বাংলা ভাষার সম্পদ কোথায়
অরুণাভ বিশ্বাস
বইচিত্র সভাঘরে শ্রোতাদের একাংশ
ভিন্ন আঙ্গিকে ভিন্ন প্রকরণে ভিন্ন পরিসরে বাঙালি আবার বইমুখো বা বলা ভালো পাঠমুখো হয়ে উঠছে। ধ্রুপদী সাহিত্যের আঙিনায় আবদ্ধ না থেকে বাঙালি যুবক সম্প্রদায় নতুন শৈলীতে নতুন বিষয়ে মুক্ত গদ্য লিখছে, কবিতা লিখছে, অনুগল্প লিখছে, রাজনীতি বা সমাজবিজ্ঞানের নতুন ভাষাশৈলীর জন্ম দিচ্ছে ; এবং সে সব লেখার অধিকাংশ সোশাল মিডিয়ায় অথবা লিটল ম্যাগাজিনের অপেশাদার প্রকাশনায় পাঠক খুঁজে নিচ্ছে। এবারের শীতের মরসুমে তাই কলকাতাকেন্দ্রিক মননচর্চার পরিসরকে ছাপিয়ে জেলায় জেলায় মফস্বলগুলিতে কুড়িটিরও বেশি লিটল ম্যাগাজিন মেলা প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর হয়ে উঠেছে। এই উত্থান পড়ুয়াজনের, এই ফিরে আসা বাংলা ভাষার, এই জাগরণ যুবশক্তির, এই খোলা হাওয়া প্রান্তিক বাঙালির। একে অস্বীকার করার উপায় নেই, যদিও সে সব লেখা কালোত্তীর্ণ হবে কিনা তা ভবিষ্যৎ বলবে। শুরুতে এই বার্তা দিয়ে গত ৩ মার্চ'১৮ 'একক মাত্রা' পত্রিকার মার্চ সংখ্যার (প্রচ্ছদ বিষয়: সীমান্ত দেশ) মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান শুরু করেন সম্পাদক অনিন্দ্য ভট্টাচার্য।
শুরুর কথায় অনিন্দ্য ভট্টাচার্য
বন্ধুপ্রতীম নিকটজনের প্রয়াণের পর তাঁর স্মৃতিতে ফরমায়েশি লেখার কাজকে ডোমের মড়া পোড়ানোর সাথে তুলনা করে মধুময় পাল অনুষ্ঠানের প্রথম ভাগের শুরুতে সদ্যপ্রয়াত রবিশংকর বলের সাথে তাঁর ব্যক্তিগত অম্লমধুর সম্পর্কের জোয়ার-ভাঁটার ওঠানামা সকলের সাথে ভাগ করে নেন। এর আগে সংবাদপত্রের প্রয়োজনে অগ্ৰজ আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখের স্মৃতিচারণায় হাতে কলম নিতে হয়েছে। কিন্তু এবার বছর পাঁচ-ছয়েকের ছোট সুহৃদের মৃত্যুতে একঘর লোকের সামনে কিছু বলতে কুন্ঠিত হয়ে পড়ছেন তিনি। শক্তি চট্টোপাধ্যায় ১৯৯৫ সালের ২৩ মার্চ মারা যান। সে সময় সান্ধ্য প্রতিদিনের গল্পের পাতা দেখতেন রবিশংকর বল। ২৫ তারিখ সান্ধ্য প্রতিদিনে জাহ্নবী গঙ্গোপাধ্যায় কবিকে স্মৃতিতর্পণ জানালে তারই সাথে মধুময় পালের ছোটগল্প 'নদী নদী খেলা' প্রকাশিত হয়। গল্পটিকে বলা যায় বাণিজ্যিক কাগজে ছাপানো মধুময়দার প্রথম সাহিত্যকর্ম। অর্থাৎ, অগ্ৰজ কবির মহাপ্রয়াণের পাশাপাশি বাণিজ্যিক কাগজের সাহিত্যাঙ্গনে মধুময় পালের অনুপ্রবেশ কাকতালীয় ভাবে একই সাথে ঘটে এবং অনুঘটকের কাজটি করেন রবিশংকর বল। সেই ১৯৯৪ সালে প্রদীপ ভট্টাচার্য সম্পাদিত 'একালের রক্তকরবী' পত্রিকায় রবিশংকর বলের উপন্যাস
স্বপ্নযুগ পড়ে অভিভূত হয়ে মধুময়দা যেচে আলাপ করেন রবিশংকর বলের সঙ্গে। উল্টোদিকে ১৯৯৬তে লেখা মধুময়দার প্রথম উপন্যাস
আলিঙ্গন দাও নারী রবিশংকর দ্বারা উচ্চপ্রশংসিত হয়। মধুময়দার নিজের বাঁধা সময়ের চাকরি আর মফস্বলে বসবাসের কারণে দুজনের আলাপ বন্ধুত্বের পর্যায়ে হয়তো উন্নীত হতে পারেনি, কিন্তু বিজ্ঞাপনের প্রয়োজনে মধুময়দার লেখা রবিশংকর বল বাণিজ্যিক কাগজের পূজাবার্ষিকী থেকে বাদ দিলে তা কিন্তু তিক্ততা বয়ে আনেনি। এমনকি মধুময়দাও নির্দ্বিধায় ওঁর লেখার সমালোচনা করেছেন। তবে পরবর্তীতে বিভাস চক্রবর্তীর
যদুমধুর জার্নাল বইটির সমালোচনা প্রকাশ হওয়াকে কেন্দ্র করে দুজনের দূরত্ব বাড়ে যা রবিশংকর বলের আকস্মিক প্রয়াণে চিরকালের জন্য অনতিক্রম্য রয়ে গেল।
রবিশঙ্কর বল স্মরণে বললেন মধুময় পাল
আবেগসর্বস্ব নাটুকেপনা এবং আঁতেল মারপ্যাঁচ বা কৃত্রিমতার প্রতি উদাসীন মণীন্দ্র গুপ্ত চিরকাল মগ্ন ছিলেন নিজের জীবনবিশ্বাসে আর ক্ষমতাবিপ্রতীপে নিজের অবস্থানে। গৈলা গ্ৰামে জন্মানো, সেনাবাহিনীতে জরিপের কাজ করা কেউ কখন মণীন্দ্র গুপ্ত হয়ে ওঠেন সে রহস্য খোঁজে অতনু ভট্টাচার্য তাই পাঠক-সম্পাদক-কবি-গদ্যকার মণীন্দ্র গুপ্তকে পেঁয়াজের খোসার মতো ছাড়িয়ে আলাদা করে বুঝতে চান। হাজার বছরের বাংলা কবিতার তিনি একজন নিবিড় পাঠক। এই পাঠকসত্তার একটি পরিবর্ধিত রূপই তাঁকে শুধু 'পরমা' পত্রিকার পত্রিকার সুসম্পাদনা নয়,
