Saturday, 28 May 2016

বিষয় পশ্চিমবঙ্গ

নতুন সরকার নতুন পর্ব 
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য



ভোট পর্ব মিটল, ফলাফল বেরল, শপথ নিয়ে সরকারে আসীনও হলেন শাসকেরা। গত পাঁচ বছরে সদর্থক কিছু কাজ করার ফল হাতেনাতে পেয়েছেন মমতার সরকার। সে নিয়ে আমরা ‘একক মাত্রা’র মে সংখ্যায় (‘পশ্চিমবঙ্গের হাল হকিকত') কিছু আলোচনাও করেছি। আমাদের এই সংখ্যাটি প্রকাশ পেয়েছিল এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহে, তখনও বোদ্ধারা খুব সংশয়ে ছিলেন ভোটের ফলাফল নিয়ে। মিডিয়া, বিশেষত আনন্দবাজার গোষ্ঠীর হলুদ সাংবাদিকতায় তখন অনেকেরই মনে হচ্ছে এবার মমতা আর ক্ষমতায় ফিরছেন না। নানা ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ, প্রচ্ছন্ন হুমকি বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে- এবার ২০১১’র ‘পরিবর্তনপন্থী’দের দেখে নেওয়া হবে। নির্বাচন কমিশনও খুব কড়া হাতে দীর্ঘ সময়ব্যাপী নির্বাচনের নির্ঘণ্ট পরিচালনা করছেন। এমতাবস্থায় আমাদের সংখ্যাটি যখন বেরল, অনেকেই আমাদের বিশ্লেষণগুলিকে খোলা মনে নিতে পারেননি, কারও কারও মনে হয়েছে আমরা একটু হেলে আছি দিদির দিকে। কেউ কেউ, যারা আমাদের ওপর আস্থা রাখেন, তাঁরাও ভাবছেন আমরা বোধহয় সময় ও বাস্তবতা থেকে বিচ্যুত হয়েছি। নিকটজনেরা যখন জিগেস করেছেন ভোটের ফলাফল কী হবে, নির্দ্বিধায় উত্তর দিয়েছি, তৃণমূল ২০০’র কিছুটা এপাশ ওপাশে থাকবে। বাস্তবিক দেখা গেল, তাই ঘটল। আমরা সময়কে প্রতিনিধিত্ব করেছি মাত্র।

এখন দু-তিনটি বিষয় মনে হচ্ছে। যে কণ্টকহীন গুরুদায়িত্ব মমতার সরকারের ওপর অর্পণ করলেন এ রাজ্যের মানুষ তার ফলাফল কী দাঁড়াবে। কারণ, এবারে বিপুল জনসমর্থন নিয়ে তৃণমূল ক্ষমতায় এসেছে এবং বিরোধীরা কার্যত নিধিরাম সর্দার’এ পরিণত হয়েছেন। তাহলে কি শাসককুল এখন এই খোলা মাঠ পেয়ে যা খুশি তাই করবেন? আবারও বলি, বাস্তবতার নিরিখে এমনতর ভাবার কোনও কারণ নেই; এটা একটা অতিকথা যে তৃণমূল ধান্দাবাজ ও সিন্ডিকেট-নির্ভর একটি পার্টি যার কোনও নিয়মনীতি বা আদর্শ নেই। বরং এটা অনুধাবন করতে হবে, তৃণমূল ও মমতা এক নির্দিষ্ট সময়ের প্রেক্ষিতে স্বতঃস্ফূর্ত জনজোয়ারের ফসল,  একটি স্টেটমেন্ট এবং প্রান্তিক মানুষের অন্তর্নিহিত আকাঙ্ক্ষা। একে অতিক্রম করার সাধ্য তৃণমূল দলেরও নেই। যেদিন তা ঘটবে সেদিন ইতিহাসের অন্য এক বয়ানের সূত্রপাত হবে। মানুষের স্বতঃসারিত আবেগ, স্বপ্ন ও সম্মিলিত চৈতন্যে তৃণমূলের বিস্তার; যে কারণে অন্য দল ভেঙ্গে আসা নেতা-কর্মীরা, নবাগত পেশাদার বা ব্যক্তিরা, সাধারণ ভাবে কাজেকম্মে পারদর্শী ও সামাজিক মানুষেরা তৃণমূলে প্রবেশাধিকার পান এবং অবস্থা বিশেষে তাঁদের কেউ কেউ লাইমলাইটে চলে আসেন, নির্বাচনে দাঁড়ানোর টিকিটও পান বা বিশেষ গুরুত্বের কোনও কাজ। এটাই একটা গণ পার্টির বৈশিষ্ট্য এবং প্রকারান্তরে তলা থেকেই জনমতের চাপে এর গঠন, বিস্তার ও লয়। তা বলে এমনটা ভাবার কারণ নেই যে দলটি ও এদের নেতারা একেবারে ধোয়া তুলসিপাতা। বরং সমাজের ক্লেদ, হিংসা, সঙ্কীর্ণতাও প্রতিফলিত হয় এদের কার্যকলাপে, সমাজের সুদিকগুলির সঙ্গেই।

