এই পথে আলো জ্বেলে
মালবিকা মিত্র
আরজি কর হাসপাতালে পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট ট্রেনি ছাত্রীর ধর্ষণ ও মৃত্যু নিয়ে সারা বাংলা এমনকি বাংলার বাইরে মানুষ প্রতিবাদে ফেটে পড়েন। এই প্রতিবাদের
১) একটা বড় অংশ সরকারের বিরুদ্ধে;
২) একটি অংশ নির্দিষ্টভাবে ওই ঘটনার বিরুদ্ধে ও হাসপাতালে নিরাপত্তা ব্যবস্থা সুদৃঢ় করার দাবিতে ও
৩) আরেকটি অংশ সমগ্র নারী জাতির নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ও চিন্তান্বিত।
কিন্তু এই তৃতীয় ধারাটি আন্দোলনের মূলধারা থেকে ক্রমশ বিলীয়মান। তাই একটু বিশেষ আলোচনার দাবি রাখে। কারণ, এই তৃতীয় ধারা ধর্ষণ সংস্কৃতির বিরুদ্ধে সোচ্চার; লিঙ্গ বৈষম্য বিলোপের দাবি করে, সাধারণভাবে সর্বত্র নারী নিগ্রহ ও তার বিরুদ্ধে নারীর নিরাপত্তার পক্ষে সোচ্চার। রাত দখল আন্দোলন তো শুধু ধর্ষিতা ও খুন হওয়া ডাক্তার ছাত্রীর জন্য নয়, মেয়েদের রাত দখল। কেন মেয়েরা একা রাত্রে বেরতে পারবে না, কেন মেয়ের জন্য বাড়ির মানুষকে দুশ্চিন্তায় থাকতে হবে 'এখনও কেন ফিরল না', কেন একটি মেয়েকে ভাবতে হবে, থাক আমি বার্থডে পার্টিতে যাব না, ফিরতে রাত হয়ে যাবে। এই লিঙ্গ বৈষম্যের বিরুদ্ধে মেয়েদের রাত দখল আন্দোলন। এটাই আন্দোলনের লক্ষ্য, তিলোত্তমা উপলক্ষ মাত্র। আমি এই তৃতীয় পক্ষে অঙ্গীভূত হতে চাইলেও শেষ অবধি পারলাম না। আর সেটাই আমার মানসিক যন্ত্রণা। এমন একটি প্রতিবাদে কোথাও সামিল হতে পারলাম না। এই যন্ত্রণা প্রকাশের ভাষা নেই।
'স্বাধীন স্বতন্ত্র' (বে)নামে একটি সংগঠন নিচের এই আবেদনটি প্রকাশ করেছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আগে সরকারের রোষানল থেকে আত্মরক্ষার জন্য এরকম বেনামে আত্মগোপন করতে হত। এখন উপর্যুপরি নির্বাচনে জনগণের প্রত্যাখ্যান আসার ফলে জনগণের থেকে আত্মগোপন করতে হচ্ছে নানাবিধ বেনামে:
#রাজপথে_নির্যাতিতার_পোশাক_প্রদর্শনী
''রাত' মেয়েদের জন্য সুরক্ষিত নয়। আজ প্রায় আড়াই মাস কেটে গেলেও সরকার নারীদের দাবি নিয়ে একটি কথাও বলেনি;
আমরা যারা যৌন হেনস্থার শিকার হয়েছি, ধর্ষিত হয়েছি বা ইভ-টিজ হয়েছি, তারা তাদের এলাকায় সেই বয়সের পোশাক টাঙিয়ে দিই, যে বয়সে আমরা নির্যাতিত হয়েছিলাম;
নবজাতক শিশু, কিশোরী, যুবতী, গর্ভবতী এবং প্রৌঢ়া সকলেই আমরা এই নির্যাতন এবং ধর্ষণের স্বীকার হয়েছি বারংবার;
সরকারকে বুঝিয়ে দিই, বাংলার ৫ কোটি মেয়েদের মধ্যে এমন কেউ নেই যে নির্যাতিত হয়নি। যাদের বয়স ৪ থেকে ৯০, যারা স্কুল ছাত্রী থেকে বৃদ্ধা;
প্রতিশ্রুতি নয় সমাধান চাই।'
অর্থাৎ বলা হচ্ছে, সকল নারীই ধর্ষিতা! প্রকারান্তরে সকল পুরুষই ধর্ষক!
