Thursday 17 October 2024

২০২৪: অর্থনীতিতে নোবেল

প্রতিষ্ঠান একটি সামাজিক চয়নের বিষয়

অচিন চক্রবর্তী



সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ইউক্রেন ও পোল্যান্ড দুটি সার্বভৌম দেশ। ইউক্রেনের অর্থনীতি তখন যথেষ্ট এগিয়ে – শিল্পোন্নত, প্রশিক্ষিত শ্রমিকের অভাব নেই, প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ। অন্যদিকে উন্নয়নের নিরিখে পোল্যান্ড রয়েছে অনেক পিছনে। অথচ পরবর্তী তিন দশকে দেখা গেল ইউক্রেনের অর্থনীতি প্রায় স্থবির, সমস্যায় জর্জরিত আর পোল্যান্ডের মাথাপিছু জাতীয় আয় বেড়ে হল প্রায় তিন গুন। কেন এমন হল? কেন এমন হয়? বুঝতে গেলে এই দু' দেশের প্রতিষ্ঠানগুলির দিকে তাকাতে হবে। 

এখন অনেকে স্বাভাবিকভাবেই মনে করেন, জটিল জালের মতো বিছানো প্রতিষ্ঠানগুলির উপর সমাজ প্রগতি নির্ভর করে থাকে। সেগুলি বিবাদের নিষ্পত্তি করে, বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করে, বিনিয়োগে উৎসাহ দেয়, পরিবেশকে সুরক্ষা দেয় ইত্যাদি। খেলার নিয়ম স্থির করে দেওয়াই প্রতিষ্ঠানের কাজ। সে নিয়ম আইনের চেহারায় থাকতে পারে, না হলে প্রচলিত রীতি হিসেবেও। পোশাকি আইন আর প্রচলিত রীতি মিলেমিশেই হয় এক একটি প্রতিষ্ঠান। ভারতে জাতপাত সে অর্থে একটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠান যেমন ডিজাইন মেনে স্থাপন করার চেষ্টা হয়, আবার তা দীর্ঘ সময় ব্যেপে বিবর্তিতও হতে পারে। ইউক্রেনের ব্যর্থতার কারণ যদি হয় বাড়াবাড়ি রকম দুর্নীতি, তাহলে দুর্নীতির কারণ খুঁজতে হবে সে দেশের প্রতিষ্ঠানগুলিতে। পোল্যান্ডের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাবে, সেগুলি দুর্নীতি ঠেকাতে যে তেমন কার্যকরী হয়নি, তার ব্যাখ্যা তাদের প্রকৃতিতেই খুঁজে পাওয়া যাবে। 

আগেই বলেছি, প্রতিষ্ঠান বলতে বুঝব খেলার নিয়ম, যাকে বলে ‘রুলস অফ দ্য গেম’। রাষ্ট্র যেমন একটি প্রতিষ্ঠান, প্রতিযোগিতাপূর্ণ বাজার ব্যবস্থাও একটি প্রতিষ্ঠান, আবার দাস-ব্যবস্থাও একটি প্রতিষ্ঠান। যে কোনও ব্যবস্থারই মর্মবস্তুতে রয়েছে একগুচ্ছ নিয়ম যা মানুষের আর্থনীতিক কাজকর্মকে নির্ধারণ করে। সোভিয়েত-উত্তর ইউক্রেনে একটি ছোট এলিট গোষ্ঠী সামাজিক ব্যবস্থাপনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে লাগল। এঁরাই আবার সোভিয়েত যুগে ক্ষমতার সিঁড়ির মাথায় ছিলেন। ফলে, খেলার নিয়মও বেঁকিয়ে-চুরিয়ে এমন করা হল যাতে তাঁদের স্বার্থ রক্ষা হয়, দেশের অর্থনীতির নয়। এমতাবস্থায় সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অনীহা দেখা দেবে উৎপাদন ও নতুন প্রযুক্তি-উদ্ভাবনের জন্যে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগে, যার পরিণতি অর্থনীতির মন্দগতি। 

ডারন আসেমগলু, সাইমন জনসন এবং জেমস রবিনসন আর্থনীতিক প্রগতি বা তার নিম্নগতিকে বিশ্লেষণ করেছেন এই প্রতিষ্ঠানভিত্তিক ব্যাখ্যা দিয়ে। প্রতিষ্ঠানভিত্তিক ব্যাখ্যা যে তাঁরাই প্রথম দিলেন তা নয়। অতীতে অনেক বিশিষ্ট অর্থশাস্ত্রীই নানান ছাঁদে প্রতিষ্ঠানভিত্তিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। ডগলাস নর্থ তো আর্থনীতিক ইতিহাসের প্রতিষ্ঠানভিত্তিক তত্ত্বায়নের জন্যে নোবেল পুরস্কারই পেয়েছিলেন ১৯৯৩-এ। নর্থ-অনুসৃত বিশ্লেষণ-ধারাকে বলা হয় ‘নিউ ইনস্টিটিউশনাল ইকনমিকস’। তবে আসেমগলু-জনসন-রবিনসনদের তত্ত্ব নর্থের থেকে অনেকটাই আলাদা। নর্থের তত্ত্বে সম্পত্তির ব্যক্তি মালিকানার বিষয়টি প্রাধান্য পায়। সম্পত্তির মালিকানা অস্পষ্ট থাকলে বাজার বিস্তার লাভ করতে পারে না। তাই যে রকম প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো মুক্ত বাজারের বিস্তারে সহায়ক তা-ই আর্থনীতিক বৃদ্ধিও ঘটাতে পারে, নর্থের মতে। উন্নত দেশগুলির ইতিহাস নাকি সে রকমই বলে। কিন্তু এবারের নোবেল প্রাপক তিন অর্থশাস্ত্রী প্রতিষ্ঠানের গবেষণা নিয়ে গেছেন অন্য খাতে। তারই স্বীকৃতিস্বরূপ নোবেল পুরস্কার। নর্থের মতো মুক্ত-বাজার-সহায়ক প্রতিষ্ঠানে তাঁরা আটকে থাকেননি। তিনজনের জোটকে নোবেল কমিটি স্বীকৃতি দিলেও ধারে এবং ভারে আসেমগলুর নামই প্রথমে আসবে। 

আসেমগলুদের মতে প্রতিষ্ঠান মূলত দুরকম হতে পারে। এক ধরনের প্রতিষ্ঠান আহরণমূলক বা এক্সট্র্যাকটিভ, যা উৎপাদন ও উদ্ভাবনকে প্রণোদনা দেওয়ার বদলে যেটুকু যা সম্পদ তৈরি হচ্ছে তা-ই বিশেষ ক্ষমতাধারী গোষ্ঠী বা শ্রেণিকে পাইয়ে দেয়। আর্থনীতিক কাজকর্মের থেকে উদ্ভূত ফল অসম অনুপাতে সেই গোষ্ঠীরই হস্তগত হয়। ধরা যাক দাস ব্যবসা, যা দীর্ঘকাল চলেছে নির্দিষ্ট সামাজিক রীতি (নর্ম) ও নির্দেশ (কম্যান্ড) নির্ভর করে, উচ্চ শ্রেণিদের স্বার্থর দিকে লক্ষ রেখে। এও এক ধরনের এক্সট্র্যাকটিভ প্রতিষ্ঠান। এক সময়ে বামপন্থী বিশ্লেষণে ভারতীয় কৃষি-ব্যবস্থা প্রসঙ্গে ‘আধা-সামন্ততন্ত্র’ কথাটি খুব ব্যবহৃত হত। এই ব্যবস্থায় জমির মালিক তথা ঋণদাতা ভাগচাষীকে এমন সুযোগ দেবেন না যাতে কৃষির উৎপাদনশীলতা বেড়ে যায়, চাষির আয় বাড়ে এবং তিনি ঋণমুক্ত হন। এ ক্ষেত্রে বর্গাদারী ব্যবস্থাটিকে বলা যায় এক্সট্র্যাকটিভ, যা কৃষির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির পক্ষে সহায়ক নয়। এখন আমাদের ঘরের কাছে আছে অতি পরিচিত 'সিন্ডিকেট' নামক আহরণমূলক প্রতিষ্ঠানটি। পাঠক কল্পনা করে নিতে পারেন, সেটি না থাকলে পশ্চিমবঙ্গের ইমারত শিল্পের প্রগতি কেমন হতে পারত।   

তাহলে অন্যরকম প্রতিষ্ঠানটি কেমন? সেটি এরকম আহরণমূলক নয়, যাকে আসেমগলুরা বলছেন ‘ইনক্লুসিভ’ বা সমন্বিত। সেখানে আর্থনীতিক উদ্যোগ এবং পরিশ্রম যথাযথ পুরস্কৃত হবে; বাজারে সকলের সমান অন্তর্ভুক্তিতে কোনও রাজনৈতিক বা জাত পরিচয় বাধা হবে না। ইতিহাস ঢুঁড়ে দেখলে এই দু প্রকার প্রতিষ্ঠানেরই অস্তিত্ব লক্ষ করা যায়। আসেমগলুদের কৃতিত্ব তাঁরা কয়েক শতকের পরিসংখ্যান ঘেঁটে, আঁটোসাঁটো সংখ্যাতাত্ত্বিক গবেষণা পদ্ধতি ব্যবহার করে, সমন্বিত প্রতিষ্ঠান ও আর্থনীতিক প্রগতির মধ্যে জোরালো সম্পর্ক স্থাপন করতে পেরেছেন।    

এই পদ্ধতি অনুসরণ করে দেখানো যায় তথাকথিত ‘ভাগ্যের ডিগবাজি’। মাথাপিছু আয়ের নিরিখে মধ্য আমেরিকা, দক্ষিণ এশিয়া বা আফ্রিকায় সাহারার নীচের দেশগুলি – যাদের সাধারণভাবে ‘উন্নয়নশীল’ বলা হয় – তাদের থেকে উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপ অনেক দূর এগিয়ে গেছে। উন্নয়নের অর্থনীতির পাঠ্যবইয়ে পশ্চাদপদতার যে কারণগুলি উল্লেখ থাকত তা হল পুঁজিতে বিনিয়োগ কম, শিক্ষার ধীরগতি প্রসারের কারণে মানব পুঁজির অভাব, প্রায় অচল প্রযুক্তি ইত্যাদি। কিন্তু এগুলি সবই যাকে বলা যায় ‘সমীপবর্তী কারণ’, যে কারণের আবার গভীরতর কারণ থাকা সম্ভব, যাকে বলা যায় ‘মূল কারণ’। মার্কসীয় তত্ত্বে এই ‘মূল কারণ’ খোঁজা নিয়ে হাসিঠাট্টাও কম হয়নি। যেমন, ধরা যাক জনৈক মদ্যপ বেসামাল হয়ে গাড়ি চালিয়ে দুর্ঘটনায় নিহত হন। তাঁর মৃত্যুর সমীপবর্তী কারণ হিসেবে মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালানোকে যেমন চিহ্নিত করা যায়, আবার পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ব্যক্তি মানুষের বিচ্ছিন্নতা এবং তার মদ্যপ হয়ে ওঠার সম্পর্ক দেখিয়েও কেউ বলতে পারেন দুর্ঘটনায় এই মৃত্যুর আসল কারণ পুঁজিবাদী সমাজ। মজার ব্যাপার হল, সমাজবিজ্ঞানে এই সমীপবর্তী কারণ থেকে গভীরে প্রোথিত মূল কারণে পৌঁছনোর কোনও সোজাসাপটা ফর্মুলা নেই।  

উপনিবেশায়নের প্রক্রিয়াটি আসেমগলুরা খুব গভীরভাবে অধ্যয়ন করেছেন, যে পাঠে অর্থনীতির সঙ্গে ভূগোল, ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে মেশাতে হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের উন্নয়নের ইতিহাসের ব্যাখ্যায় কেউ কেউ ভৌগোলিক পার্থক্যকে কেন্দ্রে রাখতে চান। যুক্তিটা হল, পেছিয়ে পড়া দেশগুলির অধিকাংশই রয়েছে নিরক্ষরেখার আশপাশে, যেখানে বৃষ্টিপাত বেশি এবং গ্রীষ্মমণ্ডলে বিদ্যমান রোগভোগের (যেমন ম্যালেরিয়া) প্রাদুর্ভাব বেশি। আসেমগলুরা বললেন, ভৌগোলিক অবস্থান এবং আর্থনীতিক অনুন্নয়ন, এরকম দুটি বৈশিষ্টের মধ্যে সহগতির সম্পর্ক থাকতেই পারে, কিন্তু তা থেকে বলা যায় না একটি (ভৌগোলিক অবস্থান) অন্যটির (অনুন্নয়ন) কারণ। উপনিবেশায়নের ইতিহাস সেটি প্রমাণ করার সুযোগ এনে দেয়। ভূগোল যদি নির্ধারক হত তাহলে তো উপনিবেশায়নের আগে যে সব অঞ্চল সমৃদ্ধ ছিল তারাই থাকত আজকের উন্নত বিশ্বে, আর তখন যারা পিছিয়ে ছিল এখনও তাদেরই পিছনে থাকার কথা। কিন্তু তা হয়নি। উপনিবেশায়নের ফলে এক প্রকার ‘ভাগ্যের ডিগবাজী’ বা ‘রিভারসাল অব ফরচুন’ ঘটে গেছে; সমৃদ্ধশালী অঞ্চল তাদের জৌলুস হারিয়ে ঢুকেছে আজকের উন্নয়নশীল পরিবারে, আর সেকালের অনুন্নত অঞ্চল হয়েছে এখনকার উন্নত বিশ্ব। এই সামান্যীকরণে একটু ফাঁক-ফোকর থাকলেও মোটের উপর গ্রহণযোগ্য। 

