সমপ্রেম অপরাধ ?
হিন্দোল ভট্টাচার্য
কী অদ্ভুত এক রায় দিয়েছে সুপ্রীম কোর্ট। বলে কিনা- প্রাকৃতিক নিয়ম বিরোধী যে কোনো সম্পর্কই অপরাধ ! আর সেই সুবাদে সমকামিতাও অপরাধ। অর্থাৎ, কোনও দুজন মানুষ একে অপরকে ভালবাসবে তা ঠিক করে দেবে রাষ্ট্র! আমাদের দেশ কি এখনো অস্কার ওয়াইল্ড-এর সময়ে পড়ে আছে? আমার কিছু প্রশ্ন আছে। এই ভারতবর্ষ তো প্রকৃতিকে তাহলে খুব প্রাধান্য দেয় দেখছি। তাহলে নির্বিচারে প্রকৃতিকে ধ্বংস করে কেন? কেন নর্মদায় বাঁধ দেওয়া হয়? কেন তেহরিতে বাঁধ দেওয়া হয়? কেন অরণ্য ধ্বংস করা হয়? পুকুর বুজিয়ে বাড়ি ওঠে? জমি অধিগ্রহণ করে জমির উর্বরতা নষ্ট করা হয়? এমন কিছু কারখানা বজায় থাকে যা বায়ু দূষণ করে, জল দূষণ করে? প্রাকৃতিক সাম্য নষ্ট করে? আর তার বিরুদ্ধে আন্দোলনগুলিকেও দমিয়ে রাখা হয়? এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর সুপ্রীম কোর্ট দেবেন কি? মনে হয় না।
এবার আসা যাক সম্পর্কের ক্ষেত্রে। ভারতবর্ষ নাকি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র যেখানে সাম্য মৈত্রী ও স্বাধীনতায় মূল মন্ত্র। বুঝলাম। তো এই সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতা কাদের নিয়ে? জনগণকে নিয়ে। নিশ্চই ভারতের কতিপয় ক্ষমতালোভী রাজনীতিবিদ এবং আইনবিদদের নিয়ে নয়। অর্থাৎ ক্ষমতাকাঠামোকে নিয়ে নিশ্চই গণতন্ত্র নয়। তাদের জন্য একমাত্র মৌলিক অধিকার থাকবে আর জনগনের কোনো মৌলিক অধিকার থাকবে না এ কথা নিশ্চই কোথাও বলা নেই। কিংবা এ কথা হয়ত ভারতবর্ষের সংবিধানের অলিখিত নিয়মগুলির মধ্যে পড়ে। আমরা তা জানি না। মনে করি আমরা এক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বসবাস করি যেখানে সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার সত্যি কোনো মানে আছে।
কিন্তু হায়! তা যে নেই, সে বিষয়ে ভারতের জনগণ আর কত প্রমাণ পাবেন কে জানে? এই রায় একটা উদাহরণ, যার কারণে সমপ্রেমী যারা, তাদের যেমন মাথার চুল খাড়া হয়ে যেতে বাধ্য, তেমন যারা সমপ্রেমী নন, তাদেরও খুব স্বস্তিতে থাকার কারণ নেই। কারণ এই রায় স্পষ্ট বলছে ব্যাক্তির কোনো স্বাধীনতা নেই এই দেশে। একজন ব্যাক্তি কী পরবেন, কী পড়বেন, কাকে ভালবাসবেন, কার সঙ্গে যৌন সম্পর্ক করবেন, কার সঙ্গে করবেন না, সে সব ঠিক করবে আমাদের দেশের বৃহৎ গণতন্ত্র। ঠিক করে দেবে বিভিন্ন ধর্মের মুখপত্ররা, রাজনীতিবিদেরা, শাসকেরা, আইনপ্রণেতারা এবং বিচারকেরা। কিন্তু কেন?
ভারতীয় সংবিধানের প্রিয়াম্ব্ল এবং সেই সংবিধানকে আশ্রয় করে গড়ে ওঠা এই ৩৭৭ ধারা আইন তো পরস্পর বিরোধী। প্রথমত প্রাকৃতিক নিয়মকে সম্পূর্ণ ভাবে বুঝতে পারার এক তীব্র অহমিকা রয়েছে এই রায়ে। 'বিষম'-টাই সত্য এবং 'সম'-টা সত্য নয় এবং প্রাকৃতিক নয় এই সত্যে কীভাবে তারা এলেন জানিনা। দ্বিতীয়ত, ব্যাক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে তারা ব্যাক্তির মৌলিক অধিকারকে খণ্ডন করছেন যা ভারতীয় সংবিধান বিরোধী। তৃতীয়ত, ব্যাক্তির ব্যাক্তিগত জীবনকে রাষ্ট্র যখন নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে, তবে কি গণতন্ত্র বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব আদৌ থাকে? না কি তা স্বৈরতন্ত্রে পর্যবসিত হয়ে যায়? তাহলে কি এই ইসুতে এটা প্রমানিত হলো না, যে এই দেশে সংবিধানের মৌলিক অধিকারের নাম করে সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার নাম করে এক চরম অসাম্য, চরম অমৈত্রী এবং চরম পরাধীন এক 'শাসক-তন্ত্র' চলছে? যার সঙ্গে গণতন্ত্রের দূরত্বই আছে?