সাধারণভাবে বলা হয়ে থাকে, All men are potential rapist-- এই কথার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে potential শব্দটি এখানে গুরুত্বপূর্ণ। যার অর্থ, All men have the potential to rape.। মানুষ তো মূলগত ভাবে এক জৈব সত্তা। তাই তার মধ্যে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি যৌন আকর্ষণ, যৌন চিন্তা, চেতনা কাজ করে থাকে। ধর্ষণ করার সামর্থ্য আছে। কিন্তু একই সাথে আবার মানুষ এক সামাজিক জীব। ফলে, তার একটা সামাজিক সত্তা আছে। সেই সামাজিক সত্তার মধ্যে সে মা কাকিমা দিদি বোন স্ত্রী ইত্যাকার নানা সম্পর্কে আবদ্ধ। নানাবিধ সামাজিক উচিত-অনুচিত, শোভন-অশোভন, ন্যায়-অন্যায় ইত্যাদি বোধ, রেওয়াজ, রীতি বিদ্যমান, সর্বোপরি একটা লজ্জা, ভয় কাজ করে। এই সামাজিক রেওয়াজ ও রীতিগুলি তাকে, তার জৈব সত্তাকে নিয়ন্ত্রণ করে, প্রবৃত্তি থেকে বিরত করে। নানাবিধ সম্পর্কগুলি তার জৈব সত্তাকে নিয়ন্ত্রণ করে। এর ফলে মূলগতভাবে মানুষ অ্যানিমেল হলেও অ্যানিম্যালিটি তার মধ্যে প্রাধান্য পায় না। কিন্তু সুপ্ত থাকে। মান্না দে'র গানে এই প্রবৃত্তির একটা নমনীয় রূপ বর্ণিত আছে:
'ও কেন এত সুন্দরী হল...
অমনি করে ফিরে তাকালে,
দেখে তো আমি মুগ্ধ হবই ....
ও কেন তখন হঠাৎ এমন এলোচুলে বাইরে এল...
দেখে তো আমি মুগ্ধ হবই
আমি তো মানুষ।'
কিন্তু এই মুগ্ধতা, প্রবৃত্তি এসব ছাড়াও একটা বাড়তি জিনিস, একটা নিয়ন্ত্রক, একটা সেন্সর কাজ করে। বিকৃত মানসিকতা বলতে বোঝায়, ওই সেন্সরটি যখন ঠিকমতো কাজ করে না। অধিক মাত্রায় উত্তেজক পানীয় সেবন করলে সেন্সরটি, মানে পাহারাদারটি ঝিমিয়ে পড়ে, ঠিকমতো কাজ করে না। আবার নিয়মিতভাবে উত্তেজক সেবন করার ফলে ধীরে ধীরে অকেজো, অচল হয়ে যায়, পাহারাদার সর্বদাই ঝিমোতে থাকে। এইভাবেই সেন্সরটি অচল ও বিকৃত হয়ে যায়। বেশ মনে আছে, শেষ দফার বামফ্রন্টের শাসনে অর্থমন্ত্রী দেদার দেশি-বিদেশি মদের দোকানের লাইসেন্স দিয়েছিলেন। এমনকি চাঁপদানিতে একটি নার্সারি স্কুলের পাশের প্লটে এফ এল অন শপ লাইসেন্স দিয়েছিলেন। এখন সেগুলোই বটবৃক্ষের ছায়া বিস্তার করেছে। যে কোনও স্পট থেকে মাত্র এক কিলোমিটারের মধ্যে দেশি-বিদেশি মদের দোকান পাওয়া যাবে। মদ্যপান করে গাড়ি চালানো নিষিদ্ধ থাকলেও, হাইওয়ের পাশেই দু' হাত অন্তর হাজার হাজার লাইসেন্স প্রাপ্ত পানশালা দেখতে পাবেন।
