The most popular blog of our bi-monthly magazine (একক মাত্রা) in Bangla on contemporary socio-economic and cultural issues.. মগজে দিন শান/ নয়তো মিলিয়ে যান... Also visit our online version: https://www.ekakmatra.in
Wednesday, 29 June 2016
Monday, 20 June 2016
যৌনপেশার অধিকার
চুরি নয় ডাকাতি নয়
প্রার্থিতা সেনগুপ্ত*
প্রার্থিতা সেনগুপ্ত*
ফিনফিনে কাপড়ের আঁচলটা আলতোভাবে গায়ে ফেলা। ন্যুড মেক-আপ। ঠোঁটটা হাইলাইটেড ডার্ক
ব্রাউন আউটলাইনে। যাতে ঈষৎ পুরু দেখায়। সামান্য ঠোঁটের ইশারায় কুপোকাৎ দীর্ঘল
পুরুষটি। ঘণ্টার বিচারে টাকা ওড়াতে পুরুষটি যেন কার্পণ্য না করে। তার বিনিময়ে
মেয়েটি তাকে দেবে সর্বস্ব। সন্ধ্যে নামতেই শুরু হয়ে যায় কাস্টমার ধরার পালা।
মেয়েটির কাছে দীর্ঘল পুরুষটি খরিদ্দার ছাড়া আর কিছু নয়। ঘণ্টা পিছু একের পর এক
খরিদ্দার। সেক্স, মস্তি। মস্তি শেষ হয় আকণ্ঠ সুধা পানে। দেহ ও সুরা উভয়েই বুঁদ
খরিদ্দার।
প্রতিদিনই মেয়েটি নিংড়োয় নিজেকে। তার বিনিময়ে মেলে প্রাপ্য টাকা। সঙ্গে
উপহারস্বরূপ আরও কিছু। যৌনরোগ। একের বেশি বহুজনের সঙ্গে যৌন সংসর্গ করার জন্য
মেয়েটির যৌনাঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে যৌনরোগ। যেটি দিনের পর দিন অবহেলায় এইচআইভি হওয়ার
সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আর এখানেই কড়া হাতে মেয়েদের প্রতিদিন শাসন করে চলেছে এক-একটি ক্লিনিক। চোখ
রাঙানি দিয়ে নয়। পরম মমতা ও ভালবাসা দিয়ে। পলাতক, অবিনাশ, রবীন্দ্রসরণি, শেঠবাগান,
জোড়াবাগান, রামবাগান। বিরাট সোনাগাছিকে শাসন করছে এরা। দুর্বার মহিলা সমন্বয়
কমিটির তত্বাবধানে।
রাতের ফিনফিনে শাড়ির মোহিনীরা সকালে সম্পূর্ণ ভাবে অন্যরকম। এক্কেবারে গৃহিণী।
রান্নাবান্না সেরে স্নান করে তৈরি আটপেড়ে শাড়িতে, নয়তো সালওয়ার কামিজে। সেইসব
ক্লিনিকের পিয়ার এডুকেটরদের সঙ্গে এদের অনেকেই আসে ক্লিনিকে। শিখে নেয় যৌনরোগের
হাত থেকে বাঁচতে কনডোমের সঠিক ব্যবহার। সিফিলিস ও এইচআইভি রক্তে ঢুকল কিনা তার জন্য
রক্ত পরীক্ষাও করে। কারণ, সব থেকে ঝুঁকিপূর্ণ পেশা যে তারা বেছে নিয়েছে। দেশে
তাদের সংসার আছে; যে সংসার বাবা, মা আর বোন কিংবা ছোট ভাইকে ঘিরে। আর
নিত্যসঙ্গী অভাব। আছে নিজের সন্তান। তার কিছু হয়ে গেলে সন্তান যে অনাথ হয়ে যাবে।
এই ভাবনাতেই তারা ক্লিনিকের সমস্ত কথা মেনে চলে। পিয়ার এডুকেটরস, আউটরিচ ওয়ার্কারস, কাউন্সেলর ও ডাক্তার এই নিয়েই গড়ে ওঠা সেই ক্লিনিক।
পেটের তাগিদে যৌন পেশায় নামা। সামাজিক কষ্ট, মানসিক কষ্ট কোন পর্যায়ে গেলে
তারা বেছে নেয় এই পেশা! সর্বোপরি, তারা তো মা। রাতের মোহিনী রূপ শুধুমাত্র দিতে
চেয়েছিল অর্ধাঙ্গকে। কিন্তু বিধি বাম। সেই নির্ভর করা মানুষটি তার অর্ধাঙ্গিনীর
দেহ ছাড়া আর কিচ্ছু চেনেনি। মেয়েমানুষের আবার মন আছে নাকি! যত বেশি অত্যাচার তত
বেশি সেক্স। সহ্য করতে না পেরে দেহকে সম্বল করেই তাদের বেশিরভাগের সোনাগাছি পাড়ি।
মনকে তারা পুরুষ নামক বস্তুটির থেকে বিসর্জন দেওয়ারই সিদ্ধান্ত নেয়। একতরফা মনের
ভালবাসায় তারা আর মরতে চায় না। কিন্তু তাও মাঝে মাঝে ‘বাবু’ নামক ‘না প্রেমিক না
স্বামী’ বস্তুটির প্রতি তারা মরে। আবার অত্যাচার, মেয়েটির সমস্ত অর্জিত উপার্জন
কেড়ে নেবার মতো ঘটনা ‘বাবু’ নামক বস্তুটি ঘটায়। মেয়েটি মন পেতে চেয়েছিল আর পুরুষটি
দেহ। যে দেহ যখন খুশি সেই ভোগ করবে। কিন্তু মেয়েটি তো অনেক কষ্ট, অনেক লাঞ্ছনা
সহ্য করে সোনাগাছি এসেছে পেশা করতে। ‘বাবু’র হাত থেকে বাঁচতে তারা শরণাপন্ন হয়
দুর্বারের কাছে। আসে ক্লিনিকে। দুর্বার মেয়েটির কথামতো যতটা পারে সাহায্য করে।
মেয়েটি চাইলে থানা, পুলিশ পর্যন্তও যায় দুর্বার। সন্তানকে তারা মানুষ করতে চায়
নিজের রোজগারে। তথাকথিত সোনাগাছির এক একটি মোহিনী অন্তরে যেন এক একজন সিঙ্গল
মাদার।
দেহব্যবসা নয়। আর পাঁচটা পেশার মতো এটিকে যৌনপেশা বলতে চায় তারা। চুরি করছে
না, ডাকাতি করছে না, কাউকে খুনও করছে না বরং আনন্দ দান করছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
তাহলে এই বিনোদন পেশাটির জন্য কেন তারা শ্রমিকের মর্যাদা পাবে না! এইসব আইনের
ঘেরাটোপকেও অতিক্রম করতে চায় তারা। পৃথিবীর অন্যতম বড় সোনাগাছি যৌনপল্লী দুর্বারের
জন্যই আজ নিজের স্বাধিকারের পথে।
*কাউন্সেলর, দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটি।
Saturday, 18 June 2016
সেজ - না
বকলমে সেজ'এর নিদান?