ভূগোল-কেন্দ্রিক ব্যাখ্যার দুর্বলতা না হয় বোঝা গেল, কিন্তু এ থেকে ভাল প্রতিষ্ঠান আর খারাপ প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বে কীভাবে উপনীত হলেন তাঁরা? ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে, ইউরোপীয়রা তাদের বিভিন্ন উপনিবেশে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেছে এবং তার ফলে যে আনুষঙ্গিক প্রতিষ্ঠানগুলি গুরুত্ব পেয়েছে তারা একই রকম নয়। বেলজিয়ান উপনিবেশ কঙ্গো থেকে শুরু করে ক্যারিবিয়ান এবং মধ্য আমেরিকার খনি – সর্বত্রই দমনমূলক শ্রম প্রক্রিয়া দেখা যায়, যা আহরণমূলক প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার উদাহরণ। ভারতে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তও তাই। অন্যদিকে ‘নতুন বিশ্ব’ উত্তর আমেরিকা এবং কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে ইউরোপীয়রা স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকে দেশগুলিকে নিজেদের পছন্দসই ধাঁচে গড়ে তুলে। স্থায়ীভাবে থেকে যাওয়ার একটি কারণ অবশ্য রোগবালাই সেখানে কম। অন্যদিকে জমি অঢেল কিন্তু খাটার লোকের অভাব। ফলে, স্থানীয়দের একাংশের সঙ্গে আঁতাত করে অন্যদের শ্রমে বাধ্য করে সম্পদ আহরণের যে প্রাতিষ্ঠানিক মডেলটি মধ্য আমেরিকা ও কারিবিয়ানে গজিয়ে উঠল, তা সে সব দেশে চলবে না। এই দেশগুলিতে তাই প্রতিষ্ঠানগুলি এমন চেহারা নিল যা ব্যক্তির উদ্যোগকে পুরস্কৃত করতে সম্পত্তির অধিকারে জোর দিল; প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও ব্যবহার গুরুত্ব পেল। সেই সঙ্গে অবশ্য দাস ব্যবসার মতো কুৎসিত ব্যাপারও চলতে থাকল। কিন্তু সেইসব অর্থনীতির দ্রুত উত্থানের পক্ষে দাস ব্যবসা অন্তরায় হওয়ার কথা নয়।

অর্থনীতির প্রগতির সঙ্গে সমন্বয়ী প্রতিষ্ঠানের জোরালো সম্পর্ককে কঠোর পদ্ধতির সাহায্যে প্রতিষ্ঠিত করায় এই ত্রয়ী অভিনন্দনযোগ্য। সমাজবিজ্ঞানে কোনও তত্ত্বই তর্কাতীত নয়। তর্ক থাকবে। এই তর্ককে উসকে দেওয়ার কাজটি শুধু অর্থনীতির উচ্চস্তরের গবেষণা পত্রিকায় পেপার প্রকাশের মধ্যে দিয়ে হয় না। তাই আসেমগলুরা তাঁদের গবেষণালব্ধ জ্ঞান সেভাবে আটকে রাখেননি। গবেষণার নির্যাস নিয়ে আসেমগলু ও রবিনসন ‘হোয়াই নেশানস ফেল’ শিরোনামে একটি চমৎকার বই প্রকাশ করেন বারো বছর আগে যা অর্থনীতির গণ্ডি ছাড়িয়ে যে কোনও সিরিয়াস পাঠকের আগ্রহের সঞ্চার করবেই। আসেমগলু ও জনসনের সাম্প্রতিক বই ‘পাওয়ার এন্ড প্রগ্রেস’ও অবশ্যপাঠ্য মনে করি। 

প্রযুক্তির দ্রুত পরিবর্তন – যা আমাদের এনে ফেলেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার টালমাটাল ক্ষেত্রে – নানান উদ্বেগের জন্ম দিয়ে চলেছে ক্রমাগত। আসেমগলু ও জনসন মনে করিয়ে দিচ্ছেন, প্রযুক্তি উদ্ভাবনে কার লাভ কার ক্ষতি এই প্রশ্নটি গত সহস্র বছরের মতো আজও প্রাসঙ্গিক। বিদ্যমান প্রতিষ্ঠান সমূহই নির্ধারণ করে দেয় লাভক্ষতির ভাগাভাগি কেমন হবে। মনে রাখতে হবে, সমাজই চয়ন করতে পারে ন্যায্য প্রতিষ্ঠানটিকে।


Saturday 5 October 2024

নারী শ্রমিকদের লড়াই

শ্রমিক আন্দোলনে উত্তাল পাহাড়

অতনু চক্রবর্তী



আবার উত্তাল হল পাহাড়। দীর্ঘ আট বছর পর পাহাড় আবার দেখল সর্বাত্মক বনধ। তাও আবার মুখ্যমন্ত্রীর উত্তরবঙ্গ সফরের মাঝখানে। এবার বনধ ডাকা হয়েছিল চা বাগান শ্রমিকদের পুজো বোনাসের দাবিতে, যৌথ মঞ্চের পক্ষ থেকে। দার্জিলিং পাহাড়ের চা বাগিচার নারী শ্রমিকদের বর্ণময় পোশাক ও বিভিন্ন পাহাড়ি রাস্তা ধরে স্লোগান মুখরিত দৃপ্ত মিছিল, উত্তোলিত মুষ্ঠিবদ্ধ হাত আবার চা বাগিচার অ্যাজেন্ডাকে সামনে নিয়ে এল। 

পর্যটনের ভরা মরশুমে পাহাড়ে প্রবল বৃষ্টির সাথে নানা জায়গায় নেমে আসা ধস, চা বাগানে কর্মবিরতি গোটা শৈল শহরে এখন যেন নিত্যদিনের ছবি। প্রতিবারের মতো এবারেও চা বাগিচার মালিকদের সাথে  শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর অনেকগুলো বৈঠক, বিস্তর দর কষাকষির পর রাজ্য শ্রম দফতরের মধ্যস্থতায় ১৬ শতাংশ বোনাস ঘোষিত হয়। এই বোনাস ঘোষণার পরেই পাহাড়ের চা বাগিচার শ্রমিকরা বেঁকে বসেন। তাঁরা ২০ শতাংশ বোনাসের দাবিতে শুরু করেন আন্দোলন। ২৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চারটে ত্রিপাক্ষিক বৈঠক হয়। ওইদিন, অর্থাৎ ২৯ সেপ্টেম্বরের বৈঠকটি ভেস্তে যাওয়ার পর ৩০ সেপ্টেম্বর ১২ ঘন্টার বনধের ডাক দেয় আটটি ট্রেড ইউনিয়নের যৌথ মঞ্চ। সেই সময় উত্তরবঙ্গ সফররত মুখ্যমন্ত্রী 'বনধ হচ্ছে না ' বলে বিবৃতি দিলেও বনধ হয় সর্বাত্মক। রাজ্য শ্রম দফতর দার্জিলিং চা শিল্পকে অবিলম্বে ১৬ শতাংশ বোনাস প্রদানের জন্য ১ অক্টোবর অ্যাডভাইজারি পাঠালে ইউনিয়নগুলি সম্মিলিতভাবেই তা সঙ্গে সঙ্গে খারিজ করে বনধের ডাক দেয়। তাদের দাবি, তরাই ডুয়ার্সের বাগানগুলোর তুলনায় দার্জিলিং'এর চা থেকে অনেক বেশি মুনাফা আসে। তাই, বোনাসের ক্ষেত্রে তরাই ডুয়ার্সের সাথে সমতা বজায় রাখার যে যুক্তি সরকার দিয়েছে, তা পাহাড়ের ইউনিয়নগুলো মানতে প্রস্তুত নয়। 

দার্জিলিং পাহাড়ের ৮৭টি বাগানে বোনাস নিয়ে ত্রিপাক্ষিক আলোচনার সময় মালিকরা জানায় ২০ শতাংশ বোনাস দেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। সর্বোচ্চ ১৩ শতাংশ বোনাসে তারা রাজি হয়। এরপর থেকে পাহাড়ের  চা শিল্পে অশান্তি নেমে আসে। বনধ, কর্মবিরতি শুরু হয়ে যায়। জয়েন্ট ফোরাম'এর ডাকে ধর্মঘটকে জিটিএ'র চিফ একজিকিউটিভ অনীত থাপারের দল 'ভারতীয় জনতা প্রজাতান্ত্রিক পার্টি' সক্রিয় সমর্থন করে। 

ডুয়ার্সের নাগেশ্বরী ও কিলকোট চা বাগানের নারী শ্রমিকরাও ন্যায্য বোনাসের দাবিতে প্রতিবাদে মুখর হন। পিএফ-গ্রাচুইটির পর এবার এই দুই বাগানে ন্যায্য বোনাসের দাবিও বাগানগুলির পরিচালন সমিতি মানতে প্রস্তুত নয়। চা বাগানের পরিচালন সমিতির সিদ্ধান্ত হল, যে বাগানগুলো বন্ধ হওয়ার মতো অবস্থায় রয়েছে সেখানে ৯ শতাংশ, আর যেগুলো চালু সেখানে ১৬ শতাংশ বোনাস দেওয়া হবে। কিন্তু, উল্লিখিত বাগান দু'টি চালু থাকলেও মেরিকো কোম্পানি সেখানে ৯ শতাংশের বেশি বোনাস দিতে প্রস্তুত নয়। এমনকি এ নিয়ে শ্রমিকদের সাথে আলাপ আলোচনার জন্যও তারা রাজি নয়। এই দুই বাগানের শ্রমিকদের দাবি, মালিকপক্ষ বিগত দিনে যথেষ্ট মুনাফা পেয়েছে, তাই তাদেরও ২০ শতাংশ বোনাস পাওয়া উচিত। এই দুটি বাগানের নারী শ্রমিকরা মেটালি থানা ঘেরাও করেন, প্রবল বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে ৮ কিলোমিটার পথ ধরে মিছিল করেন, কিছু জায়গায় পথ অবরোধও করা হয়।

এ কথা ঠিক, প্রকৃতির খামখেয়ালিপনা, চা গাছগুলোতে এক ধরনের পোকা প্রভৃতি কয়েকটি কারণে চা পাতার উৎপাদনশীলতা বেশ কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও, দার্জিলিং'এ বহুজাতিক সংস্থাগুলো নিত্য নতুন চা বাগিচা কিনে নিচ্ছে, মালিকানারও হাত বদল হচ্ছে। শ্রমিকদের প্রশ্ন, চা শিল্প যদি রুগ্ন হয়, তবে নতুন নতুন বাগান হস্তগত করতে বহুজাতিকেরা কেন পিছপা হচ্ছে না! ২০২২ সালে সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটি এক রিপোর্টে জানায়, 'চা বাগিচার শ্রমিকদের নিদারুণ দুর্দশা ও অমানবিক জীবন ধারণের মান মনে করিয়ে দেয় ঔপনিবেশিক আমলে ব্রিটিশ চা মালিকদের আমল। এরা আজও বাঁধা মজুরের মতো দিন যাপন করে।... দার্জিলিং'এর চা শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি দেশের সমস্ত শিল্প শ্রমিকদের চেয়ে সবচেয়ে কম!' উচ্চমূল্যে রফতানিকৃত দার্জিলিং'এর চা পাতা বিপুল মুনাফা কামালেও শ্রমিকদের মজুরি আজও রয়ে গেছে তলানিতে। 

দেশে চা সহ বাগিচা শিল্পে মজুরির প্রশ্নে রাজ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে বিস্তর তফাত। উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রায় ৮০ শতাংশ জমিতে চা বাগিচা রয়েছে। এখানকার উৎপাদনশীলতা দক্ষিণী রাজ্যগুলোর সমান হলেও দক্ষিণ ভারতের তুলনায় উত্তর-পূর্ব ভারতের উৎপাদিত চায়ের নিলাম মূল্য দক্ষিণের রাজ্য থেকে অনেক বেশি। কিন্তু তা সত্ত্বেও, দক্ষিণ ভারতের তুলনায় উত্তর-পূর্ব ভারতে চা শিল্পের মজুরি অনেক কম, প্রায় অর্ধেক! 

এ রাজ্যে চা শিল্পের ইউনিয়ন ও মালিকপক্ষের সাথে রাজ্য শ্রম দফতর পরের পর বৈঠক করার পর অবশেষে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ হয় দৈনিক ২৫০ টাকা। অন্তর্বর্তীকালীন এই দৈনিক মজুরি মালিকপক্ষ মানতে অস্বীকার করে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়। কিন্তু হাইকোর্ট মালিকপক্ষের এই আবেদন খারিজ করে ১ আগস্ট থেকেই নতুন মজুরি কার্যকরী করার আদেশ দেয়। গত বছরের সাপেক্ষে এই অন্তর্বর্তীকালীন মজুরি বৃদ্ধি হয় মাত্র দৈনিক ১৮ টাকা! অসমে ২০২২ সালে ২৭ টাকা মজুরি বৃদ্ধি হয়, ফলে ১ আগস্ট থেকে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় তা হয়ে দাঁড়ায় ২৩২ টাকা, আর বরাক উপত্যকায় হয় ২১০ টাকা। বিগত বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির প্রধান নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল চা শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি, যা ক্ষমতায় আসার পর তারা কিছুটা পালন করতে বাধ্য হয়।

এবার দেখা যাক, দক্ষিণ ভারতে চা শ্রমিকরা কত মজুরি পান। কেরলে এই মজুরি দেশের মধ্যে সর্বাধিক (৪২১.২৬ টাকা)। তারপর তামিলনাড়ু (৪০৬.৮০ টাকা), কর্নাটক (৩৭৬.৭৮ টাকা)। বিহার ও ত্রিপুরায় মজুরি সর্বনিম্ন: যথাক্রমে ১৭৫ ও ১৭৬ টাকা। বোঝাই যাচ্ছে, দক্ষিণী রাজ্যগুলোর তুলনায় উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোর মধ্যে মজুরির প্রশ্নে রয়েছে আসমান জমিন পার্থক্য। তা সত্ত্বেও এ রাজ্যগুলোর মালিকপক্ষ লোকসানের অজুহাতে মজুরি বৃদ্ধিতে সম্মত নয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ২০০০- ২০১৫ পর্যন্ত এ রাজ্যের ডুয়ার্স অঞ্চল দেখেছিল ১৪০০ অনাহার মৃত্যু, আজও বহু শ্রমিক অর্ধাহারে অপুষ্টিতে ক্ষীণ দেহে কাজ করতে বাধ্য হন।

অনিন্দ্য সুন্দর প্রাকৃতিক শোভার বেষ্টনীতে নারী শ্রমিক প্রধান এই চা শিল্পের শ্রমিকরা সমস্ত দিক থেকে বঞ্চিত। মজুরির ক্ষেত্রে প্রকট লিঙ্গ অসাম্য, সমস্ত সরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চনা, সামাজিক সুরক্ষাহীন এই অগণন নামহীন অবয়বহীন নারী শ্রমিকদের অমানুষিক শ্রমে উৎপাদিত চা পাতা বিশ্ব বাজারে 'ভারতের শ্যাম্পেন' হিসাবে খ্যাত। তাঁদের যন্ত্রণাক্লিষ্ট চোখের জল আমরা শহুরে মধ্যবিত্তরা ঠাহর করতে পারি না। সকালে চায়ের প্রতিটি চুমুকের অন্তরালে চোখের জলের এই বেদনা আমরা কবে বুঝব?


