Wednesday, 9 July 2025

উত্তাল বিহার

বিহার কি আবারও পথ দেখাবে?

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য

 


গত দু’ শতকের ইতিহাসে অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে অবিভক্ত বিহার বার বার রুখে দাঁড়িয়েছে, বিদ্রোহের ধ্বজা হাতে নিয়েছে। তা ১৮৫৫ সালের সাঁওতাল বিদ্রোহই হোক কি ১৮৯৯'এর মুণ্ডা অভ্যুত্থান, কিংবা ১৯১৭ সালের ঐতিহাসিক চম্পারণ সত্যাগ্রহ বা ১৯২০’র দশকের কিষাণ সভার সংগ্রাম, অথবা ১৯৪২’এর ভারত-ছোড়ো আন্দোলন— জন অংশগ্রহণে বিহার সবসময়েই সামনের সারিতে দাঁড়িয়েছে, স্ফুলিঙ্গকে দাবানলে পরিণত করেছে। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ১৯৭৪’এ জেপি’র ডাকে ‘সম্পূর্ণ ক্রান্তি’ আন্দোলনই হোক কিংবা ১৯৮০’র দশকের গোড়ায় মধ্য বিহার জুড়ে অভূতপূর্ব কৃষক জাগরণ, পারতপক্ষে একেকটা সময়ে স্থবির হয়ে পড়া মানুষের চৈতন্যের দিশারী হয়েছে বিহার।

আজ আবারও কি এই বিপন্ন সময়ে বিহারের উঠে দাঁড়াবার পালা? গোটা দেশ যখন উত্থিত ফ্যাসিবাদের থাবার সামনে কতকটা অসহায়, ছত্রভঙ্গ বা অন্তর্কলহেও দীর্ণ, তখনই বিহারের জনতা এক উপযুক্ত মুহূর্তে— যখন ফ্যাসিবাদ এমনকী গরিব জনতার নির্বাচনী অধিকারকেও কেড়ে নিতে নির্বাচন কমিশনকে হাতের পুতুল বানিয়ে একবগগা আক্রমণে মত্ত— রুখে দাঁড়িয়েছে। আজ ৯ জুলাই (২০২৫) বিহারের হাজারও মানুষ পথে নেমে এসেছেন। এই জনসমাবেশ এক সর্বাত্মক বনধের রূপ পেয়েছে। শুধু তাই নয়, পাটনায় ‘ইন্ডিয়া’ জোটের নেতৃত্বে হাজার হাজার জনতা ঘেরাও করেছে নির্বাচন কমিশনের দফতর— তাদের দাবি, অবিলম্বে SIR (Special Intensive Revision)’এর নামে কোটি কোটি গরিব, পরিযায়ী, দলিত ও আদিবাসীদের নাম ভোটার লিস্ট থেকে বাদ দেওয়ার প্রক্রিয়া বন্ধ করতে হবে।

আমরা দেখেছি, গত মহারাষ্ট্র বিধানসভা নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন রাতারাতি ভোটার তালিকায় জল মিশিয়ে রাজ্যে প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যা থেকে ভোটারের সংখ্যাকে বাড়িয়ে এক অসাধু প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এনডিএ জোটকে ক্ষমতায় আনে। এবারে তারাই বিহারে ভোটার লিস্ট থেকে রাতারাতি লক্ষ লক্ষ মানুষের নাম বাদ দিয়ে আগামী বিধানসভা নির্বাচন তড়িঘড়ি সেরে ফেলতে উলটো কৌশল নিয়েছে। বলাই বাহুল্য, এই প্রক্রিয়াটি ভোটারদের, বিশেষত প্রান্তিক এবং দুর্বল শ্রেণির মানুষকে, ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করার এক সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র।

 

১) সময় নিয়ে প্রশ্ন ও উদ্দেশ্যমূলক

নির্বাচনের এত কাছাকাছি সময়ে এই ধরনের ব্যাপক সংশোধন প্রক্রিয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। নির্বাচন কমিশন হঠাৎ করে প্রায় ২২ বছর পর এই ধরনের নিবিড় সংশোধন প্রক্রিয়া শুরু করেছে, যেখানে ২০০৩ সালের পর আর এমন ব্যাপক সংশোধন হয়নি। স্পষ্ট যে, এই প্রক্রিয়াটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনকে ব্যাহত করতে এবং একটি নির্দিষ্ট দলকে সুবিধা পাইয়ে দিতেই করা হচ্ছে। বিহারে যেহেতু আর কয়েক মাসের মধ্যেই নির্বাচন, তাই এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য যে সময়সীমা দেওয়া হয়েছে, তা সম্পূর্ণ অবাস্তব। এত কম সময়ে প্রায় ৮ কোটি ভোটারের তথ্য যাচাই করা অসম্ভব।

 

২) বিপুল সংখ্যক ভোটারের নাম বাদ পড়ার আশঙ্কা

বিহারের মোট ভোটারের প্রায় ৩৭ শতাংশই পরিযায়ী শ্রমিক, যারা রাজ্যের বাইরে কাজ করেন। উৎসবের সময় তাঁরা বাড়িতে আসেন। বর্তমান নির্দেশিকা অনুযায়ী, তাঁদের নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে জন্ম শংসাপত্র বা অন্যান্য কঠিন নথি জমা দিতে হচ্ছে। অনেক পরিযায়ী শ্রমিক, দলিত, মহাদলিত এবং অন্যান্য প্রান্তিক মানুষের কাছে এই ধরনের নথি না থাকায় তাঁরা ভোটাধিকার হারাতে পারেন। সুপ্রিম কোর্টে দাখিল করা আবেদনগুলিতেও উল্লেখ করা হয়েছে যে, প্রায় ৩ কোটি ভোটারের নাম বাদ পড়তে পারে।

 

৩) নথিপত্র নিয়ে সমস্যা এবং প্রান্তিক মানুষের উপর প্রভাব

আধার কার্ড, রেশন কার্ড, বা মনরেগা কার্ডের মতো সহজলভ্য নথিগুলিকে বৈধ প্রমাণ হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে না। বিহারের গ্রামীণ এলাকার দরিদ্র মানুষের কাছে জন্মের শংসাপত্র বা ১৯৮৭ সালের আগেকার সরকারি পরিচয়পত্রের মতো নথি থাকা অত্যন্ত বিরল। এমন বহু মানুষ আছেন যারা বহু বছর আগেই তাঁদের পরিবারের সদস্যদের হারিয়েছেন, তাঁদের পক্ষে বাবা-মায়ের জন্ম শংসাপত্র বা অন্যান্য নথি জোগাড় করা অসম্ভব। এর ফলে এই প্রক্রিয়াটি প্রান্তিক ও অশিক্ষিত মানুষদের জন্য বিরাট সমস্যা তৈরি করবে এবং তাদের ভোটাধিকার কেড়ে নিতে পারে।

 

৪) প্রক্রিয়াগত ত্রুটি ও আইনের লঙ্ঘন

এই সংশোধন প্রক্রিয়াটি জনপ্রতিনিধিত্ব আইন, ১৯৫০-কে লঙ্ঘন করছে। ভোটার তালিকা থেকে কোনও নাম বাদ দেওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে নোটিশ দিয়ে তাঁর বক্তব্য শোনার সুযোগ দিতে হয়। কিন্তু এই প্রক্রিয়াতে সেই আইন লঙ্ঘন করা হচ্ছে। তাড়াহুড়ো করে এই কাজটি করায় স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে বলেও ইতিমধ্যেই অভিযোগ উঠেছে।

 

৫) এনআরসি’র ছায়া

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সহ অনেক বিরোধী নেতা এই প্রক্রিয়াতে এনআরসি’র ছায়া দেখছেন। বোঝাই যাচ্ছে, এর মাধ্যমে অ-ভারতীয়দের নাম বাদ দেওয়ার অজুহাতে বহু ভারতীয় নাগরিককে নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে বাধ্য করা হবে, যা পরবর্তীতে পুরো প্রক্রিয়াটাকেই ‘জাতীয় নাগরিক পঞ্জী’র দিকে নিয়ে যেতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা, এই প্রক্রিয়ায় ভোটারদের নাগরিকত্বের প্রমাণ এইভাবে আদায় করা অত্যন্ত অনৈতিক ও সংবিধান বিরোধী। ইতিমধ্যেই এ বিষয়ে শীর্ষ আদালতে কয়েকটি মামলা দাখিল হয়েছে।


এই আলোকে অন্তত বিহারে দেখা গেল, ইন্ডিয়া জোট ঐক্যবদ্ধ ভাবে এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে একযোগে পথে নেমেছে। সিপিআই(এমএল) নেতা দীপঙ্কর ভট্টাচার্য এই SIR প্রক্রিয়াকে ‘ভোটবন্দী’ আখ্যা দিয়ে পরিষ্কার জানিয়েছেন, এটি ২০১৬ সালের নোটবন্দীর মতো সাধারণ মানুষের জন্য ট্রমাটিক অভিজ্ঞতা নিয়ে আসবে। তাঁর মূল প্রশ্ন, কেন ২২ বছর পর হঠাৎ করে এই ধরনের ব্যাপক সংশোধন করা হচ্ছে এবং কেন কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা না করেই এটি শুরু করা হল? তাঁর মত, ভোটারদের নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে এমন নথিপত্র চাওয়া হচ্ছে যা বহু সাধারণ মানুষের কাছে নেই, বিশেষ করে জন্ম শংসাপত্রের মতো নথি (এমনকী প্রধানমন্ত্রী মোদিজীরও যা নেই)।


লোকসভার বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধী SIR প্রক্রিয়াকে ‘গরিবদের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়ার ষড়যন্ত্র’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বিহারের বন্যা পরিস্থিতি এবং পরিযায়ী শ্রমিকদের সমস্যার কথা তুলে ধরেছেন, যারা এই মুহূর্তে প্রয়োজনীয় নথি জমা দিতে অক্ষম।


আরজেডি নেতা তেজস্বী যাদব SIR প্রক্রিয়াকে ‘অবৈধ ও অগণতান্ত্রিক’ আখ্যা দিয়েছেন। তাঁর মতে, ২৫ দিনের মধ্যে ৮ কোটি ভোটারের যাচাই হওয়া অসম্ভব, বিশেষ করে যখন প্রায় ৪ কোটি বিহারী রাজ্যের বাইরে থাকেন। তিনি নির্বাচন কমিশনের কাছে আধার কার্ড, রেশন কার্ড ও মনরেগা কার্ডকে বৈধ নথি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানিয়েছেন। তাঁর অভিযোগ, এই প্রক্রিয়া সম্পর্কে নির্বাচন কমিশনের কোনও স্পষ্টতা নেই এবং তাদের জারি করা বিভিন্ন বিজ্ঞপ্তিতে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হচ্ছে। তাঁরও আশঙ্কা, প্রয়োজনীয় ১১টি নথি না থাকায় বহু দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়বে।


দিনের শেষে এই লেখা যখন প্রকাশের মুখে তখন গোটা বিহার জনজোয়ারে অচল হয়ে পড়েছে। নির্বাচন দফতরের অদূরে দাঁড়িয়ে বিরোধী নেতারা তীব্র ভাষায় নির্বাচন কমিশন এবং রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের সমালোচনা করেছেন। তাঁদের মতে, নির্বাচন কমিশন 'একটি রাজনৈতিক দলের শাখা' হিসেবে কাজ করছে এবং 'গুজরাতের দুই ব্যক্তি' বিহারের ভোটারদের ভোটাধিকার নির্ধারণ করছেন। তাঁদের আশঙ্কা, এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ গরিব মানুষের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়লে পরবর্তীতে তাদের রেশন ও পেনশনও বন্ধ হয়ে যেতে পারে।


অবশ্য, সমস্ত জড়তাকে ছিন্ন করে বিহারের জেহানাবাদ থেকে দ্বারভাঙ্গা, আরাড়িয়া থেকে মুজাফফরপুর, নওয়াদা থেকে অরওয়াল— সর্বত্র পথে নেমেছেন মানুষ। চাক্কা জ্যাম’এর ডাক দিয়ে যে আন্দোলনের শুরু তা আজ বিহার বনধ’এ রূপান্তরিত হয়েছে। আগামী দিনে এই আন্দোলন সারা ভারতে প্রভাব ফেলে কিনা, অথবা, নির্বাচন কমিশন কিছুটা নরম হওয়া থেকে শেষমেশ পিছু হঠে কিনা, এসব দেখার রইল। সব থেকে বড় কথা, এই প্রক্রিয়া যদি চালু থাকে, তার অন্তিমে কতজন ভোটারের নাম বাদ গেল, সেও দেখার। তারপর বিহার আবারও অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে কিনা, তা ভবিষ্যৎই বলতে পারবে।


তবে সাধু সাবধান! বিহারের পর এবারে লক্ষ্য পশ্চিমবঙ্গ! আপনার-আমার ভোটাধিকার থাকবে তো?