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য
কলকাতা পুরসভার মেয়রের কণ্ঠে বেশ উচ্চ নিনাদে শোনা যাচ্ছে পূর্ব কলকাতার অবশিষ্ট জলাভুমি বুজিয়ে ‘উন্নয়ন’এর সদম্ভ ঘোষণা। আবার এই ইনফোসিস ও উইপ্রো’কে সেজ গড়তে দেওয়ার কানাঘুষোও ইতিউতি ঘুরে বেড়াচ্ছে। কোনটা সত্যি কোনটা মিথ্যে রাজ্য সরকার খোলসা করে বলুক। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম-লালগড়ের আন্দোলন ‘উন্নয়ন’এর এই জনবিরোধী মিথ্যাচারকে সপাটে প্রত্যাখান করেছিল। দ্বিতীয় দফায় সরকারে এসে তৃনমূল যদি তার ইস্তাহার থেকে পদস্খলিত হয় তবে ইতিহাস কি ক্ষমা করবে?
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য
খবরে প্রকাশ, ইনফোসিস ও
উইপ্রো’র দীর্ঘদিনের সেজ’এর (স্পেশ্যাল ইকনমিক জোন) দাবি এবার নাকি রাজ্য সরকার
মানতে চলেছে। যদিও এ ব্যাপারে সরকারি তরফে তেমন স্পষ্ট করে কিছু বলা হয়নি। মন্ত্রী
হওয়ার পর তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রী ব্রাত্য বসু তথ্য প্রযুক্তির কর্ণধারদের সঙ্গে এক
দফা বৈঠক করে সাংবাদিকদের ভাসা ভাসা কিছু বলেছিলেন যাতে এমন একটা সম্ভাবনার কথা
মনে হতে পারে। তবে সরকারি তরফে সোজাসুজি তেমন ঘোষণা না এলে খামকা মন্তব্য করা যেমন
ঠিক নয়, আবার এও তো বাস্তব যে ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ডরায়। কারণ, খবরে এও
প্রকাশ, সরকারি স্তরে এমন একটা আলোচনা চলছে যে, যেহেতু তথ্য প্রযুক্তি শিল্পে জমির
পরিমাণ কম তাই এই ধরনের তথ্য প্রযুক্তি শিল্পের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্ত
হিসেবে সেজ’এর অনুমতি দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু আমরা জানি, জমি ছোট কি বড় তা সেজ’এর
ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক নয়।
এখানে প্রাথমিক ভাবে দুটো
সম্ভাবনা রয়েছে। এক, কর্পোরেট মিডিয়া তথ্য প্রযুক্তি শিল্পের হয়ে একটা খবর এমন
ভাবে নির্মাণ করছে যাতে সরকারকে প্রভাবিত করা যেতে পারে; অন্তত শর্ত সাপেক্ষে
ন্যূনতম ক্ষেত্রে বকলমে অন্য নামে বা রূপে হলেও সেজ আদায় হতে পারে। অথবা, দুই,
সরকারও হয়তো সেজ সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি বদলাচ্ছে এবং ধাপে ধাপে কর্পোরেট
স্বার্থকে অগ্রাধিকারে আনতে চাইছে। আপাতত আমরা আশঙ্কা ও কিছুটা বিভ্রান্তির মধ্যে
থাকব।
সেজ হল দেশের এমন একটি
বিশেষ অঞ্চল যেখানে ব্যবসা-বাণিজ্য ও শ্রমের যে জাতীয় আইনগুলি আছে, তা কার্যকর হয়
না। কর্পোরেট’রা অতি মুনাফার লোভে এমন একটি বিশেষ সুবিধা সরকারের থেকে নেওয়ার
চেষ্টা করে। আমরা জানি, সেজ স্থাপনার
ক্ষেত্রে বিশ্বে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল চীন। ১৯৮০’র দশকের গোড়ায় চীনে শেনজেন,
জুহাই ও শানতাও- এই তিন শহরে প্রথম সেজ গড়ে ওঠে। চীনে বিপুল পরিমাণে প্রত্যক্ষ
বিনিয়োগ ঢুকতে থাকে এবং সেই উৎসাহে আরও বহু শহর ও প্রদেশকে সেজ হিসেবে ঘোষণা করা
হয়। ২০০৮ সাল অবধি দেখা যায়, অর্থনীতির ম্যাক্রো স্তরে (গড় বা জাতীয় হিসেবে)
অর্থনীতির সূচকগুলো বাড়তে থেকেছে। বিদেশি বিনিয়োগ এলে জাতীয় আয় বাড়ে, চীনেও তাই হয়েছে। আর সেই
সুবাদে একটি একনায়কতন্ত্রী দেশ হওয়াতে এবং শ্রমিকদের স্বাধীন ট্রেড ইউনিয়ন’এর
অধিকার অস্বীকৃত থাকাতে সেজ অঞ্চলে শ্রমিকদের অবাধে ও অল্প মজুরিতে খাটিয়ে নেয়
বিদেশি বিনিয়োগকারী ও দেশিয় উদ্যোগপতিরা। বিশ্ব জুড়ে প্রতিপাদ্য হয় সস্তার চীনা
পণ্য, যার গুণমান নিয়ে অবশ্য কারও কোনও ভরসা ছিল না। একদিকে বিশাল পরিমাণে
কর্পোরেট বিনিয়োগ, অন্যদিকে, তথাকথিত কম্যুনিস্ট শাসিত হওয়ায় একদলীয় ব্যবস্থায়
গণতন্ত্রহীন পরিসরে শ্রমিকদের বাধ্যত নিম্ন মজুরি ও বেশিক্ষণ শ্রম করিয়ে নেওয়ার
সুযোগ এবং তার সঙ্গে অন্যান্য শ্রম অধিকারকে লঙ্ঘন করে বেশি মুনাফা অর্জনের
প্রতিটি দেয় সুযোগকে কাজে লাগায় বিনিয়োগকারীরা। চীনা অর্থনীতিতে এক আপাত বৃদ্ধি অর্জিত
হয় কিন্তু তার ভেতরটা ছিল একেবারেই ফোঁপরা। তাই, চীনে সস্তা মজুরিতে পণ্য তৈরি করে
সারা বিশ্বে বেচে কর্পোরেটরা যে মুনাফা কামিয়েছে তার দিন আজ ফুরিয়েছে। কারণ, শ্রম
আইন ও শ্রম অধিকার নিয়ে চীনের শ্রমিকেরা দীর্ঘদিন ধরে নানা বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও যে
লড়াই চালিয়েছেন (আইনি ও বেআইনি) তার ফলে গত কয়েক বছরে শ্রমিকদের গড় মজুরি আগের