এবার প্রশ্ন, আগামী পাঁচ বছরের যাত্রাপথটি কী ও কেমন? আপাতত এটুকুই বলা যায়, নির্মম সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসার ফলে খুব যে বিপদে পড়ে গেল মানুষ, তেমন ভাবনাটা অমূলক বলেই মনে হচ্ছে। জনকল্যাণের মধ্য দিয়ে অগ্রগতি ও বৃদ্ধির হার বাড়ানোর যে পথ মমতা নিয়েছেন, বিপুল জনাদেশ সেই পথেই এগোতে তাঁকে নিদান দিয়েছে। কিন্তু গণতন্ত্রের প্রশ্নটা কীভাবে মোকাবিলা করবে এই সরকার তা দেখার কৌতূহল রইল। শুধুমাত্র বিরোধীদের মোকাবিলা করার প্রশ্ন নয়, সাধারণ মানুষও অনেক প্রশ্ন তুলতে পারেন, জবাব চাইতে পারেন- সেইগুলোকে কীভাবে এই সরকার সামাল দেবে তা দেখতে হবে। কারণ, এই প্রশ্নে গতবার এঁদের ভূমিকা খুব একটা ভাল ছিল না। তবে নিঃসন্দেহে বলতেই হয়, উন্নয়নের প্রশ্নে মমতা এক নতুন দিশা দেখিয়েছেন যা তথাকথিত বাম্পন্থীদের যথেষ্ট লজ্জা দেবে।

Monday, 16 May 2016

নগরায়নের তাণ্ডব



যদি উড়ালপুল না ভাঙত!
প্রবুদ্ধ বাগচী
 
চিত্র পরিচালক বাসু চট্টোপাধ্যায় অনেক দিন আগে কলকাতা দূরদর্শনের জন্য একটা সিরিয়াল তৈরি করেছিলেন, যার নাম ছিল যদি এমন হত’। ওই সিরিয়ালের চিত্রনাট্যে প্রথম থেকে আস্তে আস্তে একটা সম্ভাব্য সংকট তৈরি করা হত, তারপর ক্লাইম্যাক্সে এসে একজন এসে দাঁড়াতেন পর্দায়; বলতেন, না এমনটা আসলে হয়নি। কিন্তু হলে কী হত? তারপর সেই সংকট মোচন করে মধুরেণ সমাপয়েৎ হয়ে শেষ হত এপিসোড। সন্দেহ নেই, একটু ভিন্ন মেজাজের ট্রিটমেন্ট, দর্শকদের জন্য স্বাদ বদল। কলকাতার জনবহুল রাজপথে নির্মীয়মাণ উড়ালপুলের ভেঙে পড়ার পর, কেন জানি না, আমার ওই সিরিয়ালের এপিসোডগুলো মনে পড়ে যাচ্ছিল ।

