স্কুল প্রাঙ্গণ ও ছাত্র-ছাত্রীরা
সঞ্জয় পাঠক
যে বিষয়টিকে সুকৌশলে চেপে দেওয়া হল-
গত ১২ সেপ্টেম্বর দমদমের ক্রাইস্ট চার্চ গার্লস হাইস্কুলের পঞ্চম শ্রেণীর
ছাত্রী ঐন্দ্রিলার মর্মান্তিক মৃত্যুর প্রক্ষিতে ঐ স্কুলের প্রায় সব
অভিভাবক ও ছাত্রীরা স্কুল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে তাঁদের দীর্ঘদিনের
পুঞ্জিভূত ক্ষোভ উগড়ে দিয়েছিলেন। কিছু অভিভাবক তাঁদের অনিয়ন্ত্রিত ক্ষোভে ঐ
স্কুলের বেশ কিছু জিনিষপত্র ভাঙচুর করেন। বৈদ্যুতিন মাধ্যমে দেখা গেছে,
অধ্যক্ষা ক্ষমা চাইলেও, অভিভাবক ও ছাত্রীরা ছিলেন অনড়। তাঁদের দাবী ছিল,
অধ্যক্ষাকে পদত্যাগ করতে হবে এবং গ্রেপ্তার করতে হবে। ।এমন কি ক্ষোভে কেউ
কেউ অধ্যক্ষাকে জুতোও দেখিয়েছেন। এরপর অধ্যক্ষাকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে ও
তিনদিন পর তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়। স্কুল ভাঙচুরের অপরাধে ইতিমধ্যে ১৪ জনকে
গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এরপর ওয়েস্ট বেঙ্গল এসোসিয়েশন অফ ক্রিশ্চিয়ান স্কুলের
পক্ষে আর্চবিশপ ঘোষণা করেন, পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত ক্রিশ্চিয়ান স্কুল, কলেজ
এবং সমস্ত আইসিএসই স্কুল (প্রায় ১৫০০ স্কুল প্রতিষ্ঠান) এই ভাঙচুর ও
পুলিশি নিষ্কৃয়তার প্রতিবাদে আগামী ১৯শে সেপ্টেম্বর বন্ধ থাকবে – তাঁরা ঐ
দিন কালা দিবস পালন করবেন। এই পর্যন্ত খবরটি প্রায় সমস্ত মানুষই ইতিমধ্যে
বৈদ্যুতিন ও সংবাদমাধ্যমে জেনেছেন।
কিন্তু যে বিষয়টি এই ঘটনাটিকে
কেন্দ্র করে সামনে আসতে পারত, তাকে অত্যন্ত সুকৌশলে এড়িয়ে যাওয়া হল।
বিষয়টি কী ? তা হল, এই বেসরকারী স্কুলগুলির যথেচ্চাচার। স্কুলের পরিকাঠামো
থেকে শুরু করে, শিক্ষকদের বেতন কাঠামো, ছাত্র/ছাত্রীদের প্রদেয় বিপুল বেতন
সহ আরোপিত শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে এক তুঘলকি ব্যবস্থা যা দেশের প্রতিষ্ঠিত আইনকে
মর্যাদা তো দেয়ইনা, বিপরীতে এদের তৈরী আইনকে মান্যতা দেওয়ার বাতাবরণ তৈরী
করেছে দীর্ঘ সময় ধরে। এই অব্যবস্থার বিরুদ্ধে না সরকার পক্ষ, না স্কুল
কর্তৃপক্ষ টু শব্দটি করেনি। বিপরীতে ভাঙচুরের ঘটনাটিকে প্রাধান্য দিয়ে,
প্রচার মাধ্যমে চাউড় করিয়ে দেওয়া হল অমোঘ এক বার্তা – ‘ভাঙচুরকে কোন ভাবেই
বরদাস্ত করা হবে না, একে শক্ত হাতে মোকাবিলা করা হবে।’ অথচ অভিভাবক ও
ছাত্রীরা তীব্র ক্ষোভে কেন ফুঁসে উঠলেন, কেন বিক্ষোভ দেখালেন, তার মূলটি
কোথায় প্রোথিত – এই গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক, অর্থনৈতিক প্রশ্নটিকে সুচতুর