আবহমান বাংলা কবিতা নামে তিনটি খণ্ডের ধীমান কাজেও প্রেরণা জুগিয়েছিল। এমনকি তরুণদের কবিতাও তিনি পড়তেন, ফোন করে জানাতেন। তাঁর কবিতায় ধ্রুপদী প্রাচীর, চিৎকৃত প্রতিবাদ, পঞ্চাশের আত্মরতি বা ইউরোকেন্দ্রিকতা লক্ষ করা যায় না; বদলে পাওয়া যায় এক স্বকীয় দৃষ্টিকোণ, কাব্যিক চিত্রধর্মিতা আর কাহিনি বলার উৎসাহ। তাঁর কবিতায় নৃতাত্ত্বিক প্রয়োগও একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। ছন্দশাসিত না হলেও
নীল পাথরের আকাশ (১৯৬৯),
আমার রাত্রি (১৯৯৪),
মৌ পোকাদের গ্ৰাম (১৯৭৪) বইতে মিশ্র কলাবৃত্ত ও দলবৃত্ত ছন্দের প্রাধান্য দেখা যায়। অন্যদিকে পুরস্কার নিয়ে মাথা ঘামাননি কোনওদিন, সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পেলেন বৃদ্ধ বয়সে
বনে আজ কনচার্টো কবিতা গ্ৰন্থের জন্য। কবিতার পাশাপাশি কবিতার অনুষঙ্গে লিখলেন অমোঘ কিছু গদ্যগ্ৰন্থ।
অক্ষয় মালবেরি থেকে আমরা তাঁর গদ্যের ভক্ত হয়ে গিয়েছিলাম কার্যত। ছোটাছুটি করে মার্কামারা কবি হতে গেলে জীবিত কবির প্রেত হওয়া যায় বড়জোর, এই সাবধানবাণীও তিনি আমাদের শুনিয়েছেন
চাঁদের ওপিঠে গ্ৰন্থে।
পরবাসী, কুড়ানি দারুমা সান এর ছয়টি নিবন্ধ ভাষা, জীবনের বহুমাত্রিকতা, প্রকৃতি, কবি, সন্ন্যাসী, ঈশ্বর, মৃত্যু ইত্যাদি নিয়ে যেন মহাসঙ্গীত ! লোকশিল্প, আধুনিক চিত্রশিল্পী, কারুকলার ওপর কবির টান অকৃত্রিম। ভগ্ন শরীর নিয়েই তাই লিখলেন রামকিঙ্করকে নিয়ে। সবশেষে অতনুদার মূল্যায়ণে মণীন্দ্র গুপ্ত শুধু পথিক নন, পথকার, এমন পথ যার শেষ নেই।
মণীন্দ্র গুপ্ত স্মরণে বললেন অতনু ভট্টাচার্য
বেসুতে ১৯৬২ সালে ধ্রুবজ্যোতি ঘোষ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সে ভর্তি হয়েছিলেন; কিন্তু প্রয়াণকালে সেই জগৎ ছাপিয়ে তিনি সাধারণ বাঙালির কাছে পরিবেশপ্রেমী তথা গণবিজ্ঞান আন্দোলন সংগঠক হিসেবে অধিক সমাদৃত। এই কথা প্রথমে উল্লেখ করে বেসুতে তাঁর চেয়ে এক বছরের বড় জয়ন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করালেন ধ্রুপদী প্রযুক্তিবিদ্যা থেকে জনবিজ্ঞানের জগতে ধ্রুবজ্যোতি ঘোষের এই সঞ্চরণ একদিনে হয়নি। আসলে যে পূর্ব কলকাতা জলাভূমির সাথে তার নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িত তাকে রামসর ঘোষণায় তাঁর ব্যগ্ৰতার প্রেক্ষাপট অনেক পূর্বেকার। জয়ন্তবাবুর মতে, ধ্রুবজ্যোতি ঘোষ শুধু বিজ্ঞানী ছিলেন না, বিদ্বান বিজ্ঞানী ছিলেন যাঁর কর্মজীবনের অভিলক্ষ্যই ছিল সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে অনবরত নিরীক্ষণ করা। তাই খবরের কাগজের কলামে তাঁর শাণিত যুক্তির সাথে সাথে সমাজবীক্ষণের পরিচয় পাওয়া যেত বহু আগে থেকেই। আর শুধু জনবিজ্ঞানের প্রসারই নয়, জনবিজ্ঞান আন্দোলনের সংগঠন যাতে তাঁর অবর্তমানে দুর্বল না হয়ে যায় সেজন্য যোগ্য উত্তরসূরিদেরও তিনি নিজেই নির্বাচন করে গিয়েছিলেন। সেই তরতাজা যুবশক্তিই ভবিষ্যতে তাঁর আদর্শ আর কর্মসূচি অটুট রাখবে। তাই সম্প্রতি পরিবেশের ক্ষতির সাথে সাথে ধাপায় খেটে খাওয়া সব্জিচাষী বা মাছচাষীদের রুটিরুজিতে টান পড়ার সম্ভাবনা দেখা দিলে দ্রুত জন আন্দোলন সংগঠিত করে আদালতে কীভাবে এগোনো যায় সে সব বিষয়ে মাথা ঘামাতে শুরু করে দেন তিনি। অন্যদিকে ধ্রুবজ্যোতির যে পরিচয়টা কেবল জয়ন্তবাবুর মতো নিকটবন্ধুর কাছেই ধরা পড়ে তা হল বিজ্ঞানের একেবারে হালফিলের এমন সব গবেষণায় তাঁর আগ্ৰহ যেগুলো নিছক জীবনযাপনে ছাপ ফেলা গবেষণা নয়, মানবসমাজের মোড় ঘোরানো আবিষ্কার, যাকে হয়তো কায়েমী স্বার্থ কুক্ষিগত রাখতে চায়। যেমন ১৯৬৩ সালে আবিষ্কার হওয়া ইন্টারনেটকে মার্কিন সামরিক বিভাগ ঠান্ডা লড়াইয়ের কারণে গোপন রেখেছিল নয়ের দশক পর্যন্ত এবং সোভিয়েত অবসানে তা খোলা বাজারে ছেড়ে বিশ্বায়নের সময়ে বিপুল আর্থসামাজিক বা রাজনৈতিক ফায়দা লোটা হয়। ধ্রুবজ্যোতি সর্বদা নিজেকে এ ধরনের গবেষণা বা আবিষ্কার সম্পর্কে সচেতন রাখতেন। তাই ধ্রুবজ্যোতি ঘোষ বলতে শুধু সমাজের নিপীড়িতদের প্রতি দরদ বা বেআইনি কাজের বিরোধিতা বোঝায় না, বিজ্ঞানের প্রতি আনুগত্য বা বিজ্ঞান গবেষণার জনকল্যাণকর অভিমুখটিও প্রাধান্য পায়। জয়ন্তবাবুর মতে, ধ্রুবজ্যোতি ঘোষ এবং 'একক মাত্রা'র অভিমুখ ও কর্মকান্ড তাই যেন মিলেমিশে যায়।
ধ্রুবজ্যোতি ঘোষ স্মরণে বললেন জয়ন্ত বন্দ্যোপাধায়
কলিম খানকে 'একক মাত্রা'র তরফে স্মারক দিলেন অবন্তী কাঁঠাল
প্রকাশ পেল 'একক মাত্রা'র মার্চ সংখ্যা।
