অক্ষরেরা যখন উঠে আসে
সিধু-কানু নামগুলো শুনলেই এক লহমায় মনে পড়ে যায় শাল মহুলের বনচেরা লাল পথে তীর-ধনুক নিয়ে ছুটতে থাকা একদল স্বাধীনতাকামী বিদ্রোহী মানুষের কথা যাঁদের বিদ্রোহ আজও ফুরায়নি। শীতের ঠিক এই সময়ে ধামসা মাদল আর মহুয়ার গন্ধে ভরা শালপিয়ালের বনে সাঁওতাল পুরুষ রমণীর নাচগানের ছবি ভেসে ওঠে মস্তিষ্কের কোণে; ভেসে ওঠে পুলিশের ম্যাপে লালরঙে দাগানো চার অক্ষরে লেখা একটি জেলার নাম: পুরুলিয়া। শীতে পুরুলিয়া যাওয়ার প্রসঙ্গ উঠতেই প্রশ্ন ছুটে আসে চারপাশ থেকে -- বেড়াতে যাওয়া বুঝি ... তাহলে অযোধ্যা পাহাড়টা মিস্ করো না ... গড়পঞ্চকোট, ওটা কিন্তু যেতেই হবে। ব্যাগ গোছানো চলতে থাকে; সঙ্গে চলে সোয়েটার মাফলারের সাথে পত্রিকার কোন কোন সংখ্যার কটা কপি নেওয়া যায় বারবার তার সংখ্যা গোনা। পত্রিকা? হ্যাঁ; পত্রিকাই তো। শীতকাল পড়ে গেছে মানেই মেলার মরশুম। সুপর্ণার গোপন কবিপ্রেমিক তিন মাস ঘুমিয়ে থাকতে চাইলেও ছোট পত্রিকার মানুষগুলোর তো সে জো নেই; তাদের যে দেখা করার কথা তাদের পাঠকের সাথে। ছোট পত্রিকার খ্যাপাটে মানুষগুলো তাই শীতের নিজস্ব উষ্ণতায় ভিজতে ভিজতে পাঠকের সাথে দেখা হওয়ার অবিরাম উত্তেজনায় ঘামতে ঘামতে উঠে পড়ে ট্রেনে-বাসে; সংরক্ষিত টিকিট থাকুক বা না থাকুক। তাঁদের গন্তব্য পুরুলিয়া। পুরুলিয়ার লিটল ম্যাগাজিন মেলা।
পুরুলিয়া লিটল ম্যাগাজিন মেলার এবার ১৬-এ পা। সাহেব বাঁধের সামনেই ১৯২১-এ প্রতিষ্ঠিত বৃহৎ হরিপদ সাহিত্য মন্দির চত্বরে প্রতিবারের মতোই শুরু হয়ে যায় পুরুলিয়া লিটল ম্যাগাজিন মেলা ২০১৭'র ২২, ২৩ ও ২৪ ডিসেম্বরের দিনগুলো জুড়ে। মেলা প্রাঙ্গণের প্রবেশপথের বেগুনি রং রক্তাক্ত সময়ে জমাট বাঁধা বেদনার প্রতিনিধি হয়ে ওঠে। প্রবেশ পথটি ছোট, ঠিক বেনারসের সরুগলির মতো। কিন্তু গলি ঘুরলেই যে ছবি চোখে পড়ে তা সব বেদনাকে ভুলিয়ে দেয়। রাশি রাশি পলাশ শিমুল যেন ছড়িয়ে আছে এই অসময়েও টেবিলে টেবিলে। তাদের বুকের রক্তাক্ত ভাবনাগুলো অসময়ে নিভে যাওয়া স্বপ্নগুলো কিংবা আগামী দিনের নতুন কথারা অক্ষর শব্দ বর্ণমালার সাথে উৎসুক মুখে অপেক্ষারত পাঠকের জন্য। হঠাৎই চোখ চলে যায় স্টলের প্যান্ডেলের মাথায়। রাশিরাশি ঘুড়ি আটকানো। তারা যেন ছেড়ে যেতে উড়ে যেতে চাইছে ওই আকাশের দিকে যেখানে তাদের জায়গা, কিন্তু পারছে না। ঘুরে দেখি মাঝখানে রয়েছে আটকে থাকার কারণ। লাটাইয়ের সুতোর কারণ না হয় বুঝলাম। কিন্তু মাদল চাকা কেন এখানে? প্রশ্ন জাগে মনে। মনের প্রশ্ন মুখে কথা জাগায় দুম করে -- যেভাবে কলমে দুম করে ফেটে পড়ে অনাহুত অবাঞ্ছিত শব্দ ভাবনারা, ঠিক সেইভাবে।
