Sunday, 17 November 2024

প্রজাপতির ন্যায় এক ত্বষ্টা

কেউ শব্দ কোরো না

অমৃতা ঘোষাল


(২২ ডিসেম্বর ১৯৩৮ - ১২ নভেম্বর ২০২৪)

সাজানো বাগানে বেশ কিছু রঙিন আর সাদা-কালো ছবির মতো ফুল ছিল। চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর মতো! আর গভীরভাবে দেখলেই দ্রষ্টার বুকের মধ্যে স্বর্গসুখকে ছাপিয়ে প্রকট হবে গুলজার এক নরক। বাস্তববাদী নাট্যকার যে অপার নাট্যজগতে প্রজাপতির ন্যায় এক ত্বষ্টা, তার সার্থক উপমা মনোজ মিত্র। 

ব্রিটিশ-ভারতের খুলনা জেলার সাতক্ষীরা মহকুমার ধূলিহর গ্রামে জন্ম নেওয়া মনোজ শৈশবেই প্রত্যক্ষ করেছিলেন দেশভাগের ফলাফল। খুলনা তাঁর জন্মভূমি হলেও আর ভারতভূমি হিসেবে রইল না! কাঁচা বয়সেই সৃজনশীল রচনায় দক্ষ মনোজকে যথেষ্ট ভাবিয়েছিল ভারত-পাকিস্তানের স্বাধিকারপ্রমত্ত রাজনীতি। গ্রামের চণ্ডীমণ্ডপে নাটকের অভিনয় দিয়েই তাঁর নাট্যজগতে পদার্পণ, বললে অত্যুক্তি হয় না। জীবনের ঊষালগ্ন থেকেই 'imitation of an action'-কে চ্যালেঞ্জ জানাতে পেরেছিলেন তিনি। রবীন্দ্রনাথের হাস্যকৌতুক 'রোগের চিকিৎসা'-র অভিনয়ে, হাঁস-চুরি-করা বালকটির ভূমিকায় তিনি এক অবিশ্বাস্য কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন। কোনও অনুকৃতি নয়! জামার ভেতর গোটা হাঁস লুকিয়ে শিশু-মনোজ স্টেজে এসে অভিনয় করল। তবে হাঁসের আঁচড়ে-কামড়ে পেট-বুক রক্তাক্ত হয়ে তাঁর সহ্যসীমাও সহজেই অতিক্রান্ত হয়েছিল। দর্শক অনুভব করেছিল, নাটককে সাধারণ দর্শকের বিশ্বাসযোগ্য তথা 'universalized' করে তোলার জন্য তাঁর প্রতিটি সত্তা চূড়ান্তভাবে উন্মুখ। সেই যন্ত্রণায় মাখা কৌতুক-স্মৃতি সম্ভবত তাঁর জীবনের শেষ সাক্ষাৎকারেও আমরা খুঁজে পাব। 

দেশভাগের প্রভাবে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন বঙ্গদেশের বিভিন্ন স্তর-মর্যাদার বহু  মানুষ। মাতৃভূমি ছেড়ে ১৯৫০ সাল নাগাদ তিনি চলে আসেন এই বাংলায়। বেলেঘাটার ভাড়াবাড়ি, বসিরহাটের বাড়ি পেরিয়ে তরুণ মনোজ মিত্র থাকতে শুরু করলেন বেলগাছিয়ার বাড়িতে। এরপর স্কটিশচার্চ কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হন ১৯৫৪ সালে। আর তখন থেকেই একটা নাটক রচনার প্রতিবেশ নিজের চারিপাশে আবিষ্কার করে ফেলেন। পার্থপ্রতিম চৌধুরী, অতনু সর্বাধিকারী আর দীপার  (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রী) মতো বন্ধুদের সান্নিধ্যে থিয়েটারের সঙ্গে একেবারে গভীর সম্পর্কে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন। সেই পার্থর অফুরান উৎসাহেই ১৯৫৬ সালে গড়ে ওঠে নাটকের দল 'সুন্দরম'। চলচ্চিত্র-সংরূপের সঙ্গে জড়িয়ে নাটকের এক অভিনব দিশা সন্ধান করেছিল সেই দল। তাই 'পথের পাঁচালী'র নাট্যরূপ মঞ্চে উপস্থাপিত করার পরিকল্পনা করেছিল সেই দল, যদিও মনোজ প্রাধান্য দিতে চেয়েছিলেন সমকালীন বাস্তবতার জ্বলন্ত পাবককেই। সম্ভবত প্রদর্শনধর্মী  উন্মাদনা আর যুগীয় প্রবণতার কিছুটা বিপরীতে হাঁটতেন তিনি। 

দর্শন নিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ পড়াকালীন ১৯৫৯ সালে লিখলেন প্রথম নাটক 'মৃত্যুর চোখে জল'। ২১ বছরের যুবার কলমে সেই একাঙ্কের পরতে পরতে দীপ্ত হয়ে উঠল এক বার্ধক্য-আক্রান্ত প্লট। শৈশব থেকেই বৃদ্ধ পিতামহকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ করা মনোজ উপলব্ধি করেছিলেন জীবনসায়াহ্ন-জনিত ক্রাইসিস। অথচ তাঁর সেই ঠাকুরদা অন্নদাচরণ মিত্র কিন্তু ছিলেন থিয়েটার-বিরোধী। তবে  অন্নদাচরণের কর্তৃত্বে তাঁদের গ্রামের বাড়িতেই থিয়েটারের উপকরণ-সরঞ্জাম রাখা হত। মাত্র একুশ বছর বয়সেই তিনি অভিনয় করলেন 'মৃত্যুর চোখে জল'-এর কেন্দ্রীয় চরিত্র বৃদ্ধটির ভূমিকায়। আর্টিস্ট অনন্ত দাসের অসামান্য সাজানো, গলায় বার্ধক্যের ভঙ্গিমা, হাঁটার কায়দায় অবসন্ন ভাব কিংবা বয়সজনিত জরা-- এ সমস্ত কিছুকে আয়ত্ত করে সদ্য যুবক মনোজ একেবারে তাক লাগিয়ে দিলেন দর্শককে।  ১৯৫৭ থেকে ১৯৬০ অবধি 'সুন্দরম'-এ কাটিয়ে শ্যামল ঘোষের দল 'গন্ধর্ব'-এর সঙ্গে কিছুটা যুক্ত হলেন। সেই দলের নাট্যপত্রিকায় ছাপা হল তাঁর 'মোরগের ডাক' ও 'নীলকণ্ঠের বিষ'।

১৯৬০-এ রানীগঞ্জ কলেজ, ১৯৬৪'তে ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র কলেজ আর ১৯৬৫'তে নিউ আলিপুর কলেজে দর্শন বিষয়ে অধ্যাপনাও করেন। পরবর্তীকালে অবশ্য রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক বিভাগেই অধ্যাপনার কাজে যোগ দেন। রানীগঞ্জ থেকে কলকাতায় ফেরার পর মহানগর দায়িত্ব নিয়েই তাঁর প্যাশনের স্রোতকে সঠিক খাতে বইয়ে দিল। শুরু করেছিলেন যে গবেষণার কাজ, তা-ও বন্ধ হয়ে গেল। শ্যামল ঘোষের নতুন দল 'গন্ধর্ব' কিংবা পার্থর 'সুন্দরম'-এ তিনি আর ফিরলেন না। কয়েকজন মিলে গড়ে তুললেন এক ক্ষণস্থায়ী দল 'ঋতায়ন'। সেই দলও ভেঙে যাওয়ার পর তাঁর লেখা নাটক 'চাক ভাঙা মধু' বেশ সাড়া ফেলে দেয়। সেই নাটকের পরিকল্পনা-রিহার্সাল আরম্ভ হওয়ার পর নতুন গড়ে ওঠা দলটির সামগ্রিক ছন্দে কিছু খুঁত ফুটে ওঠে। অন্যদিকে 'সুন্দরম' দলের দেহেও তখন কিছুটা অকাল-ভাঙন। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও নির্মাল্য আচার্য সম্পাদিত 'এক্ষণ' পত্রিকায় এবার  প্রকাশিত হল তাঁর 'চাক ভাঙা মধু', আর বিভাস চক্রবর্তীর 'থিয়েটার ওয়ার্কশপ'-এর উদ্যোগে তা মঞ্চে অভিনীত হল। 

রানীগঞ্জ কলেজে হিন্দি ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক নারায়ণ পাণ্ডের লোকসাহিত্য বিষয়ক গবেষণার আঁচ পেয়েছিলেন তিনি। সেই গবেষণার উত্তাপ থেকেই সংগ্রহ করেছিলেন 'সাজানো বাগান' নাটকের রসদ। ১৯৭৭-এ 'সুন্দরম'-কে উপহার দিলেন 'সাজানো বাগান'-এর মতো মাস্টারপিস। ১৯৮০'তে সেই প্লটের ওপর ভিত্তি করে তপন সিংহ পরিচালিত চলচ্চিত্র 'বাঞ্ছারামের বাগান'এ রুপোলি পর্দায় প্রথম দেখা গেল নাট্যকার মনোজ মিত্রকে। প্রায় ষাটটির মতো বাংলা চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জায়গা করে নিতে একটুও ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত থেকে হরনাথ চক্রবর্তী কিংবা সত্যজিৎ রায় থেকে অঞ্জন চৌধুরী-- সর্বত্রই তাঁর সাবলীল কিন্তু নজরকাড়া উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। নিন্দুকেরা আড়ালে তাঁকে বলতে লাগলেন উৎপল দত্তের কপি, সমালোচকেরা বললেন, উত্তরসাধক। বাদল সরকার আর রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত'র মতো শিল্পীদের নৈকট্য ও সান্নিধ্যপ্রাপ্ত মনোজ লিখেছিলেন 'নরক গুলজার' (১৯৭৪)। রাজনীতি ও অর্থনীতির স্যাটায়ারে ভরা এই নাটকে দর্শক প্রত্যক্ষ করল, কল্পতরু থলিতে স্বর্গরূপসী রম্ভাকে চেয়ে হাত ঢোকালে অনিবার্যভাবেই বেরয় মর্তমান কলা। সেখানে আবার প্রজাস্রষ্টা ব্রহ্মাকে উৎকোচ গ্রহণের সমর্থক হিসেবে দেখিয়ে, সমাজের ভয়াবহ অন্তঃসারশূন্যতাকে প্রকট করালেন মনোজ। 

শেষ জীবনে স্ত্রী আরতি মিত্রকে নিয়ে সল্টলেকে বাস করতেন। তাঁর দুই অনুজ অমর ও উদয়নও তাঁদের সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছেন যথাক্রমে বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক ও ইতিহাস-গবেষক রূপে। এই বছরই সেপ্টেম্বর মাসে মনোজ মিত্রের একমাত্র কন্যা ময়ূরী মিত্র জানান পিতার হৃৎযন্ত্র বিকল হওয়ার কথা। সেই সঙ্গে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবিটিস, কিডনির সমস্যা, সিওপিডি আর ডিমেনশিয়ার মতো ব্যাধি তাঁকে ক্রমশ গ্রাস করছিল। ৮৫ বছর বয়সে বটবৃক্ষর মতো এই শিল্পীর জীবনের রঙ্গমঞ্চ থেকে চিরপ্রস্থান ঘটে, রয়ে যায় অসীম প্রত্যয়ে ভরা প্লট-চরিত্র-সংলাপের শিকড়-ঝুরি। তাঁর মৃত্যুর পর সম্ভবত শুভানুধ্যায়ী আর নিন্দুকদের মুখে একসঙ্গে উচ্চারিত হয়েছে 'নরক গুলজার' নাটকের সেই অমোঘ পঙক্তি--

'কথা বোলো না কেউ শব্দ কোরো না 

ভগবান নিদ্রা গিয়েছেন 

গোলযোগ সইতে পারেন না।'

সহৃদয় সামাজিকের নয়ন সমুখে অভিনেতা কিংবা শিল্পবেত্তা মনোজ আর কোনও দিনও অবতীর্ণ হবেন না। অপেক্ষা ফুরলো, নটে গাছটি মুড়োলো।


Friday, 15 November 2024

বুলডোজার শাসন নিষিদ্ধ

নিকৃষ্টতম শাসনের ইতি

বর্ণালী মুখোপাধ্যায়



বুলডোজার শাসনকে নিষিদ্ধ করে সর্বোচ্চ আদালত আপাতত আমাদের স্বস্তি দিয়েছে; বিশেষত বিরোধী দলের সদস্য, সমর্থক ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু মানুষকে। বেআইনি দখল করা জমিকে পুনরুদ্ধার করতে হলে যদি বুলডোজার ব্যবহার করতে হয় তবে আগে থেকে পোর্টালে সেই নোটিশ আপলোড করতে হবে, নির্দেশ দিয়েছে আদালত। তাছাড়া প্রক্রিয়া না মেনে বুলডোজার চালালে সরকারি আধিকারিককে আদালত অবমাননার দায়ে গ্রেফতার পর্যন্ত করা হতে পারে। নোটিশ পেয়ে পনেরো দিনের মধ্যে প্রশাসনের তরফে হিয়ারিং হবে। সেই হিয়ারিংয়ে যদি শেষ পর্যন্ত সেই বাড়ি বা দোকান ভাঙ্গা স্থির হয় তার পরে আরও ১৫ দিন সময় দেওয়া হবে যাতে সেই ব্যক্তি আদালতের দ্বারস্থ হতে পারে।

দলিত বনাম মুসলিম সমীকরণে এই বুলডোজার সন্ত্রাস ব্যবহার করা হয়েছে কিনা সেটা সমাজতাত্ত্বিক গবেষণা যারা করেন তাদের খোঁজ নিতে অনুরোধ করব। আদিবাসী, দলিত, তথাকথিত নিম্নবর্ণের মানুষকে আর এসএস এবং বিজেপি এটাই ফিসফিসিয়ে বোঝায় যে মুসলিমদের জমি-দোকান-ব্যবসা-পুকুর-ক্ষেত দখল করে তাদের দেওয়া হবে। ফলে, তদন্ত করলে হয়তো দেখা যাবে, ৬৭,০০০ একর বুলডোজারের ব্যবহারে পাওয়া জমির একাংশ আদিবাসী, দলিত বিজেপি সদস্যদের দেওয়া হবে এমন আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। সেই আশ্বাস কতটা বাস্তবে কার্যকর হবে সেটা অবশ্যই বিচার্য নয়। মেরুকরণই লক্ষ্য। 

আমাদের দেশে শহর, আধা-শহরের বাড়িঘরের মধ্যে একটা বড় অংশেরই সব কাগজপত্র ঠিক নেই। সরকার, পৌরসভা সেটা জানে। কিন্তু সব বাড়ির সব কাগজ ঘাঁটতে বসলে লোম বাছতে কম্বল উজাড় হবে, সেটাও জানে প্রশাসন। ফলে, যে সরকার বা মুখ্যমন্ত্রী অথবা প্রধানমন্ত্রী হঠাৎ জমি পুনরুদ্ধার করতে নামে, বুঝতে হবে তা আসলে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বা ধর্মীয় সংখ্যালঘু মানুষের উপর সন্ত্রাস চালিয়ে ধর্মীয় মেরুকরণ করার ছল মাত্র। সেখানে বিন্দুমাত্র দখলদারি বন্ধ করার উদ্দেশ্য নেই। মুসলিম বস্তি উজাড় করে সেখানে তাদের পোষ্যদের বেআইনি ভাবেই ব্যবসা করার আশ্বাস দেওয়া হয়। বেআইনি দখল তুলতে হলে বিজেপির দলীয় অফিসগুলো আগে ভাঙতে হবে, এমনটা বলেছিলেন আপ দলের এক নেতা। কৃষক আন্দোলনের নেতা টিকায়েত বলেছিলেন যে বুলডোজার নিয়ে এমন আক্রমণ হলে ট্র্যাক্টর দিয়ে প্রতিরোধ করা হবে। 

বুলডোজারের ব্যবহারে এক নির্লজ্জ মুসলিম আক্রমণের নজির গড়ে তুলেছিল বিজেপি। একজন গরু খেয়েছে বলে অভিযোগ এল, তাকে মৃত বা অর্ধমৃত করা তো হলই, উপরন্তু তার বাড়িও ভেঙে দেওয়া হল। পরে প্রশাসন একটা ব্যাক ডেটেড নোটিশ দেখিয়ে বলল যে ওই বাড়ি নাকি বেআইনি ছিল! এখন আদালতে সে যাবে, হয়তো জিতেও যাবে, কিন্তু সর্বনাশ যা হওয়ার তা তো হয়েই গেল! আবার এমন উদাহরণও আছে যে একটা গোটা বস্তি উদ্বাস্তু কলোনি। কিন্তু তার মধ্যে একজন বিরোধী দলের সমর্থকের বাড়ি ভাঙা হল দখলিকৃত অভিযোগ এনে, অথচ সেই সংজ্ঞায় গোটা বস্তিটা বেআইনি!