কৌশলে আপাতত ঠান্ডাঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হল।
ঘটনার দিন বৈদ্যুতিন ও সংবাদমাধ্যমের সূত্রে ঐ স্কুলের কয়েকজন অভিভাবক ও ছাত্রীদের স্কুল কর্তৃপক্ষের
বিরুদ্ধে ক্ষোভের বহি:প্রকাশ ঘটেছিল। তা ছিল, কর্তৃপক্ষের দুর্ব্যবহার ও
যে কোনও অজুহাতে অভিভাবকদের কাছ থেকে টাকা-পয়সা আদায় করা নিয়ে। আগেই বলেছি,
‘অভিভাবক ও ছাত্রীরা স্কুল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে তাঁদের দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ উগড়ে দিয়েছিলেন’। হ্যাঁ, ঠিক এটাই এখানে ঘটেছিল বলেই মনে
হয়। ঐন্দ্রিলার মর্মান্তিক মৃত্যু একটি উপলক্ষ মাত্র, যা অনুঘটক হিসেবে কাজ
ক’রে, দীর্ঘদিনের জমে থাকা ক্ষোভ ও ঘৃণাকে উস্কে দিয়ে প্রায় প্রলয়ের আকার
ধারণ করেছিল। স্কুল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে এটি ছিল একটি স্বত:স্ফুর্ত
আন্দোলন। অভিভাবক ও ছাত্রীদের কোন সংগঠন না থাকার কারণে তাৎক্ষণিক বিচারে
যে যেমন ভেবেছেন, তেমনই ভূমিকা রেখেছিলেন।
বিগত প্রায় ১৫ বছর ধরে
সরকারী পে-কমিশন লাগু করার প্রেক্ষিতে এইসব স্কুলগুলি গোটা দেশ জুড়ে
স্কুল-ফি বাড়িয়েছে ৪০০ থেকে ৫০০ শতাংশ। অথচ নিয়ম অনুযায়ী, পে-কমিশন লাগু
করার প্রেক্ষিতে সর্ব্বোচ্চ ৫০ শতাংশ স্কুল-ফি একটি মাত্র বছরে বাড়ান যেতে
পারে। এই আইনকে কলা দেখিয়ে প্রায় সব স্কুলই এই সুযোগে প্রতি বছর উচ্চ হারে
স্কুল-ফি বাড়িয়ে অভিভাবকদের ঘারে চাপ বাড়াচ্ছে ক্রমাগত।
বিভিন্ন
অজুহাতে অভিভাবকদের পকেট কাটা এই স্কুলগুলি একটা নিয়মে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
যেমন, এডমিশন ফি, সিকিউরিটি ডিপোসিট, বিল্ডিং ফান্ড, স্কুল এসেনশিয়ালস,
এক্টিভিটি এন্ড হবি ফিস, মেনটেনেন্স চার্জ, অডিও-ভিসুয়াল ফিস, কম্পিউটার
ল্যাব ফিস, সায়েন্স ল্যাব ফিস, স্কুল ফান্ড, এন্যুয়াল ডে চার্জ, ম্যাগাজিন
ফিস, এন্যুয়াল কনসার্ট ফিস, স্পোর্টস ফিস, চিলড্রেন ডে সেলিব্রেশন ফিস,
টিচার্স ডে সেলিব্রেশন ফিস, পিকনিক, ট্রান্সপোর্ট ফিস ইত্যাদির নামে লক্ষ
লক্ষ টাকা প্রতিবছর এইসব নামী-বেনামী বদ স্কুলগুলি অভিবাবকদের কাছ থেকে
আঁখ-মাড়াই কলের মত নিংড়ে নিচ্ছে । আমি জানি কোন কোন স্কুল নার্সারী লেভেলে
নিচ্ছে ১৫ লাখ টাকা। শুধু কি তাই, এরা অভিবাবকদের কাছে বাধ্যতামূলক করেছে
বই, খাতা, খাতা-বইয়ের মলাট, ইউনিফর্ম(গরম ও শীতের ভিন্ন), সব ধরণের
স্টেশনারি স্কুল থেকেই কিনতে হবে যা বাজার থেকে অন্তত তিনগুণ বেশী দাম
।স্কুলের বার্ষিক অনুষ্ঠান হবে, তারজন্য ঝাঁ-চকচকে পোষাক লাগবে, কে দেবে ?