আকস্মিক ঘটে যাওয়া এই মর্মান্তিক ঘটনা, ধ্বংসস্তূপের মধ্যে বিপন্ন মানুষের আর্তনাদ, রক্ত, ছিন্ন প্রত্যঙ্গ, প্রশাসনের কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা আমাদের মনেও তৈরি করছিল এক বিপন্নতা। তারই মধ্যে সংবাদ চ্যানেলের লাইভ নিউজ দেখানোর কাড়াকাড়ি, প্রশাসনের সর্বময়ী নেত্রীর নিলাজ বক্তব্য এবং ফুটপাথে চেয়ার পেতে বসে লোক দেখানো মাতব্বরি অথচ সেনা জওয়ানদের সুসংহত নিষ্ঠ প্রয়াসে সাধারণের আস্থা, আস্তে আস্তে যা স্বাভাবিকতার দিকে নিয়ে গেছে। পাশাপাশি, সেতু নির্মাণের প্রকৌশলী দক্ষতা নিয়ে চাপানউতোর যা ক্রমশ গড়িয়ে আসছে বরাত পাওয়া সংস্থার রাজনৈতিক ছাতা ও মাল সরবরাহকারী সংস্থার অস্বচ্ছ অভিসন্ধির দিকেও, হয়তো বা। এই তদন্ত, অনুসন্ধান, চাপানউতোর ও আমাদের স্বাভাবিক রাজনৈতিক রুচিমাফিক চাপা পড়া মানুষের মুখে ব্যালট পেপার খুঁজে বেড়ানোর নেতা ও নেত্রীসুলভ ইতরামো পেরিয়ে আমরা যদি বিষয়টাকে একটি অন্যভাবে দেখতে চাই, কেমন হয়?

এই দেখতে চাওয়ার সঙ্গে অবশ্যই জড়িয়ে থাকবে রাজধানী শহর কলকাতা ও তার সংলগ্ন এলাকার নগরায়নের অভিমুখ, যার সূত্রপাত ঘটেছে দেশের উন্মুক্ত অর্থনীতি উত্তর জমানায়। এর পরিণতি ঠিক কোথায় আমাদের নিয়ে যাবে আমরা জানি না, তবে তা যে কোনও অমরাবতীর দ্বারপ্রান্ত নয়, এটা বোঝার জন্য খুব বেশি মাথা ঘামাতে হয় না। যেমন ধরা যাক, এই যে জেএনইউআরএম প্রকল্প, যার আওতায় এই উড়ালপুল তৈরি হচ্ছিল। এই প্রকল্প ইউপিএ সরকারের একটি নগরায়ন প্রকল্প যার মূল উদ্দেশ্য বড় বড় শহরের নাগরিক পরিষেবা ও পরিকাঠামোর উন্নয়ন। কিন্তু অনেক কেন্দ্রীয় প্রকল্পের মতো এই প্রকল্পের আর্থিক দায় শুধুমাত্র কেন্দ্রের সরকারের নয়, রাজ্যের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ দায় আছে। কোনও রাজ্য সরকারই আর্থিক ভাবে সম্পূর্ণ স্বয়ম্ভর এমন উদাহরণ এই দেশে নেই। ফলে, কেন্দ্রীয় সরকারের আংশিক অনুদানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে বেশির ভাগ রাজ্য সরকারই অপারগ। অথচ কেন্দ্র রাজ্যের রাজস্ব বন্টনের অনুপাতে যে ঘোর অসাম্য তা নিয়ে নতুন খোলাবাজারি অর্থনীতিতে তেমন দিকনির্দেশ নেই। এই অসাম্য নিয়ে একদা এই রাজ্যের বামপন্থীরা জোরদার হইহই করেছিলেন, তাঁদের দাবি নিছক সারহীন ছিল না। কিন্তু রাজ্য সরকারের রাজস্ব আদায়ের প্রধান উপাদান বাণিজ্য কর বিলোপ করে যখন দেশব্যপী ভ্যাট(ভ্যালু অ্যাডেড ট্যাক্স) চালু হল তার জন্য যে দেশজোড়া কমিটি হয়েছিল তার প্রধান ছিলেন এই রাজ্যেরই তৎকালীন অর্থমন্ত্রী। ফলে রাজ্যগুলি এই ভ্যাটের প্রকোপে তাঁদের নিজস্ব স্বাধীনতা নিজেরাই হারাল, এখনও যে জিএসটি বিল কেন্দ্রীয় সরকারের বিবেচনায় আছে তাতে রাজ্যগুলির রাজস্ব আদায়ে খুব একটা সুবিধে হবে এমন নয়, যদিও এই রাজ্যের বর্তমান সরকারি দল সেই বিল আইনে পরিণত করতে কেন্দ্রীয় সরকারকে সহযোগিতা করবে বলে আগাম প্রতিশ্রুত। কিন্তু আর্থিক সংকটে দীর্ণ রাজ্য সরকারগুলি এই নগরায়ন প্রকল্পের পূর্ণ সুযোগ পাবে না কারণ ম্যাচিং গ্র্যান্ট না দিলে নয়া দিল্লীর সরকারও অর্থ বরাদ্দ বন্ধ করে দেবে। তাহলে নুন আনতে পান্তা ফুরোনো রাজ্যে এই জেএনইউআরএম প্রকল্পের অগ্রাধিকার ঠিক করা একটা বড় ইস্যু। আমরা আমাদের সীমিত সাধ্যে কী করব? কাদের জন্য করব? কতটুকু করব?

