Tuesday, 22 October 2019

এক সাধারণের জবানিতে অভিজিৎ


তিনি থাকুন তাঁর মতোই
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য
আমরা যারা নিতান্তই পিএনপিসি করা, সবজান্তা শিরোমণি, অকালপক্ক, খাপ পঞ্চায়েত বসানোয় ওস্তাদ, কুচুটে বাঙালি, তারা সক্কলেই অন্তত একটা ব্যাপারে খুব পাকা মস্তিষ্ক: পুরে দেওয়া। যেমন, জেলে পুরে দেওয়াটা বেশ আমোদের। কিন্তু সে ক্ষমতা তো আবার আমার-আপনার নেই। পুলিশ তেমন ‘নিন্দেমন্দ’ কাউকে যদি জেলে পুরে দেয় তো আমাদের ভারী উৎসাহ। কিন্তু বাকী ‘পুরে দেওয়া’গুলোতে আমরা বেশ সিদ্ধহস্ত। কেউ যদি কম কথা বলে, তাকে আমরা দেমাকির ঘরে পুরে দিই, কেউ যদি একটু বেশি এগিয়ে এসে কারও সাহায্যে লাগে তো তাকে ‘নির্ঘাৎ ধান্দাবাজি’র খোপে ফেলতে আমাদের কালবিলম্ব হয় না, কেউ যদি ‘সর্বজন-স্বীকৃত’র বাইরে অবস্থান করে সে নিশ্চিত পাগল অথবা সন্দেহজনক। আর রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক মতামতকে সর্বাগ্রে পার্টির খোপে পুরে দিতে আমরা আরও তৎপর। সাধে কি আর রবীন্দ্রনাথ, তাঁর নোবেল প্রাপ্তির পর কলকাতা থেকে ট্রেন ভাড়া করে শান্তিনিকেতনে সংবর্ধনা দিতে আসা তাঁর নিন্দুকদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, আজ আমাকে দেয় আপনাদের সম্মাননা আমি ওষ্ঠ অবধি তুলতে পারি মাত্র, তাকে পান করার শক্তি আমার নেই।

অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নোবেল প্রাপ্তির পর দেখা গেল একশ্রেণি বাঙালির সেই চির অভ্যেস আবার চাগাড় দিয়ে উঠল। রবীন্দ্রনাথ, অমর্ত্য সেন তাঁদের নোবেল প্রাপ্তির আগে যতটা বাঙালি সমাজে পরিচিত ব্যক্তিত্ব ছিলেন, অভিজিৎ তা একেবারেই নন। হঠাৎ করে এমন এক প্রায়-অজানা বাঙালি নামের সঙ্গে নোবেল ঘোষণা জড়িয়ে যেতেই প্রাথমিক হতচকিত হয়ে পড়া একটা হল বটে কিন্তু বাঙালি যেহেতু বড় সেয়ানা তাই জানে, হাতের মুঠোয় গুগল থাকতে ‘ফলস খাওয়াটা’ অত অস্বস্তির কিছু নয়। নিমেষে সকলে জেনে গেলেন, অভিজিৎ কাহারে কয় আর তার কত ও কী কী প্রকার। ব্যস। শুরু হয়ে গেল পুরে দেওয়ার খেলা। এক পক্ষ তাকে পুরে দিলেন বিজেপি বিরোধী শিবিরে, প্রায়-বামপন্থী সার্টিফিকেটও জুটে গেল তাঁর তো অপর পক্ষ সেটাই সত্য ধরে নিয়ে তাঁর ‘ন্যায়’ নীতিকে জনগণ প্রত্যাখান করেছে ও তিনি দুইবার বিবাহিত, উপরন্তু তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী বিদেশি, অতএব প্রকারান্তরে নীতিভ্রষ্ট, নিদেনপক্ষে কংগ্রেসি বা বামপন্থী খোপে ফেললেন তাঁকে। কেউ কেউ আবার এক কাঠি ওপরে উঠে নিজেদের বিজ্ঞতার জানান দিতে এমনও বললেন যে দারিদ্রই তাঁকে মহার্ঘ করেছে।

এবার যেই প্রধানমন্ত্রী মোদির সঙ্গে অভিজিতের সাক্ষাৎ হল, বয়ানটি হয়ে যেতে শুরু করল উলটো। এবার আরেক দফা হতভম্ব হয়ে পড়ার পালা। যারা তাঁকে দ্বিতীয় বিয়ে নিয়ে খোঁটা দিচ্ছিলেন তাঁরা এবার হয়ে পড়লেন তাঁর গুণগ্রাহী এবং ভারতীয় অর্থনীতি পরিকল্পনায় তাঁর সাহায্য নেওয়ার কথাও ঘোষণা দিয়ে দিলেন। আর সেই প্রথম পক্ষ যারা তাঁর দারিদ্র দূরীকরণ কর্মযোগে বৈপ্লবিক সম্ভাবনা দেখছিলেন ও মোদি বিরোধী এক প্রবল প্রতিপক্ষকে খুঁজে পেয়েছিলেন তাঁরা এবার ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে হয় খানিক চুপ করলেন বা আসলে তো তিনি পুঁজিবাদের পক্ষেই কাজ করছেন এইসব যা হোক আমতা আমতা করে বলে আপাতত রণে ভঙ্গ দিলেন। আর এসবের ফাঁকেই অভিজিৎ পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন, তিনি একজন আপাদমস্তক পেশাদার এবং যে কোনও দল বা সংস্থা তাঁর মতামত চাইলে তা তিনি দিতে রাজী। বিপ্লব ও হিন্দুত্ব দুইই সাঙ্গ হল, নটে গাছটিও মুড়লো।