শুধু তো উত্তেজক পানীয় না, পরিবার বা পরিবেশে যদি ছোটবেলা থেকে কেউ সুন্দর সম্পর্ক না দেখে, তার কাছে উচিত অনুচিত বোধ তৈরি হয় না। শৈশব থেকেই যদি কেউ বাড়িতে যৌনাঙ্গ ও যৌন সম্পর্ক বিষয়ক আকছার কুকথা সর্বক্ষণ শুনতে থাকে, তখন তার বাচনের মধ্যে খিস্তি খেউড় অন্যায় বা অস্বাভাবিক বোধ হয় না। প্রসঙ্গত বলি, আমার প্রতিবেশী আমারই এক ছাত্রী তখন সম্ভবত ক্লাস টু'তে পড়ে। সে তার খাতার এক পৃষ্ঠায় অত্যন্ত কুরুচিকর গালিগালাজ লিখে ভর্তি করেছিল। আমি সেগুলো উচ্চারণ করতে পারব না, এমনকি আমার উপস্থিতিতে সেগুলো খুলে দেখাতে পারব না বলে পড়ানোর শেষে ছাত্রীর মাকে বলেছিলাম, 'বৌদি, মনে হয় মান্তুর কিছু সমস্যা হচ্ছে। একটু নজর দিয়ে খাতাটা দেখবেন। খুব খারাপ কথা লিখেছে, আপনি দেখলেই হবে। মারধর বকাবকি করবেন না।' পরদিন ওই ছাত্রীর পিসি হাসতে হাসতে আমাকে জানালো, 'ওইগুলি কোনও খারাপ কথা না। এইগুলি তো দাদা'রা হামেশাই কয়। তবে দিদিমণি, এইডা কিন্তু মানতেই হইব, বানান দ্যাহেন, একখানও ভুল লেখে নাই।' আর বৌদি জানালেন, 'বিয়ের পর প্রথম প্রথম এ বাড়ির কথাবার্তা শুনলে আমি লজ্জায় মুখ ঢাকতাম। মনে হত কান থেকে বুঝি রক্ত বেরিয়ে আসছে। এখন সবই সয়ে গেছে।' পরিবার পরিবেশে যা শুনছে, যা দেখছে, সেগুলোই মুখে বলছে ও কাজে করে দেখাচ্ছে।
অবাধ্য দুর্বিনীত কোনও পড়ুয়ার অভিভাবককে ডেকে পাঠিয়েছি। দুদিন পর হাজির হল সেই ছাত্রের দিদিমা। তিনি জানালেন, 'আমি বুড়ো মানুষ, আমাকে দয়া করে ডেকে পাঠাবেন না। যা করার আপনারাই করবেন।' শুনলাম, ওই শিশুর মা বিবাহ-অতিরিক্ত একটি সম্পর্কের কারণে সন্তানকে দু' বছর বয়সে ফেলে রেখে অন্যত্র গমন করেছেন। নিশ্চয়ই আমার নারীবাদ এই স্বাধীনতা অনুমোদন করে। তার বাবা এই সন্তানের কারণে আর বিয়ে করেননি। কিন্তু একটু দূরে চাকরি করেন, ফিরতে রাত হয়। জামাই খুব ভালোমানুষ। এ ধরনের সিঙ্গল পেরেন্ট চাইল্ড বা নো পেরেন্ট চাইল্ড'এর সংখ্যা ইদানীং সংখ্যায় বাড়ছে। এদের চোখে নারী-পুরুষের সম্পর্কগুলি কোন মানদন্ডে দেখা হয় ভাবুন তো। মোবাইল ও নেট দুনিয়ার দৌলতে স্মার্টফোনে নাবালক ভাই বোন ব্লু ফিল্ম দেখছে। আবার সেই ব্লু ফিল্মকে নিজেরা অনুশীলন করছে। তারপর বাড়িতে জানাজানি হবে সেই ভয়ে নাবালক ভাই নাবালক বোনের গলায় ছুরি চালাচ্ছে।