থেকে অনেকটা বেড়েছে এবং কর্পোরেটদের মুনাফাও আগের থেকে কমেছে। কর্পোরেটরা এখন নতুন
নতুন সস্তা মজুরির দেশে ও সেখানে সেজ গড়ে তাদের পুঁজি নিয়ে পালাচ্ছে, ফলে, গত এক
বছরে চীনে নেমে এসেছে এক ঘোরতর অর্থনৈতিক বিপর্যয়। বহু কারখানা বন্ধ হয়ে পড়েছে এবং
শ্রমিক ছাঁটাই এখন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। সংক্ষেপে এই হল বিশ্বে সর্ববৃহৎ সেজ অঞ্চল
গড়া চীনের ইতিহাস। ভারতও চীনকে অনুসরণ করে এমন একটা পথ নিয়েছে কিন্তু তা যে তীব্র
শ্রমিক শোষণ ও সস্তায় জমি হাতানোর কর্পোরেট ধান্দা ছাড়া আর কিছু দাঁড়ায়নি, তা
ইতিমধ্যে বেশ স্পষ্ট। এইসব দেখেশুনেও যদি রাজ্য সরকার সত্যি সত্যি, সীমিত পরিসরে
হলেও, নতুন সেজ গড়ার অনুমতি দেয় তা নিজের পায়ে কুড়ুল মারার সামিল হবে বৈকি।
কলকাতা পুরসভার মেয়রের কণ্ঠে বেশ উচ্চ নিনাদে শোনা যাচ্ছে পূর্ব কলকাতার অবশিষ্ট জলাভুমি বুজিয়ে ‘উন্নয়ন’এর সদম্ভ ঘোষণা। আবার এই ইনফোসিস ও উইপ্রো’কে সেজ গড়তে দেওয়ার কানাঘুষোও ইতিউতি ঘুরে বেড়াচ্ছে। কোনটা সত্যি কোনটা মিথ্যে রাজ্য সরকার খোলসা করে বলুক। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম-লালগড়ের আন্দোলন ‘উন্নয়ন’এর এই জনবিরোধী মিথ্যাচারকে সপাটে প্রত্যাখান করেছিল। দ্বিতীয় দফায় সরকারে এসে তৃনমূল যদি তার ইস্তাহার থেকে পদস্খলিত হয় তবে ইতিহাস কি ক্ষমা করবে?
Thursday, 16 June 2016
কথোপকথনে ছাত্রী-ছাত্র আন্দোলন
নতুনের জন্ম?
মৈনাক মাইতি
সম্প্রতি (৯ই জুন) কলকাতার ভারত সভা হলে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল 'কথোপকথনে ছাত্রী-ছাত্র আন্দোলন: নতুনের জন্ম?' শিরোনামে একটি সেমিনারমূলক উদ্যোগ । সেমিনারটির উদ্যোক্তা ছিলেন প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রাক্তনী দেবর্ষি চক্রবর্তী, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগে গবেষণারত বন্দনা মণ্ডল এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের স্নাতকোত্তরে পাঠরত শ্রমণ গুহ। বন্দনা দেবর্ষী শ্রমণ ছাত্র-যুব-সামাজিক পরিসরে বিভিন্ন বৈষম্যের বিরুদ্ধে ন্যায় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যে সব আন্দোলন সংগঠিত হচ্ছে সেগুলির সক্রিয় মুখ। পূর্বনির্ধারিত সূচি অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গ এবং রাজ্যের বাইরে দেশের নানান প্রান্তের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বিভিন্ন ছাত্রী-ছাত্র আন্দোলন থেকে উঠে আসা ১৭ জন সংগঠকের বক্তব্য রাখার কথা ছিল। কিন্তু ক্যাম্পাসজনিত অনিবার্য কারণে দিল্লির জওহরলাল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের সদস্য শেইলা রশিদ এবং রামা নাগা এসে উঠতে পারেননি। ফলে, মোট ১৫ জন সংগঠক বক্তব্য রাখেন। অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন বর্ধমান, কলকাতা, প্রেসিডেন্সি, যাদবপুর, বারাসাত, সেন্ট জেভিয়ার্স, আইআইইএসটি, জেএনইউ, এইচসিইউ সহ অন্যান্য কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রী, গবেষক ও শিক্ষকেরা। এছাড়াও নাগরিক সমাজ তথা নাগরিক আন্দোলনের নানান পরিচিত মুখ উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠান শুরু হয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক স্তরের ছাত্র শুভম কাঞ্জিলালের ম্যান্ডোলিন বাজানোর মধ্যে দিয়ে। এরপর সংগ্রামী, ব্রিটিশ-বিরোধী দলিত যোদ্ধা বীরসা মুণ্ডার প্রয়াণ দিবস এবং তরুণ দলিত গবেষক ও জাতভিত্তিক শোষণের বিরুদ্ধে আন্দোলনের অন্যতম শরিক রোহিথ ভেমুলার স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। অনুষ্ঠান পরিচালনা করছিলেন দেবর্ষি। তারপর একে একে বক্তব্য রাখেন পণ্ডিচেরী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্দ্রজিত, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের দেবাশিস, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃষা, ইএফএলইউ'এর কুণাল, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের টিপু, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের শুভম, জেএনইউ'এর ঈশান, প্রেসিডেন্সি'র গবেষক বিবস্বান, জেএনইউ'এর জিগীষা, হায়দ্রাবাদ কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সুন্কন্যা, যাদবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং-এর সৌভিক, আইআইএসসি-র প্রকাশ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্ক, যাদবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং-এর স্বর্ণেন্দু, যাদবপুর সায়েন্স-এর রাণা আবির এবং যাদবপুর আর্টসের শ্রমণ। শেষে দেবর্ষি সমস্ত বক্তব্য থেকে উঠে আসা গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন সাধারণ বিষয়গুলিকে গোছ করে বক্তব্য রেখে অনুষ্ঠান শেষ করেন।
