চোখে দেখা হাল হকিকত
মালবিকা মিত্র
'তোমাকে দেখেই বুঝতে পারছি ২০০২ সালে তোমার ভোটের বয়েস হয়নি। এবার বলো, তোমার বাবা-মা কার নাম ছিল? সেই কাগজ এনেছো?'
আমার সামনে দাঁড়ানো নির্বাচক পটল বাগদি এসআইআর ফর্ম পূরণ করতে এসেছে। তার সোজা উত্তর, অত সব তো আমি জানি না, আর মা-বাবাও তো কেউ বেঁচে নেই। তারপর জানালো তার এক দাদা আছে, বর্ধমানে থাকে। অম্বলগ্রামে ওরা থাকত। মা-বাবাও ওখানেই ছিল। পটল ভদ্রেশ্বর আসত জমির কাজ করতে। তারপর এখানেই দুলির সাথে আলাপ, প্রেম, বিয়ে ও স্থায়ী বসবাস। অম্বলগ্রাম কোথায় সে বলতে পারে না, কোন বিধানসভা জানে না, কোন ভোটকেন্দ্র তাও জানে না। বলতে পারলে হয়তো নেট ঘেঁটে বিধানসভা ঘেঁটে খুঁজে বের করে দেওয়া যেত। সে ওসব কিছুই জানে না। শুধু জানে অম্বলগ্রাম আর বর্ধমান। মা-বাবা মরে যাওয়ার পর সে আর কখনও অম্বলগ্রামে যায়নি।
নেট সার্চ করে জানা গেল, 'অম্বলগ্রাম একটি গ্রাম এবং এটি পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব বর্ধমান জেলার কেতুগ্রাম-২ সমষ্টি উন্নয়ন ব্লকের অন্তর্গত ও কেতুগ্রাম থানার অধীনে থাকা গ্রামগুলির মধ্যে একটি। অম্বলগ্রামে একটি রেলওয়ে স্টেশনও রয়েছে।' এরপর ২০০২ সালের কেতুগ্রাম বিধানসভার ভোটার তালিকা। সেখান থেকে অম্বলগ্রাম থানা ঠিকানায় বুথে বুথে অনুসন্ধান। কারণ, পটল বাগদি জানে না কোন স্কুলে তার বাপ-ঠাকুরদা ভোট দিত। এই কাজ পটল বাগদির পক্ষে করা অসম্ভব। আর সম্ভব না হলে তাকে উটকো অবৈধ ভোটার বলা হবে। কারণ, তার নাম উঠেছে ২০১৯ সালে। সে তো পুরনো ট্র্যাক রেকর্ড দেখাতে পারছে না।
তৃণমূল দলের এসআইএর হেল্প ডেস্কের সামনে দাঁড়িয়ে এইসব দেখছিলাম। জনৈক টুসি মাঝি এসেছেন ফর্ম ফিল আপ করতে। তার শ্বশুরবাড়ি এখানেই। তাদের ট্র্যাক রেকর্ডে ২০০২ সালে নাম পাওয়া গেল। কিন্তু টুসি বিয়ে হয়ে এসেছে বড়ঞা থেকে। সে ভোটার লিস্টের ওই নির্দিষ্ট পাতাটি সংগ্রহ করেছে। সেখানে তার মা-বাবার নাম আছে। এবার টুসি'কে যখন প্রশ্ন করা হল, তার মায়ের নাম কী, তার বাবার নাম কী? সে বিস্ময়ের সঙ্গে তাকিয়ে আছে। কারণ, সে তো আম্মু-আব্বুকে কোনও নামে চেনে না। সে আম্মু-আব্বু বলেই জানে। কোথাও তো তাকে আজ পর্যন্ত এই প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়নি। হেল্প ডেস্কের স্বেচ্ছাসেবকের প্রশ্ন, মা বাবার নাম কী? টুসি বলে, ওই তো, ওই কাগজে লিখ্যা আছে, দেইখে নিন। স্বেচ্ছাসেবক বলে, দেখব তো বটেই, নামটা তো বলতে হবে। বলে ওই তো ওই কাগজে লিখা আছে। ওই কাগজে আসলে যে ৪০ জন বাবা-মার নাম লেখা আছে, সেটাও সে বোঝে না।