আসলে আমি বলতে চাইছি, ধর্ষণ একটি সামাজিক ব্যাধি। একটি মানসিক বিকৃতি। সেই বিকৃতির হাত ধরে এসেছে ধর্ষণ। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ব্যক্তি নাগরিকের ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অধিকার। আপনি গণতান্ত্রিক সমাজে বলতে পারেন না, নাইট ক্লাব থাকবে না, আপনি গণতান্ত্রিক সমাজে বলতে পারবেন না, রাত্রে হোটেল বারে মহিলাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ, এটা ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের প্রশ্ন। সেই কারণেই আপনি বলতে পারেন না, মেয়েদের নাইট ডিউটি দেওয়া যাবে না। সেই কারণেই আমরা বলতে পারি না, 'মেয়ে মানুষ' লেট নাইট পার্টি করে বাড়ি ফিরবে না। এটা সমানাধিকারের প্রশ্ন, আমি এই অধিকারের প্রশ্নে একমত।
কিন্তু স্মরণে রাখবেন, বেশ কিছু ক্ষেত্রেই এই সমানাধিকারের মধ্যেও কিছু বিশেষ অধিকার রাখতে হয়। ধরুন, কর্মস্থলে মেটারনিটি লিভ তো রাখতে হয়, সমাজের স্বার্থে। বাসে লেডিজ সিট, ট্রেনে সংরক্ষিত লেডিজ কম্পার্টমেন্ট, এসবের তো প্রয়োজন আছে। অফিসে, সিনেমা হলে, শপিং মলে পৃথক লেডিজ টয়লেট প্রয়োজন হয় না? এগুলোকে অস্বীকার করব কীভাবে? আমার দৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন নারীর অধিকারের প্রশ্নে খুবই যুক্তিপূর্ণ ও বাস্তব সম্মত। তাঁর অধিকার চিন্তায় একটা পরিমিতি বোধ লক্ষ করা যায়। তিনি লিখেছিলেন, 'মেয়েদের শরীরের এবং মনের প্রকৃতি পুরুষের হইতে স্বতন্ত্র বলিয়াই তাহাদের ব্যবহারের ক্ষেত্র স্বভাবতই স্বতন্ত্র হইয়াছে। আজকাল বিদ্রোহের ঝোঁকে একদল মেয়ে এই গোড়াকার কথাটাকেই অস্বীকার করিতেছেন।'
ধরা যাক একজন নারী নাইট ক্লাব বা বারে সিংগার অথবা ড্যান্সার। তিনি ডিউটি শেষে আকন্ঠ মদ্যপান করে রাত্রি দুটোয় বাড়ি ফিরছেন। এ পর্যন্ত কিছু সমস্যা নেই। কিন্তু সেই নারীর নিজস্ব কোনও বাহন নেই, এখানেই সমস্যা শুরু। তিনি লিফট চাইলেন অন্যের গাড়িতে, পেলেন। সেই গাড়িতে চার যুবক তারাও মদ্যপ। আকন্ঠ মদ্যপান করে আছে। এবার বলুন, ওই নারী গাড়িতে ওঠার পর কি তাঁকে মাতৃজ্ঞানে ও ভগ্নীজ্ঞানে তাঁর ঠিকানায় সুযোগ-সন্ধানী মাতালরা পৌঁছে দেবে? এখানেই এসে পড়ে সূচনায় উল্লিখিত মন্তব্যটি -- 'All men have the potential to rape.'। কিন্তু তার মানেই সবাই রেপিস্ট নয়। কিন্তু বিশেষ বিশেষ কতকগুলো শর্ত যখন তার হিতাহিত জ্ঞান, কাণ্ডজ্ঞান, উচিত অনুচিত বোধ নষ্ট করে দেয়, তখন সে একজন রেপিস্ট হতে পারে। নানান কারণে এই সেন্সরটি বিকল হতে পারে। তার কয়েকটি উল্লেখ করেছি মাত্র। এই ঘৃণ্য সামাজিক অপরাধটি যে সমস্ত কারণ থেকে উদ্ভূত তার অধিকাংশই আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই, নিয়ন্ত্রণে থাকে না। কিন্তু কিছু বিষয় আছে আমাদের নিয়ন্ত্রণে।
