একজন দার্শনিক ও আদর্শ শিক্ষক
বিনয় কৃষ্ণ পাল
(১৯৩৬ - ২৮ নভেম্বর ২০২৪)
আমৃত্যু মানবতাবাদী ও বামপন্থী অর্থনীতিবিদ শুধু নয়, একজন দার্শনিক, আদর্শ শিক্ষক এবং মানুষ হিসেবে আমাদের কাছে ধরা দিয়েছিলেন অধ্যাপক অমিয় কুমার বাগচী। এমফিল পড়ার সময়েই দেখেছি, এত বড় মাপের একজন মানুষ মাটির কাছাকাছি থেকে ছাত্রছাত্রীদের বোধগম্য করে শেখাতেন, তাদের সঙ্গে সতত যোগাযোগ, আত্মীয়সূচক ব্যবহার ও পরিচর্যার মাধ্যমে তাদের বড় হয়ে উঠতে সাহায্য করতেন। দেখা হলে প্রথমেই, 'কেমন আছো বিনয়?', কেমব্রিজ ছেড়ে আসা এক অধ্যাপকের সাথে এক সাধারণ ছাত্রের সমস্ত মানসিক দূরত্বের অবসান ঘটিয়ে দিত।
একমুখি বই-নির্ভর পড়ানোর বদলে দেশ-বিদেশের নানা সাহিত্য, সিনেমা, ঘটনা, গল্পের মাধ্যমে আমাদের শেখার পরিধি বহুধা বিস্তৃত করেছিলেন তিনি। ২০১৪ সালে IDSK'এর পড়া শেষ হলেও, ওই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, কর্মী ও স্যারের সাথে যোগাযোগ রাখি। ২০১৫ সালে ওনার স্ত্রী মারা যাওয়ার পর জানতে পারি তিনি কিছুটা একাকিত্বের মধ্যে রয়েছেন। সেই সূত্রে মাঝে মধ্যেই তিনি আমায় বাড়িতে ডাকতেন। স্যারের বাড়ির এক সহায়ক একদিন রাত্রে আমায় খাবার পরিবেশন করতে গিয়ে খাবার পাতে এক খণ্ড ইলিশ মাছ তুলে দেন। কয়েক মিনিটের মধ্যেই সেই ইলিশ উদরস্থ করি। খেতে খেতেই এক দিকে কথা বলছি, অন্যদিকে চোখ প্লেটে পড়ে থাকা আরও দুই খণ্ড ইলিশের দিকে। স্যার বুঝতে পেরেই বলেন, 'ওই দুটিও তোমারই জন্য!' শুনে আমার চোখে আনন্দ ফুটে ওঠে এবং উনি হাসতে হাসতে বলেন, 'বাঙালিকে মাছ এবং মূলত ইলিশ দেখে চেনা যায়!' খাওয়ানোর তৃপ্তি ও রসিকতা আমায় আপ্লুত করে, যা আজও স্মৃতিতে বয়ে নিয়ে চলেছি। একান্ত সেই আড্ডাগুলিতে আরও পরিশীলিত হয়েছে আমার অর্থনীতি, ইতিহাস ও রাজনীতির জ্ঞান। বারবার বলতেন শুম্পেটার, মার্কস, স্মিথ, অমর্ত্য সেন, রবীন্দ্রনাথকে পড়তে, বুঝতে, লিখতে, 'পড়তে ও লিখতে লিখতেই হাতে লেখা আসে।' উৎসাহ দিতেন-- যা পড়ছি, সঠিক বলে ভাবছি, তা মুক্তকণ্ঠে-নির্ভয়ে বলতে।
ওনাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, পূর্ব ভারতে সেন্টারের (কলকাতার 'সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস') মতো ঐতিহ্যশালী সমাজ বিজ্ঞান চর্চার একটি প্রতিষ্ঠান থাকলেও IDSK তৈরি করার পিছনে আপনাদের কী চিন্তা-ভাবনা ছিল? উত্তরে বলেছিলেন, 'আমাদের সাধারণ কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সহ গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলির সমাজ বিজ্ঞানের যে চর্চা হয় তা অনেক ক্ষেত্রেই তাত্ত্বিক এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে তার যোগাযোগ খুবই কম। তথ্য সংগ্রহে নানা কারচুপি, ছল-চাতুরি থাকায় অনেক ক্ষেত্রেই প্রকৃত বাস্তব উঠে আসে না! IDSK তৈরি এবং ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ কোর্সের মাধ্যমে আমরা একদিকে একটি উন্নততর সমাজ গঠনে জ্ঞান চর্চা, তাত্ত্বিক সমাজ বিজ্ঞান চর্চা এবং বর্তমান সমাজের নানা জনগোষ্ঠী, প্রান্তিক মানুষজন, পরিবেশ এবং সর্বোপরি মাটির সঙ্গে মেলবন্ধন তৈরি করতে চেয়েছিলাম। তোমরা যদি ক্রমাগত ফিল্ড ওয়ার্ক করে, যাচাইযোগ্য তথ্য ও ঘটনার মাধ্যমে একদিকে আর্থিক ও সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষ ও বর্তমান সময়ের সমস্যা তুলে ধরতে পারো এবং তাদের সমস্যায় পাশে গিয়ে দাঁড়াতে পারো, তাহলে আমাদের উদ্দেশ্য সফল হবে।' গরিব কৃষকদের থেকে বহুফসলি জমি কেড়ে শিল্পায়নের বিরোধী ছিলেন অধ্যাপক বাগচী। মূলত অর্থনীতির অধ্যাপক হলেও জ্ঞানের বিস্তৃত পরিসরে অবাধ যাতায়াত ছিল তাঁর।
