একটি সেক্সিস্ট ও এপলজিস্ট লেখা
পল্লবী বন্দ্যোপাধ্যায়
বছর দুয়েক হল রাতের ট্রেনে মহিলা
কামরায় পুলিশ দেওয়া হচ্ছে। তার আগেকার ছবির সামান্য বর্ণনা দেওয়া যাক।
রাত
সাড়ে নটার আপ গেদে লোকাল শিয়ালদহ থেকে ছাড়ে। স্বাভাবিকভাবেই মহিলা কামরা
বেশ ফাঁকা। অনেক সিট খালি। সাধারণ কামরাগুলোও ফাঁকা, সেখানেও কিছু সিট খালি। ট্রেন ছাড়ে। গড়িয়ে গড়িয়ে বিধাননগর ষ্টেশনে ঢোকামাত্র মহিলা যাত্রীরা মহিলা কামরায় ওঠার পরই তাদের পেছন পেছন এক দঙ্গল পুরুষ যাত্রী উঠে
পড়ে। খালি সিট দখল করে বসে বিড়ি ধরিয়ে খৈনি ডলতে ডলতে তাসের জুয়ার আসর
বসায়। এই যাত্রীদের মধ্যে মাড়োয়াড়ি গদির কর্মচারি আছে, সব্জি-ফল বিক্রেতা
আছে, আবার কিছু সাদা কলারের বাবুও আছে। এমনিতে এরা কেউই মহিলা যাত্রীদের
হেনস্তা করে না। কিন্তু কখনো কোনও মহিলা তাদের মহিলা কামরায় ওঠার প্রতিবাদ
করলে, বেশ বুক চিতিয়ে গলা ফাটিয়ে তারা জানিয়ে দেয় যে তারা প্রতিদিনই এমনটা
করেই অভ্যস্ত এবং কোনও মহিলার অসুবিধে হলে নেমে যেতে পারেন অথবা 'যা পারেন
করে' নিতে পারেন। সাধারণ কামরা রাতে বেশ ফাঁকা থাকা সত্ত্বেও এমনটা করার
কারণ কী জানতে চাইলে তারা অম্লানবদনে বলে, সাধারণ কামরা ফাঁকা থাকলেও
যেহেতু সেখানে সিট পাওয়ার নিশ্চয়তা নেই, তাই তারা মহিলা কামরায় ওঠে।
এরপর
শিয়ালদহ মেইন শাখার পরিস্থিতি কিছুটা পাল্টেছে। রাত নটার পর সমস্ত আপ
ট্রেনে পুলিশ থাকছে, অতএব পুরুষ যাত্রীরা আর কেউই ওঠার রিস্ক নেয় না।
মাতৃভূমি লোকাল চালু হবার পর মহিলা যাত্রীদের সুখের ভাগ বাড়ে। জুলজুল করে
তাকিয়ে থাকা পুরুষদের সামনে দিয়ে মহিলাদের নিয়ে হুশ করে বেরিয়ে যায় লেডিজ
স্পেশাল ট্রেন। প্রথমে লেডিজ স্পেশালের ভেন্ডর কামরায় ছেলেদের ওঠার অনুমতি
থাকলেও পরে তাও বন্ধ কর দেয় রেল কর্তৃপক্ষ। লেডিজ স্পেশাল নিয়েও বিতর্ক চলতে
থাকে। বিকেল পাঁচটা পাঁচের আপ মাতৃভূমি লোকাল শিয়ালদহ থেকে বস্তুত
খালিই ছাড়ে। মহিলা যাত্রীরাও মনে করেন এমন বাজে সময়ে লেডিজ স্পেশাল দেওয়া সম্পদের অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়। অথচ এর পরে আর লাইন এবং ষ্টেশন লেডিজ
স্পেশালের জন্য খালি করা সম্ভব নয়। এর পরের লেডিজ স্পেশাল ছাড়ে বিকেল পাঁচটা পঞ্চাশ - শিয়ালদহ মেইন শাখার শেষ আপ লেডিজ স্পেশাল ট্রেন। এর পরের
ট্রেনগুলোয় নারীপুরুষ নির্বিশেষে বাদুড় ঝুলে যাতায়াত।
এদিকে
ট্রেন চলাচলের গোটা ব্যাপারটাকে খুব দক্ষভাবে একটা প্রহসনের পর্যায় নিয়ে
যেতে পেরেছে রেল কর্তৃপক্ষ। প্রতিদিন প্রত্যেকটা ট্রেনই তার নির্ধারিত
সময়ের চেয়ে বেশ খানিকটা দেরিতে চলে। সামান্য ঝড়জল হলেই কোথাও জল জমে কোথাও
গাছ পড়ে বন্ধ হয়ে ট্রেন চলাচল। ছুতোয়নাতায় অবরোধ, ট্রেনে গুন্ডাদের
মারামারির জেরে বোমাবাজি, বিষধর সাপের কামড়ে যাত্রীর আহত হওয়া, এসব তো
আছেই। স্বাভাবিকভাবেই তাই রেলের ওপর বিন্দুমাত্র ভরসা করার সুযোগ রেল
পুরুষ-মহিলা কোনও যাত্রীকেই দিয়ে উঠতে পারেনি। আর তাই, যেই জানানো হলো
লেডিজ স্পেশালের কিছু কামরায় পুরুষদের ওঠার সুযোগ দেওয়া হবে, মহিলা যাত্রীরা ক্ষেপে গেলেন। অথচ যদি ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখি, একটা ন' কামরা
ট্রেনের প্রথম অথবা শেষ দুটো কামরা যদি পুরুষদের জন্য খুলে দেওয়া হয় এবং
বাকি প্রতিটা কামরায় পুলিশ মোতায়েন করা হয়, কোনও পুরুষ যাত্রী আর মহিলা
কামরায় ওঠার সাহস দেখাতে পারবে না। ঘটনার আকস্মিকতায় মহিলা যাত্রীরা না
পেরেছেন তলিয়ে ভাবতে, না পেরেছেন রেলের ওপর ভরসা করতে। তাই এই বিবৃতি শুনেই
তাদের মনে হয়েছে, এবারে মাতৃভূমি লোকাল বুঝি পুরুষদেরই দখলে চলে গেল। এছাড়া
প্রিভিলেজড ক্লাস যে কখনওই তা চট করে ছাড়তে রাজি হয় না এ তো জানা কথাই।
এত
ঘটা করে খবরের কাগজে বিজ্ঞপ্তি না দিয়ে রেল যদি এই ঘোষণা ষ্টেশনের মাইকে
ট্রেন ছাড়ার কিছু আগে করত, এত বড় ঝামেলা এড়ানো যেত। কিছুদিন জল মেপে নিয়ে
তারপর না হয় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানানো যেত। বাস্তবের সঙ্গে ক্ষীণ যোগাযোগ এবং
প্রশাসনিক হঠকারিতার কারণেই মাতৃভূমি লোকাল নিয়ে অহেতুক খানিক তিক্ততা তৈরি হল, যার রেশ পুরুষ-নারীর সম অধিকারের লড়াইকেও বেশ কয়েক পা পিছিয়ে দিতে
সক্ষম।
No comments:
Post a Comment