গিরিশ পার্কে উড়ালপুল ভাঙার সঙ্গে এইসব প্রশ্নের কী যোগ তার ব্যাখ্যা পাঠক চাইতেই পারেন। আশা করা যায়, ক্রমশ তিনি তাঁর জবাব পাবেন। এই দিক বদলের হদিশ পাওয়া যাবে গত কয়েক বছরের নাগরিক উন্নয়ন ও পরিষেবার দিকে চোখ রাখলে। সন্দেহ নেই, কলকাতার মতো ব্যস্ত ও জনবহুল শহরে, যেখানে রাস্তার আনুপাতিক হার প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট কম সেখানে শহরের রাস্তায় যানবাহনের গতি বাড়াতে গেলে উড়ালপুল করা প্রয়োজন। নয়া দিল্লি বা মুম্বাই শহরে যেখানে শহরতলির পরিসীমা আরও বড় সেখানেও নানা উড়ালপুল তৈরি হয়েছে, এখনও হচ্ছে। সে তুলনায় কলকাতায় উড়ালপুলের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় এখনও বেশ কম। এর ফলে যানজট ও দূষণে কীভাবে আমাদের অমূল্য সময় অনুৎপাদক হিসেবে অপব্যয় হচ্ছে অতি সম্প্রতি সেই বিষয়ে একটি সমীক্ষার রিপোর্ট বেরিয়েছে যা যথেষ্ট হতাশা জাগায়।
প্রাক উদার অর্থনীতি জমানায় কলকাতার যাতায়াত ব্যবস্থার সুবিধায় দুটো খুব দরকারি উড়ালপুল তৈরি হয়েছিল - একটি শিয়ালদহে, অন্যটি হাওড়া ব্রিজ পেরিয়ে ব্র্যাবোর্ন রোডের ওপর। জায়গা হিসেবে এই দুটিই খুব গুরুত্বপূর্ণ। শিয়ালদহ এলাকায় একদিকে প্রান্তিক রেল স্টেশন, এখানেই আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র উত্তর দিক থেকে এসে হাত ধরছেন আচার্য জগদীশ চন্দ্রের, অন্যদিকে মহাত্মা গান্ধী রোড পশ্চিমগামী হয়ে জুড়ে দিচ্ছে শিয়ালদহের সঙ্গে হাওড়া স্টেশনকে। এখানে উড়ালপুলের প্রয়োজন ছিল। ঠিক যেমন ছিল, হাওড়া স্টেশন থেকে হাওড়া সেতু পেরিয়ে শহরের প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক প্রাণকেন্দ্রের দিকে সহজতর যাতায়াত। কোন সরকারের আমলে কবে এই উড়ালপুলের পরিকল্পনা হয়েছিল তা এখনি হাতের কাছে নেই। না থাকলেও কিছু আসে যায় না। প্রয়োজনের নিরিখটাই বেশি জরুরি।