এবার তিনি নিশ্চিন্তে চলাচল করুন, স্বাধীন মতে কাজ করুন এবং যা মনে করেন তাইই লিখুন, বলুন। বিমুদ্রাকরণ কার্যক্রমের বিরুদ্ধে বা ভারতীয় অর্থনীতির খারাপ অবস্থা সম্পর্কে বললেই তিনি যেমন কংগ্রেসি বা বামপন্থী হয়ে যান না, তেমনই আমলাতন্ত্রকে মোদি সবক শিখিয়ে ভালই করছেন বললেও তিনি বিজেপি বা হিন্দুত্ববাদী হয়ে যান না। তিনি অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে নতুন ভাবে কাজ করছেন, সে কাজের ভালমন্দ আছে, তিনি তাঁর বহুমূল্য কাজের স্বীকৃতি পেয়েছেন। কলকাতার ছেলে, আমাদের ঢঙে চলেন, বলেন, বাঙালিয়ানায় পুরোদস্তুর, আমাদের গর্বের কথা। তাঁর কাজে অনেক মানুষের উপকারও হয়েছে, হচ্ছে, সেও বড় কথা। তাঁর কাজের সমালোচনাও গড়ে উঠবে, তাও খুব স্বাভাবিক। কিন্তু তাঁকে স্রেফ আপনাদের খেয়ালে গড়া রাজনীতির খোপে পুরে দেবেন না। কারণ, আজকের রাজনৈতিক অর্থনীতির ভুবনে অমন সাদা-কালোয় গড়া কোনও নির্দিষ্ট খোপও কিছু নেই।             

Sunday, 13 October 2019

কাশ্মীর নিয়ে দু-চার কথা

৩৭০  ধারা বাতিলের কৃতিত্ব কংগ্রেসেরও 
 সৌমেন  নাগ
১৯৪৭  সালের ১৫ আগস্ট  ব্রিটিশ  ঔপনিবেশিক শাসকের হাত  থেকে ভারতকে দ্বিখণ্ডিত করে ক্ষমতার বাটোয়ারার মাধ্যমে শাসন ভার পাওয়ার পর ধরে নেওয়া হয়েছিল, এবার  দুই  সম্প্রদায় তথা দুই দেশের শাসকেরা অন্ততপক্ষে লক্ষ লক্ষ মানুষের সব হারানোর আর্তনাদের বিষাদঘন ঘটনাগুলির কথা মনে রেখে উভয় খণ্ডের মধ্যে শান্তির প্রচেষ্টায় ব্রতী হবেন। কিন্তু ১৫ আগস্ট  থেকে ২৭ অক্টোবর- মাত্র তিন মাসের মধ্যেই উভয় দেশের সেনাবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ল একে অপরের বিরুদ্ধে। লক্ষ্য কাশ্মীরের দখল। ১৯৪৯ সালের ১ জানুয়ারি উভয় দেশের মধ্যে যুদ্ধবিরতির চুক্তি হয়। কাশ্মীর দ্বিধাবিভক্ত হয় যুদ্ধ বিরতির রেখা বরাবর। ২৭ জুলাই ১৯৪৯ রাষ্ট্রসঙঘের ভারত-পাকিস্তান বিষয়ক কমিটির উপস্থিতিতে করাচীতে উভয় দেশ যুদ্ধবিরতি রেখা চিহ্নিত করে যে চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেছিল, মনে করা হয়েছিল এই রেখাটিকেই উভয় দেশের সীমানা চিহ্নিত করে একটা স্থায়ী সমাধান হতে পারে; দেশের সাধারণ মানুষ এই যুদ্ধের উত্তাপ থেকে সরে এসে নতুন করে তাদের ভাঙা ঘরে ভবিষ্যৎ গড়ার কাজে শান্তিতে অবশিষ্ট খুদকুড়ো নিয়ে আত্মনিয়োগ করতে পারবে। সমস্যা হচ্ছে, সাধারণ মানুষ শান্তি চাইলেও সেই শান্তি যে ক্ষমতার কারবারীদের ক্ষমতাকে ধরে রাখতে অনিশ্চয়তার আশঙ্কার সামনে দাঁড় করিয়ে দেয় অশান্তিকে টিকিয়ে রাখতে, তাই তারা আজকের দুনিয়ায় নবতম ভয়াবহ অস্ত্র ধর্ম ও জাতিগত বিভেদ নীতিকে ব্যবহার করে।

৭০ বছর ধরে জম্মু-কাশ্মীর-লাদাখ নিয়ে  চলেছে ভারত পাকিস্তানের রাজনৈতিক লড়াই। তিন তিনটি যুদ্ধের উত্তাপ সইতে হল উভয় দেশের মানুষকে। এখনও প্রতিদিন যুদ্ধের হুমকির উত্তেজনার তাপে উভয় দেশের মানুষের ক্ষুধার রুটি সেঁকার পরিবর্তে উত্তেজনার অনিশ্চয়তার ভাবনাকে সেঁকতে হচ্ছে। কতদিন  চলবে একে অপরের বিরুদ্ধে এই মানসিক লড়াইয়ের বন্দীশালায় আটকে রেখে মূল সমস্যাগুলি থেকে তাদের দূরে রাখার এই কৌশলের খেলা? এবার  তো সময়  এসেছে এর এক স্থায়ী  সমাধানের।

লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান বা লড়কে লেঙ্গে হিন্দুস্থানের মতো লড়কে লেঙ্গে কাশ্মীর যে সম্ভব নয় এটা জেনেও আমাদের  রাজনৈতিক প্রভুরা তাদের ভোট মৃগয়ার স্বার্থে বাস্তব কথাটা বলতে পারছেন না। সেদিন জহরলাল নেহেরু যুদ্ধ  বিরতির কথা ঘোষণা না করলে সম্পূর্ণ  কাশ্মীর আজ ভারতের অংশ হত, সৃষ্টি  হত না আজাদ কাশ্মীর-  এইসব বিলাপের কোনও মূল্য বর্তমান আন্তর্জাতিক বিন্যাসে নেই। অতীতের রাষ্ট্রনেতার কোনও চুক্তি সেই শাসনের অবসানের সঙ্গে বাতিল হয় না। তাহলে তো জার শাসনের চুক্তি বলে আলাস্কায় আমেরিকার অধিকার বাতিল হয়ে  আবার রাশিয়ার অধিকারে চলে আসত। চীন তখন দুর্বল ছিল বলে শক্তিশালী ব্রিটিশ শাসকদের তৈরি ডুরান্ড বা ম্যাকমোহন লাইনকে সীমানা বলে মেনে  নিয়েছিল, তাহলে তো চীনের এই যুক্তি মেনে ভারতের অনেক এলাকা চীনের হাতে  দিয়ে  দিতে হয়। আবার শক্তিশালী মাঞ্চুরিয়া সাম্রাজ্যের আমলে চীনের অধীনে যে বিশাল  এলাকা এসেছিল তা আজকের  তথাকথিত  সমাজতান্ত্রিক চীনের দাবি  অনুসারে  মেনে  নিলে ভারতও তাহলে  দাবি  করতে পারে, অতীতের ভারতীয় সম্রাটরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যে বিশাল এলাকা জুড়ে  তাদের  সাম্রাজ্য  বিস্তার  করেছিল সেগুলি আজ ভারতের অন্তর্ভুক্ত  হবে। আজকের বাস্তবতায়  যা সম্ভব তাকে বিবেচনায় এনে সমস্যার স্থায়ী  সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। বার্লিনের প্রাচীর ভেঙ্গে দুই জার্মানি এক হওয়ার মতো ভারত ও পাকিস্তানের দ্বি-জাতিতত্ত্বের প্রাচীর সরে গিয়ে  আবার  দুই  দেশ এক হবে, এই সুখস্বপ্ন সত্যি হলে তার থেকে সুখকর আর কিছু  হতে পারে না। কিন্তু বাস্তবকে  নিয়ে  ভাবতে হবে। খোঁজ  করতে হবে মীমাংসার পথ।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী  লোকসভায়  ঘোষণা  করেছেন,  শুধু  পাকিস্তান  অধিকৃত কাশ্মীর নয়, চীনের দখলে  থাকা লাদাখকেও তিনি  মুক্ত করবেন। প্রতিটি  ভারতবাসী তাই চায়। তবে চাওয়া  ও পাওয়ার  মাঝে  যে বিশাল ফাটল তাকে অতিক্রম করার পথও যে বলা দরকার। আপাতত  চীন এই আলোচনার বাইরে  থাক। পাকিস্তানের  দখলে  থাকা কাশ্মীর যা আজাদ কাশ্মীর নামে পরিচিত তার সম্পর্কে  তো আমাদের  জানাটাও অনেকটা ভাসা ভাসা।

পাকিস্তানের অধীন এই এলাকাটির দুটি ভাগ। একটি আজাদ কাশ্মীর। এটি জম্মু ও কাশ্মীর  প্রদেশের পশ্চিম অংশ। আয়তন  ৫১৩৪ বঃ কিমি যা পাক অধিকৃত কাশ্মীরের ১৫ শতাংশ এবং সমগ্র  জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের ৬ শতাংশ মাত্র। তুলনামূলক ভাবে পাক অধিকৃত কাশ্মীরের উত্তরাঞ্চলের  আয়তন অনেক বড়। পাক অধিকৃত  কাশ্মীরের ৮৫ শতাংশ। এই অঞ্চলটি প্রায় জনবিরল। তবে মনে রাখা দরকার, গিলগিট এজেন্সি ও বালতিস্থান নিয়ে এই উত্তরাঞ্চল ব্রিটিশ রাজনৈতিক প্রতিনিধির নিয়ন্ত্রণাধীন প্রশাসনিক বাঁধনে কাশ্মীরের আংশিক নিয়ন্ত্রণে থাকলেও এটি সম্পূর্ণ  ভাবে কাশ্মীরের  অংশ ছিল না।  ব্রিটিশ প্রতিনিধি মেজর ব্রাউনের প্ররোচনায় গিলগিট এজেন্সির আদিবাসী নেতারা সেখানে পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলন  করে তারা পাকিস্তানে যোগ  দিয়েছে বলে ঘোষণা করেছিল। চীন, তিব্বত, আফগানিস্তান ও রাশিয়ার সীমান্তবর্তী  বলে এর সামরিক গুরুত্ব  খুব বেশি। গিলগিট ও বালতিস্তান  নিয়ে  গঠিত  এই অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ শিয়া এবং আদিম জনজাতি। এরা নিজস্ব নেতা দ্বারা শাসিত। পাকিস্তানের  দখলে  থাকলেও এরা সেখানকার  আইন রীতিনীতির খুব একটা ধার ধারে না।