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে যে বিষয়টি কম-বেশি সকলের বক্তব্যেই আসে তা হল - বর্তমান সময়ের দেশজোড়া ছাত্র-ছাত্রী আন্দোলন শুধুমাত্র ক্যাম্পাসের দৈনন্দিন বিভিন্ন ইস্যু, ক্যাম্পাস অগণতন্ত্রের বিরুদ্ধে গড়ে উঠছে তা নয়, এর সাথে যুক্ত হচ্ছে লিঙ্গবৈষম্য মুক্ত, জাত-বর্ণের ভেদ-ভাব মুক্ত, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতামুক্ত, প্রাদেশিকতাবাদ মুক্ত, বিকল্প যৌনতার অধিকার যুক্ত ক্যাম্পাস তথা সমাজ গড়ার জন্য লড়াই; ফলত, আন্দোলন-লড়াইয়ের পরিসর আরও উন্মুক্ত ও ব্যাপ্ত হচ্ছে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা আরও বেশি করে নীতি নির্ধারণের প্রশ্নে সক্রিয় ভূমিকা নিতে এগিয়ে আসছেন, ফলে সাধারণ সভা বা জেনারেল বডি (সংক্ষেপে জিবি) আরও বেশি বেশি করে আন্দোলনের সংগঠক হয়ে উঠছে। পরিচিত রাজনৈতিক শক্তি বা পতাকাগুলির বাইরেই মূলত আজকের আন্দোলনগুলি সাধারণ আম-পড়ুয়াদের নেতৃত্বে বিকাশ লাভ করছে, এটা একটা নতুন বিষয় - এমন মতামতও বিভিন্ন বক্তব্যে উঠে আসে। আবার স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনে সচেতন অংশের ভূমিকা নিয়েও নানান ভিন্ন মতের আদানপ্রদানে জমে ওঠে 'কথোপকথন'। 'হোক কলরব'-এর পীঠস্থান যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সকলের বক্তব্যেই 'হোক কলরব'-যাপন থেকে শেখা দিকগুলো উঠে আসে। অধিকাংশ আন্দোলন সংগঠকের বক্তব্যে আন্দোলনকে দেখার প্রশ্নে তাদের অনুভূতিপ্রবণতা বিশেষভাবে ফুটে ওঠে। প্রায় সকল বক্তার বক্তব্যেই উঠে আসে যে এই মুহূর্তে সামাজিক অন্যান্য পরিসরের মতো শিক্ষাক্ষেত্রেও সবচেয়ে বড় বিপদ ফ্যাসিবাদী সঙ্ঘ পরিবার-বিজেপি নেটওয়ার্ক এবং শিক্ষার গেরুয়াকরণ প্রসঙ্গ। ফলত, বিভিন্ন আন্দোলনগুলির এই প্রশ্নে জোট বাঁধার প্রসঙ্গটিও জোর দিয়ে উত্থাপিত হয়। বৈচিত্র্যপূর্ণভাবে প্রকাশিত হতে চাওয়া আজকের ছাত্র-যুব আন্দোলনগুলির মধ্যে কথোপকথন আরও অনেক বিস্তৃত ও গভীর করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন সকলেই এবং এই উদ্যোগ আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ায় ভূমিকা নেবার কথাও উঠে আসে। দীর্ঘ সময় ধরে সভা চললেও শেষ অবধি সভাগৃহ পূর্ণ ছিল - আলোচনাসভাটির সফল হবার এটাও একটা দিক।
মৈনাক মাইতি
সম্প্রতি (৯ই জুন) কলকাতার ভারত সভা হলে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল 'কথোপকথনে ছাত্রী-ছাত্র আন্দোলন: নতুনের জন্ম?' শিরোনামে একটি সেমিনারমূলক উদ্যোগ । সেমিনারটির উদ্যোক্তা ছিলেন প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রাক্তনী দেবর্ষি চক্রবর্তী, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগে গবেষণারত বন্দনা মণ্ডল এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের স্নাতকোত্তরে পাঠরত শ্রমণ গুহ। বন্দনা দেবর্ষী শ্রমণ ছাত্র-যুব-সামাজিক পরিসরে বিভিন্ন বৈষম্যের বিরুদ্ধে ন্যায় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যে সব আন্দোলন সংগঠিত হচ্ছে সেগুলির সক্রিয় মুখ। পূর্বনির্ধারিত সূচি অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গ এবং রাজ্যের বাইরে দেশের নানান প্রান্তের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বিভিন্ন ছাত্রী-ছাত্র আন্দোলন থেকে উঠে আসা ১৭ জন সংগঠকের বক্তব্য রাখার কথা ছিল। কিন্তু ক্যাম্পাসজনিত অনিবার্য কারণে দিল্লির জওহরলাল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের সদস্য শেইলা রশিদ এবং রামা নাগা এসে উঠতে পারেননি। ফলে, মোট ১৫ জন সংগঠক বক্তব্য রাখেন। অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন বর্ধমান, কলকাতা, প্রেসিডেন্সি, যাদবপুর, বারাসাত, সেন্ট জেভিয়ার্স, আইআইইএসটি, জেএনইউ, এইচসিইউ সহ অন্যান্য কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রী, গবেষক ও শিক্ষকেরা। এছাড়াও নাগরিক সমাজ তথা নাগরিক আন্দোলনের নানান পরিচিত মুখ উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠান শুরু হয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক স্তরের ছাত্র শুভম কাঞ্জিলালের ম্যান্ডোলিন বাজানোর মধ্যে দিয়ে। এরপর সংগ্রামী, ব্রিটিশ-বিরোধী দলিত যোদ্ধা বীরসা মুণ্ডার প্রয়াণ দিবস এবং তরুণ দলিত গবেষক ও জাতভিত্তিক শোষণের বিরুদ্ধে আন্দোলনের অন্যতম শরিক রোহিথ ভেমুলার স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। অনুষ্ঠান পরিচালনা করছিলেন দেবর্ষি। তারপর একে একে বক্তব্য রাখেন পণ্ডিচেরী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্দ্রজিত, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের দেবাশিস, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃষা, ইএফএলইউ'এর কুণাল, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের টিপু, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের শুভম, জেএনইউ'এর ঈশান, প্রেসিডেন্সি'র গবেষক বিবস্বান, জেএনইউ'এর জিগীষা, হায়দ্রাবাদ কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সুন্কন্যা, যাদবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং-এর সৌভিক, আইআইএসসি-র প্রকাশ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্ক, যাদবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং-এর স্বর্ণেন্দু, যাদবপুর সায়েন্স-এর রাণা আবির এবং যাদবপুর আর্টসের শ্রমণ। শেষে দেবর্ষি সমস্ত বক্তব্য থেকে উঠে আসা গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন সাধারণ বিষয়গুলিকে গোছ করে বক্তব্য রেখে অনুষ্ঠান শেষ করেন।
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে যে বিষয়টি কম-বেশি সকলের বক্তব্যেই আসে তা হল - বর্তমান সময়ের দেশজোড়া ছাত্র-ছাত্রী আন্দোলন শুধুমাত্র ক্যাম্পাসের দৈনন্দিন বিভিন্ন ইস্যু, ক্যাম্পাস অগণতন্ত্রের বিরুদ্ধে গড়ে উঠছে তা নয়, এর সাথে যুক্ত হচ্ছে লিঙ্গবৈষম্য মুক্ত, জাত-বর্ণের ভেদ-ভাব মুক্ত, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতামুক্ত, প্রাদেশিকতাবাদ মুক্ত, বিকল্প যৌনতার অধিকার যুক্ত ক্যাম্পাস তথা সমাজ গড়ার জন্য লড়াই; ফলত, আন্দোলন-লড়াইয়ের পরিসর আরও উন্মুক্ত ও ব্যাপ্ত হচ্ছে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা আরও বেশি করে নীতি নির্ধারণের প্রশ্নে সক্রিয় ভূমিকা নিতে এগিয়ে আসছেন, ফলে সাধারণ সভা বা জেনারেল বডি (সংক্ষেপে জিবি) আরও বেশি বেশি করে আন্দোলনের সংগঠক হয়ে উঠছে। পরিচিত রাজনৈতিক শক্তি বা পতাকাগুলির বাইরেই মূলত আজকের আন্দোলনগুলি সাধারণ আম-পড়ুয়াদের নেতৃত্বে বিকাশ লাভ করছে, এটা একটা নতুন বিষয় - এমন মতামতও বিভিন্ন বক্তব্যে উঠে আসে। আবার স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনে সচেতন অংশের ভূমিকা নিয়েও নানান ভিন্ন মতের আদানপ্রদানে জমে ওঠে 'কথোপকথন'। 'হোক কলরব'-এর পীঠস্থান যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সকলের বক্তব্যেই 'হোক কলরব'-যাপন থেকে শেখা দিকগুলো উঠে আসে। অধিকাংশ আন্দোলন সংগঠকের বক্তব্যে আন্দোলনকে দেখার প্রশ্নে তাদের অনুভূতিপ্রবণতা বিশেষভাবে ফুটে ওঠে। প্রায় সকল বক্তার বক্তব্যেই উঠে আসে যে এই মুহূর্তে সামাজিক অন্যান্য পরিসরের মতো শিক্ষাক্ষেত্রেও সবচেয়ে বড় বিপদ ফ্যাসিবাদী সঙ্ঘ পরিবার-বিজেপি নেটওয়ার্ক এবং শিক্ষার গেরুয়াকরণ প্রসঙ্গ। ফলত, বিভিন্ন আন্দোলনগুলির এই প্রশ্নে জোট বাঁধার প্রসঙ্গটিও জোর দিয়ে উত্থাপিত হয়। বৈচিত্র্যপূর্ণভাবে প্রকাশিত হতে চাওয়া আজকের ছাত্র-যুব আন্দোলনগুলির মধ্যে কথোপকথন আরও অনেক বিস্তৃত ও গভীর করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন সকলেই এবং এই উদ্যোগ আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ায় ভূমিকা নেবার কথাও উঠে আসে। দীর্ঘ সময় ধরে সভা চললেও শেষ অবধি সভাগৃহ পূর্ণ ছিল - আলোচনাসভাটির সফল হবার এটাও একটা দিক।
Wednesday, 15 June 2016
কলকাতার কিডনি
মেয়র কি অমূল্য বাস্তুতন্ত্রের মৃত্যুর জয়ডঙ্কা বাজাচ্ছেন?
দেবব্রত চক্রবর্তী
শ্রীযুক্ত
শোভন চট্টোপাধ্যায় মহাশয়
