ইসলামিক স্টেট এবং রোজাভা
দেবব্রত চক্রবর্তী
যখন প্যারিস থেকে বেইরুত, আঙ্কারা থেকে কিনিয়া প্রায় প্রত্যহ কোথাও না কোথাও সন্ত্রাসবাদী হামলার সাথে সন্ত্রাস দমনে দেশ জুড়ে জরুরি অবস্থা এবং আকাশ থেকে নির্বিচার বোমাবর্ষণ প্রায় নিয়মে পরিণত; যখন লক্ষ লক্ষ মানুষের ঘর বাড়ি ছেড়ে প্রাণ
বাঁচাতে মরুভূমির শুষ্ক বালিতে পর দয়া-নির্ভর উদ্বাস্তুর
জীবনযাপন এমনকি বিপজ্জনক ডিঙ্গি নৌকায় বিদেশে
আশ্রয়ের আশার প্রাণপন প্রচেষ্টা ইউরোপের বাসিন্দাদের
কাছে এক নতুন উৎপাত হিসাবে উপস্থিত; যখন হাঙ্গেরি এবং অন্য অনেক দেশ হাজার হাজার কিলোমিটার পার হয়ে আসা ক্লান্ত উদ্বাস্তুর দল পাশের দেশকে চালান
পাঠানোর নির্লজ্জ খেলার নিত্য নতুন
দক্ষতা রপ্ত করতে ব্যস্ত; যখন
উরুগুয়ের প্রেসিডেন্ট তার বাসস্থান মধ্যপ্রাচ্যের উদ্বাস্তুদের জন্য উন্মুক্ত করে দিচ্ছেন, গ্রিস তার অসহনীয় আর্থিক দুরবস্থা স্বত্বেও সমুদ্র পার হয়ে আসা উদ্বাস্তুদের প্রাথমিক চিকিৎসা এবং শুশ্রূষার মানবিক দায়িত্ব পালন করতে পিছুপা হচ্ছে না; যখন বড়
বড়
দেশ প্রতিনিয়ত হিসাবনিকেশ
কষতে ব্যস্ত ঠিক কত কম পরিমাণ উদ্বাস্তু গ্রহণ করলে লজ্জার মাথাটা কাটা পরবে না; যখন বিশ্বের প্রধান শক্তিসমূহ আফগানিস্তান, লিবিয়া, সিরিয়া, ইরাকের সরকারি ব্যবস্থা ধ্বংস করে দেওয়ার অবশেষে, আপামর জনসাধারণকে মৌলবাদী সন্ত্রাসীদের হাতে ছেড়ে দিয়ে মাঝে মাঝে হুঙ্কার এবং আকাশ থেকে বোমাবর্ষণে আইসিস’কে পরাস্ত করার এক দিবাস্বপ্ন ফেরি করে বেড়াচ্ছে - ঠিক তখন আইসিস’এর ঘাঁটিতে গত
তিন বছরের অধিক সময় ধরে সকলের অগোচরে ঘটে চলেছে এক অসাধারণ সামাজিক বিপ্লব
- Rojava
Revolution।
কুর্দ ভাষায়
'রোজাভা' শব্দটির অর্থ 'পশ্চিম'। টাইগ্রিস এবং ইউফ্রেটিস নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চল, কুর্দিস্তানের পশ্চিমে, সিরিয়ার উত্তরে এবং তুরস্কের সীমানায় বর্তমানে ১৮৪০০ স্কোয়ার কিলোমিটারের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে আমাদের বর্তমান সময়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিপ্লবী আবদুল্লা অচালানের ‘ডেমোক্র্যাটিক কনফেডেরালিজম' বা ‘রাষ্ট্র বিহীন গণতন্ত্রের’ তত্ত্বের ভিত্তিতে রোজাভা গড়ে তুলেছে এক অভূতপূর্ব গণতন্ত্রের মডেল। আইসিস মানেই যখন
চরম পরধর্ম অসহিষ্ণুতা
তখন রোজাভা সব ধর্মের মানুষের জন্য
এক খোলা বাতাস। আইসিস মানেই যখন নারী গৃহবন্দী, বোরখা বন্দী, ইতিহাসবিহীন, রাজনীতি বিহীন এক সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র, ইসলামিক স্টেট’এ বিধর্মী হলে যখন
গণ ধর্ষণ আইনসম্মত, যৌনদাসী নিয়মানুগ তখন
রোজাভায় বাল্য বিবাহ, বহু বিবাহ এবং বলপূর্বক বিবাহ আইনত নিষিদ্ধ। আইসিস মানেই যখন চরম মধ্যযুগীয় পুরুষ আধিপত্য তখন রোজাভা প্রতিটি সংস্থায়, তা রাজনৈতিক পার্টিই হোক