বাঁদিক থেকে দেবলীনা ভট্টাচার্য, অরুণাভ বিশ্বাস, অনিন্দ্য ভট্টাচার্য, কলিম খান, মধুময় পাল ও দেবাশিস নন্দী।
শিক্ষিত-অশিক্ষিত গোত্রভাগের বাইরেও কলিম খানের মতো কেউ কেউ হয়ে ওঠেন স্বশিক্ষিত। সহযোগী নারায়ণ চন্দ্র দাসের মতে এই তৃতীয় গোত্রের মানুষ হলেন কলিম খান যাঁকে এক কথায় বলা যায় স্বশিক্ষিত ভাষা দার্শনিক। নারায়ণবাবু উপস্থিত শ্রোতাদের জানান, কলেজে পা দিতে না দিতেই ছাত্র রাজনীতিতে অংশ নিতে গিয়ে মার্কসীয় তত্ত্বের দ্বারা প্রভাবিত হলেও মার্কসবাদের ফলিত রূপে কিছু বিকৃতি দেখে চিরকালের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাচর্চার পরিসরকেই হেলায় অবহেলা করেছিলেন কলিম খান। এই সাহস এবং আত্মবিশ্বাসের উৎস হয়তো তাঁর জন্মস্থান ও বেড়ে ওঠার মধ্যেই নিহিত ছিল। জন্ম মেদিনীপুরের ডেবরার কাঁসাই নদীর ধারের গন্ডগ্ৰাম মানুদাবাদে। মাতৃভাষা আরবি-ফারসি-হিন্দি-বাংলা মিশ্রিত 'খেড়িয়া-বোলি'। বেড়ে ওঠা আপন খেড়ে-মুসলিম সম্প্রদায়ের সাথে সাঁওতাল, ভূমিজ, মাহালি প্রভৃতি আদিবাসী ও কৈবর্ত-চণ্ডালের মতো অন্ত্যজ বাঙালি জনগোষ্ঠীর মিশ্রণে গঠিত এমন গ্ৰামীণ পরিবেশে যেখানে মুসলিমদের ধর্মসভা কাওয়ালি মহরম জারিগান সারিগান, আদিবাসীদের ভাদু টুসু মকর মুরগি লড়াই এবং হিন্দুদের শঙ্খনাদ কীর্তন কবিগান ইত্যাদির অঢেল আহ্বান। সেই সাথে পারিবারিক সূত্রে পান সুফি উত্তরাধিকার। মার্কসবাদী দলগুলির উপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে যখন কলেজ ছাড়লেন তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না কীসের আশায় ভারতের বৈচিত্র্যময় ঐক্যের মধ্যে বেড়ে ওঠা কলিম খান ফিরে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথের কাছে। উপনিষদস্নাত রবীন্দ্রনাথের লেখায় খুঁজে পেয়েছিলেন প্রাচীন ভারতীয় ধর্মগ্ৰন্থ পুরাণ বা রামায়ণ-মহাভারতের মতো মহাকাব্যের ঐতিহাসিক গুরুত্ব। কিন্তু বাংলা কৃত্তিবাসী রামায়ণ পড়তে গিয়ে প্রথম ছত্রেই গেলেন আটকে:
গোলোক বৈকুণ্ঠপুরী সবার উপর।
লক্ষ্মী সহ তথায় আছেন গদাধর।।
এর ইংরেজিতে অনুবাদযোগ্য সর্বজনবোধ্য মানে খুঁজতে গিয়ে যখন বহু পুরাণ ও ইতিহাস গ্ৰন্থ, অভিধান ইত্যাদি ঘেঁটেও সন্তুষ্ট হলেন না তখনই একদিন ত্রাতা হিসেবে পেয়ে যান নমস্য হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের
বঙ্গীয় শব্দকোষ নামক আলিবাবার গুপ্তভান্ডার যার খুল যা সিম সিম মন্ত্র ক্রমে তিনি নিজেই আবিষ্কার করে নেবেন বয়ঃজ্যেষ্ঠ রবি চক্রবর্তীর সাথে মিলে। 'গোলোক' 'বৈকুণ্ঠপুরী' 'লক্ষ্মী' 'গদাধর' ইত্যাদি শব্দগুলোর ক্রিয়াভিত্তিক ব্যুৎপত্তিগত অর্থ নিষ্কাশন করে যা পাওয়া গেল তা রামায়ণের প্রচলিত পাঠকেই দিল বদলে। প্রাচীন গ্ৰন্থগুলিতে কী পড়ছি তা থেকেও বড় হয়ে দাঁড়াল কীভাবে পড়ছি। তাই পড়া আর বোঝার সরলরৈখিক সম্পর্কের প্রকরণ গেল পাল্টে। উন্মোচিত হল ঔপনিবেশিক চিহ্নভিত্তিক ইংরেজি ভাষার রাজকীয় দাপটে আত্মবিস্মৃত বাঙালি জাতি কীভাবে তার ক্রিয়াভিত্তিক পরমা বাংলাভাষাকে হারিয়ে ফেলে পশ্চিমি logocentric ভাষাতত্ত্বকে মান্যতা দিয়ে এসেছে। বাঙালির ভাষা দর্শনের এই দৈন্যের স্বরূপ উদ্ঘাটন করেই তিনি ক্ষান্ত হননি, নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছেন এক নিবিড় চর্চায়। সেই চর্চা শব্দকে দেহ এবং তার অর্থকে মন হিসেবে দেখে এ দুয়ের মধ্যে এমন এক নিরুক্ত (semantic) সম্পর্ক আবিষ্কার করা যা সুদূর অতীতে অ্যারিস্টটল থেকে হাল আমলের চমস্কি পর্যন্ত পশ্চিমি ভাষাতাত্ত্বিকদের মতানুযায়ী আলগা খেয়ালখুশি-নির্ভর (arbitrary) তো নয়ই, বরং নিবিড় ও অবিচ্ছিন্ন। নারায়ণবাবুর মতে, কলিম খান আক্ষরিক অর্থেই পরমা ভাষার একজন একাগ্ৰ সাধক (achiever) -- অর্থাৎ 'সাধন' করেন যিনি, প্রাচীন ভারতীয় ভাষাদর্শনের নিভৃত মুনি -- অর্থাৎ 'মনন' সঞ্চিত রয়েছে যার মধ্যে (intellectual)। তাঁর সাধনা পরমা ভাষার গভীরে, ভাবের গভীরে, শব্দকে ভেঙ্গে বর্ণে, বর্ণকে ভেঙ্গে লিপি ও ধ্বনির উৎসমুখে পৌঁছে পরম জ্ঞান লাভ করে পরম আলোয় স্নাত হওয়ার সাধনা। তাই, অ্যাকাডেমিক বিদ্যাচর্চার জগতে তথাকথিত স্নাতক স্তর না পেরলেও কিছুই যায়-আসে না কলিম খানের। একইভাবে, এশিয়াটিক সোসাইটির মতো প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যায়তনের দ্বারা উপেক্ষিত হলেও ভাগে পাওয়া পৈতৃক সম্পত্তির জমি বেচে নিজের বই ছাপাতেও কোনও দ্বিধা হয় না।