Thursday, 3 July 2025

যুদ্ধ যখন এক উত্তেজক নেশা

শত্রু কেবল অস্ত্রধারী বহিঃশত্রু নয়

শ্রীপর্ণা চক্রবর্তী



এ লেখা যখন লিখছি, তন্মধ্যে ঘটে গেছে পাহেলগাঁও'এর নৃশংস উপাখ্যানকে কেন্দ্র করে দু' দেশের মধ্যে সম্যক উত্তেজনা। ঘটমান বিশ্ব চর্চিত ইজরায়েল কর্তৃক গাজার হত্যালীলা ছাপিয়ে তাতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে যুক্ত হয়েছে একে একে ইরান, লেবানন ইত্যাদি মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্ৰিকার দেশগুলি এবং বঙ্গ-তথা দেশব্যাপী চিরপরিচিত 'পাকি-মুসলিম' ঘৃণার সঙ্গেই জন্ম নিয়েছে এক নব্য ইজরায়েল প্রেমীর দল। পরিবেশকর্মী গ্রেটা ও তাঁর সহচররা ত্রাণভর্তি (তাদের ভাষ্যে 'প্রতীকী') ম্যাডেলিন জাহাজটিকে নিয়ে গাজা অভিমুখে রওনা দিয়ে ভূমধ্যসাগরের আন্তর্জাতিক জলসীমায় খানিক অবধারিত ভাবেই ইজরায়েলি সেনার হাতে আটক হয়ে অবশেষে তিনি ও আরও তিন সমাজকর্মী অতি দ্রুত সুইডিশ সরকারের কোনওরকম হস্তক্ষেপ ছাড়াই দেশে দেশে প্রত্যার্পিত হয়েছেন।

অধুনা আধুনিকতার মঞ্চে সুশীলতার ধ্বজাধারী বাদবাকি বিশ্বকে ন্যায়-অন্যায়ের পাঠ দেওয়া ইউরোপ ধর্মপ্রচার ও ব্যবসায়ে মুনাফা করার ধান্দায় স্রেফ গায়ের জোরে আমেরিকা, আফ্রিকা ও এশিয়ায় উপনিবেশ স্থাপন করে আর নিজেদের দ্বারা নির্যাতিত ও নিজভূমে অবাঞ্ছিত ইহুদিদের প্যালেস্টাইনের 'পুণ্যভূমি'তে বসিয়ে দিয়ে একদিকে ভেদনীতি ও যুদ্ধব্যবসাকে ধূমায়িত করে, অন্যদিকে ইহুদি-মুসলিমের শান্তিস্থাপনের নাটক করে চলেছে সুদীর্ঘকাল ধরে। প্রকৃতপক্ষে এই সাম্রাজ্যবাদী ও ভোগবাদী ইঙ্গ-মার্কিন তথা পশ্চিমা বিশ্বের মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক (তেল ও বিশ্ব-বাণিজ্য) ঘাঁটি হিসাবেই ইজরায়েল রাষ্ট্রটি গঠিত হয়, যা তাদের মধ্যপ্রাচ্যে ক্ষমতা প্রদর্শন ও অর্থনৈতিক প্রভুত্বের প্রতীক।

অন্যদিকে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পূর্ব পর্বে, প্রধানত ইউরোপ ও পশ্চিম এশিয়ায় উৎসারিত রেসিজম ও অ্যান্টি-সেমিটিসমের নির্মম বলি হয় ইহুদি জনগোষ্ঠী। পশ্চিমা শক্তিসমূহের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় তারা তথাকথিত ‘পিতৃভূমি’র পুনরাধিকার লাভ করে। ফলস্বরূপ, সহস্রাব্দব্যাপী সেই ভূখণ্ডে বাসকারী আরব জনজাতির সঙ্গে তাদের এক অনিবার্য সাংঘর্ষিক সম্পর্কের সূচনা ঘটে। ইসলামের প্রারম্ভ থেকেই আরব ভূখণ্ডে ইহুদিরা আরব জাতির অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বর্তমান ছিল এবং আসমানী কিতাবে ইহুদিদের সৃষ্টির অন্তিমকাল পর্যন্ত একপ্রকার চিরশত্রু রূপেই উপস্থাপন করা হয়েছে। ফলত, এই দ্বন্দ্ব এক পর্যায়ে অবশ্যম্ভাবীভাবে ধর্ম-সংঘর্ষের অবয়ব গ্রহণ করে। এই প্রেক্ষাপটে ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আঙ্গিককে আস্তিনে লুকিয়ে, পশ্চিমা পরাশক্তি সমূহ এই সংঘর্ষকে ধর্মযুদ্ধ তথা ‘গণতন্ত্র বনাম ধর্মীয় মৌলবাদ’— এই মোড়কে উপস্থাপন করতে থাকে; সম্ভবত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, হলোকাস্ট, গণহত্যার মতো তাদের নিজস্ব কলঙ্কময় ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে একপ্রকার প্রতিসাম্য বা নৈতিক পরিশুদ্ধির আকাঙ্ক্ষাও এর অন্তর্লিখিত অভিসন্ধি ছিল।

ইজরায়েল রাষ্ট্রের জন্মলগ্ন থেকেই যুদ্ধ যেন তার ওপর আরোপিত বাস্তবতা হয়ে ওঠে, বিশেষত, আরব রাষ্ট্রসমূহের সম্মিলিত আক্রমণের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের জটিল সংঘাতের সূচনায়। পরবর্তীকালে ইজরায়েল-মার্কিন জোটের ভূকৌশলগত স্বার্থরক্ষার প্রয়োজনে ‘চিরস্থায়ী প্রতিরোধের’ ধারণা প্রতিষ্ঠা পায়। যদিও এই রক্তক্ষয়ী সংঘাতের অন্তঃস্থ চালিকাশক্তি ধর্ম নয়, বরং অর্থনৈতিক, বিশেষত খনিজ ও জ্বালানি সম্পদ নিয়ন্ত্রণের প্রতিযোগিতা। উদাহরণস্বরূপ, জর্ডনের যুদ্ধ থেকে দূরে থাকার অন্যতম কারণ তার ভৌগোলিকভাবে অনুর্বরতা ও সম্পদহীনতা। এর বিপরীতে তেলসমৃদ্ধ রাষ্ট্রসমূহ— সিরিয়া, লেবানন, ইজরায়েল-প্যালেস্টাইন, ইরাক, ইরান দীর্ঘকাল ধরে সংঘাতে জর্জরিত। 

আশ্চর্যজনকভাবে, কেবলমাত্র ইজরায়েল পরিচালিত নিধনযজ্ঞকে কেন্দ্র করেই (আমাদের দেশেও বটে) তিনটি স্বতন্ত্র সমর্থক শ্রেণির স্পষ্ট উত্থান পরিলক্ষণ করি। প্রথম গোষ্ঠীটি আন্তর্জাতিক পর্যায়ের-- তারা দেশকাল এবং কিয়দংশে মনুষ্যত্বেরও ঊর্ধ্বে উঠে নিজেদের ধর্মীয় সত্তাতেই একমেবাদ্বিতীয়ম পরিচয়ে পরিচিত হতে চায় এবং বিশেষ কিতাবানুসারে তারা ইহুদীদের ধ্বংসের এক অনৈতিক ও বর্ণবৈষম্যমূলক স্বপ্ন বুনে চলে প্রজন্মান্তরে। এই গোষ্ঠীর একাংশ তথাকথিত ‘ঐশী নির্দেশ’, অর্থাৎ, ধর্মরক্ষার দোহাই দিয়ে কোনও 'একের' আদেশপ্রাপ্তির দাবি তুলে মরণোত্তর পুরস্কার লাভের আশায় বোমা হয়ে ফেটে উঠে ফুটে যায় এ ধরাধামের কোনও না কোনও অংশে প্রায় নিত্যদিনই, অকাল বা ‘উপযুক্ত’ কালেই। অজ্ঞাত কারণে গোষ্ঠীটির অপরাংশ, সরাসরি হত্যাযজ্ঞের অংশ না হলেও, কদাপি এই নৃশংসতার বিরুদ্ধেও অবস্থান নেয় না। বরং তারা পরম্পরাগত নিপীড়নের ইতিহাস থেকে ‘সমভাবে’ স্বধর্মী অথবা বিধর্মীদের দ্বারা সংখ্যাগুরু বা সংখ্যালঘুর দেশে নিগৃহীত হবার অজুহাতে নিজেদের অবস্থানকে ন্যায্যতায় পরিণত করার প্রয়াসে আত্মরত। ক্ষমাপ্রার্থী না হয়ে করুণাপ্রার্থী হওয়ার এই প্রবণতাই তাদের নৈতিক দৈন্যকে উন্মোচিত করে। 

দ্বিতীয় গোষ্ঠীটি উল্লিখিত প্রথম দলের এই উগ্রতা ও সহিংসতার দ্বারা ভীত-ফোবিয়াক ও মৌলিকভাবে বিরোধী। ফলত, ‘শত্রুর  শত্রু  আমার  বন্ধু’ এই তত্ত্বে উদ্বুদ্ধ তারা ইজরায়েল তথা ইহুদী সমর্থনে নিজেদের রাজনৈতিক ও নৈতিক অবস্থান সংহত করতে নিরন্তর সচেষ্ট এবং অতি সক্রিয়, বোধহয় প্রাণপাতেও আগ্রহী! যদিও  ইজরায়েল, বিশেষত ইজরায়েলবাসী ইহুদীরা তাদের এই অবস্থান সম্পর্কে খুব একটা ওয়াকিবহাল নয়।

তৃতীয় তথা সর্বাধিক চিত্তাকর্ষক গোষ্ঠীটি মার্কিন ও ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতায় প্রত্যয়ী এবং কোনও কোনও ক্ষেত্রে সমাজ পরিবর্তনের অলীক স্বপ্নে বিভোর। ফলে, পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী বলয়ের একমাত্র ভূ-রাজনৈতিক প্রতিস্পর্ধারূপে তারা প্রথম গোষ্ঠীর প্রতি একনিষ্ঠ সমর্থন প্রদানে অঙ্গীকারবদ্ধ। ঘোষিতভাবে ধর্মনিরপেক্ষ তথা ধর্মবিরোধী হওয়ায় প্রথম গোষ্ঠী যদিও তাদের এ আত্মীয়তা স্বীকার করে না, তবু প্রথম গোষ্ঠীর অনুগামীরা তাদের মধ্যেই বিপুল ভাবে সমাদৃত! কালান্তরে বাংলার ভূখণ্ডে এই দুই গোষ্ঠীর রাজনৈতিক সহাবস্থানও ঘটেছে বৃহত্তর (দলীয়) স্বার্থে! উক্ত গোষ্ঠীটির যারপরনাই মিছিল প্রেমে ইত্যবসরে কলিকাতাবাসী বেশ কিছু যুদ্ধবিরোধী মিছিলে পা মেলাবার পুণ্যার্জন করেছে, যার স্লোগানে স্লোগানে ঢেকেছে সমাজ মাধ্যমের দেওয়াল, আর এভাবেই তারা সমাজ মাধ্যমকেই ব্রিগেড জ্ঞানে আপন মনের বাৎসল্যে জিতে ফেলেছে শত শত নির্বাচন। ভারতীয় এই সর্ব-(গণ)হারার দলের রাজনৈতিক অবস্থান হয় অন্তর্লীন ব্রাহ্মণ্যবাদে আস্থাশীলতা, অথবা প্রকাশ্যেই প্রথম গোষ্ঠীর ধর্মতত্ত্ব ও আচরণের প্রতি সমর্থন।

জার্মান রাজনৈতিক দার্শনিক Carl Schmitt একদা বলেছিলেন, 'The specific political distinction to which political actions and motives can be reduced is that between friend and enemy.'। অর্থাৎ, রাজনীতির মৌলিক ধারণা হল ‘মিত্র-শত্রু বিভাজন’। এ এমন এক ক্ষেত্র যেখানে সমাজ নিজেকে চিত্রায়িত করে 'আমরা' বনাম 'ওরা' রূপে। শত্রু এখানে ব্যক্তিগত নয়, বরং রাজনৈতিকভাবে সংজ্ঞায়িত— যে আমাদের অস্তিত্বের বিপরীতে দাঁড়ায়। আদতে রাজনীতির জমিই প্রস্তুত হয় না অপর পক্ষটিকে চিহ্নিত করতে না পারার প্রাক-মুহূর্ত পর্যন্ত। আবার নীৎশে বলছেন, 'He who despises himself still respects himself as one who despises.'। তিনি শত্রুকে আত্ম-উৎপাদনশীল এক অবলম্বনরূপে চিহ্নিত করছেন। তাঁর মতে, আমাদের নৈতিকতাবোধের এক বৃহৎ অংশই শত্রুর উপস্থিতি ও তাকে ঘৃণা করার মাধ্যমে নির্মিত। যেমন, নৈতিকতার আঙ্গিকে তৃতীয় গোষ্ঠীটি ধর্মবাদকে বাদ দিতে চাইলেও, রাজনৈতিকভাবে তা করতে অপারগ, কারণ, তাদের লাল পুস্তিকা কোনও এক সুদূর অতীতে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার যে ‘সুরা’ গ্রাহ্য করতে বলেছিল, তা অনুসরণ করতে গিয়েই তারা প্রথম গোষ্ঠীকে মিত্ররূপে বিবেচনা করেছে। এবং সেই নির্দিষ্ট ধর্মতত্ত্বের ‘আফিম’ তারা গিলতে বিন্দুমাত্র কসুর করে না তথাকথিত 'পুঁজিবাদী' বলয়ের বিরুদ্ধতায় প্রথম গোষ্ঠীটিকে এক বলিষ্ঠ প্রতিপক্ষ রূপে বিবেচনা করে। 

এরই বিপরীতে অবস্থিত দ্বিতীয় গোষ্ঠী যারা প্রথম গোষ্ঠীর বিরোধী, প্রতিস্পর্ধী ধর্মীয় মৌলবাদেই বিশ্বাসী—জন্মলগ্ন থেকেই এই তাদের পরিচয়। ফলত তারা দেখতে কিংবা দেখাতে চায় না কীভাবে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতেও ভারতীয়দের হাফিয়া নামক শহরের বাঙ্কারে প্রবেশেই বাধা দেওয়া হয়েছে স্থানটি শুধুমাত্র ইহুদীদের জন্য সংরক্ষিত দাবিতে। অনুরূপে, তৃতীয় গোষ্ঠীর অনুসারীরা জানতে চায় না, যেভাবে গ্রেটা'রা বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিল ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছতে ইজরায়েলের আগ্রাসনের কাছে, ঠিক সেভাবেই স্থলপথ রুদ্ধ করে ত্রাণকার্য প্রতিহত করেছিল লিবিয়া ও ইজিপ্ট (দুই ইসলামিক রিপাবলিক); কিংবা, জাফর পানাহি, নোবেলজয়ী শিরিন এবাদি সহ প্রায় জনা ত্রিশেক বিশিষ্টজন ইরান সরকারের উদ্দেশ্যে এক প্রকাশ্য পত্রে লেখেন, 'Iran and its people should not be sacrificed for uranium enrichment and the ambitions of the Islamic Republic.'। 