বা মিউনিসিপ্যালিট,
৪০ শতাংশ নারী কোটা বাধ্যতামূলক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে ভেঙ্গে দিচ্ছে হাজারো বছরের পুরুষ প্রাধান্য। প্রতিটি সংস্থা রোজাভা পরিচালনা করছে যৌথ নেতৃত্বের ভিত্তিতে - কো-প্রেসিডেন্ট, কো-মেয়র, কো-চেয়ারম্যান - এক জন পুরুষ হলে
অন্যজন মহিলা হতে বাধ্য। মহিলারা অংশ নিচ্ছেন সমাজের সর্বক্ষেত্রে এমনকি যুদ্ধক্ষেত্রেও । বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় আমরা কিছুদিন যাবৎ যে সমস্ত মহিলা যোদ্ধাদের
ছবি দেখছি তারা সবাই এই রোজাভার মহিলা যোদ্ধাবাহিনী
YPJ'এর সদস্য ।
আইসিসের মাত্র
হাজার চারেক জিহাদিদের সামনে চারদিনের যুদ্ধের
অবশেষে প্রায় ৩০,০০০ ইরাকের সেনা অসংখ্য আধুনিক অস্ত্র সমেত ইরাকের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর ‘মসুল’ পরিত্যাগ করে পশ্চাৎ প্রদর্শন করে ২০১৪ সালের জুন মাসে । কিরকুক শহর আইসিস দখল করে প্রায় একই উপায়ে। আইসিস’এর বর্তমান রাজধানী রাককা
শহরের দখল আসে বিনা রক্তপাতে। ইরাকের সৈন্য বাহিনীর ফেলে যাওয়া এবং অসংখ্য আমেরিকান যুদ্ধাস্ত্র, তেলের চোরাই ব্যবসার অর্থস্রোত এবং বিপুল পরিমাণ ইরাক-সিরিয়ার ভূমি
দখল যখন আইসিসকে প্রায় অপ্রতিরোধ্য হিসাবে প্রতিষ্ঠা দিচ্ছে, ইসলামিক স্টেট তখন ২০১৪ সালের আগস্ট মাসে আক্রমণ করে ‘শিঞ্জার’ ইয়েযেদিদের বাসস্থান । এই ইয়েযেদিরা ইসলাম, খ্রিস্ট ধর্মের অনেক পূর্বের মেসোপটেমিয়ার প্রাচীন প্রথা এবং ধর্মের অনুগামী এক কুর্দ জনজাতি - আইসিস’এর মতে শয়তানের উপাসক
।
২০১৪ সালের আগস্ট মাস থেকে আইসিসের আক্রমণে এই ইয়েযেদিদের বাসস্থানে ঘটতে থাকে
বর্তমান সময়ের অন্যতম বৃহৎ গণহত্যা। প্রায় ৫০০০’এর ওপর নিরস্ত্র ইয়েযেদি জনজাতিকে(মূলত পুরুষ) পিছমোড়া করে হত্যা করা হয়। অসংখ্য ইয়েযেদি নারী গণ ধর্ষণ এবং আইসিসের বিদেশি জিহাদিদের যৌনদাসীতে পরিণত হয়। ইয়েযেদি শিশু, পুরুষ এবং মহিলাদের দাস হিসাবে বিক্রি করে দেওয়া হয় – এরা শয়তানের উপাসক
এই অন্ধ ধারণার যুক্তিতে। প্রাণ বাঁচাতে প্রায় ৫০,০০০’এর ওপর ইয়েযেদি পুরুষ, নারী, শিশু, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা আশ্রয় নেন রুক্ষ সিঞ্জার পাহাড়ের খাঁজে । সারা বিশ্বে নিন্দার ঝড়, বর্বরতার প্রতিবাদে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ ফেটে পরলেও বিশ্বের প্রধান নেতা গণ মিটিং করতে থাকেন যে কী উপায়ে এই গণহত্যা বন্ধ করা
যায় । অন্যদিকে ইয়েযেদি জনজাতি পাহাড়ে জল, খাদ্যের অভাবে যখন
মৃতপ্রায় তখন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আবদুল্লা অচালানের প্রতিষ্ঠিত পিকেকে'র মহিলা