Saturday 28 September 2024

'এক দেশ এক ভোট'?

যুক্তরাষ্ট্রীয় ও বহুদলীয় ব্যবস্থার উপর আঘাত

বর্ণালী মুখোপাধ্যায়



বিজেপি'র ফ্যাসিস্ট রাজ কায়েমের সব থেকে বড় বাধা হল বহু দলের অস্তিত্ব। ইডি-সিবিআই'কে দিয়ে বিরোধী দলের নেতাদের গ্রেফতার করে দলগুলির মাজা ভাঙার চেষ্টা করেছিল তারা। কিন্তু জনগণ প্রত্যাঘ্যাত করলেন, নরেন্দ্র মোদী বেনারস থেকে মাত্র এক লাখের কিছু বেশি ভোটে জিতলেন। এখন অরবিন্দ কেজরিওয়াল, অনুব্রত মন্ডল, সেন্থিল বালাজি সহ অনেকেই একে একে বেলে ছাড়া পেয়ে যাচ্ছেন। তাই এবার বিজেপির নতুন ফন্দি হল ‘এক দেশ এক ভোট’। পুঁজিবাদের বৃদ্ধ বয়সের (যদিও বার্ধক্যের বয়সও দেড়শো বছর হতে চলল) সন্তান ফ্যাসিবাদ আবার যুবক পুঁজিবাদের গণতন্ত্রকে সহ্য করতে পারে না। হিটলার থেকে বাজপেয়ী হয়ে মোদী আদ্যপান্ত ভোট বিরোধী। বাজপেয়ী আমলেও এই চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু তখন পরিস্থিতি আলাদা ছিল। আজ মোদী শেষ চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

রামনাথ কোভিন্দের সভাপতিত্বে অমিত শাহ, গুলাম নবি আজাদ, এন কে সিং, সুভাষ কাশ্যপ, হরিশ সাল্ভে, সঞ্জয় কোঠারি, নীতিন চন্দ্র এবং আমন্ত্রিত সদস্য হিসেবে আইন মন্ত্রী অর্জুন রাম মেঘওয়াল— এই কমিটি সুপারিশ করেছে ‘এক দেশ এক ভোট’ (One Nation One Election- ONOE) আইন। ৩২২ পাতার রিপোর্ট এটি, যা ১৮ সেপ্টেম্বর মন্ত্রীসভায় গৃহীত হয়েছে। প্রস্তাবটি সংসদে পেশ হবে শীতকালীন অধিবেশনে। রিপোর্ট অনুযায়ী, পাঁচ বছর অন্তর ৪ মাস ধরে ভোট চলবে। প্রথমে বিধানসভা আর লোকসভা ভোট একসঙ্গে হবে, তারপর তিন মাসের মধ্যে পঞ্চায়েত ও পৌরসভা ভোট। রিপোর্টটি তৈরি করা হয়েছে ১৯১ দিনে। অন্তত একজন সাংসদ আছে এমন ৪৭টা রাজনৈতিক দলের মতামত নেওয়া হয়েছে। ২০২৪ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের মতামত জানায়। এছাড়া ভারতের তিনটি বৃহৎ ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ফিকি-অ্যাসোচেম-সিআইআই'এর থেকে নেওয়া হয়েছে পরামর্শ। পরামর্শ নেওয়া হয়েছে উকিল এবং বিচারপতিদের থেকেও। এই সুপারিশ গঠনে বিশেষ ধন্যবাদ জানানো হয়েছে আইন মন্ত্রক ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের উচ্চপদস্থ দু-চারজন আমলাকে। যদিও যে নামগুলো আছে সেগুলো বাছাই করা তাতে সন্দেহ নেই। সুপ্রিম কোর্টের চারজন বাছাই করা প্রাক্তন বিচারপতি, কিছু বাছাই করা হাই কোর্টের বিচারপতি, আবার অখিল ভারতীয় অধিভক্ত পরিষদ অর্থাৎ আরএসএস'এর উকিল সংগঠনের প্রতিনিধি, কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন এবং রাজ্য নির্বাচন কমিশনের প্রাক্তন আধিকারিক- এদের থেকেও মতামত নেওয়া হয়েছে। আর জনগণ? হ্যাঁ তাও আছে বৈকি!! ১৪০ কোটির এই দেশে ২১,৫৫৬ জন নাগরিক তাদের মতামত জানিয়েছেন; যাদের মধ্যে ৮০ শতাংশ, অর্থাৎ, ১৭ হাজার মানুষ এই সুপারিশের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। যথেষ্ট নয় কী?! ৩২টি রাজনৈতিক দল এই প্রস্তাবের পক্ষে রায় দিয়েছে, ১৫টি দল বিরুদ্ধে মত দিয়েছে। তবে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, শিবসেনা পক্ষে মত দিয়েছে আর আরজেডি নীরব থেকেছে। অন্তত বিরোধিতা করেনি।    

বিজেপি বিরোধীরা হয়তো ভেবেছিল যে এই আইন মন্ত্রীসভায় গৃহীত হবে না। বিজেপির আসন এবার কম তাই সেই সুযোগ নিয়ে শরিকরা এটা অনুমোদন করবে না। কিন্তু দেশে বা বিভিন্ন রাজ্যে অনাস্থা প্রস্তাব এলে মধ্যবর্তী ভোট হবে-- এই আশ্বাস দিয়েই কি কোভিন্দ কমিটির সুপারিশ শরিকদের মন জিতে নিল? ‘একসাথে বিধানসভা আর লোকসভা ভোট হলেও বহু আঞ্চলিক দল বহু রাজ্যে জিতেছিল’-- সুপারিশ থেকে এই বার্তা পেয়েও হয়তো শরিকরা সন্তুষ্ট। অথবা বিজেপি বিরোধী দলগুলো যেমন শরিকদের উপর নির্ভর করছিল হয়তো বিপরীতটাও সত্যি। শরিকরাও হয়তো ধরেই নিয়েছে যে এই আইনের বিরুদ্ধে মামলা হবেই, ফলে তারা আর অমিত শাহকে চটাতে চাইল না। কংগ্রেস দলের আমলে এই ব্যবস্থা ছিল বলে রাহুল গান্ধী নীরব থাকবেন, এমনটাও হয়তো বিজেপি আশা করেছে। তাছাড়া, বহুদলীয় ব্যবস্থা থেকে সরে এসে দ্বিদলীয় ব্যবস্থা হলে কংগ্রেসের আপত্তি থাকবে না, এমন আশা বিজেপি করতেই পারে।

আসলে এই সুপারিশ মোতাবেক এই যে বহু দল থাকবে, একসাথে সব ভোট হবে, অনাস্থা প্রস্তাব এসে কোনও সরকার পড়ে গেলে আবার মধ্যবর্তী ভোটও হবে, অথচ ভোটের সংখ্যা কমবে-- এ এক সোনার পাথরবাটি। অমিত শাহ সেটা জানেন। যেমন জানেন সুভাষ কাশ্যপ (এই কমিটির সদস্য)। কমিটির প্রস্তাবে স্পষ্ট বলা আছে যে কংগ্রেস আমলে প্রথম চারটে লোকসভা ভোট বিধানসভার সাথেই হয়েছে। কিন্তু যে পরিমাণে ক্রমেই বহুদলীয় গণতন্ত্র পাকাপোক্ত হয়েছে একসাথে ভোট আর করা যায়নি। ফলে, কাশ্যপ মধ্যবর্তী সাধারণ ভোটে রাজি নন। তার বদলে বিধানসভা বা সংসদের ভেতরে ভোটের মধ্য দিয়ে পরবর্তী সরকার গঠন করার সুপারিশ করেছেন, তবে একটাই শর্তে, বিকল্প মুখ্যমন্ত্রী/ প্রধানমন্ত্রীর মুখ বেছে নিতে হবে তখনই। সারকারিয়া কমিশন আর পুঞ্চ কমিশনের নির্দেশমতো রাজ্যপাল বা রাষ্ট্রপতি পরবর্তী সরকার গঠনের জন্য দল/জোটকে আহ্বান জানাবে আর অনাস্থা প্রস্তাব যারা এনেছে তাদের পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রীকে ওই হাউজেই ভোটের মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত করতে হবে। অর্থাৎ, ঘোড়া কেনাবেচা হবে, অনাস্থা আসবে, হাউজের ভেতরেই বিকল্প মুখ্যমন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রী নির্দিষ্ট করতে হবে। প্রয়োজনে হাউজে ভোটও হবে। আর না হলে? তিনি আর কিছু বলেননি, কিন্তু একটাই বিকল্প হয় সে ক্ষেত্রে: রাষ্ট্রপতি শাসন। কাশ্যপবাবু কিছুতেই মধ্যবর্তী সাধারণ বিধানসভা বা লোকসভা নির্বাচন চাননি। তাঁর দিক থেকে বিষয়টা অযৌক্তিকও নয়। কোভিন্দ কমিটির যুক্তির গোড়ার অজুহাত হল ভোটের সংখ্যা কমাও, খরচ কমাও। অথচ, কমিটির প্রস্তাব অনুযায়ী পাঁচ বছর অন্তর সব ধরনের ভোট একসাথে করার যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে সেটা আইন হলে, আবার পাশাপাশি মধ্যবর্তী ভোটও চালু থাকলে, ভোটের সংখ্যা কমার বদলে আরও বাড়বে। যেহেতু নতুন আইন চালু হলে মধ্যবর্তী সরকার পাঁচ বছর থাকবে না, লোকসভার এক বছর আগে নতুন সরকার হলেও আবার নতুন করে একসাথে ভোট হবে, ফলে, কাশ্যপ সোজাসাপ্টা রাজ্যপালের ক্ষমতা প্রয়োগের কথা বলেছেন এবং সেই হেতু এও স্পষ্ট করেছেন যে ভারত আসলে যুক্তরাষ্ট্র নয়, এখানে আমেরিকার মতো রাজ্যগুলি স্বেচ্ছায় একটি ভৌগোলিক সীমানায় অন্তর্ভুক্ত হয়নি। 

অমিত শাহ জানতেন যে কাশ্যপের প্রস্তাব এখনই মানা যাবে না। কোভিন্দ কমিটি কাশ্যপের এই প্রস্তাব বাতিল করে শরিকদের, হয়তো বা বিরোধীদেরও সন্তুষ্ট করে বলেছে যে মধ্যবর্তী ভোট অবশ্যই হবে। কিন্তু রাজ্যপালের সাংবিধানিক ক্ষমতা আছে রাজ্য সরকার ফেলে দেওয়ার, কাশ্যপের এই মতামতকে সার্বিক সমর্থন জানাতে ভোলেনি কোবিন্দ কমিটি। রাজ্যপালকে মন্ত্রীসভার অনুমোদন নিতে হবে না এবং আদালতেও রাজ্যপালের এই কাজকে প্রশ্ন করা যাবে না। অমিত শাহ জানেন যে এই আইনের মধ্য দিয়ে আসলে তারা এই দুটো বিষয়কেই বৈধ করতে চেয়েছে-- 

এক) রাজ্যপাল মোটেই আলংকারিক নয়। 

দুই) দেশ মোটেই যুক্তরাষ্ট্র নয়। 

'যুক্তরাষ্ট্র' শব্দটার গুরুত্ব স্রেফ এইটুকুই যে সংবিধানে তিনরকম তালিকা আছে, এবং সেটাও দেশের বৈচিত্রের দিকে খেয়াল রেখে যেন বা দয়া করে কেন্দ্র দিয়েছে রাজ্যকে। আপাতত এই দুটো স্বীকৃতি পেলেই অমিত শাহের চলবে। বাকিটা দাঙ্গা করে তারা আদায় করবে। যেমন প্রতিশ্রুতি থাকা সত্ত্বেও জম্মু কাশ্মীরের ভোট ৬ বছর দেরিতে হল। 

ভোট নাকি উন্নয়নের পথে বাধা। ভোটের খরচ নাকি আকাশছোঁয়া!! যদিও হিসেব করলে দেখা যাচ্ছে, মাথাপিছু ভোটের খরচ দেড় হাজার টাকা, অথচ মাথাপিছু দেশের ঋণ হল দেড় লাখ টাকা। এদিকে প্রস্তাবে পাবেন বালতি বালতি কুমিরের চোখের জল। ভোটের জন্য নতুন প্রজেক্টের শীলা স্থাপন করা যাচ্ছে না, অনুদান দেওয়া যায় না, ইস্কুল আর শিক্ষকদের ভোটের কাজে নিয়ে যেতে হচ্ছে, এমন কত আক্ষেপ অমিত শাহের। বাস্তব হল, বছরে একটা ভোট অসহ্য হয়ে উঠছে একাধারে বিজেপি অন্যদিকে এ দেশের বৃহৎ ব্যবসাদারদের পক্ষেই। তাদের মৌখিক যুক্তি হল, পরিযায়ী শ্রমিকরা বার বার ঘরে ফেরে ভোট দিতে, তাই পাঁচ বছর অন্তর এই বন্ডেড লেবারদের আটকাতে ভোট আর যেন বছরে একবার না হয়। এমন নির্লজ্জ বক্তব্য তারা রেখেছে ঠিকই। কিন্তু আসল কারণ আরও গভীরে। জনবিরোধী নীতিগুলি কার্যকর করার আগে তাদের প্রতি পদে হিসেব কষতে হয়। তাছাড়া বিরোধীরা থাকে সমাজতান্ত্রিক মেজাজে। পাঁচ বছর অন্তর ভোট হলে সেই বালাই নেই। প্রতি বছর ভোট না থাকলে মাঝের চার বছর বিরোধী দল সিন্দুকের ভেতর সেঁধিয়ে যাবে, এমনই আশা বিজেপির। বেলজিয়াম, দক্ষিণ আফ্রিকা, জার্মানি, ফিলিপিন্সের মতো হাতে গোনা কিছু ছোট দেশ, যাদের ভারতের মতো বৈচিত্র নেই, সেখানে চালু আছে একসাথে ভোট প্রক্রিয়া। আমাদের দেশে সেটা অসম্ভব। 