প্রায় দেড়শ বছর আগে দি পিকচার অফ ডোরিয়ান গ্রে লেখার অপরাধে অস্কার ওয়াইল্ডকে কারারুদ্ধ করা হয়েছিল এবং সমপ্রেমী হওয়ার অপরাধে অস্কার ওয়াইল্ড-এর মৃত্যও হয়। কিন্তু সে সব দেশে সমপ্রেম নিষিদ্ধ নয়। প্রাকৃতিক নিয়মের বিরুদ্ধও নয়। প্রাকৃতিক নিয়ম তো এই দেশে এক, ওই দেশে আরেক হতে পারে না। প্রাকৃতিক নিয়ম যখন বলছি, তখন তা সর্বজনীন। ইউনিভার্সাল। আজ নিউটন-এর ল তো ভারতে এক বা ইংল্যান্ড-এ এক হতে পারে না। কিংবা জেনারেল থিওরি অফ রিলেটিভিটি ভারতে এক বা জার্মানিতে আরেক! তার মানে প্রাকৃতিক নিয়ম সারা বিশ্বে এক। একমাত্র ভারতের শাসক বা বিচারব্যবস্থা প্রাকৃতিক নিয়মের সত্যতা সম্পর্কে নি:সন্দেহ এবং বাকি পৃথিবী ভুল পথে চলছে এই ভাবনা কি চরম অহমিকা নয়? এই অহমিকা কার বা কাদের? এই অহমিকা ভারতীয় শাসক-তন্ত্রের। এই অহমিকার কোনো বিজ্ঞান নেই। এই প্রাকৃতিক নিয়ম সংক্রান্ত নিদানেরও কোনো বিশ্বজনীনতা নেই। তাহলে প্রাকৃতিক নিয়মের নাম করে স্বৈরতান্ত্রিক নিদান দেবার অধিকার কে দিল সুপ্রীম কোর্টকে?
এই রায় আসলে আমাদের দেশে গণতন্ত্র আছে কিনা সে বিষয়েই আবার নতুন করে প্রশ্নচিহ্ন তুলে দিল।
প্রাকৃতিক নিয়মেই সমপ্রেমীরা অপরাধী নয়।
হিন্দোল ভট্টাচার্য
কী অদ্ভুত এক রায় দিয়েছে সুপ্রীম কোর্ট। বলে কিনা- প্রাকৃতিক নিয়ম বিরোধী যে কোনো সম্পর্কই অপরাধ ! আর সেই সুবাদে সমকামিতাও অপরাধ। অর্থাৎ, কোনও দুজন মানুষ একে অপরকে ভালবাসবে তা ঠিক করে দেবে রাষ্ট্র! আমাদের দেশ কি এখনো অস্কার ওয়াইল্ড-এর সময়ে পড়ে আছে? আমার কিছু প্রশ্ন আছে। এই ভারতবর্ষ তো প্রকৃতিকে তাহলে খুব প্রাধান্য দেয় দেখছি। তাহলে নির্বিচারে প্রকৃতিকে ধ্বংস করে কেন? কেন নর্মদায় বাঁধ দেওয়া হয়? কেন তেহরিতে বাঁধ দেওয়া হয়? কেন অরণ্য ধ্বংস করা হয়? পুকুর বুজিয়ে বাড়ি ওঠে? জমি অধিগ্রহণ করে জমির উর্বরতা নষ্ট করা হয়? এমন কিছু কারখানা বজায় থাকে যা বায়ু দূষণ করে, জল দূষণ করে? প্রাকৃতিক সাম্য নষ্ট করে? আর তার বিরুদ্ধে আন্দোলনগুলিকেও দমিয়ে রাখা হয়? এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর সুপ্রীম কোর্ট দেবেন কি? মনে হয় না।
এবার আসা যাক সম্পর্কের ক্ষেত্রে। ভারতবর্ষ নাকি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র যেখানে সাম্য মৈত্রী ও স্বাধীনতায় মূল মন্ত্র। বুঝলাম। তো এই সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতা কাদের নিয়ে? জনগণকে নিয়ে। নিশ্চই ভারতের কতিপয় ক্ষমতালোভী রাজনীতিবিদ এবং আইনবিদদের নিয়ে নয়। অর্থাৎ ক্ষমতাকাঠামোকে নিয়ে নিশ্চই গণতন্ত্র নয়। তাদের জন্য একমাত্র মৌলিক অধিকার থাকবে আর জনগনের কোনো মৌলিক অধিকার থাকবে না এ কথা নিশ্চই কোথাও বলা নেই। কিংবা এ কথা হয়ত ভারতবর্ষের সংবিধানের অলিখিত নিয়মগুলির মধ্যে পড়ে। আমরা তা জানি না। মনে করি আমরা এক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বসবাস করি যেখানে সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার সত্যি কোনো মানে আছে।
কিন্তু হায়! তা যে নেই, সে বিষয়ে ভারতের জনগণ আর কত প্রমাণ পাবেন কে জানে? এই রায় একটা উদাহরণ, যার কারণে সমপ্রেমী যারা, তাদের যেমন মাথার চুল খাড়া হয়ে যেতে বাধ্য, তেমন যারা সমপ্রেমী নন, তাদেরও খুব স্বস্তিতে থাকার কারণ নেই। কারণ এই রায় স্পষ্ট বলছে ব্যাক্তির কোনো স্বাধীনতা নেই এই দেশে। একজন ব্যাক্তি কী পরবেন, কী পড়বেন, কাকে ভালবাসবেন, কার সঙ্গে যৌন সম্পর্ক করবেন, কার সঙ্গে করবেন না, সে সব ঠিক করবে আমাদের দেশের বৃহৎ গণতন্ত্র। ঠিক করে দেবে বিভিন্ন ধর্মের মুখপত্ররা, রাজনীতিবিদেরা, শাসকেরা, আইনপ্রণেতারা এবং বিচারকেরা। কিন্তু কেন?