এরাই তো হবে এসআইআর'এর বলির পাঁঠা। একজন নির্বাচক সুফল বলল, ২০০২ সালে আমার তো নাম ছিল না। আমার মায়ের নাম ছিল। বাবা তো সেই কবেই আমার দুই বছর বয়সে মারা গেছে। মায়ের নাম ফেলু বিবি, গ্রামের কেউ কেউ ফুলি বিবি বলেও ডাকে। এই যে ২০০২'এর ভোটার লিস্ট এনেছি। এখানে নাম আছে। অনেক খুঁজে ভুলি বিবি, ফেলনা বিবি এসব নাম পেলাম কিন্তু ফেলু বিবি আর পাই না। অবশেষে সুফলের মেয়ে যে এখন সবে ক্লাস ফাইভ, সে দেখিয়ে বলল, ওই তো লিস্টিতে ফেলু বিবি লেখা আছে। দেখলাম একজন নির্বাচক ডালিম, তার আত্মীয়ের নামের জায়গায় লেখা আছে ফেলু বিবি, নির্বাচকের জায়গায় নেই। সুফলের ছোট মেয়ে বলে ওটাই তো, ডালিম আমার চাচা কিন্তু চাচার নাম তো প্রমাণ হিসেবে দেখানোর অধিকার আমাকে দেওয়া হয়নি।
বাড়ির মহিলাদের পক্ষে নিজের মা-বাবা, দাদু-ঠাকুমার ২০০২'এর ভোটার তালিকা, নাম তথ্যপ্রমাণ হিসেবে হাজির করা খুব সমস্যার। যেহেতু তারা বিয়ে হয়ে স্থানান্তরিত হয়েছে, একটা পরিচয় ছেড়ে এসেছে। দ্বিতীয়ত, গ্রামীণ সম্পর্কে বা বলা যায় নিম্নবর্গের সম্পর্কের মধ্যে কোনও একটি পোশাকি নাম নয়, মুখে মুখে ক্যাবলা মামা, হাবাদা, গজাদা, ভজাকা, জটাধারী দাদু, ছোলামটর মামা, ঘটি গরম দাদা ইত্যাদি নাম এত বেশি পরিচিত যে পোশাকি নামটা উধাও হয়ে গেছে। অনেকেই জানে না দাদু-ঠাকুমার নাম। তৃতীয়ত, মালদা-মুর্শিদাবাদ বা ঝাড়গ্রাম মেদিনীপুর বাঁকুড়া পুরুলিয়া থেকে অনলাইনে ভোটার তালিকা বের করে খুঁজে আনা শিবের অসাধ্যি। চতুর্থত, ২০০২ সালে নাম থাকা আত্মীয়তার সম্পর্কের মধ্যে শুধুমাত্র মা-বাবা ও পিতৃকুলের দাদু-ঠাকুমার নাম থাকা চাই। পরে তদবির করে জানা গেল, মামাবাড়ির দাদু-দিদিমা হলেও চলবে।
নিম্ন মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে উচ্চ স্তরে কমবেশি সকলেরই আধার কার্ড, ভোটার কার্ড, ইন্টারনেট অ্যাক্সেস, এসব সহজলভ্য। ফলে এদের পক্ষে ২০০২'এর ট্র্যাক রেকর্ড উপস্থাপন করা খুব জটিল বিষয় নয়। সমস্যায় পড়বে নিম্নবিত্তরা, প্রান্তিকরা। যাদের ঘরে নেট আছে, ইন্টারনেট নেই। তাদের ঘরে খ্যাবলা জাল আছে, একটু বর্ষার জল জমলেই সেই জাল নিয়ে বাচ্চারা কোমর জল, গলা জলে নেমে পড়ে। এই অংশটি হল এসআইআর'এর মূল লক্ষ্যবস্তু বা শিকার। একবার ভাবুন, অক্ষর চেনে না, বানান বলতে পারবে না, এমন মানুষ কীভাবে লিস্টে নিজের মায়ের নাম খুঁজবে? আপনি বলবেন, অন্য কেউ খুঁজে দেবে। তাহলে শুনুন, আমাদের কাছেই আছে একটি আবাসন। সেখানে এমনই এক প্রান্তিক মহিলা দৈনিক ঠিকা কাজ করে। তাকে বলছি, তুমি কোথায় কাজ করো? সে বলছে, ওই নজরাল বিবি বাড়ি আছে, সেখানে। আমি বললাম সেটা কোথায়? সেই মহিলা বলল, কেন ইস্টিশনের পাশেই উঁচু লম্বা যে বাড়ি। তখন বুঝলাম বাড়িটার নাম নেচারাল ভিউ। সেটা ওর উচ্চারণে নজরাল বিবি। ও বলবে মা বাবার নাম, আর সেটা শুনে আপনি খুঁজে বের করবেন ভোটার তালিকা থেকে। সেও এক অসাধ্য সাধন।
