Monday, 20 January 2025

ন্যায়বিচার চাই, না ক্যাঙারু কোর্ট?

অপরাধী সঞ্জয় রায় কি 

ঘোলাজলে সুবিধা পেয়ে যাচ্ছে?

মালবিকা মিত্র



২০ জানুয়ারি ভরা এজলাসে সিবিআই ও নির্যাতিতার পরিবারের আইনজীবীদের ফাঁসির দাবিকে অগ্রাহ্য করে শিয়ালদহ আদালতের বিচারপতি দোষী সঞ্জয় রায়কে আমৃত্যু কারাবাসের সাজা দিয়েছেন। বিচারপতি জানিয়েছেন, তাঁর কাছে সঞ্জয় রায়ের অপরাধ 'বিরলের মধ্যে বিরলতম' বলে মনে হয়নি। কেন? এই প্রশ্ন উঠবে। বলাই বাহুল্য, তিলোত্তমার ধর্ষণ ও খুনের তদন্ত, তার বিচার প্রক্রিয়া এবং অবশেষে শাস্তি প্রদান নিয়ে কেউ কেউ সন্দিহান ও ক্ষুব্ধ। খবরে প্রকাশ, এইসব বিষয়ে ২২ জানুয়ারি ও ৫ ফেব্রুয়ারি যথাক্রমে সুপ্রিম কোর্ট ও কলকাতা হাইকোর্টে শুনানিরও সম্ভাবনা আছে। খুব স্বাভাবিক যে, নানাজনের নানা মতের মতোই এই নৃশংস ঘটনাটির ক্ষেত্রেও লোকজনের নানারকম পর্যবেক্ষণ, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও বোধ ভিত্তিক মতামত সমাজ পরিসরে গত ৫-৬ মাস ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এর মধ্যে যেমন বড় বড় সব মিথ্যাচার ও গুজব আছে, আবার কিছু কিছু প্রশ্নের যাথার্থ্যও আছে। 

গত ১৮ জানুয়ারি শিয়ালদহ আদালতে সঞ্জয় রায়কে দোষী হিসেবে সাব্যস্ত করার পর পরিচিতজনদের কাছ থেকে কয়েকটা মেসেজ পেলাম। সেগুলো উল্লেখ করেই কথা শুরু করি-- 

১) বিচার আমাদের দেশে হতে দেখেছেন?  বিজেপি তো বলেই দিয়েছিল এজেন্ডা রামমন্দির বানানো। পাবলিক তো তাতেই ভোট দিল। আর টিএমসি? টিএমসি বিজেপির ভালবাসা (সেটিং)? মোদী হচ্ছে মমতার রক্ষক। দুটোই বজ্জাত। তাই এসব আদালতের রায়ে কোনও ভরসা নেই; 

২) বিচার আর বিশেষ কী হবে? মোদি-মমতা সেটিং। সিবিআই কলকাতা পুলিশের ঢেকুর তুলছে। অধিকাংশ তথ্যপ্রমাণ লোপাট হয়ে গেছে। দায়িত্ব নেওয়ার আগে কলকাতা পুলিশ পাঁচদিন সময় পেয়েছে। কলকাতা পুলিশ তার ভেতরে সব সেরে ফেলেছে। এখন সঞ্জয় বলির পাঁঠা। ও আর একটা ধনঞ্জয়। পেছনের পর্দার আড়ালের কারিগররা অধরাই থেকে যাবে। হাওয়াই চটি আর সাদা শাড়ির আড়ালে সবাই সাদা; 

৩) ভদ্রলোকের এক কথা। একবার বলে দিয়েছি, সঞ্জয় রায়কে আরজিকর কাণ্ডে দোষী মানি না। ব্যাস। এক কথা। বলে দিয়েছি গণধর্ষণ। ব্যাস। যা বলেছি, বলে দিয়েছি। এখন সুপ্রিম কোর্ট বললেও মানবো না। অপরাধী একমাত্র বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার, নিতান্ত কোনও মন্ত্রীর ঘর থেকেই বেরতে হবে। 

প্রতিক্রিয়াগুলো প্রাপ্তির অপেক্ষা করছিলাম। প্রথম দুটি প্রতিক্রিয়া আমার একদা ট্রেন পথের সহযাত্রী একজন শিক্ষিকা এবং আর একজন সরকারি কর্মচারী আর তৃতীয় প্রতিক্রিয়াটি আমার ছাত্রের। ও সাংবাদিক হিসেবে বেশ সুনাম করেছে। 

সংবাদপত্রের প্রথম পৃষ্ঠায় দেখলাম, আগের দিনও সমাজ মাধ্যমে দেখেছিলাম, অভয়ার বাবার উক্তি, 'ভরসা রেখেছিলাম, পূর্ণ মর্যাদা দিয়েছেন', তিনি আদালতে দাঁড়িয়ে ১৮ জানুয়ারি  বিচারপতিকে বলেছেন। অবশ্য ইনি আগে একাধিকবার সিবিআই'এর তদন্ত প্রক্রিয়ায় আস্থা রাখতে পারেননি বলে জানিয়েছিলেন। অমিত শাহ'র সঙ্গেও দেখা করতে চেয়েছিলেন। সুপ্রিম কোর্টে ভরসা রাখতে পারেননি। 

এ ক্ষেত্রে মৃতার পরিবারকে প্রথমেই আলোচনার বাইরে রাখা উচিত। কারণ, এই ধরনের পরিস্থিতিতে বহু মানুষ উপদেশ দেয়। অমুক ডাক্তার ভালো, অমুক ডাক্তার খারাপ; কী সর্বনাশ, এ তো আমার ননদের ছেলেকে প্রায় প্রাণে মেরে ফেলেছিল! ডাক্তার পাল্টাও, একবার পীরের থানে গিয়ে দেখতে পারো, একটু আয়ুর্বেদ করাও। অর্থাৎ, পরিবারে যখন কারও দুরারোগ্য ব্যাধির সম্ভাবনা দেখা দেয় এবং চিকিৎসায় বিশেষ ফল হচ্ছে না, তখন অজস্র মতামত পরিবারকে চালিত করে। এ ক্ষেত্রে তাই হচ্ছে, এক কথায় তাঁরা প্রতারিত। কখনও বিকাশবাবুকে পরিত্রাতা ভাবছেন, আবার পরক্ষণে বিকাশবাবুকে ছেড়ে বৃন্দা গ্রোভারকে ধরেছেন এবং শেষে তাঁকেও ছেড়েছেন। ভিকটিমের পরিবারের এ হেন আচরণ সমালোচনার ঊর্ধ্বে। কিন্তু প্রশ্নটা হল, আশেপাশে যাঁরা সহানুভূতির মুখোশ পরে কথা বলছেন, মতামত দিচ্ছেন, তাঁরা গোল বাঁধাচ্ছেন। 

প্রসঙ্গত বলে রাখি, সিবিআই'এর প্রথম চার্জশিটের প্রেক্ষিতেই ১৮ই জানুয়ারির এই রায়দান। সিবিআই তার সাপ্লিমেন্টারি চার্জশিট এখন পর্যন্ত দেয়নি। জানি না এর পরেও তা দেওয়ার সুযোগ আইনে থাকে কিনা। সিবিআই নিজে কিন্তু জানিয়েছে তথ্য প্রমাণ লোপাটের কথা। অতএব, এই মামলায় রায় হলেও উচ্চ আদালতে গিয়ে দোষী সাব্যস্ত সঞ্জয় রায় কিন্তু শুরু থেকেই একটি মোক্ষম অস্ত্র নিয়ে প্রবেশ করবে। তা হল, তথ্যপ্রমাণ লোপাট হয়েছে। তাহলে সে ক্ষেত্রে সত্যতা, যথার্থতা যাচাই হবে কীভাবে? অতএব উচ্চ আদালতে সঞ্জয়ের শাস্তি লঘু হবার সম্ভাবনা সিবিআই করে রেখেছে।

আমার প্রশ্নটা অন্যত্র। বহুদিন যাবৎ শুনে এসেছিলাম, 'তথ্য প্রমাণ লোপাটের চেষ্টা' শব্দটি। এই চেষ্টার কারণে সাজার কথাও শুনেছি। অর্থাৎ, তথ্য প্রমাণ আছে, পাওয়া গেছে। সেগুলো লোপাট করার চেষ্টা করা হয়েছিল। এখন অভয়া মামলায় নতুন শব্দটা শুনলাম 'তথ্য প্রমাণ লোপাট হয়েছে'। কী তথ্য প্রমাণ? সেটা কারও জানা নেই, কারণ সেটা তো লোপাট। এই যে একটা ধরে নেওয়া তথ্য প্রমাণ, যা কারও জানা নেই এবং সেটা লোপাট হয়ে গেছে, এটা শুনে আমার কাছে ছেলেমানুষী যুক্তি মনে হয়েছে।

ঘুম ভেঙ্গে বাচ্চার বায়না, আমার পাতাতি'টা কোথায় গেল? বাড়ির লোক বোঝে না, পাতাতি, সেটা কী? বাচ্চা কী বলে? ওই যে সেই তা। আমার ছিল পাতাতিটা কোথায় গেল? বড়রা এটা সেটা এনে দেখায়, এইটা? ওইটা? কোনটা? আমার পাতাতিটা। কথা হল, পাতাতি বস্তুটা কী? এটা তো আগে জানতে হবে। যদি সেটাই জানা না থাকে, তাহলে কোথায় গেল, লোপাট হল কীভাবে, কে লোপাট করল জানব কীভাবে? তথ্য প্রমাণ যেহেতু লোপাট হয়ে গেছে, অতএব ওটা আর জানা সম্ভব না। এ যেন সার্জিক্যাল স্ট্রাইক। এত নিপুণ নিখুঁত যে শত্রুপক্ষ টের পায়নি, গাছপালা পাহাড় নদী পশুপাখি কেউ টের পায়নি, অপারেশন হয়ে গেছে। কেউ জানে না শুধু কর্তামশাই জানেন, হইছে হইছে জানতি পারো নাই। তার কোনও চিহ্ন কোথাও পড়ে নেই। 

সিবিআই'এর বিরুদ্ধে অভিযোগ! সেটার মানে বুঝতে পারি। সেই যদি কলকাতা পুলিশের তদন্তের ন্যায্যতাই স্বীকৃত হয়, তাহলে সিবিআই চেয়ে লাভ কী হল? লক্ষ্যটা ছিল কলকাতা পুলিশ দোষীদের আড়াল করছে, এটা প্রতিষ্ঠা করা। তাই সিবিআই। সেই সিবিআই বিস্তর ক্রস-চেকিং করে এখন কলকাতা পুলিশের তদন্তকেই যথার্থ বলে গ্রহণ করেছে। সমস্যা হল, অভয়ার বিচারের নামে যারা হইচই চেয়েছেন তাদের কাছে এটা মেনে নেওয়া খুবই অসুবিধাজনক। কতবার কত ভাগে লালবাজার অভিযান হল। বিনীত গোয়েলকে শিরদাঁড়া উপহার দেওয়া হল। এখন সিবিআই তদন্তকে মেনে নেওয়া হলে কলকাতা পুলিশকেই মেনে নেওয়া হয়। মানে হাওয়াই চটিকে মেনে নেওয়া হয়। তাহলে 'চটিচাটা' শব্দটা বসবে কোথায়? নতুন শব্দ আসবে 'থুতুচাটা'।

আমার বেশ মজাই লেগেছে। ধরুন, ডাক্তারবাবু ফুসফুসের সংক্রমণ দেখেছেন এবং কিছুটা ফ্লুইড জমেছে; সেই ফ্লুইড বিপজ্জনক কিনা পরীক্ষা করানোর জন্য দুটি ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হল। দুটি ল্যাবের রিপোর্টই নির্দোষ বলে ঘোষণা করল। রোগীর বাড়ির লোকেদের প্রতিক্রিয়া, তাহলে এসব পরীক্ষা করে কী লাভ হল, খালি খালি দু' জায়গায় পয়সা খরচ। ব্যাপারটা যেন, একটা জটিল প্রাণঘাতী রোগের তথ্য ধরা পড়লে পয়সাটা সার্থক হত। ক্রস-চেক তো পরীক্ষার রিপোর্ট নির্ভুল করার জন্য করা হয়। যদি ক্রস-চেকের উদ্দেশ্যই হয় ক্যানসার ধরা, তাহলেই সমস্যা। 

পাঁচ দিন বাদে সিবিআইকে হস্তান্তর, এটা নাকি খুব বিলম্বিত। ততদিনে কলকাতা পুলিশ তথ্য প্রমাণ লোপাট করে ফেলেছে। তা আমার প্রশ্ন, কবে কোথায় ঘটনার প্রথম দিনে প্রথম ঘণ্টায় সিবিআই দায়িত্ব নিয়েছে? যে কোনও ঘটনায় ফার্স্ট ইনফরমেশন রেকর্ডেড হয় তো লোকাল থানায়। তাহলে তো রাজ্যের পুলিশি ব্যবস্থাটা তুলে দেওয়া উচিত। কারণ, সিবিআই'কে প্রথম ঘন্টায় প্রথম মিনিটেই দায়িত্ব দিতে হবে। সিবিআই নিজের দুর্বলতা ও অপদার্থতা ঢাকতে এই সূত্রটিকে কাজে লাগায়, তথ্য প্রমাণ লোপাট হয়ে গেছে। তাই যদি হয়, দায়িত্ব না নিলেই পারেন। এ তো সেই ডাক্তার, আগেই বলে রাখেন, বড় দেরি করে এনেছেন, রোগীকে প্রায় মেরে এনেছেন। এসব বলে নিজের সম্ভাব্য ব্যর্থতাকে আগেই সেফগার্ড দেওয়া।

এর সঙ্গে বলতে হয় সেটিং তত্ত্ব। ধরেই নিলাম, যারা প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন তাদের সেটিং তত্ত্ব সঠিক। এই তত্ত্বটা ২০১৪ নির্বাচন থেকেই শুরু হয়েছিল। আর প্রবলভাবে দেখা দিয়েছিল ২০১৯, ২০২১, ২০২৪ সালে। সেটিং তত্ত্বের প্রবক্তাদের বলি, পশ্চিমবাংলায় ধরে নিলাম বিজেপি এবং তৃণমূলের সেটিং আছে। তাহলে তো এ কথাও মানতে হয়, পশ্চিমবাংলার ৮০/ ৯০ শতাংশ জনমত এই সেটিং'এ প্রভাবিত। বিরোধী কংগ্রেস, বাম ও অতি বামদের সম্মিলিত জনসমর্থন ১০ শতাংশেরও কম। ১০ শতাংশের বিরুদ্ধে ৯০ শতাংশের সেটিং? একবার ভেবে বলবেন। ২০১৬ সালেও কংগ্রেস ও বামেরা প্রায় ৩৪ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। সেই ভোটটা নেমে ৪ থেকে ৬ শতাংশ হল কীভাবে? আর বিজেপির ভোটটা ১০/১২ শতাংশ থেকে ৩৬/৩৮ শতাংশ বাড়ল কী করে? কার সাথে কার সেটিং হল? 