আমি যেন কোনওমতেই প্ররোচনার কারণ না হই। কদিন আগেই মমতাশঙ্কর এরকম একটি কথা বলার কারণে যথেষ্ট ট্রোলড ও সমালোচিত হয়েছেন। এমনকি কেউ কেউ পাল্টা উস্কানিমূলক মন্তব্য ও ছবি ছেপেছেন। সেটা যার যার ভিন্ন রুচি। ভগবান বুদ্ধ গভীর ধ্যানে মগ্ন থাকবেন, তার চারপাশে যতই তাকে প্ররোচনা দেওয়া হোক, এটা একটা আইডিয়াল কনসেপ্ট। ঠিক তেমনি, কেন রাত্রি দুটোয় একজন মেয়ে রাস্তায় নিরাপদ থাকবে না? রাত্রি দুটোয় শুধু তো একজন মেয়ে নয়, আমরা কেউই নিরাপদ নই। ছেলে হলে তার সর্বস্ব ছিনতাই হতে পারে। বাধা দিলে প্রাণটিও। আর মেয়ে হলে যথাসর্বস্ব, প্রাণ ও সেই সাথে তার আব্রু ইমান। রাস্তার কুকুরও বেশি রাতে আপনাকে রাস্তায় অনুমতি দেয় না। আপনি বলবেন, রাতে কেন পর্যাপ্ত পরিমাণ পুলিশ পেট্রোলিং থাকবে না? গাড়ি থামিয়ে কেন চেক করা হবে না, মদ্যপ কিনা, গাড়িতে কারা যাচ্ছে, ভেতরে কী হচ্ছে, এটা নজরদারি করা দরকার। না, সেটাও হবে না। নীতি পুলিশি? ব্যক্তিগত পরিসরে নাক গলানো? তদুপরি এত রাস্তা, এত অলিগলি, এত এত গাড়ি, পেট্রোলিং করে এই নজরদারি সম্ভব? তার চেয়ে ভালো হয় না যে, রাত্রি দশটা বা এগারোটার পর বার বন্ধ হয়ে যাবে, নাইট ক্লাব বন্ধ হবে। জানি, এই প্রস্তাবে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদ, নাগরিক অধিকার হৈ হৈ করে উঠবে।
বাস্তবিক, আমরা কেউ কি নিরাপদ? যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বপ্নদীপ, সে কি সুরক্ষিত ছিল? সেটা ছিল ২০২৩'এর ৯ অগস্ট। তার ওপর যা হয়েছে, তাকে নগ্ন করে তাকে দিয়ে যা যা বলানো ও করানো হয়েছে, এমন কি প্রতিষ্ঠা দিবসের নামে পিতা-মাতার দৈহিক মিলনের দিনটি পর্যন্ত তাকে দিয়ে উচ্চারণ করানো হয়েছে। এটা কি যৌনপীড়ন নয়? শোনা যায় এই সমস্ত পীড়নে সিনিয়র দাদাদের সাথে সিনিয়র দিদিরাও থাকে, মজা উপভোগ করে। আর অনিতা দেওয়ান'এর ধর্ষণের কথাটা উচ্চারিত হয় একটি বিশেষ কারণে; ওই ঘটনার পর মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু বলেছিলেন, এ তো হতেই পারে।