কাশ্মীরের মানুষের  আত্মনিয়ন্ত্রণের  অধিকার  অবশ্যই  আছে। তাদের যদি মনে হয় সেই অধিকার  খর্ব  হচ্ছে, তাদের  আন্দোলনেরও অধিকার আছে। এই অধিকার শুধু কাশ্মীরীদের ক্ষেত্রে নয় সব সম্প্রদায় তথা জাতির আছে। কিন্তু  এই অধিকারে যদি ধর্মীয় পরিচয় প্রধান হয়ে দাঁড়ায় তখন কিন্তু  তাকে আর আত্মনিয়ন্ত্রণের আন্দোলন বলা চলে না। সেটা  হয়ে  দাঁড়ায় সাম্প্রদায়িক ভাবনার প্রকাশ। এখানেই  মানবাধিকার  সংগঠনগুলির দুর্বলতা প্রকট হয়ে পড়ছে। এরা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস নিয়ে প্রতিবাদে মুখর হয় অথচ মৌলবাদী মুসলিম সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বহু ক্ষেত্রেই এক আত্মক্ষয়ী  নীরবতা পালন করে বলেই সাধারণ মানুষ তাদের প্রতিবাদকে ভোট  রাজনৈতিক  দলগুলির মতো মুসলিম  তোষণ বলে তাদের পাশে আসতে  চান না। অথচ সাধারণ মুসলিম জনগোষ্ঠী কিন্তু  এই সন্ত্রাসবাদী  ইসলামি ভাবনাকে সমর্থন করে না। এই প্রসঙ্গে  আরও  একটি প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার দরকার  ছিল। কারা কাশ্মীরী? কাশ্মীরী পণ্ডিতরা কি কাশ্মীরী নয়? ধর্ম  বিশ্বাসে তারা হিন্দু  বলে কাশ্মীর থেকে সাম্প্রদায়িক  ইসলামিক সন্ত্রাসবাদীদের আক্রমণ থেকে বাঁচতে দলে দলে তাদের জন্মভূমি কাশ্মীর  থেকে তারা পালিয়ে এসে উদ্বাস্তু শিবিরে আশ্রয়  নিয়েছিল, তখনই  তো সব ধর্মনিরপক্ষ সংগঠনগুলির বোঝা দরকার  ছিল যে এই ঘটনা পাল্টা  আরেক ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক শক্তির জন্ম  দেবে। কাশ্মীরের  এই বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের অন্যতম শীর্ষ নেতা সৈয়দ আলীশাখ গিলানী তাঁর ‘কাশ্মীর নভ-ই হুরিয়ত’ বইতে  লিখেছেন, তাঁরা কাশ্মীরী বলতে শুধু  কাশ্মীরী মুসলিমদেরই মনে করেন। তাই তিনি ‘হিন্দু’ ভারতের  পরিবর্তে ইসলামিক  পাকিস্তানের  সঙ্গে  কাশ্মীরকে যুক্ত  করার দাবি  করেন। এর কারণ হিসেবে তাঁর আরও যুক্তি, কাশ্মীরী মুসলমানরা ভাষা, বর্ণ, সংস্কৃতি, সভ্যতা, আচার-ব্যবহার ও চিন্তায় এক পৃথক জাতি। এদের ঐক্যের ভিত্তি ইসলাম।

প্রশ্নটা যে এখানেই। ধর্মীয় পরিচয় কি মানবাধিকার, আত্মনিয়ন্ত্রণ বা পৃথক এক জাতির পরিচয়
নিয়ে  এভাবে বিচ্ছিন্ন হবার অধিকারের দাবি করতে পারে? ভারতের প্রায় ৮০ শতাংশ হিন্দু সেই দাবিতে যদি ভারত নিজেদের হিন্দু  রাষ্ট্রের আত্মনিধনকারী সিদ্ধান্ত  নেয় তবে গোয়া, নাগাল্যান্ড কোথায়  যাবে? সেখানে তো অধিকাংশ খ্রিস্টান। শিখদের কিছু  অংশ যে পৃথক শিখ রাষ্ট্রের দাবি করছে তার কী হবে? মানবাধিকারের অর্থ তো খণ্ডিত মানবাধিকার  হতে পারে না। ধর্ম বিশ্বাস আর মানবাধিকার যদি এক হত তবে পৃথিবীতে এত যুদ্ধের ঘটনা ঘটত না। খ্রিস্টান হিটলার আক্রমণ করত না খ্রিস্টান ধর্মভাইদের। লড়াই হত না ইরান ইরাকের। পাকিস্তানের সেনার হাতে নিহত হত না পূর্ব পাকিস্তানের  লক্ষ লক্ষ মুসলমানেরা।

বিহার থেকে রুটি রোজগারের তাগিদে যেদিন মজুরেরা কাশ্মীরের ইটভাটায় কাজ করতে গিয়েছিল, তারা হিন্দু, এই বিচারে  যখন  তাদের  সারিবদ্ধ ভাবে  দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা  করা হয়েছিল, কাশ্মীরী পন্ডিতদের কাশ্মীর থেকে বিতাড়িত করে এই উপত্যকায় যখন সম্পূর্ণ ইসলামিকরণের আত্মক্ষয়ী  ভাবনার প্রকাশ  শুরু হয়েছিল, তখনই  তো দেশের সব শক্তির একযোগে এর প্রতিরোধে এগিয়ে আসার কথা ছিল। বিজেপি  প্রতিবাদ  করেছিল তার রাজনৈতিক  অঙ্ক  কষে। যত বেশি  হিন্দু  আক্রান্ত  হবে তত সে তার হিন্দু ঐক্যের সাম্প্রদায়িক তাসকে ব্যবহার করতে পারবে। আজ বিজেপি  সেই  রাজনৈতিক পাশা খেলায় জয়ী হওয়ায় তথাকথিত প্রগতিবাদীরা এখন সর্বনাশের রব তুলেছেন। তারা যদি  কুরু  রাজসভায় দ্রৌপদীর লাঞ্ছনার সময় কুরু মহারথীদের মতো এমন ভাবে মুখ লুকিয়ে  না রেখে কাশ্মীরের সন্ত্রাসের প্রশ্নে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের  বিরুদ্ধে প্রতিবাদের পাশাপাশি এই তালিবানী সন্ত্রাসের বিরুদ্ধেও তীব্র প্রতিবাদ  করতেন তবে কিন্তু  বিজেপির এই বিজয় নিয়ে এমন  অসহায়  আত্মবিলাপ করতে হত না। পাকিস্তানের হানাদারদের হাত থেক কাশ্মীরকে বাঁচাতে ব্রিগেডিয়ার  ওসমানের সেই অভূতপূর্ব  বীরত্ব  ও শহীদ  হওয়ার  ইতিহাস  আজকের  প্রজন্মের কাছে উপযুক্ত মর্যাদায় যদি তুলে ধরা হত তবে বুরহান ওয়নিরা এমন  ভাবে উপস্থিত হত না।