ভারতের সংবিধান ঔপনিবেশিক রাজ্যপালের পদ বিলোপ করতে ব্যর্থ হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নীতিকে খাপছাড়া ভাবে কার্যকর করেছে। তিনটি তালিকার মধ্যে রাজ্যের হাতে যা আছে সেটা প্রায় প্রহসনে পরিণত হয়েছে। এ হেন সাংবিধানিক ফাঁকের সুযোগ নিয়ে আজ কোভিন্দ কমিটি যুক্তরাষ্ট্রকেই অস্বীকার করছে, রাজ্যপালদের ঈশ্বর বানাচ্ছে। 

১৯৫০ আর ২০২৪'এর মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। আজ বাস্তব ঘাড় ধরে এ দেশে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে, যার সাংবিধানিক স্বীকৃতি আমাদের চাই। আর ফ্যাসিস্টদের তরফে চাওয়া রাষ্ট্রপতি এবং রাজ্যপালের আলংকারিক অস্তিত্বের ন্যূনতম সাংবিধানিক স্বীকৃতিকেই অস্বীকার করা দরকার।


Monday 23 September 2024

কর্পোরেটরা হাসছে, রোগীরা অসহায়!

রোগী-ডাক্তার সম্পর্কই নিরাপত্তার চাবিকাঠি  

উত্তান বন্দ্যোপাধ্যায়



লেখকের ডিসক্লেইমার: আরজিকর কাণ্ডে তিলোত্তমা'র জঘন্য হন্তাকারীরা কেউ যেন ছাড়া না পায়। দোষীদের নিরপেক্ষ সঠিক বিচার হোক, দোষীরা সাজা পাক। দুর্নীতি উন্মোচিত হোক; তারও সঠিক, নিরপেক্ষ, ন্যায়বিচার চাই। জুনিয়র ডাক্তারদের প্রতিবাদ সঙ্গত।

পশ্চিমবঙ্গে রেজিস্টিকৃত ডাক্তারের সংখ্যা প্রায় ৯৩,০০০'এর কাছাকাছি। West Bengal Medical Council'এ গিয়ে অনুসন্ধান করলেই জানা যাবে। তার মধ্যে আছে, 

১) ১৫ থেকে ২০ হাজার ডাক্তার মৃত অথবা ডাক্তারি করা থেকে অবসর নিয়েছেন কিংবা ভীষণ বৃদ্ধ, বোধশক্তিই রহিত হয়েছে বার্ধক্যে। মৃত ডাক্তারদের বাড়ির লোক এসে খবরও দেননি যে উনি আর ইহলোকে নেই;

২) বেসরকারি হাসপাতাল ও নার্সিংহোমের ডাক্তার;

৩) কেন্দ্রীয় সরকারি হাসপাতালের (রেল, ডিফেন্স, পোর্ট, ইএসআই, কেন্দ্রীয় সরকারি) ডাক্তারেরা;

৪) ইএসআই রাজ্য সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার;

৫) স্বাধীন প্রাকটিস করা ডাক্তার।

এরপরে পড়ে থাকল,

পশ্চিমবঙ্গ সরকারের হেলথ অ্যান্ড ফ্যামিলি ওয়েলফেয়ার মন্ত্রণালয়ের অধীনে সমস্ত সরকারি হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ, প্রাইমারি, ব্লক প্রাইমারি, গ্রামীণ, জেলা ও স্টেট জেনারেল হাসপাতালের মোট ডাক্তার। যারা সব মিলিয়ে ১৮,০০০।

তাহলে এবার অঙ্কটা কষে ফেলা যাক! 

৭৩০০ জুনিয়র ডাক্তার পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অধীনে কর্মরত ১৮,০০০ ডাক্তারের কত শতাংশ? প্রায় ৪০ শতাংশ।

পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ১২৫৭টি প্রাইমারি হেলথ সেন্টার এবং ব্লক প্রাইমারি হেলথ সেন্টার আছে। ৮০'র কাছাকাছি সেকেন্ডারি কেয়ার বা স্টেট জেনারেল হাসপাতাল আছে, কিছু টার্সিয়ারি কেয়ার ও সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল আছে, যা জেলা হাসপাতালও বটে, যেমন এম আর বাঙুর; ৩০'টার উপরে মেডিকেল কলেজ আছে যার ২৬টাই সরকারি, বাদবাকিগুলো বেসরকারি। এই ২৬টার মধ্যে ১৮টা মেডিকেল কলেজে প্রথম এমবিবিএস ব্যাচ বেরিয়েছে, বাদবাকি ৮টায় এখনও ফাইনাল এমবিবিএস অবধি ছাত্র-ছাত্রীরা পৌঁছয়নি। 

তাহলে বলা হয় কেন, এমনকি আদালতেও যে, জুনিয়র ডাক্তারেরা মাত্র ৭৩০০ জন, এই বিপুল, বিশাল স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় মাত্র ১৮টা জায়গায়, তো তাতে কী এমন স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙে পড়ল!

আসুন হিসেব করি।

৭৩০০ সংখ্যাটি কমবেশি ঠিকই আছে, কিন্তু ১৮টার হিসেব কষতে হচ্ছে।

১) সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালেও পোস্ট গ্রাজুয়েট কোর্স পড়ানো হয়, যারা পড়েন অথচ চাকরি করতে করতে লিয়েন'এ আসেননি বরং ফ্রেশ‌, মানে ইন্টার্নশিপ'এর পরেই DNB (MD/MS এর সমতুল্য) করছেন, তারাও সংখ্যায় কম নন। তারাও জুনিয়র ডাক্তার। 

২) বহু স্টেট জেনারেল হাসপাতালেও DNB কোর্স আছে, যেমন বিদ্যাসাগর, বাঘাযতীন হাসপাতাল। এদের যারা ফ্রেশ DNB করছে, তারাও জুনিয়র ডাক্তার। ধরা যাক বাঘাযতীন'এ ৮টা DNB সিট আছে, তার মানে, ১ম, ২য় ও ৩য় বর্ষ মিলে ২৪ জন। এদের মধ্যে যারা সরকারি চাকরি করতে করতে লিয়েন'এ আসেননি, সবাই জুনিয়র ডাক্তার। 

৩) এটা ঠিকই, এখন হাউসস্টাফশিপ আর আবশ্যিক নেই। তার মানে, কেউ সরাসরি ইন্টার্নশিপ থেকে পোস্ট-গ্রাজুয়েশনে সুযোগ পেতেই পারেন প্রবেশিকা পরীক্ষা দিয়ে। তবু, তা তো প্রথম সুযোগেই সবাই পান না! কেউ কেউ দুবার, তিনবার এমনকি চারবারেও পায়।

তবু, ধরা যাক...

কোনও মেডিকেল কলেজেও দেখা গেল, কোনও ফ্যাকাল্টির সব ইউনিট ধরেও কোথাও হয়তো জুনিয়র ডাক্তার কম। সে ক্ষেত্রে 'Need basis'এ হাউসস্টাফ নিয়োগ করা হয়। কোনও কোনও হাসপাতালে হাউসস্টাফ ২০ থেকে ৪০'ও হতে পারে সব মিলিয়ে। প্রতি বছরেই হাউসস্টাফশিপের একটা কোটাও থাকে মেডিকেল কলেজগুলোতে। এছাড়াও মেডিকেল কলেজগুলো বাদ দিয়ে বিভিন্ন স্পেশালিটি ক্লিনিক, সুপার স্পেশালিটি ক্লিনিক, জেলা হাসপাতাল ও স্টেট জেনারেল হাসপাতালেও হাউসস্টাফ নিয়োগ করা হয়। এরা সবাই জুনিয়র ডাক্তার।

কেন বলছি এ কথা? 

শুধুমাত্র ১৮টা কলেজ বললে ভুল বলছি। সারা বাংলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে মেডিকেল কলেজগুলো বাদ দিয়েও জুনিয়র ডাক্তার বর্তমান। হয়তো সংখ্যায় কম কিন্তু মেডিকেল কলেজের তুলনায় সেই হাসপাতালটিও তো ছোট। অতএব, পরিষেবা শুধু মেডিকেল কলেজগুলোতেই ব্যাহত হচ্ছে না, অন্যত্রও হচ্ছে।

এছাড়াও জেলা হাসপাতালগুলো থেকে একটা অ্যাপেন্ডিক্স অপারেশনও পাঠিয়ে দেওয়া হয় কোনও মেডিকেল কলেজে বা বিশেষ করে কলকাতার মেডিকেল কলেজগুলোতে। কেন? ওখানকার ডাক্তারেরাই ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে নার্সিং হোমে কেস করেন। উল্টে বলেন, হাসপাতালে ওটি খারাপ, যন্ত্রপাতি স্টেরাইল নেই, এটা নেই, স্টাফ নেই, সেটা নেই। যারা ওনাকে দিয়েই নার্সিংহোমে পারেন না, তাদেরকে বড় হাসপাতাল বা মেডিকেল কলেজগুলোতে রেফারেল দিয়ে দেওয়া হয়। ফলে, সব মেডিকেল কলেজগুলোতে যত রোগী হয় তার মধ্যে রেফারেল কেসই ৭০ শতাংশ, যার প্রায় ৬০ শতাংশের ওই পেরিফেরিতেই চিকিৎসা হত, সম্ভবও ছিল। 

সবাই এসব কথা সব কিছু জানে। 

ধরা যাক, কোনও ডাক্তার কলকাতার কোনও সরকারি মেডিকেল কলেজেরই ডাক্তার। কোনও একটা মহল তার থেকে ঘুষ চাইল ১০ বা ১৫ লক্ষ টাকা। তিনি দেবেন না বা দিতে পারবেন না জানালে তাঁকে দক্ষিণবঙ্গ থেকে উত্তরবঙ্গে পাঠানো হল। এবার তিনি রাগে, অপমানে আরেকটা দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়লেন। তিনি হয়তো শিলিগুড়িতে নর্থ বেঙ্গল মেডিকেল কলেজে আছেন। এবারে তিনি করলেন কী- ওখানে ২ দিন আর কলকাতায় ৫ দিন থাকলেন। সময় নষ্ট করবেন না বলে যাতায়াত প্লেনে সারলেন। ফলে, এত খরচের টাকা তো তাঁকে তুলতে হবে! তিনি তখন বাকি পাঁচদিনের চারদিনেই চুটিয়ে বাণিজ্য করতে শুরু করে দিলেন। বাণিজ্য বাড়াতে কী করতে হবে? ফার্মা লবিকে ধরতে হবে। কোনও ফার্মা লবি তাঁর ক্লিনিকটাও কলকাতার বিশেষ জায়গায় তৈরি করে দিল। এখন তার টাকা পয়সা কীরকম? ওই আধিকারিক যে ঘুষ চাইছিলেন, তাঁর থেকেও তিনি এখন বিত্তবান, খুব কম সময়েই।

কী দাঁড়ালো? 

১) মেডিকেল কলেজে রোগীর চাপ এবং সেখানে জুনিয়র ডাক্তারদের অনুপস্থিতিতে একজন রোগীকে প্রথম ও প্রাথমিক ভাবে দেখার লোকই রইল না। উপরন্তু, দৈনন্দিন নিত্যনৈমিত্তিক একজন ইন্ডোর পেশেন্টের প্রতি পরিষেবাও অপ্রতুল হল; 

২) করাতের দুদিকেই ধার। এদিকে কর্তৃপক্ষের কেউ যদি দুর্নীতি করেন, ওদিকে যিনি তার কোপে পড়লেন, তারও কেমন যেন একটা মেটামরফোসিস ঘটে! এ এক অমোঘ নিষ্ঠুর বাস্তবতা; 

৩) কর্পোরেটরা হাসছে। তাদের চুরি, আরও চুরি অনায়াসেই মান্যতা পাচ্ছে;

৪) অধিকাংশ সরকারি ও বেসরকারি সিনিয়র ডাক্তাররাই কর্পোরেট হাতছানিতে আছেন - হয় ১০০ শতাংশ, নতুবা ন্যূনতম ১০ শতাংশ। এরাই জুনিয়র ডাক্তারদের আগুন খাওয়াকে উৎসাহ দিচ্ছেন;

৫) পুরো মহলটাই এমন হয়ে যাচ্ছে যে সমগ্র সরকারি ব্যবস্থাটাকেই তার আমলাতন্ত্র এমন জায়গায় নিয়ে যাবে যে তা কর্পোরেটের হাতে তুলে দিতে হবে;

৬) অধিকাংশ সম্পন্ন ঘরের ছেলেমেয়েরাই এখন নিট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারে, ব্যবস্থাটা তেমনই। আগেকার মতো অত্যন্ত গরিব ঘরের ছেলেমেয়েদের বিভিন্ন জেলা থেকে এসে টিউশনি করে সরকারি মেডিকেল কলেজে পড়ার মাইনে ও হোস্টেলের খরচ বহন করতে হত - সেরকম সংখ্যা এখন কত? ৫ শতাংশও না। কাজে কাজেই তাদের আন্দোলনের সবকিছু যৌক্তিক দাবিগুলো অকপটে মেনে নিয়েও বোঝানোর দায়দায়িত্ব থাকে সিনিয়রদের উপর যে, দেখো, হাসপাতালের বেনিফিশিয়ারি কারা! কাদের চিকিৎসা দিচ্ছ না। কে চিকিৎসা দিচ্ছে না? সম্পন্ন ঘরের অধিকাংশ ছেলেমেয়েরাই। কারা চিকিৎসা পাচ্ছে না? গরিব, নিম্নবিত্তরা, যারা মোট রোগীর অধিকাংশ। 