সদ্য কিছুদিন কলেজে পড়ানোর সুবাদে ওনাকে জানিয়েছিলাম, 'আমার কলেজগুলির অধিকাংশ ছাত্র-ছাত্রী খুব প্রান্তিক স্তর থেকে আসা, ওদের শেখানোর ক্ষেত্রে আমার তরফ থেকে অনেক সমস্যা বোধ করছি, মনে হচ্ছে ওদের কাছে ঠিকভাবে পৌঁছতে পারছি না।' নানা অভিজ্ঞতা ভাগ করার সুবাদে তিনি আমায় কিছু পরামর্শ দেন ও IDSK লাইব্রেরি থেকে আমার হাতে একটি অসামান্য বই তুলে দেন: The Pedagogy of The Oppressed। উন্নয়নশীল ও বিপুল বৈষম্যের দেশে শিক্ষক-শিক্ষণ, প্রান্তিক ছাত্রছাত্রীদের শেখানোর পদ্ধতি নিয়ে ব্রাজিলিয় লেখকের কালজয়ী সৃষ্টি এই গ্রন্থ আজও আমার অবশ্যপাঠ্য।
আমাদের অগ্রজদের থেকে শোনা, বাগচী স্যারের (একদিনের) এক নির্দিষ্ট সময় বরাদ্দ ছিল তাঁদের জন্য। একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজের তাগিদে হঠাৎ/ বিলম্বে তাঁর অফিসে হাজির। অফিস থেকে স্যারের কাছে বার্তা পাঠালে তিনি জানান, 'ওরা অপেক্ষা করুক। আমার কাছে ছাত্রছাত্রীদের সময় আগে। এখন হঠাৎ ওদের জন্য ছাত্রছাত্রীরা তার মাশুল দিতে পারে না।' ছাত্রছাত্রীদের ও তাদের সময়ের প্রতি দায়বদ্ধতার এরকম নজির সত্যি বলতে আমার জীবনে খুব কমই দেখেছি। উদারমনস্ক, মুক্তচিন্তায় বিশ্বাসী বাগচী কঠোর নিয়মশৃঙ্খলার ঘেরাটোপে জীবন তৈরিতে নিরাসক্ত ছিলেন। তাই একদিকে যেমন বেলুড় মঠের পড়া ছাড়তে বাধ্য হন, তেমনই আমাদের প্রিয় প্রতিষ্ঠান IDSK'কে এক মুক্তাঙ্গন হিসেবে আমাদের উপহার দিয়ে গেছেন। অধ্যাপক বাগচী ছাড়াও আমরা পেয়েছিলাম গবেষণা শেখার কিছু ব্যতিক্রমী শিক্ষক-গবেষক ও পরিমণ্ডল।
বয়সে বৃদ্ধ হলেও মনের দিক থেকে তিনি ছিলেন চির কিশোর, তাই হয়তো আমাদের মতো শিক্ষানবিশদের থেকে বিভিন্ন বিষয়ে, বিশেষত ক্ষেত্র সমীক্ষা ও তা থেকে পাওয়া ফলাফলের ব্যাপারে মনোযোগ সহকারে শুনতেন, আমাদের মতামতের ওপর শিশুসুলভ তর্ক করতেন এবং তাতে সত্যিই অহংবোধ বা দমিয়ে দেওয়ার লেশমাত্র থাকত না। হরিয়ানা কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার যুক্ত হওয়ার সুবাদে দিল্লি ও গুরুগ্রাম কেন্দ্রিক বিভিন্ন বিশিষ্ট মানুষ ও তাঁর ছাত্রদের যোগাযোগ দিয়েছিলেন আমায়।
নিয়মমতো ২৮ নভেম্বর সন্ধ্যায় আমার অন্যতম শ্রদ্ধেয় ও প্রিয় শিক্ষক অধ্যাপক প্রশান্ত রায়ের কুশল নেওয়ার সময় অমিয় স্যারের অসুস্থতার কথা বললাম। উনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, 'খুবই অসুস্থ! সামনে গিয়ে দেখা করলেও সংক্রমণ ছড়াতে পারে, তাই যেতে পারছি না!' ফোন রাখার কয়েক মিনিটের মধ্যেই ওনার আবার বার্তা, অধ্যাপক অমিয় বাগচী নেই! আমার নতুন কাজে যোগ দেওয়া ও সেখানকার অভিজ্ঞতার বিষয়ে শুনতে আমায় কোনও এক ছুটির সকালে দেখা করতে বলেছিলেন। নভেম্বরের সন্ধ্যার মলিনতা আমার জীবনের একটি সকাল গ্রাস করল! দেশ-সমাজ জীবনের চরম অনিশ্চয়তার অন্ধকারে আলোর দূত হয়ে আসা আমাদের প্রিয় শিক্ষক চলে গেলেন, আমরা অভিভাবকহীন হলাম! সামনে থাকল এক শোষণহীন সমাজ গঠনে তাঁর সুবিশাল কর্মজীবনে আমাদের জন্য রেখে যাওয়া আলোকবর্তিকা।
অধ্যাপক বাগচীর মৃত্যুতে, শিক্ষাক্ষেত্রে ও আর্থসামাজিক উন্নয়নে ওনার বহুধা বিস্তৃত কাজের কিছু অংশ আন্তর্জাল ও সংবাদমাধ্যমের পাতায় উঠে এসেছে। বিস্তারিত নিচের এই লিঙ্কে পাওয়া যাবে-