কেবলমাত্র কলকাতার মেয়র মাত্র নন, বর্তমানে আমাদের রাজ্যের মহামান্য পরিবেশমন্ত্রীও বটে। তার সিংহাসনে অধীন হওয়া এবং প্রমোশন প্রাপ্তির দু'
সপ্তাহ অতিক্রান্ত হওয়ার আগেই তিনি সম্প্রতি পূর্ব কলকাতা জলাভূমির আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ 'রামসার’
স্বীকৃতির বিষয়ে ভীষণ
উষ্মা প্রকাশ করেছেন। ১৯৭১ সালে ইরানের রামসার শহরে বিভিন্ন দেশের গুরুত্বপূর্ণ জলাভূমিগুলির সংরক্ষণ এবং যুক্তিসঙ্গত দীর্ঘস্থায়ী ব্যবহারের স্বার্থে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশগুলি নিজেদের মধ্যে এক চুক্তি সম্পাদন করে। ১৯৮২ সালে ভারতবর্ষ এই রামসার চুক্তির সাথে যুক্ত হয় এবং আমাদের রাজ্যের অন্যতম
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন
ইকোলজিস্ট ধ্রুবজ্যোতি ঘোষের উদ্যোগে ২০০২ সালে পূর্ব কলকাতার জলাভূমি 'রামসার’ স্বীকৃতি পায়। আপনারা জানেন, সারা পৃথিবীতে বর্তমানে প্রায় ২২০০ গুরুত্বপূর্ণ জলাভূমি রামসার তালিকাভুক্ত।
ভারতের মাত্র ২৬টি জলাভূমি এই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির অধিকারী এবং তার মধ্যে অন্যতম আমাদের ‘পূর্ব
কলকাতার জলাভূমি’।
উল্লেখ্য, আমাদের প্রতিবেশী রাজ্য উড়িষ্যার ভিতরকনিকা ম্যানগ্রোভ অরণ্য এবং জলাভূমিও এই রামসার তালিকাভুক্ত।
আমাদের
পরিবেশমন্ত্রী বলেছেন 'রামসার' তালিকায় নাম থাকার দরুণ পূর্ব কলকাতা জলাভূমি এলাকায় ঠিকঠাক উন্নতি করতে পারছেন
না। এদিকে
কলকাতার প্রতিটি প্রবেশ
পথে বিশাল
হোর্ডিং ঝুলছে, ‘Come
to Bengal Ride the Growth’। আমাদের
রাজ্যের পরিবেশমন্ত্রীর মতে, কলকাতা মিউনিসিপ্যালিটির বিভিন্ন ইনফ্রাস্টাকচার প্রোজেক্ট,
উন্নয়নের নীলনকশা পূর্ব কলকাতার বিস্তীর্ণ জমি আন্তর্জাতিক গুরুত্বসম্পন্ন জলাভূমি রামসার স্বীকৃতির কারণে ব্যবহার করা যাচ্ছে
না। কলকাতার মেয়র হিসাবে তার বক্তব্য,
রামসার স্বীকৃতির সময়ে এই বিষয়ে কলকাতা কর্পোরেশনের সাথে পরামর্শ করা হয়নি। অথচ ২০০২ সালে বিভিন্ন ব্যক্তির প্রয়াসে এই বিস্তীর্ণ জলাভূমি যখন রামসার তালিকাভুক্ত হয় তখন কলকাতা কর্পোরেশনের নিয়ন্ত্রণ ছিল তৃণমূলের হাতে এবং কলকাতার মেয়র ছিলেন সুব্রত মুখার্জি।
আমাদের পরিবেশমন্ত্রী বুঝতেই পারছেন না যে এই পূর্ব কলকাতার জলাভূমির ভেতরের ভেড়ি এবং চাষিদের কাছ থেকে উচিত মূল্যে জমিগুলি কিনে নিয়ে সেখানে উনি বিভিন্ন প্রোজেক্ট করতে পারবেন না কেন?
একদিকে কলকাতার মেয়র হিসাবে তিনি রামসার স্বীকৃতি বাতিল করার জন্য দরবার করছেন অন্যদিকে ওনার অধীনে পরিবেশ দপ্তর পরিবেশের ভারসাম্যের কথা মাথায় রেখে পূর্ব কলকাতার জলাভূমির অভূতপূর্ব চরিত্র বজায় রাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত।
শোভনবাবুর
হাতে ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক,
এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক এবং জাইকা'র
কোটি কোটি টাকার প্রজেক্ট। বিভিন্ন
রিয়েল এস্টেট কোম্পানির প্রলোভন অথচ জমির অভাবে সেই প্রোজেক্টগুলি বাস্তবায়িত হতে পারছে
না। বাইপাসের পশ্চিম
দিকে যখন হোটেল, হাউসিং কমপ্লেক্স সমেত বড় বড় প্রজেক্ট তখন বাইপাসের পূর্বদিকে বিপুল পরিমাণ জমি জলাভূমি সংরক্ষণের আন্তর্জাতিক চুক্তি রামসার স্বীকৃতি প্রাপ্ত হওয়ায় হুড়মুড়িয়ে উন্নয়নের রথ চালানো যাচ্ছে
না। আর
যথারীতি বাকি রাজনৈতিক নেতাদের মতো রাগ গিয়ে পড়ছে পরিবেশবিদ এবং পরিবেশ সংরক্ষণের নামে উন্নয়ন বিরোধী মতামতের ওপর। অধিকাংশ রাজনৈতিক নেতাদের মতো আমাদের মেয়র এবং রাজ্যের পরিবেশমন্ত্রী মনে করেন পরিবেশ বাঁচানো এক অর্থহীন প্রয়াস এবং সেটা উচ্চারণ করতে তিনি বিন্দুমাত্র কুণ্ঠা বোধ করেন না। তিনি বলেন, জলাভূমি সংরক্ষণ ‘means
little to the common man’.
কলকাতার
পূর্ব প্রান্তের প্রাকৃতিক এবং মনুষ্যসৃষ্ট ১২৫০০ হেক্টরের এই জলাভূমি পৃথিবীর সর্ববৃহৎ এবং অত্যাশ্চর্য
এক প্রাকৃতিক
কিডনি। পূর্ব কলকাতার জলাভূমি ময়লা জল এবং জঞ্জাল পুনঃব্যবহার, পরিশোধন এবং বর্জ্য থেকে উৎপাদনের অনন্যসাধারণ যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে তা পৃথিবীর প্রাচীনতম এবং বৃহত্তম নজির।
ঐতিহাসিক কাল থেকে বর্তমানের লবণ হ্রদ অঞ্চল
থেকে পিয়ালি পর্যন্ত বিদ্যাধরী নদীর
একটি খাত বজায় ছিল এবং ব্রিটিশ জমানার প্রাথমিক যুগে সেন্ট্রাল লেক চ্যানেল মারফত কলকাতার নিকাশি ব্যবস্থা এই বিদ্যাধরী খাতের সঙ্গে যুক্ত ছিল।
