স্বপ্নের
উড়ান থমকে গেল
সোমনাথ গুহ
জেট এয়ারওয়েজ
বন্ধ হয়ে গেল। স্থায়ী, অস্থায়ী মিলে প্রায় বাইশ হাজার কর্মচারির জীবন জীবিকা
অনিশ্চিত হয়ে গেছে, বিমান ভাড়া হু হু করে বাড়ছে, পর্যটন শিল্পকে যা ক্ষতির মুখে
ঠেলে দিয়েছে। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে মুক্ত অর্থনীতি চালু হওয়ার পর থেকে বিমান
পরিষেবায় বেসরকারি এয়ারলাইন্সের প্রবেশ শুরু হয়। কিন্তু ইস্টওয়েস্ট, দামানিয়া বা
কিংফিশার'এর মতো নামি ব্র্যান্ডও সাত আট বছরের বেশি বাজারে টিকে থাকেনি। ব্যাতিক্রম
ছিল জেট। প্রায় ছাব্বিশ বছর আগে ১৯৯৩ সালে চারটে লিজ করা বিমান নিয়ে জেটের যাত্রা
শুরু হয় যাতে গালফ এয়ার এবং কুয়েত এয়ারওয়েজ বিনিয়োগ করে। এত দিন ধরে এর যাত্রা
শুধু অক্ষুণ্ণ থেকেছে তাই নয়, ভালো পরিষেবার কারণে যাত্রীদের বাহবা পেয়েছে, বাজারে
মোটামুটি সুনাম বজায় রেখেছে। ২০০৪ সালে আন্তর্জাতিক উড়ান শুরু করে যখন ঘরোয়া বিমান
শিল্পে জেটের শেয়ার সর্বাধিক। কিন্তু প্রায় এই সময় থেকেই স্পাইসজেট এবং ইন্ডিগো অভাবিত
সস্তায় বিমান ভাড়া চালু করার পর জেট কড়া প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হয়। সংকটের সেই
শুরু। সাহারা এয়ারলাইন্স কিনে নিজেদের সস্তা পরিষেবা চালু করে বাজারে টিকে থাকার
জন্য মরিয়া চেষ্টা করা হয়। ভাড়া-যুদ্ধে পাল্লা দেওয়া সম্ভব হয় কিন্তু তাতে ঋণের
বোঝা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে এবং সংকট ঘনীভূত হয়। গত কয়েক বছরে ক্ষয়ের
উপসর্গগুলো স্পষ্ট হতে থাকে। পরপর তিন বছর লোকসান হয়। নরেশ গয়াল সংস্থার মালিক,
চেয়ারম্যান এবং মূল অংশীদার এসবিআইয়ের কাছে পুনরায় ১৫০০ কোটি টাকা ঋণের
জন্য আবেদন করেন। ইতিমধ্যে ব্যাঙ্কে ৮৫০০ কোটি দেনা হয়ে গেছে। ব্যাঙ্ক
শর্ত দেয় গয়াল পদত্যাগ করলে ঋণ দেওয়া হবে। গয়াল পদত্যাগ করে, ব্যাঙ্কের কাছে তাঁর
৫১ শতাংশ শেয়ার এক টাকায় বিক্রি করে এবং লন্ডনে পাড়ি দেয়। রহস্যজনক ভাবে যে ব্যাঙ্ক এতদিন সংস্থাটি সংকটাগ্রস্ত
হওয়া সত্ত্বেও নির্দ্বিধায় ধার দিয়েছে, তারা এবার ঋণ দিতে অস্বীকার করে। ফেব্রুয়ারি
মাস থেকে কর্মচারিদের মাইনে বন্ধ হয়ে যায়। অবশেষে ১৭ এপ্রিল জেটের ঝাঁপ বন্ধ হয়ে
যায়। বলে রাখা ভালো, বিমান শিল্পে এই সংকট সার্বিক। স্পাইসজেট গত দুটি ত্রৈমাসিক
এবং ইন্ডিগো এই প্রথম গত ত্রৈমাসিকে লোকসান করেছে।
আইএটিএ (ইন্টারন্যাশানাল এয়ার ট্রান্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশন)'এর তথ্য অনুযায়ী,
বিশ্ব জুড়ে বিমান শিল্পে লাভ চলছে। কিন্তু ভারতে ছবিটা উলটো। এর মূল কারণ নিত্য
প্রয়োজনীয় খরচা। জ্বালানির দাম বিশ্ব বাজারের চেয়ে বেশি, চড়া হারে কর এবং
বিমানবন্দরের খরচা, যার মধ্যে অন্যতম উড়ানসূচি ভাড়া। এছাড়া আছে প্রবল প্রতিযোগিতা,
ভাড়া-যুদ্ধে অন্যদের সাথে পাল্লা দেওয়া। অবস্থা এমন দাঁড়ায়, শেষ দিকে জেটকে প্রতি
এক কিলোমিটার উড়ানে জনপ্রতি ৭৭ পয়সা লোকসান গুনতে হচ্ছিল। তবে বুনিয়াদী সমস্যা
হচ্ছে মুক্ত অর্থনীতি এক শ্রেণি উদ্যোগপতির জন্ম দিয়েছে যাদের নিজেদের শিল্প বা ব্যবসার প্রতি কোনও দায়বদ্ধতা নেই। এদের কোনও মূলধন নেই, অভিজ্ঞতা নেই। যা
আছে তা হল রাষ্ট্র
ব্যবস্থায় ঠিক জায়গায় ঠিক লোকটিকে ঠিক সময়ে তুষ্ট রাখার ক্ষমতা। এদের চাটুকার
বৃত্তির দক্ষতা রীতিমত ঈর্ষণীয়। এদের মূল উদ্দেশ্য যত কম সময়ে যত বেশি মুনাফা করা
যায়। কেতাবী ভাষায় এদের বলা হয় ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিস্ট’। ‘ক্রোনি’র বাংলা অর্থ