মেলা প্রাঙ্গণ
'একক মাত্রা'র নিবিড় পাঠক আশীষ মাহাতো
মেলার খন্ডদৃশ্য
কিন্তু তবুও জয়ী হয় মানুষের কর্মযোগ, শুরু হয় মেলা। ছোট্ট এক চত্বরে প্রায় সব জেলা থেকে আসা ৭৫/৭৬টি ছোট পত্রিকা জায়গা করে নেয়। রোজ দুপুর ২টো থেকে রাত ৮টা অবধি তাদের নিজেদের মেলে ধরার সময়। 'আঙ্গিক' 'মথ' 'ভাষালিপি' 'দূরত্ব' 'বোধশব্দ' 'গুহালিপি' 'কারুবাসনা' 'কবিতাশ্রম' 'কঙ্ক' 'যুক্তিতর্ক' 'ধ্যানবিন্দু' 'নিবিড়' 'আখরপত্র' 'মনতাজ' 'একক মাত্রা' সমেত আগত ছোট ছোট পত্রিকাগুলির পাশাপাশি পুরুলিয়ার নিজস্ব 'অনৃজা'র মতো পত্রিকা পাঠকের হাতে উঠে কখনও ফুলের সুগন্ধ ছড়িয়ে কখনও সঙ্গীতের মতো তীব্র মূর্ছনায় জেগে ওঠে। আবার কখনও বা বিপ্লবীর হাতের মেশিনগানের মতো উজ্জ্বল ধারালো হয়ে ওঠে। লেখক পাঠক আর সম্পাদক এই তিন নিয়েই বই-কাগজ। পাঠক-লেখকের কোন আলাদা জাতপরিচয় হয় না, লেখাপড়ার জগৎ রাজ্যে সবাই সমান, এক বৃহৎ চেতনার অংশমাত্র। একই চেতনাকে আমরা ছুঁয়ে দেখি নিজের মতো করে। তবু জাগতিক প্রয়োজনে কিছু নাম তো মনে আসেই। পুরুলিয়ার শহর ও তার কাছে দূরের গ্রামে ছড়িয়ে থাকা আমাদের পাঠজগতের সহপাঠীরা যখন ছুটে আসে একটু ছুঁয়ে একটু চোখে দেখতে মেলাকে, তখন মনে হয় পুরুলিয়ার বন্য প্রান্তর থেকে তারা যেন হেঁটে আসে না, যেন উড়ে আসে পাখির মতো আমাদের স্বপ্নগুলোর সাথী হতে। 'একক মাত্রা'র স্টলে ভীড় জমায় তন্ময় মাহাতো আশিস মাহাতোর মতো স্থানীয় পুরনো বন্ধুরা অথবা গৌরচন্দ্র চন্দের মতো অভিভাবকরা। তাঁদের পিছু পিছু হাত ধরাধরি করে আসে ঝুলনপ্রিয়া বৈশাখী অভিনন্দন অনির্বাণ অনিরুদ্ধ অজয়রা। বনটিয়া তিতির ফিঙে শ্যামা শালিকের কলকাকলিতে সরগরম হয়ে ওঠে পুরো জায়গাটা। স্কুলের গন্ডি না পেরোনো ছোট্ট শ্রাবস্তী যখন প্রবন্ধের কাগজখানা হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখে খুশি হয় হাসি মুখে নিয়ে যেতে যায় লেখকের একটু চেতনার অংশকে খুশি হয়ে ওঠে মন। পুরুলিয়ার শীতের হাল্কা বিকেলের রোদ্দুরও তখন হেসে ওঠে 'একক মাত্রা'র স্টলে। দেখা হওয়ার কথা ছিল না হয়তো যে মানুষগুলোর সাথে, এককের টানে টানে দেখা হয়ে যায় তাঁদের সাথেও। নিবিড় পাঠক হাতে পত্রিকা নিয়ে নিবিষ্ট মনে পড়ে যান স্টলে স্টলে, হাত দিয়ে নেড়েচেড়ে সদ্য দেখা সন্তানকে আদর করার মতো করে। ভিড় বাড়ে, বাড়তেই থাকে। স্টলের সামনেই দেখা হয়ে যায় নানান শিল্পমাধ্যমের অনেক মানুষের সাথেও। ক্রমাগত পাঠকের মুখ বদলে যেতে থাকে। পদস্থ বনকর্মী গবেষক অধ্যাপক ব্যবসায়ী গৃহবধূ ছাত্রছাত্রী হস্তশিল্পী, কে নেই সেই ভিড়ে। এই ভিড় পাঠকের ভিড়।