কোভিডের সময়ে টেলিভিশনে এসে প্রত্যহ ভয় বিতরণকারী চিকিৎসকেরা যারা রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেলেন, তাঁরাই নাগরিকদের কেউ ভ্যাক্সিন না নিলে তাদের অসামাজিক বলেছেন; সেই তাঁরাই ১৮০ ডিগ্রি পাল্টি খেয়ে ২০২২ সালের পর বলেছেন যে জেনেটাক্যালি মডিফায়েড ভ্যাক্সিন (mRNA)'এ প্রচুর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হচ্ছে! এই তাঁরাই কোভিডের সময়ে প্রত্যেকে প্রত্যহ লক্ষ টাকা কামিয়েছেন, কোটি কোটি টাকা পাইয়ে দিয়েছেন তাদের কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে। জুনিয়র ডাক্তারদের উচিত ছিল, সিনিয়রদের মধ্যে ভারী এই অংশটাকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করা।

তাই, সুরক্ষা ও নিরাপত্তার জন্য একে-ওকে ট্রান্সফার করে বা ফ্লাডলাইটে হাসপাতাল ভরিয়ে দিয়ে অথবা কোলাপসিবল গেট চারগুণ বাড়িয়ে কিংবা সিসিটিভি ১০ গুণ বেশি বসালেই হাসপাতালের সুস্থ পরিবেশ ফিরে আসে না। যে কোনও মর্ষকামী শক্তিশালী কায়েমী স্বার্থ, তা যে কোনও সরকারি দলের কারও তাণ্ডবেই হোক বা অন্য যে কোনও স্বার্থান্বেষী শক্তির দাপটে, তা আন্দোলন করে একসাথেই প্রতিহত করতে হবে। তার বিকল্প কিছু নেই। জনস্বাস্থ্যের এক সামগ্রিক কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি, রোগী ও রোগীর বাড়ির লোকের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি ঘটাতে হবে। তা রোগীকে পাশে ঠেলে নয়। সম্পর্কের উন্নতি হলে তাঁরাই আসল সুরক্ষা ও নিরাপত্তার চাবিকাঠি।

(লেখক একজন রোগী অধিকার আন্দোলনের কর্মী)


Sunday 22 September 2024

'ডুবল রে ক্ষেত বসত ভিটে...'

গ্রামবাংলার বেঁচে থাকা!

লাবণী হালদার



পোষক প্রকৃতির বিধ্বংসী ও বিরূপ মনোভাবের একপ্রকার আত্মপ্রকাশ ঘটে প্লাবনের মাধ্যমে। প্রাণী জগতের অসহায়তা আরও একবার প্রবল ভাবে ধরা দেয় প্রকৃতির খামখেয়ালি রূপে। আজ প্রাণীকুলের জীবন সংকট প্রকট হয়ে উঠেছে বন্যা বিধ্বস্ত বঙ্গদেশের আনাচেকানাচে। কোনও কিছুর পরিবর্তনই আকস্মিক রূপে হয় না। ঋতু বদলও হয় নিয়মমাফিক মাস গুনে। কিন্তু বর্ষা এসে হঠাৎ জবরদখল করে নেয় গ্রীষ্মের রাজত্বকে। জয়ঢাক বাজিয়ে সে তার আগমন বার্তা জানান দেয় এবং শীঘ্রই আসমুদ্রহিমালয় সমগ্র দেশের উপরে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে ফেলে। মানুষের মননে প্রবেশ করে প্লাবনভীতি। 

আবহমান কাল ধরেই নদীমাতৃক আমাদের এই বাংলার মানুষ বন্যা নামক দুর্যোগের সাথে সুপরিচিত। বন্যার শিকারও বটে। মৌসুমী জলবায়ুর অন্তর্গত অঞ্চলে অবস্থিত আমাদের বঙ্গদেশ। ফলত দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে প্রবল বৃষ্টিপাত এ দেশের মাটিতে অপরিচিত নয়। আষাঢ়-শ্রাবণ মাস জুড়ে বৃষ্টিপাত বাংলার নদী নালা খাল বিল ছাপিয়ে তোলে। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় তখনই, যখন নদীর কূল ছাপিয়ে বর্ষার জল কোনও বাধানিষেধ না মেনে মানব জীবনের আবাসিক এলাকায় প্রবেশ করে বাড়িঘর রাস্তাঘাট সর্ষের ক্ষেত ছাপিয়ে প্লাবিত করে। 

বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় দেখা দিয়েছে জলস্ফীতি এবং প্লাবন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। জলমগ্ন হয়েছে পশ্চিম মেদিনীপুর, পূর্ব মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, বীরভূম, দুই বর্ধমান এবং নদীয়ার কিছু অংশ। ডিভিসি'র জল ছাড়াতে বাঁকুড়ার বিস্তীর্ণ এলাকায় প্লাবন পরিস্থিতি চোখ রাঙাচ্ছে। বাঁকুড়ার সোনামুখী ব্লক জলে ভেসে গেছে। বহু মানুষ ঘরছাড়া। মাইথন এবং পাঞ্চেত জলাধার থেকে প্রায় তিন লক্ষ কিউসেক জল ছাড়া হয়েছে। সে কারণেই বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটেছে রাজ্যে। যদিও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর তৎপরতায় এবং পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে ডিভিসি জল ছাড়ার পরিমাণ হালে কিছুটা কমিয়েছে। অন্যদিকে কংসাবতী নদীর বাঁধ ভেঙে প্লাবিত পশ্চিম মেদিনীপুরের ডেবরা ও দাসপুরের বিস্তীর্ণ এলাকা। জলের তোড়ে হু হু করে জল ঢুকছে বহু বাড়িতে। জলমগ্ন বেশ কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দারা। পূর্ব মেদিনীপুরের পাঁশকুড়াতেও পরিস্থিতি বেশ জটিল। ১৮ সেপ্টেম্বর ভোর রাত থেকে কাসাই নদীর বাঁধ ভেঙে বন্যার সৃষ্টি হয়েছে সেখানে। নিম্নচাপ পরিস্থিতিকে আরও ভয়ানক করে তুলেছে। আস্ত পাকা বাড়ি তলিয়ে গিয়েছে। আশ্রয়হীন মানুষ রাস্তায় বা কখনও আশ্রয় কেন্দ্রে দিন যাপন করছেন। উঁচু এলাকার স্কুলগুলি খোলা হয়েছে আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে। সেই সমস্ত এলাকায় স্কুল অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ। ছেদ পড়েছে স্কুলের পরীক্ষাতেও। পশ্চিম মেদিনীপুরের চন্দ্রকোনা ও ঘাটাল, হুগলির খানাকুল ও আরামবাগ, হাওড়ার উদয়নারায়ণপুর ও আমতা, বীরভূমের ইলামবাজার সহ কিছু এলাকাতে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। শিলাবতীর জলে ঘাটাল থানা সহ বিস্তীর্ণ এলাকা জলে নিমজ্জিত। এমতাবস্থায় প্রশ্ন উঠছে ঘাটাল মাস্টারপ্ল্যান নিয়েও। প্রশাসনিক তৎপরতা ও সদিচ্ছা প্রশ্নের মুখে। 

বীরভূমে বাঁধ ভেঙে কুঁয়ে নদীর জল ঢুকেছে বাড়িঘরগুলিতে। মুর্শিদাবাদের বড়ঞাতে মায়ের সাথে ত্রাণ নিতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছে এক নাবালিকা। ‌ মৃত্যু হয়েছে একাধিক মানুষের। বৃষ্টি ও ক্রমাগত বাঁধের জল ছাড়ায় পরিস্থিতি ভীষণ ভীতিদায়ক। অন্যদিকে হাওয়া অফিস আভাস দিয়েছে, ২৩ সেপ্টেম্বর উত্তর-পশ্চিম এবং সংলগ্ন মধ্য বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ তৈরি হতে পারে। ফলত, বৃষ্টির আশঙ্কা দক্ষিণের জেলাগুলিতে বেড়েই চলেছে। ফের যদি প্রবল বৃষ্টিপাত শুরু হয় পরিস্থিতির অবনতি অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে।

বন্যা যে কেবল প্রকৃতি সৃষ্ট একটি দুর্যোগ তা বলা সম্পূর্ণভাবে সঠিক নয়। প্রকৃতি চলে প্রকৃতির নিয়মেই। কিন্তু মানব সমাজে লোভের পরিমাণ মাত্রাহীন হয়ে পড়লে সে তার লিপ্সা পরিপূর্ণ করার নিমিত্তে প্রাকৃতিক সম্পদকে আত্মসাৎ করতেও পিছপা হয় না। কাজেই বিভিন্ন প্রকৃতি-বিরুদ্ধ কার্যকলাপের হিস্যাদার হয়ে ওঠে মানবজাতির লোভাতুর দল অনায়াসেই। প্রকৃতির দুর্যোগ সেরে উঠতে পারে প্রকৃতিতেই। কিন্তু গত দশক-শতক ধরে নির্বিচারে পুকুর খাল বিল ইত্যাদি ভরাট বন্যার ঘটনা ও প্রকোপ উভয়কেই যেন কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। তার ওপর রয়েছে সুপরিকল্পনাবিহীন রাস্তাঘাট ও নিকাশি ব্যবস্থার অপর্যাপ্ত ব্যবস্থাপনা। প্রকৃতির চিরাচরিত জলচক্র, লোকসৃষ্ট প্রকৃতি বিনাশ ইত্যাদির ফলস্বরূপ আমাদের দেশে বন্যা একটি বাৎসরিক দুর্বিপাকের মতো হয়ে উঠেছে - 

'আষাঢ় মাসে বান ডেকেছে বাঁধ ভেঙেছে হায়/ বানের জলে ঘরবাড়ি আজ ভেসে বুঝি যায়।' 

বন্যার কবলে পড়ে মাঠঘাট বাড়ি-দোকান সবই জলের নিচে ঠাঁই পেয়েছে। চারিদিকে তাকালে বিস্তীর্ণ জলমগ্ন ভূমি ছাড়া আর কিছুই দৃষ্টিগোচর হয় না। দিন-সপ্তাহ তো দূরের কথা, এক রাতের ফারাকে জনজীবন সম্পূর্ণভাবে ওলটপালট হয়ে যায়। রাতে যে ঘরের নিশ্চিন্ত বিছানায় মানুষ সারা দিনের ক্লান্তি নিরসনের হেতু নিদ্রাদেবীর কোলে মাথা রেখে নিশ্চিদ্র ঘুমের কোলে ঢলে পড়ে, সকালে চোখ খুললেই সব শেষ। দেখা যায়, পাশের পুকুরের জলরাশি তার ঘরে ঢুকে পড়েছে। চোখের জল আর বন্যার জল মিলেমিশে একাকার হয়ে ওঠে নির্নিমেষে। বসতবাড়ি হয়ে ওঠে সমুদ্রময়। শহর থেকে শহরান্তর, গ্রাম থেকে গ্রামান্তর ভেসে যায়। বিনা গত্যন্তর, উপায়ান্তরে বানভাসি মানুষের দিন-রাত কাটে উন্মুক্ত আকাশের নিচে; অথবা সামান্য আশ্রয় খুঁজে নেয় গাছের ডালে, পাকা বাড়ির ছাদে, রেলের প্লাটফর্মের উপরে। মানুষের সহাবস্থান হয় প্রকৃতির আদিম মানুষের মতো সাপ-শেয়াল-কুকুরের সান্নিধ্যে। জলস্রোতের মতোই ভেসে চলে মানব জীবনের স্রোত। জীবন মুহূর্তেই হয়ে পড়ে নিরাপত্তাহীন। সভ্যতার আরম্ভ যেন নিমেষেই উধাও হয়ে মানুষকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় সেই বন্য আদিমতায়, ছাদবিহীন ঠিকানায়।

প্রকৃতির নিয়মে বর্ষা নামবে, পুকুর নদী ভরিয়ে তুলবে, তা স্বাভাবিক এবং প্রাকৃতিক। কিন্তু মনুষ্য-সৃষ্ট কারণগুলিই বন্যার প্রকোপকে বাড়িয়ে তোলে। সুদীর্ঘকাল যাবৎ এ রাজ্যের ও দেশের মানুষ বন্যা নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টায় সরব। কিন্তু যে চেষ্টা পথভ্রষ্ট তা যে সাফল্য পাবে না, সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। রাজ্যের ভরাট হয়ে যাওয়া নদী ও পুকুর খাল বিল জলাশয়গুলিকে খনন করে তাদের নাব্যতা বাড়ানো অবশ্য করণীয় একটি কাজ। এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কাজ করা হয়েছে নদীয়া জেলার চাকদহ ব্লকের বুড়িগঙ্গা সংস্কারের মাধ্যমে। এরূপ কাজ কি আরও আবশ্যিক নয় বন্যার দাপটকে হ্রাস করবার উদ্দেশ্যে? প্রশাসনের সদিচ্ছা ও নাগরিক সহযোগিতার মাধ্যমে তা অবশ্যই করা সম্ভব। সাথে প্রয়োজন প্রচুর পরিমাণে খাল ও নালাতে সুচারু নিকাশি ব্যবস্থা যাতে বৃষ্টির জল দ্রুত নদীতে পতিত হতে পারে। বড় বড় নদীতে বাঁধ দিয়ে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলকে বন্যার প্রকোপ থেকে রক্ষা করতে হবে। সে ক্ষেত্রে বলতে হয়, বাঁধ নির্মাণ করার আগে প্রাকৃতিক ও বৈজ্ঞানিক যুক্তি সমূহকে প্রাধান্য দেওয়া প্রয়োজন। বাঁধের জল যাতে অন্য অঞ্চলকে প্লাবিত না করে সেদিকে বিশেষ নজর রাখতে হবে। 