মাফিয়া গোষ্ঠীদের মধ্যেও অলিখিত আইন আছে যে শত্রু গ্যাং'এর পরিবারদের বিরক্ত করা হবে না, খুন করা তো দূরের কথা। সেরকম কোনও অঘটন হলে সেটাকে যুদ্ধ বলে ধরা হয়। আদিত্যনাথ যোগী যে নিকৃষ্টতম মাফিয়া বস সেটা তার বুলডোজার শাসন থেকেই প্রমাণিত। সমগোত্রীয় নরেন্দ্র মোদিও ভোটের প্রচারে বুলডোজার ব্যবহার করতে স্পষ্ট ভাষায় বিজেপির মুখ্যমন্ত্রীদের উৎসাহ দিয়েছিলেন। তাই মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, উত্তরাখণ্ডের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রীরাও পিছিয়ে নেই। রাজস্থানের কংগ্রেস সরকারও মোদী, যোগী অনুপ্রাণিত ছিল এমন অভিযোগ আছে। 

রাজনীতি মানেই বিপদ। সরকারি দল করলে লাভ আর বিরোধী দল করলে 'হাজতবাস, আহত, নিহত হতে পারি' এটা জেনেই মানুষ রাজনীতি করতে আসে। কিন্তু বিরোধী জনের পরিবারও ছাদহীন হবে এই আশঙ্কা থাকলে, মেহনতি জনতার ক্ষেত্রে না হলেও, আমাদের মতো শহুরে আরবান নকশাল, আন্দোলনজীবীদের সংখ্যা যে অনেক কমে যেত তা নিশ্চিত ভাবে বলা যায়।


Tuesday, 12 November 2024

'পিপাসা, হায় না মিটিল'

প্রলম্বিত এক ছায়াপথ 

প্রবুদ্ধ বাগচী



আরও পাঁচটা না-পাওয়ার মতোই ঋত্বিকের ছবিকে তাঁর প্রকৃত চেহারায় খুঁজে পেতে আমাদের অনেকদিন লেগে গিয়েছে। আমরা মানে, যারা আশির দশকে বেড়ে উঠেছিলাম কলকাতার আবহাওয়া থেকে বেশ কিছুটা দূরত্বে। ১৯৮৭'র শহরে ‘নন্দন’ নামের এক অত্যাশ্চর্য প্রেক্ষাগৃহের স্থাপনার পর সেখানে ওই বছরের নভেম্বর মাসে সরকারি উদ্যোগে করা হয়েছিল ‘ঋত্বিক ঘটক রেট্রোস্পেক্টিভ’। মাত্র পাঁচ টাকার টিকিট কেটে সেবার দুটো ছবি দেখি। ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’ ও 'কোমল গান্ধার'। নন্দনের বিশাল স্ক্রিনে নীলকণ্ঠ বাগচীর পাশ-করা মুখের ফ্রেমে এসে দাঁড়ায় বঙ্গবালা, আর গোটা প্রেক্ষাগৃহে বিদ্যুতের শকের মতো বেজে ওঠে ‘কেন চেয়ে আছো গো মা’— এই দৃশ্য আসলে একটা জন্মান্তর। আমাদের ভিন্ন জন্ম হয়। আগামী সময়ে আমরা কেবল তার মধ্যেই বেড়ে উঠব অবিরাম। 

প্রায় একইরকম গায়ে-কাঁটা-দেওয়া 'কোমল গান্ধার'এর সেই লংশট— ট্রলির ওপর ক্যামেরা চলতে চলতে আচমকা লাইন থেমে যায় দুটো অনিবার্য বাফারে। এপার বাংলা ওপার বাংলা, মধ্যিখানে চর— চর নয় চরাচর। একটা প্রজন্মের বিধিলিপি লেখা হয়ে গেল ওই শটে। তুলনায় তাঁর ‘মেঘে ঢাকা তারা’ হিট ছবি। আটের দশকে নিঃসঙ্গ দূরদর্শন-জমানায় সেই ছবি প্রায়ই দেখানো হত রবিবার। সে ছবিতে নীতার জীবন নিংড়ে-নেওয়া বাঁচতে চাওয়ার আর্তি বাড়ির মা-মাসিমাদের কাছেও এক প্রবল শোকের ভ্রূণায়ন বলে চিহ্নিত হয়েছিল। ‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙল ঝড়ে’ গানটির অমন সুতীব্র অভিঘাত ও ব্যঞ্জনা ছিল প্রায় অলৌকিক। আর এই সূচিমুখ তীব্রতার মধ্যেই আমরা খেয়াল করতে ভুলে যেতাম আজাদগড় কলোনির পরিবার-বঞ্চিত এক রিফিউজি যুবতী কোথাও যেন মিশে যায় কুমারসম্ভবের পার্বতীর অনুষঙ্গে, ভুলে যেতাম বাগেশ্রীর ওই স্বরলিপির মধ্যে কীভাবে আছড়ে পড়ছে চাবুকের আওয়াজ! গান না আর্তনাদ ? 

এত দূর মুগ্ধতার আগে কিন্তু আমরা সত্যজিৎ মৃণালের ছবি কিছু কিছু দেখে ফেলেছি। তাই এটা বলার কথা যে, আসক্ত মুগ্ধতা থেকে ঋত্বিকের পরের ছবিগুলি খুঁজে পেতে দেখতে গিয়ে তেমন বড় কিছু লাভ করেছি এটা বলা ঠিক হবে না। বাংলার দিকপাল তিন চলচ্চিত্র পরিচালকের মধ্যে ঋত্বিক সব থেকে ছোট, তাঁর তৈরি করা ছবির পরিমাণও কম। অনেকে মনে করেন, সুযোগ পেলে তিনি অন্যদের থেকে নিজেকে আরও ভাল ছবি করার কাজে নিয়োজিত করে মহত্তর হতে পারতেন। এই আপ্তবাক্যে আমাদের তেমন আস্থা নেই। এটা ঠিক, তাঁর প্রথম ছবি ‘নাগরিক’ কার্যত ‘পথের পাঁচালী’র আগে রিলিজ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ‘নাগরিক’ বা ‘কোমল গান্ধার’ সময়ান্তরে দেখে তাঁর নির্মাণের মধ্যে এমন কিছু পাওয়া যায়নি যা নাকি ‘পথের পাঁচালী’কে অবান্তর করে দিতে পারে। তবে তাঁর শতবর্ষের সীমানায় এসে তাঁকে কোনও ‘বনাম’ এর মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়াটা সমুচিত নয় বলেই আমাদের ধারণা। বাংলার প্রবাদ হল, ‘অতি বড় সুন্দরী না পায় বর/ অতি বড় ঘরণী না পায় ঘর’— ঋত্বিক ঘটকের ক্ষেত্রে এই ধারণাটা কিছুটা ব্যবহার করা চলে। হ্যাঁ কিছুটা, অবশ্যই পুরোটা নয়। সিনেমা ব্যাপারটাই তো এরকম, তার জন্য পুঁজি, লোকলস্কর, প্রযুক্তি লাগে, লাগে তৈরি হওয়া চলচ্চিত্রের বিপণন। মুঠো মুঠো সদিচ্ছা আর বিপুল মেধা ও জ্ঞান থাকলেই যে তাতে সিদ্ধিলাভ ঘটবে এমন মোটেও নয়। যদিও প্রখর পাণ্ডিত্য ও ফিল্ম-বিষয়ক ভাবনায় ঋত্বিক নিজে সত্যিই একজন পথিকৃৎ। পুনার ফিল্ম ইন্সটিটিউটে তাঁর কিছু কৃতবিদ্য প্রাক্তন ছাত্ররা বলেছেন, লিখেছেন সেই ঋত্বিক-সংসর্গের কথা। জীবনের শেষ দিন অবধি ঋত্বিককে কাছ থেকে পেয়েছেন নবারুণ ভট্টাচার্য, তিনিও বলেছেন এই বিরল ব্যক্তিত্বের নানা কথা। প্রতিটিই প্রণিধানযোগ্য। 

ইতিহাসে ও বাজারে নানারকম মতামত ঘুরে বেড়ায়। তার একটা হল, বিশ্রুত প্রতিভাধরদের নাকি একটু এলোমেলো বিশৃঙ্খল না হলে চলে না। ঠিক ভোট  দিয়ে এই বক্তব্যের সার নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। তবে দুনিয়ার সব প্রতিভাকেই যে নৈরাজ্যের উপাসক হতে হবে এটা কোনও নেসেসারি ও সাফিসিয়েন্ট শর্ত নয়। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তার প্রোজ্জ্বল উদাহরণ, যিনি এমনকি অন্যের কাছে নিজের লেখা চিঠি অবধি কপি করে রেখে দিতেন। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে কতদূর সুশৃঙ্খলভাবে নিজের কাজগুলো করে নেওয়া সম্ভব এর অভিধান তিনি নিজেই রচনা করে নিয়েছিলেন। ইচ্ছে করেই এই ডিসিপ্লিনের নিরিখে  ঋত্বিক-সমকালীন সত্যজিতের কথা তুলছি না, কারণ, তাতে আবার ওই ‘বনাম’ এর বদনাম হবে। কিন্তু সিনেমা এমনই একটা মাধ্যম যা তার স্রষ্টার কাছ থেকে দাবি করে নিখুঁত নিষ্ঠা ও শৃঙ্খলা, কারণ, আদপে সিনেমাটা তৈরি হয় একটি বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া মেনে যার মধ্যে ছেলেমানুষির জায়গা থাকে না। তাঁর একটি সাক্ষাৎকারে ঋত্বিক বলেছিলেন, যদি তিনি সিনেমার থেকেও জোরালো কোনও মাধ্যম কোনওদিন পান, সিনেমার মুখে লাথি মেরে তিনি সেখানেই চলে যাবেন। 

প্রথম জীবনে তিনি নাটক লিখেছেন, অভিনয় করেছেন। এর পরেও সিনেমা নামক মাধ্যমটিকে তিনি খুব সিরিয়াস ভাবে নিতে পেরেছিলেন কি না, এ নিয়ে আজ একটা প্রশ্ন তোলাই যায়। কারণ, সিনেমায় নিজের মতো করে কিছু করে দেখাতে গেলে গোড়ার দিকে তাঁর অবস্থানটা পোক্ত করার কাজটা নিজেকেই করতে হয়। সবাইকেই তা করতে হয়েছে। সম্ভবত এই প্রয়াসটায় তাঁর কিছু ঘাটতি ছিল। আজ এ কথা বলা কতদূর সঙ্গত জানি না, তবু বিনীতভাবেই সপ্রশ্ন হই, নিজেকে ‘জিনিয়াস’ ভাবা এবং কেবল সেই গুণেই প্রযোজকরা আগ বাড়িয়ে এসে কাজ দেবেন, এমন একটা গোপন অহং কি ছেয়েছিল তাঁকে? আবাল্য ছটফটে ঋত্বিক ওরফে ভবা'র প্রতিভার মূল্যায়ন করতে গেলে এই কথাগুলো ওঠে। 

আরেকটা কথা ঝুঁকি নিয়েও বলা দরকার। ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের যে বিরাট সাংস্কৃতিক ছায়া একটা সময় প্রগতি শিল্পের মূল ধারা হয়ে উঠেছিল, ঋত্বিক মূলত তারই সন্তান। বাম রাজনীতি নিয়ে তাঁর বেড়ে ওঠা, তার সঙ্গে তাঁর বিতর্ক, নানা ভাবনার দোলাচল তাঁকে সারা জীবন ব্যস্ত রেখেছে। জীবনের শেষ ছবি ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’তে নীলকণ্ঠ বাগচীর চরিত্রে রূপদান বেশ অনেকটাই তাঁর রাজনৈতিক দোলাচলের আত্মকাহিনি। এই যাত্রাও কিন্তু কিছুটা ‘ছটফটে’ চরিত্রের। কোথাও থিতু নন। ফিল্ম ইন্সটিটিউটের পাকা চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন। শেষ জীবনে কার্যত পথের ভিখারি ঋত্বিক। নবারুণ ভট্টাচার্য একদিন দেখলেন ভবানীপুরের এক ফুটপাথে ছিন্ন পোশাকে শুয়ে রয়েছেন তিনি। পর্যুদস্ত। চরম অ্যালকোহলিক। অসম্ভব মেধা, বিপুল জ্ঞান, সংগীতের রসপিপাসু, ফিল্মের ব্যাকরণকে ফালা ফালা করার পোটেন্সি সব একাকার হয়ে গেল হাহাকারে: 'আমি পুড়ছি! ব্রহ্মাণ্ড পুড়ছে!' 