এরপরেও কথা আছে। এসআইআর ফর্মে উপরের অংশে জানতে চাওয়া হয়েছে নির্বাচকের জন্ম তারিখ, বাবার নাম, মায়ের নাম এবং স্বামী বা স্ত্রীর নাম। আর বাকি যা আছে সেগুলো ঐচ্ছিক, দিতে পারেন নাও দিতে পারেন। এবার ফর্মের দ্বিতীয় অংশে ওই নির্বাচকের প্রাচীনত্ব ও তার ট্র্যাক রেকর্ড খোঁজা হচ্ছে। সেখানে তার ২০০২'এর ভোটার তালিকায় নাম ছিল কিনা জানতে চাওয়া হচ্ছে। থাকলে তো মিটে গেল। যারা লেখাপড়া করা বাবু, মধ্যবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্ত, তারা সহজেই এ কাজ সেরে ফেলছেন। আর যারা প্রান্তিক তারাই ২০০২'এর হদিস করতে পারছে না। যে কথা আগেই বলেছি। কিন্তু যে মধ্যবিত্ত শিক্ষিত উচ্চ বর্গীয় সম্প্রদায়, তারাও এক জায়গায় গিয়ে ফাঁপড়ে পড়বে এবং পড়ছে। ২০০২ সালে নিজের নাম না থাকলেও বাবা-মার নাম থাকলেই চলবে। যাদের সেটা নেই তারা দাদু ঠাকুমা, দাদু দিদিমা'র নাম ও তথ্য উল্লেখ করবেন। কিন্তু ওপরের অংশে তো কেবল মা-বাবা ও স্বামী বা স্ত্রীর নাম উল্লেখ আছে। দাদু দিদিমার নামটার সঙ্গে তাদের সম্পর্কের সূত্র প্রমাণ হবে কীভাবে? এমনকি উল্লেখ করার জায়গা নেই যে, এরা কীভাবে সম্পর্কিত। বাধ্য হয়ে নামের পাশে লিখে দেওয়া হচ্ছে, দাদু দিদিমা ঠাকুমা এবং ব্র্যাকেটে মাতৃকুল বা পিতৃকুল। কোনও নির্দেশ ছাড়াই নিজস্ব উদ্ভাবনে এটা করা হচ্ছে।
এরপরেও একটা সমস্যা চোখে পড়ছে। কোনও কোনও নির্বাচকের দাদু দিদিমা তো নেইই, এমনকি কোনও আত্মীয়-পরিজনও নেই। বলতে পারেন নিউক্লিয়াস ফ্যামিলির প্রথম জেনারেশন। বিশেষ করে বিবাহিত মহিলা, মা-বাবা বহুকাল গত হয়েছেন, কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরির সুবাদে দেশের নানা প্রান্তে ঘুরে বেড়িয়েছেন। এভাবেই কন্যার বিয়ে দিয়েছেন। তাই কোনও নির্দিষ্ট ঠিকানা মা-বাবার ছিল না। ফলে, মেয়ে জানে না কোথায় কোন রাজ্যে কোন ভোটকেন্দ্রে মা বাবার নাম খোঁজ করবে। কোনও আত্মীয় পরিজনের নামও বলতে পারছে না। আমার পাড়ার বিয়ে হয়ে আসা বউমা। তারা এই সমস্যার সম্মুখীন। আবার ২০০২ সালে যে নাম ও পদবী ছিল পরবর্তীকালে নাম ও পদবী দুইই পরিবর্তিত হয়েছে। ফলে, বর্তমান স্ট্যাটাসের সঙ্গে ২০০২'এর প্রদত্ত তথ্য ম্যাচ করছে না। অথচ ফর্মে এটি উল্লেখ করার কোনও ক্ষেত্র নেই।