আর এই যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলার বিভীষিকাময় প্রেক্ষাপটে গাজা পরিণত হয়েছে এক চলমান উপাখ্যানে— কখনও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের পরিসংখ্যানপত্রে, কখনও গবেষকের তথ্য ভাণ্ডারে, আবার কখনও তথাকথিত মানবতাবাদীদের সমাজ ও ছায়া-সমাজের খণ্ডচিত্রে বিন্যস্ত বেদনায়। আমরা 'মানুষ' নামক জীবেরা তাতে প্রয়োজনানুসারে প্রতিক্রিয়া জ্ঞাপন করেছি, করছি, তবে আদতে মনুষ্যত্ব রক্ষা করতে পারিনি, পারি না। যদিও আল্লাহ-উপাসকদের একাংশের কাছে গাজা এমন এক চিত্রপট যা অশ্রু ও  অভিশাপ বর্ষণের পাশাপাশি ধিক্কার ও প্রতিবাদেরও। এমনটা গোটা ইসলামী দুনিয়ায় বিরল, সেখানে বিধর্মী এমনকি স্বধর্মী নিধনের ফরমান সর্বদা শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের চেয়ে অগ্রাধিকার পেয়েছে। তাই সিরিয়া, লিবিয়া, ইয়েমেন কিংবা কুর্দ অঞ্চলে আরবীয় আগ্রাসন হোক অথবা আফগানিস্তানের অভ্যন্তরে নিত্যনতুন দানবিক নীতিমন্ত্রের উদ্ভাবন ও প্রয়োগ, প্রতিক্রিয়ার পরিবর্তে ঘোর নৈঃশব্দ্যই দেখেছে সমগ্র বিশ্ব।

যুদ্ধ সর্বদাই অবধারিত বিপর্যয় ও মৃত্যু, গর্ভস্থ জীবনের অপূর্ণতা, আশ্রয়চ্যুত নাগরিক সমাজ, ধ্বংসস্তূপে পরিণত আবাস এবং ক্ষতবিক্ষত উত্তর-প্রজন্মের অস্তিত্ব সংকট। তথাপি এই সর্বজনীন যুদ্ধ বিরোধিতার নৈতিক স্তম্ভে উপবিষ্ট হয়ে আমরা প্রত্যক্ষ করি, ইজরায়েল যখন ইরানের ওপর আঘাত হানে কিংবা ভারত পাকিস্তানের ওপর, তখন ভারতীয়দের একাংশ উল্লাসধ্বনিতে মুখরিত হয়, অপরপক্ষ নিস্পন্দ স্তব্ধতায় নতজানু থাকে। ন্যায়চিন্তার মধ্যে বিপর্যয় আরও তীব্র হয়, যখন দেখা যায় তথাকথিত প্রগতিশীল বা মানবিক চেতনায় উজ্জীবিত বুদ্ধিজীবী সমাজ ইজরায়েলের ধ্বংসস্তূপ বা রক্তস্নাত শিশু-দেহাবশেষে সেই একই পৈশাচিক পরিতোষ অনুভব করে। যেভাবে বামপন্থীরা প্রত্যেক ইজরায়েলিকে 'জায়নাবাদী' রূপে চিহ্নিতকরণ করছে, তা নেতানিয়াহুর সেই সর্বজনীনিকরণকেই স্মরণ করায়, যেখানে সমগ্র ফিলিস্তিন জাতিই হামাসের সহচর বলে প্রতিপন্ন হয়। এক জাতির মৃত্যুকে অপর জাতির ন্যায় বিজয়ের এই উদ্‌যাপন যেন মনুষ্যত্ব বর্জিত কোনও যুদ্ধদেবতার আরাধনায় অর্পিত নৈবেদ্যমাত্র।

চলচ্চিত্রের দার্শনিক-বিদূষক উডি অ্যালেনের এক প্রসঙ্গে বলেছিলেন, 'I'm not afraid of death; I just don't want to be there when it happens.'। অনুমেয়, এই অত্যুৎসাহীরা কস্মিনকালেও মৃত্যুর বাস্তবতার আবহ সম্মুখে প্রত্যক্ষ করেনি, কেবল যুদ্ধকে একপ্রকার উত্তেজক নেশা হিসেবে কল্পনা করেছে। একমাত্র আত্মবিস্মৃত, প্রতিহিংসায় মোহাবিষ্ট জনতা, যারা জাতীয়তাবাদে অন্ধ, যুক্তিবোধে শূন্য এবং কেবলমাত্র স্লোগানের উত্তেজনায় নিমগ্ন, তাদের পক্ষেই এ ধরনের ‘আনন্দ’ উদযাপন সম্ভবপর। যেমন, পাকিস্তান বিরোধী স্লোগান উচ্চারণ মাত্রেই অনেকে ভাবনাহীন, মননশূন্য দেশপ্রেমে আপ্লুত হয়ে ওঠেন।

জাঁ-পল সার্ত্র তাঁর 'The Look' তত্ত্বে ব্যাখ্যা করেছেন, অন্য মানুষ (l’Autre)-এর দৃষ্টির ভিতর দিয়েই আমি ‘বস্তু’তে রূপান্তরিত হই; সেই ‘অপর সত্তা’(other)'ই হয়ে ওঠে অস্তিত্বগত শত্রু, কারণ সে আমাকে অপর রূপে চিহ্নিত করে তার দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে। সেই চাহনিই হয়ে পড়ে আমার অস্তিত্বের অনতিক্রম্য সীমারেখা। অন্যদিকে বিষ্ণুপুরাণ ও গীতার বর্ণনায় 'শত্রু' বহির্দেশীয় নয় বরং অনেকাংশে অন্তরীণ— অহং, কাম, ক্রোধ, লোভ প্রভৃতি বিকার এ ক্ষেত্রে 'অন্তর্জাত শত্রু' হিসেবে চিহ্নিত। বৌদ্ধ দর্শনে ‘Māra’ সেই অন্তর্মুখী বিভ্রমের প্রতীক, যে নির্বাণের পথে বাধা সৃষ্টি করে। অতএব, শত্রু কেবল অস্ত্রধারী বহিঃশত্রু নয়, সে কখনও রাষ্ট্রীয়, কখনও নৈতিক, আবার কখনও অস্তিত্বগত ভ্রান্তি বা অপরের দৃষ্টিতেই নিহিত থাকে।

এই বৈপরীত্যের মধ্যস্থলে দাঁড়িয়ে, দ্বন্দ্বে জীর্ণ হওয়ার আগে আমাদের আত্মজিজ্ঞাসা করা প্রয়োজন—অসহিষ্ণুতার প্রতি সহিষ্ণুতা প্রদর্শন করব, নাকি অসহিষ্ণুতাকেই ধ্বংসের শাস্তি দেব? এবং এই অন্তঃসঙ্গাতে জীর্ণ হবার পূর্বেই স্মরণ করিয়ে দিতে হয় নীৎশের সেই অনিবার্য সতর্কবাণী, 'He who fights with monsters should see to it that in the process he does not become a monster. And if you gaze long enough into an abyss, the abyss will gaze back into you.'। আমরা যেন প্রতিহিংসার উন্মাদনায় অচেতন হয়ে নিজেরাই এক এক দানবে পরিণত না হই। মানবতার রক্ষাকবচ হিসেবে আমাদের প্রয়োজন, বোধ, ভাবনা ও আত্মসমালোচনার নিরলস অনুশীলন।


Wednesday, 2 July 2025

অতঃপর?

রাজনৈতিক ভাবনা ও অনুশীলনকেই পাল্টাতে হবে

উত্তাল ঘোষ



কল্পনাও করতে পারিনি, এরকম দুর্দান্ত কিছু ঘটে গেলে আমরা আত্মহারা হয়ে পড়ি। যেমন, ১৯৮৩ সালে বিশ্বকাপ জেতার পর জুনের গরমেও অনেকে ক্রিকেট খেলতে নেমে পড়েছিলাম।

কল্পনাও করতে পারিনি, এরকম ভয়ঙ্কর কিছু ঘটে গেলে স্নায়ু অবশ হয়ে যায়, রাগ হয়, চিৎকার করতে ইচ্ছে করে, সব ভেঙেচুরে ফেলার ইচ্ছে হয়। যেমন, সাউথ ক্যালকাটা ল' কলেজের মধ্যেই এক ছাত্রী গণধর্ষিতা হওয়ার খবর জানার পর হয়েছে। যেমন হয়েছিল আরজি কর মেডিক্যালের ভিতরেই ডাক্তারি ছাত্রীকে ধর্ষণ-খুনের কথা জানার পর। অথবা, কালীগঞ্জে বোমার আঘাতে ন' বছরের নাবালিকার মৃত্যুতে।

দেখবেন, আরজি করের ঘটনা যেমন রাস্তায় মানুষের ঢল নামিয়েছিল, কসবার ঘটনায় তা হয়নি। কারণ, আরজি কর আন্দোলন ফলপ্রসূ হয়নি। যদিও ওই ঘটনার পর পরই কিন্তু দলে দলে মানুষ পথে নামেননি। নেমেছিলেন ৫ দিন পর জনৈক রিমঝিম সিনহার ডাকে আলোড়িত হয়ে। সে আলোড়ন ছিল নারী নিরাপত্তার দাবিতে। তারপর? বিজেপি ঠেক না পেয়ে সরে গেল। সিপিএম-সহ বামেরা রাশ হাতে নিয়ে নারী নিরাপত্তার বৃহত্তর আঙ্গিক থেকে আন্দোলনকে স্রেফ ঘটনার মধ্যে আটকে ফেলল। সিস্টেম সব সামলে নিল। 

যাঁরা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর খবর রাখেন, তাঁরা জানেন কসবার ঘটনা ঘটারই ছিল। কলকাতাতেই যদি এসব হয় তাহলে গ্রামের ছবিটা কেমন বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। সেরকম কয়েকটা ঘটনার কথা কানে এলেও তেমন আন্দোলিত হয় না মধ্যবিত্ত মন। দৈন্য আমাদের চিন্তার। আমরা সব কিছুকেই রাজনৈতিক দলের ছাঁচে দেখতে অভ্যস্ত। তার ফল কী হয়, তা আরজি করের ঘটনার পর দেখেছি। কসবার ঘটনাতে নির্যাতিতা ও অভিযুক্ত তিনজনই তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সদস্য। কষে তৃণমূলকে গালমন্দ শুরু হয়েছে। তৃণমূল বলছে, পুলিশ তো সবাইকে গ্রেফতার করেছে। তৃণমূল আঙুল তুলছে বিজেপি-সিপিএমের দিকে। রাশ কার হাতে থাকবে তা নিয়ে কসবার কলেজের সামনে 'রাত দখল' আন্দোলনকারীদের ওপর বিজেপি হামলা চালিয়েছে। নীতি-নৈতিকতার জন্য নয়, সবই ভোটের জন্য। সেখানে রাজনৈতিক দলের আওয়াজই শুধু শোনা যায়। আমজনতার কথা হারিয়ে যায়। আমজনতার অনেকে রাজনৈতিক দলগুলোর ভাষাতেই বলতে শুরু করে। দলীয় রাজনীতির সেই ভাষায় তর্কাতর্কি করতে করতেই রাগ সব বেরিয়ে যায়। আরজি কর, কালীগঞ্জ, কসবার মতো আরও ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটার ভয় নিয়ে আমজনতার বড় অংশ বোবা হয়ে যায়। সিস্টেম দিব্যি বেঁচেবর্তে থাকে।

রাজনীতি নির্ভর করে অর্থনীতির উপর। মূলত অর্থনীতির উপরই নির্ভর করে সমাজ ও রাজনীতির নীতি-নৈতিকতা বোধ। ১৯৯১ সালে আমাদের মতো দেশে বাজার অর্থনীতির দরজা হাট করে খুলে দেওয়া হয়েছে। বাজার অর্থনীতি মানে তো ভোগ-লোভ ও আরও মুনাফার আকাঙ্ক্ষা। খেয়াল করলে দেখা যাবে, বাজার অর্থনীতির দরজা খোলার পর থেকেই ধীরে ধীরে সামাজিক মূল্যবোধ-নীতি-নৈতিকতা পাল্টে যাচ্ছে। রাজনীতিতেও তার ছাপ পড়তে বাধ্য। পড়ছেও। বাজার অর্থনীতি মানুষের মৌলিক সমস্যাগুলোর কোনও সমাধান করতে পারে না। কিন্তু চকচকে প্রচার আমজনতার মনকে সে সব থেকে সরিয়ে ভোগের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ভোগের সঙ্গেই তো জড়িয়ে থাকে লোভ-লালসা ও শুধুমাত্র নিজেকে নিয়ে বাঁচা। মনে থাকবে, আগে মাস্তানদের একটা রবিনহুড-মনোভাব ছিল। তারা কেউ মহিলাদের অসম্মান করেছে এরকম উদাহরণ প্রায় নেই। এখন আর মাস্তান নেই, এখন সব মাফিয়া ডন। তারা পারে না এমন কোনও কাজ নেই।

যে কোনও ভাবে ভোটে জিততে হবে, এটাও তো একটা লোভ। ভোগবাদী মুনাফাসর্বস্ব রাজনীতির অনিবার্য ফল। ভোটে জিততে হলে কী লাগবে? মানি পাওয়ার, মাসল পাওয়ার।