বহরমপুরের কলেজ জীবনে তিনি আরএসপি দলের ঘনিষ্ঠ, পরে কলকাতায় পড়তে এসে কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সখ্য, সস্তা ষোলো মিলিমিটার ক্যামেরা জোগাড় করে ‘তেভাগার লড়াই’কে নথিবদ্ধ করার তাগিদে বন্ধু সলিল চৌধুরীর সঙ্গে পথে বেরনো। তথাকথিত ‘রণদিভে লাইন’কে তিনি মানছেন না তার ছাপ পড়ল পঞ্চাশের দশকে পার্টির মধ্যে তাঁর তোলা বিতর্কে। বিস্তর লেখাপড়া করা ঋত্বিককে জ্যোতি বসু সমর্থন করতেন কিন্তু স্বভাবে কিছুটা ‘কুচুটে’ ও শিক্ষিত পার্টি সদস্যদের প্রতি বিদ্বিষ্ট প্রমোদ দাশগুপ্ত কলকাঠি নেড়ে ‘অন কালচারাল ফ্রন্ট’এর প্রস্তাবক ভবা'কে বহিষ্কার করে দেন। ষাটের মধ্যপর্বে নকশাল রাজনীতি তাঁকে কিছুটা টানল তবু ঠিক স্বস্তি দিল না। নকশাল খতমের গুলি বিনিময়ের মধ্যেই নিহত হলেন নীলকণ্ঠ বাগচী ওরফে ঋত্বিক। 

কিন্তু এই প্রজ্বলনের তো একটা পরিণতি চাই। আলো। শক্তি। গতি। কেবলমাত্র ভারতীয় উপমহাদেশের চরম ট্র্যাজেডি যে পার্টিশন, তাকে কেন্দ্রে রেখে অথবা তারই অবশেসনের কাছে নিজেকে সমর্পণ করেই কি একজন ফিল্মমেকার পুরো জীবন বেঁচে থাকতে পারেন? ঠিক, বাঙালির জীবনকে নতুন এক ছাঁদে ঢালাই করে নিয়েছে দেশভাগ। শিয়ালদহ রেল স্টেশনের বীভৎসা, বনগাঁ সীমান্ত, যাদবপুর, দমদম, হাবরা, কুপার্স ক্যাম্প, আজাদগড়, বিজয়গড়। একেকটি জনবসতির সঙ্গে একটি ধ্বস্ত জাতির শোক ক্রোধ প্রতিরোধ ক্লেদ যন্ত্রণা সব একাকার। কিন্তু তার পরের অন্তত সিকি শতাব্দী তিনি বেঁচে ছিলেন। এর প্রতিস্পর্ধী যে নানান রঙের মানচিত্র তৈরি হয়েছিল এই বাংলায় সেখানে কি কিছুই খুঁজে পেলেন না তিনি? চলচ্চিত্র পরিচালককে ফিল্মের বিষয় নিয়ে পরামর্শ দেওয়া লেখককে লেখার বিষয় বাতলে দেওয়ার মতোই অশ্লীল ঠিকই, কিন্তু আমরা বলছি একটা প্রত্যাশার কথা। তাঁর কাছে আসলে অপার প্রত্যাশা ছিল আমাদের। তিনি তাঁর মতো করেই না হয় গড়ে পিটে নিতেন তাঁর বাস্তবকে; আমরা জানি সেইটুকুতেই তিনি তাঁর ফাল্গুনী রচনা করে তাক লাগিয়ে দিতেন আমাদের। ‘পিপাসা, হায় না মিটিল’। ১৯৭৬'এর এক ফাল্গুনী ভোরে পিজি হাসপাতালের ক্লিন্ন বিছানায় ‘জীবনের ক্লান্তি ক্ষুধা আকাঙ্ক্ষার বেদনার’ ঋণ চুকিয়ে যেদিন তিনি চলে যাচ্ছেন, সেদিন তাঁর গুটিকয় সুহৃদ ব্যতিরেকে স্তব্ধ হয়েছিল একটা জাতি, রাজধানী-ভরা নাগরিক সমাজ। পড়ে-আসা বেলার দিকে যেভাবে নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে থাকে সাদা বক। ছটফটে জীবন। প্রলম্বিত এক ছায়াপথ। 

[তথ্যসূত্র: সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় (সাক্ষাৎকার), বসু আচার্য (ফেসবুক পোস্ট)]

Sunday, 3 November 2024

ভেতরের মানুষটা কেমন!

এই পথে আলো জ্বেলে

মালবিকা মিত্র



আরজি কর হাসপাতালে পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট ট্রেনি ছাত্রীর ধর্ষণ ও মৃত্যু নিয়ে সারা বাংলা এমনকি বাংলার বাইরে মানুষ প্রতিবাদে ফেটে পড়েন। এই প্রতিবাদের 

১) একটা বড় অংশ সরকারের বিরুদ্ধে;

২) একটি অংশ নির্দিষ্টভাবে ওই ঘটনার বিরুদ্ধে ও হাসপাতালে নিরাপত্তা ব্যবস্থা সুদৃঢ় করার দাবিতে ও 

৩) আরেকটি অংশ সমগ্র নারী জাতির নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ও চিন্তান্বিত। 

কিন্তু এই তৃতীয় ধারাটি আন্দোলনের মূলধারা থেকে ক্রমশ বিলীয়মান। তাই একটু বিশেষ আলোচনার দাবি রাখে। কারণ, এই তৃতীয় ধারা ধর্ষণ সংস্কৃতির বিরুদ্ধে সোচ্চার; লিঙ্গ বৈষম্য বিলোপের দাবি করে, সাধারণভাবে সর্বত্র নারী নিগ্রহ ও তার বিরুদ্ধে নারীর নিরাপত্তার পক্ষে সোচ্চার। রাত দখল আন্দোলন তো শুধু ধর্ষিতা ও খুন হওয়া ডাক্তার ছাত্রীর জন্য নয়, মেয়েদের রাত দখল। কেন মেয়েরা একা রাত্রে বেরতে পারবে না, কেন মেয়ের জন্য বাড়ির মানুষকে দুশ্চিন্তায় থাকতে হবে 'এখনও কেন ফিরল না', কেন একটি মেয়েকে ভাবতে হবে, থাক আমি বার্থডে পার্টিতে যাব না, ফিরতে রাত হয়ে যাবে। এই লিঙ্গ বৈষম্যের বিরুদ্ধে মেয়েদের রাত দখল আন্দোলন। এটাই আন্দোলনের লক্ষ্য, তিলোত্তমা উপলক্ষ মাত্র। আমি এই তৃতীয় পক্ষে অঙ্গীভূত হতে চাইলেও শেষ অবধি পারলাম না। আর সেটাই আমার মানসিক যন্ত্রণা। এমন একটি প্রতিবাদে কোথাও সামিল হতে পারলাম না। এই যন্ত্রণা প্রকাশের ভাষা নেই। 

'স্বাধীন স্বতন্ত্র' (বে)নামে একটি সংগঠন নিচের এই আবেদনটি প্রকাশ করেছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আগে সরকারের রোষানল থেকে আত্মরক্ষার জন্য এরকম বেনামে আত্মগোপন করতে হত। এখন উপর্যুপরি নির্বাচনে জনগণের প্রত্যাখ্যান আসার ফলে জনগণের থেকে আত্মগোপন করতে হচ্ছে নানাবিধ বেনামে:

#রাজপথে_নির্যাতিতার_পোশাক_প্রদর্শনী 

''রাত' মেয়েদের জন্য সুরক্ষিত নয়। আজ প্রায় আড়াই মাস কেটে গেলেও সরকার নারীদের দাবি নিয়ে একটি কথাও বলেনি;

আমরা যারা যৌন হেনস্থার শিকার হয়েছি, ধর্ষিত হয়েছি বা ইভ-টিজ হয়েছি, তারা তাদের এলাকায় সেই বয়সের পোশাক টাঙিয়ে দিই, যে বয়সে আমরা নির্যাতিত হয়েছিলাম;

নবজাতক শিশু, কিশোরী, যুবতী, গর্ভবতী এবং প্রৌঢ়া সকলেই আমরা এই নির্যাতন এবং ধর্ষণের স্বীকার হয়েছি বারংবার; 

সরকারকে বুঝিয়ে দিই, বাংলার ৫ কোটি মেয়েদের মধ্যে এমন কেউ নেই যে নির্যাতিত হয়নি। যাদের বয়স ৪ থেকে ৯০, যারা স্কুল ছাত্রী থেকে বৃদ্ধা; 

প্রতিশ্রুতি নয় সমাধান চাই।'

অর্থাৎ বলা হচ্ছে, সকল নারীই ধর্ষিতা! প্রকারান্তরে সকল পুরুষই ধর্ষক! 

সাধারণভাবে বলা হয়ে থাকে, All men are potential rapist-- এই কথার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে potential  শব্দটি এখানে গুরুত্বপূর্ণ। যার অর্থ, All men have the potential to rape.। মানুষ তো মূলগত ভাবে এক জৈব সত্তা। তাই তার মধ্যে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি যৌন আকর্ষণ, যৌন চিন্তা, চেতনা কাজ করে থাকে। ধর্ষণ করার সামর্থ্য আছে। কিন্তু একই সাথে আবার মানুষ এক সামাজিক জীব। ফলে, তার একটা সামাজিক সত্তা আছে। সেই সামাজিক সত্তার মধ্যে সে মা কাকিমা দিদি বোন স্ত্রী ইত্যাকার নানা সম্পর্কে আবদ্ধ। নানাবিধ সামাজিক উচিত-অনুচিত, শোভন-অশোভন, ন্যায়-অন্যায় ইত্যাদি বোধ, রেওয়াজ, রীতি বিদ্যমান, সর্বোপরি একটা লজ্জা, ভয় কাজ করে। এই সামাজিক রেওয়াজ ও রীতিগুলি তাকে, তার জৈব সত্তাকে নিয়ন্ত্রণ করে, প্রবৃত্তি থেকে বিরত করে। নানাবিধ সম্পর্কগুলি তার জৈব সত্তাকে নিয়ন্ত্রণ করে। এর ফলে মূলগতভাবে মানুষ অ্যানিমেল হলেও অ্যানিম্যালিটি তার মধ্যে প্রাধান্য পায় না। কিন্তু সুপ্ত থাকে। মান্না দে'র গানে এই প্রবৃত্তির একটা নমনীয় রূপ বর্ণিত আছে:

'ও কেন এত সুন্দরী হল...

অমনি করে ফিরে তাকালে, 

দেখে তো আমি মুগ্ধ হবই .... 

ও কেন তখন হঠাৎ এমন এলোচুলে বাইরে এল... 

দেখে তো আমি মুগ্ধ হবই 

আমি তো মানুষ।' 

কিন্তু এই মুগ্ধতা, প্রবৃত্তি এসব ছাড়াও একটা বাড়তি জিনিস, একটা নিয়ন্ত্রক, একটা সেন্সর কাজ করে। বিকৃত মানসিকতা বলতে বোঝায়, ওই সেন্সরটি যখন ঠিকমতো কাজ করে না। অধিক মাত্রায় উত্তেজক পানীয় সেবন করলে সেন্সরটি, মানে পাহারাদারটি ঝিমিয়ে পড়ে, ঠিকমতো কাজ করে না। আবার নিয়মিতভাবে উত্তেজক সেবন করার ফলে ধীরে ধীরে অকেজো, অচল হয়ে যায়, পাহারাদার সর্বদাই ঝিমোতে থাকে। এইভাবেই সেন্সরটি অচল ও বিকৃত হয়ে যায়। বেশ মনে আছে, শেষ দফার বামফ্রন্টের শাসনে অর্থমন্ত্রী দেদার দেশি-বিদেশি মদের দোকানের লাইসেন্স দিয়েছিলেন। এমনকি চাঁপদানিতে একটি নার্সারি স্কুলের পাশের প্লটে এফ এল অন শপ লাইসেন্স দিয়েছিলেন। এখন সেগুলোই বটবৃক্ষের ছায়া বিস্তার করেছে। যে কোনও স্পট থেকে মাত্র এক কিলোমিটারের মধ্যে দেশি-বিদেশি মদের দোকান পাওয়া যাবে। মদ্যপান করে গাড়ি চালানো নিষিদ্ধ থাকলেও, হাইওয়ের পাশেই দু' হাত অন্তর হাজার হাজার লাইসেন্স প্রাপ্ত পানশালা দেখতে পাবেন। 

শুধু তো উত্তেজক পানীয় না, পরিবার বা পরিবেশে যদি ছোটবেলা থেকে কেউ সুন্দর সম্পর্ক না দেখে, তার কাছে উচিত অনুচিত বোধ তৈরি হয় না। শৈশব থেকেই যদি কেউ বাড়িতে যৌনাঙ্গ ও যৌন সম্পর্ক বিষয়ক আকছার কুকথা সর্বক্ষণ শুনতে থাকে, তখন তার বাচনের মধ্যে খিস্তি খেউড় অন্যায় বা অস্বাভাবিক বোধ হয় না। প্রসঙ্গত বলি, আমার প্রতিবেশী আমারই এক ছাত্রী তখন সম্ভবত ক্লাস টু'তে পড়ে। সে তার খাতার এক পৃষ্ঠায় অত্যন্ত কুরুচিকর গালিগালাজ লিখে ভর্তি করেছিল। আমি সেগুলো উচ্চারণ করতে পারব না, এমনকি আমার উপস্থিতিতে সেগুলো খুলে দেখাতে পারব না বলে পড়ানোর শেষে ছাত্রীর মাকে বলেছিলাম, 'বৌদি, মনে হয় মান্তুর কিছু সমস্যা হচ্ছে। একটু নজর দিয়ে খাতাটা দেখবেন। খুব খারাপ কথা লিখেছে, আপনি দেখলেই হবে। মারধর বকাবকি করবেন না।' পরদিন ওই ছাত্রীর পিসি হাসতে হাসতে আমাকে জানালো, 'ওইগুলি কোনও খারাপ কথা না। এইগুলি তো দাদা'রা হামেশাই কয়। তবে দিদিমণি, এইডা কিন্তু মানতেই হইব, বানান দ্যাহেন, একখানও ভুল লেখে নাই।' আর বৌদি জানালেন, 'বিয়ের পর প্রথম প্রথম এ বাড়ির কথাবার্তা শুনলে আমি লজ্জায় মুখ ঢাকতাম। মনে হত কান থেকে বুঝি রক্ত বেরিয়ে আসছে। এখন সবই সয়ে গেছে।' পরিবার পরিবেশে যা শুনছে, যা দেখছে, সেগুলোই মুখে বলছে ও কাজে করে দেখাচ্ছে।