অথচ কেতুগ্রামে একটি বাড়িতে ডাকাত পড়েছিল। সংবাদপত্রেই পড়েছি, ডাকাতরা সেই বাড়ির সর্বস্ব টাকা পয়সা গয়না লুঠ করে। তখন বাড়ির মেয়েটি ডাকাত সর্দারের পায়ে ধরে বলে, জেঠু, আমার বিয়ের জন্য সংগ্রহ করা এইটুকুই ছিল শেষ সম্বল। এগুলো তুমি নিয়ে গেলে আমার আর বিয়ে হবে না। তোমরা বরং আমাকেও মেরে রেখে যাও। সংবাদে প্রকাশ, এরপর ডাকাত সর্দার সমস্ত সোনা দানা অর্থ ফেরত দিয়েছিল। বাড়ির সবাইকে ছেড়ে দিয়েছিল। এমনকি কিছু অতিরিক্ত টাকা-পয়সাও তাদের দিয়ে গিয়েছিল। কথা দিয়েছিল বিয়ের দিন আশীর্বাদ করতে আসবে। বোঝা যায়, অনেক ক্ষেত্রেই সেন্সর নষ্ট হয়ে যায়নি। লুঠপাটের সঙ্গে অতিরিক্ত প্রাপ্তি ধর্ষণের সুযোগ তারা কিন্তু নেয়নি।
আমার মনে হয়, সমস্যাটা নারীর অধিকার, পুরুষতন্ত্র এসব নয়। সমস্যাটা হল ভেতরের মানুষটা, তাকে তো আগে মানুষ হতে হবে, তারপর সে নারী বা পুরুষ, চোর বা পুলিশ, সাধু অথবা ডাকাত ইত্যাদি। এনআরএস মেডিকেল কলেজে ছাত্ররা যখন আধপাগল কোরপান শাহকে ধরে হোস্টেলে এনে গণ পিটুনি দিয়ে হত্যা করে, তখন তাদের পরিচয় ডাক্তার নয়, অমানুষ। তিলোত্তমার ধর্ষক তেমনি সিভিক পুলিশ নয়, একজন অমানুষ।
কী চোখে দেখি, প্রশ্নটা এইখানে। খুব তৃপ্তির সঙ্গে স্মরণ করছি, বছর দশ আগের একটি ঘটনা। এপিডিআর'এর এক সভায় আমার এক দাদা স্থানীয় মানবাধিকার কর্মীকে বলেছিলাম, 'কত দিন পরে দেখা। তোমাকে দেখতে খুব ভালো লাগছে।' সেই দাদা শুনে মুচকি হাসল। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অন্য এক মানবাধিকার কর্মী দাদাকে বলল, 'তুমি কেমন আশ্চর্য মানুষ গো! মালবিকার মতো একজন ভদ্রমহিলা তোমাকে সুন্দর বলছে, আর তুমি একটুও কোনও প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে রামগরুড়ের ছানা?' সেই দাদা বলেছিল, 'আমি মালবিকাকে একজন মেয়ে হিসেবে দেখি না, দেখি বোন হিসেবে। আর ও আমাকে পুরুষ হিসেবে নয়, দাদা হিসেবেই দেখে।' এই কমপ্লিমেন্ট আমি কোনওদিন ভুলব না। আর দৃষ্টিভঙ্গির সমস্যা যদি সামাজিক সমস্যা হয়, তাহলে আপনি নিশ্চিত জানবেন, দাদা কাকা দাদু এদের কাছে যেমন চার বছরের শিশুকন্যাটি নিরাপদ নয়, ইচ্ছাকৃত ভাবেই তাদের এখানে সেখানে স্পর্শ করা হয়, ঠিক তেমনি দিদি মা কাকিমা ঠাকুমার হাতেও চার বছরের শিশু পুত্রটিও খুব নিরাপদ নয়। শ্রীকৃষ্ণ বিষয়ক একটি টিভি সিরিয়ালের একটি এপিসোড একদিন হঠাৎই চোখে পড়ে যায়। দেখি, খুব ছোটবেলায় কৃষ্ণকে মানে গোপালকে নিয়ে পাড়ার কাকিমা পিসিমা দিদি মামীমা'দের অদ্ভুত ধরনের আদর করার হিড়িক ও চোখে পড়ার মতো কিছু কার্যকলাপ। দেখে বুঝেছিলাম, শৈশবে যার এই ধরনের অভিজ্ঞতা, সে তো পুকুর পাড়ে