Saturday 22 July 2023

সমর বাগচী

'বৃক্ষমূলে আমার ঘনিষ্ঠতম কথা রেখে দিয়েছি'

তুষার চক্রবর্তী



(১৯৩৩ - ২০২৩)

 

'একক মাত্রা' পত্রিকার সৌভাগ্য, একেবারে শুরু থেকে লেখক, পাঠক, আজীবন গ্রাহক ও শুভানুধ্যায়ী হিসেবে তো বটেই, অভিভাবক ও পরামর্শদাতা হিসেবেও সমর বাগচীর নিরন্তর সান্নিধ্য এই পত্রিকা পেয়ে এসেছে। পরিচালনা করেছেন 'একক মাত্রা'র বিষয়কেন্দ্রিক আড্ডা। সাহায্য করেছেন নানা ভাবে। তাঁর মৃত্যু আমাদের তাই বিশেষ ভাবে রিক্ত করে দিল।  

বয়সকে কী করে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে বিভিন্ন মতামতের মানুষকে নিয়ে সামাজিক কাজে ব্যাপৃত হওয়া যায়- এই দুটো বিষয়ে সমর বাগচী ছিলেন বঙ্গসমাজে উজ্জ্বল এক ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত। গত কয়েক বছর শারীরিক অসুস্থতায় যখন হাসপাতালে ঘনঘন যেতে হচ্ছে, তখনও তিনি মাঝের ফাঁকগুলি ভরিয়ে রাখতেন কাজ কাজ আর কাজে। বিজ্ঞান শিক্ষা, প্রকৃতি ধ্বংসের যে কোনও উদ্যোগকে প্রতিরোধ করা ও গরিব মানুষের অধিকার আদায়ের জনআন্দোলনের কোনও কাজ বা কর্মসূচিই সমর বাগচীকে বাদ দিয়ে সম্পন্ন হতে পারে, এমনটা কেউ ভাবতে পারেনি। এ ধরনের প্রায় প্রতিটি কর্মসূচির শুরুতেই তিনি হাজির থেকেছেন অর্থ ও সামর্থ্য নিয়ে। ডেকে এনেছেন নানা বয়সের, নানা ক্ষেত্রের বন্ধুদের। কর্মসূচিকে সাফল্যমণ্ডিত করেছেন। এবং যদি কোনও আর্থিক ঘাটতি থেকে থাকে, তা যথাসাধ্য পূরণ করার দায় বহন করা থেকে তাঁকে কোনওভাবেই কখনও ঠেকানো যায়নি। এমন একজন সমাজবন্ধু মানুষের অভাব এখন থেকে আমাদের তাই প্রায় প্রতিদিন পদে পদে অনুভব করতে হবে।

'একক মাত্রা' যাত্রা শুরু করেছিল বিশ্বায়নের শুরুতেই- ১৯৯৮ সালে- 'একক সাময়িকী' হিসেবে। প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদ বিষয় ছিল 'বিশ্বায়ন'। নিবন্ধিকৃত হয়ে 'একক মাত্রা' নামে তা নিয়মিত প্রকাশিত হতে শুরু করল ২০০০ সাল থেকে। এই প্রথম বছরে নভেম্বর মাসে প্রকাশিত তৃতীয় সংখ্যার প্রচ্ছদ বিষয় ছিল 'প্রযুক্তি ও ভবিষ্যৎ'। সেই সংখ্যায় 'প্রযুক্তির মুক্তির সন্ধানে' শিরোনামে সমর বাগচী, কীভাবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে হাইজ্যাক করেছে পুঁজি ও ভোগবাদী আকাঙ্ক্ষা, তা নানা উদাহরণ দিয়ে দেখান। তিনি বিশ্বাস করতেন, এর বিপরীতে এক সাম্যপূর্ণ কল্যাণকর ও টেকসই উন্নয়নের বিকল্প পথ আমাদের বেছে নিতে হবে এবং প্রকৃতি বিধ্বংসী বর্তমান জীবন প্রণালী থেকে মানুষ মুখ ঘোরাবেই ঘোরাবে। গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ ও মার্কস'এর নিবিড় পাঠ তাঁর এই বিশ্বাসকে পোক্ত করেছিল। সব থেকে বড় কথা হল, শুধু ব্যক্তিগত আবেগের প্রকাশ হিসেবে নয়, BITM'এর অধিকর্তার পদ থেকে অবসর নেবার পর তাঁর প্রতিটি কাজ ছিল এই লক্ষ্যের দিকে এগোবার একেকটি পদক্ষেপ। এই প্রবন্ধের কথাগুলি সমর বাগচী'র অনেক লেখায় ও প্রায় প্রতিটি বক্তৃতায় ঘুরে ফিরে এসেছে।