অবাধ্য দুর্বিনীত কোনও পড়ুয়ার অভিভাবককে ডেকে পাঠিয়েছি। দুদিন পর হাজির হল সেই ছাত্রের দিদিমা। তিনি জানালেন, 'আমি বুড়ো মানুষ, আমাকে দয়া করে ডেকে পাঠাবেন না। যা করার আপনারাই করবেন।' শুনলাম, ওই শিশুর মা বিবাহ-অতিরিক্ত একটি সম্পর্কের কারণে সন্তানকে দু' বছর বয়সে ফেলে রেখে অন্যত্র গমন করেছেন। নিশ্চয়ই আমার নারীবাদ এই স্বাধীনতা অনুমোদন করে। তার বাবা এই সন্তানের কারণে আর বিয়ে করেননি। কিন্তু একটু দূরে চাকরি করেন, ফিরতে রাত হয়। জামাই খুব ভালোমানুষ। এ ধরনের সিঙ্গল পেরেন্ট চাইল্ড বা নো পেরেন্ট চাইল্ড'এর সংখ্যা ইদানীং সংখ্যায় বাড়ছে। এদের চোখে নারী-পুরুষের সম্পর্কগুলি কোন মানদন্ডে দেখা হয় ভাবুন তো। মোবাইল ও নেট দুনিয়ার দৌলতে স্মার্টফোনে নাবালক ভাই বোন ব্লু ফিল্ম দেখছে। আবার সেই ব্লু ফিল্মকে নিজেরা অনুশীলন করছে। তারপর বাড়িতে জানাজানি হবে সেই ভয়ে নাবালক ভাই নাবালক বোনের গলায় ছুরি চালাচ্ছে। 

আসলে আমি বলতে চাইছি, ধর্ষণ একটি সামাজিক ব্যাধি। একটি মানসিক বিকৃতি। সেই বিকৃতির হাত ধরে এসেছে ধর্ষণ। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ব্যক্তি নাগরিকের ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অধিকার। আপনি গণতান্ত্রিক সমাজে বলতে পারেন না, নাইট ক্লাব থাকবে না, আপনি গণতান্ত্রিক সমাজে বলতে পারবেন না, রাত্রে হোটেল বারে মহিলাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ, এটা ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের প্রশ্ন। সেই কারণেই আপনি বলতে পারেন না, মেয়েদের নাইট ডিউটি দেওয়া যাবে না। সেই কারণেই আমরা বলতে পারি না, 'মেয়ে মানুষ' লেট নাইট পার্টি করে বাড়ি ফিরবে না। এটা সমানাধিকারের প্রশ্ন, আমি এই অধিকারের প্রশ্নে একমত। 

কিন্তু স্মরণে রাখবেন, বেশ কিছু ক্ষেত্রেই এই সমানাধিকারের মধ্যেও কিছু বিশেষ অধিকার রাখতে হয়। ধরুন, কর্মস্থলে মেটারনিটি লিভ তো রাখতে হয়, সমাজের স্বার্থে। বাসে লেডিজ সিট, ট্রেনে সংরক্ষিত লেডিজ কম্পার্টমেন্ট, এসবের তো প্রয়োজন আছে। অফিসে, সিনেমা হলে, শপিং মলে পৃথক লেডিজ টয়লেট প্রয়োজন হয় না? এগুলোকে অস্বীকার করব কীভাবে? আমার দৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন নারীর অধিকারের প্রশ্নে খুবই যুক্তিপূর্ণ ও বাস্তব সম্মত। তাঁর অধিকার চিন্তায় একটা পরিমিতি বোধ লক্ষ করা যায়। তিনি লিখেছিলেন, 'মেয়েদের শরীরের এবং মনের প্রকৃতি পুরুষের হইতে স্বতন্ত্র বলিয়াই তাহাদের ব্যবহারের ক্ষেত্র স্বভাবতই স্বতন্ত্র হইয়াছে। আজকাল বিদ্রোহের ঝোঁকে একদল মেয়ে এই গোড়াকার কথাটাকেই অস্বীকার করিতেছেন।'

ধরা যাক একজন নারী নাইট ক্লাব বা বারে সিংগার অথবা ড্যান্সার। তিনি ডিউটি শেষে আকন্ঠ মদ্যপান করে রাত্রি দুটোয় বাড়ি ফিরছেন। এ পর্যন্ত কিছু সমস্যা নেই। কিন্তু সেই নারীর নিজস্ব কোনও বাহন নেই, এখানেই সমস্যা শুরু। তিনি লিফট চাইলেন অন্যের গাড়িতে, পেলেন। সেই গাড়িতে চার যুবক তারাও মদ্যপ। আকন্ঠ মদ্যপান করে আছে। এবার বলুন, ওই নারী গাড়িতে ওঠার পর কি তাঁকে মাতৃজ্ঞানে ও ভগ্নীজ্ঞানে তাঁর ঠিকানায় সুযোগ-সন্ধানী মাতালরা পৌঁছে দেবে? এখানেই এসে পড়ে সূচনায় উল্লিখিত মন্তব্যটি -- 'All men have the potential to rape.'। কিন্তু তার মানেই সবাই রেপিস্ট নয়। কিন্তু বিশেষ বিশেষ কতকগুলো শর্ত যখন তার হিতাহিত জ্ঞান, কাণ্ডজ্ঞান, উচিত অনুচিত বোধ নষ্ট করে দেয়, তখন সে একজন রেপিস্ট হতে পারে। নানান কারণে এই সেন্সরটি বিকল হতে পারে। তার কয়েকটি উল্লেখ করেছি মাত্র। এই ঘৃণ্য সামাজিক অপরাধটি যে সমস্ত কারণ থেকে উদ্ভূত তার অধিকাংশই আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই, নিয়ন্ত্রণে থাকে না। কিন্তু কিছু বিষয় আছে আমাদের নিয়ন্ত্রণে। 

আমি যেন কোনওমতেই প্ররোচনার কারণ না হই। কদিন আগেই মমতাশঙ্কর এরকম একটি কথা বলার কারণে যথেষ্ট ট্রোলড ও সমালোচিত হয়েছেন। এমনকি কেউ কেউ পাল্টা উস্কানিমূলক মন্তব্য ও ছবি ছেপেছেন। সেটা যার যার ভিন্ন রুচি। ভগবান বুদ্ধ গভীর ধ্যানে মগ্ন থাকবেন, তার চারপাশে যতই তাকে প্ররোচনা দেওয়া হোক, এটা একটা আইডিয়াল কনসেপ্ট। ঠিক তেমনি, কেন রাত্রি দুটোয় একজন মেয়ে রাস্তায় নিরাপদ থাকবে না? রাত্রি দুটোয় শুধু তো একজন মেয়ে নয়, আমরা কেউই নিরাপদ নই। ছেলে হলে তার সর্বস্ব ছিনতাই হতে পারে। বাধা দিলে প্রাণটিও। আর মেয়ে হলে যথাসর্বস্ব, প্রাণ ও সেই সাথে তার আব্রু ইমান। রাস্তার কুকুরও বেশি রাতে আপনাকে রাস্তায় অনুমতি দেয় না। আপনি বলবেন, রাতে কেন পর্যাপ্ত পরিমাণ পুলিশ পেট্রোলিং থাকবে না? গাড়ি থামিয়ে কেন চেক করা হবে না, মদ্যপ কিনা, গাড়িতে কারা যাচ্ছে, ভেতরে কী হচ্ছে, এটা নজরদারি করা দরকার। না, সেটাও হবে না। নীতি পুলিশি? ব্যক্তিগত পরিসরে নাক গলানো? তদুপরি এত রাস্তা, এত অলিগলি, এত এত গাড়ি, পেট্রোলিং করে এই নজরদারি সম্ভব? তার চেয়ে ভালো হয় না যে, রাত্রি দশটা বা এগারোটার পর বার বন্ধ হয়ে যাবে, নাইট ক্লাব বন্ধ হবে। জানি, এই প্রস্তাবে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদ, নাগরিক অধিকার হৈ হৈ করে উঠবে। 

বাস্তবিক, আমরা কেউ কি নিরাপদ? যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বপ্নদীপ, সে কি সুরক্ষিত ছিল? সেটা ছিল ২০২৩'এর ৯ অগস্ট। তার ওপর যা হয়েছে, তাকে নগ্ন করে তাকে দিয়ে যা যা বলানো ও করানো হয়েছে, এমন কি প্রতিষ্ঠা দিবসের নামে পিতা-মাতার দৈহিক মিলনের দিনটি পর্যন্ত তাকে দিয়ে উচ্চারণ করানো হয়েছে। এটা কি যৌনপীড়ন নয়? শোনা যায় এই সমস্ত পীড়নে সিনিয়র দাদাদের সাথে সিনিয়র দিদিরাও থাকে, মজা উপভোগ করে।  আর অনিতা দেওয়ান'এর ধর্ষণের কথাটা উচ্চারিত হয় একটি বিশেষ কারণে; ওই ঘটনার পর মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু বলেছিলেন, এ তো হতেই পারে। 

অথচ কেতুগ্রামে একটি বাড়িতে ডাকাত পড়েছিল। সংবাদপত্রেই পড়েছি, ডাকাতরা সেই বাড়ির সর্বস্ব টাকা পয়সা গয়না লুঠ করে। তখন বাড়ির মেয়েটি ডাকাত সর্দারের পায়ে ধরে বলে, জেঠু, আমার বিয়ের জন্য সংগ্রহ করা এইটুকুই ছিল শেষ সম্বল। এগুলো তুমি নিয়ে গেলে আমার আর বিয়ে হবে না। তোমরা বরং আমাকেও মেরে রেখে যাও। সংবাদে প্রকাশ, এরপর ডাকাত সর্দার সমস্ত সোনা দানা অর্থ ফেরত দিয়েছিল। বাড়ির সবাইকে ছেড়ে দিয়েছিল। এমনকি কিছু অতিরিক্ত টাকা-পয়সাও তাদের দিয়ে গিয়েছিল। কথা দিয়েছিল বিয়ের দিন আশীর্বাদ করতে আসবে। বোঝা যায়, অনেক ক্ষেত্রেই সেন্সর নষ্ট হয়ে যায়নি। লুঠপাটের সঙ্গে অতিরিক্ত প্রাপ্তি ধর্ষণের সুযোগ তারা কিন্তু নেয়নি। 

আমার মনে হয়, সমস্যাটা নারীর অধিকার, পুরুষতন্ত্র এসব নয়। সমস্যাটা হল ভেতরের মানুষটা, তাকে তো আগে মানুষ হতে হবে, তারপর সে নারী বা পুরুষ, চোর বা পুলিশ, সাধু অথবা ডাকাত ইত্যাদি। এনআরএস মেডিকেল কলেজে ছাত্ররা যখন আধপাগল কোরপান শাহকে ধরে হোস্টেলে এনে গণ পিটুনি দিয়ে হত্যা করে, তখন তাদের পরিচয় ডাক্তার নয়, অমানুষ। তিলোত্তমার ধর্ষক তেমনি সিভিক পুলিশ নয়, একজন অমানুষ।

কী চোখে দেখি, প্রশ্নটা এইখানে। খুব তৃপ্তির সঙ্গে স্মরণ করছি, বছর দশ আগের একটি ঘটনা। এপিডিআর'এর এক সভায় আমার এক দাদা স্থানীয় মানবাধিকার কর্মীকে বলেছিলাম, 'কত দিন পরে দেখা। তোমাকে দেখতে খুব ভালো লাগছে।' সেই দাদা শুনে মুচকি হাসল। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অন্য এক মানবাধিকার কর্মী দাদাকে বলল, 'তুমি কেমন আশ্চর্য মানুষ গো! মালবিকার মতো একজন ভদ্রমহিলা তোমাকে সুন্দর বলছে, আর তুমি একটুও কোনও প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে রামগরুড়ের ছানা?' সেই দাদা বলেছিল, 'আমি মালবিকাকে একজন মেয়ে হিসেবে দেখি না, দেখি বোন হিসেবে। আর ও আমাকে পুরুষ হিসেবে নয়, দাদা হিসেবেই দেখে।' এই কমপ্লিমেন্ট আমি কোনওদিন ভুলব না। আর দৃষ্টিভঙ্গির সমস্যা যদি সামাজিক সমস্যা হয়, তাহলে আপনি নিশ্চিত জানবেন, দাদা কাকা দাদু এদের কাছে যেমন চার বছরের শিশুকন্যাটি নিরাপদ নয়, ইচ্ছাকৃত ভাবেই তাদের এখানে সেখানে স্পর্শ করা হয়, ঠিক তেমনি দিদি মা কাকিমা ঠাকুমার হাতেও চার বছরের শিশু পুত্রটিও খুব নিরাপদ নয়। শ্রীকৃষ্ণ বিষয়ক একটি টিভি সিরিয়ালের একটি এপিসোড একদিন হঠাৎই চোখে পড়ে যায়। দেখি, খুব ছোটবেলায় কৃষ্ণকে মানে গোপালকে নিয়ে পাড়ার কাকিমা পিসিমা দিদি মামীমা'দের অদ্ভুত ধরনের আদর করার হিড়িক ও চোখে পড়ার মতো কিছু কার্যকলাপ। দেখে বুঝেছিলাম, শৈশবে যার এই ধরনের অভিজ্ঞতা, সে তো পুকুর পাড়ে অন্যদের বস্ত্রহরণ করবেই। পাড়ায় বা কোনও কলেজে একটু গোবেচারা শান্তশিষ্ট ছেলেকে নিয়ে মেয়েরা কেমন আলোচনা ও খোরাক তৈরি করে সে অভিজ্ঞতাও অনেকের আছে। আসলে ওই যে একটা ম্যাচো ফিগার, উন্মুক্ত সারা গায়ে লিপস্টিকের দাগ, চুম্বনের লক্ষণ বহন-- এসব তো বিপরীতমুখী ধর্ষণের ভাষ্য নির্মাণের চেষ্টা। আজকাল সিনেমায় যেমন অপ্রয়োজনে, জোর করে গালাগালি খিস্তি সংলাপের মধ্যে ব্যবহার করা হয়। আবার মহিলা চরিত্রকে দিয়ে সেগুলো বেশি উচ্চারণ করানো যেন একটা দ্বিগুণ সার্থকতা। 

কিন্তু এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল ধর্ষণের রাজনৈতিক ও দার্শনিক ভিত্তি। এটা আমার চোখে সবচেয়ে বেশি উদ্বেগজনক। কারণ, এই রাজনীতি ও রাজনৈতিক দর্শন নারী ধর্ষণকে একটা বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করে। ধর্ষণকারীকে বীর নায়ক সাজানো হয়। সেই ধর্ষক নায়ককে গলায় মালা পরানো, তাকে মিষ্টি মুখ করানো, বরণ করা হয়। ভি ডি সাভারকার লিখেছেন, আমরা গর্বের সঙ্গে ছত্রপতি শিবাজী এবং  চিমজি আপ্পার উল্লেখ করি যে, তারা যুদ্ধ জয়লাভের পরেও সসম্মানে কল্যাণের মুসলমান শাসনকর্তার গৃহবধূ এবং বেসিনের পর্তুগীজ শাসনকর্তার স্ত্রীকে ফেরত পাঠিয়েছিলেন। সাভারকার বিস্মিত হয়ে মন্তব্য করছেন, শিবাজী মহারাজ বা চিমজী আপ্পা কি করে ভুলে গেলেন, গজনির মাহমুদ, মোহাম্মদ ঘোরি, আলাউদ্দিন খিলজী এই সমস্ত মুসলমান শাসকদের কথা, যারা হাজার হাজার হিন্দু নারীর উপর শারীরিক অত্যাচার ও পীড়ন করেছেন ইত্যাদি ইত্যাদি। তাঁর বক্তব্যে উহ্য এই অভিযোগ যে, কেন শিবাজী বা চিমজি মুসলিম নারীদের ধর্ষণ না করে ছেড়ে দিলেন।