নির্বাচনের ফলাফল থেকে শুরু করে আরজিকর কাণ্ড, আনিস থেকে সন্দেশখালি-- সর্বত্র কল্পনার পোলাওয়ে ঘি ঢেলেছেন। ঘি'এর কোনও মাপ থাকেনি। এখন বাস্তবে পোলাওয়ের অস্তিত্ব না দেখে সেটিং বলা ছাড়া আর কী উপায় থাকতে পারে। ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডে ভাবের ঘরে এত কাহিনির জন্ম হয়ে গেছে যে সেই ভাব বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে, এক বিরাট স্বপ্নভঙ্গ ও হতাশা। এই স্বপ্নভঙ্গ-হতাশার ব্যাখ্যা একমাত্র সেটিং ও তথ্য প্রমাণ লোপাট তত্ত্বের মধ্যেই আশ্রয় খুঁজবে, এটাই স্বাভাবিক।

সঞ্জয় রায়কে যে ১১টি অকাট্য প্রমাণ হাজির করে সিবিআই অভিযুক্ত সাব্যস্ত করে চার্জশিট দিয়েছে, সেগুলো এখন পর্যন্ত কেউ খণ্ডন করেননি। এবার অভয়া মঞ্চের দাবি হিসেবে আমি মেনে নিচ্ছি যে, নেপথ্যে আরও অনেকের হাত আছে এবং তথ্য প্রমাণ লোপাট হয়েছে। কিন্তু হাওয়ায় ভাসানো এই কথা পথসভায় দাঁড়িয়ে মাইক্রোফোন হাতে বলা যায়, আদালতে বলতে গেলে, কারা এর পেছনে আছে, কারা লোপাট করেছে, কীভাবে করেছে, হলফনামা দিয়ে বলতে হবে। তা না হলে সংবাদ মাধ্যমের সান্ধ্য মজলিসে বাজার গরম করা ছাড়া কাজের কাজ কিছুই এগোবে না। যারা এত জোর দিয়ে বলছেন আরও অনেকে যুক্ত আছে, তারা একবার নামগুলো বলছেন না কেন সিবিআই'এর কাছে বা আদালতে দাঁড়িয়ে! 

এখনও যুক্তি হিসেবে সেই সুবর্ণ গোস্বামীর 'দেড়শো গ্রাম বীর্য' কখনও একজন ধর্ষকের উপস্থিতি প্রমাণ করে না। কিন্তু কথা হল, দেড়শো গ্রামের তত্ত্বটাই তো ভুয়ো। এর ফলে অভয়ার বিচার প্রক্রিয়া মসৃণ ভাবে অগ্রসর তো হবেই না বরং অপ্রমাণযোগ্য কিছু যুক্তি এনে বিচার প্রক্রিয়াকে ধোঁয়াটে করে দেওয়া হবে। অভয়া মঞ্চের জাস্টিস'এর দাবিদারদের কাছে তাই সবিনয় নিবেদন, আপনাদের কাছে যা তথ্য আছে সেগুলি অনুগ্রহপূর্বক আদালতে পেশ করুন। ডোরিনা ক্রসিংয়ে দাঁড়িয়ে সেগুলো তথ্য যুক্তি প্রমাণ ছাড়া পেশ করবেন না। এর ফলে অভয়া মঞ্চ সম্পর্কে সাধারণ মানসে সন্দেহের বাতাবরণ সৃষ্টি হচ্ছে। 

এমনিতেই জুনিয়র ডাক্তারদের কর্মবিরতির সময়ে মুখ্যমন্ত্রী প্রদত্ত তালিকা অনুযায়ী এক বিরাট সংখ্যক ডাক্তার স্বাস্থ্যসাথীর কার্ডে বাইরে বেসরকারি হাসপাতালে রোগীর চিকিৎসা করেছেন, অভয়ার জাস্টিসের দাবিতে কোটি কোটি টাকা তহবিল সংগ্রহ হয়েছে, এমনকি কোনও কোনও জুনিয়র ডাক্তার নেতার অনৈতিক ভুয়ো ডিগ্রি ভাঁড়িয়ে বেআইনি প্রাইভেট প্র্যাকটিসের অভিযোগ উঠেছে, ধর্না মঞ্চে কর্পোরেট হাসপাতাল ও ওষুধ কোম্পানির ঢালাও অর্থ ব্যয় হয়েছে-- এসবই জনমানসে অস্পষ্টতা তৈরি করেছে। 'এর মধ্যে আরও অপরাধী আছে' এই প্রমাণবর্জিত কথা, 'তথ্য প্রমাণ লোপাট' প্রসঙ্গ অভয়ার সুবিচার প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করেছে বলেই আমার বিশ্বাস।

তবুও তিলোত্তমার বিচারে অপরাধী শাস্তি পেয়েছে। সিবিআই'এর যদি 'সাপ্লিমেন্টারি চার্জশিট' বলে কিছু থেকে থাকে তা তারা আদালতে পেশ করুক। আরও কেউ অপরাধী থাকলে তারাও তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়ায় উন্মোচিত হোক। কিন্তু তা ন্যায়বিচারের পদ্ধতি মেনেই; ক্যাঙারু কোর্ট বা গোদি মিডিয়ার যুক্তিহীন সান্ধ্য জলসায় নয়। 


Tuesday, 14 January 2025

ধৈর্যের পরীক্ষা!

কৃষক আন্দোলন 

অভূতপূর্ব মোড় নিতে পারে 

প্রশান্ত ভট্টাচার্য



কৃষকদের আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়টি শুরু হয়েছে গত বছরের গোড়া থেকেই। এখন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকারের যা মতিগতি, তাতে আগামী ১৩ ফেব্রুয়ারি কৃষকদের দিল্লি অভিযান অনিবার্য হয়ে উঠেছে।  দেশের অন্ন যাঁরা জোগান, মোদী সরকার তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে পর্যন্ত নারাজ। আর আদালতের ভূমিকাও স্যালুট করার মতো নয়; শীর্ষ আদালতের যত আগ্রহ সড়ক থেকে আন্দোলনরত কৃষকদের হঠিয়ে পরিবহন যাতায়াতের সুবিধা করে দেওয়ায়, ততটা আগ্রহ নেই কৃষকদের মূল দাবিগুলোর সুষ্ঠু সমাধানে সরকারকে বাধ্য করানোয়। তা সত্ত্বেও কৃষকরা এখনও পর্যন্ত প্রশংসনীয় ধৈর্য দেখাচ্ছেন। কিন্তু এই  ধৈর্য কতদিন থাকবে আমার গভীর সন্দেহ আছে। যে কোনও সময়ই মাটির এই মানুষগুলো আক্রমণাত্মক হতে পারেন। এমন লক্ষণও দেখা যাচ্ছে, যে কোনও সময় কৃষক আন্দোলন চমকপ্রদভাবে অন্য চেহারা নিতে পারে। খেয়াল রাখতে হবে, গত তিন সপ্তাহের মধ্যে প্রতিবাদী দু'জন কৃষক নেতা আত্মঘাতী হয়েছেন। 

তবে এটাও ঘটনা, কেন্দ্রের মোদী সরকারকে গত দশ বছরে যদি কোনও গণআন্দোলন বিব্রত করে থাকে, সেটা কৃষক বিক্ষোভ। ২০২১ সালে কৃষকদের আন্দোলনের জেরে কৃষি আইন প্রত্যাহারও করতে হয় কেন্দ্রকে। কিন্তু তারপরও সমস্যা মেটানো যায়নি।

২০২৪ সালের লোকসভা ভোটেও মোদীর যে ৪০০ পূরণের স্বপ্ন ধূলিস্যাৎ হয়েছে, তার অন্যতম কারণ কৃষকদের দুর্মর আন্দোলন। এখনও পঞ্জাব-হরিয়ানার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে কেন্দ্র বিরোধী বিক্ষোভে কৃষকরা। কৃষক নেতা জগজিৎ সিং দাল্লেওয়াল এখনও অনশনে। কৃষকরা এখন পর্যন্ত অবস্থান কর্মসূচি পালন করে আসছেন। হরিয়ানা, রাজস্থান আর উত্তরপ্রদেশে কৃষকরা বিক্ষোভের সূত্রপাত করেন। এই দ্বিতীয় পর্যায়ের আন্দোলনে মোট ৫ জন নিহত আর ১০ জনের মতো বিক্ষোভকারী জখম হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। অনেক কৃষককে হেফাজতে নেওয়া হয়েছে আর আন্দোলনরত কৃষকদের বিরুদ্ধে বহু এফআইআর নথিভুক্ত করা হয়েছে। কৃষকরাও বেশ কয়েকবার অহিংস পথে দিল্লি সীমান্তে প্রবেশের চেষ্টা করলেও সতর্ক দিল্লি পুলিশ নানাভাবে তাঁদের বাধা দেয়। মন্থর গতিতে আন্দোলন ২০২৪ জুড়ে চললেও গত ডিসেম্বরে এটি একটি নতুন মাত্রা অর্জন করে। সংযুক্ত কৃষক মোর্চা (অরাজনৈতিক)  আর ক্রান্তিকারী কৃষক মোর্চা গত ৬ ডিসেম্বর দিল্লি অভিযানের ডাক দিতেই আন্দোলন তীব্রতা পায়। পঞ্জাব, হরিয়ানা ও উত্তরপ্রদেশে ধারাবাহিক প্রতিবাদ শুরু হয়।

মোদীর প্রতিশ্রুতির পর ২০২১ সালের ডিসেম্বরে কৃষকদের আন্দোলনের প্রথম পর্যায়টি স্থগিত করার ডাক দেয় সংগঠনগুলোর সংযুক্ত কমিটি। কিন্তু যেদিন থেকে মোদীর নেতৃত্বাধীন সরকার দ্বারা প্রতারিত হওয়া টের পান কৃষকরা, শুরু হয় ফের আন্দোলন। তিনটি বিতর্কিত খামার আইন প্রত্যাহার ও সরকার তাদের অনেক দাবিকে বাস্তবায়িত করার আশ্বাস দেওয়ার পরে কৃষকরা ন্যায্যত অনুভব করেছিলেন তাঁদের দাবি পূরণ হবে। কিন্তু কৃষক সংগঠনগুলো বলছে, আশ্বাস পূরণ হয়নি। ২০২১'এর আন্দোলনে ৭৫০ জন কৃষক প্রাণ হারিয়েছিলেন আর কৃষকদের বিরুদ্ধে অসংখ্য এফআইআর নথিভুক্ত করা হয়েছিল।

সম্প্রতি দিল্লিতে এক অনুষ্ঠানে উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনখর কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহানকে এই প্রসঙ্গে তিরস্কার করেন। তিনি ওই প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে চৌহানকে সরাসরি জিজ্ঞাসা করেন, কেন কেন্দ্র প্রতিবাদী কৃষকদের সঙ্গে কথা বলছে না। তিনি বলেন, 'প্রতিটি মুহূর্ত আপনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের দ্বিতীয়-সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তি হিসাবে আমি আপনাকে অনুরোধ করছি, দয়া করে আমাকে বলুন, কৃষকদের কোন প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল আর কেন তা পূরণ করা হয়নি? প্রতিশ্রুতি পূরণে আমরা কী করছি? গত বছর একটা আন্দোলন হয়েছিল, আর এই বছরও একটা আন্দোলন হয়েছে। সময় চলে যাচ্ছে, কিন্তু আমরা কিছুই করছি না।' উপরাষ্ট্রপতি এমনকী জগজিৎ সিং দাল্লেওয়ালের প্রসঙ্গও টানেন। ধনখর কেন্দ্রকে স্পষ্ট সতর্ক করেছিলেন যে সরকার তার নিজের লোকদের সঙ্গে লড়াই করতে পারে না বা তাদের এমন পরিস্থিতিতে ফেলতে পারে না যেখানে লড়াই করা ছাড়া অন্য উপায় থাকে না। সেদিন উপরাষ্ট্রপতি নিজেকে কৃষক পরিবারের সন্তান বলে দাবি করে খুল্লামখুল্লা বলেন, 'আমরা এই ধারণা নিয়ে বসে থাকতে পারি না যে তাদের সংগ্রাম ক্রমে সীমিত হবে আর তারা শেষ পর্যন্ত ক্লান্ত হয়ে পড়বে। আমাদের ভারতের আত্মাকে বিরক্ত করা উচিত নয়, আমাদের হৃদয়ে আঘাত করা উচিত নয়। আমরা কি কৃষক সমাজ ও সরকারের মধ্যে একটি সীমানা তৈরি করতে পারি? যাদের আমাদের আলিঙ্গন করতে হবে তাদের দূরে ঠেলে দেওয়া যাবে না।' ভারতের উপরাষ্ট্রপতির এইসব মন্তব্য কৃষকদের আন্দোলনের গুরুত্ব ও অপরিহার্যতাকে স্পষ্ট করে দিয়েছে। আন্দোলন এসে পড়েছে ২০২৫-এ। প্রতিবাদী জগজিৎ সিং দাল্লেওয়ালের অনশন ৪৯ দিনে পড়েছে। তাঁর শারীরিক অবস্থা খুবই খারাপ। উদ্বিগ্ন সুপ্রিম কোর্ট আগেই কেন্দ্রীয় সরকারের সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, 'কেন আপনার ক্লায়েন্ট একটি বিবৃতি দিতে পারে না যে প্রকৃত দাবিগুলি বিবেচনা করবে আর কৃষকদের অভিযোগ নিয়ে আলোচনা করার জন্য আমাদের দরজা খোলা আছে?' এরপরও কিছুই এগোয়নি। 

