রোগীদের দু-চার কথা
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য
জীব বিজ্ঞানী ব্রুস লিপটন
তাঁর সুবিখ্যাত গ্রন্থ ‘বায়োলজি অফ বিলিফ’এ বলেছেন, ডাক্তারি সিলেবাসে যদি শুধু ‘প্লেসেবো
এফেক্ট’ই ৫০ শতাংশ পড়ানো হয় তাহলে স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি হতে পারে। ‘প্লেসেবো
এফেক্ট’ হল রোগীর ওপর স্বান্ত্বনা বা ভরসার এক নিরাময়কারী প্রভাব। অর্থাৎ,
ডাক্তারবাবু যদি বলেন, আপনি এখন ফার্স্ট ক্লাস আছেন বা সামান্য একটা ভিটামিন বড়ি
দিয়ে বললেন, এই ওষুধটি রোজ একটা করে সাতদিন খেলেই আপনি ১০০ শতাংশ ফিট হয়ে যাবেন,
তাহলে রোগী বিশ্বাসের বলেই অনেকটা ভাল হয়ে যেতে পারেন। যে কারণে, অনেক সময়
হোমিওপ্যাথী চিকিৎসায় রোগী ভাল হয়ে গেছেন জেনে অ্যালোপ্যাথির ডাক্তারবাবুরা বলেন,
আসলে রোগী ভাল হয়েছেন হোমিওপ্যাথিতে নয়, ‘প্লেসেবো এফেক্ট’এ। অর্থাৎ, ভরসা বা
বিশ্বাস এখানে এক অমূল্য পাথেয়।
আমরা সামান্য গেঁয়ো
অশিক্ষিত জীব। এ জগৎ-সংসারের কীই বা জানি! ডাক্তারি তো নয়ই! ডাক্তার আমাদের
মা-বাপ। আমরা কেজো রোগী, রোগী স্বার্থ আন্দোলনের কর্মী বন্ধুবর উত্তান সেদিন বলল,
ডাক্তারের কাছে যাওয়াটা স্বাস্থ্যের লক্ষণ নয়, না-যাওয়াটাই স্বাস্থ্যের লক্ষণ। তো
তথ্য ঘেঁটে দেখি: According to a recent study by Johns Hopkins, more than
250,000 people in the United States die every year because of medical mistakes,
making it the third leading cause of death after heart disease and cancer.
(Feb 22, 2018)। বুঝুন কাণ্ড, মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর আড়াই লক্ষ মানুষ মারা যাচ্ছেন চিকিৎসায় গাফিলতির কারণে,
যা কিনা হার্টের রোগ ও ক্যানসারে মৃত্যুর পর তৃতীয় বৃহত্তম মৃত্যুর কারণ। এই ‘ব্যাধি’র
নাম দেওয়া হয়েছে: iatrogenic disease। তাহলে রোগব্যাধি
হলে কী করব?
আমার মনে হয়, জুনিয়র ডাক্তারেরা যে অসীম
সাহসের সঙ্গে গত সাতদিন এক প্রায়-অসম লড়াই লড়ে কিছু বিষয় সরকারের থেকে আদায় করেছেন
তার মধ্যে রোগীর স্বার্থের কথা বেশ কিছুটা জায়গা জুড়ে আছে। সেটা বেশ ভরসার। এতে
আমার ও অনেকের শরীর ও মন বেশ চনমনে হয়ে গেছে (প্লেসেবো এফেক্ট), আরও এই কারণে যে,
অন্তত ভাবতে পারছি, এবার সরকারি হাসপাতালে নিজের বা আত্মীয়স্বজন অথবা
বন্ধুবান্ধবদের চিকিৎসার প্রয়োজনে কোনও রেফারেন্স ও আশঙ্কা ছাড়াই যে কোনও ডাক্তারের পরামর্শ
নিতে যেতে পারব। ১৯৮৩ সালের ঐতিহাসিক জুনিয়র ডাক্তার আন্দোলনে
রোগীদের কথা ভেবেই ধর্মঘটের পাশাপাশি সমান্তরাল ওপিডি ও ইমার্জেন্সি চালু ছিল, যে
কারণে বহু পুলিশি দমনপীড়ণ সত্ত্বেও সে আন্দোলন ব্যাপক মানুষের সমর্থন আদায় করতে
পেরেছিল। তাই এবারের আন্দোলনেও রোগীরা ভরসা রেখেছিলেন অন্তত ইমার্জেন্সি বিভাগ
চালু থাকবে। ছিল কি ছিল কিনা, কতটা ছিল, সর্বত্র ছিল কিনা, সে তর্কে এখন গিয়ে আর
লাভ নেই, কিন্তু এই প্রয়োজনটার কথা আমার কিছু ঘনিষ্ট মহলে জানাবার চেষ্টা
করেছিলাম। কেউ বুঝেছিলেন কেউ বোঝেননি। কেউ ডাক্তারি শিক্ষার বড়াই করেছিলেন (যেন
বিজ্ঞানী, ইঞ্জিনিয়ার, শিল্পী, লেখক, গায়ক বা একজন দক্ষ কৃষকও কম মেধাবী), কেউ আবার,
আমরা রোগীরা যে মিনমিন করে হলেও দু-চারটে কথা তোলার অধিকারী, সে কথাটাকেও মানতে
চাননি। তবে, অধিকাংশরাই ভরসা দিয়েছেন। সেই ভরসার জায়গাটাই প্রধান। প্লেসেবো