কেন বলির পাঁঠা অভিভাবক। স্পোর্টসে কালার ফুল টি সার্ট পড়তে হবে, কে দেবে?
কেন ছাত্র/ছাত্রীর বাপ। এসবই ঘটছে সরকারের নাকের ডগায়।
আমার এক ছাত্র
এক সময় আমাকে বলেছিল, “স্যার, একটা স্কুল চালানো মানে সমান্তরাল ভাবে একই
সাথে ৫-৬টি ব্যবসা চালানো। যেমন, বাস থাকলে ট্রান্সপোর্ট বিসনেস, ক্যান্টিন
থাকলে রেস্টুরেন্ট বিসনেস, বই-খাতার ব্যবসা, ব্যাগের ব্যবসা, ম্যাগাজিন
ব্যবসা, বছরের প্রথমে ঢপ্ দিয়ে তোলাবাজীর ব্যবসা – আরো কত কি!” ওর আরো একটি
বিষয়ে ক্ষোভ ছিল তাহল, প্রতিদিন স্কুল শুরুর সময়ে খ্রীষ্টিয় ধর্মীয় সঙ্গীত
প্রার্থনা করতে সবাইকে বাধ্য করা এবং বছরে কয়েকবার খ্রীষ্টিয় ধর্মগুরু
পরিচালিত ‘মাস’-এ আবশ্যক অংশগ্রহণের যৌক্তিকতা নিয়ে। বেসরকারীকরণ, উদারীকরণ
ও বিশ্বায়ণের পুঁজিবাদী নীতির ফলে সব কিছুর মত শিক্ষাকেও পণ্য করা হয়েছে।
আর ক্রিশ্চিয়ান/ বেসরকারী স্কুলের মালিকরা বেপরোয়া ভাবে লুট করছে অসংগঠিত
জনতার রক্ত জল করা সম্পদ।
বিভিন্ন ক্রিশ্চিয়ান/ বেসরকারী স্কুলে
শিক্ষকতার সূত্রে স্কুল কর্তৃপক্ষকে কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করার সুযোগ
পেয়েছিলাম। এদের ঔদ্ধত্য, দম্ভ ও সবাইকে দমিয়ে রাখার প্রয়াসকে ঘৃণার চোখে
দেখেছি। কখনো এদেরকে হিটলারের ছানা বলে মনে হয়েছিল।সরকারী অনুদান বহু
স্কুলই পেয়ে থাকে, তা সত্বেও এদের খাই মেটেনা। বহু স্কুলে শিক্ষকদের আইন
অনুযায়ী বেতন দেওয়া হয়না। কন্ট্রাক্ট প্রথায় শিক্ষক নিয়োগ করা হচ্ছে। চাকরী
চলে যাবার ভয়ে বেশীরভাগ শিক্ষকরা সঙ্কুচিত। প্রায় সবাই প্রাইভেট টিউশন
পড়ান। প্রাইভেট টিউশন করতে কিছু শিক্ষকদের লালায়িত হতে দেখেছি। এসব সত্বেও
তাঁদের ভিতরে ক্ষোভ দানা বাঁধছে, লক্ষ করা যায়। এই সামগ্রিক অব্যবস্থার
বিরুদ্ধে ছাত্র/ছাত্রী, অভিভাবক ও শিক্ষকদের জোট বেঁধে লড়াই গড়ে তোলা
ছাড়া অন্য কোন রাস্তা খোলা আছে বলে মনে হয়না। কিভাবে সংগঠিত হবেন, তা
ছাত্র/ছাত্রী, অভিভাবক ও শিক্ষকরাই ঠিক করবেন। এদিকে, এই বে-নিয়ম টিঁকিয়ে
রাখার তাগিদে ও ক্ষোভের আগুনে জল ঢেলে দিতে এরা যে কতটা পারঙ্গম এবং কি
ভিষণভাবে এরা সংগঠিত, তা তাদের ধর্মঘট ডাকার মধ্যদিয়ে প্রমানিত। এই অচলায়তন
ভাঙ্গার তাগিদ ও পুঁজির হিংস্র আক্রমণের বিপরীতে সার্বজনীন শিক্ষার
নির্মাণে যাঁরা ব্রতী হবেন, সঙ্গত কারণেই তাঁদের দিকে দৃষ্টিপথ খোলা রাখব।
No comments:
Post a Comment