কসবার কলেজের ঘটনা সম্পর্কে অনেকে ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়ার কথা বলছেন। বাম জমানায় একটা সময়ের পর থেকে নির্বাচন হত? নাকি গায়ের জোরে প্রতিপক্ষকে ভোটে লড়তে না দিয়ে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছাত্র সংসদ দখল হত? টাকা নিয়ে ভর্তি হত না? ছাত্র সংসদের টাকা খরচে দুর্নীতি হত না?  সে সময় এসএফআই রাজ্য সম্মেলনের রিপোর্ট দেখলেই বোঝা যাবে, নেতারা সব জানতেন। তবু সে সব অপকর্ম চলতেই থাকত। ক্ষমতা দখলে রাখতে হবে। তাই নেতারাও বদলের চেষ্টা করতেন না। 

বাম জমানায় নেতারা বুদ্ধি করে রেখেঢেকে চলতে পারতেন। সোশ্যাল মিডিয়া, অডিও ভিসুয়াল মিডিয়া না থাকায় জানাজানিও কম হত। তার চেয়েও বড় কথা, বাজার অর্থনীতির দর্শন রাজনীতিকে পুরোপুরি গিলে খেতে পারেনি। বামেরা যাওয়ার পর রাজনীতির রাশ বহু জায়গায় চলে গেল লুম্পেনদের হাতে। আগে নেতারা গুণ্ডাদের ব্যবহার করত। ভোটে জেতাটাই যত বেশি রাজনীতির মোক্ষ হল ততই গুণ্ডাদের হাতে চলে গেল রাজনীতির রাশ। এর শুরু সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের জমানা থেকে হলেও বাম আমলে এর বিস্তার ঘটেছে, এখন বিষবৃক্ষ হয়ে গেছে। তার ফল ঝরে ঝরে পড়ছে। আরও পড়বে।

বলাই বাহুল্য, আমাদের রাজ্যে সমাজ জীবন পুরোপুরি রাজনৈতিক দল নিয়ন্ত্রিত। এটা বাম জমানাতেই শুরু হয়েছে, তৃণমূল জমানায় এই পার্টিশিল্প আরও পোক্ত হয়েছে। পার্টির সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমজনতার বাঁচা-মরা, বিশেষত গ্রামে। তার সঙ্গে যোগ করুন এই ভোগ-লোভের-ভোটসর্বস্ব রাজনীতি। তাহলেই বোঝা সম্ভব কসবার কলেজের মনোজিৎ মিশ্ররা জন্ম নেয় কী ভাবে। যে ছেলেটা অপকর্মের জন্য কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হয়, যে কথা টিএমসিপি ইউনিট সভাপতি দলের উচ্চতম নেতৃত্বকেও জানিয়েছিলেন, সেই ছেলেটিই আবার কলেজে ভর্তি হওয়ার অনুমতি ও পরবর্তীতে অস্থায়ী কর্মীর চাকরি পায় কী করে? সে জন্য তো বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতি লাগে। হাত কতটা লম্বা সেটা পরিস্কার। এখন গ্রেফতারের পর হাত ধুয়ে ফেলার খেলা চলছে? 

রোগটা কোনও দলের নয়, রোগটা সিস্টেমের। সব রাজনৈতিক দলই এই সিস্টেমের অংশ। আপনি তৃণমূলের দিকে আঙুল তুললে তৃণমূল বলবে, হাথরাস-উন্নাও-কাঠুয়া-বিলকিস বানু-মনিপুর-কার্তিক মহারাজ-প্রজ্জ্বল রেভান্না-বানতলা-ধানতলা-মণীষা মুখার্জি-সুশান্ত ঘোষ-আরও কত কিছু। আসল কথা হারিয়ে যাবে। আসল কথা এই সিস্টেমকে চ্যালেঞ্জ করার মতো বিকল্প রাজনীতি, বিপক্ষকে গালাগাল করার নেতিবাচক রাজনীতির বদলে চাই ইতিবাচক রাজনীতি।

আমিও ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত ছিলাম। আমাদের কলেজের শিক্ষাগত মান খুব একটা ভাল ছিল না। আমরা ঠিক করেছিলাম, ৬৫ শতাংশ উপস্থিতি না থাকলে কেউ পরীক্ষা দিতে পারবে না। একবার ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদকের উপস্থিতি ৬৫ শতাংশ ছিল না। তিনি পরীক্ষা দিতে পারেননি। সব অধ্যাপকই জানতেন ছেলেটি নিয়মিত কলেজে যেত। ছাত্র সংসদের কাজ করতে গিয়ে ক্লাসে যেতে পারত না। আমরা তাঁকে ছাড় দিতে বলিনি। আমাদের কলেজের শিক্ষার মান ক্রমশ বাড়তে বাড়তে কলকাতার সামনের সারির কলেজে পরিণত হয়েছিল। সিপিএম-কংগ্রেস-নকশাল সব মনোভাবের শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীরা এই কাজে নিজেদের উজাড় করে দিয়েছিলেন। ছাত্র সংসদের ভোট হত। মারধর-মারামারি হত। কিন্তু ভোটের পর বিরুদ্ধ ছাত্র সংগঠনের কর্মীদের সঙ্গে কোনও তিক্ততা থাকত না।

এসএফআই দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলায় বেশ দুর্বল ছিল। আমি সম্পাদক থাকার সময় আমরা জেলার শিক্ষাগত উন্নয়নের দাবিকে সামনে রেখে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলাম। তৃণমূল কর্মী হিসেবে কাজ করা শিক্ষকরাও ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে সমাবেশে এসেছিলেন। দলীয় রাজনীতির গণ্ডী ভেঙে গিয়েছিল। এই ইতিবাচক মনোভাবের রাজনীতি চাই যা সিস্টেমকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। আমার মতে, কান্নাকাটি রাগারাগি করে অন্যকে দোষ দেওয়ার বদলে বিকল্প রাজনীতির ভাষ্য তৈরি করাটাই বেশি জরুরি। এই বিকল্প ভাবনার কেন্দ্রে থাকতে পারে প্রতিটি পরিবারের আয় বাড়ানো, স্বনির্ভর পরিবার গড়ে তোলার উদ্যোগ, প্রকৃতি-বন্যপ্রাণ-পরিবেশকে বাঁচিয়েই উন্নয়ন, বিষমুক্ত খাদ্যের দাবি। সঙ্গে স্বপ্ন। প্রয়োজন ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, নানা মনোভাবের মানুষকে নিয়ে চলার মানসিকতা। তাহলেই কাঙ্ক্ষিত বিশল্যকরণীর খোঁজ পেতে পারি আমরা। 

নয়তো থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড়।


Monday, 30 June 2025

কলেজ চত্বরে কাদের মাস্তানি

কলুষিত শিক্ষা অঙ্গন

আবু সঈদ আহমেদ



স্কুল জীবন থেকে কলেজ জীবনে পা রাখার সময়টা ছাত্রছাত্রীদের জীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ এবং রোমাঞ্চকর মোড়। তবে একে ঘিরে মানসিক অস্থিরতাও একেবারে কম নয়। এই সময় তারা একাধিক মানসিক অবস্থার মধ্যে দিয়ে যেতে পারে-- একইসঙ্গে পায় উত্তেজনা ও স্বাধীনতার অনুভব, নিজেকে নতুন করে গড়ে তোলার সুযোগ, নিজের পছন্দ অনুযায়ী বিষয় বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা— এসব এক ধরনের আত্মবিশ্বাস এনে দেয়। কেউ কেউ হোস্টেল বা বাড়ির বাইরে থাকতে শুরু করে, জীবনের প্রথম স্বাধীনতা অনুভব করে। তবুও সব কিছু এত রঙিন নয়। যেমন, মনে আসে নানা উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তা। নতুন পরিবেশ, অপরিচিত বন্ধু-বান্ধব, কঠিন একাডেমিক চ্যালেঞ্জ— সবই একটা উদ্বেগ তৈরি করে। ভবিষ্যতের কেরিয়ার নিয়ে চাপ তৈরি হয়, 'ঠিক পথে হাঁটছি তো?', এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খায় মনে।

কেউ কেউ আবার হতাশায় ভোগে, নিজের জায়গাটা খুঁজে পেতে সময় নেয়। আর জীবনের এই সময়েই নারী জীবনের সব থেকে ভয়াবহ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হল কসবার আইন কলেজের এক ছাত্রী। যেখানে অপরাধী হিসেবে নাম উঠে এসেছে সেই কলেজেরই ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্তদের, যাদের মধ্যে মূল অভিযুক্ত ওই কলেজেরই প্রাক্তন ছাত্র, যে কলেজের পঠনপাঠনের সঙ্গে আর যুক্ত না থাকলেও কলেজ চত্বরে দিনের পর দিন অবাধে মাস্তানি চালিয়ে গেছে। 

আমরা জানি, ছাত্রছাত্রীদের কণ্ঠস্বর ছাত্র ইউনিয়ন মারফত শিক্ষাব্যবস্থায় প্রতিফলিত হওয়াটা শুধু গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং গণতান্ত্রিক ও সচেতন শিক্ষাব্যবস্থার একটি অপরিহার্য অঙ্গ। এখানেই ছাত্ররা সরাসরি জানাতে পারে কী কী চ্যালেঞ্জের মুখে তারা পড়ছে— হোক তা একাডেমিক, প্রশাসনিক কিংবা মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়। নীতিমালায় পরিবর্তনের আগে শিক্ষার্থীদের অভিজ্ঞতা-ভিত্তিক মতামত উঠে আসে। যখন ছাত্রছাত্রীরা নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ার অংশ হয়, তখন তারা সিদ্ধান্তগুলিকে আরও দায়িত্ব নিয়ে গ্রহণ করে। এতে দায়িত্ববোধ ও নেতৃত্বের গুণাবলী গড়ে ওঠে। একজন ছাত্রনেতা হয়ে ওঠা মানে সমস্যার সমাধান, জনসংযোগ ও সময় ব্যবস্থাপনার মতো গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতা অর্জন। ছাত্রছাত্রীদের ইউনিয়ন কার্যকলাপে যুক্ত করা মানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো আরও স্বচ্ছ, গণতান্ত্রিক ও শোধনযোগ্য হয়। এতে শিক্ষার উদ্দেশ্য কেবল পরীক্ষায় ভালো ফল করা নয়, বরং সামাজিক ও নৈতিক শিক্ষাও অন্তর্ভুক্ত হয়। অতএব, একজন ছাত্র প্রতিনিধি হওয়াটা শুধু একটা পদ নয়, বরং এটাও শেখা, কীভাবে নিজের কথা বলা এবং অন্যের কণ্ঠস্বরকেও গুরুত্ব দেওয়া যায়।

অথচ, পশ্চিমবঙ্গের কলেজগুলোতে বহুদিন ছাত্র সংসদের নির্বাচন নেই। সর্বত্র একদলীয় তৃণমূলি রাজনৈতিক দাপট। যার ফল হয়েছে, ক্লাসরুম, গ্রন্থাগার বা সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের চলাফেরার জায়গাগুলো রাজনৈতিক দখলদারিতে পরিণত। পড়াশোনা ও গবেষণার পরিবেশে ভয়, চাপ ও হুমকির ছায়া। আগের শাসনামলগুলোতেও এসবের অভাব ছিল না। কিন্তু এখন সবই মাত্রাছাড়া চলছে। হঠাৎ হুমকি, মারপিট বা সংঘাতের মাঝে সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা মানসিক উদ্বেগে ভুগছে। কেউ কেউ ক্যাম্পাসে আসতে ভয় পাচ্ছে বা শিক্ষাজীবন অসম্পূর্ণ রেখেই সরে দাঁড়াচ্ছে। কলেজে ছাত্র ভর্তিও কমে যাচ্ছে। 

রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় কিছু গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থে অস্ত্রও ব্যবহার করছে। এইভাবে তারা টাকাও তোলে।ফলে, 'ছাত্রনেতা' শব্দটা নেতিবাচক অর্থ পেতে শুরু করেছে। যখন দুর্বৃত্তরা বিচারহীনভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকে, তখন ছাত্রদের মধ্যে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ কমে যায়। নৈতিক শিক্ষার জায়গা দখল করে নেয় ক্ষমতার রাজনীতি। প্রকৃত নেতৃত্ব গুণ থাকা ছাত্ররা পেছনে পড়ে যাচ্ছে, ভয় পাচ্ছে, অথবা দূরে সরে যাচ্ছে। ভবিষ্যতের সম্ভাব্য চিন্তাশীল সমাজনেতারা হারিয়ে যাচ্ছে সহিংসতার কোলাহলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। দেশের বাইরে পর্যন্ত এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। উচ্চশিক্ষা ও কেরিয়ার তৈরির পথে বাধা সৃষ্টি করেছে। দেশে বা বিশ্বে শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ ক্রমশই পিছিয়ে পড়ছে।

যখন ছাত্র রাজনীতি আদর্শ, নেতৃত্ব এবং গণতান্ত্রিক চর্চার বদলে দুর্বৃত্তায়নের পথে হাঁটে, তখন তা গোটা শিক্ষাব্যবস্থাকে নাড়িয়ে দিতে পারে। ছাত্র রাজনীতি যদি আদর্শভিত্তিক, অংশগ্রহণমূলক ও গণতান্ত্রিক হয়, তাহলে তা সমাজ পরিবর্তনের এক মহৎ মাধ্যম হতে পারে। কিন্তু যখন সেটাই দুর্বৃত্তদের হাতে পড়ে যায়, তখন স্বপ্নের ক্যাম্পাস রূপ নেয় আতঙ্কের প্রান্তরে। এই চক্র থেকে বেরনো উচিত।