অমরনাথ  শিবলিঙ্গ  তো আবিষ্কার  করেছিলেন এক কাশ্মীরী মেষপালক মুসলিম। তার পরিবার তখন  থেকে  এই পবিত্র  শিবলিঙ্গের রক্ষণাবক্ষেণ করে আসছে। ২০০৮ সালে ৪০ একর জমি অমরনাথ শ্রাইন বোর্ডকে দেওয়া  হয়েছিল সেখানে তীর্থযাত্রীদের জন্য একটা  স্থায়ী  বিশ্রামাগার  নির্মাণের জন্য। এতে স্থানীয় কাশ্মীরীদেরই সুবিধা হত। অথচ গিলানীদের মতো বিচ্ছিন্নতাবাদী  সাম্প্রদায়িক  শক্তিগুলি এর বিরুদ্ধে হিংসাত্মক আন্দোলন সৃষ্টি  করলে জম্মুতে তার পাল্টা যে পথ অবরোধ  হয়েছিল তাতে কিন্তু  সেখানে হিন্দু  ও মুসলমান উভয়েই সামিল হয়েছিল। কারণ, অমরনাথ  তীর্থযাত্রার ওপর এই রাজ্যের অর্থনীতি অনেকটাই নির্ভরশীল।

৩৭০ ধারার ইতিহাস ও তার বিলোপ  নিয়ে  ইতিমধ্যেই  বহু  আলোচনা  হয়েছে এবং হবে। একচক্ষু  হরিণের মতো এই বিলোপ নিয়ে শুধুমাত্র বিজেপির সাম্প্রদায়িক  রাজনীতির দিকে আলোচনাকে নিক্ষেপ করলে কিন্তু  নিজেদের  দায়কে এড়ানো যাবে না। এতগুলি ধর্মনিরপক্ষে দল ও সংস্থা  থাকতেও  বিজেপি কেন  আজ এমন অপ্রতিহত  গতিতে  তাদের পেছনে  ফেলে  দেশের শাসনক্ষমতায়  আসতে পারল তার উত্তর দেওয়ার  দায়  থাকলেও  তা দিতে  না পারলে মানুষ  কিন্তু  বিজেপির কাছেই সেই  উত্তর খুঁজতে যাবে। খুঁজবে তাদের কাছেই আশ্রয়।

এক সময়ের সেই ‘লড়কে  লেঙ্গে  পাকিস্তান’ বা ‘ লড়কে  লেঙ্গে  কাশ্মীর’ আজ অচল। রাজনাথের  পরমাণু অস্ত্র  ব্যবহার নীতি পরিবর্তনের ঘোষণা, অপরদিকে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর হুমকি,  কোনওটাই বাস্তবায়িত হওয়ার সম্ভাবনা  নেই। উভয়েই  যদি  আত্মহত্যা করতে চায় সে অন্য কথা। ভাবতে হবে এর সমাধানের কথা। ভুট্টো এক সময়  ভারতের  বিরুদ্ধে  কাশ্মীর  নিয়ে  হাজার বছরের  যুদ্ধের কথা ঘোষণা করেছিলেন। তার দেশেরই সামরিক  শাসক তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে  দিল। জহরলাল নেহেরু সেদিন যুদ্ধবিরতি ঘোষণা না করলে কী হত সেই  প্রশ্নের এখন কোনও মূল্য নেই। কাশ্মীরের  একটা  অংশ পাকিস্তানের  দখলে  আছে  ৭০ বছরেরও বেশি সময়  ধরে। মেনে  নেওয়া  হয়েছে অঘোষিত ভাবে লাইন অফ কনট্রোলকে সীমানা বলে। কাশ্মীর উভয় রাষ্ট্রের নায়কদের কাছে  তাদের ভোট রাজনীতির হাতিয়ার। উগ্র জাতীয়তাবাদ তাদের  মূলধন। সেই সুযোগে পৃথিবীর  ভয়ঙ্করতম শক্তি  ইসলামিক সন্ত্রাসবাদ সাধারণ মানুষের মনে প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ পাচ্ছে। সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রভাব  থেকে  মুক্ত  হতে চেয়ে তালিবানদের আগমনের সুযোগ করে দিয়ে  আজ শুধু আফগানিস্তান নয় সারা দুনিয়ার মানুষকে তার মূল্য পরিশোধ করতে  হচ্ছে। LOCকে সামনে রেখে দুই দেশ আলোচনা শুরু  করতে পারে কিনা ভেবে দেখলে ক্ষতি তো কিছু নেই। ভারত তো এক দলীয়  শাসনে চীনের মতো তার মাটিতে প্রতিবাদীদের ট্যাংকের চাকার তলায় পিষে মারতে পারবে না। পাকিস্তানের মতো সামরিক শাসকের হাতে দেশের মানুষের ভাগ্যকে সঁপে দিতেও পারবে না। ভারত গণতান্ত্রিক দেশ। আলোচনার মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান করতে হবে। কাশ্মীর আমাদের। কাশ্মীরের মানুষেরা আমাদেরই আপন লোক। তাদের  কোনও ভাবেই সন্ত্রাসবাদীদের শিকার  হতে দিতে পারা যায় না।