বন্যার প্রভাব শুধু যে মানুষকে বাস্তুচ্যুত করে তাই নয়, খাদ্যাভাব, পানীয় জলের সংকট, রোগব্যাধি, হীনম্মন্যতা, শিক্ষায় ছেদ, কর্মবিরতি বা কর্মচ্যুতি মানুষকে এক সার্বিক সংকটের দিকে ঠেলে দেয়। ঘর-বাড়ির সাথে সাথে বিনষ্ট হয় বিস্তীর্ণ ফসলের ক্ষেত। খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি একটি অনিবার্য আপত্তি রূপে প্রকট হয়। দূষিত জল বয়ে আনে কলেরা, টাইফয়েড, ডায়েরিয়া প্রভৃতি রোগ। পানীয় জলের অভাবে মানুষের জীবন হয়ে পড়ে দুর্বিষহ। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির অভাব হয় আরও তীব্র। মানুষ দরিদ্র থেকে আরও দরিদ্র হতে থাকে। বন্যা-ত্রাসিত মানুষের দুর্দশা সত্যিই অনির্বচনীয়। তবুও যদি বলতেই হয় তাহলে বলা যায়-- 

'ডুবল রে ক্ষেত বসত ভিটে চারদিক জলে ভরা/ নিভলো আশার প্রদীপগুলো যত্ন করে গড়া।'


Friday 20 September 2024

ফ্যাসিবাদ পরবর্তী বাংলাদেশ

এক গণতান্ত্রিক ও স্থিতিশীল সমাজ গঠনের চ্যালেঞ্জ

শাহেদ শুভো



বাংলাদেশের ৫ অগস্ট'এর গণ অভ্যুত্থান কি বেহাত বিপ্লব? এই আলাপ ৫ অগস্ট পরবর্তী পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের একটা অংশ প্রশ্ন করছে। এই প্রশ্নের উত্তর আমি নিজে কয়েকবার খোঁজার চেষ্টা করেছি। শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসন, তার তৈরি বাহিনীর গুম খুন, লুঠপাট দুর্নীতি রুখতে গিয়ে ছাত্র জনতা কি আরেকটা অপশাসনের পথ সুগম করল? এরকম প্রশ্ন বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজে ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্রশ্ন করা, কাঠগড়ায় দাঁড় করানো অনেক সহজ, কিন্তু এই আন্দোলনের স্পিরিটকে ধারণ করে হাসিনা পরবর্তী শাসনকে বুঝতে পারা তখনই কঠিন, যখন কিনা এই আন্দোলনের আবেগ আমার চিন্তাকে অন্ধ করে দিতে পারে।

বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদ পতনের পর একটি 'ট্যাগিং' প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, যেখানে সাংস্কৃতিক কর্মী এবং বুদ্ধিজীবীদের ওপর লক্ষ রাখা হচ্ছে যারা ফ্যাসিস্ট শাসনে সংযুক্ত ছিল। এই ব্যক্তিবর্গ এবং সংগঠনগুলোকে অভিযুক্ত করা হয়েছে বিদেশি সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর সাথে মিলিত হয়ে এমন এক আদর্শ প্রচারের জন্য, যা ওই শাসনের বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক ভিত্তি গড়ে তুলেছিল। এই সমালোচনা বিশেষভাবে তীব্র হয়েছিল ৫ অগস্টের রাজনৈতিক সংকটের পরে। তারা যে রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক আদর্শ সমর্থন করেছিল, তা অবশ্যই অবমাননাকর প্রমাণিত হয়েছে; তবে এমন লেবেলিং-এর দীর্ঘমেয়াদী পরিণতি নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।

যদিও এই ব্যক্তি ও গোষ্ঠীগুলোকে একঘরে করে ফেলা হয়েছে, তবু বিতর্ক রয়েছে যে তাদের কেবল অভিযুক্ত করেই কি একটি স্থিতিশীল ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়ার সক্ষমতা অর্জন সম্ভব! এখানে চ্যালেঞ্জটি হল, তাদের অতীতের ফ্যাসিবাদে জড়িত থাকার বিষয়ে সঠিকভাবে বিচার করার সঙ্গে সঙ্গে একটি সম্ভাব্য নব্য ফ্যাসিস্ট মতাদর্শের বিকাশকে ঠেকানো। এমনতর গতিবিধি, যা পৃথিবীর বিভিন্ন ফ্যাসিবাদোত্তর সমাজে দেখা যায়, উদ্বেগ সৃষ্টি করে যে এক ধরনের কর্তৃত্ববাদকে প্রতিহত করতে গিয়ে অন্য কোনও ধরনের কর্তৃত্ববাদ আবার মাথা না তোলে। মূল প্রশ্ন, ঘৃণা এবং একঘরে করার কুচক্রে না জড়িয়ে একটি সমাজ কি সত্যিই এগোতে পারে? ঐক্য এবং স্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে পারে?

ফ্যাসিবাদ পতনের পর পৃথিবীর অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় যে, সমাজগুলো প্রায়শই অত্যাচারী শাসনের সমর্থনকারী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বিচার প্রক্রিয়া চালায়। তবে এই প্রক্রিয়া অবশ্যই সাবধানে পরিচালিত হওয়া উচিত, যেন কোনও নতুন রূপে কর্তৃত্ববাদের পুনরুত্থান না ঘটে। এসব সমাজ থেকে প্রাপ্ত শিক্ষাগুলো দেখায় যে, জবাবদিহিতা এবং পুনর্মিলন প্রক্রিয়ার মধ্যে একটি ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে যাতে ভবিষ্যতে নব্য ফ্যাসিবাদ বা অন্যান্য চরমপন্থার বৃদ্ধি প্রতিরোধ করা যায়। আমরা জানি, পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ফ্যাসিবাদের পতন শুধুমাত্র রাজনৈতিক নেতাদের জন্য নয়, বরং যারা ফ্যাসিবাদী মতাদর্শের সাথে যুক্ত ছিল, সেইসব লেখক, কবি, বুদ্ধিজীবী ও চলচ্চিত্র নির্মাতাদের জন্যও সুদূরপ্রসারী পরিণতি নিয়ে এসেছিল। ফ্যাসিবাদী শাসনগুলো ভেঙে পড়ার সাথে সাথে যারা একসময় এই সামরিক ব্যবস্থাগুলোকে সমর্থন করেছিল, তারা পেশাগত ভাবে একঘরে হওয়া থেকে শুরু করে ফৌজদারি বিচার পর্যন্ত বিভিন্ন মাত্রার প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হয়েছিল। তাদের উত্তরাধিকার ফ্যাসিবাদের সাথে সংশ্লিষ্ট থাকার কারণে কলঙ্কিত হয়েছিল, যা তাদের কর্মজীবন, খ্যাতি এবং সামাজিক অবস্থানকে প্রভাবিত করেছে। ইউরোপে তাদের মধ্যে অনেককে ফ্যাসিবাদী শক্তির সাথে সহযোগিতার অভিযোগে বিচারের সম্মুখীন করা হয়েছিল, বিশেষ করে ফ্রান্স এবং ইতালির মতো দেশে, যেখানে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের শত্রুকে সহায়তা করা বা এমন মতাদর্শ প্রচার করার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছিল যা হলোকাস্ট ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতো অত্যাচারের জন্য দায়ী ছিল।

ইতালি: ১৯৪৩ সালে মুসোলিনির শাসনের পতনের পর তার অনেক সমর্থককে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া বা কারাগারে পাঠানো হয়েছিল। যারা প্রকাশ্যে ফ্যাসিবাদ সমর্থন করেছিলেন, যেমন কবি গ্যাব্রিয়েল ডি'আন্নুনজিও এবং এজরা পাউন্ড, তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ বিভিন্ন পরিণতির সম্মুখীন হয়েছিলেন। পাউন্ড একজন আমেরিকান কবি, যিনি মুসোলিনিকে সমর্থন করেছিলেন, তাঁকে মার্কিন সরকার গ্রেফতার করে।  

জার্মানি: যারা প্রথমে নাৎসিদের সমর্থন করেছিলেন, যেমন গটফ্রিড বেন, তাঁদের কাজ এবং খ্যাতি স্থায়ীভাবে কলঙ্কিত হয়ে যায়। নোবেল বিজয়ী ক্নুত হ্যামসুন, যিনি হিটলারের একজন শক্তিশালী সমর্থক ছিলেন, যুদ্ধের পরে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছিলেন এবং তাঁকে মানসিকভাবে অক্ষম বলে ঘোষণা করা হয়েছিল।

স্পেন: ফ্রাঙ্কোর শাসন ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত টিকে থাকায় অনেক বুদ্ধিজীবী যারা ফ্যাসিবাদী সরকারকে সমর্থন করেছিলেন তাঁরা ক্ষমতায় রয়ে গিয়েছিলেন। তবে ফ্রাঙ্কোর মৃত্যুর পর তাঁরা স্পেনের গণতান্ত্রিক উত্তরণের সময় ব্যাপক নিন্দা এবং প্রভাব হারানোর সম্মুখীন হন। 

ব্যক্তিগত ভাবে আমি নির্মোহ ভাবে বুঝতে চেষ্টা করছি, আসলে আমাদের দেশে এই যে কিছু অশান্তি ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে, এর কারণ কী? আমি যখন এই লেখাটি লিখছি, সারা রাত আমার নির্ঘুম কেটেছে। গতকাল বাংলাদেশের অন্যতম বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা তোফাজ্জল নামে একজন মানসিক প্রতিবন্ধী মানুষকে পেট পুরে ভাত খাইয়ে নির্মম ভাবে হত্যা করেছে! এই পাশবিকতা যখন সামাজিক মাধ্যমে দেখছি, স্রেফ নিজেকে একজন 'মেটামরফসিস' মনে হচ্ছে! কী হচ্ছে, কেন হচ্ছে, চারপাশে এমন এক অস্থিরতা, সবাই বলতে চায়, কিন্তু শুনতে কেউ চায় না! রাজধানীর হলগুলোতে প্রচুর জ্ঞানালাপ চলছে - সংবিধান সংস্কার না পুনর্লিখন? কীভাবে রাষ্ট্র সংস্কার করা যায়? সাংস্কৃতিক সংগঠন, চলচ্চিত্রকর্মী, নাট্যকর্মী, শিল্পকলায় বাছাই চলছে, আপনি ফ্যাসিবাদের পক্ষে না বিপক্ষে ছিলেন! ভিতরে ভিতরে এক একটা ক্ষুদ্র গোষ্ঠীতন্ত্র জাগ্রত হচ্ছে! তারাই মূলত বুদ্ধিবৃত্তিক সেমিনার করছে, আন্দোলনের বুদ্ধিবৃত্তিক মালিকানার দাবি করছে। ওদিকে আমার পাহাড়ে বাঙালি-আদিবাসী সংঘাত শুরু হয়েছে, পাহাড়ীদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, সামাজিক মাধ্যমে সেনাবাহিনীর নিগ্রহের চিত্র কিছু ছড়িয়ে পড়েছে, সেনাবাহিনীকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য বিচারবিভাগীয় ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এই বিষয়ে একদলের সমর্থন আছে আবার অনেকেই ভুল পদক্ষেপ বলছে! কিন্তু এটা সত্য যে ৫ অগস্ট'এর পর অনেক পুলিশ সদস্য কাজে যোগদান করেনি। আবার এও অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আন্দোলনের সময় পুলিশ বাহিনী ছাত্র জনতার উপর নির্মম আক্রমণ, শিশু-কিশোর, তরুণদের নির্মমভাবে হত্যা, স্নাইপার দিয়ে টার্গেট কিলিং, এমন কি ৫ তারিখ আশুলিয়াই'এ আন্দোলনকারী ছাত্রজনতার লাশ পুড়িয়ে ফেলার মতো নির্মম ঘটনাও ঘটিয়েছে। ৫ থেকে ৮ অগস্ট দেশে কার্যকর সরকার না থাকার সুযোগে একদল সুযোগ-সন্ধানী জনগণের সম্পত্তি লুঠপাট ও দখল করেছে। কতিপয় অংশ এটাকে রাজনৈতিক রং লাগালেও প্রশ্ন উঠেছে, রাজনীতি আর লুঠ কি এক জিনিস? আওয়ামী লীগ'এর নেতা-কর্মীদের মধ্যে এক ধরনের প্রচারনা ছিল, তারা ক্ষমতা হারালে নাকি প্রায় ৭ লক্ষ মানুষ মারা যাবে, হিন্দু বাড়িঘর মন্দির সব পুড়িয়ে ফেলবে। কিন্তু হাসিনার পতনের পর কি এমন কিছু ঘটেছে? যে দুদিন কার্যত কোনও সরকার ছিল না, সেই দুদিন যে সব ভাঙচুর, হামলা হয়েছে, তার মধ্যে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ দৈনিক 'প্রথম আলো' লিখেছে, রাজনৈতিক সহিংসতায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ২ জন নিহত, ৫-২০ অগস্টের মধ্যে তাদের হাজারের কাছাকাছি সম্পদ আক্রান্ত; যদিও কিছু কিছু সংবাদকে এএফপি'র ফ্যাক্ট চেকার ভুল সংবাদ হিসেবে চিহ্নিত  করেছে।