বিজেপি, আরএসএস'এর রাজনৈতিক কর্মসূচি, দৃষ্টিভঙ্গি ও দর্শনে বিধর্মীর ওপর, বিশেষভাবে মুসলিম মহিলার উপর ধর্ষণ ও হত্যা একটি স্বীকৃত ঘোষিত নীতি। এই কারণেই গুজরাত দাঙ্গায় বিলকিস বানো'র পরিবারের সকলের হত্যাকারী ও ধর্ষক দশজন যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত অপরাধী গুজরাত সরকারের নির্দেশে মুক্তি লাভ করে। পার্টি তখন তাদের মিষ্টিমুখ করিয়ে, ফুলের মালা পরিয়ে বরণ করে নেয়। একইভাবে সাংসদ ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে দেশের অলিম্পিক পদকজয়ী সোনার মেয়েরা যখন শ্লীলতাহানির অভিযোগ করে, তারপরেও কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। এমনকি ব্রিজভূষণ প্রধানমন্ত্রীর পাশে সংসদে উপবিষ্ট থাকেন। বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটির ছাত্রী গণধর্ষিতা হলে ধর্ষণকারী ছাত্রদের পুলিশ গ্রেফতার করতে পারে না। কারণ, অভিযুক্ত ছাত্রদের পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল মধ্যপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারে। তারপর যদি বা দু' মাস পর তাদের গ্রেফতার করা হল, সাত মাসের মধ্যে জামিনে মুক্ত হয়ে গেল। কারণ, ওই অভিযুক্তরা বিজেপির আইটি সেলের নেতা। একই কথা বলা চলে মণিপুরের ক্ষেত্রে। সেই রাজ্যে এক বছরের বেশি সময় ধরে চলেছে জাতি দাঙ্গা। ৩৭টির বেশি ধর্ষণের ঘটনা এফআইআর হয়েছে। এফআইআর না হওয়া ঘটনার সংখ্যা অজস্র। মহিলাদের সেখানে নগ্ন করে প্রকাশ্যে প্যারেড করানো হয়েছে, সে সব ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। 

এই পরিস্থিতিতে নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, নারী সুরক্ষা এই সমস্ত প্রশ্নে আমার কাছে প্রধান হল, 

১) উল্লিখিত রাজনৈতিক ও দার্শনিক ভিত্তি। এটা শুধুমাত্র নারী ধর্ষণ ও নারী পীড়ন ঘটায় না, ঘটনাকে দার্শনিক বৈধতা দেয়। অতএব, তা সবচেয়ে বেশি বিপদজনক। একে যে কোনও মূল্যে প্রতিহত করা প্রয়োজন। এটা প্রতিহত না হলে সামাজিক আন্দোলন এগোতে পারবে না;

২) নারী সুরক্ষা ও নিরাপত্তার যাবতীয় বন্দোবস্ত ও সেই সংক্রান্ত প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিশ্চয়ই সমর্থনযোগ্য ও আশু প্রয়োজন;

৩) নারী সম্পর্কে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন ঘটানো। অর্থাৎ, গোড়া থেকে সমস্যায় নাড়া দেওয়া চাই। এর জন্য এক দীর্ঘস্থায়ী জীবন দর্শন, মনোভাব, সংস্কৃতি গড়ে তোলা দরকার। ওটা সরকারের কাছে জবাব চাওয়ার বিষয় নয়।

'কে তুমি নন্দিনী আগে তো দেখিনি' যদি বিনোদন হয়, তাহলে আঁচল ধরে টান পড়বে, অর্থবান সুপুত্তুর টেনে গাড়িতে তুলবে, ফার্ম হাউসেও নিয়ে যাবে। একদম গোড়াতেই এর বিনাশ দরকার। হুগলি ডিএম'স রিক্রিয়েশন ক্লাবের বাৎসরিক অনুষ্ঠানে উদ্বোধনী সঙ্গীত ছিল 'জীবনে কি পাব না, ভুলেছি সে ভাবনা'। সেটা ২০০৪-০৫ সালের কথা। সঙ্গে অবশ্য নাটক ছিল 'ফেরারী ফৌজ'। ক্যাবারে  থাকবে, বার থাকবে, দ্রোহের নাটক থাকবে আর মাতাল লিঙ্গ সাম্যে আস্থাবান হবে, এটা অতি কাল্পনিক। তবুও আমি মানুষের সুবুদ্ধির উপরেই আজও আস্থাবান। ১৪০ কোটির দেশে অন্তত একজন তো বলেছিল, মালবিকাকে আমি মহিলা হিসেবে দেখি না, ও আমার বোন। এইটুকুই আমার কাছে আশাব্যঞ্জক। এই পথেই তাই ক্রমমুক্তির আশ্বাস।


Wednesday, 23 October 2024

প্রাপ্তিও কিছু আছে!

সব আন্দোলনেরই নিজস্ব বৈশিষ্ট্য থাকে 

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য



দেখা গেল, মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর পরই ও অভয়া'র মা-বাবার অনুরোধে জুনিয়র ডাক্তারবাবুরা আমরণ অনশন প্রত্যাহার করে নেওয়ায় বেশ কিছু রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিত্ব যারপরনাই বিরক্ত ও হতাশ হয়েছে। বোঝা ভার, তারা ঠিক কী চাইছিলেন জুনিয়র ডাক্তারদের এই সংঘবদ্ধ আন্দোলন থেকে। তবে কেউ কেউ যে এর মধ্যে এক ঘোরতর বিপ্লব সংগঠিত করে ফেলার যথেষ্ট উপাদান পাচ্ছিলেন, তা অমূলক হলেও দৃশ্যত অস্পষ্ট ছিল না। কেউ কেউ আবার দিবাস্বপ্ন দেখছিলেন যে, বাংলাদেশ স্টাইলে নবান্ন'র ছাদ থেকে হেলিকপ্টারে চড়ে মুখ্যমন্ত্রী পগার পার হবেন। এইসব অপরিণত, বালখিল্য আচরণে তিলোত্তমার সুবিচার ও লিঙ্গ সাম্যের দাবি এবং জুনিয়র ডাক্তার আন্দোলনে উত্থাপিত-- যদিচ কিছুটা প্রচ্ছন্নে থাকা-- জনস্বাস্থ্যের লক্ষ্যে স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে পুনর্গঠনের দাবি কতকটা যেন আড়ালে চলে যাচ্ছিল।

অথচ, ৯ অগস্ট পরবর্তী ঘটনাবলী কিন্তু গোটা রাজ্য জুড়ে তিনটি অভিমুখকে বর্শাফলকের মতো ক্ষুরধার করেছিল: 

এক) অভয়া'র নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পরিণতিতে জনমানসে এক তীব্র অভিঘাত সৃষ্টি হেতু নাগরিক ক্ষোভের স্বতঃস্ফূর্ত বিস্ফোরণ; 

দুই) আরজিকর ও অন্যান্য সরকারি স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে চূড়ান্ত দুর্নীতি ও অপকর্মের বিরুদ্ধে মেডিকেল ছাত্র-ছাত্রী ও জুনিয়র ডাক্তারদের দীর্ঘদিনের তীব্র অসন্তোষের এক ব্যাপক ও সুসংগঠিত আত্মপ্রকাশ; 

তিন) এই দুই গণবিক্ষোভের আবহে নাগরিক ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলির তৎপরতা।

এ কথা অনস্বীকার্য যে, একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান, যেখানে নিরাপত্তার সর্বোচ্চ গ্যারান্টি কাম্য, সেখানে এক কর্মরত চিকিৎসকের ওপরে এমন এক নিদারুণ অত্যাচার ও হত্যাকাণ্ডে সরকার ও তার প্রশাসনের কাঁধেই নৈতিক ও রাজনৈতিক দায় এসে পড়ে। সে অর্থে যে কোনও ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশও শাসক ও সরকারি দলের বিরুদ্ধেই প্রাথমিক ভাবে ধাবিত হয়। আর এ ব্যাপারে, বিশেষত দুর্নীতি প্রসঙ্গে এ রাজ্যে শাসক দলের যে বেশ দুর্নাম আছে, তাও অস্বীকার করার উপায় নেই। তাই, ১৪ অগস্টের মধ্যরাতে যখন রাজ্য জুড়ে অন্তত ৩৫০'এরও বেশি জায়গায় লক্ষাধিক সাধারণ মানুষের, বিশেষত মহিলাদের তীব্র রোষ রাজপথে আছড়ে পড়ল, তা ড্যাবড্যাবে চোখে দেখা ছাড়া সরকারপক্ষ ও শাসক দলের আর কোনও উপায়ও ছিল না। তারা ইতিমধ্যে দেওয়াল লিখনও পড়ে ফেলেছে, আর তা যে একেবারেই তাদের পক্ষে স্বস্তিদায়ক নয়, তা বুঝতেও তাদের দেরি হয়নি। ইতিমধ্যে আরজিকরের জুনিয়র ডাক্তারেরাও সংগঠিত হয়ে ময়দানে নেমে পড়েছেন, তাদের পাশে অন্যান্য হাসপাতালের জুনিয়র ডাক্তারেরা ধীরে ধীরে সামিল হতে থেকেছেন। নিহত চিকিৎসকের মা-বাবা কলকাতা হাইকোর্টে সিবিআই তদন্তের দাবি করে তার মঞ্জুরি পেয়েছেন আর এসবের মাঝেই, আইএমএ'এর দৃষ্টি আকর্ষণ হেতু শীর্ষ আদালতের প্রধান বিচারপতি গোটা বিষয়টিকে স্যুয়ো-মোটো নিজেদের এক্তিয়ারে নিয়ে এসেছেন।

তখন চারিদিকে কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে আরজিকর নিয়ে উত্তপ্ত আলোচনা। মেইনস্ট্রিম ও সোশ্যাল মিডিয়া ভরে উঠছে কিছু সত্যের সঙ্গে মিথ্যার নানা অতিকথনে, এমনকি পাগলের প্রলাপেও। মানুষ কিছুটা ক্ষিপ্ত ও বিভ্রান্ত। শাসক দল নিজেদের দায়কে হাল্কা করতে নানারকম প্রশাসনিক পদক্ষেপ সহ দলীয় স্তরেও নানা উদ্যোগ নিতে শুরু করেছে। তবে তদন্তভার সিবিআই'এর হাতে চলে যেতেই শাসক আস্তে আস্তে নিজেদের কিছুটা গুটিয়ে নেয় এবং মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা দেন যে, আরজিকর বিষয়ে সরকারের তরফে যা বলার তা একমাত্র তিনিই বলবেন। পাশাপাশি, ১৪ অগস্টের 'রাত দখলের' অভূতপূর্ব সাফল্যের পর 'নাগরিক সমাজ' ও বিবিধ সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের নামে ইতস্তত আরও কয়েকটি 'রাত দখল' এদিক ওদিক সংগঠিত হয়, কিন্তু ক্রমান্বয়ে দেখা যায়, জমায়েত ও গণ অংশগ্রহণের গুনতি কমে আসছে। কিন্তু নাছোড়বান্দা কিছু বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি সোশ্যাল মিডিয়ার কয়েকজন ইউটিউবারদের দিয়ে রাতারাতি এক 'ছাত্র সমাজ' বানিয়ে ২৭ অগস্ট 'দফা এক দাবি এক/ মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ' শ্লোগান তুলে 'নবান্ন দখলের' ডাক দেয়; যদিও, পর্বতের মূষিক প্রসবের মতো কলকাতা শহরের ইতিউতি কয়েকশো লোকের বিচ্ছিন্ন দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও পুলিশের টিয়ার গ্যাস, জলকামান সহযোগে তার অকাল প্রয়াণ ঘটে। ইতিমধ্যে দানা বেঁধে ওঠা জুনিয়র ডাক্তার আন্দোলনকারীরাও জানিয়ে দেন যে, তাঁরা ওই 'নবান্ন দখল' অভিযানে একেবারেই নেই। 

তবে ইতোমধ্যে, জুনিয়র ডাক্তাররা এই কদিনে নিজেদের বেশ সংগঠিত করে ফেলেছেন এবং ১৪ অগস্ট আরজিকরে মধ্যরাতে বহিরাগত দুষ্কৃতীদের তাণ্ডবের পর পাঁচ দফা দাবি নিয়ে এক সর্বাত্মক আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন; শুরু হয় অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতি। সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা এক চ্যালেঞ্জের মুখে এসে পড়ে। তাদের আন্দোলনের পাশে এসে দাঁড়ায় সর্বস্তরের চিকিৎসক সমাজ। কর্পোরেট ও বেসরকারি হাসপাতালগুলি এতে উৎসাহ পায় এবং কর্মবিরতির কারণে সরকারি চিকিৎসা অপ্রতুল হয়ে পড়ায় অল্প কয়েক দিনেই তাদের ব্যবসা প্রায় ৪০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে যায়। এ কথা স্বীকার করে নেওয়া ভাল, এ রাজ্যে গত কয়েক বছরে সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা আগের থেকে কিছু উন্নত হয়েছে, নিখরচায় সে পরিষেবা পাওয়ার নানাবিধ ব্যবস্থাদিও গড়ে উঠেছে, ফলে, স্বাস্থ্য দুনিয়ার মুনাফাবাজদের একটা মতলবই ছিল এই সরকারি ব্যবস্থাদিগুলিকে পঙ্গু করে দেওয়ার। জুনিয়র ডাক্তার আন্দোলন ও তাদের কর্মবিরতি তাদের সামনে সেই সুযোগকে 'পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা'র মতো এনে দিল। ফলে, কর্পোরেট হাসপাতাল, ফার্মা লবি ও স্বাস্থ্য বীমা কোম্পানিগুলি এই সুযোগকে ষোলোআনা উশুল করতে কোনও চেষ্টারই কসুর করতে বাকী রাখল না। সরকারি হাসপাতালে রোগী পরিষেবার ঘাটতি ও হয়রানি উত্তরোত্তর বেড়েই চলল। বিনা চিকিৎসায় রোগী মৃত্যুর অভিযোগও উঠল।