৩৭০ ধারা বাতিল করা নিয়ে  আজ যারা প্রতিবাদ মুখর  হয়ে  উঠেছে  তারা একটা সত্যকে অস্বীকার করছে। ৩৭০ ধারার বিলোপ কিন্তু কংগ্রেসের শাসনকালেই ঘটেছে। পণ্ডিত জহরলাল নেহেরুর আমলেই শেখ আব্দুল্লার মন্ত্রীসভাকে বাতিল করে তাকে কারারুদ্ধ করে বক্সী গোলাম মহম্মদকে কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রীর পদে বসানো হয়েছিল। সে সময় (১৯৫৪) ভারতের রাষ্ট্রপতির জম্মু-কাশ্মীরের  জন্য একটি সাংবিধানিক নির্দেশিকায় বলা হয়েছিল, জম্মু-কাশ্মীরে যে কোনও  বিষয়ে  আইন প্রণয়নের  ক্ষমতা  ভারত সরকারকে দেওয়া  হল। সেদিন গোলাম মহম্মদের উদ্যোগে জম্মু-কাশ্মীরের  বিধানসভায় তা অনুমোদিত  হয়েছিল। এভাবেই  তো ৩৭০ ধারা অবসানের  সূত্রপাত  হয়েছিল। ১৯৫৬ সালের ১৭ নভেম্বর জম্মু-কাশ্মীরের যে সংবিধান গৃহীত হয়েছিল, সেখানেই বলা হয়েছিল  জম্মু-কাশ্মীর ভারতের একটি  অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ  হিসেবে  রয়েছে এবং থাকবে। তাহলে আজ ৩৭০  ধারা বাতিল করে জম্মু ও কাশ্মীরকে যে ভারতের অন্য সব রাজ্যের মতোই এক সমমর্যাদার রাজ্যে রূপান্তরিত  করা হয়েছে তার পূর্ণ  কৃতিত্ব  যেমন বিজেপি  নিতে পারে না তেমনি  কংগ্রেসও এর বিরোধিতায় এভাবে  রাস্তায় নামতে পারে না।

তবে কাশ্মীর উপত্যকার সাধারণ মানুষ যাতে উপলব্ধি  করে যে তারা ধর্মীয় পরিচয় ছাড়াও পৃথিবীর  বৃহত্তম  গণতন্ত্রের এক গর্বিত নাগরিক, তা বুঝতে দেওয়ার  দায়িত্ব  কিন্তু  আমাদের  সবার। এখানেই প্রয়োজন খোলা মনে আলোচনা। পাকিস্তানের শাসকেরা এই আলোচনা  চায় না। কারণ, পাকিস্তানের  জন্মই হয়েছে  দ্বিজাতি তত্ত্বের ওপর দাঁড়িয়ে। তাদের  যুক্তি  ছিল, হিন্দু  ও মুসলমান  পৃথক  জাতি, তারা তাই একসঙ্গে  থাকতে পারে না। মুসলিমদের জন্য  চাই পৃথক ইসলামি পাকিস্তান। ভারতের  নেতৃত্ব তো দ্বিজাতি তত্ত্ব  মানতে  চায়নি। কমিউনিস্ট পার্টি অবশ্য স্তালিনের জাতি তত্ত্বকে সমর্থন  জানাতে ১৯৪২  সালের সেপ্টেম্বর  মাসের মাদুরাই প্লেনামে মুসলমানদের পৃথক জাতি  ঘোষণা করে তাদের পৃথক হবার অধিকারকে সমর্থন করে প্রস্তাব  নিয়েছিল। কংগ্রেসের মধ্যে কিছু  উগ্র হিন্দুত্ববাদী নেতারাও অবশ্যই মুসলিম লীগকে পৃথক হবার প্ররোচিত করার দায়ে অভিযুক্ত  হবে।

দ্বিজাতি তত্ত্ব মিথ্যা, এটা  প্রমাণিত হলে পাকিস্তানের জন্মই ভুল, তা স্বীকার করে নিতে হবে। পাকিস্তানের সামরিক শাসন নিয়ন্ত্রিত সরকারের টিকে থাকতে হলে তাকে ভারত বিরোধিতাকে বজায়  রাখতে হবে। এতে  কিন্তু  ভারতের লাভ। কারণ, পাকিস্তান যে একটি  ব্যর্থ রাষ্ট্র  তা প্রমাণিত। ইতিমধ্যেই সে হারিয়েছে পূর্ব পাকিস্তানকে। বালুচিরা বিদ্রোহের পতাকা তুলেছে। আমাদের দরকার  তাই এক সহনশীলতা। পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ আমাদের মিত্র  ও ভাই। পাকিস্তানের  শাসক বিরোধিতা তাই কোনওভাবেই যেন পাকিস্তানী বিরোধীতায় রূপান্তরিত না হয়।

Friday, 11 October 2019

জলাতঙ্ক

নিজেরা সচেতন হই
সঞ্জয় মজুমদার
শিউরে ওঠারই কথা। আমাদের পৃথিবীর দুই-তৃতীয়াংশ শুধু জল। তার মাত্র ২ শতাংশ ব্যবহারযোগ্য, যার আবার ১.৩ শতাংশ হিমবাহ আর পোলার আইস-ক্যাপে মোড়া। অথচ বছরের পর বছর আমাদের দেশ এই দুর্লভ ব্যবহারযোগ্য জলসম্পদের পরিকল্পনাবিহীন যথেচ্ছ ব্যবহার করে আসছে। বিশ্বব্যাপী জল-সূচকের সমীক্ষায় ১২২টি দেশের মধ্যে আমাদের দেশের স্থান ১২০। নীতি আয়োগের কম্পোজিট ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট ইন্ডেক্স ২০১৮'র তথ্য বলছে, ২০২০ থেকে ২০৫০ সালের মধ্যে ভারতের প্রায় সমস্ত মাঝারি ও বড় শহরের ভূগর্ভস্থ জলস্তর শূন্যে গিয়ে দাঁড়াবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা হিসেব করে দেখিয়েছে, প্রতিদিন একজন ব্যক্তির ২৫ লিটার জল দৈনন্দিন কাজে প্রয়োজন হয়, শুধু বেঁচে থাকার প্রয়োজনে অর্থাৎ রান্নাবান্না এবং পানীয় হিসেবে। আমাদের দেশের বর্তমানে সামগ্রিক জনসংখ্যাকে ২৫ দিয়ে যদি গুন করি তাহলে যে পরিমাণ ব্যবহারযোগ্য জলের মাথাপিছু প্রতিদিন প্রয়োজন, তার জোগান সরকার সুনিশ্চিত করতে পারছে কি? অথবা, পারবে তো?

