আইনের লঙ্ঘন
এই সংশোধন প্রক্রিয়াটি জনপ্রতিনিধিত্ব আইন, ১৯৫০-কে লঙ্ঘন
করছে। ভোটার তালিকা থেকে কোনও নাম বাদ দেওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে নোটিশ দিয়ে তাঁর বক্তব্য শোনার সুযোগ দিতে হয়। কিন্তু এই প্রক্রিয়াতে সেই আইন লঙ্ঘন করা
হচ্ছে। তাড়াহুড়ো করে এই কাজটি করায় স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে বলেও ইতিমধ্যেই
অভিযোগ উঠেছে।
৫) এনআরসি’র ছায়া
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সহ অনেক
বিরোধী নেতা এই প্রক্রিয়াতে এনআরসি’র ছায়া দেখছেন। বোঝাই যাচ্ছে, এর মাধ্যমে
অ-ভারতীয়দের নাম বাদ দেওয়ার অজুহাতে বহু ভারতীয় নাগরিককে নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে
বাধ্য করা হবে, যা পরবর্তীতে পুরো প্রক্রিয়াটাকেই ‘জাতীয় নাগরিক পঞ্জী’র দিকে
নিয়ে যেতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা, এই প্রক্রিয়ায় ভোটারদের নাগরিকত্বের প্রমাণ
এইভাবে আদায় করা অত্যন্ত অনৈতিক ও সংবিধান বিরোধী। ইতিমধ্যেই এ বিষয়ে শীর্ষ আদালতে
কয়েকটি মামলা দাখিল হয়েছে।
এই আলোকে অন্তত বিহারে দেখা
গেল, ইন্ডিয়া জোট ঐক্যবদ্ধ ভাবে এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে একযোগে পথে নেমেছে। সিপিআই(এমএল)
নেতা দীপঙ্কর ভট্টাচার্য এই SIR প্রক্রিয়াকে ‘ভোটবন্দী’ আখ্যা দিয়ে পরিষ্কার
জানিয়েছেন, এটি ২০১৬
সালের নোটবন্দীর মতো সাধারণ মানুষের জন্য ট্রমাটিক অভিজ্ঞতা নিয়ে আসবে। তাঁর মূল
প্রশ্ন, কেন ২২ বছর পর হঠাৎ করে এই ধরনের ব্যাপক সংশোধন করা হচ্ছে এবং কেন কোনও
রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা না করেই এটি শুরু করা হল? তাঁর মত, ভোটারদের নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে এমন নথিপত্র চাওয়া হচ্ছে যা
বহু সাধারণ মানুষের কাছে নেই, বিশেষ করে জন্ম শংসাপত্রের মতো নথি (এমনকী
প্রধানমন্ত্রী মোদিজীরও যা নেই)।
লোকসভার বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধী SIR প্রক্রিয়াকে ‘গরিবদের
ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়ার ষড়যন্ত্র’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বিহারের বন্যা
পরিস্থিতি এবং পরিযায়ী শ্রমিকদের সমস্যার কথা তুলে ধরেছেন, যারা এই মুহূর্তে
প্রয়োজনীয় নথি জমা দিতে অক্ষম।
আরজেডি নেতা তেজস্বী যাদব SIR প্রক্রিয়াকে ‘অবৈধ ও
অগণতান্ত্রিক’ আখ্যা দিয়েছেন। তাঁর মতে, ২৫ দিনের মধ্যে ৮ কোটি ভোটারের যাচাই
হওয়া অসম্ভব, বিশেষ করে যখন প্রায় ৪ কোটি বিহারী রাজ্যের বাইরে থাকেন। তিনি
নির্বাচন কমিশনের কাছে আধার কার্ড, রেশন কার্ড ও মনরেগা কার্ডকে বৈধ নথি হিসেবে
অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানিয়েছেন। তাঁর অভিযোগ, এই প্রক্রিয়া সম্পর্কে নির্বাচন
কমিশনের কোনও স্পষ্টতা নেই এবং তাদের জারি করা বিভিন্ন বিজ্ঞপ্তিতে বিভ্রান্তির
সৃষ্টি হচ্ছে। তাঁরও আশঙ্কা, প্রয়োজনীয় ১১টি নথি না থাকায় বহু দরিদ্র ও