'একক মাত্রা'র বর্তমান সংখ্যার প্রচ্ছদ বিষয়, সকলেই জানেন, 'জলাভূমি'। আমাদের পরিবেশ ভাবনায় জলাভূমি এখনও অবহেলিত বিষয়। 'একক মাত্রা'য় প্রকাশিত তাঁর প্রবন্ধে সমরবাবু আজ থেকে দু' দশক আগেই লিখেছিলেন: 'পৃথিবীর সমস্ত জলাভূমি ভরাট হয়ে যাচ্ছে। পুকুর, নদী ও সমুদ্রের জল দূষিত হচ্ছে। এর ফলে জলে অবস্থান করে যে জীববৈচিত্র তা দ্রুত হারে নিঃশেষিত হচ্ছে।' আর, রোগশয্যা থেকেও আমাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন একটি দীর্ঘ লেখা: 'ভারতবর্ষ কোন পথে?'। দুই কিস্তিতে এই লেখাটি স্বাধীনতার ৭৫ বর্ষ পূর্তি উপলক্ষ্যে প্রকাশিত হয় 'একক মাত্রা' ব্লগে। বিগত ৭৫ বছরের যাত্রাপথের মূল ভ্রান্তি, ১৯৬৩ সালে নেহরুর গান্ধীকে ভুল বোঝা ও ভুল পথ বেছে নেবার স্বীকৃতি, আজকের জনজীবনের সংকট অতিক্রম করার একটি সম্ভাব্য রূপরেখাও তিনি যেখানে তুলে ধরেন।

আজ মানুষের বাসভূমি এই গ্রহ আর বিশ্বের সব চাইতে জনবহুল ও প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ আমাদের দেশ– দুইই এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। অরুণ মিত্রের যে কবিতা সমর বাগচী কখনও বক্তব্যের শুরুতে, কখনও শেষে উপস্থাপিত করতেন, তার মধ্যেই ধরা আছে অবিস্মরণীয় এই বিজ্ঞান–দার্শনিকের মূল সঞ্জীবনী বার্তা-

'বৃক্ষমূলে আমার ঘনিষ্ঠতম কথা রেখে দিয়েছি

আমার সমস্ত আত্মীয়তার মধ্যে

কেননা আকুল জল এখানেই ঢালা হয়েছিল...'

 

         

              ,       

4 comments:

  1. আমরা ওঁর কাছে বহু বিষয়ে আশ্রয় পেয়েছি। শ্রমজীবী বিদ্যালয়ে উনি ক্লাস নিয়েছেন ওঁর অননুকরণীয় ভঙ্গিমায়। পরমানু বিদ্যুত বিরোধী লড়াইয়ে ওনার সঙ্গী ছিলেন অনেকে।

    ReplyDelete
  2. সুজয় বসু , মেহের ইঞ্জিনিয়ার, গৌতম সেন , প্রদীপ দত্ত আর সমর বাগচী এই পাঁচজন ছিলেন পরমাণু অস্ত্র ও পরমাণু শক্তি বিরোধী আন্দোলনের অঘোষিত কেন্দ্রীয় কমিটি

    ReplyDelete
    Replies
    1. এই সারণিতে আরো একটা নাম মনে পড়লো: ডা: হুসেনুর রহমান। এক বিশিষ্ট ব্যক্তি।

      Delete
  3. অসাধারণ লেখা, আর তাকে নিয়ে লেখা সেই অসাধারণ ব্যাক্তিত্ব আলোকসাগরপারে আলোকময় থাকুন

    ReplyDelete