পরিকাঠামো এবং নির্মাণ ক্ষেত্রে ব্যবহৃত জলের পরিমাণের কোনও হিসেব নেই। এরপর খেলাধুলো, বিনোদন, পর্যটন এবং আরও কত অজস্র ক্ষেত্র পড়ে রয়েছে যেখানে একজন নাগরিকের খেয়ে বেঁচে থাকার বাইরেও জলের প্রয়োজন। না হলে বাণিজ্যে বসতি লক্ষ্মী হবে না। কোন দিকে যাবে সরকার ঠিক করুক। বিনে পয়সায় খাবার জল দেবে নাকি ব্যবসার প্রয়োজনে জল খরচা করবে। রাষ্ট্রপতি ভবনের মুঘল গার্ডেনস বাঁচিয়ে রাখার জন্য কত লিটার জল লাগে? আমাদের জলশক্তি মন্ত্রক হিসেব করে দেখেছে? আইপিএল প্রসঙ্গ টেনে আনা অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত। যদিও সেটা প্রতীকী, কিন্তু ভাবতে হবে, এক টুকরো সবুজ মাঠ প্রয়োজন। কিন্তু স্পন্সর ও কর্পোরেট দুনিয়ার চাপে এত ঘনঘন মুনাফা অর্জনকারী টুর্নামেন্টের প্রয়োজন কতদূর? সাধারণ মানের একটা রেস্তোরাঁয় খেতে গেলেও ওয়েটার জিজ্ঞেস করেন, মিনারেল ওয়াটার নাকি রেগুলার ওয়াটার? একে তো প্লাস্টিকের বোতল, তার মধ্যে মিনারেল ওয়াটার! সুস্থ মস্তিষ্কে যার ব্যাখ্যা মেলে না। 'মিনারেল' এই অক্ষর সমষ্টি দিয়ে দেশের জনগণকে বোঝানো হয়েছে যে একমাত্র এই জল পান করলেই সুস্থ থাকা নিশ্চিত। ঠিক যেমন প্রজন্মের পর প্রজন্ম বোঝানো হয়েছে, গঙ্গাতে একমাত্র বিশুদ্ধ জল পাওয়া যায়; যার ধর্মীয় সংস্করণ 'পবিত্র' এবং তা শিব ঠাকুরের মাথায় ঢাললে দেবাদিদেব সব পাপ ধুয়ে দেবেন। সরকারি প্ররোচনায় শুধু পাপ ধুতেই দেশের জনগণ কতটা জল খরচ করে? মুখ দিয়ে টুঁ শব্দটা করা যাবে না, খুন হয়ে যেতে পারি। সত্যজিৎ রায়ের 'গণশত্রু' ছবির প্রতিটি সংলাপ যেন জীবন্ত।

যে জল না খেতে পেলে আমি মরে যাব, সেই পানীয় জল নিয়েও সূক্ষ্ম শ্রেণিবিভাগ। এই সাজানো প্রহসনের মানে কী? ভারতের নদ-নদী বিশ্বব্যাপী জলসম্পদের মাত্র ৫-৬ শতাংশ বয়ে নিয়ে যায়। আমাদের জানা আছে, নদী শুধু জল বহন করে না, পলিও বহন করে। তার পরিমাণ নেহাৎ কম নয়, প্রায় ৩৫-৪০ শতাংশ। ভারতের কৃষি ব্যবস্থা এখনও বৃষ্টির জল নির্ভর। অনুন্নত এবং অপ্রতুল সেচ ব্যবস্থা সমস্যা আরও বাড়িয়েছে। রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং, ওয়াটার শেড ম্যানেজমেন্ট, ইন্টিগ্রেটেড ওয়াটার রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট এসব সরকারি পরিকল্পনাতেই আটকে আছে; দিনের আলোর যেটুকু মুখ দেখেছে তার বেশির ভাগটাই দালালদের পকেটে গেছে। পবিত্র গঙ্গাকে নিয়ে অপবিত্র অ্যাকশন প্ল্যান বছরের পর বছর আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। পূর্বসুরীদের কথা ছেড়েই দিলাম, বারাণসীর মাননীয় সাংসদ আজ আমাদের সম্মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। নিন্দেমন্দ করছি না, কিন্তু প্রশ্ন তো করতেই পারি। এর সঙ্গে আছে অচেতন নাগরিকদের দায়িত্বজ্ঞানহীন নদীর জলের ব্যবহার এবং শিল্প-বর্জ্য। গোদের উপর বিষফোঁড়া।

ভারতের ৭০ শতাংশের উপর ব্যবহারযোগ্য জল দূষিত হয়ে গেছে এমনি এমনি নয়। একটার পর একটা স্থানীয় জলাভূমি, পুকুর বুজিয়ে বাড়ি উঠেছে। ভোট ব্যাংকের রাজনীতি করতে গিয়ে প্রোমোটার-রাজকে যথেচ্ছভাবে প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে। আমাদের নিজেদের বোধবুদ্ধিও তারিফযোগ্য। নির্দিষ্ট পাত্রে প্রয়োজন মতো জল ধরে যেটুকু দরকার সেটুকুই পরিবারের সদস্যরা ব্যবহার করব, এটুকুও কি আমরা করি? সরকারকে গালমন্দ করার আগে, কর্পোরেট দুনিয়াকে ঢিল মারার আগে নিজের দিকটা ভেবে দেখতে হবে। দিনের শেষে ঘুমের দেশে যাওয়ার আগে সুরাপায়ীরা(নিম্নবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত) কত গ্যালন জল খরচ করে? পণ্ডিতেরা বলছেন, দূরদর্শীরাও বলছেন, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ নাকি জলের জন্যই হবে। এখনই কি যুদ্ধ কিছু কম হচ্ছে? আচ্ছা, একটা পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ পরিচালনা করতে কত জল লাগে?  হিজিবিজবিজ হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে। হাসি থামছেই না।