কিন্তু এমন কঠোর পরিস্থিতিতেও, এমনকি শীর্ষ আদালতের নির্দেশে জুনিয়র ডাক্তারেরা কর্মবিরতি না তুললে সরকারের তরফ থেকে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হলে আদালতের কিছু করার থাকবে না-- এই মোতাবেক হুকুম থাকা সত্ত্বেও রাজ্য সরকার আলাপ-আলোচনার পথকেই বেছে নিল এবং দু-তিনবারের ব্যর্থ চেষ্টার পর সে আলোচনা প্রথম দফায় মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে সম্পন্নও হল। পাঁচ দফা দাবির প্রায় সবই মেনে নেওয়া হল (স্বাস্থ্য সচিবের অপসারণের দাবি ব্যতীত)। জুনিয়র ডাক্তাররা কর্মবিরতি তুলে নিলেন। কিন্তু আবারও দশ দফা দাবি সহ তারা ফিরে এলেন এবং কলকাতার কেন্দ্রস্থল ধর্মতলায় আমরণ অনশনে বসে পড়লেন। সেও কয়েকদিন গড়াল। তারপর আমরা জানি, ওই দশ দফা দাবির মধ্যেও (এক-দেড়খানা বাদ দিলে) প্রায় সবকটি মেনে নেওয়া হয়েছে এবং জুনিয়র ডাক্তাররা অনশন প্রত্যাহার করে আবারও কাজে ফিরে গেছেন।

কিন্তু প্রশ্ন হল, এত সব কিছুর পর, সব মিলিয়ে সাধারণ মানুষ (বা রোগী) ও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে কর্মরত স্বাস্থ্যকর্মী-- উভয়ে উভয়ের দিক থেকে কি কিছু আদায় করতে পারলেন? অবশ্যই কিছু পারলেন; হয়তো সে পারা বা পাওয়ার মধ্যে সব-পাওয়া নেই, কিন্তু বেশ কিছু নতুন ও উল্লেখযোগ্য পাওয়া আছে বৈকি! আসুন, এক এক করে খানিক দেখে নেওয়া যাক:

১) নাগরিক সমাজ ও জুনিয়র ডাক্তারদের এই লাগাতার আন্দোলনের ফলেই তো সিবিআই আরও বেশি তৎপর হয়েছে এবং ৫৮ দিনের মাথায় শিয়ালদহ আদালতে প্রাথমিক চার্জশিট জমা দিয়েছে। ৪ নভেম্বর এই মামলার চার্জশিট পরবর্তী প্রথম শুনানি;

২) শীর্ষ আদালতের স্বতঃপ্রণোদিত হস্তক্ষেপে জাতীয় ও রাজ্য স্তরে বিশেষ টাস্ক ফোর্স গঠিত হয়েছে যারা স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে কর্মরত সমস্ত কর্মীদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা বিষয়টিকে দেখভাল করবে। ২১ অক্টোবর মুখ্যমন্ত্রী ও জুনিয়র ডাক্তারদের বৈঠক থেকেও রাজ্য টাস্ক ফোর্সে ডাক্তারদের প্রতিনিধিত্বকে সুনিশ্চিত করা হয়েছে (জুনিয়র ডাক্তারদের জোরালো দাবিতে) এবং ইতিমধ্যেই সরকারের তরফে সে সম্পর্কে নির্দেশাবলীও প্রকাশ পেয়েছে;

৩) সব থেকে বড় পাওনা, যা জুনিয়র ডাক্তারদের দশ দফা দাবির মধ্যে ছিল, কেন্দ্রীয় রেফারেল ও ডিজিটাল বেড ভ্যাকেন্সি ব্যবস্থার প্রবর্তন। এই দ্বি-ব্যবস্থা শুধু ডাক্তারদের তরফে সুচিকিৎসা প্রদানকেই সুনিশ্চিত করবে না, রোগীদের অযথা হয়রানি ও ভর্তি সংক্রান্ত নানান দুর্নীতিকেও প্রতিরোধ করবে। সরকারের তরফে জানানোও হয়েছে, এই দুই ব্যবস্থা ইতিমধ্যেই পাইলট আকারে পরীক্ষামূলক স্তরে রয়েছে, যা ১ নভেম্বর থেকে গোটা রাজ্যে চালু হয়ে যাবে;

৪) স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে দুর্নীতি রোধে আরও একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জুনিয়র ডাক্তারদের তরফে তোলা হয়েছিল-- কলেজে কলেজে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রবর্তন, অর্থাৎ, নির্বাচনের মাধ্যমে ছাত্র সংসদ সহ সমস্ত গণতান্ত্রিক কাঠামোয় প্রতিনিধি চয়ন। এ বিষয়েও উভয় পক্ষ সহমতে পৌঁছেছে এবং মার্চ ২০২৫'এর মধ্যে নির্ধারিত নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে বলে সরকারের তরফে প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়েছে;

৫) স্বাস্থ্য পরিষেবায় সমস্ত শূন্য পদগুলি পূরণ করাও ছিল একটি অন্যতম দাবি, যা নীতিগত ভাবে সরকার মেনে নিয়েছে, কিন্তু ওবিসি সংক্রান্ত আদালতের একটি নির্দেশ ও তার বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে দায়ের করা মামলায় ব্যাপারটা আপাতত আইনি গেরোয় ফেঁসে আছে। আইনি জট খুলে গেলে এ ক্ষেত্রেও সদর্থক পদক্ষপ দেখা যাবে বলে উভয় পক্ষ আশা রেখেছে বলে মনে হয়।

নির্দিষ্ট ভাবে এই প্রাপ্তিগুলো কিন্তু কম কিছু নয়। যে সমস্ত উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত সমাজের একাংশ, যারা কোনওভাবেই সরকারি হাসপাতালের দোরগোড়া অবধিও যান না, অর্থের জোরে স্বাস্থ্য পরিষেবা কিনে গর্ব প্রকাশ করেন, তাদের কাছে এই দাবিগুলির হয়তো কোনও অর্থই নেই। কিন্তু সাধারণ মানুষ ও নিত্যভোগী যারা সরকারি পরিষেবায় চক্কর কাটেন, তাদের কাছে এই প্রাপ্তি অমূল্য। এই প্রাপ্তিগুলিতে (বিশেষত উপরে উল্লিখিত ৩ নং প্রাপ্তিটি) সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা আরও উন্নত হবে বলে আশা করা যায়।

তবে এর মধ্যেও দুটি কাঁটা যেন রয়ে গেল:

১) 'থ্রেট কালচার'এর নামে কলেজ একাডেমিক কাউন্সিলের নির্দেশে কলেজ থেকে ডজন ডজন ছাত্র বা জুনিয়র ডাক্তার বহিষ্কারের নীতি-নৈতিকতার এক্তিয়ার কতটা, তা নিয়ে ২১ অক্টোবরের বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী প্রশ্ন তুলেছেন শুধু তাই নয়, পরের দিন কলকাতা হাইকোর্টও আরজিকর থেকে ৫১ জন শাস্তিপ্রাপ্ত ছাত্র ও জুনিয়র ডাক্তারের ওপর শাস্তি রদ করে একই প্রশ্ন তুলে রাজ্য সরকারের কাছে তা বিচার ও সিদ্ধান্তের জন্য পাঠাতে নির্দেশ দিয়েছে;  

২) জুনিয়র ডাক্তারদের কর্মবিরতির সময় তাদের যে ৫৬৩ জন বেসরকারি হাসপাতালে কাজ করে অর্থ কামিয়েছেন, তথ্য হাতে মুখ্যমন্ত্রীর তোলা এই অভিযোগের জবাব এখনও কিন্তু জুনিয়র ডাক্তারদের তরফ থেকে পাওয়া যায়নি।

এ ব্যতিরেকে, অভয়ার সুবিচারের দাবিতে জনসমাজের সোচ্চার আওয়াজ, কাজে নিরাপত্তা, গণতান্ত্রিকীকরণ ও রোগীদের সুচিকিৎসার দাবিতে জুনিয়র ডাক্তারদের জোরদার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন, অন্যদিকে, আন্দোলনের প্রতি সরকারের ধৈর্য, নিজেদের গাফিলতির দায়কে প্রকারান্তরে স্বীকার করে নমনীয়তা অবলম্বন ও কোনওভাবেই দমন-পীড়নের পথে না হেঁটে গণতান্ত্রিক উপায়ে সমস্যা নিরসনের চেষ্টা-- উদ্ভুত সমস্যাকে কিছুটা হলেও সমাধানের দিকে এগোতে সাহায্য করেছে।     

কিন্তু তার মানে এও নয় যে, সব কিছু মিটে গেল। আন্দোলনের যেমন শুরু ও বিরতি থাকে, নানাবিধ ওঠানামাও থাকে, শাসকের তরফেও তাকে মোকাবিলার নানান তরিকা থাকে; প্রশ্নটা হল, বিপরীত দিক থেকে ধাবিত শাসক ও শাসিতের এই দুই প্রক্রিয়া কি উভয়ের পক্ষে ক্রমেই অসহনীয় হয়ে উঠছে, নাকি, সেখানে বোঝাপড়ার জায়গা থাকছে। এই দ্বান্দ্বিক নিয়ম যারা বোঝেন না, তারাই 'থ্রেট কালচারের' আসল তল্পিবাহক হন এবং 'ট্রোলিং' ও 'বুলিং'এর মাস্টারমাইন্ড হিসেবে জনবিচ্ছিন্ন মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে নিজেদের এজেন্ডাকে কোথাও অনুমোদন না করাতে পেরে খিস্তিখেউড় আর হিংসাকে অবলম্বন করে হতাশায় দিন কাটান।

 

Tuesday, 22 October 2024

লাদাখের লড়াই

কর্পোরেট আগ্রাসন বনাম সোনম ওয়াংচুক

প্রশান্ত ভট্টাচার্য 



টানা ১৬ দিন অনশনে থাকার পর কেন্দ্রীয় সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের তরফে আগামী ৩ ডিসেম্বর বৈঠকে বসার প্রতিশ্রুতি পেয়ে গত ২১ অক্টোবর দিল্লিতে সোনম ওয়াংচুক অনশন ভঙ্গ করেন। কিন্তু কেন এই অনশন? কোন প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের বিরুদ্ধে ও কীসের দাবিতে লাদাখের এই ব্যাপক জন আন্দোলন যার অন্যতম নেতা সোনম ওয়াংচুকের এই দীর্ঘ লড়াই? দেশের এক প্রত্যন্ত অঞ্চল লাদাখের এই সমস্যাকে বুঝতে আমাদের কিছুটা পিছিয়ে যেতে হবে।

২০১৯ সালের ৫ আগস্ট ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ বাতিল হওয়ার সুবাদে খুশি হয়েছিলেন লাদাখের মানুষ। জম্মু-কাশ্মীর থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার আনন্দে হাত ধুয়ে বিজেপিকে ভোট দিয়েছিলেন লাদাখবাসী। সেই তাঁরাই আজ ক্ষুব্ধ! কেন? 

অনেকের মনে আছে, লাদাখের সাংসদ বিজেপির জামিয়াঙ্গ শেরিং নামগিয়াল লাদাখের জম্মু-কাশ্মীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পৃথক কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হওয়া আর ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল নিয়ে খুবই উচ্ছ্বসিত ভাষণ দিয়েছিলেন সংসদে। কিন্তু তারপর সবটাই কেমন বদলে গেল! বিজেপির বিরুদ্ধে বিশ্বাসভঙ্গের অভিযোগ তুলে আর কর্পোরেট আগ্রাসনের প্রতিবাদে সোনম ওয়াংচুকদের লড়াইয়ে বরফে মোড়া লাদাখ আজ ক্রমেই তপ্ত হচ্ছে। কেন? সব প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে সোনম ওয়াংচুক ও লাদাখবাসীদের প্রতিটি পদক্ষেপে। লাদাখ আর সোনম ওয়াংচুক আজ সমার্থক। চলতি বছরে ২১ দিন টানা অনশন করার পর ২৬ মার্চ অনশন প্রত্যাহার করলেও সোনম ওয়াংচুক জানিয়ে দিয়েছিলেন, লড়াই চলবে। লড়াই চলছে, যা আজ পৌঁছে গিয়েছে দেশের রাজধানী দিল্লিতে।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, গত ৫ অক্টোবর থেকে কলকাতার ধর্মতলায় আমরণ অনশন শুরু করেন ৬ জন জুনিয়র ডাক্তার। পরে  অনশনে যোগ দেওয়া আন্দোলনকারী ডাক্তারদের সংখ্যা বেড়েছে। পুলিশ ও রাজ্য প্রশাসনের তরফে বারবার অনশন তুলে নেওয়ার জন্য ডাক্তারদের কাছে অনুরোধও করা হয়েছে। কিন্তু তাদের উপর কোনও জোরজবরদস্তি হয়নি। অথচ, দিল্লিতে দুর্গাপুজোর কার্নিভাল না থাকলেও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের অধীনে থাকা দিল্লি পুলিশ লাদাখের পরিবেশকর্মী সোনম ওয়াংচুক-সহ ২০ জনকে জোরজবরদস্তি অনশনস্থল থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে আটক করে।

দিল্লির লাদাখ ভবনের কাছে আলাদা রাজ্যের দাবিতে অনশন চালাচ্ছিলেন জলবায়ু আন্দোলন কর্মী সোনম ওয়াংচুক। তাঁর সঙ্গে এই একই দাবিতে আন্দোলনে ছিলেন আরও ২০-২৫ জন। ১৩ অক্টোবর রবিবার আইনশৃঙ্খলা রক্ষার সাফাই দিয়ে সোনম-সহ ২০ জনকে লাদাখ ভবনের সামনে থেকে আটক করে দিল্লি পুলিশ। দিল্লি পুলিশের এই ভূমিকার তীব্র বিরোধিতা করে সোনম ওয়াংচুক জানান, 'এটা সত্যিই খুব দুঃখের যে গণতান্ত্রিক পরিবেশে মানুষ নিজের মতামতও প্রকাশ করতে পারছে না। লাদাখ ভবনের সামনে আমরা যখন নীরব অনশন শুরু করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম তখন ওখানে অনশনে যোগ দেবে বলে অনেকে জড়ো হয়েছিলেন। আমাদের বলা হয়েছিল কোনও স্লোগান দিতে পারব না। আমরা তাও মেনে নিয়েছিলাম। তা সত্ত্বেও আমাদের জোর করে তুলে দিল পুলিশ। পুলিশের বাসে চাপিয়ে আমাদের আটক করা হল। আমাদের বলা হল, এখানে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। এটা শুধু আমাদের জন্য দুঃখজনক নয়, গণতন্ত্রের পক্ষেও লজ্জার। ভারতের জন্য আমাদের দুঃখ হচ্ছে।' লজ্জার হচ্ছে, এ নিয়ে বাংলার প্রধান সংবাদমাধ্যমের কোনও হেলদোল নেই। ভাবটা এমন, কে সোনম ওয়াংচুক! অথচ এই প্রযুক্তিবিদ যখন পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনে ম্যাগসেসাই পুরস্কার পান, তখন ধন্য ধন্য করেছিল এই সংবাদমাধ্যমগুলিই। আসল কথাটি হচ্ছে, কর্পোরেট বিরোধী কোনও আন্দোলনের খবর করতে নারাজ এখানকার সরকার বাড়ি।