সঠিক ছাত্র প্রতিনিধিত্ব না থাকলে আরেকটি ব্যাধি অবাধে চলতে থাকে। তা হল শিক্ষক-শিক্ষিকাদের পক্ষপাতিত্ব। কিছু তোষামোদকারী ছাত্রছাত্রীদের সামনে রেখে তৈরি করা হয় এক ক্লেদাক্ত পরিবেশ। এখানে শিক্ষককে আর 'নিরপেক্ষ' গাইড বা মেন্টর হিসেবে দেখা যায় না। শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধাবোধে ভাঁটার টান পড়ে, ফলে ক্লাসের নিয়ন্ত্রণেও সমস্যা দেখা দেয়। পক্ষপাত শিক্ষাকে একটি প্রতিযোগিতামূলক ও জটিল খেলায় পরিণত করে, যেখানে গুণ নয়, পরিচয় বা প্রভাব প্রাধান্য পায়। এখানে যারা পক্ষপাতের বাইরে থাকে, তারা নিজেদের অবমূল্যায়িত বা অবহেলিত মনে করে। এতে তাদের আত্মবিশ্বাস কমে যায় এবং পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ নষ্ট হয়। ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে 'পছন্দের' ও 'অপছন্দের' গোষ্ঠী তৈরি  হয়। বন্ধুত্ব, সহযোগিতা ও সহমর্মিতার পরিবেশ বিঘ্নিত হয়। পক্ষপাতিত্ব'র ফলে ছাত্রছাত্রীরা অতিরিক্ত সুবিধা পেয়ে নিজের প্রকৃত উন্নতির চেষ্টা কমিয়ে দেয়। অন্যদিকে, অবহেলিত ছাত্ররা নিজের দক্ষতা প্রমাণের ইচ্ছা হারিয়ে ফেলে।

রাজনীতির উদ্দেশ্য যদি হয় ক্ষমতা ধরে রাখা যে কোনও মূল্যে, তাহলে তা মানুষের প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের আত্মাকে আঘাত করে। অপরাধীরা যখন রাজনৈতিক আশ্রয় পায়, তখন তারা নিজেদের আইনের ঊর্ধ্বে ভাবতে শুরু করে। বিচারব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং সাধারণ মানুষ 'ন্যায় পাব কি না' সেই বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছেন। নীতিনির্ধারকরা দুর্বৃত্তদের স্বার্থরক্ষার জন্য নিয়ম-কানুন পরিবর্তন করে ফেলতে পারে, সে সবও মানুষ দেখছে। দেশ জুড়েই প্রশাসনের মধ্যেও ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। বিরোধী মত দমন, সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদিও বাড়ছে।

গোটা দেশেই দেখা যাচ্ছে, কখনও ধর্ষণকে সাজানো ঘটনা বলা হচ্ছে, কখনও ধর্ষকদের গলায় মালা পরিয়ে সংবর্ধনা দেওয়া হচ্ছে, কখনও ধর্ষকদের পক্ষে জাতীয় পতাকা নিয়ে মিছিল বেরচ্ছে। দুষ্কৃতিপূর্ণ আচরণ যদি রাজনৈতিক ছায়ায় সুরক্ষা পায়, তাহলে তা সমাজ, প্রশাসন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং ন্যায়ের প্রতি আস্থা— সবকিছুকে ক্ষতিগ্রস্ত করে তোলে। নারী নির্যাতন যদি সমাজে 'নিয়মিত', 'সহনীয়' কিংবা 'সংস্কৃতির অংশ' হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পায়, তাহলে তা শুধুই একটি মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়, বরং পুরো সমাজব্যবস্থার মূল্যবোধেই ফাটল ধরায়। নির্যাতনকে স্বাভাবিক হিসেবে দেখা মানে অপরাধী আরও বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে, নারীর আত্মসম্মান ও মানসিক স্বাস্থ্য ধ্বংস হয়। নির্যাতনে আক্রান্তরা মনে করেন, নালিশ করেও কিছু হবে না। ফলে, তাঁরা চুপ করে যান আর অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। নির্যাতনের শিকার নারী নিজেই নিজেকে দোষারোপ করতে শুরু করে। উদ্বেগ, ডিপ্রেশন, হীনম্মন্যতা এমনকি আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যায়। এসবের ফলে বিচারহীনতার সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে— 'এমনই তো সবসময় হয়' ধরনের ধারণা ছড়িয়ে পড়েছে। যখন অন্যের কষ্টকে 'নিয়মিত ব্যাপার' হিসেবে দেখা হয়, তখন সামগ্রিকভাবে সমাজের সহানুভূতি হারিয়ে যায়। যখন দেখা যায় অপরাধীরা পুরস্কৃত হচ্ছে, আর সৎরা বঞ্চিত, তখন তরুণ প্রজন্ম মূল্যবোধ হারিয়ে ফেলে। সামাজিক মাধ্যমের মন্তব্যগুলো দেখলেই তা বোঝা যায়। পাশাপাশি, আইনের শাসন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের খবর আন্তর্জাতিক মহলে যাওয়াতে দেশের আর্থিক বিনিয়োগ, শিক্ষা বিনিময় বা পর্যটন ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। সহিংসতার চক্র আরও গভীর ও প্রাতিষ্ঠানিক হয়ে উঠেছে। 

নির্যাতনের ঘটনা যতই 'নর্মাল' করার চেষ্টা হোক না কেন, সচেতন কণ্ঠই পারে সেই অস্বাভাবিকতাকে দৃঢ়ভাবে চিহ্নিত করতে। সচেতনতা ও প্রতিবাদই পাল্টে দিতে পারে এই সংস্কৃতি।


Sunday, 22 June 2025

নিছক দুর্ঘটনা?

বিপর্যয়ের অতল খাদে দেশ

প্রশান্ত ভট্টাচার্য



রাজনৈতিক সমাজে কোনও দুর্ঘটনা নিছক দুর্ঘটনা থাকে না। ঠিক মতো কাটাছেঁড়া করলে দেখা যায়, প্রতিটি দুর্ঘটনার পিছনে রাজনীতির লোকজনদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ ভূমিকা আছে। ঘটনার যখন কারণ আপাত প্রত্যক্ষ করতে পারি না, তখনই তো তাকে আমরা দুর্ঘটনা বলি। তাই তো আহমেদাবাদে সাধের এয়ার ইন্ডিয়ার ড্রিমলাইনার ফ্লাইট নম্বর ১৭১ ভেঙে পড়লে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলে দেন, দুর্ঘটনাকে তো কেউ আটকাতে পারে না! বাহ! বাত খতম পয়সা হজম। ফলে, দুর্ঘটনা নানান প্রলেপে বিতর্কের কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায়। শুধু তো এয়ার ইন্ডিয়ার উড়ান ভেঙে পড়া নয়, প্রতিদিনই সড়ক পথে, রেলপথে, জলপথে দুর্ঘটনা ঘটছেই। তার সঙ্গে আছে সেতু ভেঙে পড়ার গপ্পো। 

দিল্লি পুলিশের একটি হিসেব বলছে, এ বছরের মে মাসের মধ্যেই দিল্লিতে ২২৩৫টি পথ দুর্ঘটনা ঘটেছে যার মধ্যে ৫৭৭ জন মারা গিয়েছে। উত্তরপ্রদেশ পুলিশের হিসেবে, এই বছরের মে মাসের মধ্যে ১৩ হাজারের বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে যার মধ্যে ৭৭০০ জনের মৃত্যু হয়েছে। আমাদের মধ্যে একটা নিহিত বাতিক, আমরা নথিভুক্ত করি না। ফলে, সর্বগ্রাহ্য পরিসংখ্যান পাওয়া রীতিমতো কঠিন। অর্থাৎ, সেকেন্ড হ্যান্ড উপাত্ত নিয়ে কাজ করা প্রায় অসম্ভব। আর প্রাথমিক উপাত্ত সংগ্রহ করার মতো টিম আমাদের হাতে নেই। তাই শুধু দিল্লি আর উত্তরপ্রদেশের হিসেবটাই রাখতে পারলাম। আর মজার, এই দুটো রাজ্যেই মোদীর অতিপ্রিয় ডাবল ইঞ্জিন সরকার। আর ভারতীয় রেল! 

আমাদের মনে রাখতে হবে, রেলে দুর্ঘটনা যেন এক বাঞ্ছিত সত্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও দুটি ট্রেন মুখোমুখি একই লাইনে এসে পড়ছে, কোথাও লাইনচ্যুত হচ্ছে, কোথাও ২টি ট্রেনের বীভৎস ধরনের সংঘর্ষে বিপুল সংখ্যক মানুষ আকস্মিক প্রাণ হারাচ্ছেন। এমনকী, রেল কর্তৃপক্ষ ঠিকমতো হিসেবটাও দেয় না। তবু রেলের পুনে ডিভিশন জানাচ্ছে, এ বছরের প্রথম পাঁচ মাস ৫১ জন রেল দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে যার মধ্যে দুজন মারা গিয়েছে। 

আর সেতু! একটা করে সেতু ভাঙে আর প্রশাসন নড়েচড়ে বসে। সেতুর স্বাস্থ্য পরীক্ষার তোড়জোড় শুরু হয়। ২০২৫ সালের চলতি মাস অর্থাৎ জুন পর্যন্ত বেশ কয়েকটি সেতু ভেঙে পড়ার খবর পাওয়া গিয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল মহারাষ্ট্রর পুনেতে ইন্দ্রায়ণী নদীর ওপর একটি সেতু ভেঙে পড়া, যেখানে বেশ কয়েকজন পর্যটকের মৃত্যু হয়েছে। কারও মতে সংখ্যাটা ১৫-২০, কারও মতে ৩০ জন। পুরনো লোহার সেতু দিয়ে যান চলাচল আগেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বর্ষার সময় নদী ও এলাকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে পর্যটকরা ছবি বা নিজস্বী তুলতে অনেকেই সেতুতে জড়ো হন। আগেই স্থানীয় বাসিন্দারা সেতুর হাল নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। ৪-৫ বছর আগে সেতুটির মেরামতি হয়। উদ্ধারকারীদের মতে, বর্ষার সময় নদী ছিল খরস্রোতা। জলস্তর বেড়েছিল, তাই বহু মানুষ ভেসে গিয়ে নিখোঁজ হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। 

ঘটনা ঘটে গেলে রাজনীতিকরা আসবেন না, তা হয় নাকি? ফলে, অকুস্থলে যান শরদ পাওয়ারের মেয়ে তথা এনসিপি (শরদ পাওয়ার গোষ্ঠীর) সাংসদ সুপ্রিয়া সুলে। ওদিকে এক্স হ্যান্ডেলে মুখ্যমন্ত্রী  দেবেন্দ্র ফড়নবিশ। এসব তো ঘটে যাওয়ার পরের কাহিনি ও বাকতাল্লা! কথা হচ্ছে যে এমন একটা লবেজান সেতু না মেরামত করে বা ভেঙে না ফেলে মৃত্যুসেতু সাজিয়ে রাখার মানেটা কী? এরপরও কি বলতে হবে, 'দুর্ঘটনা কেউ আটকে রাখতে পারে না'। আসলে এগুলো apolitical disaster নয়, হাইলি political।  

এছাড়াও, কদিন আগে মধ্যপ্রদেশের শিবপুরীতে একটি নির্মীয়মাণ সেতু ভেঙে পড়ে, যাতে কয়েকজন শ্রমিক আহত হন। একইসঙ্গে অসমেও গত ১৮ জুন বুধবার একটি সেতু ভেঙে পড়ে। অসমের কাছাড় জেলায় হারাং নদীর উপর ব্রিজটি ভেঙে পড়ায় ত্রিপুরা, মিজোরাম ও মণিপুরের সঙ্গে সড়কপথে বাকি দেশের যোগাযোগ কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে ৷ ব্রিজ ভেঙে নদীর জলে তলিয়ে যায় পাথরবোঝাই ডাম্পার ৷ তবে ঘটনায় কোনও হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি ৷ তবে আশ্চর্যের, মেরামতির এক মাসের মধ্যেই ভেঙে পড়ে এই সেতুটি। এই ঘটনাগুলি থেকে বোঝা যায়, সেতুগুলির রক্ষণাবেক্ষণ এবং নির্মাণের গুণগত মান কোন স্তরের। বিশেষ করে, পুরনো সেতুগুলির ক্ষেত্রে এই সমস্যা আরও বেশি প্রকট। ভঙ্গরপারের সঙ্গে শিলচর-কালাইনের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থায় হারাং নদীর ওপর এই সেতু গুরুত্বপূর্ণ ৷  অসমের বরাক উপত্যকার দুই প্রধান শহর গুয়াহাটি ও শ্রীভূমির (করিমগঞ্জ) মধ্যে যোগাযোগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হল এই ব্রিজ ৷ এই দুর্ঘটনার ফলে বরাক উপত্যকা-সহ উত্তর-পূর্ব ভারতের তিনটি রাজ্য— ত্রিপুরা, মিজোরাম ও মণিপুরের সঙ্গে সড়কপথে বাকি দেশের যোগাযোগ কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে ৷ ১ কোটি ৩৭ লক্ষ টাকা খরচ করে মেরামতির ১ মাসের মধ্যে সেতুর ভবলীলা সাঙ্গ! কই এবার তো মোদী বা শাহ হিমন্ত বিশ্বশর্মা বা মোহন যাদবকে বলছেন না, 'ইয়ে অ্যাক্ট অফ গড নেহি অ্যাক্ট অফ ফ্রড হ্যায়'। কেন বলছেন না? কারণ মধ্যপ্রদেশ ও অসম, দুটোতেই ডাবল ইঞ্জিনের সরকার। 