কৃষকদের বিক্ষোভ ও তাঁদের নেতা জগজিৎ সিং দাল্লেওয়ালের অনশনের কথা বিবেচনা করে সুপ্রিম কোর্ট তাঁদের সঙ্গে কথা বলে একটি সমাধান খুঁজে বের করার জন্য একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করে দিয়েছে, যার নেতৃত্বে আছেন একজন অবসরপ্রাপ্ত উচ্চ আদালতের বিচারপতি। এই কমিটি কৃষি ও অর্থনীতির সঙ্গে জড়িত বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত করেছে। কমিটির কাজ কৃষকদের সমস্যা আর দাবিগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা।

কিন্তু কৃষক সংগঠনগুলি এই কমিটির সঙ্গে বৈঠকে অংশ নিতে অস্বীকার করে। যার ফলে পরিস্থিতি স্থবির হয়ে আছে। কৃষক সংগঠনগুলোর বক্তব্য, এই সমস্যা ও সঙ্কট আদালতের বিষয় নয়, এটা সম্পূর্ণ কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি ও সদাশয়ের ওপর নির্ভর করছে। কিষাণ মজদুর মোর্চা (কেএমএম) ও কিষাণ মজদুর সংগ্রাম কমিটির (কেএমএসসি) সমন্বয়কারী কৃষক নেতা সারওয়ান সিং পান্ধের সাফ কথা, 'এটা আদালতের বিষয় নয়। আমাদের দাবি কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে, আর সরকারের নিজেই আলোচনার জন্য এগিয়ে আসা উচিত।' তিনি অভিযোগ করেন যে কৃষকদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করতে এই বৈঠক ডাকা হয়েছিল আর কমিটি এর মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের সামনে তাদের সুপারিশ পেশ করেছে। পান্ধের আরও অভিযোগ, কমিটি কিছু নিয়ম আর শর্ত দিয়েছে, যে কারণে কৃষকরা বৈঠক না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। অন্যদিকে সরকার পক্ষের অভিযোগ, অনশনরত কৃষক নেতা জগজিৎ সিং দাল্লেওয়ালের অবস্থা ইচ্ছাকৃতভাবে খারাপ করার চেষ্টা করা হচ্ছে; চূড়ান্ত একটা কিছু ঘটে গেলে কৃষকরা সেন্টিমেন্টাল ইস্যু করে ফয়দা লুঠতে চায়। 

বাস্তব ঘটনা হচ্ছে, ব্যাপারটা কিন্তু দাল্লেওয়ালেই সীমাবদ্ধ নয়। গত বৃহস্পতিবার শম্ভু সীমানায় বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেন আন্দোলনরত ৫৫ বছর বয়সী কৃষক নেতা রেশম সিং। ঘটনাটি জানতে পেরে তাঁর সতীর্থরা দ্রুত তাঁকে পাতিয়ালার রাজেন্দ্র হাসপাতালে নিয়ে যান। দুপুরে সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত কৃষক নেতা পঞ্জাবের তরন তারন জেলার পাছবিন্দের বাসিন্দা। বৃহস্পতিবার সকালে তিনি আন্দোলনরত সতীর্থদের সঙ্গে বসেছিলেন। তখনই আচমকা বিষ খেয়ে নেন ৫৫ বছরের ওই প্রৌঢ়। আন্দোলনকারী  কৃষকদের অভিযোগ, মোদী সরকারের ওপর ক্ষোভ থেকেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ওই কৃষক। রেশম সিংয়ের আত্মহত্যা গত তিন সপ্তাহের মধ্যে দ্বিতীয় ঘটনা।

গত ১৮ ডিসেম্বর শম্ভু সীমানায় আত্মহত্যা করেছিলেন রণযোধ সিং নামে এক কৃষক নেতা। রবিবারই খানাউড়ি সীমানায় আন্দোলনরত এক বয়স্ক কৃষি শ্রমিক মারা গিয়েছেন। ফরিদকোটের এই কৃষি শ্রমিককে হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তাররা তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। 

নভেম্বরের শেষ থেকেই দফায় দফায় শম্ভু সীমানা থেকে দিল্লির উদ্দেশে মিছিল করে এগোনোর চেষ্টা করেছেন কৃষকরা। পরিস্থিতি সামাল দিতে তৈরি ছিল প্রশাসনও। বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ভোর থেকেই বন্ধ করে দেওয়া হয় মোবাইল ও ইন্টারনেট পরিষেবা। এলাকায় জারি হয়েছিল ১৬৩ ধারা। কৃষকরা ব্যারিকেড টপকে এগোতে গেলে তাঁদের সঙ্গে খণ্ডযুদ্ধ বাধে পুলিশের। ছোড়া হয় জলকামান, কাঁদানে গ্যাস। তাই বার বারই কৃষকদের 'দিল্লি চলো' অভিযানের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (এমএসপি), কৃষি ঋণ মকুব, পেনশনের ব্যবস্থা ও বিদ্যুতের বিল না-বাড়ানোর মতো বেশ কয়েকটি দাবি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কৃষকদের এই আন্দোলন চলছে। গত বছর ১৩ ফেব্রুয়ারি থেকে দিল্লি লাগোয়া পঞ্জাব আর হরিয়ানার শম্ভু ও খানাউড়ি সীমানায় সংযুক্ত কিষান মোর্চা (অরাজনৈতিক) ও কিষান মজদুর মোর্চার ব্যানারে অবস্থানে বসে রয়েছেন কৃষকরা। ২৬ নভেম্বর থেকে কৃষক নেতা জগজিৎ সিং দাল্লেওয়াল আমরণ অনশন শুরু করার পর আন্দোলন নতুন করে উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। এই পরিস্থিতিতে কিছুটা মলম লাগাবার গরজে বছরের প্রথম দিন কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বৈঠকের শেষে নিজেদের কৃষকদরদী প্রমাণ করার জন্য বড় ঘোষণা করে মোদী সরকার।

'প্রধানমন্ত্রী ফসল বিমা যোজনা প্রকল্প'কে এবার ঢেলে সাজাতে চাইছে কেন্দ্র। এই লক্ষ্যে ৬৯,৫১৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করার কথা জানানো হয়েছে। এই প্রকল্পের প্রযুক্তিগত আধুনিকীকরণের জন্য ৮০০ কোটি টাকার তহবিলও গড়ছে সরকার। কৃষি ক্ষেত্রে ব্যবহৃত অত্যন্ত জরুরি ডাই অ্যামোনিয়াম ফসফেট (ডিএপি)) সার উৎপাদনকারীদের জন্য বিপুল অঙ্কের বিশেষ আর্থিক প্যাকেজ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মন্ত্রীসভা। নতুন এই এককালীন বিশেষ প্যাকেজের অধীনে মোট ৩,৮৫০ কোটি টাকার ভর্তুকি দেওয়া হবে। উল্লেখ্য, এর আগে এই সারেই এনবিএস ভর্তুকি ছিল। তার ওপরে এই বিশেষ প্যাকেজের মাধ্যমে অতিরিক্ত ভর্তুকি দেবে কেন্দ্র।

কিন্তু কৃষকরা তাঁদের দাবিতে অনড়। উত্‍পাদিত ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য বা এমএসপি গ্যারান্টি আইন প্রণয়ন না করা পর্যন্ত তাঁরা সরছেন না। জগজিৎ সিং দাল্লেওয়ালের ধনুকভাঙা পণে যতটা বিচলিত শীর্ষ আদালত বা দেশের সংবেদনশীল মানুষ, তার ন্যূনতম ছাপ নেই নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর সতীর্থদের। তারা ভাবছে, ওই মলমেই কাজ হবে। 

কৃষকরা যে কতটা চড়া মেজাজে আছেন, তা বোঝা গেল দিলজিৎ দোসাঞ্জের ব্যাপার নিয়ে। নতুন বছরের সূচনায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে দেখা করেন দিলজিৎ, এরপরই প্রতিবাদী কৃষক নেতাদের তীব্র সমালোচনার শিকার হন এই পঞ্জাবি তারকা। মোদীর সাথে দিলজিৎ দোসাঞ্জের বৈঠক নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে কৃষকরা গায়কের দায়বদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। দিলজিৎ দোসাঞ্জ মোদীর সঙ্গে তাঁর বৈঠককে নতুন বছরের ‘দুর্দান্ত শুরু’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন, অন্যদিকে ‘নম্র সূচনা থেকে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন’ তারকা হিসাবে দিলজিৎ-এর উত্থানের প্রশংসা করেছেন প্রধানমন্ত্রী। এর পালটা প্রতিবাদী কৃষকদের কথা, 'দিলজিৎ যদি সত্যিই কৃষকদের কথা ভাবতেন, তাহলে শম্ভু সীমান্তে দাল্লেওয়ালজীর লড়াইকে সংহতি জানিয়ে আমাদের সঙ্গে যোগ দিতেন, আমাদের উদ্বেগ শুনতেন আর তাঁর আগের বক্তব্যেই অটল থাকতেন। প্রধানমন্ত্রী মোদীর সঙ্গে দেখা করায় ওঁর উদ্দেশ্য নিয়েই সংশয় দেখা দিচ্ছে।' প্রতিবাদী কৃষকরা এসব কথা নিছক অভিমান থেকে বলছেন না। আমাদের মনে রাখতে হবে, ২০২০ সালে দিলজিৎ দোসাঞ্জ কৃষক আন্দোলনের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেছিলেন, কেন্দ্রকে তাঁদের দাবি পূরণের আহ্বান জানিয়েছিলেন আর কৃষকদের পক্ষে জোরালো সওয়াল করেছিলেন। ওই বছরই দিলজিৎ ইনস্টাগ্রামে কৃষকদের সমর্থনে এই পোস্টটি করেছিলেন: ‘২৫ সেপ্টেম্বর। আমরা সবাই কৃষক সমাজের পাশে দাঁড়াব। পঞ্জাবের সব বয়সের মানুষ কৃষকদের পাশে দাঁড়িয়েছেন।' কৃষকদের ভাষায় সেই দিলজিৎ এখন 'গদ্দার'।

আগামী দিনে এই কৃষক আন্দোলন এক ব্যাপক অভ্যুত্থানের চেহারা নিতে পারে। দাল্লেওয়ালজীর অনশন দেশবাসীকে এক বিপুল উৎকণ্ঠায় রেখেছে।


Saturday, 4 January 2025

'ফেল প্রথা'য় এত উৎসাহ কেন?

ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই, ছোটো সে তরী

মালবিকা মিত্র



'সহজ লোকের মতো কে চলিতে পারে।

কে থামিতে পারে এই আলোয় আঁধারে

সহজ লোকের মতো; তাদের মতন ভাষা কথা

কে বলিতে পারে আর; ...

 

সকল লোকের মতো বীজ বুনে আর

স্বাদ কই, ফসলের আকাঙ্ক্ষায় থেকে,

শরীরে মাটির গন্ধ মেখে, 

শরীরে জলের গন্ধ মেখে,

উৎসাহে আলোর দিকে চেয়ে

চাষার মতন প্রাণ পেয়ে

কে আর রহিবে জেগে পৃথিবীর ’পরে?'

--বোধ/ জীবনানন্দ দাস।


এ এক অদ্ভুত সমাজ, যেখানে পারফিউমের নাম এনভি অথবা সিক্রেট। অর্থাৎ, সকলের তরে নয়। এটা বিশেষের জন্য এবং যিনি এটার ভোক্তা তার গর্ব এটা। সেই যে একটা বিজ্ঞাপনের ক্যাচলাইন ছিল 'নেবার্স এনভি ওনার্স প্রাইড'। এমন একটা সমাজে সকলের মতো, সকলের সঙ্গে, সকলের তরে-- এ কথাগুলো খুবই মামুলি, বস্তাপচা, ব্যাকডেটেড। এ সমাজে 'যো জিতা ওহি সিকান্দার'। তাহলে কাউকে তো হারতেই হবে, তবেই কেউ জিততে পারবে। আর হার-জিতের এই খেলাতে জীবনকে মাপা হবে-- কে সফল কে ব্যর্থ। তাহলে বলুন দেখি, পরীক্ষা হবে আর পাশ ফেল থাকবে না, এ কি কখনও হয়! উত্তমর্ণ আর অধমর্ণ দেগে দিতে হবে না? তবেই তো সিকান্দার কে, চেনা যাবে। 

২০০৯ সালে দেশ জুড়ে প্রণয়ন করা হয়েছিল শিক্ষার অধিকার আইন। সেই আইন অনুসারে, ৬ থেকে ১৪ বছর বয়সী প্রতিটি শিশুর বিনামূল্যে বাধ্যতামূলক শিক্ষা পাওয়ার অধিকার আছে। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সমস্ত শিশুর শিক্ষা সম্পূর্ণ করার দায় রাষ্ট্রের। সরকার পরিচালিত কোনও স্কুলে প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত থাকবে না পাশ-ফেল প্রথা। এরপর ২০১৮ সালে মোদী সরকার পাশ-ফেল প্রথা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়। ওই বছরই লোকসভায় এবং পরের বছর (২০১৯) রাজ্যসভায় গৃহীত হয় সংশোধনী বিল (যদিও স্কুলশিক্ষার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে রাজ্যগুলি)। ইতিমধ্যেই ১৬টি রাজ্য এবং দু’টি কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল কেন্দ্রের নীতি অনুযায়ী পাশ-ফেল প্রথা চালু করেছে। 

এবারে গত ১৬ ডিসেম্বর থেকে লাগু হয়েছে 'Right to Free Compulsory Child Education Amendment Rules 2024' যা মোতাবেক পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির অন্তে পরীক্ষায় যদি কোনও ছাত্র ফেল করে, তাকে দু' মাসের মধ্যে আরও একবার পরীক্ষার সুযোগ দেওয়া হবে; কিন্তু তারপরেও যদি কেউ ফেল করে তাহলে তাকে উক্ত শ্রেণিতে আটকে দিতে হবে। পশ্চিমবঙ্গ এখনও এই সিদ্ধান্ত না নিলেও সম্ভবত নেওয়ার পথে।