লাদাখকে রাজ্যর মর্যাদা দেওয়ার দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে লড়াই করছেন বাস্তবের 'র‍্যাঞ্চো' সোনম ওয়াংচুক। তাঁর দাবি, লাদাখকে সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলের আওতাভুক্ত করে পূর্ণ রাজ্যর মর্যাদা দেওয়া হোক। লাদাখের জন্য একটি পৃথক পাবলিক সার্ভিস কমিশন গঠন ও লে আর কার্গিলের জন্য আলাদা লোকসভা আসনের বন্দোবস্ত করা হোক। এমনই সমস্ত দাবি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলনের পাশাপাশি ফের অনশনে বসেন সোনম। শুধু নুন আর জল পান করেছেন। ফলে, শরীর হয়ে পড়েছিল দুর্বল। প্রথমে দিল্লির যন্তর মন্তরের সামনে ধর্নায় বসতে চেয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু অনুমতি না মেলায় দিল্লির লাদাখ ভবনের সামনে অনির্দিষ্টকালের জন্য অনশন শুরু করেন। শাহমন্ত্রক নিয়ন্ত্রিত দিল্লি পুলিশের বক্তব্য, 'আন্দোলনকারীরা যন্তর মন্তরের সামনে অনশনে বসার অনুমতি চেয়েছিলেন। সেই অনুমতিই খতিয়ে দেখা হচ্ছে। লাদাখ ভবনের সামনে এভাবে অনশনে বসার কোনও অনুমতি ছিল না তাঁদের কাছে। আমরা কয়েকজনকে আটক করেছি। ছেড়ে দেওয়া হবে।' লে থেকে দীর্ঘ ৩০ দিন পথ পায়ে হেঁটে দিল্লিতে এসেছেন আন্দোলনকারীরা। এর আগে ৩০ সেপ্টেম্বর তাঁদের দিল্লির সিঙঘু সীমানার কাছে আটক করা হয়েছিল। পরে সোনম-সহ বাকিদের ২ অক্টোবর ছেড়ে দেওয়া হয়। 

লাদাখে কর্পোরেট আগ্রাসন নিয়ে কোনও সমঝোতায় আসতে নারাজ সোনমরা। সোনমের স্পষ্ট কথা,  লাদাখে এখন না আছে স্থানীয়দের জন্য সংরক্ষণ, না আছে গণতান্ত্রিক কাঠামো। এখানে বিধানসভা নেই, নির্বাচিত নেতা নেই। দিল্লি থেকে নিয়ন্ত্রিত একটি আমলাতান্ত্রিক শাসন চলছে লাদাখে। ফলে, এক কালে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল চেয়ে আসা মানুষেরই আজ মোহভঙ্গ হয়েছে। লাদাখি সেনাদেরও মনোবল একই কারণে ভেঙে গিয়েছে বলে দাবি করেন সোনম। তিনি অকপটে বলেন, ‘ওঁরা শুধু ভোটের কথা আর কতগুলো আসন জেতা যেতে পারে, সেই কথা ভাবেন। কিন্তু মানুষের কথা ভুলে যান। আমরা কেন্দ্রের কাছে এই নিশ্চয়তা চাই যে, ভবিষ্যতে তারা এ ভাবে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করবে না।’ কেন্দ্রের সঙ্গে একটি বহুপাক্ষিক আইনি চুক্তিই তাঁরা চাইছেন বলে সোনম জানিয়েছেন। তাঁদের লক্ষ্য, ষষ্ঠ তফসিলের অন্তর্ভুক্তি তো বটেই, সেই সঙ্গে পূর্ণ রাজ্যর মর্যাদাও।

চলতি বছরের গোড়ায়, লাদাখের ওই হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডায় আমরা দেখেছি, গায়ে একটা কম্বল জড়ানো, অনশনক্লিষ্ট শীর্ণ কালি পড়া মুখ ‘বাস্তবের র‌্যাঞ্চো’ সোনম ওয়াংচুককে। টিভি সাক্ষাৎকারে অকম্পিত তাঁর গলা। কোনও শীতল-জড়তা ছাড়াই লাদাখের পরিবেশ আন্দোলনের অদম্য প্রহরী বলে গেলেন, ‘লোকে আজ জানতে চাইছে, আমাদের পাহাড়গুলোকে বিভিন্ন শিল্প আর খনি সংস্থার কাছে বেচে দেওয়াটাই লাদাখকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করার আসল উদ্দেশ্য নয় তো?’ এক্কেবারে গোড়া ধরে নাড়া দিয়েছেন সোনম। তাঁর উচ্চারিত এই লোকরা কারা? সোনম জানাচ্ছেন, এঁরা লাদাখবাসী, কেন্দ্রীয় শাসক দলের নেতাদের প্রতি মোহভঙ্গ হয়েছে যাঁদের; রোজ যাঁরা সোনমের সঙ্গে খোলা আকাশের নীচে মাইনাস ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে হাড়জমানো শীতে রাত কাটিয়েছেন। সংখ্যায় এঁরা অন্তত আড়াইশো। এ ছাড়া রোজ সারা দিনে ভিড় জমাচ্ছিলেন আরও দুই থেকে পাঁচ হাজার মানুষ। অনশনরত সোনমের মুখে সেদিনও শোনা গিয়েছিল, ‘আমরা বিদায়ী সরকারকে মনে করাতে চাই, তারা লাদাখের মানুষকে কী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। বিভিন্ন বৈঠকে, ১৯'এর লোকসভা ভোট এবং ২০'র পার্বত্য পরিষদের নির্বাচনে তারা বলেছিল, লাদাখকে সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলের রক্ষাকবচ দেওয়া হবে। এই প্রতিশ্রুতি দিয়েই তারা বিপুল ভোটে জেতে। কিন্তু তারপর থেকে টালবাহানাই চলেছে। গত ৪ মার্চ তারা পরিষ্কার জানিয়ে দেয়, ষষ্ঠ তফসিল হবে না।’

সোনম অনশনে বসার আগেই পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা এবং ষষ্ঠ তফসিলে অন্তর্ভুক্তির দাবিতে লাদাখে বিক্ষোভ ও বন্‌ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল। এই সময়ে কার্গিল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স বা কেডিএ এবং লে অ্যাপেক্স কাউন্সিলের ছ' সদস্যর একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বৈঠক করেন। জানা যায়, সেই বৈঠকে জমি, চাকরি এবং সংস্কৃতি নিয়ে লাদাখবাসীদের উদ্বেগ দূর করার লক্ষ্যে সংবিধানের ৩৭১ ধারার মতো রক্ষাকবচের আশ্বাস দিয়েছিলেন শাহ। তবে এ-ও জানিয়ে দিয়েছিলেন, ষষ্ঠ তফসিলে লাদাখের অন্তর্ভুক্তি আর পৃথক আইনসভার দাবি মানা সম্ভব নয়। সোনমের অনশন আন্দোলনের প্রতি সহমর্মিতা জানিয়ে কেডিএ লাদাখে অর্ধদিবস ধর্মঘটের ডাকও দিয়েছিল। এই লড়াই-সংগ্রামগুলো প্রমাণ করে সোনমের পাশে আছে বৃহত্তর লাদাখ। 

কর্পোরেট সমাজের সীমাহীন লোভ যে হিমালয়ের পরিবেশকে নানাভাবে বিপন্ন করে তুলছে, তার নমুনা আমরা বিভিন্ন সময় পাচ্ছি। হরিদ্বার-ঋষীকেশ বা চারধামের মতো তীর্থস্থানে এই বিপন্নতার ছবি স্পষ্ট বোঝা গেছে। তা নিয়ে বারবার কথা উঠেছে, পর্যটনের সঙ্গে এর যে ভয়াবহ সম্পর্ক আছে তাও সুবিদিত। অথচ কোনওরকম তোয়াক্কা না করে এক  বিরাট প্রযুক্তিগত কেরামতি চালানো হচ্ছে যোগাযোগ ব্যবস্থার অস্বাভাবিক উন্নতির জন্য। এর দুঃসহ পরিণাম সবাই দেখছেন। যোশী মঠের মানুষের হাহাকার গেরুয়া শিবিরের কার কার হৃদয়ে পৌঁছেছে জানা নেই, তবে নির্মাণ শ্রমিকদের সুড়ঙ্গে আটকে পড়া এবং হাড় হিম করা উদ্ধারকার্য আমরা গিলেছি রিয়েলিটি শো দেখার বিনোদনে। আহা! কী টান টান উত্তেজনা। 

‘থ্রি ইডিয়টস’ ছবির নায়ক ফুংসুক ওয়াংডুর মধ্যে সোনমেরই ছায়া একসময় যারা দেখেছিল, সেই সংবাদমাধ্যম কী নিষ্ঠুর উদাসীন! তাই একুশ দিন ধরে ভারতের এক প্রান্তে অনশন করা সোনম ওয়াংচুকের কথা মূলধারার সংবাদমাধ্যমে উপেক্ষিত। সোনম কিন্তু কোনও এলিতেলি নন। আদ্যন্ত অহিংস ভাবনায় হিমালয়ের পরিবেশ এবং এলাকার মানুষের জীবন-জীবিকার সুরক্ষা নিয়েই তাঁর কাজকর্ম। তিনি এক ব্যতিক্রমী প্রযুক্তিবিদ ও শিক্ষক, যিনি বিজ্ঞানকে প্রকৃত অর্থে হাতেকলমে নেড়েচেড়ে মানুষের কাজে লাগিয়েছেন। তাঁর বরফ-স্তূপ লাদাখের মানুষের জল সমস্যা মেটানোর এক অভিনব প্রক্রিয়া। তাঁর উদ্ভাবনী শক্তির ফলেই ভারতের এই সংবেদনশীল সীমাঞ্চলে প্রবল ঠাণ্ডায় থাকা সৈনিকদের জন্য সৌর তাঁবু তৈরি করা গেছে। প্রকৃতির শৌর্য ও শক্তির সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কে থাকায় আজ বিশ্বব্যাপী জলবায়ু সংকট ও হিমালয়ের সম্ভাব্য বিপর্যয়ের দিকে খেয়াল রেখে তিনি একের পর এক উদ্ভাবনের কথা ভেবেছেন এবং সকলের সহযোগিতায় এক বিকল্প পথের সন্ধান করে চলেছেন। এমন মানুষকে যখন বিশ্ব স্বীকৃতি দেয়, তখন তাঁর ওপর রাষ্ট্র এবং গোদী মিডিয়া চটে কেন? কারণ একটাই, যে কর্পোরেটের সেবা করার দায় রাষ্ট্র ও তার পেটোয়া চতুর্থ স্তম্ভের, সেই কর্পোরেটের বিরুদ্ধেই সরব সোনমরা। তাঁদের আন্দোলন হিমালয়ের পরিবেশ ধ্বংসের মতো বিষয়কে সরাসরি কর্পোরেট আগ্রাসনের সঙ্গে যুক্ত করে দেখিয়ে দিচ্ছে। আর সে কারণেই লাদাখবাসীর এই আন্দোলনকে মূলধারার রাজনীতি ও সমাজমাধ্যম নির্লজ্জভাবে অগ্রাহ্য করে চলেছে।‌ মুনাফাবাজরা তার ধারেকাছেও যাবে না। তাদের কাছে মাটির ওপরে বা নীচে যা যা পাওয়া যায় সমস্তই পণ্য, তা লুঠে নিয়েই তারা মুনাফার পাহাড় গড়বে। 

এই অবস্থায় লাদাখ ষষ্ঠ তফসিলের অন্তর্ভুক্ত হলে কী হবে? হবে, কিছুটা সুরাহা হবে। যেহেতু লাদাখের জনসংখ্যার ৯৭ শতাংশ জনজাতি গোষ্ঠীভুক্ত, তাই খানিকটা সুরক্ষা পাওয়া যাবে। স্থানীয় মানুষের ভাবনাও তেমনই। তফসিলি জনজাতির জাতীয় কমিশন থেকেও সেই সুপারিশ করা হয়েছে। সোনমদের আন্দোলনও তাই অব্যাহত।


Thursday, 17 October 2024

২০২৪: অর্থনীতিতে নোবেল

প্রতিষ্ঠান একটি সামাজিক চয়নের বিষয়

অচিন চক্রবর্তী



সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ইউক্রেন ও পোল্যান্ড দুটি সার্বভৌম দেশ। ইউক্রেনের অর্থনীতি তখন যথেষ্ট এগিয়ে – শিল্পোন্নত, প্রশিক্ষিত শ্রমিকের অভাব নেই, প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ। অন্যদিকে উন্নয়নের নিরিখে পোল্যান্ড রয়েছে অনেক পিছনে। অথচ পরবর্তী তিন দশকে দেখা গেল ইউক্রেনের অর্থনীতি প্রায় স্থবির, সমস্যায় জর্জরিত আর পোল্যান্ডের মাথাপিছু জাতীয় আয় বেড়ে হল প্রায় তিন গুন। কেন এমন হল? কেন এমন হয়? বুঝতে গেলে এই দু' দেশের প্রতিষ্ঠানগুলির দিকে তাকাতে হবে। 

এখন অনেকে স্বাভাবিকভাবেই মনে করেন, জটিল জালের মতো বিছানো প্রতিষ্ঠানগুলির উপর সমাজ প্রগতি নির্ভর করে থাকে। সেগুলি বিবাদের নিষ্পত্তি করে, বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করে, বিনিয়োগে উৎসাহ দেয়, পরিবেশকে সুরক্ষা দেয় ইত্যাদি। খেলার নিয়ম স্থির করে দেওয়াই প্রতিষ্ঠানের কাজ। সে নিয়ম আইনের চেহারায় থাকতে পারে, না হলে প্রচলিত রীতি হিসেবেও। পোশাকি আইন আর প্রচলিত রীতি মিলেমিশেই হয় এক একটি প্রতিষ্ঠান। ভারতে জাতপাত সে অর্থে একটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠান যেমন ডিজাইন মেনে স্থাপন করার চেষ্টা হয়, আবার তা দীর্ঘ সময় ব্যেপে বিবর্তিতও হতে পারে। ইউক্রেনের ব্যর্থতার কারণ যদি হয় বাড়াবাড়ি রকম দুর্নীতি, তাহলে দুর্নীতির কারণ খুঁজতে হবে সে দেশের প্রতিষ্ঠানগুলিতে। পোল্যান্ডের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাবে, সেগুলি দুর্নীতি ঠেকাতে যে তেমন কার্যকরী হয়নি, তার ব্যাখ্যা তাদের প্রকৃতিতেই খুঁজে পাওয়া যাবে। 

