'বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে...'
মালবিকা মিত্র
প্রাথমিক স্তরে অঙ্কের প্রশ্ন করেছি, একটি ঝুড়িতে ৫০০টি আম ছিল, তার মধ্যে ২০টি আম পচা। তাহলে ঝুড়িতে ভালো আম কটা রইল? সহজ গণিতের বুদ্ধিতে এর উত্তর মিলবে না। যদি ফলওয়ালার হিসেবে ধরেন, সে হিসেবও মিলবে না। বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য বলেছেন, ঝুড়িতে চার-পাঁচটি পচা আম থাকলে ঝুড়ি সমেত আম ফেলে দিতে হয়। অঙ্ক বা ব্যবসার বুদ্ধিতে এর থই পাওয়া যায় না। অবশ্য, কিছু পচা আমের সঙ্গে থাকা বাকী সকল ভালো আম ফেলে দেওয়া আর কিছু পচা মানুষের সঙ্গে একই গণ্ডির ভিতরে থাকা বাকী সব ভালো মানুষদের ভাতে মারা তুল্যমূল্য কিনা সে প্রশ্ন তিনি তোলেননি। কারণ, জনগণ তো বিকাশবাবুদের গোটা ঝুড়িটাকেই ফেলে দিয়েছে।
ঝুড়িতে যে পচা আম ছিল সেটা বোঝা গেছে। নিয়োগ দুর্নীতি হয়েছে এটা প্রমাণিত। তার জন্য এসএসসি ও রাজ্য সরকার দায় এড়াতে পারে না। সেও মান্য। ফলে, তাদের মন্ত্রী ও কর্তাব্যক্তিরা গ্রেফতারও হয়েছেন। অনেককে সিবিআই হেফাজতে নেওয়া হয়েছিল। আবার অনেককেই জামিনে মুক্ত রাখা হয়েছে। মামলা এখনও বিচারাধীন। কিন্তু দুর্নীতি প্রক্রিয়ার সর্বনিম্ন স্তরে এক ধাক্কায় ২৫,৭৫২ জনের নিয়োগ বাতিল করে দেওয়া হল যাদের অধিকাংশের সঙ্গেই দুর্নীতির কোনও নামগন্ধই ছিল না। বিচার হবে, কারা দোষী তা চিহ্নিত হবে, তাদের শাস্তি হবে-- এগুলোই তো আশা করেছিলাম। না সে সব কিছুই হয়নি। ঝুড়ির কিছু পচা আমের সঙ্গে বাকী সব ভালো আমকে বিসর্জন দেওয়ার মতোই ২০১৬ সালের সমগ্র শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিয়োগকেই বাতিল করা হল। অথচ কোর্ট বলল, যোগ্য প্রার্থীদের মাইনে ফেরত দিতে হবে না এবং তিন মাসের মধ্যে অনুষ্ঠিতব্য নিয়োগ প্রক্রিয়ায় তাঁরা আবেদন করতে পারবেন। অর্থাৎ, যোগ্য কারা কোর্ট জানে; এবং জানে বলেই তাঁদের আরেক দফা সুযোগও দিল চাকরি ফেরত পেতে। এ তো হাত ঘুরিয়ে নাক দেখানো! এই অযাচিত কসরত কেন?
অতএব, আমজনতার মধ্যে কিছু প্রশ্ন উঠল:
১) ২০২৪'এর নীট পরীক্ষায় হরিয়ানা, গুজরাত, বিহার ইত্যাদি রাজ্যের বহু কেন্দ্রে শোনা গেল প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। এ সম্পর্কিত রিপোর্ট কেন্দ্রীয় সরকারের শিক্ষা দফতরের জানা ছিল। এমনকি পরীক্ষা পরিচালকমণ্ডলী (এনটিএ) সে কথা কবুল করেছে। তথাপি, সুপ্রিম কোর্ট পরীক্ষা বাতিল করেনি বা কাউন্সেলিং বন্ধ রাখেনি। যুক্তি ছিল, কিছু অনিয়মের জন্য এত বিপুল সংখ্যক ছাত্রের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত করা যায় না। সাধু সাধু! কী অসাধারণ পর্যবেক্ষণ। কিন্তু, ২৫,৭৫২ জনের চাকরি বাতিল করবার রায়ে সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, গোটা প্রক্রিয়া বাতিলের মাপকাঠি হল sanctity of the process যদি প্রশ্নের মুখে পড়ে এবং কোর্ট মনে করেছে এ ক্ষেত্রে সেটা হয়েছে। নীট ২০২৪'এর ক্ষেত্রেও সুপ্রিম কোর্ট মনে করেছিল যে sanctity of the process লঙ্ঘিত হয়েছে। দুটি মামলার ক্ষেত্রে কোর্টের মনে হওয়াটা একই। কিন্তু রায় পৃথক হল কেন?