এসব কিছুর পরেও আমরা ধরে নিই যে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর হামলা হয়েছে বেশ কিছু জায়গায়; যদিও অনেক ঘটনার থেকে ভিতরের ঘটনা ভিন্ন এই অর্থে যে, যতখানি না ধর্মীয় পরিচয়, তার থেকে বেশি রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে আক্রান্ত হতে হয়েছে। যদিও আমি মনে করি, যে ঘটনাগুলো ঘটেছে সেগুলো অবশ্যই অনভিপ্রেত, কিন্তু সেই সময় থেকে এই আন্দোলনকারী ছাত্রদের মধ্যে একটা অস্বীকারতন্ত্র চালু হল। ফলে, একটা সামাজিক বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন কীভাবে একটা রাজনৈতিক ও স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনে পরিণতি পেল এবং এই পরিণতি যে সুদীর্ঘ এক সংগ্রামের ফসল, শুধুমাত্র এক মাসের লড়াইয়ের ফল না, সেটা এই আন্দোলনে জয়ী বুদ্ধিবৃত্তিক ছাত্ররা মনে হয় ভুলতে শুরু করেছে; মনে হচ্ছে, ছাত্ররা যেন জনতার সাথে আর রাজনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে পারছে না। জনতা ইনভিজিবল হয়ে যাচ্ছে। একইভাবে যে মাদ্রাসার ছাত্ররা মন্দির পাহারা দিচ্ছিল তারা সেখানে আবার নামাজ পর্যন্ত পড়েছে! ইসলামী রাজনৈতিক দল সংখ্যালঘুদের বলছে, যত খুশি মূর্তি বানান, আবার তাদেরই অন্য কোনও চিন্তাধারার সংঘবদ্ধ শক্তি মাজারগুলোতে হামলা চালাচ্ছে; গরিব, পাগল, সাধারণের আস্থার জায়গা মাজার আক্রান্ত হচ্ছে, অনেক মাজারের স্থাপনা গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। অথচ এই অবস্থায় রাষ্ট্র তার অবস্থান পরিষ্কার করছে না। কী অদ্ভুত দ্বৈত চরিত্র।

ড. ইউনুস এবং তাঁর উপদেষ্টা পরিষদের প্রতি মানুষের আস্থা আছে। তাঁর উপদেষ্টা চয়নের প্রতিও মানুষের সম্মতি আছে। এও বাস্তব, মাত্র দেড় মাসে গত ১৬ বছরের ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান ও অর্থনীতির উন্নতি সাধন সম্ভব নয়। তবে মনে রাখতে হবে, এই সরকার কোনও রাজনৈতিক মতাদর্শিক সরকার নয়, এরা বাংলাদেশের সবচেয়ে বুর্জোয়া এলিট প্রতিনিধিত্বকারীদের সাথে ছাত্র প্রতিনিধিদের মিলিত সরকার। তাই, ছাত্রসমাজ এই আন্দোলনে দৃশ্যমান বি-রাজনৈতিক পরিচয়ে যুক্ত হলেও তারা বেশ কয়েকটা ক্ষুদ্র বুদ্ধিবৃত্তিক সংঘের প্রতিনিধিত্বকারী; সাথে দৃশ্যমান না হলেও আমলাতন্ত্র এবং সেনাবাহিনীরও একটা যোগ আছে, যেটা আসলে অস্বীকার করার সুযোগ নেই। প্রশ্ন হচ্ছে, এই ছাত্র প্রতিনিধিদের রাজনীতি কী? 

ইতিমধ্যে একজন ছাত্র প্রতিনিধি-উপদেষ্টাকে মিডিয়া প্রশ্নবিদ্ধ করেছে 'মাস্টারমাইন্ড' শব্দে, যদিও এই শব্দ আপত্তিকর, কিন্তু বাংলাদেশের বড় অংশ মানুষ জানে না এদের রাজনীতি কী! এদের বি-রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্যে কি আরেকটা রাজনীতিকে প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া আছে? জনমনে প্রশ্ন, ১/১১'এর 'মাইনাস টু ফর্মুলা' যেটা ব্যর্থ হয়েছিল, সেই প্রক্রিয়া এখনও সক্রিয় কিনা! বলাই বাহুল্য, শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা তার দলের এবং বাঙালি জাতিবাদী চিন্তাশক্তির পরাজয় ঘটিয়েছে। বাঙালি জাতিবাদ আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দোহাই দিয়ে গুম খুন, লুঠপাটের সম্মতি স্থাপন মানুষ ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করেছে, আবার হাসিনার পতনের পর বিএনপি'র রাজনীতিকে খুব সুচতুর ভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে। অথচ এই দলটি গণমুখি হয়ে উঠেছে গত ১৫ বছরে। একটা মতাদর্শ-বিরোধী রাজনৈতিক দল কীভাবে আস্তে আস্তে সংগ্রামের মাধ্যমে একটা গণমুখি দলের প্রক্রিয়ায় যুক্ত হচ্ছে, এটা অবশ্যই আলোচনার দাবি রাখে। দেখা যাচ্ছে, তাদের দলের ৩১ দফা যেটাকে  তারা 'রেইনবো নেশন' বলছে, তাদের সাথে যুক্ত হচ্ছে বেশ কিছু বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল, আবার তারা ইসলামি দলগুলোর সাথে দূরত্বও রাখছে! কিন্তু কেমন যেন অনেকেই বলছে, অবাধ নির্বাচন হলে বিএনপি জিতে যাবে, এই ভয়ে হাসিনা কোনওদিন সুষ্ঠু ভোট হতে দেয়নি, আর বিএনপি'র সাথে জামাতের নাম জুড়ে বিএনপিকে ক্রুসিফাই করেছে। কিন্তু কেউ কেউ বলছে, এই ছাত্র সমন্বয়কেরাও বিএনপি'র রাজনীতিকে চ্যালেঞ্জ মনে করছে! 

এদিকে বামপন্থী প্রগতিবাদী সংস্কৃতিও প্রশ্নবিদ্ধ। বাঙালি সংস্কৃতির আড়ালে একটা পেটি বুর্জোয়া রাজনীতির পরিণতি হয়তো বাংলাদেশের বামপন্থার ইতিহাসে লেখা থাকবে। একজন ব্যক্তি মানুষের বক্তব্য ও জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে তাদের যে উদ্বেগ এবং আচরণ, তার আড়ালে রয়েছে আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনের অপচেষ্টা। আবার উর্দু ভাষীদের এক আয়োজনে জিন্নাহ'কে নিয়ে যে সাম্প্রতিক ঘোষণাটি শোনা গেল, সেটাকে সরকারের সিদ্ধান্ত বলে চালাবার চেষ্টা চলেছে। 

সব মিলিয়ে প্রশ্ন উঠছে, রাষ্ট্র কি এক অভিজাততন্ত্র থেকে আরেক অভিজাততন্ত্রের হাতে চলে যাচ্ছে? তবে নানা ধরনের কথাবার্তা, তর্কবিতর্ক ও মানুষের লড়াইও চলমান। ইতালির ফ্যাসিস্ট মুসোলিনি'র অনুসারী কবি এজরা পাউন্ড লিখেছিলেন, 'We are chained by our own stupidity.'।


Wednesday 18 September 2024

'বন্ধুসুলভ আগুন'

'বাড়িতে মা-বোন নেই?'

শ্রীপর্ণা চক্রবর্তী



জীবনানন্দ লিখেছিলেন,

“মৃত্যুর আগে কি এ পৃথিবী থেকে সমস্ত সুন্দর মুছে যাবে?

যারা শান্তির নিকেতনে বাস করতে জানত,

তারা তো অস্তিত্বের নির্যাস হারাল যুদ্ধের ধোঁয়ায়।”

গত অগস্টের গোড়ার দিকেই কলকাতার এক নামী সরকারি চিকিৎসালয়ে কর্মরত অবস্থায় ভোর রাতে চিকিৎসকের ধর্ষণ-মৃত্যু বা মৃত্যু-ধর্ষণ এবং সেই প্রেক্ষিতে আন্দোলন, ঘটনার মাস খানেক পরেও প্রায় সম-লয়ে দৈনন্দিনকে আন্দোলিত করে চলেছে। বিচার অবিচারের শঙ্কা, ভিন্ন স্তরীয় ও ভিন্ন শ্রেণিয় মানুষের দাবিদাওয়া, শিক্ষানবিশ চিকিৎসকদের দফা দফা আবদারে আরেক দফার মাসখানেক ব্যাপী সফল কর্মবিরতি - সবের অন্বয়েই কলিকাতা চলিতেছে নড়িতে নড়িতে। হিঁদু বাঙালির বচ্ছরকার উৎসব দুর্গাপুজোও প্রায় দুয়ারে সমাগত, বিপ্লবে উৎসব যাপন নাকি বিচার পরিণতি না পাওয়া ইস্তক যাপন পরিত্যাগ, তা নিয়েও স্বআরোপিত উচ্চ মননের বাঙালির মন দোদুল্যমান। পুজো এবং ভোট ব্যতিরেক বাঙালির এ হেন বিচলতা দেখে হঠাৎ করে মনে হতেই পারে তার অকল্পনীয় ব্যথা পাওয়া মৃতদেহের কল্পিত চিত্রখানি এখানে 'কিউ'এর ভূমিকায় আসীন এবং ব্রেক শটটিও দুর্দান্ত সফল! অথচ, এত্ত সব কিছুর মধ্যে যে বিষয়টা একেবারে বিলীন হয়ে গেল তা হল নারী নির্যাতন, পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিতে নারীর অবস্থান এবং সেই প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রের ভূমিকা।

সেই অগস্টেরই অন্তিমে হরিয়ানার ফারিদাবাদে উনিশ/কুড়ির এক তরুণের গাড়ি ধাওয়া করে তাকে হত্যা করা হয় গরু পাচারকারী সন্দেহে। বর্তমান ভারতে, সুনির্দিষ্ট করে বললে গো-বলয়ে, তা চমকপ্রদ কোনও ঘটনাই নয়। তবু নজর কাড়ে যখন জানা যায়, হত্যাকারী কিশোরের বাবার কাছে করজোড়ে ক্ষমা চায় মুসলমান ভেবে এক ব্রাহ্মণ সন্তানকে হত্যার জন্য! শুধুমাত্র সন্দেহের বসে স্বঘোষিত রক্ষক এক নির্দিষ্ট সংখ্যালঘু জাতিকে হত্যার অধিকার নিজ স্কন্ধে তুলে নেয় প্রশাসনের তোয়াক্কা না করে, কিংবা প্রশাসনের প্রশ্রয়েই। 

শেষ ঘটনাটি দেশের থেকে এট্টু দূরে। প্যারিস অলিম্পিক্সে মহিলাদের ম্যারাথনে অংশ নিয়েছিলেন উগান্ডার অ্যাথলিট রেবেকা। থাকতেন অবশ্য কেনিয়ার এনডেবেসে। সেখানেই জমির মালিকানা সংক্রান্ত বিবাদে তাঁর প্রেমিক আচমকাই তাঁর গায়ে পেট্রল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেন। হাসপাতালে দিন পাঁচেক কাটিয়ে অলিম্পিক্স শেষের এক সপ্তাহের মধ্যে মারা যান তিনি। সেই মৃত্যুর আরও পাঁচদিন পরে মারা যান প্রেমিকটিও। যে অনলে পোড়াতে চেয়েছিলেন শুধুই তাঁর প্রেমিকাকে, সে দহনেই তিনি নিজেও পৃথিবীর মায়া কাটালেন।

তিনটি ঘটনায় কোনও সাদৃশ্য চোখে পড়ে না, চোখে পড়ে না অপ্রচল কিছু। তবু ঘটনাগুলি ব্যতিক্রমী  তার পরবর্তী উপবর্তে - দৈনিক গড়ে ৮৬টি নথিভুক্ত ধর্ষণের দেশে অপরিচিতার তরে এই জন আন্দোলন, পয়স্বিনী রক্ষকই জাতির রক্ষকের দেশে গুলিবিদ্ধ সন্তানের পিতার কাছে ভক্ষকের দোষ মার্জনার ভিক্ষা, আর সব শেষে এক গরিব অনাম্নী দেশের থেকে আসা ৪৪তম স্থানে ম্যারাথনের দৌড় শেষ করা প্রতিযোগিনীর উদ্দেশ্যে প্যারিসের মেয়রের শহরের একটি ক্রীড়াঙ্গন নামাঙ্কিত করার সিদ্ধান্ত।  

যুদ্ধ টুদ্ধ

যুদ্ধ কী তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত। তবে গোদা ভাষায় বললে, নিজ স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে দুই বা ততোধিক দলের মধ্যে ঘটা সহিংস কার্যকলাপই আসলে যুদ্ধ। আবার জর্জ অরওয়েলের ভাষায় বললে, 'War is peace. Freedom is slavery. Ignorance is strength.’। 

এ তো গেল রণকৌশলে সজ্জিত এবং দীক্ষিত মানুষের যুদ্ধের সংজ্ঞা। সুপ্রাচীন যুগ থেকেই এই সকল  যুদ্ধের সেনারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শাসকের বেতনভুক কর্মচারী। তবে আমাদের আলোচনা এ ক্ষেত্রের বাইরে পড়ে থাকা, সেই সব নিজ ভূমে লিঙ্গ-চামড়া-ধর্ম-বর্ণ-অর্থের অথবা আরও অন্য কিছুর ভিত্তিতে হয়ে ওঠা দ্বিতীয় শ্রেণির প্রায় না-মানুষদের বেঁচে থাকার যুদ্ধ নিয়ে। যে লড়াই তাঁরা লড়তে চাননি, কোনও কোনও ক্ষেত্রে তাঁদের এ লড়াইয়ে তাঁদের অস্তিত্ব সম্পর্কেও তাঁরা অজ্ঞাত।    

