এই মৃত্যু মিছিলের দায় আপনার প্রধানমন্ত্রীজী
অপূর্ব সাহা
১০ নভেম্বর সকাল সাতটার সূর্য বিশাল মাপের দুটি সরকারি
বিজ্ঞাপনের ছাপান্ন ইঞ্চি ছাতির পাশ দিয়ে যখন কোনোরকমে জায়গা করে প্রকাশিত হওয়ার
চেষ্টা করছে তখন দেওয়ালে দেওয়ালে সাঁটানো ‘শতবর্ষে নভেম্বর বিপ্লব’ পোস্টারের লেনিনের পথ নির্দেশক তর্জনীটি
জানিয়ে দিচ্ছে – ধর্মতলা নয়, ব্রিগেড নয়, দিল্লীও নয়- ব্যাঙ্ক চলো।
ব্যাঙ্কের সামনে লাইনে দাঁড়াতে
হয়েছিল ধর্মেন্দ্র ভার্মাকেও। সাথে ছিল তার চার বছরের মেয়ে। মেয়ের প্রচন্ড জ্বর। তাই
ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলে তাকে মেয়ের চিকিৎসা করাতে হবে। দীর্ঘ সর্পিল লাইনে একটু
পিছিয়েই পরেছিল সে। লাইন এগোচ্ছিল খুব ধীর গতিতে। মেয়ের অসুস্থতাও বাড়ছিল। অবশেষে
দীর্ঘ সময় পর যখন সে কাউন্টারে পৌঁছয় তখন দেখে মেয়ে মারা গেছে।
পঁয়ষট্টি বছর বয়সী রমানাথ কুশওয়ারও
লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন টাকা তুলতে। তার গর্ভবতী মেয়ে ভর্তি আছে হাসপাতালে। টাকা তুলে
নিয়েই তাকে ছুটতে হবে হাসপাতালে। খুব ভিড় জমে থাকা ব্যাঙ্কের সামনে দৌড়োদৌড়ি,
হুড়োহুড়িতে মাটিতে পড়ে যান তিনি। হঠাৎ করে তৈরি হওয়া উদ্বিগ্ন পরিস্থিতিতে ঘাবড়ে
যাওয়া মানুষগুলোর জমায়েতের চাপে জখম হন তিনি। হাসপাতালে নিয়ে গেলে মৃত ঘোষণা করা
হয় তাকে।
তিনদিন ধরে লাইনে দাঁড়িয়েও টাকা
বদলাতে না পারা সিয়ারাম, অনিল ঘোষ, রবীন মুখার্জি, বিশ্বদেব নস্কর কিংবা মেয়ের
বিয়ের জন্য টাকা তুলতে লাইনে দাঁড়ানো বাবুলাল সবারই একই পরিণতি হয়েছে।
দ্বিতীয় বর্ষের মেধাবী ছাত্র
সুরেশ। কয়েকদিন ধরেই তাকে ব্যাঙ্কের লাইনে দাঁড়াতে হচ্ছিল কলেজের বার্ষিক পরীক্ষার
ফি’এর টাকা তুলতে। অবশেষে ফি জমা
দেওয়ার শেষদিন এসে যায়। প্রয়োজনীয় টাকা তুলতে না পেরে খুব হতাশ হয়ে যায় সে। যেদিন
পরীক্ষার ফি জমা দেওয়ার শেষ দিন ছিল সেদিন
রাতেই সুরেশ মায়ের শাড়ি গলায় দিয়ে সিলিং ফ্যানে ঝুলিয়ে দেয়
নিজের দেহকে।
ভাগচাষি শিবু মান্ডি, ব্যাবসায়ী
সুখেন দে সরকার, ঠিকাশ্রমিক ত্রিভুবন সুমেসেরা, দিনমজুর গোরা মাঝি, আলুচাষি অমিত
সরকার এরা কেউই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অভিযোজিত করতে পারেনি নিজেরদেরকে। এরা
প্রত্যেকেই এখন মৃত।
মৃত্যুর সংখ্যা ৮৪ পেরিয়ে গেছে।