এবং পুরুষ গেরিলা বাহিনী, মাইন সরিয়ে, মর্টার এড়িয়ে, আইসিস’এর থেকে জমি দখল
করে তৈরি করে এক নিরাপদ রাস্তা। সিঞ্জার পাহাড়ে আটকে
পরা হাজারে হাজারে শয়তানের উপাসক ইয়েযেদিদের উদ্ধারকর্ম চালাতে থাকে পিকেকে'র গেরিলা
বাহিনী। ২৪ ঘণ্টা পায়ে হেঁটে
৫০,০০০ হাজারের ওপর অসহায় নিরস্ত্র সন্ত্রস্ত ইয়েযেদি পিকেকে'র গেরিলা
বাহিনীর নিরাপত্তায় অবশেষে পৌঁছন রোজাভার ‘নিউ রোজ’ উদ্বাস্তু শিবিরে। রোজাভা যেহেতু ইউনাইটেড নেশান
স্বীকৃত রাষ্ট্র নয় তাই মানবতা রয়ে
যায় লিপ সার্ভিস হিসাবে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উদ্ধারকৃত ইয়েযেদিদের নিরাপদ আশ্রয় ‘নিউ রোজ’ উদ্ভাস্তু শিবির তাই না পায় কোনও আন্তর্জাতিক সাহায্য না কোনও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অথচ ইসলামিক স্টেটকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার কি অদম্য প্রতিজ্ঞা। ইয়েযেদিদের ওপর আইসিস’এর বর্বরতার বিষয়ে কি অসাধারণ কুম্ভীরাশ্রু !
রোজাভার গণতান্ত্রিক মডেল, নারী স্বাধীনতা, সর্বধর্ম, জাতি এবং সংস্কৃতির স্বীকৃতি আইসিস’এর মধ্যযুগীয় তত্ত্বের অ্যান্টিডোট, সাথে রোজাভা নিয়ে তুরস্কের বেড়ে চলা অস্বস্তিজনিত পরোক্ষ আইসিস সমর্থন এবং বিরোধীদের গুঁড়িয়ে দেওয়ার প্রবণতা থেকে উদ্ভূত অনুপ্রেরণায় অবশেষে সেপ্টেম্বের ২০১৪ সালে আইসিস আক্রমণ করে রোজাভা বিপ্লবের সূতিকাগার ‘কোবানে’।
বাগদাদ বার্লিন পুরনো রেলপথের অন্যতম প্রধান রেল স্টেশন কোবানে একদম তুরস্কের সীমানা ঘেঁষা প্রায় ৩-৪ লাখ
অধিবাসীর এক ঐতিহাসিক শহর । তিন দিক থেকে আক্রমণ এবং ট্যাঙ্ক, কামান এবং আধুনিক যুদ্ধাস্ত্রের বলে আইসিস মাত্র ৫ দিনের মধ্যে দখল
করে নেয় কোবানের গ্রামাঞ্চলের ৮০ শতাংশ অঞ্চল । তুরস্ক সীমান্তে দাঁড়িয়ে মজা দেখতে থাকে, পৃথিবীর বৃহৎ দেশগুলি কোবানে পতনের সময় গুনতে থাকে অন্যদিকে রচিত হতে থাকে এক অসাধারণ প্রতিরোধের ইতিহাস। আমাদের সময়ের স্টালিনগ্রাড- ১৩৫ দিনের কোবানে অবরোধ, লাখো উদ্বাস্তু, হাজার শহীদ, ৯০
শতাংশ
ইনফ্রাস্ট্রাকচার ধ্বংস, বুবি ট্র্যাপ, মাইন সমস্ত প্রয়াস স্বত্বেও আইসিস এই
প্রথম মধ্যপ্রাচ্যে পরাজিত হয় এক গণতান্ত্রিক শক্তির অদম্য
জেদ এবং প্রতিজ্ঞার কাছে ।
স্টালিনগ্রাড যেমন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিক পরিবর্তনের অন্যতম প্রধান কারণ, ঠিক তেমনই কোবানের অসাধারণ প্রতিরোধের ইতিহাস আইসিসের বর্বরতার অবসানের অন্যতম প্রধান কারণ হিসাবে ইতিহাস অবশ্যই মনে রাখবে। জানুয়ারি ২০১৫ সালে ১৩৫ দিনের অবরোধের অবশেষে রোজাভার বিপ্লবীরা কোবানে মুক্ত করেন এবং সেই দিন থেকে প্রত্যহ আইসিস পরাজিত হতে থাকে এই
বিপ্লবীদের হাতে। সম্প্রতি প্যারিস আক্রমণের দিনেই ইসলামিক স্টেট’এর হাত থেকে ১৪
মাস পরে মুক্ত হয়