কলিম খানের সঙ্গে শ্রোতাদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন নারায়ণ চন্দ্র দাস
বলছেন কলিম খান
অনুষ্ঠানের মূল অংশে 'বাংলা ভাষার সম্পদ কোথায়' শীর্ষক বক্তৃতায় কলিম খান উপস্থিত সকলকে জানান যে মানুষের ভাষার প্রকৃত শক্তি বা সম্পদ কোনগুলি, বিশ্বের কোন ভাষায় ঐ সম্পদ কী পরিমাণে রয়েছে অথবা সবচেয়ে বেশি পরিমাণে রয়েছে, এসব জানার সহজ কোনও উপায় নেই। ভাষার শক্তিগুলিকে চিহ্নিত করা ও তাদের তুলনামূলক আলোচনা আজ পর্যন্ত কেউ গভীরভাবে না করায় কলিম খান ও তাঁর অগ্ৰজ সুহৃদ রবি চক্রবর্তী এ বিষয়ে অগ্ৰসর হন। কিন্তু এই পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যায়তনে শেখানো ইতিহাসজ্ঞান ও ভাষাজ্ঞান। এর বিপরীতে যে রামায়ণ-মহাভারত-পুরাণাদি গ্ৰন্থকে অ্যাকাডেমিক বিদ্বজ্জন মিথ-মিথ্যা-মিথলজি বলে এসেছেন তাকেই স্কুলশিক্ষাও সম্পূর্ণ না করা রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন ভারতবর্ষের প্রকৃত ইতিহাস। কাজেই বিপথগামী রবীন্দ্রনাথকে আশ্রয় করে সেইসব প্রাচীন গ্ৰন্থাদি নির্দেশিত পথে শুরু হল দুজনের যৌথ পথচলা। কিন্তু সেই পথে এগোতে না এগোতেই পশ্চিমি প্রতীকী শব্দার্থবিধির ঘেরাটোপে পড়ে বুঝলেন, গাধাকে গাধা বলা হয় কেন, 'ভাষার অত্যাচার' প্রবন্ধে সুকুমার রায়ের সেই প্রশ্নের জবাব সেখানে নেই। কেননা প্রতিষ্ঠান তা জানে না, জানতেও চায় না, গাধারা গাধাই রয়ে যায় চিরকাল। বহু চেষ্টায় তাঁরা দুজনে সেই ঘেরাটোপ থেকে মুক্তির পথ পান এবং সে পথ পাওয়া যায় বহুকাল ক্রমাগত ও ধুলিধূসরিত ভারতবর্ষের নিজস্ব শব্দার্থবিধিতে, যে বিধির প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধন করে নাম রাখা হয় 'ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক-শব্দার্থবিধি'। শুধু তাই নয়, সেই বিধি অনুযায়ী কলিম খান এবং রবি চক্রবর্তী দুই খণ্ডে বৃহৎ
বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ প্রণয়ন করেছেন। পাতা ওল্টালে জানা যাবে 'গাধ' কথাটির মানে অল্প; আর তার সাথে আ-কার যোগ করলে মানে দাঁড়ায় অল্পের আধার। মানুষের মগজকে ঘট বা পাত্রের সাথে তুলনা টানা হয় বলেই 'গাধা' কথাটি কম মেধাসম্পন্ন ব্যক্তি সম্পর্কে ব্যবহৃত হয়। এবার কম মেধাসম্পন্ন ব্যক্তির আচরণগত সাদৃশ্য একটি বিশেষ চতুষ্পদ জন্তুর আচরণের সাথে মিলে যায় বলে ঐ জন্তুটিকেও বলা হতে লাগল গাধা। অর্থাৎ, শুরুতে গাধা বিশেষণটির সাদৃশ্যগত এবং অদৃশ্যগত দুটি ভিন্ন অর্থ একইসাথে বজায় থাকলেও মূল সাদৃশ্যগত অর্থটি বিলুপ্ত হয়ে বর্তমানের অর্থটি ঐ জন্তুর আচরণ সম্পর্কে ব্যবহৃত হয়ে বিশেষ্যে পরিণত হয়েছে। বিপরীতক্রমে গাধ শব্দের সাথে অ- উপসর্গ যোগ করলে হয় 'অগাধ', যার মানে দাঁড়ায় অল্প নয়। এজন্যই ঘটে যথেষ্ট বিদ্যাবুদ্ধি আছে, এক কথায় পণ্ডিত বা বিদ্বান, এমন কারোর সম্পর্কেই শব্দটি ব্যবহৃত হয়। প্রসঙ্গত বলা যায়, 'যাচ্ছেতাই' শব্দের অর্থ হল যা ইচ্ছে তাই বা যাদৃচ্ছিক; কিন্তু লক্ষণার্থে যাচ্ছেতাই মানে 'যা ভালো নয়'। বিখ্যাত ভাষা দার্শনিক Ferdinand de Sassure প্রমুখ পাশ্চাত্য দার্শনিকরা মনে করেন শব্দের অর্থ যাদৃচ্ছিক (word meanings are arbitrary), অর্থাৎ কোন শব্দের কী অর্থ হবে তার কোনও নির্দিষ্ট নিয়ম নেই। গাধাকে কেন গাধা বলে বা ঘোড়াকে কেন ঘোড়া বলে তার কারণ জিজ্ঞাসা করলে ঐসব পণ্ডিতরা বলবেন যে ওসব প্রথামাফিক হয়ে আসছে। সে কারণেই কলিম খান ও রবি চক্রবর্তীর মতে অমন নীতিতে লেখা বর্ণানুক্রমিক অভিধান 'যা ইচ্ছা তাই মানে যুক্ত' (arbitrary), আসলে তা যাচ্ছেতাই। এই পুরো ব্যাপারটা সুকুমারভক্ত শুভাশিস চিরকল্যাণ পাত্রের লেখা
বর্ণসঙ্গীত নামের বইয়ের শুরুতেই এমন উপভোগ্য ভাবে দেওয়া আছে যে এখানে উদ্ধৃত করার লোভ সামলানো গেল না :
সুকুমার তুমি বর্ণমালার তত্ত্ব করিলে শুরু;
আজকে তোমায় বন্দনা করি, তোমাকেই মানি গুরু।
পদাবলী দিয়ে লিখে এক ক্রিয়াভিত্তিক অভিধান,
অ-আ-ক-খ অক্ষরে কত জাদু দেব তার সন্ধান।
জানি হে ভাবুক সুকুমার, তুমি রেগে যেতে খালি খালি,
অভিধান আর ব্যাকরণে দিতে তেড়েফুঁড়ে গালাগালি।
কোথা থেকে হয় অর্থের শুরু, কোথা দিয়ে হয় শেষ?