Wednesday, 2 October 2019

গান্ধী

স্বরাজ আমার জন্ম অধিকার
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য
এই মানুষটি বিচিত্র পরিসরে অবিচল হেঁটেছেন। এমন কোনও বিষয় নেই যার ওপর তিনি তাঁর মতামত জ্ঞাপন করেননি। তাঁকে কেউ ভয়ঙ্কর আপসকামী, ধনীদের অনুগ্রহপ্রার্থী ইত্যাদি ভূষণ আরোপ করেছেন, কেউ বা তাঁকে যুগপুরুষ, মহাত্মা, দুর্বলতম মানুষের পথপ্রদর্শক আখ্যা দিয়েছেন। তিনি সর্বদাই বিতর্কিত, বহু আলোচিত ও দ্বন্দ্ব-কীর্ণ। আজও পৃথিবীর অন্যতম জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে তিনি সমাদৃত।

এ সবই আমরা জানি। তাঁকে নিয়ে খুব বেশি কিছু নতুন করে বলারও নেই। তিনি একেক অস্তিত্বে একেকজনের কাছে এখনও সবাক। তিনি বহুরূপে, বহু অর্থে, নানান ব্যাপ্তিতে মূর্ত। তাঁকে আপন বোধের মাধুরীতে বোঝা যায়, ধরা যায় না। এ হেন বহুগামী, বিস্তৃত চরাচরে ব্যাপ্ত ব্যক্তিত্বের সুতোটি কোথায় বাঁধা তবে? সেও এক রূপকল্পনা।

তাঁর মূল অভিঘাতটি বোধহয় 'স্বরাজ'। আপন রাজ। সে রাজের অধিষ্ঠান কোথায়? নিজের অন্তর্লোকে, গভীর চৈতন্যে। এ তাবৎকালের সমস্ত রাজনৈতিক প্রজ্ঞাকে অস্বীকার করে 'স্বরাজ' ছিল তাঁর নিজস্ব অভিজ্ঞান। শাসক যেই হোক, স্বরাজের বীক্ষা বলে, আমার অধিকারে, পরিসরে হস্তক্ষেপ এলে আমি প্রতিরোধ করব - প্যাসিভ রেজিসটেন্স। যার মূর্ত প্রকাশ: অসহযোগিতা। আর সেই আন্দোলনেই অগ্নিপরীক্ষা। কারণ, অসহযোগিতা তখনই সফল হতে পারে যদি তাতে সামিল হয় জনসাধারণের বিপুল অংশ। মানুষের এই বিশাল সমাগমই গণতন্ত্রের মূর্ত প্রতীক। তাঁর স্বরাজ চিন্তা এই বয়ানের ওপরেই দাঁড়িয়ে।

লবণ আইন অমান্যে সবরমতী আশ্রম থেকে ৩৮৮ কিলোমিটারের পথ ডান্ডির উদ্দেশ্যে যেদিন তিনি হেঁটে রওনা দিলেন, তাঁর সঙ্গে ছিলেন মাত্র ৭৮ জন সত্যাগ্রহী। ভারতের বড়লাট এ খবর শুনে খুব স্বস্তিতে ছিলেন যে গান্ধীর এই 'পাগলামো'তে তিনি অন্তত কিছুদিন শান্তিতে ঘুমতে পারবেন। ২৮ দিন পায়ে হেঁটে তিনি যখন ডান্ডি পৌঁছলেন তখন অন্তত ৩০ লক্ষ মানুষ তাঁর পেছনে সমবেত হয়েছেন। এই সমাগমই রাজনৈতিক বার্তা। স্বরাজ তখন ব্যক্তি স্তর থেকে সামাজিক স্তরে ব্যাপ্ত। বলাই বাহুল্য, বড়লাটের নিশ্চিদ্র নিদ্রার দিবাস্বপ্ন অধরাই থেকে গেল।

তিনিও জানতেন, তিনি যখন থাকবেন না তখন কী থাকবে। তা আজ বিশ্ব প্রত্যক্ষ করছে। একদিকে লোভ, লালসা, তঞ্চকতার দাসত্ব, অন্যদিকে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া খেটে-খাওয়া মানুষের দঙ্গল - এই দুই পৃথিবীর মধ্যেই পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে স্বরাজ। ইতিহাসকে উলটো করে পেশ করেছিলেন তিনি - যদি তুমি সব থেকে পিছিয়ে পড়া মানুষটি নিজেকে সর্বাগ্রে স্বরাজের আসনে বসাতে পার তাহলে শাসক আর পেরে উঠবে না তোমার সঙ্গে। এইভাবেই অসহায়, পীড়িত মানুষের ভাবনায় ও কর্মে স্বরাজ এলেই বৃহত্তর রাজনৈতিক,  সামাজিক, অর্থনৈতিক প্রাঙ্গণেও স্বরাজ তখন বাধ্যত আসবে।

এই অসম সাহসী চিন্তককে সার্ধশতবর্ষের বিনীত প্রণাম। তিনি দৃশ্যত ইউটোপিয় কিন্তু চিন্তায় সদর্থক।তিনি আপাত ক্ষণিকে দুর্বল কিন্তু  চিরঅবধ্য। তিনি কার্যত বিস্মৃত কিন্তু নিয়ত চলমান ভূখণ্ডের প্রতি পল-অনুপলে।