পরবর্তীতে বিভিন্ন কারণে বিদ্যাধরীর এই খাত মজে যাওয়ায় ক্রমশ কলকাতার নিকাশি ব্যবস্থা সঙ্কটগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
অবশেষে ক্লার্ক সাহেবের পরিকল্পনায় কলকাতা শহরের ময়লা জল হুগলি নদীতে ফেলার পরিবর্তে ১৮৭৫ সালে কলকাতা শহরের ভূগর্ভ পয়ঃপ্রণালী তৈরি হয় । ৩৮ মাইলের ইঁটের এবং ৩৭ মাইলের পাইপের পয়ঃপ্রণালী কলকাতা শহর ছেয়ে ফেলে । সমস্ত ময়লা জল বিভিন্ন পাম্পিং স্টেশনের মাধ্যমে পাম্প করে সেন্ট্রাল চ্যানেলের মাধ্যমে পৌঁছে দেওয়া হতে থাকে বিদ্যাধরী নদীর মুখে । পরবর্তীতে গঙ্গা
দূষনের কারণ
অনুসন্ধানে দেখা গেল যে গঙ্গার তীরের প্রতিটি বড় শহর যখন শহরের বর্জ্য সরাসরি গঙ্গায় ফেলে গঙ্গা দূষণ ঘটাচ্ছে তখন একমাত্র কলকাতা শহর গঙ্গার পরিবর্তে শহরের বর্জ্য এবং ময়লা জল আজ থেকে ১০০ বছর আগে থেকেই শহরের পূর্বপ্রান্তের বিস্তীর্ণ জলাভূমির মাধ্যমে প্রাকৃতিক উপায়ে শোধন করে গঙ্গার উল্টোদিকে চালান করেছে। দুর্ভাগ্যক্রমে আমাদের
রাজ্যের পরিবেশমন্ত্রী এই অসাধারণ দৃষ্টান্ত বিষয়ে সম্পূর্ণরূপে অজ্ঞ ।
বর্তমানে
আমাদের শহর প্রত্যেক
দিন প্রায়
৭৫০ মিলিয়ন লিটার ময়লা জল এবং ২৫০০ টন কঠিন জঞ্জাল উৎপন্ন করে।
কলকাতা শহর স্থাপিত হওয়ার পর থেকে আজ
পর্যন্ত কোনও সুয়েজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট স্থাপিত হয়নি - শহরের
সমস্ত নোংরা জল খোলা এবং ভূগর্ভের পয়ঃপ্রণালীর মাধ্যমে বিভিন্ন পাম্পিং স্টেশনে গিয়ে জমা হয়,
পাম্পিং স্টেশনগুলি সেই জল বিন্দুমাত্র শোধন না করে পাম্প করে ফেলে বিভিন্ন খালে। তিলজলা, তপসিয়া, বেলেঘাটা, কেস্টপুর, বাগজোলা খাল ইত্যাদি আর সেই খালের পচা,
অপরিশোধিত প্রায় ৭৫০ মিলিয়ন লিটার ময়লা জল
প্রত্যহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক,
মনুষ্যসৃষ্ট খাল, উপখালের মাধ্যমে ছড়িয়ে যায় প্রায় ২৫০’র
ওপর ভেড়িতে
এবং অবশেষে
প্রাকৃতিক উপায়ে প্রায় পরিশোধিত অবস্থায় ব্যবহৃত হয় চাষের জমিতে,
মিলে যায় কুলটি গাঙে এবং বিদ্যাধরী নদীতে।
১৯৫৬ সালে কলকাতার পূর্বপ্রান্তে এইরকম ময়লা জলে মাছ চাষ করার ভেড়ি ছিল
প্রায় ৮০০০ হেক্টর এলাকা জুড়ে, তারপর থেকে অপরিকল্পিত উন্নয়নের ঠেলায় শুরু হয়েছে কমার পালা। আজ থেকে প্রায় ৪০-৪৫ বছর আগে কলকাতার এই অমূল্য কিডনির পচন ধরা শুরু হয়েছিল সল্টলেক স্থাপনের মাধ্যমে। প্রাকৃতিক ভারসাম্যের কথা মাথায় না রেখে,
এই সমস্ত ভেড়ি,
জলাভূমি বুজিয়ে প্রথমে গড়ে ওঠে পরিকল্পিত নগরী বিধাননগর; তারপরে সেক্টর ৫,
ইস্টার্ন মেট্রপলিটান বাইপাস,
কসবা শিল্পাঞ্চল,
মুকুন্দপুর এবং রাজারহাটের একটি অংশ। ১৯৯২ সাল নাগাদ বামফ্রন্ট সরকার এই অমূল্য জলাভূমির ২২৭ একর এলাকা বুজিয়ে এক আন্তর্জাতিক বিজনেস সেন্টার গড়ে
তোলার পরিকল্পনা করে। অবশেষে এই অদূরদর্শী কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদে বনানী
কক্করের পিআইএলের ফলে কলকাতা হাইকোর্ট এক যুগান্তকারী রায় দেয়- সেই থেকে একদল বিজ্ঞান সচেতন মানুষ
আমাদের কলকাতা শহরের এই প্রাকৃতিক কিডনি
রক্ষা করার প্রয়াস চালাচ্ছেন আর
সরকার বদল হলেও সেই একই মানসিকতায় রাজনৈতিক দলগুলি অদূরদর্শী উন্নয়নের নামে এই অমূল্য সম্পদ বেচে দেওয়ার চক্রান্ত চালাচ্ছে।
বর্তমানে
১২৫০০ হেক্টরের পৃথিবীর সর্ববৃহৎ এই প্রাকৃতিক কিডনির মধ্যে ৫৮৫২ হেক্টর জলাজমি এবং ভেড়ি (জলকর) ৪৭১৮
হেক্টরের মতো নিচু ধানের জমি,
৬০২ হেক্টর মতো বিভিন্ন ধরনের সবজি এবং চাষের জমি এবং মধ্যে মধ্যে ১৩২৬ হেক্টরের মতো বসত জমি। দুই ভেড়ির
মাঝে চলার পথ,
মানুষের বসতি, ছোট
ছোট গ্রাম বর্তমান। কলকাতা শহরের প্রত্যহ ৭৫০ মিলিয়ন লিটার ময়লা জল বিনা পয়সায় শোধন হয়ে যায় এই প্রাকৃতিক জলাভূমির মাধ্যমে।
অনবদ্য দক্ষতায় অঞ্চলের মৎস্য
চাষিরা কলকাতা
শহরকে এই দূষিত জলের ভেড়ি থেকে উপহার দেয় ১১০০০ টনের থেকেও বেশি মিষ্টি জলের মাছ।
রুই, কাতলা, তেলাপিয়া, মৃগেল, সিলভার কার্প,
চারাপোনা, ট্যাংরা, গ্রাস কার্প গরিব মানুষের পাতে সস্তায় প্রোটিন যোগায়। এখনও মাত্র ৩০ টাকায় কলকাতা শহরে মাছ ভাত পাওয়া যায় এই অনবদ্য দক্ষ চাষিদের কারণে। জলা জমির
কচুরিপানা শোষণ করে নেয় ময়লা জলের তেল।
কঠিন জঞ্জালের সারের ফলে উৎপাদন হয় ৩৭০০০ টনের ওপর চাল এবং কলকাতা শহরের প্রায় অর্ধেক সবজি,