এ তো শুধু কেন্দ্রীয় সরকার, রাজ্য সরকার, তাদের শিক্ষানীতি-- এসবের দিকে আঙ্গুল তোলার বিষয় নয়। তা করলে দায় এড়ানো যায় মাত্র। ওই যে এআইডিএসও, যারা কত দশক ধরে দাবি করে চলেছে প্রাথমিক স্তরে পাশ-ফেল ফিরিয়ে আনতে হবে; বিদ্যালয়ে যান, বহু শিক্ষক, বা বলতে পারেন প্রায় সব শিক্ষক মনে করেন, পাশ-ফেল নেই বলে পড়াশোনা লাটে উঠেছে। অভিভাবকরা মনে করেন, পাশ-ফেল নেই বলে ছাত্রদের মধ্যে পড়ার তাগিদ নেই। শিক্ষকের ভেতরও পড়ানোর তাগিদ নেই, কারণ, শিক্ষকের সাফল্যের মাপকাঠি তো ওই পাশ-ফেল। 

আসুন একটু খুঁটিয়ে বিচার করে দেখি। পাস কি ছিল না? গ্রেডেশন ছিল তো। এ, এ প্লাস, ডাবল এ, বি, বি প্লাস, সি, সি প্লাস, আর ডি মানে ছিল নন-কোয়ালিফাইড, দুর্বলতম চিহ্নিত করা। তাহলে কেন পাশ-ফেল ফিরিয়ে আনার প্রশ্ন আসছে, ছিলই তো। যেটা ছিল না, 'ফেল' শব্দের অর্থটা একটু পরিবর্তিত হয়েছিল। দুর্বলতমকে চিহ্নিত করা হত কিন্তু তাকে শিক্ষার চলন্ত গাড়ি থেকে নামিয়ে দেওয়া হত না। তোমার দ্বারা হবে না, তুমি এ গাড়ি থেকে নেমে যাও, এটা ছিল না। তাকে বলা হত, এই বিষয়গুলো আরেকটু যত্ন নাও না হলে পরের ক্লাসে তুমি এগোতে পারবে না, উচ্চ বুনিয়াদির গণ্ডি পেরতে পারবে না। একটা স্তর পর্যন্ত সেই দুর্বলতম শিশুটিকে সঙ্গে নিয়ে চলা হত। এর ফলে তার মধ্যে হীনম্মন্যতা কাজ করত না। অনিবার্য ড্রপ-আউট ঘটত না। বিদ্যালয় শ্রেণি কক্ষ, শিক্ষক, ছাত্র, বন্ধুবান্ধব, এই সামগ্রিক পরিবেশে তার সামাজিক কিছু একটা অর্জন হত। আর হয়তো কিছু কিছু পুঁথিগত শিক্ষাও অর্জন হত। 'ফেল' প্রথা চালু করে তাকে ড্রপ-আউট হতে বাধ্য করা হল। 

বহুবারের চর্চিত বহু লেখায় কথিত উদাহরণটি আর একবার বলতে হয়। যে ছাত্রটি ফেল প্রথা না থাকার ফলে সকল বিষয়ে শূন্য, তিন, পাঁচ, এরকম নম্বর পেয়ে দিব্যি পরের ক্লাসে উঠে যায়, সেই ছেলেটিকে খেলার মাঠে দেখেছি ক্লাশ লিগে মাঠের পাশে এক্সট্রা প্লেয়ার হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। উত্তেজনায় ছটফট করছে। হঠাৎই ওদের সতীর্থের একটা সজোর ক্রস সেন্টার ফাঁকা বক্সের সামনে ওরই আরেক বন্ধু নাগাল পেল না। সকলেই হায় হায় করল, ইস একটু পা ঠেকালেই অনিবার্য গোল। কিন্তু সাইড লাইনের পাশে দাঁড়ানো ফেল করা ছাত্রটি বলল, না স্যার, বলটায় যা পাঞ্চ ছিল ওটা অনেক জোরে ঘোরাতে হত, তবে গোলে থাকত, ঠেকালে ওটা বাইরেই চলে যেত। একটা প্রচণ্ড গতিতে ধাবমান বস্তুকে তার ডিরেকশন চেঞ্জ করানোর জন্য বা ৯০ ডিগ্রি ঘোরানোর জন্য কতটা শক্তি প্রয়োজন, অঙ্কে ও জানে না। কিন্তু খেলার মাঠে বাস্তবে সেটা জানে। 'ফেল' চালু করলে মাঠে এই ছেলেটাকে আমি মিস করতাম। পড়াশোনায় মন নেই যে ছেলেটার, সে কিন্তু বাড়তি শক্তি প্রয়োগ না করেই অবলীলায় মাঠের বাইরে ছক্কা হাঁকায়। নিজের অজান্তে মাটি থেকে ৪৫ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে বলটাকে রাখে অঙ্ক না জেনেই। 

শুধু তো 'ফেল' বন্ধ করা ছিল না। বলা হল, সবচেয়ে পিছিয়ে পড়াদের নিয়ে রেমিডিয়াল ক্লাস হবে। যে ছাত্র যে বিষয়ে পশ্চাদপদ, তাদের নিয়ে গ্রুপ করে রুটিনে রেমিডিয়াল ক্লাস রাখা হত। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, বিদ্যালয়ের সবচেয়ে ফাঁকিবাজ শিক্ষকরা ক্লাস রুটিনে রেমিডিয়াল ক্লাসগুলোর দায়িত্ব নিত। কারণ, তাদের দর্শন হল, পরের ছেলে পরমানন্দ/ যত গোল্লায় যায় ততই আনন্দ। অতএব, ক্লাস রুটিনে শেষের দিকে থাকবে রেমিডিয়াল ক্লাস। আর সেই ক্লাসগুলি কার্যত কখনই নেওয়া হবে না। আরেকটা প্রবণতাও দেখেছি, শিক্ষকরা রেমিডিয়াল ক্লাস নিতে হবে এই আশঙ্কায় সেই অতিরিক্ত দায়িত্ব এড়ানোর জন্য নিজেরা আগেই ঠিক করে নিল, পরীক্ষায় কাউকেই কোনও বিষয়ে 'ডি' দেখানো হবে না। তাহলে রেমিডিয়াল ক্লাসেরও দরকার হবে না। ফলে, শিক্ষক যদি হন রাজহংস, তাহলে যেভাবেই দাও না কেন, উনি ঠিক নিজের মতো করে দুধটুকু খেয়ে নেবেন, জল পড়ে থাকবে। 

আমি নিজে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনে যুক্ত ছিলাম যেখানে ষষ্ঠ-সপ্তম শ্রেণির ড্রপ-আউট ছাত্রদের খুঁজে আনা হত তথাকথিত পশ্চাৎপদ পাঁচটি জেলা থেকে-- বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বীরভূম, পশ্চিম মেদিনীপুর ও হাওড়া-হুগলির প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে। লক্ষ্য ছিল, একটি নতুন সিলেবাস তৈরি করে ওই ছাত্রদের প্রথম এক বছর সমস্ত বিষয় যা বিদ্যালয়ে পড়ানো হয় তার যুক্তিভিত্তিক শিক্ষা দেওয়া হবে কিন্তু বিদ্যালয়ের পরীক্ষার সিলেবাসটি অনুসরণ করা হবে না; দ্বিতীয় বছর ওই ছাত্রদের নবম ও দশম শ্রেণির সিলেবাস অনুসরণ করে পড়ানো হবে। ওই এক বছরেই তারা মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসবে। স্থানীয় একটি স্কুল এ কাজে সাহায্য করতে এগিয়ে এল। মোট কুড়িজন এসেছিল। দু' বছর পর তারা প্রত্যেকে মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হল, কেবল একজন ছাড়া। পরের ব্যাচে (২০+১)=২১ জন বসল, সকলেই পাস করল। ক্লাস সিক্সের ড্রপ-আউট ছাত্র, সে মাত্র দু' বছরে মাধ্যমিক পাস করেছে। যারা 'ফেল প্রথা' চালু করার প্রশ্নে এত সরব, তারা ভেবে দেখবেন আমাদের ওই প্রজেক্ট কীভাবে সম্ভব হয়েছিল। আমার নিজের কাছেই এটা ছিল অবিশ্বাস্য। 

শিখন পর্বের একটা স্তর পর্যন্ত তুমি ফেল, তুমি ব্যর্থ, তোমাকে দিয়ে হবে না, এ কথা বলা যায় না। শিশুকে কতবারের চেষ্টায় হাঁটতে হবে, এটা নির্দিষ্ট করা যায় না। কতবারের চেষ্টায় গাছে উঠতে পারবে, এটা নির্দিষ্ট করে দেওয়া যায় না। শিশু কতবারের চেষ্টায় মা-বাবা শব্দগুলি বলতে শিখবে, তা নির্দিষ্ট করা যায় না। ঠিক একই কারণে উচ্চ বুনিয়াদি স্তর পর্যন্ত এই সমগ্র আট বছর শিশুর কাছে একটা প্যাকেজ; এর মধ্যে কেউ ৩০ শতাংশ কেউ ৬০ শতাংশ কেউ ৮৫ শতাংশ শিখবে। আমাদের নিজেদের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, বিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় যে সমস্ত বিষয় বোধগম্য হত না, পাঁচ বছর পর সেগুলোই বোধগম্য হচ্ছে। এটাই বাস্তব। আমার মনে আছে, একটি বই হাতে এসেছিল, যেটা পড়ে ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। ফলে, ১০-১২ পাতার বেশি এগোতে পারিনি। ভাষা ও যুক্তি, কোনওটাই বোধগম্য ছিল না। একজন শিক্ষককে আমি সে কথা বলেছিলাম। সঙ্গে এটাও বলেছিলাম, আমাকে একটু বুঝিয়ে দেবেন? সেই শিক্ষক বলেছিলেন, যেখানে আটকে গেছ সেটাকে উপেক্ষা করেই পরের অংশে এগিয়ে যাও। এভাবে ছোটখাটো বাঁধাগুলো পেরিয়ে যাবার পর এক সময় দেখবে, আগের না বোঝা অংশগুলো তোমার কাছে স্পষ্ট হচ্ছে। ঠিক এই কারণেই, কোথাও আটকে গেলেই তুমি ব্যর্থ, তুমি ফেল, তুমি ড্রপ-আউট, তোমাকে দিয়ে হবে না, এই নীতি শিখন পদ্ধতির পরিপন্থী। 

আমার বিশ্বাস, ফেল করানো ও তাকে শিক্ষা প্রণালী থেকে ছেঁটে ফেলা গণশিক্ষার পরিপন্থী। একবার ভাবুন, প্রথম প্রজন্মের যে ছাত্র বিদ্যালয়ে এল, সে তো সফলভাবে শিক্ষা প্রণালীর সঙ্গে অভিযোজন করতে পারবে না। এটাই স্বাভাবিক ধরা আছে। জানা আছে। আমাদের ঘরের সন্তানটি বিদ্যালয় থেকে বাড়িতে ফিরেও মা-বাবা কাকা পিসি দাদু ঠাকুমা বন্ধুবান্ধব পাড়ার কাকা পিসি মামা মাসি সকলের সাহচর্যে শেখে। বিদ্যালয়ের শিক্ষা গৃহের চৌহদ্দিতেও চলতে থাকে। ফলে, সে কৃতকার্য হবে পাশ করবে, ওটাই তো স্বাভাবিক। আর প্রথম প্রজন্মের যে শিশুটি বিদ্যালয়ে পড়তে এল, তার কাছে বইয়ের ভাষা বিমূর্ত, ওই ভাষায় সে কথা বলে না। পরিবারের কেউ বলে না। বিষয়বস্তু বিমূর্ত, তার প্রাত্যহিক জীবন চর্চার বিষয় নয়। বাড়ি ফিরে যে পরিবেশ, সেখানেও তার বিদ্যালয়ের শিক্ষা বিষয়ক চর্চার সুযোগ নেই। ও তো ড্রপ-আউট হবার জন্যই এসেছে। আমার সন্তানের নৌকা চড়ায় আটকে গেলে পরিবারের সকলে মিলে সেই নৌকা ঠেলে দিই। নৌকা তরতর করে এগিয়ে যায়। কিন্তু প্রথম প্রজন্মের ছাত্র, তার নৌকাটি আটকে থাকবে এটাই স্বাভাবিক। বাড়িতে সেটাকে কেউ ঠেলে দেওয়ার নেই। ফলে, বিদ্যালয়ের দায়িত্ব তাকে কিছুতেই ড্রপ-আউট হতে না দেওয়া। খাবার দিয়ে, পোশাক দিয়ে, নানা আর্থিক সহায়তা দিয়ে, সাইকেল, জামা জুতো দিয়ে, ওর মনের মতো বইপত্র তৈরি করে, ওকে ধরে রাখাটাই কাজ। ফেল পদ্ধতি এসে গণশিক্ষার এই কাজটাকেই ধ্বংস করতে চাইছে। 