অন্যদের বস্ত্রহরণ করবেই। পাড়ায় বা কোনও কলেজে একটু গোবেচারা শান্তশিষ্ট ছেলেকে নিয়ে মেয়েরা কেমন আলোচনা ও খোরাক তৈরি করে সে অভিজ্ঞতাও অনেকের আছে। আসলে ওই যে একটা ম্যাচো ফিগার, উন্মুক্ত সারা গায়ে লিপস্টিকের দাগ, চুম্বনের লক্ষণ বহন-- এসব তো বিপরীতমুখী ধর্ষণের ভাষ্য নির্মাণের চেষ্টা। আজকাল সিনেমায় যেমন অপ্রয়োজনে, জোর করে গালাগালি খিস্তি সংলাপের মধ্যে ব্যবহার করা হয়। আবার মহিলা চরিত্রকে দিয়ে সেগুলো বেশি উচ্চারণ করানো যেন একটা দ্বিগুণ সার্থকতা।
কিন্তু এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল ধর্ষণের রাজনৈতিক ও দার্শনিক ভিত্তি। এটা আমার চোখে সবচেয়ে বেশি উদ্বেগজনক। কারণ, এই রাজনীতি ও রাজনৈতিক দর্শন নারী ধর্ষণকে একটা বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করে। ধর্ষণকারীকে বীর নায়ক সাজানো হয়। সেই ধর্ষক নায়ককে গলায় মালা পরানো, তাকে মিষ্টি মুখ করানো, বরণ করা হয়। ভি ডি সাভারকার লিখেছেন, আমরা গর্বের সঙ্গে ছত্রপতি শিবাজী এবং চিমজি আপ্পার উল্লেখ করি যে, তারা যুদ্ধ জয়লাভের পরেও সসম্মানে কল্যাণের মুসলমান শাসনকর্তার গৃহবধূ এবং বেসিনের পর্তুগীজ শাসনকর্তার স্ত্রীকে ফেরত পাঠিয়েছিলেন। সাভারকার বিস্মিত হয়ে মন্তব্য করছেন, শিবাজী মহারাজ বা চিমজী আপ্পা কি করে ভুলে গেলেন, গজনির মাহমুদ, মোহাম্মদ ঘোরি, আলাউদ্দিন খিলজী এই সমস্ত মুসলমান শাসকদের কথা, যারা হাজার হাজার হিন্দু নারীর উপর শারীরিক অত্যাচার ও পীড়ন করেছেন ইত্যাদি ইত্যাদি। তাঁর বক্তব্যে উহ্য এই অভিযোগ যে, কেন শিবাজী বা চিমজি মুসলিম নারীদের ধর্ষণ না করে ছেড়ে দিলেন।
বিজেপি, আরএসএস'এর রাজনৈতিক কর্মসূচি, দৃষ্টিভঙ্গি ও দর্শনে বিধর্মীর ওপর, বিশেষভাবে মুসলিম মহিলার উপর ধর্ষণ ও হত্যা একটি স্বীকৃত ঘোষিত নীতি। এই কারণেই গুজরাত দাঙ্গায় বিলকিস বানো'র পরিবারের সকলের হত্যাকারী ও ধর্ষক দশজন যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত অপরাধী গুজরাত সরকারের নির্দেশে মুক্তি লাভ করে। পার্টি তখন তাদের মিষ্টিমুখ করিয়ে, ফুলের মালা পরিয়ে বরণ করে নেয়। একইভাবে সাংসদ ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে দেশের অলিম্পিক পদকজয়ী সোনার মেয়েরা যখন শ্লীলতাহানির অভিযোগ করে, তারপরেও কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। এমনকি ব্রিজভূষণ প্রধানমন্ত্রীর পাশে সংসদে উপবিষ্ট