'একক মাত্রা'র স্টলে নিবিষ্ট পাঠিকা
ভরপুর মেলা চত্বর
হরিপদ সাহিত্য মন্দিরে
জেলা সংগ্ৰহশালার প্রবেশদ্বার
'একক মাত্রা'র স্টলের সামনে পাঠকের ভিড়
আর বিশেষ কোথাও যাওয়ার ফুরসৎ হয় না মেলার অবসরে। তাই সকালে বেরিয়ে পড়া কেনাকাটার অকারণ বিলাসিতায়। দেখা হয়ে যায় চড়িদার মুখোশ ঘরের ভ্রাতৃত্রয়ের সাথে। কেনাকাটা দরদামের সাথে পুরুলিয়ার সকালে পৌঁছে যাই খানিক ফেলে আসা সময়ের ইতিহাসের কাছে। শীতের সকালে পৌষের পুরুলিয়ার বিশেষ জিলিপি 'ঘেওর'এর স্বাদ নিতে নিতে ভ্রাতৃবর্গের অন্যতম রাজীব দত্তের থেকে জানা যায় বেশ অতিরিক্ত কিছু তথ্য। যা নিছক তথ্য নয় একদম সত্য। বাঘমুন্ডি গ্রামের চড়িদা গ্রামে ছৌ মুখোশ তৈরি করা হয়। আনুমানিক দুশো বছর আগে এখানকার ভূস্বামীদের আনুকূল্যে পুরুলিয়ায় প্রথম ছৌ নৃত্যের সূচনা হয়। ছৌ শব্দটির অর্থ 'মুখোশ', যদিও আঞ্চলিক অর্থে 'রঙ্গকৌতুক' মাত্র। নানা আচার বিচার বিশ্বাস ও সংস্কারে ঘেরা প্রতি বছর এই নাচের সূচনা ঘটে চৈত্র সংক্রান্তির শিবের গাজন উৎসব উপলক্ষে। মূলত শিব ভক্তরাই ছৌ নাচের আসর বন্দনা করে থাকেন। যদিও পৌরাণিক পালার সাথে সাথে সামাজিক ও ঐতিহাসিক ঘটনা ও পালায় স্থান পাচ্ছে আজকাল। জানা যায় মুখোশ তৈরির পদ্ধতিও। এঁটেল মাটির মণ্ড, আঠায় ভেজানো কাগজের মণ্ড আর রং তুলি তার পুঁতির অপূর্ব সম্মেলনে শিল্পীর শিল্পপ্রতিভা কল্পনা ও আঙ্গুলের অপূর্ব মুন্সিয়ানায় কেমন করে মুখোশ তৈরি হয়ে ওঠে।
মুখোশ শিল্পী রাজীব দত্তর কর্মশালা
মুখোশ তৈরিতে ব্যস্ত শিল্পী
মুখোশ শিল্পীদের কাজ - সাক্ষাৎকার ১
শিল্পীদের কাজ - সাক্ষাৎকার - ২
একক মাত্রা'র স্টলের সামনে পাঠকের ভিড়
এই প্রতিবেদন পড়ে এবার হিসেবী হিসেব কষুক; খ্যাপা খুঁজুক পরশপাথর। মোদ্দা কথা এই যে লেখক-পাঠকের রোজই পত্রপত্রিকার পাতায় পাতায় লেখার অক্ষরে অক্ষরে দেখা হলেও মাঝে মাঝে পাতার অক্ষর থেকে উঠে এসে তাঁদের পারস্পরিক দেখা হওয়াটা জরুরি হয়ে পড়ে। আর তাই মেলার প্রয়োজনে খ্যাপাটে মানুষগুলোর প্রাণের উষ্ণতায় শীতও যেন গলে যেতে থাকে; কুর্নিশ করে জায়গা ছেড়ে দেয় প্রাণের উষ্ণতাকে ছড়িয়ে যেতে দিয়ে। তাই শীত জমাট বাঁধে না, মেলা জমজমাট হয়ে ওঠে।
মেলার মুক্ত মঞ্চে গানের আসর