শুধু কি এই? গত রবিবার সকালে কেদারনাথ মন্দির থেকে তীর্থযাত্রী বহনকারী একটি কপ্টার গুপ্তকাশির কাছে বিধ্বস্ত হয়, এতে পাইলট এবং দুই বছরের একটি শিশু সহ সাতজনই নিহত হন। দুর্ঘটনাগ্রস্ত কপ্টারটি আরিয়ান সংস্থার। পুলিশ ও দমকল সূত্রের খবর, রবিবার উত্তরাখণ্ডের রুদ্রপ্রয়াগ জেলার গৌরীকুণ্ডর কাছে গৌরী মাঈ খার্ক এলাকায় জঙ্গলের ওপর ভোর সাড়ে ৫টা নাগাদ ভেঙে পড়ে চপারটি। দুর্ঘটনাস্থলের কাছে স্থানীয় মহিলারা  ঘাস কাটছিলেন, তাঁরাই প্রথম দুর্ঘটনার খবর পান। এক্স হ্যান্ডেলে উত্তরাখণ্ড'র মুখ্যমন্ত্রী পুষ্কর সিং ধামি শোকপ্রকাশ করেছেন, 'রুদ্রপ্রয়াগ জেলায় হেলিকপ্টার দুর্ঘটনার ভয়াবহ খবর পেয়েছি। রাজ্য বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী, স্থানীয় প্রশাসন ও উদ্ধারকারী দল ব্যস্ত উদ্ধারকাজে। কপ্টারের সওয়ারিদের সুস্থতার জন্য বাবা কেদারের কাছে কামনা করি।' দেখুন, গোটা ব্যাপারটা কেদারের হাতে ছেড়ে দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী নিরুদ্দেশ। অথচ ৩০ এপ্রিল তীর্থযাত্রা শুরু হওয়ার পর থেকে উত্তরাখণ্ডে ছয় সপ্তাহে চারধাম যাত্রা রুটে এটি পঞ্চম হেলিকপ্টার দুর্ঘটনা এবং দ্বিতীয় দুর্ঘটনায় প্রাণহানির ঘটনা। ৮ মে উত্তরকাশীতে একটি হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে ছয়জন নিহত হন। ১২ মে বদ্রীনাথে একটি দুর্ঘটনা এড়ানো যায়। ১৭ মে ঋষিকেশের এইমস'এর একটি এয়ার অ্যাম্বুলেন্স কেদারনাথে বিধ্বস্ত হয় তবে দুর্ঘটনায় কোনও হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। ৭ জুন কেদারনাথ যাওয়ার পথে একটি হেলিকপ্টার উড়ানের সময় যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেওয়ার পরে হাইওয়েতে জরুরি অবতরণ করে, যেখানে পাইলট আহত হন। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন যে প্রাথমিকভাবে  দুর্ঘটনাটি কন্ট্রোলড ফ্লাইট ইনটু টেরেন (সিএফআইটি)'এর ঘটনা বলে মনে করা হচ্ছে, যেখানে দৃশ্যমানতা কম এবং উপত্যকার প্রবেশ এলাকায় বিস্তৃত মেঘ থাকা সত্ত্বেও হেলিকপ্টারটি আকাশে উড়েছিল। বিমান দুর্ঘটনা তদন্ত ব্যুরো (এএআইবি) কর্তৃক বিস্তারিত তদন্তর মাধ্যমে দুর্ঘটনার সঠিক কারণ নির্ধারণ করা হবে। মজার ব্যাপার, উত্তরাখণ্ডেও চলছে ডাবল ইঞ্জিনের সরকার।  

এখন আহমেদাবাদে জমে উঠেছে নানান কিসিমের তরজা। একদিকে এয়ার ইন্ডিয়ার বেসরকারিকরণ প্রসঙ্গ, অন্যদিকে দুর্ঘটনার পিছনে কোনও গভীর রহস্য আছে কিনা। বিতর্ক শুরু হয়েছে একটি ভিডিও-কে ঘিরেও। ১২ জুন যেদিন এয়ার ইন্ডিয়ার ওই বিমানটি ভেঙে পড়ল, সেদিন ভেঙে পড়ার দৃশ্য সেকেন্ড কয়েক ক্যামেরাবন্দি করেছিল এক ১৭ বছরের তরুণ। বহু মানুষ সেই ভিডিওটি তাঁদের সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার করেছিলেন। সব টিভি চ্যানেল, ডিজিটাল মিডিয়া ওই ভিডিওটিই সম্প্রচার করেছিল-- কীভাবে এয়ার ইন্ডিয়ার ড্রিমলাইনার ফ্লাইট নম্বর ১৭১ উড়ানটি ওড়া শুরু করার সঙ্গে সঙ্গেই বি জে মেডিক্যাল কলেজ ও সিভিল হাসপাতালের ছাত্রাবাসের ওপর ভেঙে পড়ে। ওই আঁখে দেখো হাল ভিডিওটি করে ১৭ বছরের তরুণটি পড়েছে মহা ফ্যাসাদে। শনিবারের বারবেলায় রীতিমতো বাড়িতে চড়াও হয়ে তাকে নিজেদের জিম্মায় নিয়ে যায় গুজরাতের পুলিশ। জানি না কেন গুজরাত পুলিশের এই সক্রিয়তা! কেন তরুণকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তাকে কি গ্রেফতার করেছে না আটক করেছে, এসব নিয়ে কোনও কথাই বলেনি। হয়তো তাঁদের মনে হয়েছে, ওই  তরুণটির জন্যই এই বিমানটি ভেঙে পড়েছে। বিমানের যন্ত্র সংক্রান্ত কোনও সমস্যার জন্য ওই তরুণ দায়ী। গুজরাতের পুলিশ মোদী-শাহ'র বড় ভক্ত। তবে পুলিশ পরে জানিয়েছে, ওরা তরুণটিকে গ্রেফতার বা ডিটেইন করেনি, বয়ান রেকর্ড করার জন্য নিয়ে গিয়েছিল, তা করে ছেড়ে দিয়েছে। 

১৭ বছর বয়সি ওই তরুণটি উত্তর গুজরাতের সবরকণ্ঠ জেলার ইদারের বাসিন্দা। নাম আরিয়ান আসারি। প্রথমবারের জন্য আহমেদাবাদ এসেছিল বই কিনতে। সেখানেই নিজের বাবার ভাড়া বাড়ির ছাদ থেকে হঠাৎ একটি বিমানকে খুব কাছ দিয়ে যেতে দেখে মোবাইলে ভিডিও করা শুরু করে। তখন সে বুঝতেও পারেনি যে এরপরেই ঘটে যাবে এক ভয়াবহ দুর্ঘটনা। ভিডিও তোলার মাত্র ২৪ সেকেন্ডের মধ্যেই বিমানটি আগুনের গোলায় পরিণত হয়। এই ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখে আরিয়ান ভীষণ ভয় পেয়ে যায়। ভিডিওটা প্রথমে তার দিদিকে দেখায়। আরিয়ানের পরিবার সম্পর্কে জানা যায়, সে তার মা ও দিদির সঙ্গে ইদারে থাকে। তার বাবা আহমেদাবাদে একটি ভাড়া বাড়িতে থাকেন। আগে তিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীতে ছিলেন। এই প্রাক্তন সেনা জওয়ান এখন নিরাপত্তারক্ষীর কাজ করেন। যাক, গেরুয়া শিবিরের সুদূর প্রভাবশালী আইটি সেল এখনও পর্যন্ত আরিয়ানকে বিঁধতে পারেনি। 

বিমান ভেঙে পড়ার খবর ছড়িয়ে পড়ার কিছু পরই সমাজমাধ্যমে পোস্ট: 'প্রাইভেটাইজেশন মৃত্যুকে আহ্বান করে।' মানে গোড়া ধরে টান। ২০১৭ সালের ২৮ জুন মোদী সরকার এয়ার ইন্ডিয়া বেসরকারিকরণের সিদ্ধান্ত নেয়। ২০২২ সালের ২৭ জানুয়ারি বেসরকারিকরণ প্রক্রিয়া সরকারিভাবে সম্পন্ন হয়। ২০২১ সালের অক্টোবরে একেবারে জলের দরে মাত্র ১৮,০০০ কোটি টাকায় এয়ার ইন্ডিয়াকে টাটার কাছে বেচে দিয়েছিল মোদী সরকার। আক্ষরিক অর্থেই ছিল ‘ফ্রি গিফট’! আর এটা বেচে কেন্দ্রীয় কোষাগারে এসেছিল মাত্র ২,৭০০ কোটি টাকা! বাকি ১৫,৩০০ কোটি টাকার ঋণের দায় নিয়েছিলেন 'টাটাবাবুরা'। অথচ এয়ার ইন্ডিয়ার মোট ঋণ ছিল ৬১,৫৬২ কোটি টাকা। তাহলে বকেয়া ৪৬,২৬২ কোটি টাকা কে মেটাবে? কেন গৌরী সেন কেন্দ্রীয় সরকার! ফলে, বছর-বছর এয়ার ইন্ডিয়ার দেনা শোধ করবে কেন্দ্র। আর মুনাফা যাবে টাটার ঘরে। প্রায় মুফতে সেই সঙ্গেই টাটা পেয়েছিল একশোরও বেশি বিমান, হাজার হাজার প্রশিক্ষিত পাইলট ও ক্রু, দেশের বিমানবন্দরগুলিতে ৪,৪৪০টি অন্তর্দেশীয় আর ১,৮০০টি আন্তর্জাতিক অবতরণ ও পার্কিং স্লট ব্যবহারের সুযোগ; এখানেই শেষ নয়, এর পাশাপাশি পেয়েছিল, হিথরো, নিউ ইয়র্ক, সিঙ্গাপুর, দুবাই, হংকং'এর মতো বিদেশের বিমানবন্দরগুলোতে এমন ৯০০টি স্লট ব্যবহারের সুযোগ। একে রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পদ লুঠ ছাড়া আর কী বলা যায়! সরকার পক্ষের যুক্তি, ওসব ছাড় না দিলে শিল্পপতিরা নেবে কেন? আর দুর্ঘটনা? সরকারি সংস্থা হলেও দুর্ঘটনা ঘটতেই পারত, যেমন রেলে ঘটে। তবে রেলের দুর্ঘটনার মূল কারণও রাজনৈতিক। সরকারের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই রেলে কর্মী সঙ্কোচন, জনসংখ্যার অনুপাত ও যাত্রী পরিষেবার বিচারে পরিকাঠামো উন্নত না করা।  

উড়ান দুর্ঘটনার সন্ধেতে মোদী তাঁর ফার্স্ট লেফটেন্যান্ট অমিত শাহকে পাঠিয়ে দিলেন অকুস্থলে। প্রাথমিক ভাবে শাহ সবটা সালটে দেওয়ার পর শুক্রবার মোদীর পা পড়ল মেঘানিনগরে। লোকটার ফটোগ্রাফি সেন্সটা দারুণ! আর সঙ্গে করে যে সব ফটোগ্ৰাফারদের নিয়ে ঘোরেন তাঁরা প্রচণ্ড পরিশ্রমীও বটে। প্রয়োজনে তাঁরা রাস্তার ওপর শুয়ে পড়েও ওঁকে সঠিক অ্যাঙ্গেল থেকে ধরেন। কারণ, ছবিতে ওঁর উপস্থিতির যে প্রয়োজনীয়তা, সেটাও বোঝাতে হয়। নিন্দুকরা বলছেন, উনিজী কোনও বড় ঘটনা ঘটলে সেখানে ক্যামেরা নিয়ে যান, নিজের ছবি তুলিয়ে তা ফেসবুক, এক্স'এ পোস্ট করে নিজের প্রচার করেন। তবে নিন্দুকরা এ প্রশ্নও তুলছেন, কই মোদীমশাই তো মণিপুরে যাননি এখনও? লে হালুয়া! মণিপুরে তো পলিটিক্যাল ক্রাইসিস, বিজেপি তার স্পনসর, ফলে সেখানে যাবেন কেন? উনি সন্দেশখালিতে আসবেন সন্দেশ দিতে। সব ছেড়ে আলিপুরদুয়ারে আসবেন জঙ্গি তাড়াতে! এসবই ওঁর রাজনৈতিক কর্মসূচি, যেমন গেলেন আহমেদাবাদ। 

বলি শাহজী, এই বিমানটা যদি পশ্চিমবঙ্গে ভেঙে পড়ত তবে আপনি কী বলতেন? বলতেন, 'দিদি কা সরকার খতম হোনে কি সন্দেশ অ্যা রেহি হে। আপ বহুমত ভাজপা সরকার গঠন কর দিজিয়ে।' পাল্লা দিয়ে শুভেন্দু অধিকারী বলতেন, 'এর জন্য দায়ী তোলাবাজ ভাইপো ও চটি পিসি। বিমানবন্দর চত্বরে তোলামূলের জামাত বাহিনীদের বসিয়ে রেখেছে। সময় এসেছে হিন্দু হিন্দু ভাই ভাই।'


Friday, 13 June 2025

গাজার পাশে বিশ্ববাসী

ইজরায়েলের পৈশাচিক ধ্বংসলীলা

সোমা চ্যাটার্জি



গাজায় ক্রমবর্ধমান মানবিক সংকটের মধ্যেই ১৩ জুন ইজরায়েল ইরানের পারমাণবিক স্থাপনার কেন্দ্রস্থল ও অন্যান্য অবকাঠামোর ওপর ব্যাপক আক্রমণ চালায়। এই দায়িত্বজ্ঞানহীন পদক্ষেপ মধ্যপ্রাচ্যকে আরও অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিয়েছে এবং পশ্চিম এশিয়ায় আঞ্চলিক সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য কায়েমের লক্ষ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-ইজরায়েল'এর যে একটি অক্ষ গড়ে উঠেছে তার মূল উদ্দেশ্য, পশ্চিম এশিয়ার সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলিকে দমন করে লেবানন, ইয়েমেন, সিরিয়া ও অন্যান্য দেশগুলিতে সংঘাত সম্প্রসারিত করা। 