যে সব মানুষ পাশ-ফেল উঠে গেল, সব গেল, সব গেল করে চেঁচিয়েছেন, তাদের কাছে একটাই প্রশ্ন, ইঞ্জিনিয়ারিং'এর এন্ট্রান্স পরীক্ষায় ৬৮ হাজার, ৭২ হাজার স্থান পেয়েও ইঞ্জিনিয়ার হওয়া যায়। এখন তো ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের আসন ফাঁকা পড়ে থাকে। পুরো প্যানেল শেষ হয়ে যায়। অর্থাৎ, শেষতম ব্যক্তিও ইঞ্জিনিয়ার হতে পারে। আর ইঞ্জিনিয়ারিং পরীক্ষায় ফেল করে অকৃতকার্য, এমনটাও শোনা যায় না। ডাক্তারি পরীক্ষায় এমবিবিএস'এ ফেল শুনেছেন নাকি? আর ডাক্তারির পিজি এন্ট্রান্সে যারা অংশ নেয়, তারা সকলেই পিজিতে চান্স পায়। প্যানেলের শেষ ব্যক্তিটিও। শুধু পছন্দের মতো বিষয় পায় না হয়তো। কই, এ নিয়ে তো কোনও হইচই নেই? আসলে এখানেই সমস্যা। ইঞ্জিনিয়ার-ডাক্তার হতে আসে আমারই ঘরের ছেলেমেয়েরা। আমরাই তার বেনিফিশিয়ারি গ্রুপ। অতএব, এখানে পাশ ফেল না থাকা সমস্যা না। কিন্তু সরকারি বিদ্যালয়ে প্রাথমিক স্তর ও উচ্চ বুনিয়াদি থেকে পাশ-ফেল চালু না করলে, প্রান্তবাসী, সমাজের অন্ত্যজ জন প্রবেশাধিকার পেয়ে যাবে। একলব্যের মতো, ঘিনুয়ার মতো, বাঘারুর মতো, কোগার মতো সহজ মানুষগুলোকে শুরু থেকেই শিক্ষার অঙ্গনে প্রবেশাধিকার দেওয়া যাবে না এবং একালের দ্রোণাচার্যরা তাই 'ফেল ব্যবস্থা' চালু করার জন্য এত সোচ্চার। 

বন্ধু বলল, শুধু সামাজিক দিকটাই দেখলে। অর্থনীতিটা ভাবো একবার। নিম্ন স্তরে বুনিয়াদি শিক্ষায় সরকারি স্কুলগুলিতে দরিদ্রতম মানুষ পড়তে যায়। ওখানে রাজকোষের পয়সা যাতে না ব্যয় হয় সেটা লক্ষ্য। কোটি কোটি প্রান্তবাসীকে ন্যূনতম শিক্ষা দেওয়ার খরচটুকু করা যাবে না আর উচ্চশিক্ষায় সরকারি কলেজ, মেডিকেল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ কৌলিন্যের শীর্ষে। সেখানে উচ্চবিত্ত প্রবেশাধিকার পায়। অতএব, ওখানে পাশ-ফেল'এর বিষয়টা রাখা চলবে না। তাহলে বেসরকারি কলেজ ছাত্র পাবে কোথায়, আর ব্যবসাই বা জমবে কী করে। কেপিসি হলদিয়াকে ছাত্র পেতে হবে তো। তাই, ওখানে সকলেই পাশ। 

'মানুষ বড় বেশি গেলে, এত খেলে চলে' বের্টোল্ড ব্রেখটের সেই কবিতা। গরিব মানুষের জন্য রাজকোষ খুলে দিলে পেটুক জনতা সব শেষ করে দেবে। অতএব, রাজকোষের যা কিছু তা বরাদ্দ থাকবে দুধে ভাতে ঘিয়ে, হলুদ মাখা গায়ের জন্য সংরক্ষিত। সেখান থেকে নিচের তলায় ফিলট্রেশন পদ্ধতিতে যেটুকু চুঁইয়ে চুঁইয়ে পৌঁছবে সেটাই ওদের পক্ষে যথেষ্ট। কল্যাণকামী রাষ্ট্রের ধারণার ঠিক বিপরীতে এই অর্থনৈতিক ধারণার অবস্থান। সকলকে নিয়ে উন্নতির শিখরে পৌঁছনো যায় না। তাই, বাছাই করা অল্প কিছুকে নিয়ে শিখরে আরোহন করার অর্থনীতি।


Friday, 20 December 2024

অধ্যাপক বাগচীকে যেমন দেখেছি

একজন দার্শনিক ও আদর্শ শিক্ষক

বিনয় কৃষ্ণ পাল


(১৯৩৬ - ২৮ নভেম্বর ২০২৪)

আমৃত্যু মানবতাবাদী ও বামপন্থী অর্থনীতিবিদ শুধু নয়, একজন দার্শনিক, আদর্শ  শিক্ষক এবং মানুষ হিসেবে আমাদের কাছে ধরা দিয়েছিলেন অধ্যাপক অমিয় কুমার বাগচী। এমফিল পড়ার সময়েই দেখেছি, এত বড় মাপের একজন মানুষ মাটির কাছাকাছি থেকে ছাত্রছাত্রীদের বোধগম্য করে শেখাতেন, তাদের সঙ্গে সতত যোগাযোগ, আত্মীয়সূচক ব্যবহার ও পরিচর্যার মাধ্যমে তাদের বড় হয়ে উঠতে সাহায্য করতেন। দেখা হলে প্রথমেই, 'কেমন আছো বিনয়?', কেমব্রিজ ছেড়ে আসা এক অধ্যাপকের সাথে এক সাধারণ ছাত্রের সমস্ত মানসিক দূরত্বের অবসান ঘটিয়ে দিত। 

একমুখি বই-নির্ভর পড়ানোর বদলে দেশ-বিদেশের নানা সাহিত্য, সিনেমা, ঘটনা, গল্পের মাধ্যমে আমাদের শেখার পরিধি বহুধা বিস্তৃত করেছিলেন তিনি। ২০১৪ সালে IDSK'এর পড়া শেষ হলেও, ওই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, কর্মী ও স্যারের সাথে যোগাযোগ রাখি। ২০১৫ সালে ওনার স্ত্রী মারা যাওয়ার পর জানতে পারি তিনি কিছুটা একাকিত্বের মধ্যে রয়েছেন। সেই সূত্রে মাঝে মধ্যেই তিনি আমায় বাড়িতে ডাকতেন। স্যারের বাড়ির এক সহায়ক একদিন রাত্রে আমায় খাবার পরিবেশন করতে গিয়ে খাবার পাতে এক খণ্ড ইলিশ মাছ তুলে দেন। কয়েক মিনিটের মধ্যেই সেই ইলিশ উদরস্থ করি। খেতে খেতেই এক দিকে কথা বলছি, অন্যদিকে চোখ প্লেটে পড়ে থাকা আরও দুই খণ্ড ইলিশের দিকে। স্যার বুঝতে পেরেই  বলেন, 'ওই দুটিও তোমারই জন্য!' শুনে আমার চোখে আনন্দ ফুটে ওঠে এবং উনি হাসতে হাসতে বলেন, 'বাঙালিকে মাছ এবং মূলত ইলিশ দেখে চেনা যায়!' খাওয়ানোর তৃপ্তি ও রসিকতা আমায় আপ্লুত করে, যা আজও স্মৃতিতে বয়ে নিয়ে চলেছি। একান্ত সেই আড্ডাগুলিতে আরও পরিশীলিত হয়েছে আমার অর্থনীতি, ইতিহাস ও রাজনীতির জ্ঞান। বারবার বলতেন শুম্পেটার, মার্কস, স্মিথ, অমর্ত্য সেন, রবীন্দ্রনাথকে পড়তে, বুঝতে, লিখতে, 'পড়তে ও লিখতে লিখতেই হাতে লেখা আসে।' উৎসাহ দিতেন-- যা পড়ছি, সঠিক বলে ভাবছি, তা মুক্তকণ্ঠে-নির্ভয়ে বলতে। 

ওনাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, পূর্ব ভারতে সেন্টারের (কলকাতার 'সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস') মতো ঐতিহ্যশালী সমাজ বিজ্ঞান চর্চার একটি প্রতিষ্ঠান থাকলেও IDSK তৈরি করার পিছনে আপনাদের কী চিন্তা-ভাবনা ছিল? উত্তরে বলেছিলেন, 'আমাদের সাধারণ কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সহ গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলির সমাজ বিজ্ঞানের যে চর্চা হয় তা অনেক ক্ষেত্রেই তাত্ত্বিক এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে তার যোগাযোগ খুবই কম। তথ্য সংগ্রহে নানা কারচুপি, ছল-চাতুরি থাকায় অনেক ক্ষেত্রেই প্রকৃত বাস্তব উঠে আসে না! IDSK তৈরি এবং ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ কোর্সের মাধ্যমে আমরা একদিকে একটি উন্নততর সমাজ গঠনে জ্ঞান চর্চা, তাত্ত্বিক সমাজ বিজ্ঞান চর্চা এবং বর্তমান সমাজের নানা জনগোষ্ঠী, প্রান্তিক মানুষজন, পরিবেশ এবং সর্বোপরি মাটির সঙ্গে মেলবন্ধন তৈরি করতে চেয়েছিলাম। তোমরা যদি ক্রমাগত ফিল্ড ওয়ার্ক করে, যাচাইযোগ্য তথ্য ও ঘটনার মাধ্যমে একদিকে আর্থিক ও সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষ ও বর্তমান সময়ের সমস্যা তুলে ধরতে পারো এবং তাদের সমস্যায় পাশে গিয়ে দাঁড়াতে পারো, তাহলে আমাদের উদ্দেশ্য সফল হবে।' গরিব কৃষকদের থেকে বহুফসলি জমি কেড়ে শিল্পায়নের বিরোধী ছিলেন অধ্যাপক বাগচী। মূলত অর্থনীতির অধ্যাপক হলেও জ্ঞানের বিস্তৃত পরিসরে অবাধ যাতায়াত ছিল তাঁর। 

সদ্য কিছুদিন কলেজে পড়ানোর সুবাদে ওনাকে জানিয়েছিলাম, 'আমার কলেজগুলির অধিকাংশ ছাত্র-ছাত্রী খুব প্রান্তিক স্তর থেকে আসা, ওদের শেখানোর ক্ষেত্রে আমার তরফ থেকে অনেক সমস্যা বোধ করছি, মনে হচ্ছে ওদের কাছে ঠিকভাবে পৌঁছতে পারছি না।' নানা অভিজ্ঞতা ভাগ করার সুবাদে তিনি আমায় কিছু পরামর্শ দেন ও IDSK লাইব্রেরি থেকে আমার হাতে একটি অসামান্য বই  তুলে দেন: The Pedagogy of The Oppressed। উন্নয়নশীল ও বিপুল বৈষম্যের দেশে শিক্ষক-শিক্ষণ, প্রান্তিক ছাত্রছাত্রীদের শেখানোর পদ্ধতি নিয়ে ব্রাজিলিয় লেখকের কালজয়ী সৃষ্টি এই গ্রন্থ আজও আমার অবশ্যপাঠ্য। 

আমাদের অগ্রজদের থেকে শোনা, বাগচী স্যারের (একদিনের) এক নির্দিষ্ট সময় বরাদ্দ ছিল তাঁদের জন্য। একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজের তাগিদে হঠাৎ/ বিলম্বে তাঁর অফিসে হাজির। অফিস থেকে স্যারের কাছে বার্তা পাঠালে তিনি জানান, 'ওরা অপেক্ষা করুক। আমার কাছে ছাত্রছাত্রীদের সময় আগে। এখন হঠাৎ ওদের জন্য ছাত্রছাত্রীরা তার মাশুল দিতে পারে না।' ছাত্রছাত্রীদের ও তাদের সময়ের প্রতি দায়বদ্ধতার এরকম নজির সত্যি বলতে আমার জীবনে খুব কমই দেখেছি। উদারমনস্ক, মুক্তচিন্তায় বিশ্বাসী বাগচী কঠোর নিয়মশৃঙ্খলার ঘেরাটোপে জীবন তৈরিতে নিরাসক্ত ছিলেন। তাই একদিকে যেমন বেলুড় মঠের পড়া ছাড়তে বাধ্য হন, তেমনই আমাদের প্রিয় প্রতিষ্ঠান IDSK'কে এক মুক্তাঙ্গন হিসেবে আমাদের উপহার দিয়ে গেছেন। অধ্যাপক বাগচী ছাড়াও আমরা পেয়েছিলাম গবেষণা শেখার কিছু ব্যতিক্রমী শিক্ষক-গবেষক ও পরিমণ্ডল। 

বয়সে বৃদ্ধ হলেও মনের দিক থেকে তিনি ছিলেন চির কিশোর, তাই হয়তো আমাদের মতো শিক্ষানবিশদের থেকে বিভিন্ন বিষয়ে, বিশেষত ক্ষেত্র সমীক্ষা ও তা থেকে পাওয়া ফলাফলের ব্যাপারে মনোযোগ সহকারে শুনতেন, আমাদের মতামতের ওপর শিশুসুলভ তর্ক করতেন এবং তাতে সত্যিই অহংবোধ বা দমিয়ে দেওয়ার লেশমাত্র থাকত না। হরিয়ানা কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার যুক্ত হওয়ার সুবাদে দিল্লি ও গুরুগ্রাম কেন্দ্রিক বিভিন্ন বিশিষ্ট মানুষ ও তাঁর ছাত্রদের যোগাযোগ দিয়েছিলেন আমায়। 

নিয়মমতো ২৮ নভেম্বর সন্ধ্যায় আমার অন্যতম শ্রদ্ধেয় ও প্রিয় শিক্ষক অধ্যাপক প্রশান্ত রায়ের কুশল নেওয়ার সময় অমিয় স্যারের অসুস্থতার কথা বললাম। উনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, 'খুবই অসুস্থ! সামনে গিয়ে দেখা করলেও সংক্রমণ ছড়াতে পারে, তাই যেতে পারছি না!' ফোন রাখার কয়েক মিনিটের মধ্যেই ওনার আবার বার্তা, অধ্যাপক অমিয় বাগচী নেই! আমার নতুন কাজে যোগ দেওয়া ও সেখানকার অভিজ্ঞতার বিষয়ে শুনতে আমায় কোনও এক ছুটির সকালে দেখা করতে বলেছিলেন। নভেম্বরের সন্ধ্যার মলিনতা আমার জীবনের একটি সকাল গ্রাস করল! দেশ-সমাজ জীবনের চরম অনিশ্চয়তার অন্ধকারে আলোর দূত হয়ে আসা আমাদের প্রিয় শিক্ষক চলে গেলেন, আমরা অভিভাবকহীন হলাম! সামনে থাকল এক শোষণহীন সমাজ গঠনে তাঁর সুবিশাল কর্মজীবনে আমাদের জন্য রেখে যাওয়া আলোকবর্তিকা। 

অধ্যাপক বাগচীর মৃত্যুতে, শিক্ষাক্ষেত্রে ও আর্থসামাজিক উন্নয়নে ওনার বহুধা বিস্তৃত কাজের কিছু অংশ আন্তর্জাল ও সংবাদমাধ্যমের পাতায় উঠে এসেছে। বিস্তারিত নিচের এই লিঙ্কে পাওয়া যাবে- 

https://shorturl.at/JB2jy


Wednesday, 18 December 2024

অমৃতলোকে সংশপ্তক সাধক

স্বয়ং প্রজাপতির তুল্য

অমৃতা ঘোষাল


(৯ মার্চ ১৯৫১ - ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪)

'তুই হাততালি দিলে জ়াকির হোসেন

তবলা বাজানো ছেড়ে পায়রা পোষেন...'