২) মহারাষ্ট্রে গত বিধানসভা নির্বাচনে ভোট শেষ হবার পর, এমনকি প্রদত্ত ভোটের শতকরা হার ঘোষণা হবার পরও দেখা গেল, কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন প্রদত্ত হিসেবে ভোটের হার ৩ থেকে ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। একই ঘটনা ঘটেছিল দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনের পরেও। লোকসভা নির্বাচনের পরেও একই ঘটনা ঘটেছিল। এ নিয়ে বিরোধীরা সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়। সুপ্রিম কোর্টের মন্তব্য ছিল, এই সুবিপুল নির্বাচন প্রক্রিয়ায় এটুকু সামান্য হিসেবের হেরফের বা ভ্রান্তি হতেই পারে। এ নিয়ে নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বিব্রত করা উচিত হবে না;
৩) আমাদের দেশের বিচার ব্যবস্থার নির্যাস হিসেবে এমনটা বলা হয়ে থাকে যে, দশজন দোষী ব্যক্তি যদি ছাড়াও পেয়ে যায়, একজনও নিরপরাধ ব্যক্তি যেন কখনই সাজা না পায়। অথচ, ঝুড়িতে কিছু পচা আম পাওয়া গেছে এই অজুহাতে সেই মৌলিক নীতিকে অস্বীকার করেই ২৫,৭৫২ জন শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীর চাকরি বাতিল করা হয়েছে। কেন?
৪) ২০১৭ সালে 'অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্রেটিক রিফর্ম' (এডিআর)'এর পক্ষ থেকে ইলেক্টোরাল বন্ড নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করা হয়। সুপ্রিম কোর্ট সেই মামলার শুনানি তখন স্থগিত রাখে। বলা হয়, আপাতত এটা চলতে থাকুক, পরে ভাবা যাবে। অতঃপর ২০১৯ সালে লোকসভার নির্বাচন সম্পন্ন হয়। ২০২৪ সালে সুপ্রিম কোর্ট শুনানি শুরু করে, তারপর ঘোষণা করে ইলেক্টোরাল বন্ড অসাংবিধানিক। অথচ, এই অসাংবিধানিক বন্ড নিয়েই ২০১৯'এ বিজেপি ৩০৩টি আসন জিতে ক্ষমতাসীন হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্ট সেই অসাংবিধানিক সরকারটিকে কোনওভাবে শাস্তি দিতে পেরেছিল কী?
৫) একটি প্যানেল তৈরিতে বেশ বড়সড় আর্থিক দুর্নীতি হয়েছে সেটা বোঝাই যাচ্ছে। এসএসসি'র কাছে পুরনো ওএমআর শিট না পাওয়া গেলেও নয়ডায় জনৈক বনশলের বাড়ি থেকে সিবিআই যে হার্ড ডিস্ক উদ্ধার করেছিল সেখানে ওএমআর শিটের মিরর কপি পাওয়া যায় এবং ফরেনসিক পরীক্ষায় তা যথাযথ বলে কোর্টে জমাও করে। সেখানে দেখা যায়, ফাঁকা বা অসম্পূর্ণ ওএমআর শিট জমা পড়েছে, প্রার্থীর নামও আছে, ফলে কারা অভিযুক্ত তাও বোঝা যাচ্ছে। অতএব, অভিযুক্ত ৮ কি ৬ হাজারকে বাদ দিয়ে এই প্যানেলকে ত্রুটিমুক্ত করে বাকীদের নিয়োগের যাথার্থ্য দেখানোই যেত। এটাই তো তদন্তকারী সংস্থার কাজ ও বিচার-প্রত্যাশা। তার ওপর সেই প্যানেলের নিয়োগ কবেই হয়ে গেছে, তাঁরা ছ' বছরের বেশি চাকরিও করেছেন, এই সময়টায় এসে আম সুদ্ধু ঝুড়ি ফেলে দিয়ে কার বা কাদের সুবিধা করা হল? এই চাকুরিরতা শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীরা পাঠদান, মূল্যায়ন, গৃহঋণ, চিকিৎসা ঋণ, বিবাহ, সন্তান, অনেক কিছুর মধ্য দিয়ে ইতিমধ্যে বেশ কিছুটা জীবন পার করে ফেলেছেন। এ কেমন ন্যায় যা নির্দোষের বাঁচার অধিকারকে হরণ করে?