এফেক্ট। চেঙ্গাইলে, বেলুড়ে, শ্রীরামপুরে, সরবেরিয়ায় চেনা-অচেনা ডাক্তারেরা যে
অবিশ্রান্ত পরিশ্রম করে চিকিৎসাশাস্ত্রের অন্যতর অনুশীলনে এক অনির্বচনীয় সদর্থক
পরিচয় রাখছেন, তাতেই আমরা অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠছি। এবারের আন্দোলনের সময়ে যে জুনিয়র
ডাক্তারেরা নিজেদের রক্ত দিয়ে ইমার্জেন্সির রোগীদের অপারেশন করেছেন, প্রাণ
বাঁচিয়েছেন, সেইসব অত্যাশ্চর্য তরুণদের কথা জেনে আমরা আরও বেশি সুস্থ হয়ে উঠছি।
প্লেসেবো এফেক্ট। নবান্ন’এর বৈঠকে যখন তরুণ ডাক্তাররা বলছেন, রোগীদের অভিযোগ
জানানোর কুঠুরিটা সিঁড়ির তলায় অগোচরে থাকে, তাকে দৃশ্যমান করতে হবে; বা, ‘সেবাসাথী’
প্রকল্পে রোগীদের বিভিন্ন ক্লিনিকাল পরীক্ষাগুলি খরচসাপেক্ষ, সেগুলোকে এই প্রকল্পের
মধ্যে আনা উচিত; অথবা, রোগীদের আত্মীয়দের তাৎক্ষনিক শলা-পরামর্শ দেওয়ার জন্য (যেমন, রোগীকে নিয়ে কোন বিভাগে যাবেন বা রোগীর এখন কী
অবস্থা ইত্যাদি) ভেলোরের খ্রিশ্চিয়ান মেডিকেল হাসপাতালের মতো এক-জানালা ব্যবস্থা চালু করা
উচিত, তখন নীলরতন সরকার হাসপাতালে বসে অপেক্ষারত যে সমস্ত রোগী ও তাঁদের আত্মীয়রা
জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গেই নিবিড় ভাবে টিভিতে চোখ রেখে অধীরভাবে শুনছিলেন, তাঁরাও
অনেকটাই সুস্থ হয়ে উঠেছেন। প্লেসেবো এফেক্ট।
যে কোনও পেশাতেই ভুল বা মতান্তর হতে পারে। তার জন্য
কারও গায়ে হাত তোলা যায় না। যে কারণে সাংবাদিক, ইঞ্জিনিয়ার বা বিডিওকে পেটানো যায় না। আইনানুগ পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে মাত্র। আর নির্দ্বিধায় স্বীকার্য, ডাক্তারি পেশা সব থেকে দুরূহ, কারণ তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে মানুষের জীবন-মৃত্যু। নীলরতনের যে
দুজন জুনিয়র ডাক্তার আক্রান্ত হলেন তাকে নিন্দা জানাবার কোনও ভাষা নেই। তাঁরা
দ্রুত সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসুন। আক্রমণকারীদের যোগ্য ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক। ভবিষ্যতে এমন ঘটনার যেন পুনরাবৃত্তি না
হয়। হলেও, তাকে উপযুক্ত ভাবে মোকাবিলা করতে হবে। কড়া হতে হবে। সেই সঙ্গে রোগীরাও
যথার্থ চিকিৎসা পাওয়ার অধিকারী। তাঁরাও যেন না ভেবে বসেন, সরকারি হাসপাতালে
চিকিৎসা হয় না। কর্পোরেট হাসপাতালগুলি এই ভাবনা যোগাতে সদা ব্যস্ত - আমাদের এখানে এসো, তবে ঠিকঠাক চিকিৎসা পাবে। তারপর দায়ে পড়ে সেখানে
গিয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন সাধারণ রোগী ও তাঁদের পরিজনেরা। এই দুষ্ট চক্রকে ভাঙ্গতে
হবে। আর তা পারেন চিকিৎসাশাস্ত্রে উদ্বুদ্ধ ডাক্তারেরা ও তাঁদের রোগীরা। রোগীরাই
ডাক্তারদের সব থেকে বড় সুরক্ষা আর ডাক্তারেরা রোগীদের জীবনদায়ী অনুপ্রেরণা। আর সরকার? তার ভূমিকা তো মুখ্য! ডাক্তার ও রোগীদের সুরক্ষা দেওয়া, সমস্ত ওষুধের সরবরাহ হাসপাতালে ঠিকঠাক রাখা, দালাল চক্রদের নির্মূল করা, চিকিৎসার যন্ত্রপাতিগুলোকে সতেজ রাখা ও সর্বোপরি, সুচিকিৎসাকে ১০০ শতাংশ নিশ্চিত করা - তা তো সরকারেরই মূল দায়িত্ব। ছোট
মুখে বড় কথা বলা এই অধম, জুনিয়র ডাক্তারদের অসম্ভব মনের জোরকে পাথেয় করেই,
রোগীদের হয়ে তাই সকলের কাছে মার্জনা চেয়ে এই সামান্য কিছু কথা নিবেদন করতে সাহস করতে পারল।
দীর্ঘ দীর্ঘ দিন সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকুন সকলে।