(কবীর সুমন)

গায়কের এই অহেতুক স্বপ্ন গেল অস্তাচলে! অজস্ৰ শিল্পবেত্তার হৃৎস্পন্দনকে তীব্রভাবে আন্দোলিত করা সেই তবলার বোল আর বাজবে না। 'ওয়াহ তাজ' বলে চায়ের কাপে চুমুক দেওয়ার ভঙ্গিটিও আর তিনি বিনির্মিত করবেন না! তবলা বাজানোর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর কোঁকড়া কেশগুচ্ছের হিল্লোল পুরুষ-সৌন্দর্যের গতানুগতিক মাপকাঠিতে এক অন্য মাত্রা যোগ করেছিল। 

ওস্তাদ আল্লাহ রাখা'র (২৯ এপ্রিল, ১৯১৯ - ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০০০) সুপুত্র জ়াকির ধ্রুপদী শিল্প-সংস্কৃতির পরিসরে বেড়ে উঠেছিলেন। তবলাকে চিনেছিলেন সরস্বতীর রূপান্তর হিসেবেই। দৈনন্দিন জীবনচর্যার স্রোতের সঙ্গে গেঁথে নিয়েছিলেন তবলা-সাধনার অনুষঙ্গ। পিতা আল্লাহ রাখা'র শিক্ষা আর সহজাত অনুশীলন-ক্ষমতার প্রভাবে দক্ষ থেকে দক্ষতর হয়ে উঠেছিলেন। মাত্র সাত বছর বয়সেই পরিণত শিল্পীর মতো তবলা বাজাতে পারতেন; আর মাত্র বারো বছর বয়সেই জীবনের প্রথম কনসার্টটি যথেষ্ট সাফল্যের সঙ্গে করেন। বাবার সহযোগে এই উপস্থাপনাটি করে তিনি অর্জন করেন পাঁচ টাকা। মুম্বাইয়ে বেড়ে ওঠা জ়াকিরের স্কুল-জীবন কাটে সেন্ট মাইকেলস হাই স্কুলে। এরপর মুম্বাইয়েরই সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে অর্জন করেন স্নাতক ডিগ্রি। ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি থেকে সঙ্গীতের ওপর ডক্টরেট উপাধিও পেয়েছিলেন। 

পিতা আল্লা রাখা তাঁকে শিখিয়েছিলেন ভোরের সৌকুমার্য কীভাবে তবলার তানকে প্রভাবিত করে। তাই খুব ভোরেই তবলার সাধনা আরম্ভ হয়-- এমনটাই ছিল তাঁর অন্তরের বিশ্বাস। জ়াকিরের দুই ভাই তৌফিক কুরেশি ও ফজ়ল কুরেশিও ছিলেন তবলাবাদক। ষাটের দশকেই রীতিমতো খ্যাতির শিখরে পৌঁছতে থাকেন জ়াকির। তাঁর তবলার ভাষা শুধু সনাতন শিল্পের দর্পণ হয়ে ওঠে না, যেন বিশ্বজগতের সমস্ত ধ্বনিই ভর করে সেই ছান্দসিকের গতিময় আঙুলে। বায়া আর ডানের দ্বিরালাপে তিনতাল থেকে দাদরা কিংবা একতাল থেকে ঝাঁপতাল-- সর্বত্র ছিল সেই মায়াবী আঙুলের অবাধ গতি। তবলার ত্বকে মৃদু আঘাত করে আনতে পারেন ধাবমান অশ্বখুরের ধ্বনি, কখনও দ্রুতবেগে, কখনও বা মৃদু। রেলের  একঘেয়ে কু-ঝিকঝিক শব্দও তবলায় বিম্বিত করার ক্ষমতা রাখতেন জ়াকির। আবার সংক্ষিপ্ত মানবিক কথোপকথনকেও ফুটিয়ে তুলতেন চক্র-গৎ-বোলের বৈচিত্রে। তাঁর বাজানোর পদ্ধতিতে সম থেকে খালির মধ্যে ক্রিয়াশীল ছিল অজস্ৰ রেলা আর ফরমান। শুধুমাত্র বায়া বা ডুগির সাহায্যে গম্ভীর নাদ উৎপন্ন করে বিশ্বকে তাক লাগিয়েছিলেন। তাঁর বাম হাতের আঙুলের খেলায়, ধাতব আধারযুক্ত বায়ার চর্ম-পৃষ্ঠ থেকে জলদমন্দ্র ডম্বরুধ্বনি নির্গত হতে আরম্ভ করল। বিস্মিত-মন্ত্রমুগ্ধ শ্রোতারা অবিশ্বাস্য আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠল যখন ডমরুর সঙ্গে সঙ্গে ধ্বনিত হল শঙ্খনাদ। ডায়ার কৃষ্ণ-চক্রে অঙ্গুলি হেলিয়ে একেবারে সমুদ্র-শঙ্খকে বাজিয়ে তুলতে সমর্থ হলেন। সৃষ্ট হল এক ঐশ্বরিক মুহূর্ত! এ তো কোনও পুরাণ-ধর্মের খেলা নয়। জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে প্রকৃত শ্রোতারা অনুভব করলেন এ শিল্পী স্বয়ং প্রজাপতির তুল্য, কারণ ব্রহ্মাস্বাদ-সহোদর প্রীতি উৎপন্ন করার ক্ষমতা তাঁর ছিল। ষড়জ থেকে নিষাদের সুর সৃষ্টি করে এক বৈশ্বিক ঐকতান রচনা করতেন জ়াকির। পণ্ডিত রবিশঙ্কর আর ওস্তাদ আলী আকবর খানের সঙ্গে তিনি তবলার উপস্থাপনা করেছেন প্রায় প্রথম যৌবনকাল থেকেই। 

আসলে ছন্দকেও একটি বিশিষ্ট ভাষার গুরুত্ব দিতেন জ়াকির। তাই ধ্রুপদী সঙ্গীতের সঙ্গে যুক্ত যাবতীয় বাদ্যের স্পন্দনকে পর্যবেক্ষণ-বিশ্লেষণ আর অনুভব করতেন সম্যক নিষ্ঠার সঙ্গে। মৃদঙ্গ, পাখোয়াজ কিংবা কাঞ্জিরার সঙ্গে তবলার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে স্বীকৃতি দিতে চেয়েছেন সৎ শিল্পী হওয়ার অঙ্গীকারেই। পণ্ডিত শিবকুমার শর্মার সন্তুরের ঊর্মিমুখরতাকে তুলে ধরেছিলেন তাঁর তবলা-নিঃসৃত স্রোতে। পত্রী সতীশ কুমারের মৃদঙ্গ আর জ়াকিরের তবলার বোল যেন এক শাশ্বত গীতিকাব্য গড়ে তুলেছিল। হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া থেকে ঘনিষ্ঠ বন্ধু রাকেশ চৌরাসিয়ার বাঁশি উদ্দীপিত হয়ে উঠেছিল জ়াকিরের তবলার আলিঙ্গনে। ওস্তাদ আমজাদ আলী খানের সরোদের প্রতিটি তারে গেঁথে গিয়েছিল জ়াকিরের তবলার অভিঘাত। প্রণম্য কত্থকশিল্পী পণ্ডিত বিরজু মহারাজের পদবিভঙ্গ আর নৃত্যমুদ্রা আরও প্রকট হয়ে উঠেছিল জ়াকিরেরই তবলার ঝঙ্কারে। রাধা-কৃষ্ণের প্রেমালাপসিক্ত সংক্ষিপ্ত আখ্যানকেও বোল-মাধুর্যে আভাসিত করার প্রত্যয় ছিল তাঁর। মটকা বা হাঁড়ি, শ্রীখোল কিংবা ডাফলির ছন্দযতিকেও আয়ত্ত করে তবলার অনিবার্যতাকে দুনিয়ার খাস-দরবারে তুলে ধরেছিলেন জ়াকির। ওস্তাদ রশিদ খান থেকে গজ়ল-শিল্পী অনুপ জলোটার সঙ্গে দুর্দান্ত যুগলবন্দী রচনা করেছেন। সানাই-বীণার মতো অভিজাত বাদ্যের সমান্তরালে লোকায়ত বাদ্যের চলিষ্ণুতাকেও তিনি উপলব্ধি করেছিলেন।

১৯৭০'এ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস শুরু করেন জ়াকির। ১৯৭৯ সালে প্রায় সাত বছরেরও বেশি তাঁরই ব্যবস্থাপকের দায়িত্বে থাকা কত্থক নৃত্যশিল্পী ও শিক্ষক আনতোনিয়া মিনেকোলাকে বিয়ে করেছিলেন। এই প্রতিভায় দীপ্যমান দম্পতির দুই কন্যা-- আনিসা কুরেশি ও ইসাবেলা কুরেশি। তাঁরা যথাক্রমে চলচ্চিত্র নির্মাতা-প্রযোজক এবং নৃত্যশিল্পী। সম্ভবত জ়াকির-আনতোনিয়ার প্রেমবিবাহ ঘটার পথটি জাতিগত আর সামাজিক কারণে বিশেষ সুগম ছিল না বলেই গোপনে পরিণয়-পর্বটি মিটেছিল। 

নিউ ইয়র্কে থাকাকালীন বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই তবলাবাদক ১৯৭৩ সালে বিখ্যাত ব্রিটিশ গিটারিস্ট জন ম্যাকলফ্লিন-এর সঙ্গে মিলে 'শক্তি' ব্যান্ডের প্রতিষ্ঠা করেন। এই ব্যান্ডটি ভারতীয় ধ্রুপদী সঙ্গীতের দুরূহ তাল ও জ্যাজ়-সঙ্গীতের ইম্প্রোভাইজেশনের এক অভিনব সংমিশ্রণ তৈরি করেছিল। তাঁর সঙ্গে ব্যান্ডের অন্যান্য সদস্য, যেমন, বিখ্যাত বেহালাবাদক এল শঙ্কর এবং ঘটম-শিল্পী টিএইচ 'ভিক্কু' বিনায়করাম লয় আর সুরের এক অপূর্ব সমন্বয় তৈরি করেন। সত্তরের দশকে 'শক্তি' ব্যান্ডের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অ্যালবাম প্রকাশিত হয়, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য- 'Shakti with John McLaughlin' (১৯৭৬), 'A Handful of Beauty' (১৯৭৬), 'Natural Elements' (১৯৭৭)। এক দীর্ঘ বিরতির পর ১৯৯৭ সালে 'শক্তি' পুনরায় গঠিত হয় 'Remember Shakti' নামে। এই নতুনভাবে সেজে ওঠা ব্যান্ডের সঙ্গে যোগ দেন ম্যান্ডোলিন শিল্পী শ্রীনিবাস এবং কাঞ্জিরা-শিল্পী ভি সেলভগণেশ। ব্যান্ডের এই নতুন পর্বেও জ়াকির হুসেন সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এবং নতুন প্রজন্মের শ্রোতাদের মধ্যে ফিউশন সঙ্গীতের আবেদন বৃদ্ধি করেন। ২০২৩ সালে 'শক্তি' ৪৬ বছর পর তাদের প্রথম স্টুডিও অ্যালবাম 'This Moment' প্রকাশ করে। ব্যাপকভাবে প্রশংসিত এই অ্যালবামটি ২০২৪ সালের গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ডে Best Global Music Album বিভাগে পুরস্কার অর্জন করে। বর্তমানে এই ‘শক্তি’ ব্যান্ডের প্রধান কণ্ঠশিল্পী শঙ্কর মহাদেবন। 

পুরস্কার-প্রাপ্তির ক্ষেত্রেও জ়াকিরের প্রাপ্তিযোগ শিখরস্পর্শী। ১৯৮৮, ২০০২ ও ২০২৩ সালে যথাক্রমে পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ আর পদ্মবিভূষণ সম্মানে ভূষিত হন। একাধিকবার গ্র্যামি-পুরস্কার অর্জন করেছেন:

• ১৯৯২: 'Planet Drum' অ্যালবামের জন্য,  মিকি হার্টের সঙ্গে;

• ২০০৯: 'Global Drum Project' অ্যালবামের জন্য, যেখানে তিনি মিকি হার্ট, সিকিরু আদিপোজু এবং জিওভানি হিদালগোর সঙ্গে কাজ করেছিলেন;

• ২০২৪: ৬৬তম বার্ষিক গ্র্যামি পুরস্কারে তিনি তিনটি পুরস্কার লাভ করেন তাঁর 'Pashto' (বেলা ফ্লেক, এডগার মেয়ার এবং রাকেশ চৌরাসিয়া সহ), 'As We Speak' এবং 'This Moment' ('শক্তি' ব্যান্ডের সঙ্গে)-এর জন্য।

এছাড়াও ১৯৯৯ সালে পেয়েছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল এন্ডোউমেন্ট ফর দ্য আর্টস (NEA) দ্বারা প্রদত্ত ন্যাশনাল হেরিটেজ ফেলোশিপ। ২০২২'এ তাঁর প্রাপ্তি জাপানের ইনামোরি ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রদত্ত কিওটো পুরস্কার। এছাড়াও তাঁর সম্মাননার ঝুলিতে রয়েছে সঙ্গীত নাটক একাডেমি পুরস্কার (১৯৯০), কালিদাস সম্মান (২০০৬), মুম্বাই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রদত্ত এলএলডি ডিগ্রি (২০২২), সান ফ্রান্সিসকো জ্যাজ় সেন্টার কর্তৃক প্রদত্ত লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড (২০১৭) প্রভৃতি। ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তাঁকে হোয়াইট হাউসে আন্তর্জাতিক জ্যাজ় দিবসের গ্লোবাল কনসার্টে পারফর্ম করতে আমন্ত্রণ জানান। এই অনুষ্ঠানটি ৩০ এপ্রিল ২০১৬-এ অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবং বিশ্বব্যাপী সুরসাধক মানুষ জ্যাজ় সঙ্গীতের প্রভাব আত্মস্থ করে আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠেছিল। সেখানে ওস্তাদ জ়াকির হুসেনের অংশগ্রহণ ছিল একটি বিশেষ পাওনা, কারণ প্রথমবারের মতো কোনও ভারতীয় সঙ্গীতশিল্পী হোয়াইট হাউসে পারফর্ম করলেন, যা ভারত ও আমেরিকার মধ্যে সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধনকেও কূটনৈতিকভাবে দৃঢ় করেছিল। এই অনুষ্ঠানে বিশ্বের তাবড়-তাবড় সঙ্গীতশিল্পীরা অংশ নেন এবং জ়াকির হুসেনের উপস্থাপনা আন্তর্জাতিক সঙ্গীত পরিবেশনায় এক অনন্য ও চিরন্তন স্থান তৈরি করে। 