ইজরায়েল যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ণ মদতে আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার লঙ্ঘন করে একটি দুঃশাসিত রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে তার সবচেয়ে বড় সাক্ষী গাজা উপত্যকা। গত কয়েক দশক ধরে  ইজরায়েল ও হামাসের মধ্যে অবিচ্ছেদ্য সংঘর্ষে এক সময়ের সবুজ উপত্যকা আজ একটি মৃত্যুপুরী, একদা কোলাহল মুখর জনপদ আজ এক ধ্বংসস্তূপ। এ পর্যন্ত সরকারি হিসেবে গাজায় নিহতের সংখ্যা পঞ্চাশ হাজারের বেশি, আহত লক্ষাধিক। প্রতিদিন গড়ে মৃত্যু ১৪৮ জনের। নিহতদের মধ্যে অন্তত ৫০ শতাংশ নারী ও শিশু এবং ১০০ জনেরও বেশি সাংবাদিক। বিশ্বের বাকি অংশ থেকে গাজা কার্যত বিচ্ছিন্ন হওয়ায় তারা সব কিছুর জন্যই ইজরায়েলের উপর নির্ভরশীল। তাই, ইজরায়েল গাজার জল ও বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ায় গাজার জনজীবন কার্যত বিধ্বস্ত ও দুর্ভিক্ষগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। তার উপর গত আড়াই মাসেরও বেশি সময় ধরে গাজায় কারও কোনও ত্রাণ সহায়তা ঢুকতে দিচ্ছে না ইজরায়েলি সেনারা। কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে গত ৯ জুন সারা বিশ্বে আমানবিকতার চূড়ান্ত নজির সৃষ্টি করেছে ইজরায়েলের বেঞ্জামিন নেতেনইয়াহুর সরকার।

আন্তর্জাতিক অলাভজনক সংস্থা 'ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশন'এর 'ম্যাডেলিন' নামে একটি ত্রাণ সরবরাহকারী জাহাজকে ভূমধ্যসাগরের আন্তর্জাতিক জলসীমায় আটকে দেয় ইজরায়েলি সেনারা। ওই জাহাজটিতে সুইডেনের বিখ্যাত পরিবেশবাদী গ্রেটা থানবার্গ সহ আরও ১২ জন মানবাধিকার কর্মী ছিলেন, যাদের মধ্যে ফ্রান্সের বিখ্যাত আইনজীবী ও ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত ইউরোপীয় সংসদের ফরাসি সদস্য রিমা হাসান, দুই ফরাসি নাগরিক এবং স্পেন, তুরস্ক, নেদারল্যান্ডস, ফ্রান্স, ব্রাজিল ও জার্মানির আরও অনেকে ছিলেন যারা সবাই আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বা পরিবেশবিদ হিসেবে পরিচিত। গ্রেটা থানবার্গ একজন জলবায়ু রক্ষার প্রচারক কিন্তু গাজার ক্ষতিগ্রস্ত জনগণকে ত্রাণ পৌঁছনোর জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে তিনি ৩ জুন শিশুর ফর্মুলা, খাদ্য ও জীবন রক্ষাকারী পণ্যসম্ভার নিয়ে 'ম্যাডেলিন'এ যাত্রা করেন। জাহাজটি ইজরায়েল সীমানার কাছাকাছি আসতেই ইজরায়েলি সেনারা ড্রোনের মাধ্যমে কিছু বিষাক্ত রাসায়নিক নিক্ষেপ করে গাজা থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরে আন্তর্জাতিক জলসীমায় জাহাজটিকে আটক করে। সেই সময়ে গ্রেটা থানবার্গের একটি ভিডিও রয়টার্সের মাধ্যমে এক্স হ্যান্ডেলে দেখা যায়, যেখানে লাইফ জ্যাকেট পরিহিত জাহাজের যাত্রীরা রয়েছেন এবং গ্রেটা বলছেন যে তাঁদের জাহাজটি ইজরায়েলের সেনারা অপহরণ করতে চলেছে। তিনি সুইডিশ সরকার, তার নিজের পরিবার, বন্ধুবান্ধব ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাদের কাছে অনুরোধ জানান তাদের মুক্ত করার জন্য। ইজরায়েলি পররাষ্ট্রমন্ত্রক এটিকে স্টান্টবাজি ও লোকদেখানো হিসেবে অভিহিত করলে বিশ্বের গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। শেষ পর্যন্ত ইজরায়েলি সরকার গ্রেটা সহ অন্যান্যদের  ফ্রান্সে ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয় এবং সে কথা সামাজিক মাধ্যমে বার্তা দিয়ে প্রকাশ করে। রিমা হাসানকেও ইজরায়েলে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি, কারণ, তিনি ফিলিস্তিনিদের প্রতি ইজরায়েলি নীতির বিরোধিতা করেছিলেন।

রাষ্ট্রসংঘের মতে, আজ পর্যন্ত ২ লক্ষ ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়েছে যা গাজার মোট জনসংখ্যার এক-দশমাংশ। গত দু' মাসে শুধু আনাহারেই মৃত্যু হয়েছে প্রায় ৫০০ জনের। সারা পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে আতঙ্কগ্রস্ত গাজার শিশু ও নারীদের করুণ আর্তনাদের ভিডিও। চতুর্দিকে উঠেছে নিন্দার রব। ক্রমবর্ধমান আন্তর্জাতিক চাপের মুখোমুখি হয়ে ইজরায়েল মে মাসের শেষের দিকে সামান্য সাহায্যের অনুমতি দিতে শুরু করে। সম্প্রতি ঈদের দিন ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিও'তে গাজায় এক মাকে তার সন্তানের ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য মাটি থেকে ময়দার গুড়ো কুড়িয়ে নিতে দেখা যায়। ক্ষুধা, অনাহার আর মৃত্যুতে যখন প্রায় ২৩ লাখ ফিলিস্তিনির জীবন বিপর্যস্ত, ঠিক সেই সময়েই জুনের প্রথম সপ্তাহে খাবার, ওষুধ ও প্রয়োজনীয় ত্রাণ সরবরাহ নিয়ে ইতালির সিসিলির কাতানিয়া থেকে রওনা দেয় থুনবার্গ'দের জাহাজ, কিন্তু প্রথম থেকেই এই প্রশ্ন ছিল যে তা আদৌ গাজায় ত্রাণ পৌঁছতে সফল হবে কিনা! কারণ, মাত্র এক মাস আগে ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশনের আরেকটি সাহায্যকারী জাহাজকে ইজরায়েল ড্রোন দিয়ে আঘাত করার ফলে জাহাজটিতে আগুন লেগে যায় এবং চারজন বেসামরিক স্বেচ্ছাসেবক আহত হন। 

আমরা জানি, ২০০৬ সালে নির্বাচনের পর হামাস গাজা উপত্যকার নিয়ন্ত্রণ নেয় এবং ২০০৭ সালে ফাতা'র সঙ্গে গৃহযুদ্ধের পর থেকে গাজা উপত্যকা ও ইজরায়েলের মধ্যকার সংঘাত জটিল হতে শুরু করে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এ পর্যন্ত গাজায় ৫০০'রও বেশি স্বাস্থ্যকর্মী নিহত হয়েছেন, ৩৬টি হাসপাতালের মধ্যে এখন মাত্র ১০টি আংশিকভাবে কার্যকর; এলাকার ৮৪ শতাংশ স্বাস্থ্যকেন্দ্র ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত। এছাড়াও, ইজরায়েল সাংস্কৃতিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ অসংখ্য ভবন ধ্বংস করেছে, যার মধ্যে রয়েছে ১৩টি গ্রন্থাগার যেখানে হাজার হাজার বই ছিল; ছিল গাজার ১২টি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ৮০ শতাংশ স্কুল, বেশ কয়েকটি মসজিদ, তিনটি গির্জা এবং দুটি জাদুঘর। রাষ্ট্রসংঘের মতানুযায়ী, গাজা উপত্যকা পুনর্গঠনের জন্য ৫৩০০ কোটি মার্কিন ডলার প্রয়োজন।

১৯৪৮ সালে আরব-ইজরায়েল যুদ্ধ দিয়ে ফিলিস্তিনে যুদ্ধ শুরু হলেও আজ ৭৫ বছরেও তা শেষ হয়নি, বরং দিন দিন ভয়াবহ রূপ নিয়ে বেড়েছে। ১৯৯৩ সালে নরওয়ের ওসলো'তে ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন দুই পক্ষ শান্তি চুক্তিতে সম্মত হলেও ইজরায়েলের পাশে আরেকটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের জন্য ইজরায়েল রাজি না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত সেই চুক্তি বাস্তবায়িত হয়নি। তাছাড়া এই দুই রাষ্ট্রের সীমান্ত জেরুসালেম কার অধীনে থাকবে, বা ফিলিস্তিনের মধ্যে বসবাসকারী ইজরায়েলি ইহুদিরা কোথায় যাবে, এবং ফিলিস্তিনে শরণার্থীদের জন্য নতুন বাসস্থান কোথায় হবে প্রভৃতি বিষয়গুলিও পরে আলোচনায় ঠিক করা হবে বলে কথা হলেও ভবিষ্যতেও অনালোচিতই থেকে গেছে। এরপর জেরুসালেমে ইজরায়েলি রাজধানী প্রতিষ্ঠার পর এবং পশ্চিম তীরে ইহুদী বসতি দিন দিন বেড়ে যাওয়ায় ইজরায়েল সরকার স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের সম্ভাবনা থেকে সম্পূর্ণ মুখ ফিরিয়ে নেয়। বস্তুত, এই কারণই জন্ম দেয় হামাস বা ফাতা'র মতো গোষ্ঠী যাদের দাবি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন।

বর্তমান ইজরায়েল সরকার চায় পশ্চিম তীরকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে, যাতে ফিলিস্তিনিরা দুর্বল হিসেবে সবসময়ই ইজরায়েলের উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকে। তাই, এই দখলদারি রাজনীতির জন্য গাজা থেকে সাময়িক ভাবে ইজরায়েল সরে আসলেও তারা পশ্চিম তীর ছাড়েনি বরং আমেরিকার মদতপুষ্ট হয়ে শান্তি চুক্তিকে দূরে সরিয়ে রেখে লাগাতার বোমা বর্ষণ ও নিধনযজ্ঞ চালাচ্ছে গাজার উপর। ঘৃণা এতদূর ছড়িয়েছে যে ইহুদি বিদ্বেষী হিটলারও যে কথা প্রকাশ্যে বলেনি তা সাম্প্রতিককালে একজন ইহুদি ইজরায়েলি রাজনীতিবিদ মশে ফেলিন বলে ফেলেছে-- 'গাজায় বসবাসকারী প্রতিটি শিশুর মৃত্যুই কাম্য', কারণ, তারা সবাই ইজরায়েলের শত্রু।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে সবচেয়ে বেশি  বিপর্যস্ত, বিধ্বস্ত ও রাজনৈতিক ভাবে আলোচিত হলেও গাজা নিয়ে পৃথিবীর কোনও দেশই আজ পর্যন্ত কোনও একটি সঠিক ও পক্ষপাতহীন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে গাজাবাসীদের পাশে দাঁড়ায়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অধিকাংশ ইউরোপীয় দেশ সহিংসতার জন্য ফিলিস্তিনের নিন্দা করেছে, যদিও  কিছু আরব ও মুসলমান দেশ সহ বিভিন্ন রাষ্ট্র ফিলিস্তিনের সমর্থনে ইজরায়েলি দখলদারিত্বকে দায়ী করেছে। একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘ইজরায়েলের বন্ধু’ হিসেবে পাশে থেকে ইজরায়েলকে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে সামরিক খাতকে শক্তিশালী করতে সহায়তা করে যাচ্ছে, অন্যদিকে সম্প্রতি ইজরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক আরও গভীর করেছে ভারত, বিশেষ করে ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে। ইজরায়েলের ধর্মীয় জাতীয়তাবাদকে মোদির কিছু অনুসারীরা অনুপ্রেরণা হিসেবেও গ্রহণ করেছে। মস্কোর পর ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ হয়ে উঠেছে ইজরায়েল ।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বের রাজনৈতিক পটভূমি কতটা বদলে গেছে এবং পরাশক্তিগুলোর পারস্পরিক রশি টানাটানি কতটা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের নিয়ামক হয়ে উঠেছে, তা চলমান গাজা-ইজরায়েল যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। যুদ্ধটি শুধু দুই দেশের মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই।  সারা পৃথিবীর রাজনীতিবিদরা যখন জাতিসংঘে তীব্র কূটনৈতিক ঝগড়া এবং ইহুদি, মুসলিম বা আরবদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ও ঘৃণা ছড়াতে ব্যস্ত তখন গ্রেটা থানবার্গের মতো মাত্র ২২ বছর বয়সী এক তরুণীর গাজার অবরুদ্ধ মানুষের জন্য ন্যায়বিচার এবং ত্রাণের দাবিতে লড়াই করার মানসিকতা নিঃসন্দেহে একটি সাহসী পদক্ষেপ এবং এই রাজনৈতিক অচলাবস্থাকে চ্যালেঞ্জ জানায়।

কিন্তু হামাস নিধনের নামে যে পৈশাচিক ধ্বংসলীলা ইজরায়েল  চালাচ্ছে, সেই মানবাধিকারের কলঙ্ক  মোছার জন্য অন্য দেশ এবং নেতারা কি দায়িত্বশীল হবে নাকি এখনও চুপ করে এই সশস্ত্র সন্ত্রাসকে আরও  ভয়াবহতার দিকে ঠেলে দেবে সেটাই দেখার বিষয়।



Tuesday, 10 June 2025

'প্রধান শত্রু' কে?