গাঁজাখুরি যত অভিধানগুলি করে নাই তাহা পেশ।
বস্তুর গায়ে যে কোনো নামের লেবেল লাগিয়ে দিলে,
যাহা খুশী তাহা নাম দিলে কেহ, তাকে পাগলামি বলে।
গাধা কেন গাধা লুচি কেন লুচি, সেই কথা বল নাই ;
টুকে টুকে লেখা অভিধান হয় অতীব যাচ্ছেতাই !
ব্যাকরণ মানে ভাষাতত্ত্বের ভুসিমাল শুধু নয়,
শব্দের মাঝে মানব জাতির ইতিহাস কথা কয়।
বাঙালীরা গেছে ব্যাকরণ ভুলে, পড়ে না মুগ্ধবোধ ;
তাই তারা গেছে ইতিহাস ভুলে -- শব্দের প্রতিশোধ।
সুকুমারের স্কেচে গাধার বোকামির নমুনা
এ কথা তো অনস্বীকার্য যে কোন জাতি কী ভাষায় কথা বলবে সেটি ঠিক হয় কোন ধরনের উৎপাদন কর্মযজ্ঞের নেতৃত্বে জাতিটির সমাজজীবন চলছে তাই দিয়ে। কর্মযজ্ঞের নেতৃত্বে ভারীশিল্প বা কর্পোরেট থাকলে কর্পোরেটবান্ধব চিহ্নভিত্তিক প্রতীকী ভাষাকয়টিই টিকবে, বাকি ভাষাগুলির মৃত্যু অনিবার্য। বাংলাভাষাও এই বিপদের বাইরে নয়। কিন্তু পরিত্রাণের পথ যে একেবারে নেই তা নয়। কলিম খানের মতে, বাংলা ভাষার সম্পদ উপলব্ধি করতে পারলেই তা সম্ভব। কাজেই 'ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থবিধি' সম্পর্কে আর বিস্তারিত আলোচনায় না গিয়ে সরাসরি ফেরা যাক কলিম খানের মূল বক্তৃতায় যেখানে তিনি ইংরেজি ভাষার সাথে প্রতিতুলনায় মোট বারোটি ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার সম্পদ বিবেচনা করলেন।
শ্রোতাদের আরেক অংশ
কোন ভাষায় কত মহান সাহিত্য রচিত হয়েছে তা দিয়ে সেই ভাষার অর্জিত সম্পদের পরিমাণ জানা গেলেও ভাষাটির প্রকৃত সম্পদের পরিমাণ জানা যায় না। তার জন্য কিসের দ্বারা ঐ অর্জিত সম্পদ সংগ্ৰহ করা গেল তার খবর নিতে হয়। এর উত্তরে কলিম খান বলেন তা আসলে মানবমনের গভীরে চিন্তনযজ্ঞের ভাষা-প্রকরণ নামের এক কর্মশালা। মাল পরিবহণব্যবস্থার অনুষঙ্গে বিচার করে তিনি বোঝান এই ভাষা-প্রকরণ কার্যত হল মানুষের চেতনায় ধরা দেওয়া ও ধরে রাখা 'ধারণা'সমূহকে বাঁধাছাঁদা করে শ্রোতা বা পাঠকের কাছে প্রেরণের এমন এক সার্বিক মানসিক পরিবহণ ব্যবস্থা যার প্রধান শক্তি হল 'ধারণা' নাড়াচাড়া ও বাঁধাছাঁদা করার উপকরণ বা হাতিয়ারের সম্ভার। কলিম খানের অনবদ্য উপমায় ভাষা-প্রকরণ চেতনার ভাণ্ডারে স্মৃতি-শ্রুতিতে থাকা 'ধারণা'সমূহকে অজস্র শব্দ শব্দবন্ধ শব্দজোড় বাগধারা বাক্য ইত্যাদির সাহায্যে সাঁড়াশি শাবল চিমটা দড়াদড়ি দিয়ে ধরার মতো ধরে অথবা কপিকল ক্রেন ইত্যাদির মতো নাড়াচাড়া করে, পাঁচ-দশটি শব্দ বা শব্দবন্ধের একাধিক বাক্যের বাণ্ডিল বা গুচ্ছ তৈরি করে, তারপর বিভিন্ন মাপের বয়ান ভাষণ কবিতা গল্প উপন্যাস বা প্রবন্ধের গাঁটরিতে সেগুলোকে রাখে, এবং গ্ৰন্থের ছোটবড় গাড়িতে তুলে শ্রোতা বা পাঠকের কাছে নিয়ে যায়। এই হল ভাষা-প্রকরণের প্রকৃত কার্যপ্রণালী যার শুরুর ধাপে পূর্বকথিত হাতিয়ারের সম্ভার যে ভাষায় যত বেশি, যত ভাল, সে ভাষা তত প্রকৃত সম্পদের অধিকারী। এখন ইংরেজি ভাষার সাথে তুলনায় বাংলা ভাষার বারোটি হাতিয়ারকে কলিম খানের মতো করে বুঝে নেওয়া যাক।
(১) মূল শব্দসম্ভার:
কলিম খান ও রবি চক্রবর্তীর মতে বাংলা ভাষার 'অ' 'আ' 'ক' 'খ' ইত্যাদি মাতৃকাবর্ণগুলির প্রতিটিই নিজ নিজ অর্থ ধারণ করে এবং তদুপরি ১১ রকম -কার ও ৭ রকম -ফলা সমেত শব্দগুলিকে সংখ্যায় বহুগুণ বাড়িয়ে তোলে। ইংরেজি অ্যালফাবেটগুলি প্রাচীন কালে কোনও এক সামাজিক বিপর্যয়ের কারণে নিজেদের নিহিতার্থকে হারিয়ে ফেলেছে। কেবল 'I' বলতে আমি এবং 'a' বলতে একটি বোঝায়। কিন্তু বাংলার ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থতত্ত্ব ইংরেজির বিলুপ্ত শব্দগুলিকে উদ্ধারের পথ দেখাতে পারে। যেমন, বাংলার 'তৃ' আর ইংরেজি 'tree' একই শব্দসম্ভারের অন্তর্গত। তৃণ অর্থে ঘাস বোঝায়। বাঁশগাছ তৃণই বটে যা খুব তাড়াতাড়ি বাড়ে। আবার বয়ঃসন্ধি পার করলে বাচ্চারা তাড়াতাড়ি মাথায় বেড়ে তরুণ-তরুণী হয়ে ওঠে। আবার তরু মানেও গাছ যা তরতরিয়ে বাড়ে। ইংরেজি tree মানে গাছ সে তো বলাই বাহুল্য। এমনি ভাবেই দেখানো যাবে বাংলার 'কৃ' আর ইংরেজির 'cre' (create) একই শব্দসম্ভারের উত্তরাধিকার।
(২) প্রতীকী শব্দসম্ভার:
বঙ্গতীর্থে মুক্তিস্নান গ্ৰন্থে কলিম খান ও রবি চক্রবর্তী দেখিয়েছেন উত্তরাধিকার সূত্রে লব্ধ বিভক্তি-প্রত্যয়-উপসর্গাদি-যোগহীন শব্দসমূহের বর্ণভিত্তিক-ক্রিয়াভিত্তিক বহুরৈখিক অর্থকে ছেঁটে দিয়ে তাকে একটি মাত্র অর্থবাচক শব্দ করে নিতে পারলে এবং এই শব্দের নির্মাণসূত্রটি ভুলে গেলে, তবেই সেটি সম্পূর্ণভাবে প্রতীকী শব্দ হয়। এই বিচারে প্রতীকী শব্দগুলি ইংরেজি ভাষাতে অতীতহারা হয়ে থাকলেও বাংলা ভাষার এমন এক হাতিয়ার যা অতীত সহ বিদ্যমান। তার কারণ, বাংলা ভাষায় শব্দেরা তাদের কুলগোত্রাদির সংবাদ নিয়েই বর্তমান। এই প্রতীকী শব্দসম্ভার নিয়ে অন্য সব ভাষার মতো বাংলা এবং ইংরেজি ভাষারও যাত্রা শুরু হয়। ইতিহাসের মারে যৌথসমাজ ভেঙে পরিবারভিত্তিক (ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী ব্যক্তিমালিকানাবাদী) সমাজের দিকে দৌড় শুরু করায় একই কর্মের পুনরাবৃত্তি প্রয়োজন হয়ে পড়লে এর সমান্তরালে বহু অর্থবিশিষ্ট কোনও শব্দকে তার যে কোনো একটিই অর্থে বারংবার পুনরাবৃত্ত করার পরিবেশ তৈরি হয়। 'যে যায়' বলতে যা বোঝায় তেমন নানা সত্তাকেই আমাদের 'গো' শব্দ অনায়াসে বোঝাতে পারতো। এবার তার সেই নিহিত বা সহজাত অর্থগুলিকে নষ্ট করে তাকে শুধুমাত্র 'গরু' বানিয়ে ফেলা হল। গো শব্দের অর্থ থেকে বাকি গমনশীলেরা বাদ পড়ে গেল। ওদিকে ইংরেজ তার সেই একই অতীত ভুলে তাকেই বানিয়ে ফেলেছিল 'যাওয়া' (go)। অর্থাৎ, আদি শব্দের বহুরৈখিকতা নষ্ট করে তাকে একটি মাত্র অর্থে স্থির অনড় অটল করে দিয়ে তাকে প্রতীকী শব্দ বানিয়ে ফেলে ইংরেজির সঙ্গে বাংলা ভাষারও অন্তর্জলি যাত্রা শুরু হল। ফলে, ভাষার পশ্চাতে ক্রিয়াশীল আর্থ-সামাজিক শক্তিতে বলীয়ান হয়ে চিহ্নভিত্তিক ইংরেজি ভাষার রমরমা শুরু হল। শব্দের আঙুরথোকা ছিন্নবিচ্ছিন্ন অতীতহারা হয়ে কুলপরিচয়হীন অনাথের মতো হাজার হাজার (বিচ্ছিন্ন শুকনো কিসমিস স্বরূপ) একার্থবাচক প্রতীকী শব্দের ভাণ্ডার ভরে উঠতে লাগল ইংরেজি vocabulary। অন্যদিকে বাংলা ভাষাও দাপুটে ঔপনিবেশিক ইংরেজির চাপে এই প্রবণতাকে এড়াতে পারল না। 'জ্ঞানের সারবহনকারী বিশেষজ্ঞ' 'অশ্ব' পরিণত হয়েছে চতুষ্পদ 'ঘোড়া'য়; 'অশ্ব থাকে যে যৌথ সামাজিক সংস্থা'য় সেই 'অশ্বত্থ' পরিণত হয়েছে 'পিপুল' গাছে; 'যে অঙ্গ লইতে যায় সেই সরকারি খাজনা আদায়কারী' 'অঙ্গুলি' পরিণত হয়েছে শুধুমাত্র হাতের 'আঙুলে', ইত্যাদি।
(৩) বিভক্তিযোগ:
মধ্যশিক্ষা পর্ষদের অধীনস্থ ইস্কুলগুলিতে সপ্তম-অষ্টম শ্রেণিতে তৃতীয় ভাষা হিসেবে সংস্কৃত পড়ার অভিজ্ঞতা যাদের আছে তাঁরা নিশ্চয়ই শব্দরূপ-ধাতুরূপ মুখস্থ রাখার যন্ত্রণা বিস্মৃত হননি। যান্ত্রিকভাবে সেগুলি মুখস্থ রাখার বদলে বাংলা ভাষী জনসাধারণ সদা সর্বদা তাঁদের মনের গভীরে সেই কর্মযজ্ঞ চালিয়ে শব্দের রূপান্তর প্রক্রিয়া জারি রাখেন। এই নবরূপে সৃজন প্রক্রিয়ায় মূল বিশেষ্য বিশেষণ বা ক্রিয়াটির সাথে যে শব্দাংশ যোগ করে বহুরূপে বদলে ফেলা হয় তাকে বিভক্তি যোগ বলে। এ যেন একই যন্ত্রকে কখনও নখ কাটতে, কখনও নখ সমান করতে, কখনও কাগজ কাটতে, কখনও বোতল খুলতে, কখনও কর্কের ছিপি খুলতে ব্যবহার করার সামিল। এখন যেটা উল্লেখ্য সেটা হল, বাংলা ভাষায় এই বিভক্তিযোগের হাতিয়ারটি বিপুল পরিমাণে ব্যবহৃত হয়ে চলেছে, অন্যদিকে ইংরেজি ভাষায় তা কাজ চালানোর জন্য নামমাত্র বিদ্যমান। এখন কিছু উদাহরণ সহযোগে এই তফাতটা বোঝা যাক। যেমন 'মানুষ' শব্দটির সাথে টি, গণ, দের, কে ইত্যাদি শব্দাংশ যোগ করলে মানুষটি, মানুষগণ, মানুষগুলো, মানুষদের, মানুষকে, মানুষে ... ইত্যাদি নানা শব্দে বদলে ফেলা যায়। অথচ ইংরেজি 'man' শব্দে এমন বদল আনা সম্ভব নয়। একইভাবে হরিচরণের বঙ্গীয় শব্দকোষ ঘাঁটলে 'কর' শব্দ থেকে আমরা করা, করি, করেন, করিয়া, করিত, করিতে, করিতেন, করিব, করিবে, করিবেন, করিলে, করিলেন, করিবা, করিয়াছিল, করিয়াছিলে, করিয়াছিলেন, করিয়াছেন ... ইত্যাদি ১০৮ রকম শব্দ পাই। এবার 'কর' শব্দের ইংরেজি তিনটি প্রতিশব্দ ('do', 'make', 'work') বিচার করলে আমরা সাকুল্যে পাব do does did done doing; make makes made making; work works worked working। এই পরিসংখ্যান চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় কীভাবে বাংলাভাষায় আঙুরথোকাকে একটি শব্দ এবং ইংরেজি ভাষায় একটি শুকনো আঙুরকে একটি শব্দ হিসেবে গণ্য করার রীতিতে তাল না মেলায় আমরা মনে মনে ভাবি ইংরেজি ভাষার জোর তার বিপুল শব্দভাণ্ডারে যাতে নাকি ১০ লক্ষ শব্দ আছে। আর বাংলা ভাষা তুলনায় দুর্বল কারণ জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের অভিধানে শব্দসংখ্যা নাকি লাখ দুয়েকেই শেষ। কিন্তু কলিম খান ও রবি চক্রবর্তীর ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক পদ্ধতিতে গুনলে বাংলা ভাষার শব্দ সংখ্যা দাঁড়ায় ১৪ লক্ষের কাছাকাছি !