অভিনয়ের ক্ষেত্রেও চমকপ্রদভাবে কিছুটা পারদর্শিতা দেখিয়েছিলেন জ়াকির হুসেন। ১৯৭৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত 'সাজ' (SAAZ) চলচ্চিত্রে শাবানা আজমির প্রেমিকের চরিত্রে অভিনয়ের জন্য বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়েছিলেন। তাঁর ফিল্ম-কেরিয়ারে মোট ১২টি ছবি চোখে পড়ে। এর মধ্যে ১৯৮৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত শশী কাপুরের 'হিট অ্যান্ড ডাস্ট' ছিল অন্যতম। এছাড়াও তিনি 'দ্য পারফেক্ট মার্ডার' (১৯৮৮), 'থান্ডুভিটেন এনাই' (১৯৯১, তামিল), 'মিস বিটিস চিলড্রেন' (১৯৯২), 'জ়াকির অ্যান্ড হিজ় ফ্রেন্ডস' (১৯৯৮) এবং 'টর' (২০১৮) চলচ্চিত্রে তাঁর মনকাড়া উপস্থিতি ছিল। চলচ্চিত্র-নির্মাতা দেব প্যাটেলও তাঁর সাম্প্রতিক মুক্তিপ্রাপ্ত 'মাঙ্কি-ম্যান' (২০২৪) সিনেমায় জ়াকির হুসেনের তবলা বাজানোর দৃশ্য তুলে ধরেন। স্মর্তব্য যে, ১৯৯৪-এ ভারতীয় পত্রিকা 'জেন্টলম্যান'-এ 'সেক্সিয়েস্ট ম্যান' হিসেবে বিপুল ভোট পেয়ে অমিতাভ বচ্চনকেও হারিয়ে দেন জ়াকির।

সাঙ্গীতিক দুনিয়ার সংশপ্তক এই কালজয়ী শিল্প-অধীশ্বর ইডিওপ্যাথিক পালমোনারি ফাইব্রোসিসে আক্রান্ত হয়ে সান ফ্রান্সিসকোয় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। সেই অপূরণীয় বেদনা সর্বজনীন হয়ে ছড়িয়ে গেল দেশ-দেশান্তরে, তবলার বোলে যেন বেজে উঠল বিশ্বনাথ কবিরাজের 'সাহিত্যদর্পণ'এর অমোঘ সেই পঙক্তিটি: 'পরস্য ন পরস্যেতি, মমেতি ন মমেতি চ'...।


Tuesday, 17 December 2024

অতুল সুভাষ বিচার পাবেন?

গণহত্যা মঞ্চের পর্দা সরালেন অতুল সুভাষ

নন্দিনী ভট্টাচার্য



এ বছর আমরা পেরিয়ে এলাম আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবস পালনের ২৫ বছর, যা নিরবচ্ছিন্ন ভাবে শুরু হয়েছিল ১৯৯৯ সাল থেকে। এ এক সালতামামির সময়, যে আমরা কতটুকু এগোলাম। আন্দোলনে কী পেলাম-- এই ভাবনা সঠিক নয়; কী দিতে পারলাম বা কতটুকু সেই কাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারলাম, এমন ভাবনাই আরও বৃহত্তর আন্দোলনের জন্ম দেয়। 

এই পঁচিশ বছর পূর্তিতে ভারতবর্ষের বুকে ঘটে গেল এমন এক ঘটনা যা আমার এই লড়াইয়ের (যার বয়স এবার ৮ হল) সময়কালে দেখিনি এমন নয়, তবে তা নিয়ে সারা দেশকে এত কথা বলতে শুনিনি: এক পুরুষের আত্মহত্যা। 'পুরুষ' মানুষ তো! লিঙ্গ অন্য হলে এতক্ষণে 'দেশে দেশে সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে' এটা নিশ্চিত বলতে পারতাম। মানুষটির নাম অতুল সুভাষ। তিনি চলে গেছেন। বলা উচিত নিজেকে শেষ করে দিয়েছেন। পেছনে রেখে গেছেন এক ২৪ পাতার 'সুইসাইড নোট' ও একটি দেড় ঘণ্টার ভিডিও। এগুলোতেই নাড়া পড়েছে অনেকের, এতদিনের জেগে ঘুমোনো বিভিন্ন চিন্তাভাবনার গোড়ায়।

২০১৯ সালে বিয়ে হয় অতুল সুভাষ মোদী ও নিকিতা সিংহানিয়ার। কিছুদিন পর থেকেই শুরু হয় অতুল সুভাষের উপর মানসিক ও শারীরিক অত্যাচার। টাকার চাপ। এতে নিকিতার মা/ ভাই/ কাকা সবাই যুক্ত ছিলেন। এরপর অতুল ও নিকিতা'র সন্তান হয়। ধীরে ধীরে সে শিশু হয়ে ওঠে Emotional Blackmailing'এর হাতিয়ার। অতুল ও নিকিতা ইতিমধ্যে আলাদাও থাকতে শুরু করেছেন। সন্তানকে দেখতেও দেওয়া হত না অতুলকে (এটি বহু পুরুষের সঙ্গেই প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে)। ক্রমশ মানসিক/ অর্থনৈতিক নানা চাপে এক নিঃসীম অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। এরপর ৯ই  ডিসেম্বর ২০২৪, আত্মহত্যা করেন অতুল। বেঙ্গালুরুর নিজের বাড়িতে তাঁর মৃতদেহ পাওয়া যায়। ঘর থেকে একটা প্ল্যাকার্ডও পাওয়া যায় যাতে লেখা ছিল 'বিচার এখনও বাকি আছে'। আগেই লিখেছি তাঁর ২৪ পাতা সুইসাইড নোট ও দেড় ঘণ্টার ভিডিও'র কথা। ছেলের উদ্দেশ্যে লিখে যাওয়া অতুলের চিঠিটি আমি ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি প্রত্যেক পুরুষের অবশ্যপাঠ্য হওয়া উচিত। এই আত্মহত্যার ঘটনায় প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগে অতুল সুভাষের ভাই থানায় এফআইআর দায়ের করেছিলেন নিকিতা সিংঘানিয়া এবং তাঁর বাড়ির লোকদের বিরুদ্ধে। সম্প্রতি পুলিশ তাঁদের গ্রেফতার করেছে। 

অতুল আগে থেকেই নিকিতার সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ এবং সন্তানের হেফাজত নিয়ে আইনি জটিলতায় জড়িয়েছিলেন। তাঁর নিজের বাড়ি উত্তরপ্রদেশের জৌনপুর আদালতে এই মামলা চলছিল। পুলিশ জানিয়েছে যে নিকিতার কারণেই অতুল মানসিক কষ্টে ছিলেন। এমনকী এই মামলা তুলে নেওয়ার বিনিময়ে ৩ কোটি টাকার দাবিও জানিয়েছিল নিকিতার পরিবার। তাতে জড়িয়ে পড়েছিলেন এক বিচারক। তাঁর সম্পর্কেও FIR করা হয়েছে। ছেলেকে দেখার জন্য অতুলের কাছ থেকে ৩০ লক্ষ টাকাও চেয়েছিলেন নিকিতা, জানিয়েছে পুলিশ।

আমাদের (পুরুষ অধিকার কর্মীদের) সম্পর্কে যাঁরা এতকাল মনে করেছেন শুধুই Limelight পাওয়া বা নারী-পুরুষের সংসার ভেঙে দেওয়া বা নারীকে ছোট করে দেখাবার জন্য এই কাজটি করে চলেছি, তাঁরা হয়তো (?) সামান্য হলেও বুঝতে পারছেন যে তাঁরা ঠিক ছিলেন না (অবশ্যই যদি অতুলের ঘটনাটি জানেন, তবেই)। অতুলের নোটটি পড়লে বা ভিডিওটি শুনলে আপনারা জানতে পারবেন কী অমানুষিক মানসিক নির্যাতনের (হয়তো শারীরিকও) মধ্যে একজন পুরুষকেও যেতে হয়। কিন্তু বলার বা শোনার কেউ থাকে না। তাই উনি এইভাবে সারা দেশকে শুনিয়ে চলে যেতে বাধ্য হলেন। আমাদের দেশের বিচারব্যবস্থার একনায়কতন্ত্রও কি এর জন্য দায়ী নয়? এঁরা মধ্যস্থতা করতে আসেন ৩ কোটি টাকা আদায় বা সন্তানকে দেখার বিনিময়ে ৩০ লক্ষ টাকা দেবার অন্যায় আবদারে সীলমোহর দেবার জন্য! এ দেশ জুড়ে বহু নিরপরাধ/ নিরীহ/ সাধারণ বা অসাধারণ, উচ্চবিত্ত বা মধ্যবিত্ত পুরুষের মানসিক ও শারীরিক গণহত্যার যে মঞ্চ অনেকদিন ধরে তৈরি হয়েছে, সেই মঞ্চের পর্দা তুলে দিয়ে গেলেন অতুল নিজের জীবন স্বহস্তে বলি দিয়ে।

একটি জরুরি বিষয় মনে রাখতে হবে। বিশেষত যাঁরা পুরুষ অধিকার আন্দোলন নিয়ে সামান্যতমও আগ্রহী তাঁদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, ভারতবর্ষের পুরুষ অধিকার আন্দোলন এখন থেকে স্পষ্টতই দু' ভাগে ভাগ হয়ে গেল। একটি ভাগ অতুল সুভাষ'এর মৃত্যু পূর্ববর্তী, অন্যটি তাঁর মৃত্যু পরবর্তী। উনি দেখালেন, 'এভাবেও চলে যাওয়া যায়', আর আমাদের দিশা দেখিয়ে গেলেন এক নতুন লড়াই শুরুর; না থামার লড়াইয়ের। ওঁনার এই মৃত্যু যেন বৃথা না যায়, তা দেখার দায় আমাদের সবার। আশার কথা, গত ১৪ ডিসেম্বর এই বাংলা ও দেশের অন্যত্র বহু জায়গায় 'Reclaim the Night' আওয়াজ তুলে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বহু সাধারণ মানুষ অতুল সুভাষের বিচারের দাবিতে পথে নেমেছিলেন। আজ এ কথা সকলেই বুঝছেন যে, আইনি সুযোগ নিয়ে ও মিথ্যা অপবাদে নিছক পুরুষ হওয়ার কারণে পুরুষদের নির্বিবাদে অপদস্থ, হেনস্থা ও হত্যা করার যে প্রবণতা বিশেষত উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে, তার বিরুদ্ধে সদলবলে আওয়াজ তোলার সময় এসে গেছে।

আসলে পুরুষ মানুষ তাঁর জন্মলগ্ন থেকেই 'হয় রক্ষক, নয়তো ভক্ষক'-- এই দুই তকমাতেই আটকে থাকে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার সবচেয়ে বড় শিকার কিন্তু পুরুষমানুষ। তাঁর অসহায়তা বা চোখের জল দুই বড় করুণা ও লজ্জার। তাই আজ এগিয়ে আসতে হবে সবাইকে, নয়তো আমাদের বাবা, ভাই, স্বামী, পুত্র, প্রেমিক কাউকে হয়তো এই আইনি সন্ত্রাসবাদের কবল থেকে মুক্ত করা যাবে না। কাল বা পরশু সে হয়তো থাবা বসাবে আমার বা আপনার ঘরে!