কিন্তু পরিবর্তন ঘটল তারপরে। যখন খোলা অর্থনীতির নিয়ম রাজ্য সরকারগুলিকে কিছুটা স্বাধীনতা দিল যে কোনও লগ্নি বা বিদেশি অনুদানের ক্ষেত্রে। বামফ্রন্ট আমলের শেষ দশ বছরে আমরা নতুন করে কলকাতায় প্রচুর উড়ালপুলের কথা শুনলাম এবং তার বেশ কিছু তৈরিও হল নানা বিদেশি অনুদানে অথবা ওই জেএনইউআরএম প্রকল্পে। যেমন, পার্ক স্ট্রিট উড়ালপুল, গড়িয়াহাট উড়ালপুল, নাগের বাজার উড়ালপুল, কাশিপুরে লকগেট ফ্লাই ওভার, ওদিকে বাইপাস থেকে রাজারহাটগামী উড়ালপুল, ভিআইপি রোড থেকে রাজারহাটগামী উড়ালপুল, ভিআইপি রোড থেকে উল্টোডাঙ্গা মোড় এড়িয়ে সরাসরি বাইপাসে চলে যাওয়ার (এবং বিপরীতটাও) উড়ালপুল, পরমা উড়ালপুল যা পার্ক সার্কাস সাত মাথার মোড় থেকে বাইপাস যাওয়া সহজ করবে, রবীন্দ্রসদন উড়ালপুল, ডানলপ মোড়ের উড়ালপুল যা নাকি দক্ষিণেশ্বর থেকে বিটি রোডে আসার পথকে সুগম করবে, প্রস্তাব হল ভিআইপি রোডে বাগুইহাটির কাছে আরেকটি উড়ালপুলের, আরেকটি উড়ালপুল ভিআইপি রোড থেকে বিমানবন্দরে ঢুকে সোজা চলে যাবে নতুন টারমিনালের সামনে। এগুলির কিছু কিছু বাম আমলেই চালু হয়ে গিয়েছিল, কিছুর কাজ শেষ হয়েছে বর্তমান সরকারের জমানায়, কিছু উড়ালপুলের কাজ এখনো চলছে বাইপাসের ওপর, বেহালা ও বন্দর এলাকার দিকেও চালু আছে কিছু উড়ালপুলের কাজ। এইসব উড়ালপুলের আর্থিক দায় কারা বহন করেছেন বা করছেন তা সরকারি নথিতে পাওয়া যাবে। কিন্তু বলার কথা এটাই, এই উড়ালপুলগুলি কলকাতা শহরের গণ পরিবহনে যে অসংখ্য সাধারণ মানুষ রোজ যাতায়াত করেন তাঁদের গতায়াতে বিন্দুমাত্র সুরাহা করেনি। কারণ, এই প্রতিটি উড়ালপুল দিয়েই গণ পরিবহনের কোনও বাস/ মিনিবাস চলার অনুমতি নেই, এগুলি শুধুমাত্র গাড়িচালক, বা বলা ভাল, গাড়ির মালিকদের জন্য । পার্ক স্ট্রিট বা গড়িয়াহাট উড়ালপুল দিয়ে কদাচিত কয়েকটি বাস যায় বটে বা দক্ষিণেশ্বর থেকে বিটি রোডে আসতে একটু বেনিয়ম করে মাঝে মধ্যে কিছু বাস সেতুতে উঠে পড়ে তবে সেটা সাধারণ নিয়মের অনুবর্তী নয়, আসলে ওই সেতু পাবলিক বাস চলার জন্য অনুমোদিত নয়। শহরের গতি বাড়ানোর প্রতিশ্রুতির ডানা মেলে এখনও বাইপাস বা অন্যত্র যে সব উড়ালপুল মাথা তুলতে চাইছে সেখানেও এই একই নিয়ম অদূর ভবিষ্যতে লাগু হবে এটা স্পষ্ট। পরমা উড়ালপুল সম্প্রতি নাম পালটে ‘মা’ হয়েছে, কিন্তু তিনি সকলের মা নন। শহরের সম্পন্ন ধনী বা শাঁসালো উচ্চ মধ্যবিত্ত যাদের অন্তত একটি চার চাকার বাহন আছে একমাত্র তাদেরই তিনি তাঁর কোল পেতে দিতে পারেন!  