সিঞ্জার-ইয়েযেদিদের বাসভূমি । রোজাভার বিপ্লবীরা বর্তমানে পৌঁছে গেছেন আইসিসের রাজধানী রাককা শহরের তিরিশ কিলোমিটার পরিধিতে। সম্ভবত এই শীতকালেই রাককা আইসিস
মুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা ।
রোজাভা আমাদের
সময়ে ঘটে চলা এক অভূতপূর্ব গণতান্ত্রিক এবং সামাজিক
পরীক্ষা। নারী স্বাধীনতার সফল আন্দোলন, সকল ধর্মের, জনজাতির শান্তির বাসস্থান । আত্মনির্ভর পুঁজিবাদ বিরোধী
অর্থনৈতিক মডেল এবং বৈকল্পিক শিক্ষা ব্যবস্থার প্রয়োগশালা। এই যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতেও রোজাভা সংগঠিত
করছে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন, প্রতিষ্ঠা করছে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে ছাত্রের
কোনও বয়সের বাধ্যবাধকতা নেই। কারণ, রোজাভার মতে
শিক্ষায় সকলের অধিকার ।
আমাদের সামনে
মৌলবাদ, সন্ত্রাসবাদ এবং বর্বরতা বিরোধী সফল, সবল এবং গণতান্ত্রিক মডেল বর্তমান। অথচ বিশ্ব উদাসীন। আশ্চর্যজনক ভাবে বামপন্থী বুদ্ধিজীবীকুল বালির মধ্যে মুখ গুঁজে উটপাখি। সম্প্রতি রোজাভা ঘুরে এসেছেন ইউরোপের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩০ জনের এক
প্রতিনিধিমণ্ডলী এবং তাদের মধ্যে ডেভিড গেওয়ার ‘গার্ডিয়ান’এ প্রকাশিত
এক প্রবন্ধে লিখেছেনঃ 'The autonomous
region of Rojava, as it exists today, is one of few bright spots – albeit a
very bright one…… Is the world and
this time most scandalously of all, the international left – really going to be
complicit in letting history repeat itself?'
যদি আমরা
আদৌ মৌলবাদ সমস্যার প্রকৃত সমাধান চাই, মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি এবং গণতন্ত্র কামনা করি তাহলে রোজাভা এবং তার অভূতপূর্ব গণতন্ত্রের মডেল আমাদের সবল এবং সচেতন সমর্থনের দাবি রাখে।
অসাধারণ ঘটনা।
ReplyDeleteদেবব্রত ভীষণ ভাল লিখেছেন।
অনিন্দ্য, এটাকে সামনের সংখ্যায় একটা লীড স্টোরি করুন। কেউ কিচ্ছু জানি না আমরা এব্যাপারে।
agami sonkhyar lekhapottor jogar o composing sesh.. amader march sonkhyar procchod bishoy 'dhormer rajniti' - sekhane ei bishoye Debabrata boro ekta likhbe kotha hoyeche..
ReplyDeleteBesh bhalo
ReplyDeleteThanks.. Ekak Matra'r March sonkhay e bisoye bistarito lekha thakbe..
ReplyDeleteঅনবদ্য লেখা। রোজাভা সম্পর্কে কোন ধারনাই ছিল না। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
ReplyDeleteDhonnyobad lekhatar jonnyo
ReplyDeleteভাসা ভাসা শুনেছিলাম, অনেকটা স্পষ্ট হল।
ReplyDeleteঅসাধারণ লেখা।আরো বিশদে জানতে চাই।
ReplyDeleteআরও বিশদে 'একক মাত্রা'র 'ধর্মের রাজনীতি' সংখ্যায় আছে।
ReplyDelete