Thursday, 10 November 2016

মোদিফায়েড ভারত!


কোনদিকে চলেছে অর্থনীতি?
অরুণাভ চট্টোপাধ্যায়

আবার একটা ৯/১১ এবার শুধু সামান্য ওলটপালট করে লেখা। আবার আমেরিকার লোকজনকে খানিকটা অবাক করেই একটা ঘটনা ঘটে যাওয়া। যে মুহূর্তে সবাই NDTVর উপরে নিষেধাজ্ঞা নিয়ে সরব, হঠাৎ করে কালো টাকা উদ্ধারের নামে নরেন্দ্র মোদীর তাঁর নিজেরই দেশের ১২২ কোটির জনসংখ্যার উপরে আবার একটা সার্জিকাল স্ট্রাইক। প্রতিটি দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি নির্ভর করে সেই দেশের কাজকর্ম থেকে শুরু করে নতুন বিনিয়োগ, নতুন কোম্পানি, পুরনো কোম্পানিগুলো কীরকম চলছে, কতটা পরিমাণ নতুন চাকরি তৈরি হচ্ছে ইত্যাদি অনেকগুলি ফ্যাক্টরের উপর। আর এইগুলোর প্রতিফলন হিসাবে উঠে আসে শেয়ার সূচকের কথা।

যারা ভারতীয় শেয়ার সূচক বা অর্থনীতি এবং ব্যবসা বাণিজ্যের খোঁজখবর রাখতে পছন্দ করেন, তাঁরা নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন, ভারত যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সার্জিকাল স্ট্রাইক নামক লড়াইয়ের কথা জানিয়েছিল, তখন একটা চরম ডামাডোলের অবস্থা তৈরি হলেও বাজার তাঁকে সাধুবাদ জানিয়েছিল বহু সাধারণ মানুষও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এই মনোভাবকে স্বাগত জানিয়েছিল। অবশ্য, এই আক্রমণ নিয়ে প্রশ্নও উঠেছিল।কিন্তু এরপরের কয়েকটি ঘটনা যেন যুদ্ধের এবং যুদ্ধ প্রস্তুতির আর একটা দিক খুলে দিয়ে যাচ্ছেঃ
·        
১)দীওয়ালিতে অস্বাভাবিক ভাবে দিল্লী ও পাঞ্জাবে বাজি পোড়ানো। বায়ুদূষণ এবং নাসা’র উপগ্রহ চিত্রে ধরা পড়ে যাওয়া পরোক্ষে বায়ুদূষণ করে পাকিস্তানের আবহাওয়া নষ্ট করার পরিকল্পনা।
·         ২) NDTVর উপর একদিনের নিষেধাজ্ঞা
·         ৩)রিলায়েন্স গোষ্ঠীর জিও নিয়ে বিবাদেও প্রধানমন্ত্রীর চুপ থাকা।
·         ৪)রাজনাথ সিংহের মানুষ এবং গরু একই জিনভুক্ত বলে হঠাৎ করে গোমাতা সেবকদের বাজার গরম করে তোলা।

এইরকম বেশ কিছু ইস্যুর পর হঠাৎ করে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দিনই ৫০০ টাকা এবং ১০০০ টাকার উপর ভারতীয় বাজারে নিষেধাজ্ঞা জারি। কালোবাজারি এবং কালো টাকা উদ্ধার করতে এই পদক্ষেপ নিয়ে সাধারণ মানুষের হয়রানির শেষ নেই। অনেকেই এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানালেও কিছু প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

যারা ভারতীয় শেয়ার বাজারের দিকে একটু নজর রাখেন তারা খেয়াল করেছেন নিশ্চয়ই, বিশ্ব বাজারের বড় বিনিয়োগকারীদের ভাবনা ছিল হিলারি ক্লিন্টন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হলে বিশ্ব বাজার মোটের উপর ঠিক থাকবে, আর ট্রাম্প এলে বাজার নিম্নগামী হবে। গত ১ নভেম্বর থেকে বাজারের সামগ্রিক হিসাব দেখলে বোঝা যাবে, নভেম্বর থেকে ৮ নভেম্বর পর্যন্ত বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ভারতীয় বাজার থেকে ১৪৪৩.৫৬ কোটি টাকা তুলে নিয়েছে। যে কোনও দেশের আর্থিক নীতি কী হতে চলেছে তা প্রধানমন্ত্রী একা ঠিক করেন না, এই কমিটিতে সেই দেশের বড় বড় শিল্পপতিরাও থাকেন। ফোর্বস এর রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতে মোট ৮৪০০০ কোটিপতির বাস। ১২২ কোটির মধ্যে ৮৪০০০এর কাছে পৌঁছনো সহজ বলেই মনে হয়, অঙ্কের হিসাব তাই বলে। একজন সাধারণ মধ্যবিত্ত মানুষের কাছে কালো টাকা যতটা থাকাটা অস্বাভাবিক, ঠিক ততটাই স্বাভাবিক বড় শিল্পপতিদের কাছে থাকা। এখানে বুঝতে হবে, যে অফিস কর্মী ২০০০-৫০০০ টাকা ঘুষ নিচ্ছেন, তাঁকে নিশ্চয়ই হাওয়ালা মারফ সুইস ব্যাঙ্কে টাকা রাখতে হচ্ছে না। এই কালো টাকা বা ঘুষ নেওয়া কিন্তু ৫০০ টাকার নোট বদল করে, ২০০০ টাকার নোট এনে আটকে দেওয়া সম্ভব নয়।