সামরিক পরিভাষায় 'ফ্রেন্ডলি ফায়ার' বা 'ফ্র্যাত্রীসাইড' খুব অপরিচিত শব্দ নয়। শব্দটির উৎস মধ্য ইংরেজি এবং মধ্যযুগীয় যুদ্ধ থেকে। খুব সম্ভবত প্রথম ব্যবহৃত হয় ১৯১৮ সালে, আমেরিকান সেনাবাহিনীতে। যদিও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে শব্দবন্ধটি জনপ্রিয়তা পায় এবং পরে ভিয়েতনাম যুদ্ধে এর আরও প্রসার ঘটে। যুদ্ধ ক্ষেত্রে ক্কচিৎ কদাচিৎ এমন ঘটনা ঘটে যেখানে শত্রুপক্ষকে আক্রমণ করতে গিয়ে দুর্ঘটনাক্রমে সপক্ষের ওপরই আক্রমণ ঘটে যায়। যুদ্ধের ইতিহাসে এমন উদাহরণ অমেয়। সে গ্রিক-পারস্য যুদ্ধের সময় পারস্যের সম্রাট কিরাসের সৈন্যদের যুদ্ধক্ষেত্রে ভুলবশত নিজেদের সৈন্যদের ওপর আক্রমণ হোক কিংবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নরম্যান্ডি আক্রমণের সময় মিত্রবাহিনীর বিমান হামলায় তাদের নিজস্ব সেনাদের উপর বোমা ফেলা। এমনকি  অধুনাকালে উন্নত প্রযুক্তি সত্ত্বেও এ ধরনের যুদ্ধকালীন দুর্ঘটনার সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্তি যে ঘটেনি তার উদাহরণ পাই হালের ইরাক যুদ্ধে ২০০৩ সালে, ব্রিটিশ সৈন্যদের একটি দল ভুলবশত আমেরিকান সৈন্যদের উপর গুলি চালনায়।   

ফেরা যাক ব্যুৎপত্তি স্থলে। সেই যে হরিয়ানার মাথায় গুলি লাগা তরুণ, তাকে মুসলমান অতএব গো-পাচারকারী ভেবে  প্রায় ধাওয়া করে খুন করে স্বনিয়োজিত গোরক্ষকেরা যে ধর্ম রক্ষার্থে, জাতে ব্রাহ্মণ আরিয়ান মিশ্র ছিলেন সে ধর্মেরই অনুগামী। সেই তরুণীর প্রেমিকও নিশ্চয়ই ভাবেননি নিজে আহত হওয়ার কথা, ভাবলে তিনি আত্মহননের অন্য পন্থা বেছে নিতেন। দু' ক্ষেত্রেই, গোষ্ঠী কিংবা ব্যক্তি পরের ক্ষতি সাধনে নিজ কিংবা নিজ গোষ্ঠীর 'পরে আঘাত হানে। শত্রু-মিত্র পক্ষ এ ক্ষেত্রে সুচিহ্নিত এবং স্পষ্ট। ব্যতিক্রমী এ ক্ষেত্রে ঘটনার সামাজিক বিচারকের ভূমিকা। হত্যকের কাছে মৃতের বাবা জানতে চেয়েছিলেন, মুসলমান হলেও মানুষকে হত্যার অধিকার তাদের কে দিয়েছিল? প্যারিসের মেয়রও চেয়েছিলেন এক সুষম নারী-পুরুষের অবস্থান।

কলকাতার আন্দোলনটি এত সরলরৈখিক নয়। এক নির্দিষ্ট শ্রেণির পুঞ্জীভূত ক্ষোভ আন্দোলনের অবয়ব ধারণ করেছে, সদ্য পুনঃ স্বাধীনতা প্রাপ্ত প্রতিবেশী দেশের আন্দোলনটি উৎসেচকের ভূমিকায়। মেধা এবং বিত্ত দুইয়ের সঙ্গতে যে শ্রেণি দেশের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষকে হীনজ্ঞান করে, তারাও এবার আন্দোলনে এক্কেবারে সামনের সারিতে, বিচারের দাবিতে। যে কোনও সুস্থ গণতন্ত্রে আন্দোলন অপরিহার্য। কিন্তু এ আন্দোলনের গতিবিধি যেন সমাজে এক স্তর ওপরে ওঠার উঁচু মই। আন্দোলনে হাজিরা না দিলে জাত খোয়ানোর শঙ্কা প্রবল। তাই দিনের পর দিন কাটলেও রাজ্যের সরকারি চিকিৎসক শিশুদের (শিশুদের চিকিৎসক নয় কিন্তু) অচলাবস্থা কাটে না। তাঁরা পথে আন্দোলনরত। গড়পড়তা সমাজ ভাবে, হুঁ হুঁ, বাওয়া কী এক বিষম বস্তু চলিতেছে নিশ্চয়ই, তাই স্যালুট ঠোকাই আশু কর্তব্য। প্রশ্ন করার স্পর্ধাই জোটে না কীভাবে তাদের আন্দোলনে ভুরি ভুরি খাবার আসতে পারে এই অভাগা দেশে।  রোগীদের প্রতি দুর্ব্যবহার, মৃতদেহ আটকে দরকষাকষি, ভুল চিকিৎসা, নির্দিষ্ট স্থানেই পরীক্ষার নির্দেশ, অধস্তনদের শ্রমশোষণ, এসব অভিযোগ আন্দোলনে পরিণতি পায় না কখনই। 

আন্দোলনকারীদের মূল দাবি দাওয়ায় অনেক কিছু থাকলেও জোরালো হয় না যৌন শিক্ষা তথা মানুষ গঠনের শিক্ষার দাবি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাই ছোটখাটো কিংবা বড়সড় যৌন হেনস্থাকারীরা শিল্পী, রাজনৈতিক কর্মী, কবি-সাহিত্যিক আন্দোলনের প্রথম সারিতে উপস্থিত। সম্ভবত তাঁরা নিজ ক্ষেত্রে গুণী, অপরাধে সুচারু, তাই আন্দোলনে তাঁদের উপস্থিতি খবর হিসেবে গুরুত্ব বাড়ায়। এছাড়া যৌন হয়রানিকে এক স্বাভাবিক ক্রিয়ার পর্যায়ভুক্ত করাই যেন সমাজের কাজ, তাকে দূরীকরণের আশা বা প্রচেষ্টা কোনওটার প্রয়োজন অনুভব করার দায়টুকুও পরিলক্ষিত হয় না। 

রাস্তাঘাটে একটা কথা প্রায়ই কানে আসে, 'বাড়িতে মা বোন নেই?' অর্থাৎ, মা-বোনকে রক্ষার কাজ  পুরুষের, কিংবা মা-বোন জ্ঞানে কিংবা স্মরণে, ভক্ষণ না করে সংযমের দায় পুরুষের। খেয়াল করলে দেখবেন, এ তালিকায় কখনও বৌ, প্রেমিকা, বন্ধু, শিক্ষিকার উল্লেখ থাকে না। তাত্ত্বিকেরা বলেন, প্রথাগত পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর সম্মান এবং পবিত্রতাকে পরিবার, বিশেষত পুরুষদের সম্মানের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। নারীর সতীত্ব বা পবিত্রতা (বিশেষ করে মা, বোন ও কন্যা) পরিবারে পুরুষ সদস্যদের ক্ষমতার প্রতিফলন হিসেবে দেখা হয়। তাই নারীদের নিয়ে কটূক্তি বা গালি ব্যবহারও পুরুষদের সম্মান আঘাত করার একটি মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়। নারীর ওপর আক্রমণ মানে পুরুষদের সামর্থ্য ও অধিকারকে প্রশ্ন করা। এখানে আক্রমণ মূলত নারীর ওপর নয়, বরং নারীদের নিয়ে পুরুষদের নিয়ন্ত্রণ বা অধিকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করতেই এটি ব্যবহৃত হয়, যা পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা থেকে উদ্ভূত।

এই ভাবনায়, নারীদের ভূমিকা পরিবার বা পুরুষদের সম্মান, প্রজনন বা যৌন পবিত্রতার রূপক হিসেবে দেখা হয়। এ জন্যই আমাদের কথ্য ভাষায় নারীদের অবমাননাকর ভাবে উপস্থাপন করা হয়, যেখানে তাদের মানুষ হিসেবে নয়, বরং সম্পত্তি বা সম্মান রক্ষার মাধ্যম হিসেবে দেখা হয়। অথচ, 'বউ নেই?', এই ধরনের শিক্ষামূলক বাণী শোনা যায় না, বদলে বৌ'কে কিছু করে দেওয়ার হুমকিই প্রচলিত। ব্যাখ্যা হিসেবে বলা যায়, সমাজে স্ত্রীরা স্বামীর পরিবারের একটি সম্পত্তি হিসেবে বিবেচিত আজও। তারা ঠিক সে অর্থে যোনিতে আবদ্ধ, পবিত্রতার প্রতীক নয়। তদুপরি, আমাদের দেশে নিজের স্ত্রীকে ধর্ষণ সম্পূর্ণ ভাবে বৈধ। সমাজের দুর্বল বা নিম্নস্থ হিসাবে বিবেচিতকে আক্রমণ করার ভাষার কাঠামোই এ রূপে  নির্মিত, আর তাই পুরুষদের সম্মানহানি করার জন্য নারীদের ব্যবহার করার প্রয়াস, যা তাদের পরিচয় পুরুষদের সামাজিক অবস্থানের সঙ্গে যুক্ত করে দেয়। 

এবং সমস্যার আকরটিও এখানেই। মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখার এই ঝাড়াই বাছাইয়ের পর্বে কখনও অসচেতনে আবার কখনও স্বেচ্ছাতেই তা আমাদের নিকটজনের ক্ষেত্রেও সেই 'ফ্রেন্ডলি ফায়ার' হয়ে দাঁড়ায়। মা বোন এবং মা বোন সম কেউই শুধু এই 'আমি'টার অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষা পাবে - এই উদ্ভট এবং দ্বৈত মানসিকতা পরিণাম পায় আমার মা-বোন যাদের মা-বোন নয় তাদের দ্বারা আমার মা-বোনের ওপর আক্রমণে। এবং এ অভ্যাসের চরম রূপই লিঙ্গ-ভেদে পারিবারিক ধর্ষণ বা নির্যাতন। যেহেতু ভারতের সিংহভাগ ধর্ষণই  ঘরের মধ্যে এবং চেনা পরিসরে হয়, সে ক্ষেত্রে বলা যায়, আমরা নিজেদের অজান্তেই সমাজে 'ফ্রেন্ডলি ফায়ার' চক্র সৃষ্টি করি, যেখানে নিজেরাই অপরাধী হয়ে উঠি। 

যৌন শিক্ষা ও কিছু কথা

ভারতের মতো সমাজে এই আচরণের মূলে রয়েছে পিতৃতন্ত্র এবং যৌন শিক্ষা, লিঙ্গ সচেতনতা ও  সম্পর্কের নীতি, লিঙ্গ নির্যাতন সম্পর্কিত আইনি পাঠ - এসব  সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণার অভাব। যে কারণে কিশোর-কিশোরীরা সম্মতি এবং সম্পর্কের মর্যাদা নিয়ে বিভ্রান্ত, সম্পর্কের ক্ষেত্রে সম্মান ও সীমারেখা নির্ধারণের ধারণাগুলি অস্পষ্ট। যদিও কিছু রাজ্যে ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে যৌন শিক্ষা প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তবে এখনও তা সার্বজনীনভাবে বাধ্যতামূলক নয়। বহির্বিশ্বে যে ভাবে বিষয়টি দেখা হয় তার কিছু উদাহরণ দিলে হয়তো বোঝা সম্ভব। 

প্রথমেই আসা যাক নেদারল্যান্ডস'এর কথায়। দেশটি যৌন শিক্ষা এবং সম্পর্কের শিক্ষায় বিশ্বের শীর্ষস্থানে রয়েছে। এ দেশের ‘Comprehensive Sex Education’ নামে পরিচিত এই প্রোগ্রামে শিশুদের মধ্যে লিঙ্গসমতা, সম্মান এবং নিজেদের ও অন্যদের সীমাবদ্ধতা সম্মান করার শিক্ষা দেওয়া হয়। সুইডেনে দীর্ঘদিন ধরে সম্পর্কিত শিক্ষার ধারণা চালু; ‘Sex och samlevnad’ নামের এই পাঠ্যক্রম বাচ্চাদের যৌন স্বাস্থ্য, সম্মতি এবং লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে সচেতন করতে উৎসাহিত করে। ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থায় সম্পর্ক এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা একটি বড় অংশ। এখানে শিক্ষার্থীরা কিশোর বয়স থেকেই সম্মতি, যৌন সম্পর্কের সীমা এবং লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা সম্পর্কে শেখে। ইংল্যান্ডে ২০২০ সাল থেকে ‘Relationships and Sex Education (RSE)’ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এই পাঠ্যক্রমের মাধ্যমে স্কুলের শিক্ষার্থীদের সম্মতি, লিঙ্গ সমতা, যৌন হয়রানি এবং সম্পর্কের উন্নয়ন সম্পর্কে শেখানো হয়। 

হয়তো কোনও পন্থাই পূর্ণাঙ্গরূপে সফল নয়, কিন্তু কার্যকর নিশ্চিতভাবেই। পরিসংখ্যান যার প্রমাণ। লিঙ্গ অধ্যয়ন এখন দেশের কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে যদিও, কিন্তু তা সম্ভবত তাত্ত্বিক চর্চার পরিসর ছেড়ে বেরতে পারেনি। অথচ, প্রাথমিক পর্যায় থেকেই লিঙ্গসমতার শিক্ষা ও তার সর্বাত্মক ব্যবহার ভীষণ জরুরি। বোঝা জরুরি, পিতৃতান্ত্রিক সমাজের নারীও পিতৃতন্ত্রেরই বাহক, পিতৃতান্ত্রিক সমাজে প্রান্তিক লিঙ্গ'র মানুষের পাশাপাশি পুরুষও নির্যাতিত হয় এবং যৌন নির্যাতনই এমন এক বিরল অপরাধ যে অপরাধে প্রায় সারা পৃথিবী জুড়েই নিপীড়কের পরিবর্তে নির্যাতিতাকে লজ্জিত তকমা দিয়ে তার পরিচয় গোপন রাখার রাষ্ট্রীয় নিদান দেওয়া হয়।

জার্মান দার্শনিক  Friedrich Nietzsche (Source: Beyond Good and Evil) বলেছিলেন, 'He who fights with monsters should be careful lest he thereby become a monster. And if you gaze long enough into an abyss, the abyss will gaze back into you.'। তাই 'বন্ধুসুলভ আগুন' সর্বাত্মক ভাবে ছড়িয়ে পড়ার আগে একটু সাবধান হই; নচেৎ অচিরেই সেই আগুনে পুড়তে হবে আমাদেরকেই।