থাকেন। বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটির ছাত্রী গণধর্ষিতা হলে ধর্ষণকারী ছাত্রদের পুলিশ গ্রেফতার করতে পারে না। কারণ, অভিযুক্ত ছাত্রদের পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল মধ্যপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারে। তারপর যদি বা দু' মাস পর তাদের গ্রেফতার করা হল, সাত মাসের মধ্যে জামিনে মুক্ত হয়ে গেল। কারণ, ওই অভিযুক্তরা বিজেপির আইটি সেলের নেতা। একই কথা বলা চলে মণিপুরের ক্ষেত্রে। সেই রাজ্যে এক বছরের বেশি সময় ধরে চলেছে জাতি দাঙ্গা। ৩৭টির বেশি ধর্ষণের ঘটনা এফআইআর হয়েছে। এফআইআর না হওয়া ঘটনার সংখ্যা অজস্র। মহিলাদের সেখানে নগ্ন করে প্রকাশ্যে প্যারেড করানো হয়েছে, সে সব ভিডিও ভাইরাল হয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, নারী সুরক্ষা এই সমস্ত প্রশ্নে আমার কাছে প্রধান হল,
১) উল্লিখিত রাজনৈতিক ও দার্শনিক ভিত্তি। এটা শুধুমাত্র নারী ধর্ষণ ও নারী পীড়ন ঘটায় না, ঘটনাকে দার্শনিক বৈধতা দেয়। অতএব, তা সবচেয়ে বেশি বিপদজনক। একে যে কোনও মূল্যে প্রতিহত করা প্রয়োজন। এটা প্রতিহত না হলে সামাজিক আন্দোলন এগোতে পারবে না;
২) নারী সুরক্ষা ও নিরাপত্তার যাবতীয় বন্দোবস্ত ও সেই সংক্রান্ত প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিশ্চয়ই সমর্থনযোগ্য ও আশু প্রয়োজন;
৩) নারী সম্পর্কে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন ঘটানো। অর্থাৎ, গোড়া থেকে সমস্যায় নাড়া দেওয়া চাই। এর জন্য এক দীর্ঘস্থায়ী জীবন দর্শন, মনোভাব, সংস্কৃতি গড়ে তোলা দরকার। ওটা সরকারের কাছে জবাব চাওয়ার বিষয় নয়।
'কে তুমি নন্দিনী আগে তো দেখিনি' যদি বিনোদন হয়, তাহলে আঁচল ধরে টান পড়বে, অর্থবান সুপুত্তুর টেনে গাড়িতে তুলবে, ফার্ম হাউসেও নিয়ে যাবে। একদম গোড়াতেই এর বিনাশ দরকার। হুগলি ডিএম'স রিক্রিয়েশন ক্লাবের বাৎসরিক অনুষ্ঠানে উদ্বোধনী সঙ্গীত ছিল 'জীবনে কি পাব না, ভুলেছি সে ভাবনা'। সেটা ২০০৪-০৫ সালের কথা। সঙ্গে অবশ্য নাটক ছিল 'ফেরারী ফৌজ'। ক্যাবারে থাকবে, বার থাকবে, দ্রোহের নাটক থাকবে আর মাতাল লিঙ্গ সাম্যে আস্থাবান হবে, এটা অতি কাল্পনিক। তবুও আমি মানুষের সুবুদ্ধির উপরেই আজও আস্থাবান। ১৪০ কোটির দেশে অন্তত একজন তো বলেছিল, মালবিকাকে আমি মহিলা হিসেবে দেখি না, ও আমার বোন। এইটুকুই আমার কাছে আশাব্যঞ্জক। এই পথেই তাই ক্রমমুক্তির আশ্বাস।