বিপরীত পক্ষে একটু নজর করলেই দেখা যাবে পার্ক স্ট্রিট বা গড়িয়াহাটের মোড়ে উড়ালপুলের নীচে পাবলিক বাস মিনিবাসের চেনা জ্যাম জট, এদিকে উলটোডাঙ্গার মোড় বা বিমানবন্দরের এক নম্বর গেট, শ্যামবাজার পাঁচ মাথা মোড়ে সারি সারি গাড়ির সিগন্যালে দাঁড়িয়ে থাকা, এক্সাইড মোড় বা মিন্টো পার্কে শ্লথ গতি যান চলাচল। অথচ অফিসের ব্যস্ত সময়েও বিদ্যাসাগর সেতু থেকে নেমে রবীন্দ্র সদন উড়ালপুল ধরে আপনি মিনিট দশ/পনেরোয় পৌঁছে যেতে পারেন পার্ক সার্কাস সাত মাথায়, সেখান থেকে বাইপাস যদি আপনি চার চাকার সওয়ার হন। এবং গাড়ির জানলা দিয়ে যদি আপনার চোখ একটু বাইরে রাখেন দেখবেন নীচে এক্সাইড মোড় থেকে বেকবাগান অবধি গাড়ির গতি কী শিথিল, পদে পদে সিগন্যাল, কোথাও তারই মধ্যে বাস মিনিবাসের কন্ডাক্টারের যেখানে সেখানে বাস থামিয়ে লোক তোলার চির চেনা অভ্যাস। যে পথ আপনি পেরোলেন দশ পনের মিনিটে গণ পরিবহনের যাত্রীদের সেই পথ পেরোতে সময় লাগবে কম পক্ষে আধ ঘণ্টা বা চল্লিশ মিনিট। একই ভাবে বালি ব্রিজ পেরিয়ে ডানলপ ফ্লাইওভার ধরে ও লকগেটের জোড়া ফ্লাইওভারে চেপে আপনি যখন শোভাবাজার মেট্রো স্টেশন পৌঁছে যাবেন মিনিট কুড়ি-পঁচিশে তখন গাড়িবিহীন এক নিত্যযাত্রী টালা ব্রিজের একপ্রস্থ জ্যাম পেরিয়ে শ্যামবাজার পাঁচ মাথায় আসবেন এবং আবার একটা বড় সিগন্যাল পেরোতে আরো বেশ কিছুটা সময় ব্যয় করবেন। আপনার গাড়িতে চালানো এফএম রেডিও বড় জোর এই বার্তা আপনাকে জানিয়ে দেবে শহরের রাস্তায় কোথায় কোথায় গাড়ির গতি শ্লথ, এই বার্তায় আপনার কী এমন যায় আসে? আপনার সময়ের দাম অনেক বেশি কারণ আপনি গাড়ি চড়েন এবং সেই সুবাদে আপনি নতুন নতুন সব উড়ালপুলে চাপতে পারেন। বাকিদের জন্য ব্যস্ত অফিস টাইমে নিত্যসঙ্গী যানজট, ঘন ঘন হাতঘড়িতে টাইম দেখা – ঠিক সময় অফিসে ঢুকতে পারবেন তো? কারণ ওই উড়ালপথের মসৃণ হাতছানি আপনার জন্য নয়, তার স্পষ্ট পক্ষপাত গাড়ি চাপিয়ে নাগরিকদের জন্য। আপনি বড় জোর কোনও ছুটির দিনে একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে বউ বাচ্চা নিয়ে ওইসব না চাপা উড়ালপুলে উঠে একদিনের বাদশা বনতে পারেন। কিন্তু নির্মিত ও নির্মীয়মাণ ওইসব উড়ালপুলের উন্নয়ন যজ্ঞে আসলে আপনার কোনও আমন্ত্রণ নেই।

যে উড়ালপুল ভেঙে পড়ে এত কথার জন্ম দিল তাও কিন্তু তৈরি হচ্ছিল ওই প্রথম শ্রেণির নাগরিকদের জন্যই। ওটি যদি অচিরে পুনর্নির্মাণও হয় আপনার জন্য ভয়াল পোস্তা বাজারের জ্যাম একটুও কমে আসবে এমন আশা বাতুলতা। আমাদের উন্নয়ন আসলে এইরকমই একচোখা। সাধারণ যাত্রীদের জন্য তার কোনও দায় নেই। হয় তাঁরা ঘাড় উঁচু করে তাকিয়ে থাকবেন মস্ত এক সর্পিল উড়ালপুলের দিকে অথবা তার তলায় চাপা পড়ে থাকবেন উন্নয়ন প্রভুদের ভাগ বাঁটোয়ারার বিবাদে। অনেকদিন আগে সুকান্ত ভট্টাচার্য লিখেছিলেন: বলতে পারো, বড়লোকে মোটর কেন চড়বে?/ আর গরীব লোকে সেই মোটরের তলায় চাপা পড়বে! সাম্যবাদের আদর্শে প্রাণিত কিশোর কবির প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিত হয়তো পাল্টে গেছে, কিন্তু ওই প্রশ্নের জবাব আজও মেলেনি। তবে সমীকরণ কিন্তু মিলে গেছে। উড়ালপুলের তলায় যাদের চাপা পড়ার কথা ছিল, তাঁরাই পড়েছেন। তাঁরা তো আর কোনোদিন ওই উড়ালপুলে এমনিতেও চাপতে পারতেন না!