কলা সরবরাহ হয় এই অঞ্চল থেকে।
প্রায় ১২৮০-১৩০০ কোটি টাকার সম্পদ সৃষ্টি হয় এই প্রাকৃতিক কিডনির সহায়তায়।
মেকানিক্যাল ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের বিপুল খরচা বাঁচায় কর্পোরেশন এবং বিপুল পরিমাণ কার্বন শোষণ করে এই বিস্তীর্ণ জলাভূমি অঞ্চল।
আর এই বিপুল কর্মকাণ্ডের পেছনে ব্যাঙ্কের কোনও অনুদান নেই,
বিজ্ঞান বা প্রযুক্তিগত কোনও সাহায্য নেই,
এলাকার রাজবংশী, বাগদি, আদিবাসী এবং নমশূদ্র জনসম্প্রদায়ের দক্ষতা, ভূপৃষ্ঠের বৈশিষ্ট্য, সৌরশক্তির এক চমৎকার সংযোজনে গড়ে উঠেছে এই স্বনির্ভর প্রযুক্তির অননুকরণীয় নজির।
এই অঞ্চলের ওপর নির্ভর প্রায় ১০০,০০০
অধিবাসী, রাজ্যের অন্যান্য কৃষক বা কৃষি শ্রমিকের তুলনায় ঈর্ষণীয়
পরিমাণ বেশি
উপার্জন করেন,
কলকাতা শহরের টাটকা সবছি মাছ ইত্যাদির দাম সস্তা রাখতে সাহায্য করেন এবং বিপুল পরিমাণ বর্জ্য নিজ দক্ষতায় ভূপৃষ্ঠের বৈশিষ্ট্যে পরিষ্কার করেন।
সাধারণ জনতার এই জ্ঞান এবং দক্ষতার পরিচয় অনুভব করতে যে কোনও কলকাতাবাসী একবার বানতলা চর্মনগরী ঘুরে আসতে পারেন;
সেখানে বসানো
হয়েছে ভারতের সর্ববৃহৎ সেডিমেন্টেসন ট্যাঙ্ক, কিন্তু নিশ্চল নিথর। অন্যদিকে শয়ে শয়ে সচল ভেড়ির মধ্যে পড়ে আছে বানতলা চর্মনগরীর অচল যন্ত্রদানব।
পূর্ব
কলকাতার জলাভূমি একাধারে ফ্রি সুয়েজ ট্রিটমেন্ট প্লান্ট,
অভূতপূর্ব জলজ বাগান এবং বন্যা প্রতিরক্ষার উপায় । এই প্রসঙ্গে গত বছর নভেম্বরের চেন্নাই বন্যার কথায় বলি।
২০ বছর পূর্বে চেন্নাইতে ৬৫০র ওপর জলাভূমি ছিল; আজকের দিনে উন্নয়নের ঠেলায় সেই সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র ২৭’এ। তার ফলে বিপুল বর্ষার জল নিকাশি
ও শোষণের উপায়
না থাকাতে চকচকে এয়ারপোর্ট থেকে আধুনিক ভবনের প্রান্তর ভাসিয়েছে অসময়ে বৃষ্টি । কলকাতাও চেন্নাইয়ের মতো নিচু এলাকা,
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ৫ মিটার উঁচু। পূর্ব কলকাতার জলাভূমির বিলুপ্তি এই শহরের বাসযোগ্যতাকে যে
বিপদের মুখে ঠেলছে
তার পরিণাম অনুমান করার ক্ষমতা দুঃখজনক ভাবে আমাদের পরিবেশ মন্ত্রীর অনুপস্থিত। রামসার চুক্তি অনুসারে, স্থানীয় সরকার (এ ক্ষেত্রে রাজ্য সরকার) এবং কলকাতা কর্পোরেশনের ৬ মাসের মধ্যে জলাভূমি সংরক্ষণ এবং ম্যানেজমেন্টের প্ল্যান প্রস্তুত করার কথা ছিল। কিন্তু ইতিমধ্যে ১৪ বছর অতিক্রান্ত- আমাদের রাজ্য সরকার এবং কলকাতা কর্পোরেশন আজ পর্যন্ত কলকাতার এই অমূল্য সম্পদ রক্ষা করা এবং ম্যানেজমেন্টের প্ল্যান প্রস্তুত করে উঠতে পারেনি। উল্টে আমাদের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বিগত দফায় ক্ষমতায় আসার পরে এই বিস্তীর্ণ জলাভূমিতে বেআইনিভাবে গড়ে ওঠা ২৫০০০ বেআইনি বিল্ডিংকে আইনানুগ করে দেওয়ার ব্যবস্থা নিয়েছেন। আর আমাদের রাজ্যের বর্তমান পরিবেশমন্ত্রীর স্টেটমেন্ট আরও সাংঘাতিক। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের এক ডেলিগেশনকে তিনি বলেছেন, সাধারণ মানুষের কাছে জলাভূমি সংরক্ষণের তুলনায় সিভিক সার্ভিস বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
বিগত ৩০-৩৫ বছর ধরে সমস্ত রাজনৈতিক নেতা, সমস্ত রাজনৈতিক দল কলকাতাবাসীর বিপুল ক্ষতি করে একটু একটু করে এই অমূল্য সম্পদ নষ্ট হয়ে যেতে, দখল করে নিতে, আইনি স্বীকৃতি দিয়ে অধিগ্রহণে উৎসাহ দিচ্ছেন আর অতি দ্রুত পুরো কলকাতাকে ঠেলে দিচ্ছেন এক ভয়ঙ্কর ভবিষ্যতের দিকে। কলকাতা শহরের ঢালই পূর্বদিকে, অতি বর্ষা জমা জলের স্বাভাবিক গতিপথ
পূর্বদিকে- এই গতি রুদ্ধ করে দিলে কলকাতা জলে ভাসবে, গরমে অতিষ্ঠ হবে, ১০০,০০০ মৎস্যজীবী, কৃষিজীবী বাস্তুচ্যুত হবে এবং রাজনৈতিক নেতাদের অদূরদর্শিতায় গোটা কলকাতা তার বাসযোগ্যতা হারাবে। উন্নতির মরীচিকায় বাঙ্গালোর আগামী ২০২৫ সালের পরে বাসযোগ্য থাকবে কিনা এই বিষয়ে যখন সন্দেহ ঘনীভূত হচ্ছে,
জলাভূমি বুজিয়ে
উন্নতির কুফল
হিসাবে যখন আমাদের চেন্নাইয়ের বন্যা থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত, তখন আমাদের মেয়র ও রাজ্যের পরিবেশমন্ত্রী পূর্ব
কলকাতার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত অমূল্য বাস্তুতন্ত্রের মৃত্যুর জয়ডঙ্কা বাজাচ্ছেন। আমাদের উদাসীনতার ফায়দা ওঠাচ্ছেন অবিবেচক রাজনৈতিক নেতৃত্বসমূহ।
Subscribe to:
Posts (Atom)