প্রান্তিক মানুষের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়বে।
দিনের শেষে এই লেখা যখন প্রকাশের মুখে তখন গোটা বিহার
জনজোয়ারে অচল হয়ে পড়েছে। নির্বাচন দফতরের অদূরে দাঁড়িয়ে বিরোধী নেতারা তীব্র
ভাষায় নির্বাচন কমিশন এবং রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের সমালোচনা করেছেন। তাঁদের
মতে, নির্বাচন কমিশন 'একটি রাজনৈতিক দলের শাখা' হিসেবে কাজ করছে এবং 'গুজরাতের দুই
ব্যক্তি' বিহারের ভোটারদের ভোটাধিকার নির্ধারণ করছেন। তাঁদের আশঙ্কা, এই
প্রক্রিয়ার মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ গরিব মানুষের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়লে
পরবর্তীতে তাদের রেশন ও পেনশনও বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
অবশ্য, সমস্ত জড়তাকে ছিন্ন করে বিহারের জেহানাবাদ থেকে দ্বারভাঙ্গা, আরাড়িয়া থেকে
মুজাফফরপুর, নওয়াদা থেকে অরওয়াল— সর্বত্র পথে নেমেছেন মানুষ। চাক্কা জ্যাম’এর ডাক
দিয়ে যে আন্দোলনের শুরু তা আজ বিহার বনধ’এ রূপান্তরিত হয়েছে। আগামী দিনে এই
আন্দোলন সারা ভারতে প্রভাব ফেলে কিনা, অথবা, নির্বাচন কমিশন কিছুটা নরম হওয়া থেকে শেষমেশ পিছু
হঠে কিনা, এসব দেখার রইল। সব থেকে বড় কথা, এই প্রক্রিয়া যদি চালু থাকে, তার
অন্তিমে কতজন ভোটারের নাম বাদ গেল, সেও দেখার। তারপর বিহার আবারও অগ্নিগর্ভ হয়ে
ওঠে কিনা, তা ভবিষ্যৎই বলতে পারবে।
তবে সাধু সাবধান! বিহারের পর এবারে লক্ষ্য পশ্চিমবঙ্গ! আপনার-আমার ভোটাধিকার থাকবে তো?
সুপ্রিম কোর্টে মামলা চলছে। সুপ্রিম কোর্ট বলবে, আগের ভোটের তালিকা অনুযায়ী হবে। পরে দেখা যাবে। অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের খুঁজে বের করতে হবে।
ReplyDeleteকেন্দ্রীয় সরকার ২০১৯ সালের ৬ মে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশ দিয়েছিল সারা ভারতবর্ষে আসামের মতো ফরেনার্স ট্রাইবুনাল তৈরি করা হবে বিদেশি খোঁজা নিয়ে।
বিহারের জনগণের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। এখন থেকে শুধু একটা বিষয় নিয়ে আলোচনা করবে, " কাগজ আছে? কাগজ কোথায় পাওয়া যাবে? " এখানেই কেন্দ্রীয় সরকার সফল। আর কিছু করার দরকার নেই।
রুটি-রুজি-নিরাপত্তার ন্যারেটিভ ছেড়ে, কাগজ-এর ন্যারেটিভ কেন ময়দানে আনতে হচ্ছে শাসক শ্রেণীকে ? তার কারন ভয়, পরাজয়ের ভয়। পশ্চিমবঙ্গে পরাজয় নিশ্চিত, এর সাথে বিহার যুক্ত হলে কেন্দ্রের জোড়াতালি সরকারের পতন অবশ্যম্ভাবি, এটা জানে ভাজপা। ফলে তাদের হাঁটু কাঁপছে এবং তৈরি করতে চাইছেএকটা ঘোলাজল। মহারাষ্ট্রে যুক্ত আর এখানে বিযুক্ত। দেখা যাক এই চক্রান্ত সফল হয় কিনা।
ReplyDeleteযে রাজ্যে আমি ভোট পাই না, আমি দ্বিতীয় স্থানে থাকি, সেখানে ভোটাধিকার হরণ ও ভোটবন্দি করাটাই শাসকের হাতে সহজ অস্ত্র। তুমি আমার ভোটার নও, অতএব তুমি ভোটার নও, সহজ যুক্তি। না রাহেগি বাঁশ, না বাজে গি বাঁশরি।
ReplyDelete