সবই ৮ নভেম্বর রাত ৮টার ‘মাস্টার স্ট্রোক’এর পরিণতি।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বিগত কয়েক মাস ধরে কাশ্মীরে জনতা এবং সামরিক বাহিনীর যে খন্ডযুদ্ধ চলছিল সেখানে সামরিক বাহিনীর
মেশিনগানের গুলিতে নিহত সাধারণ মানুষের সংখ্যা এর
থেকে কম। তাহলে একটা রাষ্ট্রনীতি মেশিনগানের থেকেও ভয়ঙ্কর এবং ক্ষতিকারক হয়ে
উঠেছে। এইরকম একটা নীতি তার আবির্ভাব মুহুর্তেই এতগুলো প্রাণ কেড়ে নিল। দেশ জুড়ে
কয়েক কোটি গরিব এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ জীবন সংগ্রামে টিকে থাকার জন্য
লড়াই করছে এই নীতির সাথে।
যে কারখানার শ্রমিক মজুরি না পেয়ে
কারখানার গেটের সামনে বসে থাকছে, যে নির্মাণ শ্রমিক ভিনরাজ্য থেকে খালি হতে ফিরছে,
যে কৃষক ধান বিক্রি করতে না পেরে ভাবছে কিভাবে বীজ আর সার কিনবে, যে দিনমজুর গোটা
দিনই কাটিয়ে দিচ্ছে ব্যাঙ্কের সামনে লাইন দিয়ে, যে বিক্রেতা তার দোকানের জিনিসপত্র
নিয়ে ক্রেতার অপেক্ষা করছে, যে চা বাগানের কর্মীরা মজুরি না পেয়ে রাস্তায় বসে
থাকছে তাদের কাছে ‘ডিমনেটাইজেশন’ কী ‘আচ্ছে দিন’ এনে দিল? এদের ‘মন কি বাত’ শোনা হবে কখনও? ক্ষুদ্র এবং অসংগঠিত ক্ষেত্রে অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়ছে। অর্থনীতি বিশারদদের মতে এর ফলে আগামী অর্থনীতি
মন্দার কবলে পড়তে পারে।
রাষ্ট্রযন্ত্রের যান্ত্রিক
গোলযোগের শিকার এই মানুষগুলো। আর রাষ্ট্র ধৃতরাষ্ট্র হয়ে ব্যস্ত আলমারির শাড়ির ভাঁজে রাখা টাকা
বা ঘরে ছোট্ট একটা খুঁটিতে জমানো টাকাকেও করায়ত্ত করতে। ‘ডিমনেটাইজেশন’এর চাপে মুম্বাই’এর গোভান্ডিতে সদ্যোজাত যে শিশুটি চিকিৎসা না পেয়ে
মারা গেল বা আম্বুলেন্সকে একশো টাকার নোট দিতে না পারায় হাসপাতালে যাওয়ার আগেই
জয়পুরে যে শিশুটি মারা গেল তার জন্য দায়ী কে? ঘুম থেকে উঠে রোজ দু’ চামচ করে দেশপ্রেমের সিরাপ খাওয়া আরোপিত
জাতীয়তাবাদের নেশায় মাতাল পেটিএম পাব্লিক কি এগুলোর
ব্যাখ্যায় ‘শর্ট টাইম পেইন, লং টাইম গেইন’ তত্ত্ব আওড়াবেন নাকি বলবেন ‘কোল্যাটারাল
ড্যামেজ’? মনে প্রশ্ন জাগছে, এটা কালো টাকার ওপর ‘সার্জিক্যাল
স্ট্রাইক’ নাকি মানুষের জীবনের ওপর?
নির্মিত সাদা কালো আবহাওয়ায়
দেশপ্রেমের হিস্টিরিয়া ওড়ানো ছাপান্ন ইঞ্চি
ছাতির মানুষটিকে যদি কখনও কোনও লাইনে দাঁড়াতে হয় তাহলে তার সামনে পরে থাকবে এই
৮৪টা মৃতদেহ। কর্পোরেটের কার্পেটে হাঁটতে অভ্যস্ত মানুষটিকে এই জেনোসাইড’এর দায় নিতেই হবে।
No comments:
Post a Comment