ডুবন্ত মানুষ যাকে ধরবে তাকেই ডোবাবে

মালবিকা মিত্র



'হাত আছে কাজ দাও, নইলে বেকার ভাতা দাও'-- এই স্লোগান একসময়ে ছিল সিপিআইএমের ছাত্র-যুব আন্দোলনের অন্যতম মূল স্লোগান। এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত ভাবে বক্তৃতার সময় বলা হত, বেকার ভাতা দেওয়া কোনও স্থায়ী সমাধান নয়, কিন্তু এই ভাতা দেওয়ার অর্থ বেকারের কাজের অধিকারকে আইনগত ভাবে মেনে নেওয়া। এর ফলে কাজের দাবিটা অধিকার হিসেবে অনেক বেশি জোরালো হয়ে ওঠে। এরপর ১৯৭৭ সালে দল ক্ষমতায় এলে বেকার ভাতা চালু করা হয় (যদিও বছর কয়েক যেতে না যেতেই তা নিঃশব্দে অপসৃত হয়)। বলা হত, বেকার যুবক-যুবতীদের এই স্বীকৃতি রাজ্যের বাইরে সারা দেশের ছাত্র-যুব আন্দোলনে এক ঐতিহাসিক জোয়ার নিয়ে আসবে। মানে আমি বলতে চাইছি, ভাতাকে ভিক্ষাই বলি অথবা নাকের বদলে নরুণ, এই ভাতার দাবিটা সিপিআইএম দলের ছাত্র-যুব আন্দোলনের প্রধান দাবি ছিল। 

বন্ধ চা বাগানের শ্রমিকদের মাসিক রিলিফ বা ভাতা প্রদান, বন্ধ কারখানার শ্রমিকদের মাসিক ভাতা প্রদান, বার্ধক্যকালীন ভাতা, বিধবা ভাতা, এসব তো কল্যাণকামী রাষ্ট্রের ধারণার সঙ্গে অঙ্গীভূত ছিল। আমি যতক্ষণ না তোমার সমস্যার কোনও নির্দিষ্ট সমাধান করতে পারছি, ততক্ষণ আপৎকালীন হিসেবে এই ভাতা প্রদান করব। সরকারি কর্মচারীদের ক্ষেত্রেও নতুন পে-কমিশন গঠনের পর রিপোর্ট প্রকাশের আগে পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন ভাতা দেওয়া হয়। ঠিক সেই যুক্তি থেকেই এসএসসি নিয়োগ সংক্রান্ত জটিলতা ও কর্মচ্যুতির আইনি প্রক্রিয়া চলাকালীন গ্রুপ সি ও গ্রুপ ডি কর্মচারীদের আপৎকালীন একটি ভাতা প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল রাজ্য সরকার। আদালতে মামলার নিষ্পত্তি হয়ে গেলে তখন নিশ্চিতভাবে এই ভাতার প্রশ্ন আর থাকবে না। কারণ, মনে রাখতে হবে, এই কর্মচারীরা কেউ ছ' বছর কেউ সাত বছর চাকরি করেছেন, নতুন ছকে জীবনযাপন করেছেন, গৃহঋণ নিয়েছেন, কেউ শিক্ষা ঋণ নিয়েছেন সন্তানের জন্য। তাদের জীবনযাত্রায় এক বিরাট পরিবর্তন ঘটে গেছে। আজ হঠাৎ করে 'তোমার আর চাকরি নেই' বলে দেওয়াটা দায়িত্বজ্ঞানহীনতা। তাদের জীবনের সঙ্গে এখন বহু কিছু প্রশ্ন জড়িয়ে গেছে। সেই কারণেই এই আপৎকালীন ভাতার মানবিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ। একটি সরকার কখনও দায়িত্বজ্ঞানহীন ভাবে বলতে পারে না, আজ থেকে তোমার চাকরি শেষ, এবার তুমি যাও, সপরিবারে রেললাইনে গলা দাও। 

সিপিআইএমের পণ্ডিত ও আইনজীবী নেতা প্রশ্ন তুলেছেন, জনস্বার্থের সঙ্গে যুক্ত নয় এমন ক্ষেত্রে এ ধরনের ভাতা দেওয়া যায় না। আসলে এনারা নিজেদের অতীত বিস্মৃত হয়েছেন। সিঙ্গুরে বড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে এক প্রধান শিক্ষক (কৃষক নেতা) দীর্ঘদিন ধরে জেনেশুনে অন্যায় ভাবে উচ্চ হারে হায়ার স্কেলে বেতন ভোগ করলেন। অতঃপর অবসরের সময় তাঁর ঘাড়ে বিপুল পরিমাণ ওভারড্রয়ালের বোঝা। তিনি তৎকালীন নেতা বিধায়ক মলিন ঘোষ, মণীন্দ্র জানা, বলাই ব্যানার্জি এদের সুপারিশ সহ একটি মার্জনার আবেদনপত্র পাঠালেন রাজ্যপালের কাছে। রাজ্যপাল প্রায় দেড় লক্ষ টাকার ওভারড্রয়াল ক্ষমা করে দিলেন মাত্র এক টাকার বিনিময়। হ্যাঁ, এটা বামফ্রন্টের ৩৪ বছরের শাসনকালের ঘটনা। পার্থক্য একটাই, কোনও একজন ব্যক্তি বিশেষের স্বার্থে নয়, বর্তমান সরকার একটি সমগ্র প্যানেলের গ্রুপ সি-গ্রুপ ডি কর্মচারীদের সকলের জন্য সমভাবে এই আপৎকালীন ভাতা দিয়েছে। অথচ, সেই ভাতা বন্ধ করার জন্য আদালতে এখন সেই বাম নেতারাই উকিলের পোশাকে সরগরম। প্রকৃত প্রস্তাবে, এনারা যে সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকার অধিকারের বিরুদ্ধেই যুদ্ধে নেমে গেছেন, সে বোধটুকু কি বাকী বাম নেতাদেরও লোপ পেয়েছে? চোখে আঙুলদাদা হলে বলতেন, আরে বাপু, এরপরে ওই পড়ে থাকা ৬-৭ শতাংশ ভোটও কি আর আপনাদের জুটবে? 

অথচ, সিপিআইএম দলের কর্মসূচি ও কর্মনীতি এই রিলিফকে অনুমোদন করেছে। কর্মনীতির ১১২ নম্বর অনুচ্ছেদটি লক্ষ করুন-- 'Paragraph 112 of the CPIM's party programme outlines the party's approach to forming governments, emphasizing the importance of using all opportunities to bring into existence governments that implement a modest program of immediate relief for the people.'। এরপরে অবশ্য বিপ্লবীয়ানা বজায় রাখতে বলা হয়েছে যে 'such governments can strengthen the revolutionary movement of the working people and aid in building a democratic front. Essentially, it's about strategically using state power to advance the cause of the working class and broader democratic movements.'। শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লবী সংগ্রাম কতটা প্রবলভাবে শক্তিশালী হয়েছে তার বিচার করবেন জনগণ। সেই আলোচনায় যাব না। কিন্তু যাদের পার্টি কর্মসূচিতে 'ইমিডিয়েট রিলিফ' একটি ঘোষিত নীতি, তারা কী করে ৫-৬ হাজার গ্রুপ সি-গ্রুপ ডি কর্মীর পেটে অনায়াসে লাথি মারে! আর শুধু তো ৫-৬ হাজার নয়, এদের পরিবারগুলিকে হিসেব করলে সংখ্যাটি ২৫ হাজার হতে পারে। আর এই ২৫ হাজারের সঙ্গে অর্থনৈতিক ক্রিয়াকর্মে যুক্ত মানুষের সংখ্যাটি আরও হাজার খানেক হবে নিশ্চয়ই। এটাই কি আজকের সিপিআইএম? তবুও তাদের গায়ে এখনও 'বামপন্থী তকমা'?

এই দলটিই এ রাজ্যে নাকি বাম ঐক্যের নেতৃত্বে আসীন, যারা কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপি-আরএসএস শক্তির চরিত্রকে গোপন করতে আপ্রাণ সচেষ্ট। 'মেইনস্ট্রিম' পত্রিকায় ঐতিহাসিক ও বামপন্থী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নলিনী তানেজা সিপিআইএমের পার্টি কংগ্রেসের দলিল সম্পর্কে বলেন, 'nowhere in the document does one get the sense of degree of suffering of people as a result of the actions of this regime, an idea of what the Muslims go through in their daily lives, attacks and lynchings, and threats to physical existence, the NRC and potential denial of citizenship, the detention camps, or the war on tribals and smaller nationalities: in short, the fascist conditions to which certain regions of the country and certain categories of our people are subjected.'। অর্থাৎ এটা স্পষ্ট, সম্প্রতি পশ্চিমবাংলায় যে বৃহত্তর বাম জোটটি গড়ে উঠছে তার ভিত্তি আর যাই হোক ফ্যাসিবাদ বিরোধিতা নয়। মৌলালি যুব কেন্দ্র থেকে আসন্ন কালীগঞ্জের উপনির্বাচন, দেখা যাচ্ছে সর্বত্রই এই জোট সক্রিয়। কিন্তু প্রধান প্রশ্নেই তো এরা ঐক্যবদ্ধ নয়– বিজেপি জোট পরিচালিত সরকারগুলির চরিত্র ফ্যাসিবাদী নাকি আধা-ফ্যাসিবাদী, নাকি তা নিছকই এক ফ্যাসিবাদী প্রবণতা! শোনা যায়, এ নিয়ে বিস্তর মতভেদ। তাহলে এই বাম ঐক্যের ভিত্তি কী? আর প্রধান শত্রুই বা কীভাবে একই সময়ে দুটি আলাদা রাজনৈতিক শক্তি হয়? 

দেখলাম, 'এই সময়' পত্রিকায় সিপিআই(এমএল) লিবারেশন দলের রাজ্য সম্পাদক অভিজিৎ মজুমদারকে উদ্ধৃত করা হয়েছে, 'বাংলার বুকে ফ্যাসিস্ট বিজেপি-আরএসএস যুদ্ধ উন্মাদনা ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ প্রচার করে গণতন্ত্র ও সংবিধানকে ধ্বংস করতে চাইছে।' এ থেকে খুব স্পষ্ট মনে হয়, ঐক্যের ভিত্তি হল ফ্যাসিবাদ বিরোধিতা। কিন্তু ফ্যাসিস্ট চরিত্র নিয়েই তো বাম দলগুলির মধ্যে জোর বিতর্ক। তাহলে? তথাপি, কালীগঞ্জে ফ্যাসিবাদ বিরোধী জোটের কথা শুনে একটু পরিসংখ্যান দিতেই হচ্ছে। ২০১৬, ২০১৯ ও ২০২১ সালে তৃণমূলের ভোট এখানে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ৮৩৮৯৮, ৯৯৮০৯ ও ১১১৬৯৬। উল্লিখিত তিনটি নির্বাচনে বিজেপির ভোট বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছিল ১০৩৭৩, ৬২৬১১ ও ৬৪৭০৯। অথচ, সিপিএম-কংগ্রেসের ওই তিন নির্বাচনে যুক্ত ভোট ছিল ৮৫১২৫, ২৫৪২৪ ও ২৫০৭৬। আমি বলতে চাইছি যে, কালীগঞ্জ আসনটিতে বিজেপি যথেষ্ট পিছিয়ে থাকা অবস্থায় আছে। এখানে বিজেপির যে বাড়বৃদ্ধি তার সমস্ত কৃতিত্বটাই সিপিএম ও বামফ্রন্টের, কারণ, তাদের ভোটগুলিই এক লপ্তে বিজেপির ঝুলিতে জমা হয়েছে। অতএব, এক কথায় বলতে গেলে, কালীগঞ্জ কেন্দ্রে বাম ঐক্যের সামনে ফ্যাসিবাদী শক্তিকে হারানোর প্রশ্নই নেই, তদুপরি, ফ্যাসিবাদ প্রশ্নে তারা নিজেরাও ঐক্যবদ্ধ নয়। 

এবার তাহলে সিপিআইএমের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও অভিমুখ সম্পর্কে কোনও দ্বিধা থাকতে পারে না। সবটাই লাইনে আছে, কোথাও বেলাইন হয়নি। শত্রু হিসেবে তাদের মূল লক্ষ্য রাজ্যের তৃণমূল সরকার। সমালোচনা হিসেবে তাদের মূল লক্ষ্য সরকারের নানাবিধ আর্থিক ভাতা, রিলিফ, যা তাদের ভাষায় 'ভিক্ষা'। নিয়োগ সংক্রান্ত দুর্নীতির ক্ষেত্রে তাদের প্রধান লক্ষ্য দুর্নীতিগ্রস্তদের যথাযথ বিচার ও শাস্তি নয়, দুর্নীতির ফলে ভুক্তভোগী সাধারণ চাকুরিজীবী ও চাকুরী প্রার্থীদের আরও জটিলতর অসমাধানযোগ্য অন্ধগলিতে দিশাহীন করা, যার ফলে রাজ্য সরকার বিরোধী একটা গণ অসন্তোষ ও নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়। সর্বোপরি, যে বামপন্থী ভোটের ৬-৭ শতাংশ এখনও বামের ঝুলিতেই আছে এবং অন্তত এক শতাংশ বামপন্থী ভোট 'নো ভোট টু বিজেপি' সিদ্ধান্তের কারণে তৃণমূলের পক্ষে আছে, এই সমস্ত ভোটটাকে যদি একত্রিত করে অন্তত এর অর্ধেকটা বিজেপির ঝুলিতে হস্তান্তর করা যায়, তবে নিশ্চিত ভাবে এ রাজ্যে তৃণমূলের অপশাসন রোধ করা এবং বিজেপিকে ক্ষমতাসীন করা যাবে। আর সেই কারণেই গা বাঁচাতে বিজেপিকে ফ্যাসিবাদী বলা যাচ্ছে না।

বিজেপি'র বাংলা-বিহার জয় সম্পূর্ণ হলে আরএসএস-বিজেপি'র চেহারাটা আরেকটু স্পষ্ট হবে। তখন নিশ্চয়ই সিপিআইএম দল একটি বিশেষ প্লেনারি অধিবেশন আহবান করে বলতে পারবে– কমরেড, কমিউনিস্টরা ভুল করতে ও ভুল স্বীকার করতে দ্বিধাবোধ করে না। সমস্যা হল, সিপিআইএমের এই চরিত্র সাধারণের কাছে স্পষ্ট। সিপিআই(এমএল) লিবারেশন কেন যে হঠাৎ এই ভুলের অংশীদার হতে যাচ্ছে তা স্পষ্ট হচ্ছে না।