যদি ধরেই নেওয়া যায়, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাজার থেকে টাকা তুলে নিয়ে বাজারকে নামিয়ে এনে আরও টাকা ঢোকাতে চাইছেন – তবে গতকালের রিপোর্ট তা আরও ভুল প্রমা করবে। গতকাল ন্যানাল স্টক এক্সচেঞ্জ’এর রিপোর্ট অনুযায়ী, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ভারতীয় বাজারে বিনিয়োগ করেছেন ৫১০৭.৬৩ কোটি টাকা, আর বিক্রি করেছেন ৭২০২.৬৩ কোটি। মানে গতকাল একদিনেই ২০৯৫ কোটি টাকা বাজার থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে। 



ট্রাম্পের জয়ের প্রভাব এবং গতকালের ৫০০/১০০০ টাকার উপর সার্জিকাল স্ট্রাইক, ভারতীয় বাজারে নতুন কোনও আচ্ছে দিন আনতে পার না। হ্যাঁ, আচ্ছে দিন একদিনে আসে না বলবেন। উত্তরে বলব, এই যে বাজার থেকে টাকাটা হাওয়া হয়ে গেল, এগুলোতে কিন্তু বাণিজ্যিক সংস্থার টাকা খুব কম নষ্ট হয়েছে। আদতে নষ্ট হল আমার, আপনার মতো ছোট ছোট খচরো বিনিয়োগকারীদের টাকা। যারা কম পুঁজি নিয়ে খুব ঝুঁকি নিতে ভয় পান এবং এই জাতীয় প্যানিকে নিজেদের ক্ষতি কম করার জন্য হলেও বিক্রি করে বেরিয়ে আসেন। টাকাগুলো চলে যায় সেই কোম্পানিগুলোর পকেটেই যারা কালো টাকার উৎস। এই ঘটনায় পরোক্ষে আমরা তো তাঁদের ব্যবসায়িক পুঁজি বাড়িয়ে দিলাম এবং বিদেশি বাজারে নিজেদের ইনডেক্স ভ্যালু কমিয়ে দিলাম যাতে বিদেশি বাজার এখানে আরও বেশি বিনিয়োগ করতে পারে। বলা হচ্ছে, টাকা ব্যবহার না করে কার্ড ব্যবহার করে অনলাইন শপিং বেশি করুন। প্রশ্ন, যারা অনলাইন শপিং করতে পারেন না তারা কী করবেন!! ই-কমার্স’এ ক’টা কোম্পানি ভারতীয়? অ্যামাজন ভারতীয় নয়, ফ্লিপকার্টবিদেশি বিনিয়োগ রয়েছে অনেক ভারতীয় শিল্প বানিজ্যের বিকাশের দায়িত্ব কি শুধু পতঞ্জলীর?


যেখানে একজন নেপালি বাবার এ দেশে থাকতে কোনও সমস্যা হয় না এবং আমাদের বর্তমান সরকার এলে তাঁর বিরুদ্ধে চার্জশিট তৈরি হয় না, ভারতের প্রথম ১০ জন শীর্ষ ব্যবসায়ীর মধ্যে তিনি চলে আসেন।  যেখানে অন্যান্য কোম্পানির বৃদ্ধির হারের সাথে এই কোম্পানির বৃদ্ধির হারের আকাশ পাতাল তফা, যেখানে কথায় কথায় FMCG থেকে জিন্সের প্যান্ট বানাতে শুরু করে দেওয়া যায়।  এত টাকা আসে কোথা থেকে? উগ্র জাতীয়তাবাদের ধুয়ো তুলে রাজনীতি করে, এক শ্রেণির মানুষকে যুদ্ধের নামে লড়িয়ে দিয়ে, ৮ শতাংশ GDP গ্রোথের স্বপ্ন, আচ্ছে দিন, অনেক কর্মসংস্থান, মেক ইন ইন্ডিয়া আসলে পুঁজিবাদীদের হাতে আরও আমাদের সাধারণ মানুষের জীবন তুলে দেওয়া নয় তো!   

No comments:

Post a Comment