ভারতীয় সংবিধানের প্রিয়াম্ব্ল এবং সেই সংবিধানকে আশ্রয় করে গড়ে ওঠা এই ৩৭৭ ধারা আইন তো পরস্পর বিরোধী। প্রথমত প্রাকৃতিক নিয়মকে সম্পূর্ণ ভাবে বুঝতে পারার এক তীব্র অহমিকা রয়েছে এই রায়ে। 'বিষম'-টাই সত্য এবং 'সম'-টা সত্য নয় এবং প্রাকৃতিক নয় এই সত্যে কীভাবে তারা এলেন জানিনা। দ্বিতীয়ত, ব্যাক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে তারা ব্যাক্তির মৌলিক অধিকারকে খণ্ডন করছেন যা ভারতীয় সংবিধান বিরোধী। তৃতীয়ত, ব্যাক্তির ব্যাক্তিগত জীবনকে রাষ্ট্র যখন নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে, তবে কি গণতন্ত্র বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব আদৌ থাকে? না কি তা স্বৈরতন্ত্রে পর্যবসিত হয়ে যায়? তাহলে কি এই ইসুতে এটা প্রমানিত হলো না, যে এই দেশে সংবিধানের মৌলিক অধিকারের নাম করে সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার নাম করে এক চরম অসাম্য, চরম অমৈত্রী এবং চরম পরাধীন এক 'শাসক-তন্ত্র' চলছে? যার সঙ্গে গণতন্ত্রের দূরত্বই আছে?
প্রায় দেড়শ বছর আগে দি পিকচার অফ ডোরিয়ান গ্রে লেখার অপরাধে অস্কার ওয়াইল্ডকে কারারুদ্ধ করা হয়েছিল এবং সমপ্রেমী হওয়ার অপরাধে অস্কার ওয়াইল্ড-এর মৃত্যও হয়। কিন্তু সে সব দেশে সমপ্রেম নিষিদ্ধ নয়। প্রাকৃতিক নিয়মের বিরুদ্ধও নয়। প্রাকৃতিক নিয়ম তো এই দেশে এক, ওই দেশে আরেক হতে পারে না। প্রাকৃতিক নিয়ম যখন বলছি, তখন তা সর্বজনীন। ইউনিভার্সাল। আজ নিউটন-এর ল তো ভারতে এক বা ইংল্যান্ড-এ এক হতে পারে না। কিংবা জেনারেল থিওরি অফ রিলেটিভিটি ভারতে এক বা জার্মানিতে আরেক! তার মানে প্রাকৃতিক নিয়ম সারা বিশ্বে এক। একমাত্র ভারতের শাসক বা বিচারব্যবস্থা প্রাকৃতিক নিয়মের সত্যতা সম্পর্কে নি:সন্দেহ এবং বাকি পৃথিবী ভুল পথে চলছে এই ভাবনা কি চরম অহমিকা নয়? এই অহমিকা কার বা কাদের? এই অহমিকা ভারতীয় শাসক-তন্ত্রের। এই অহমিকার কোনো বিজ্ঞান নেই। এই প্রাকৃতিক নিয়ম সংক্রান্ত নিদানেরও কোনো বিশ্বজনীনতা নেই। তাহলে প্রাকৃতিক নিয়মের নাম করে স্বৈরতান্ত্রিক নিদান দেবার অধিকার কে দিল সুপ্রীম কোর্টকে?
এই রায় আসলে আমাদের দেশে গণতন্ত্র আছে কিনা সে বিষয়েই আবার নতুন করে প্রশ্নচিহ্ন তুলে দিল।
প্রাকৃতিক নিয়মেই সমপ্রেমীরা অপরাধী নয়।
No comments:
Post a Comment