৬) অতীতে সংঘটিত কোনও অন্যায় নিয়ে তদন্ত হতেই পারে। সেই তদন্তে যুক্ত অপরাধীর শাস্তিও হতে পারে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এমন বেশ কিছু পরিবর্তন ঘটে যায় যেগুলোকে আর ফিরিয়ে আনা যায় না। অবশ্য যে বিচারে দ্বাদশ শতকের 'মন্দির' ফিরিয়ে আনা যায়, সেখানে সবই সম্ভব। যে ২৫,৭৫২ জন শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীর চাকরি বাতিল হল, তাঁদের সাহচর্যে যে কয়েক লক্ষ ছাত্র-ছাত্রী এই ছয় সাড়ে ছয় বছরে পাঠ লাভ করল, সহযোগিতা পেল, সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কেউ কেউ প্রতিষ্ঠিত হল, তার কী হবে? যদি গোড়ায় গলদ হয়, নিয়োগটিই অবৈধ হয়, তাহলে এদের দ্বারা যে মূল্যায়ন ও পাঠদান সম্পন্ন হয়েছে তা কী করে বৈধ হয়? সেগুলোকে কি পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব? বিগত ছয় বছরের প্রদত্ত শ্রমের সবটাই বেগার? বেগার শ্রম তো আইনত অপরাধ। এই শিক্ষকরা অনেকেই চলতি বছরে সদ্য সমাপ্ত মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পরীক্ষক। তাহলে এ বছর পরীক্ষার মূল্যায়ন সম্পন্ন হবে কীভাবে? যে সমস্ত স্কুলে পাঁচজন, ছয়জন, ন'জন করে শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের চাকরি বাতিল হল, সেই স্কুলগুলির পঠন-পাঠনের কী হবে? আসলে, আড়ালে থেকে কেউ কি একটা সামগ্রিক নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে চাইল?
৭) আচ্ছা, এই যে দুর্নীতি ধরার সংস্থা সিবিআই/ ইডি/ আয়কর ইত্যাদি, এরা ছাড়াও এক নতুন সংস্থার কথা জানলাম; বিচারপতিদের বাড়িতে আগুন লাগলে দমকল বাহিনী আগুন নেভাতে গিয়ে উদ্ধার করে আনে আগুনে আধ পোড়া কোটি কোটি টাকা। এখন ওই বিচারপতির কী হবে? কোনও শাস্তি হবে? যদি শাস্তি হয় তাহলে প্রশ্ন উঠবে, নিশ্চয়ই কোনও বিচারের রায়দান কেনাবেচার ফলেই এই উপার্জন, তাই না? সেই সমস্ত রায়গুলোকে কি পুনরায় বিচার করা হবে? যদি কোনও মৃত্যুদণ্ডাদেশ হয়ে থাকে তাহলে কী হবে? ন্যায়বিচার কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে?
৮) যে বিচারপতি কালো গাউন গায়ে চাপিয়ে নিয়োগ দুর্নীতির মামলায় রায় দিলেন, ক্যালেন্ডার'এর পাতা ওলটানোর আগেই গেরুয়া আলখাল্লা গায়ে চাপিয়ে রাজনৈতিক দলের প্রার্থী হয়ে সাংসদ হয়ে গেলেন। এক্কেবারে ব্রেখটের নাটকের দৃশ্য। জমিদার পুলিশের ডায়ালগ বলছে, আর পুলিশ জমিদারের ডায়লগ বলছে। এই বিচারপতির দেওয়া সমস্ত রায়কে নিরপেক্ষ বলা যায় কী? তাহলে কি সেগুলোর পুনরায় বিচার হবে?