আগেই বলেছি, প্রতিষ্ঠান বলতে বুঝব খেলার নিয়ম, যাকে বলে ‘রুলস অফ দ্য গেম’। রাষ্ট্র যেমন একটি প্রতিষ্ঠান, প্রতিযোগিতাপূর্ণ বাজার ব্যবস্থাও একটি প্রতিষ্ঠান, আবার দাস-ব্যবস্থাও একটি প্রতিষ্ঠান। যে কোনও ব্যবস্থারই মর্মবস্তুতে রয়েছে একগুচ্ছ নিয়ম যা মানুষের আর্থনীতিক কাজকর্মকে নির্ধারণ করে। সোভিয়েত-উত্তর ইউক্রেনে একটি ছোট এলিট গোষ্ঠী সামাজিক ব্যবস্থাপনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে লাগল। এঁরাই আবার সোভিয়েত যুগে ক্ষমতার সিঁড়ির মাথায় ছিলেন। ফলে, খেলার নিয়মও বেঁকিয়ে-চুরিয়ে এমন করা হল যাতে তাঁদের স্বার্থ রক্ষা হয়, দেশের অর্থনীতির নয়। এমতাবস্থায় সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অনীহা দেখা দেবে উৎপাদন ও নতুন প্রযুক্তি-উদ্ভাবনের জন্যে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগে, যার পরিণতি অর্থনীতির মন্দগতি। 

ডারন আসেমগলু, সাইমন জনসন এবং জেমস রবিনসন আর্থনীতিক প্রগতি বা তার নিম্নগতিকে বিশ্লেষণ করেছেন এই প্রতিষ্ঠানভিত্তিক ব্যাখ্যা দিয়ে। প্রতিষ্ঠানভিত্তিক ব্যাখ্যা যে তাঁরাই প্রথম দিলেন তা নয়। অতীতে অনেক বিশিষ্ট অর্থশাস্ত্রীই নানান ছাঁদে প্রতিষ্ঠানভিত্তিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। ডগলাস নর্থ তো আর্থনীতিক ইতিহাসের প্রতিষ্ঠানভিত্তিক তত্ত্বায়নের জন্যে নোবেল পুরস্কারই পেয়েছিলেন ১৯৯৩-এ। নর্থ-অনুসৃত বিশ্লেষণ-ধারাকে বলা হয় ‘নিউ ইনস্টিটিউশনাল ইকনমিকস’। তবে আসেমগলু-জনসন-রবিনসনদের তত্ত্ব নর্থের থেকে অনেকটাই আলাদা। নর্থের তত্ত্বে সম্পত্তির ব্যক্তি মালিকানার বিষয়টি প্রাধান্য পায়। সম্পত্তির মালিকানা অস্পষ্ট থাকলে বাজার বিস্তার লাভ করতে পারে না। তাই যে রকম প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো মুক্ত বাজারের বিস্তারে সহায়ক তা-ই আর্থনীতিক বৃদ্ধিও ঘটাতে পারে, নর্থের মতে। উন্নত দেশগুলির ইতিহাস নাকি সে রকমই বলে। কিন্তু এবারের নোবেল প্রাপক তিন অর্থশাস্ত্রী প্রতিষ্ঠানের গবেষণা নিয়ে গেছেন অন্য খাতে। তারই স্বীকৃতিস্বরূপ নোবেল পুরস্কার। নর্থের মতো মুক্ত-বাজার-সহায়ক প্রতিষ্ঠানে তাঁরা আটকে থাকেননি। তিনজনের জোটকে নোবেল কমিটি স্বীকৃতি দিলেও ধারে এবং ভারে আসেমগলুর নামই প্রথমে আসবে। 

আসেমগলুদের মতে প্রতিষ্ঠান মূলত দুরকম হতে পারে। এক ধরনের প্রতিষ্ঠান আহরণমূলক বা এক্সট্র্যাকটিভ, যা উৎপাদন ও উদ্ভাবনকে প্রণোদনা দেওয়ার বদলে যেটুকু যা সম্পদ তৈরি হচ্ছে তা-ই বিশেষ ক্ষমতাধারী গোষ্ঠী বা শ্রেণিকে পাইয়ে দেয়। আর্থনীতিক কাজকর্মের থেকে উদ্ভূত ফল অসম অনুপাতে সেই গোষ্ঠীরই হস্তগত হয়। ধরা যাক দাস ব্যবসা, যা দীর্ঘকাল চলেছে নির্দিষ্ট সামাজিক রীতি (নর্ম) ও নির্দেশ (কম্যান্ড) নির্ভর করে, উচ্চ শ্রেণিদের স্বার্থর দিকে লক্ষ রেখে। এও এক ধরনের এক্সট্র্যাকটিভ প্রতিষ্ঠান। এক সময়ে বামপন্থী বিশ্লেষণে ভারতীয় কৃষি-ব্যবস্থা প্রসঙ্গে ‘আধা-সামন্ততন্ত্র’ কথাটি খুব ব্যবহৃত হত। এই ব্যবস্থায় জমির মালিক তথা ঋণদাতা ভাগচাষীকে এমন সুযোগ দেবেন না যাতে কৃষির উৎপাদনশীলতা বেড়ে যায়, চাষির আয় বাড়ে এবং তিনি ঋণমুক্ত হন। এ ক্ষেত্রে বর্গাদারী ব্যবস্থাটিকে বলা যায় এক্সট্র্যাকটিভ, যা কৃষির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির পক্ষে সহায়ক নয়। এখন আমাদের ঘরের কাছে আছে অতি পরিচিত 'সিন্ডিকেট' নামক আহরণমূলক প্রতিষ্ঠানটি। পাঠক কল্পনা করে নিতে পারেন, সেটি না থাকলে পশ্চিমবঙ্গের ইমারত শিল্পের প্রগতি কেমন হতে পারত।   

তাহলে অন্যরকম প্রতিষ্ঠানটি কেমন? সেটি এরকম আহরণমূলক নয়, যাকে আসেমগলুরা বলছেন ‘ইনক্লুসিভ’ বা সমন্বিত। সেখানে আর্থনীতিক উদ্যোগ এবং পরিশ্রম যথাযথ পুরস্কৃত হবে; বাজারে সকলের সমান অন্তর্ভুক্তিতে কোনও রাজনৈতিক বা জাত পরিচয় বাধা হবে না। ইতিহাস ঢুঁড়ে দেখলে এই দু প্রকার প্রতিষ্ঠানেরই অস্তিত্ব লক্ষ করা যায়। আসেমগলুদের কৃতিত্ব তাঁরা কয়েক শতকের পরিসংখ্যান ঘেঁটে, আঁটোসাঁটো সংখ্যাতাত্ত্বিক গবেষণা পদ্ধতি ব্যবহার করে, সমন্বিত প্রতিষ্ঠান ও আর্থনীতিক প্রগতির মধ্যে জোরালো সম্পর্ক স্থাপন করতে পেরেছেন।    

এই পদ্ধতি অনুসরণ করে দেখানো যায় তথাকথিত ‘ভাগ্যের ডিগবাজি’। মাথাপিছু আয়ের নিরিখে মধ্য আমেরিকা, দক্ষিণ এশিয়া বা আফ্রিকায় সাহারার নীচের দেশগুলি – যাদের সাধারণভাবে ‘উন্নয়নশীল’ বলা হয় – তাদের থেকে উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপ অনেক দূর এগিয়ে গেছে। উন্নয়নের অর্থনীতির পাঠ্যবইয়ে পশ্চাদপদতার যে কারণগুলি উল্লেখ থাকত তা হল পুঁজিতে বিনিয়োগ কম, শিক্ষার ধীরগতি প্রসারের কারণে মানব পুঁজির অভাব, প্রায় অচল প্রযুক্তি ইত্যাদি। কিন্তু এগুলি সবই যাকে বলা যায় ‘সমীপবর্তী কারণ’, যে কারণের আবার গভীরতর কারণ থাকা সম্ভব, যাকে বলা যায় ‘মূল কারণ’। মার্কসীয় তত্ত্বে এই ‘মূল কারণ’ খোঁজা নিয়ে হাসিঠাট্টাও কম হয়নি। যেমন, ধরা যাক জনৈক মদ্যপ বেসামাল হয়ে গাড়ি চালিয়ে দুর্ঘটনায় নিহত হন। তাঁর মৃত্যুর সমীপবর্তী কারণ হিসেবে মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালানোকে যেমন চিহ্নিত করা যায়, আবার পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ব্যক্তি মানুষের বিচ্ছিন্নতা এবং তার মদ্যপ হয়ে ওঠার সম্পর্ক দেখিয়েও কেউ বলতে পারেন দুর্ঘটনায় এই মৃত্যুর আসল কারণ পুঁজিবাদী সমাজ। মজার ব্যাপার হল, সমাজবিজ্ঞানে এই সমীপবর্তী কারণ থেকে গভীরে প্রোথিত মূল কারণে পৌঁছনোর কোনও সোজাসাপটা ফর্মুলা নেই।  

উপনিবেশায়নের প্রক্রিয়াটি আসেমগলুরা খুব গভীরভাবে অধ্যয়ন করেছেন, যে পাঠে অর্থনীতির সঙ্গে ভূগোল, ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে মেশাতে হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের উন্নয়নের ইতিহাসের ব্যাখ্যায় কেউ কেউ ভৌগোলিক পার্থক্যকে কেন্দ্রে রাখতে চান। যুক্তিটা হল, পেছিয়ে পড়া দেশগুলির অধিকাংশই রয়েছে নিরক্ষরেখার আশপাশে, যেখানে বৃষ্টিপাত বেশি এবং গ্রীষ্মমণ্ডলে বিদ্যমান রোগভোগের (যেমন ম্যালেরিয়া) প্রাদুর্ভাব বেশি। আসেমগলুরা বললেন, ভৌগোলিক অবস্থান এবং আর্থনীতিক অনুন্নয়ন, এরকম দুটি বৈশিষ্টের মধ্যে সহগতির সম্পর্ক থাকতেই পারে, কিন্তু তা থেকে বলা যায় না একটি (ভৌগোলিক অবস্থান) অন্যটির (অনুন্নয়ন) কারণ। উপনিবেশায়নের ইতিহাস সেটি প্রমাণ করার সুযোগ এনে দেয়। ভূগোল যদি নির্ধারক হত তাহলে তো উপনিবেশায়নের আগে যে সব অঞ্চল সমৃদ্ধ ছিল তারাই থাকত আজকের উন্নত বিশ্বে, আর তখন যারা পিছিয়ে ছিল এখনও তাদেরই পিছনে থাকার কথা। কিন্তু তা হয়নি। উপনিবেশায়নের ফলে এক প্রকার ‘ভাগ্যের ডিগবাজী’ বা ‘রিভারসাল অব ফরচুন’ ঘটে গেছে; সমৃদ্ধশালী অঞ্চল তাদের জৌলুস হারিয়ে ঢুকেছে আজকের উন্নয়নশীল পরিবারে, আর সেকালের অনুন্নত অঞ্চল হয়েছে এখনকার উন্নত বিশ্ব। এই সামান্যীকরণে একটু ফাঁক-ফোকর থাকলেও মোটের উপর গ্রহণযোগ্য। 

ভূগোল-কেন্দ্রিক ব্যাখ্যার দুর্বলতা না হয় বোঝা গেল, কিন্তু এ থেকে ভাল প্রতিষ্ঠান আর খারাপ প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বে কীভাবে উপনীত হলেন তাঁরা? ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে, ইউরোপীয়রা তাদের বিভিন্ন উপনিবেশে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেছে এবং তার ফলে যে আনুষঙ্গিক প্রতিষ্ঠানগুলি গুরুত্ব পেয়েছে তারা একই রকম নয়। বেলজিয়ান উপনিবেশ কঙ্গো থেকে শুরু করে ক্যারিবিয়ান এবং মধ্য আমেরিকার খনি – সর্বত্রই দমনমূলক শ্রম প্রক্রিয়া দেখা যায়, যা আহরণমূলক প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার উদাহরণ। ভারতে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তও তাই। অন্যদিকে ‘নতুন বিশ্ব’ উত্তর আমেরিকা এবং কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে ইউরোপীয়রা স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকে দেশগুলিকে নিজেদের পছন্দসই ধাঁচে গড়ে তুলে। স্থায়ীভাবে থেকে যাওয়ার একটি কারণ অবশ্য রোগবালাই সেখানে কম। অন্যদিকে জমি অঢেল কিন্তু খাটার লোকের অভাব। ফলে, স্থানীয়দের একাংশের সঙ্গে আঁতাত করে অন্যদের শ্রমে বাধ্য করে সম্পদ আহরণের যে প্রাতিষ্ঠানিক মডেলটি মধ্য আমেরিকা ও কারিবিয়ানে গজিয়ে উঠল, তা সে সব দেশে চলবে না। এই দেশগুলিতে তাই প্রতিষ্ঠানগুলি এমন চেহারা নিল যা ব্যক্তির উদ্যোগকে পুরস্কৃত করতে সম্পত্তির অধিকারে জোর দিল; প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও ব্যবহার গুরুত্ব পেল। সেই সঙ্গে অবশ্য দাস ব্যবসার মতো কুৎসিত ব্যাপারও চলতে থাকল। কিন্তু সেইসব অর্থনীতির দ্রুত উত্থানের পক্ষে দাস ব্যবসা অন্তরায় হওয়ার কথা নয়।

অর্থনীতির প্রগতির সঙ্গে সমন্বয়ী প্রতিষ্ঠানের জোরালো সম্পর্ককে কঠোর পদ্ধতির সাহায্যে প্রতিষ্ঠিত করায় এই ত্রয়ী অভিনন্দনযোগ্য। সমাজবিজ্ঞানে কোনও তত্ত্বই তর্কাতীত নয়। তর্ক থাকবে। এই তর্ককে উসকে দেওয়ার কাজটি শুধু অর্থনীতির উচ্চস্তরের গবেষণা পত্রিকায় পেপার প্রকাশের মধ্যে দিয়ে হয় না। তাই আসেমগলুরা তাঁদের গবেষণালব্ধ জ্ঞান সেভাবে আটকে রাখেননি। গবেষণার নির্যাস নিয়ে আসেমগলু ও রবিনসন ‘হোয়াই নেশানস ফেল’ শিরোনামে একটি চমৎকার বই প্রকাশ করেন বারো বছর আগে যা অর্থনীতির গণ্ডি ছাড়িয়ে যে কোনও সিরিয়াস পাঠকের আগ্রহের সঞ্চার করবেই। আসেমগলু ও জনসনের সাম্প্রতিক বই ‘পাওয়ার এন্ড প্রগ্রেস’ও অবশ্যপাঠ্য মনে করি। 

প্রযুক্তির দ্রুত পরিবর্তন – যা আমাদের এনে ফেলেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার টালমাটাল ক্ষেত্রে – নানান উদ্বেগের জন্ম দিয়ে চলেছে ক্রমাগত। আসেমগলু ও জনসন মনে করিয়ে দিচ্ছেন, প্রযুক্তি উদ্ভাবনে কার লাভ কার ক্ষতি এই প্রশ্নটি গত সহস্র বছরের মতো আজও প্রাসঙ্গিক। বিদ্যমান প্রতিষ্ঠান সমূহই নির্ধারণ করে দেয় লাভক্ষতির ভাগাভাগি কেমন হবে। মনে রাখতে হবে, সমাজই চয়ন করতে পারে ন্যায্য প্রতিষ্ঠানটিকে।