অভিদান অনুযায়ী অন্তরঙ্গ বন্ধু, বাস্তবে তা হল মোসাহেবি করে বন্ধুত্ব অর্জন করা। লাইসেন্স
রাজের সময় এরা ছিল না তা নয়, কিন্তু তখন প্রতিযোগিতা ছিল না। এখন আছে এবং তাই এরা
স্বল্পায়ু। কয়েক বছরের মধ্যে বুদবুদের মতো ফুলেফেঁপে ওঠে তারপর চুপসে যায়। কিন্তু
ততদিনে তারা ধনকুবের হয়ে যায়।
নরেশ গয়ালের কথাই
ধরা যাক। সত্তরের দশকে পাতিয়ালায় তার পরিবারের এক চিলতে একটা শাড়ির দোকান ছিল।
ভাগ্য অন্বেষণে দিল্লী চলে যায়। ইরাক, জর্ডনের এয়ারলাইন্সে ছোটখাটো আধিকারিকের কাজ
করে বিমান পরিষেবা সম্পর্কে কিছু প্রাথমিক অভিজ্ঞতা অর্জন করে। যে কোনওভাবেই হোক
ছোটখাটো একটা ট্রাভেল এজেন্সি খুলে বসে। মুক্ত আকাশ নীতি এবং একই সময়ে এয়ার ইন্ডিয়া
সঙ্কটে পড়ায় জেটের বিমান ব্যবসায় ঢোকার পথ সুগম হয়। প্রতিযোগী অন্য বেসরকারি বিমান
সংস্থাগুলি কয়েক বছরের মধ্যে সংকটে পড়ে এবং ব্যবসা বন্ধ করে দেয়। ক্ষমতাশালী ব্যক্তিদের ওপর প্রভাব খাটিয়ে সরকারি নিয়ম নীতি নিজের অনুকুলে নির্ধারিত করাতে
কিংবা পাল্টে দিতে সে ছিল সিদ্ধহস্ত। তার সুবির্ধাথে বিমান শিল্পে বিদেশি বিনিয়োগ
আটকে দেওয়া হয়। এর ফলে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্স ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কিন্তু গালফ এয়ার এবং
কুয়েত এয়ারওয়েজ তাদের শেয়ার বিক্রি করে দেওয়ায় জেটের আধিপত্য বৃদ্ধি পায়। এমনও
শোনা যায়, এয়ার ইন্ডিয়াকে পুনর্জীবিত করার পরিকল্পনা গয়াল কলকাঠি নেড়ে আটকে
দিয়েছে। বেসরকারি বিমান শিল্পে টাটাকে আটকে দেওয়ার ক্ষেত্রেও তার হাত রয়েছে। নতুন
শতকের প্রথম দশকে ইন্ডিগো, স্পাইসজেটের আগমন প্রথম অশনি সংকেত। এর পর আসে ২০০৮'এর
বিশ্ব জোড়া মন্দা এবং জ্বালানির দামের বৃদ্ধি। অত্যধিক আত্মবিশ্বাসের ফলে গয়াল
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে যাত্রী পরিষেবায় কোনও কাটছাঁট করে না। লোকসান বৃদ্ধি পেতে
থাকে। এই সংকটের মোকাবিলায় তারই সুবিধার্থে বিদেশি বিনিয়োগ পুনরায় চালু করা হয়।
আবু ধাবিতে অবস্থিত ইতিহাদ এয়ারলাইন্স জেটে বিনিয়োগ করে। কিন্তু তাতে সাময়িক ভাবে
পতন রোধ করা গেলেও দীর্ঘস্থায়ী কোনও সুরাহা হয় না।
কর্মচারিরা স্বয়ং
প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করেছেন যাতে সরকার হস্তক্ষেপ করে সংস্থাটিকে বাঁচায়।
অর্থমন্ত্রীর সাথেও তাঁরা দেখা করেছেন। কিন্তু তাঁদেরকে কোনও আশ্বাস দেওয়া হয়নি।
ইতিমধ্যে জেটের কিছু বিমান কর্মচারি সহ এয়ার ইন্ডিয়া এবং অন্য কিছু সংস্থা লিজে
নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিভিন্ন বিমানবন্দরের উড়ানসূচিও এই ভাবে হাতছাড়া হয়ে যেতে
পারে। বলাই বাহুল্য, এর ফলে জেটের ভাবমুর্তি আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এর বাজার দরের
অবনমন ঘটবে। এই অবস্থায় স্টেট ব্যাঙ্ক নিলাম ডেকে সংস্থা হস্তান্তর করার চিন্তাভাবনা করছে। আসলে এই ক্ষুরধার প্রতিযোগিতার বাজারে ‘ক্রোনি’দের রমরমা, তাই তাদের
সময়কালও সীমিত। ছাব্বিশ বছরে গয়াল ধনকুবের হয়ে গেছে। তার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে,
অন্য কেউ তাকে স্থানান্তরিত করার জন্য তৈরি। ব্যাঙ্ক, নেতা-মন্ত্রী, প্রশাসনের
যাবতীয় দাক্ষিণ্য নিয়ে নতুন আর এক গয়াল বিমান শিল্পে আবির্ভাব হতে প্রস্তুত। এই
অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় এটাই দস্তুর।