৯) বামফ্রন্ট সরকারের অ্যাডভোকেট জেনারেল বলাই রায় Judicial excess বা Judicial overreach সংক্রান্ত আলোচনায় হুগলি মহসিন কলেজে এক সেমিনারে বলেছিলেন, মাঝেমধ্যেই বিচারকরা কাণ্ডজ্ঞানহীনের মতো রায় দান করে থাকেন। হাওড়ার রেল স্টেশন গঙ্গা দূষণের একটি প্রধান উৎস। হাওড়ার জনস্বাস্থ্যের ওপর হাওড়া স্টেশনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া। এসবই সত্য হতে পারে। প্রত্যহ কোটি কোটি মানুষের মলমূত্র বর্জ্য খাবার-দাবারের প্যাকেট পাতা ঠোঙা ইত্যাদি সেখানে জমা হয়। কিন্তু তাই বলে বিচার বিভাগ বলতে পারে না হাওড়া স্টেশন বন্ধ করে দেওয়া হোক। অবশ্য, ইদানীং বিচারপতিদের এই ঝোঁক দেখা যাচ্ছে। হয়তো কোনদিন তারা গঙ্গা দূষণ ও জনস্বাস্থ্যের কারণে হাওড়া স্টেশন বন্ধ করতে বলবেন। বিচারপতি সহজেই বলে দিতে পারেন, রামনবমীর মিছিলের অনুমতি দেওয়া হল। তবে, এক হাজারের বেশি মানুষ থাকবে না, অস্ত্রশস্ত্র বহন করা যাবে না, এ কথাও বলে দেন। কারণ, জমায়েতের নিয়ন্ত্রণ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, সংখ্যা হাজার ছাড়াল কিনা, অস্ত্র বহন করা হল কিনা, উত্তেজনা ছড়াল কিনা, এগুলো তো দেখার দায়িত্ব বিচারপতির নয়। এই দায়িত্বহীন ক্ষমতা কি এক বিপজ্জনক দিক নয়?
আমাদের নজর থাকবে পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে। আগ্রহ থাকবে ৭ এপ্রিল নেতাজি ইন্ডোরে চাকরিহারা শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের জমায়েত ও সিদ্ধান্তে। নজর থাকবে সরকারের পদক্ষেপেও। আইনি কোনও সুযোগ আর আছে কিনা সে কৌতূহলও থাকবে। একজন সহ-নাগরিক হিসেবে এতগুলি পরিবারের অনিশ্চয়তা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি আশঙ্কিত। স্পষ্টতই এ রাজ্যের বিরোধী রাজনৈতিক দল সমূহ আহ্লাদিত; তারা ভাবছে কিছু মানুষের চাকরি গেলে যেটুকু ক্ষোভ অসন্তোষ হত, সমগ্র প্যানেল বাতিল হওয়ার ফলে অসন্তোষের আকার অনেক বাড়বে। কম্বলটা যত ভিজবে ততই ভারী হবে। সমাজ মাধ্যমে অসংখ্য পোস্ট দেখতে পাচ্ছি। আন্তরিকভাবে এতগুলি পরিবারের ভয়ঙ্কর দুরবস্থার কথা কেউ বলছেন না। খুব স্বাভাবিক, সরকার কোনও ভুল করলে, তদুপরি সেই ভুলের কারণে বিচার ব্যবস্থা বিরূপ হলে, বিরোধীরা ঝড় তুলবেন। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, ক্ষমতালাভের তড়িঘড়ি বাসনায় অসহায় মানুষের লাশের ওপর দিয়ে সে ফায়দা তুলতে হবে, অথবা, গুজবের মধুভাণ্ড নিয়ে মাঠে নামতে হবে। প্রতিটি ঝড়েই 'অতি ভোরে উঠে তাড়াতাড়ি ছুটি আম কুড়াবার ধুম'। কিন্তু শেষাবধি ঝুলি ফাঁকাই থেকে যায়, বেলা ফন্ট'এর সেই গানই সত্য হয়, 'There is a hole in the bucket.'।
চাকরিহারা শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীরা কী ভাবছেন বা কোন পথে নিজেদের জীবন-জীবিকার লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইছেন, সহমর্মিতার দৃষ্টি নিয়ে সেদিক পানেই অধীর আগ্রহে তাকিয়ে রইলাম।