সবচেয়ে বড় কথা, এসআইআর ফর্মটি অসম্পূর্ণ। প্রথমত, আরও দু-একটি তথ্য জানার বা মন্তব্য করার সুযোগ থাকা উচিত ছিল। দ্বিতীয়ত, অহেতুক এমন সব তথ্য জানতে চাওয়া হয়েছে যা নির্বাচকের ভোটার তালিকায় আগেই তথ্য হিসেবে দেওয়া আছে। নতুন করে সেগুলো জানতে চাওয়া অর্থহীন। সর্বোপরি, নির্বাচকের স্বামী বা স্ত্রীর নাম জেনে ২০০২'এর প্রাচীনত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না। কারণ, স্ত্রীর নাম ২০০২'এ থাকলে তাতে স্বামীর কিছু যাবে আসবে না। একইভাবে স্বামীর নাম ২০০২'এ থাকলেও তাতে স্ত্রীর কোনও সুবিধা হবে না। এভাবে প্রয়োজনীয় তথ্য জানানোর সুযোগ একদিকে নেই, অন্যদিকে অপ্রয়োজনীয় তথ্য জানতে চেয়ে জটিলতা সৃষ্টি সকলকে বিভ্রান্ত করেছে।
বিএলও'দের অবস্থা আরও করুণ। জনৈক বিএলও'কে জানানো হল তার জমা নেওয়া ফর্ম সফল ভাবে সিস্টেমে আপলোড হয়েছে ৬৩ শতাংশ। পরদিন তাকে জানানো হল, সফল ভাবে আপলোড হয়েছে ৫৭ শতাংশ। বিএলও'র মাথায় হাত। এলাকার মানুষ বিএলও'কে দোষারোপ করবে। নিত্যদিন হাট বাজারে তার সঙ্গে দেখা হয়। একদিন সংবাদপত্রে লেখা হল, বিএলও'রা তিনবার এসআইআর ফর্ম দিতে গিয়েও ভোটারকে না পেয়ে ফিরে এসেছেন। রাজ্যে ৫৫ লক্ষ ভোটারের কোনও হদিস নেই। অর্থাৎ, বলতে চাওয়া হয়েছে যে ৫৫ লক্ষ ভুয়ো ভোটার। তারপরেই আবার কদিন পর সংবাদপত্রে লেখা হল, বাংলায় ৯৯.১৬ শতাংশ এসআইআর ফর্ম বিলি সম্পূর্ণ। তথ্য দুটি কিন্তু পরস্পর বিরোধী। দ্বিতীয় তথ্যটিও সঠিক নয়, কারণ, একটি ভোটার তালিকায় ৭৩৬ জন ভোটারের মধ্যে ৪২ জন আছেন যারা হয় মৃত না হয় অন্যত্র চলে গেছেন, কিন্তু নাম কাটাননি। অর্থাৎ, ৫ শতাংশের কিছু বেশি। তাহলে ৯৯.১৬ শতাংশ ভোটারকে খুঁজে পাওয়া অসম্ভব।
এই অসঙ্গতিপূর্ণ তথ্য আমাকে অবাক করে না। কারণ, ভোট শেষ হবার পর প্রদত্ত ভোটের শতাংশের হিসেব তিন ঘন্টা পরে বদলে যায়, মোট ভোটারের সংখ্যা নির্বাচনী ফল প্রকাশের পর বেড়ে যায়। হিসেব করে ভোট লুঠ হচ্ছে না। লুঠ করার পর হিসাব মেলানো হচ্ছে। বুঝতে পারি, যা কিছু ঘটতে পারে। তবে নিঃসন্দেহে এটা বলতে পারি, উদ্দেশ্য যদি হয় নাম বাদ দেওয়া এবং সেটা যদি শুভেন্দু অধিকারী কথিত এক কোটি হয়, তাহলে সেই উদ্দেশ্য পূরণে এমন একটি এসআইআর ফলদায়ক। নিশ্চিতভাবে উপযুক্ত। একজন নাগরিক হিসেবে আমিও দৃঢ়ভাবে সচেষ্ট যাতে শুভেন্দু অধিকারীর পাকা গুটি কেটে ঘরে ঢোকানো যায়। মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, একজন বৈধ ভোটারেরও নাম বাদ পড়তে দেব না। সেই আহ্বানে আমার ক্ষুদ্র সীমানায় ও সামর্থ্যে আমিও সামিল। আপনি আমাকে চটিচাটা বলতেই পারেন।