যে দেশে পশু পাখির জন্য মন্ত্রণালয় আছে, পরিবেশ রক্ষায় আইন আছে, সে দেশে একটি পুরুষ কমিশন'এর দাবি এখন অত্যন্ত একটি ন্যায্য দাবি। আসুন, সবাই সে জন্য সওয়াল শুরু করি। নতুন করে শুরু হোক পথচলা, শুরু হোক কথা বলা।

(নন্দিনী ভট্টাচার্য, প্রেসিডেন্ট, অল বেঙ্গল মেনস ফোরাম: +917003624865/ +919903318148)


Tuesday, 10 December 2024

এই বৈঠক জরুরি ছিল

দু’ দেশের সম্পর্কে জনগণই চালিকাশক্তি

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য



গত এক মাসে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যকার সম্পর্কের অবনমন ও কিছু নেতিবাচক টানাপোড়েনের মধ্যে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিস্ত্রীর ৯ ডিসেম্বর ঢাকা সফর, সে দেশের সরকারের সঙ্গে তাঁর আলোচনা ও পরবর্তীতে আশাপ্রদ বিবৃতি প্রদানে মনে হতে পারে যে বহমান চাপা উত্তেজনার এবার কিছুটা অবসান হবে। সবচেয়ে বড় কথা, দুই দেশের আলোচনায় কোনও তিক্ততা উঠে আসেনি, দুই তরফেই কিছু উদ্বেগ প্রকাশ পেয়েছে মাত্র (যার হয়তো কিছু ভিত্তিও আছে) এবং দু’ পক্ষই মার্জিত ও বন্ধুসলুভ বিবৃতি দিয়ে প্রতিবেশিসুলভ আচরণ করেছে। আপাতদৃষ্টিতে এই বৈঠক আগামী দিনের পক্ষে ইতিবাচক।

কিন্তু এ দেশের গোদি মিডিয়া দেখলে মনে হবে, বাংলাদেশ যেন একেবারে উচ্ছন্নে চলে গেছে, সেখানে সংখ্যালঘুরা ভীষণ ভাবে অত্যাচারিত ও বিপন্ন এবং প্রতিনিয়ত গণ্ডগোল ও সংঘর্ষ লেগে রয়েছে। কেউ কেউ বললেন, ‘এবিসি নিরানন্দ’ টিভি চ্যানেল খুললে বোঝাই যাচ্ছে না যে তাদের দফতর কলকাতা না ঢাকায় অবস্থিত; সারাদিন, সারাক্ষণ বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে রুদালি চলেছে। ‘ঢিপাবলিক’ চ্যানেল তো ঢিল ছুঁড়েই ব্যবসা করে, তাদের বাংলাদেশ নিয়ে চিল-চীৎকার যে কহতব্য নয়, তা বলাই বাহুল্য। আর সেই তালেই নেচেকুঁদে এ রাজ্যের বিরোধী নেতা পেট্রাপোল সীমান্তে গিয়ে দু-দেশের ব্যবসা বন্ধের হম্বিতম্বি করে (যদিও প্রায় স্বভাবিক গতিতেই সীমান্ত দিয়ে বাণিজ্য পরিবহন চলেছে), তারপর রণে বঙ্গ দিয়ে এখন হাঁক পেড়েছে যে ‘শেখ হাসিনাই বাংলদেশের বৈধ প্রধানমন্ত্রী’। অথচ তারই দল পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকারের পররাষ্ট্র সচিব বাংলাদেশে গিয়ে বৈঠক করে এলেন হাসিনার জমানার বিরুদ্ধে জনঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে যারা ইতিমধ্যে হাসিনাকে গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত করেছে। তাহলে কি পররাষ্ট্র সচিব ঢাকায় এক ‘অবৈধ’ সরকারের সঙ্গে বৈঠক করে ফিরলেন? বিরোধী নেতা অধিকারীবাবুর বক্তব্য কি সে ক্ষেত্রে ভারত সরকার বিরোধী? এই বক্তব্যের জন্য দল বা সরকার কি তার বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে?

উল্লেখ্য, পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিস্ত্রী তাঁর বিবৃতিতে এও বলেছেন যে, দু’ দেশের সম্পর্কে জনগণই চালিকাশক্তি এবং অতীতের মতো ভবিষ্যতেও এই সম্পর্ক গণ-কেন্দ্রিক ও গণমুখি ভিত্তির ওপরেই দাঁড়িয়ে থাকবে। অর্থাৎ, দু’ দেশেই সরকারি ক্ষমতায় যখন যেই আসুক না কেন, উভয় দেশের মধ্যে সুসম্পর্কে কোনও বাধা পড়ার কথা নয়। ফলত, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রকের উপদেষ্টা মহঃ তৌহিদ হোসেন ভারতের মাটিতে গণহত্যাকারী শেখ হাসিনা’র বসবাস সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করতে পেরেছেন, কারণ, তা প্রকারান্তরে সে দেশ থেকে পলাতক এক রাজনৈতিক নেত্রীকে আশ্রয় দেওয়ার সামিল এবং প্রত্যার্পণের নীতিতে তাঁকে নিজ দেশে ফেরত পাঠানোই দস্তুর। বলাই বাহুল্য, বিভিন্ন দেশের মধ্যে সরকারি স্তরে নানা ধরনের কূটনৈতিক আদানপ্রদান ও বার্তালাপ থাকবে, বাণিজ্যরীতি ও যাওয়া-আসারও বিধিব্যবস্থা থাকবে, কিন্তু, মানুষে মানুষে যদি বিশ্বাস ও আস্থার সূত্রটি নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে তার থেকে বেশি বিপজ্জনক আর কিছু হতে পারে না। আর সেই সুযোগটাকেই কাজে লাগায় ধুরন্ধর মৌলবাদী শক্তিসমূহ। আজ বাংলাদেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে এই উপমহাদেশে ঘনায়মান পটভূমিতে তেমনই কিছু ইঙ্গিত যেন স্পষ্ট।

৫ অগস্ট যেদিন শেখ হাসিনা গণ অভ্যুত্থানের ব্যাপ্তি ও বিস্ফোরণে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেলেন, সেদিন থেকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যা কিছু ঘটেছে তা একান্তই সে দেশের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার। সেই সব ঘটনাবলীর দিকে সারা বিশ্বের নজর ছিল। প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারতের নজর ছিল আরও নিবিড়; বিশেষত একই ভাষা-সংস্কৃতির কারণে পশ্চিমবাংলার মানুষেরা আরও কড়া নজর রেখেছেন। ভারত-বাংলাদেশ দুই রাষ্ট্র গঠনে যেহেতু দু’ জায়গাতেই ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অবস্থান ও অংশীদারিত্বের প্রশ্নটি একটা কমন ফ্যাক্টর, যার স্পর্শকাতরতা আজও কমবেশি থেকে গেছে, তাই খুব স্বাভাবিক যে বাংলাদেশে হাসিনা পরবর্তী আমলে এই বিষয়টি কতটা হানিকর হল বা হল না, তা নিয়ে তীব্র কৌতূহল ও উৎকণ্ঠা থাকবে। চূড়ান্ত গণ অভ্যুত্থানের পর কিছু কিছু সংখ্যালঘু মানুষের ওপরে যে আক্রমণ নেমে আসেনি তাও নয়, অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে আওয়ামী লিগ’এর সমর্থক হিসেবে বহুজনের ওপর নির্যাতন হয়েছে যারা হিন্দু (তারা হিন্দু বলে তাদের ওপর আক্রমণ হয়নি)। যদিও আওয়ামী লিগের মুসলমান কর্মীরাও বহু জায়গায় আক্রান্ত হয়েছেন কিন্তু হিন্দু সদস্য বা সমর্থকের ওপর আক্রমণকে কোনও কোনও মহল থেকে ‘হিন্দুদের ওপর আক্রমণ’ বলে চিত্রায়িত করা হয়েছে। যদিচ, এই ধরনের রাজনৈতিক হামলাও নিন্দনীয়, কিন্তু সেই অজুহাতে তাকে সাম্প্রদায়িক মোড়ক দেওয়াটা ভয়ঙ্করজনক ভাবে কুৎসিত। অবশ্য, এ ব্যতিরেকে বেশ কিছু জায়গায় সংখ্যালঘু খ্রিস্টান-বৌদ্ধ-হিন্দু এবং কিছু মন্দির-মাজারে সংখ্যালঘু বলেই আক্রমণ হয়েছে, কিন্তু তা তত ব্যাপক নয়। অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হওয়ার পর এই ধরনের ঘটনা ক্রমেই কমে আসে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ছাত্র-যুবদের পাহারাদারিতে তা আরও প্রশমিত হয়। কিন্তু নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে ইস্কনের জনৈক সাধু চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে (যদিও বাংলাদেশ ইস্কন এই সাধুকে বেশ কিছুদিন আগেই শিশু নির্যাতনের অভিযোগে তাদের সংগঠন থেকে বহিষ্কার করেছে বলে প্রেস বিবৃতি দিয়ে জানায়) গ্রেফতারির পর যেন নতুন করে এক হৈচৈ শুরু হয়।

চট্টগ্রামে বাঙালি-পাহাড়ী একটা বিবাদ চলছিল। তার উপর সেখানকার সংখ্যালঘু জোটের মানুষজনও সংঘবদ্ধ হয়ে মিছিল-মিটিং করছিলেন। অভিযোগ, এই মিছিল-মিটিং-বিক্ষোভের সময় চিন্ময় দাস ও তাঁর কিছু সহযোগী বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার অবমাননা করেন এবং একটি গেরুয়া পতাকা তার ওপর টাঙিয়ে দেন। এই অভিযোগে চিন্ময় দাস ও তাঁর কতিপয় সঙ্গীকে পুলিশ ‘রাষ্ট্রদ্রোহের’ অভিযোগে গ্রেফতার করে আদালতে পেশ করে। আদালত চত্বরে চিন্ময় দাসের মুক্তির দাবিতে জনবিক্ষোভের রোষে সাইফুল ইসলাম নামে এক আইনজীবী আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে মারা যান। এই ঘটনা গোটা পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করে তোলে। চিন্ময় দাসের গ্রেফতারির প্রতিবাদে কলকাতা ইস্কন থেকে নিন্দামূলক বিবৃতি দেওয়া হয় এবং বিবিধ হিন্দু সংগঠন কলকাতা ও অন্যত্র মিছিল বের করে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীও প্রতিবাদ জানান, বিজেপি ‘সংখ্যালঘু নির্যাতনের’ অভিযোগ তুলে সর্বশক্তি দিয়ে হৈ-হট্টগোল শুরু করে দেয়। আর ঠিক এই সময় থেকেই ‘এবিসি নিরানন্দ’ ও ‘ঢিপাবলিক’ টিভি আদাজল খেয়ে নেমে পড়ে বাংলাদেশে ‘সংখ্যালঘু নির্যাতনের প্রতিবেদন’ নিয়ে। তবে, তাদের তরফে সব সময় যে তেমন তথ্যনিষ্ঠ খবর বা ভিডিও প্রচার করা গেছে তা নয়, কিছু পুরনো ও ফেক ভিডিও দিয়ে কাজ সারতে হয়েছে। কারণ, খানিক অনুসন্ধান করলেই দেখা যাবে যে, বাংলাদেশে গত দু-তিন মাসে সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ তেমন ব্যাপক ভাবে কিছু হয়ইনি।

পেট্রাপোল সীমান্তে টিভি চ্যানেলের সাংবাদিকরা দাঁড়িয়ে আছেন এই ছবি তুলতে যে সংখ্যালঘুরা সব দলে দলে বাংলাদেশ ছেড়ে পালিয়ে আসছে। সে সব ছবি তো পাওয়া যায়ইনি বরং যে দু-একজন বাসে করে কোনও কাজে ভারতীয় সীমান্তে সবে এসে পৌঁছেছেন, তাঁরাও সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে খুব কিছু বিপদ বা আক্রমণের কথা শোনাতে পারেননি; সাংবাদিকদের চোখা চোখা প্রশ্নের সামনে পড়ে, ‘হ্যাঁ, আশঙ্কা তো একটা আছে’, এই ধরনের অস্পষ্ট কিছু মন্তব্য করে পালিয়ে বেঁচেছেন। সম্ভবত আমাদের কেন্দ্রীয় সরকারও তাদের গোয়েন্দা ও অন্যান্য সূত্রে তেমন কোনও সংখ্যালঘু নিপীড়নের হদিশ পায়নি, ফলে, তারা তড়িঘড়ি পররাষ্ট্র সচিবকে সে দেশে পাঠিয়ে আসলে গোদি মিডিয়ার উন্মাদ আচরণকে ধামাচাপা দিতে চেয়েছে। শোনা যাচ্ছে, পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিস্ত্রী নাকি এ কথাও বলেছেন যে, মিডিয়া কী বলছে তাতে সরকারের কোনও হাত নেই। অনুমান করি, নিপীড়নের তেমন কোনও বিস্তৃত তথ্য থাকলে তা পররাষ্ট্র সচিব নিশ্চয়ই পেশ করতেন।

অথচ, আমাদের দেশে মণিপুর পুড়ছে। সম্বল জ্বলছে (ইতিমধ্যেই সেখানে পাঁচজন সংখ্যালঘুকে হত্যা করা হয়েছে)। উত্তরপ্রদেশ হাইকোর্টের বিচারপতি বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সভাতে গিয়ে প্রকাশ্যে বলছেন, এখানে থাকতে হলে হিন্দুবাদীদের কথা শুনেই চলতে হবে। একে একে সব মসজিদের তলা থেকেই নাকি পাওয়া যাচ্ছে শিবলিঙ্গ বা মন্দিরের ভগ্নাবশেষ। অর্থাৎ, ভবিষ্যতে আবার মন্দির পুনরুদ্ধারের রাজনীতিই মুখ্য হবে। তাই, আমরা যদি বাংলাদেশের দিকে নিশানা তাক করতে পারি, তাহলে এ দেশের নিপীড়নের ছবিগুলিকে বেমালুম হাওয়া করে দেওয়া যেতে পারে-- রাজনৈতিক কৌশলটাকে এমন করারই চেষ্টা চলেছে। কিন্তু সমস্যা হল, আজকাল মানুষ আর শুধু টিভি দেখে না, তার সামনে এখন খবর ও বিশ্লেষণের সহস্র সূত্র। উপরন্তু, তারা নিজেরাও এখন বিশ্লেষক ও পাহারাদার। অতএব, মিথ্যা খবর ও গুজব ছড়িয়ে কেল্লা ফতে করা খুবই শক্ত।

মুখ্য কথাটা হল, যদি দেশের সরকার বর্ণ-ধর্ম-লিঙ্গ-জাতি নির্বিশেষে সকল মানুষকে একসঙ্গে নিয়ে রামধনু সমাজের ন্যায্যতাকে মান্যতা দেয়, তাহলে বিপথগামী বা নাশক শক্তি চেষ্টা করলেও খুব বেশি দূর সফল হতে পারে না। বাংলাদেশে বিচ্ছিন্নভাবে যে অন্যায় ঘটনাগুলি ঘটেছে বা ঘটছে, মালুম হচ্ছে, বর্তমানের অন্তর্বর্তী সরকার চেষ্টা করছে সেগুলিকে প্রতিরোধ করার। তার মানে অবশ্য এমন ভাবার কোনও কারণ নেই যে এই সরকারে সকলেই উদার মনোভাবাপন্ন মানুষ। লড়াইটা চলছে, চলবে। কিন্তু আমাদের দেশের সংখ্যালঘু নির্যাতন প্রতিরোধে কেন্দ্রীয় বা বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলির সরকার সামগ্রিক ভাবে কতটা আন্তরিক? নাকি, তারা ইন্ধনদাতাও? এখানেও লড়াইটা চলছে, চলবে।

ভারত ও বাংলাদেশ উভয়তই শান্তি ও সম্প্রীতি বিরাজ করুক। স্ব স্ব সার্বভৌমত্ব রক্ষা পাক। প্রতিবেশিসুলভ আত্মীয়তা বজায় থাকুক।