এখন বিভক্তিযোগের ভিত্তিতে বাংলা ও ইংরেজি ভাষার এই তফাত বোঝার পর দুটি প্রশ্ন উঠে আসে। ইংরেজি ভাষা আদিতে এমন শব্দরূপ-ধাতুরূপ বিহীন ছিল কিনা, এবং বর্তমানে বাস্তব পরিস্থিতি ক্রিয়ামূলক শব্দের বহু রূপ দাবি করলেও এই ভাষা তার অভাবকে পূর্ণ করছে কীভাবে। প্রথম প্রশ্নের উত্তরে কলিম খান জানান, শব্দোৎপাদনের এই প্রক্রিয়া প্রাচীন গ্ৰীক ও ল্যাটিন ভাষায় accidence নামে প্রচলিত ছিল যা মধ্যযুগে ৬০০ থেকে ১০০০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে ইংরেজি ভাষার আদিপর্বেও প্রচলিত ছিল। গ্ৰীক ও ল্যাটিন ছিল বাংলার মতো flexional ভাষা অর্থাৎ এমন ভাষা যেখানে শব্দের inflexion [= শব্দরূপ (declension) + ধাতুরূপ (conjugation)] নামক ব্যবস্থাটির ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইংরেজি ভাষার মধ্যযুগের গদ্যপদ্যের নমুনা থেকে বোঝা যাবে কবে দ্রুত হারে প্রাচীন জার্মান থেকে আগত flexional রূপ থেকে বর্তমানের analytic রূপের দিকে সরে এসেছে। দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে কলিম খান বলেন প্রধানত দুই উপায়ে ইংরেজি তার শব্দরূপ-ধাতুরূপের ঘাটতি মেটায়। বিশেষ্যর রূপান্তরহীনতা সামাল দেয় in, to, on, of, at, by, for, from ইত্যাদি তিরিশের কাছাকাছি preposition দিয়ে। ক্রিয়াপদের বেলায় be, been, being, am, is, are, was, were, has, have, had, shall, will, should, would, can, could, may, might ইত্যাদির ব্যাপক ব্যবহারে। তারপরেও অসুবিধা হলে আসরে নামানো হয় ভীতিকর phrasal verb-কে। ফলে, শুরু থেকেই ইংরেজি ভাষা ক্রাচনির্ভর হয়ে চলতে শুরু করে। ইংরেজিতে যখন বলা হয় "He is going", তখন যা বলা হয় তা হল "সে হয় যাওয়ন্ত।" আর তাকেই আমরা "সে যাইতেছে" বুঝে নিতে বাধ্য হই। কলিম খানের মতে সমগ্ৰ ইংরেজি ভাষাটিই এমন খোঁড়া বাক্যের স্তুপ। অন্যদিকে বিভক্তিনির্ভর রূপান্তরের ব্যবস্থা থাকায় বাংলা ভাষাতে শব্দের ক্রমিক স্থানবদল না করেও বলা যায় "মানুষটিকে বাঘটি মারিল", কিংবা, "মানুষটি বাঘটিকে মারিল।" কিন্তু ইংরেজিতে এই দুটি ভিন্নার্থবোধক বাক্য লিখতে গেলে কর্তা ও কর্মের স্থানবদল করতেই হবে -- "The tiger killed the man" এবং "The man killed the tiger"। সে কারণে কলিমবাবুর মতে ইংরেজির তুলনায় বাংলায় বক্তব্যকে অনেক বেশি সূক্ষ্মতায় প্রকাশ করা যায়।
(৪) প্রত্যয়যোগ:
বাংলা ভাষায় প্রায় ২০০টি প্রত্যয় রয়েছে যেগুলি যুক্ত হলে বিভক্তিহীন শব্দেরা অজস্র নতুন নতুন শব্দের জন্ম দিতে থাকে। যথা:
(-অন) চলন, বলন, কথন
(-অন্ত) জীবন্ত, পড়ন্ত, ভাসন্ত
(-তি) চলতি, পড়তি, উঠতি
(-আই) চড়াই, সেলাই, মালাই
(-আনী) শুনানী, উড়ানী
... এরকম অজস্র। এর সঙ্গে রয়েছে প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা উত্তরাধিকারসূত্রে লব্ধ প্রত্যয়যুক্ত শব্দের বিশাল সম্ভার। যেমন, কর্তব্য, দাতব্য, করণীয়, বরণীয়, ভোজ্য, বাহ্য, পেয়, দেয়, বহমান, দীপ্যমান, দৈনিক, মাসিক, জলীয় ইত্যাদি অজস্র প্রত্যয়যুক্ত শব্দ যা আমরা ব্যাকরণ না পড়েই নিত্য ব্যবহার করি। অন্যদিকে ইংরেজিতেও suffix-এর কমতি নেই। Teutonic প্রত্যয়যোগে সৃষ্ট শব্দের নমুনা হল : (-er/-or) teacher, tailor, (-dom) wisdom, (-hood) childhood, (-ness) goodness, (-ship) friendship, (-th) health, (-en) wooden (adj) shorten (verb), (-ful) truthful (-ish) boyish, (-ly) friendly (-less) hopeless, (-some) handsome ... এরকম প্রচুর। পাশাপাশি ইংরেজি ভাষার Latin বা ল্যাটিনজাত French প্রত্যয় (suffix) যোগে সৃষ্ট শব্দের কিছু নমুনা হল: (-ary) secretary, (-ee) devotee, (-tive) captive, (-ant/-ent) servant, student, (-age) bondage, (-nce) disturbance, (-ency) urgency, (-tion) action, (-sion) conversion, (-ment) movement, (-our) favour, (-tude) aptitude, (-acy) privacy, ... এরকম প্রচুর।
(৫) উপসর্গযোগ:
বাংলা ভাষায় ৫০টিরও বেশি উপসর্গ রয়েছে। একটি ক্রিয়াবাচক শব্দকে উপসর্গযোগ যে কী পরিমাণ পরিব্যাপ্ত করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে, উপসর্গযুক্ত শব্দগুলির দিকে তাকালেই বোঝা যাবে। যদি 'কর' শব্দটিকে নেওয়া হয় তাহলে দেখা যাবে উপসর্গ যুক্ত হয়ে সে আকর নিষ্কর তস্কর ... আকরণ প্রকরণ পুরস্করণ ... প্রকৃত বিকৃত সংস্কৃত ... আকৃতি বিকৃতি প্রকৃতি ... অধিকার অপকার আকার উপকার চীৎকার তিরস্কার ধিক্কার পরিস্কার পুরস্কার প্রকার বিকার সংস্কার ইত্যাদি অজস্র নতুন শব্দের স্রোতধারা সৃষ্টি করে দেয়। ইংরেজিতেও prefix উপসর্গের কাজ করে। ইংরেজির নিজস্ব prefixযোগে সৃষ্ট শব্দগুলির কয়েকটি নমুনা : (a-) awake, (be-) become, (for-) forget, (fore-) forecast, (in-) inside, (mis-) mistake, (out-) outlook, (over-) overflow, (to-) today, (un-) uncut, (under-) undertake, (up-) uphold, (with-) withdraw ইত্যাদি। এর সাথে গ্ৰীক এবং ল্যাটিন বা তদ্ববংশীয় ফ্রেঞ্চ উপসর্গ ধরলে আরও কিছু নমুনা দেওয়া যায় : decompose, disregard, excommunicated, international, abuse, advice, accept, affirm, aggravate, annual, approach, arrive, assent, attend, ছাড়াও post-, pre-, pro-, sub-, ইত্যাদি গ্ৰীক prefix যুক্ত শব্দ।
(৬) ক্রিয়াদিযোগ:
এ এক অদ্ভুত শব্দপ্রকরণ প্রক্রিয়া যার দ্বারা ক্রিয়ামূলক ধারণাকে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মরূপে ধারণ করে প্রকাশ করা হয়। এতে একাধিক ক্রিয়াপদকে সক্রিয় রেখেই একত্রে জুড়ে প্রকাশ করা হয়। যেমন ধরে ফেল, করে দিয়ে যেও, ভেবে চিন্তে দেখ, ধুয়ে মুছে সাফ কর, দেখে ফেলেছি, বলে দিয়েছি ইত্যাদি। এই ধরনের শব্দবন্ধ ইংরেজিতে বলা বা লেখা যায় না। এমনকি অনুবাদও করা যায় না। করলেও ভুল মানে দাঁড়ায়। যেমন "ধরে ফেলেছে" ইংরেজি অনুবাদে বলতে গেলে হয়ে যাবে "ধরেছে এবং ফেলেছে" ! ধরে যদি ফেলেই দেয় তাহলে অনুবাদটাই নিরর্থক হয়ে যায়। বাংলা ভাষার এ এক অমূল্য সম্পদ।
(৭) জোড়শব্দসম্ভার:
এটি বাংলা ভাষার প্রকৃতই বিশাল সম্পদ। ইংরেজি ভাষার এই শক্তি নেই বললেই চলে। যেটুকু আছে তা বাংলার তুলনায় নগণ্য। এ হল পরস্পরনির্ভর দুটি ভিন্নবোধক ধারণাধারী শব্দকে সাঁড়াশির মতো জুড়ে একটি পূর্ণাঙ্গ ধারণাধারী শব্দে পরিণত করা। ইংরেজিতে এইরূপ জোড়শব্দের কোনও প্রকরণ নেই তা নয়, তবে তা খুবই কম পরিমাণে আছে। যেমন dilly-dally, hanky-panky, hocus-pocus, knickknack, namby-pamby, tick-tock ইত্যাদি। বাংলা ভাষায় এই প্রকরণের অন্তত চার রকম প্রক্রিয়া আছে। সেগুলি নিম্মরূপ :
ক)
পরিপূরক জোড় :
আশেপাশে, সভ্যভব্য, বিষয়আশয়, ডালপালা, ছুতোনাতা, কলকব্জা, আদানপ্রদান, যত্নআত্তি, লালনপালন, ইত্যাদি অজস্র। এই শব্দগুলির বিশেষত্ব হল, এতে দুটি করে এমন শব্দ পাশাপাশি জুড়ে দেওয়া হয় যারা পরস্পরের পরিপূরক। যেমন, 'আশে' হল সেইসকল বস্তু বা বিষয়, মানুষ যাকে আশা করে বা মন দিয়ে ছোঁয়; এবার 'পাশে' হল সেই সব বস্তু ও বিষয় মানুষ যাকে তার শরীর বা দেহাংশ (হাত) দিয়ে স্পর্শ করতে পারে। স্পষ্টতই 'আশেপাশে' শব্দটি মানুষের দেহের ও মনের চারদিক ঘিরে থাকা সব বিষয় ও বস্তুকেই বোঝাতে সক্ষম হল। তেমনই, 'সভ্য' হল ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী হয়ে দূরত্বমূলক ঘনিষ্ঠতা রক্ষা করে চলায় অভ্যস্ত হওয়া; এবং 'ভব্য' হল যা কিছু এই জগতে জন্মেছে তাদের সকলের সঙ্গে মিলেমিশে থাকায় অভ্যস্ত হওয়া। অতএব বাংলাভাষীরা মনে করেন মানুষের 'সভ্যভব্য' দুইই হওয়া উচিত। 'লালনপালন' শব্দটিতেও বাংলা ভাষীরা বোঝেন যে শিশুকে ঠিকঠাক বড় করে তুলতে গেলে তাকে যেমন প্রকৃতির কোলে, বন্ধুদের কাছে, কার্যক্ষেত্রে অচেনা অদেখা বিপদে লেলিয়ে ('লালন') দিতে হবে তেমনি আবার কাছে টেনে আগলে রেখে আশ্রয় ও নিরাপত্তার আশ্বাস বজায় রাখতে ('পালন') হবে।
খ)
পুরুষ-প্রকৃতি জোড়:
যে কোনো দুটি ক্রিয়া বা বিশেষ্যকে পরপর জুড়ে নতুন ধারণাধারী শব্দজোড় সৃষ্টি করা যায়। যেমন বিশেষ্যের ক্ষেত্রে হাতাহাতি, কানাকানি, লাঠালাঠি, ইত্যাদি; তেমনি ক্রিয়াপদের ক্ষেত্রেও মারামারি, হাসাহাসি, বলাবলি, ইত্যাদি।
গ)
সহোদর জোড়:
একই ক্রিয়ার গর্ভ থেকে জন্মে দুটি আলাদা শব্দ এই প্রক্রিয়ায় ঐ মূলের একটি বিশেষ অর্থকে জোরের সাথে পরিস্ফুট করে। যেমন, কাটকুট, খুটখাট, গোলগাল, চুপচাপ, জটাজুট, ঢিলেঢালা, ইত্যাদি।
ঘ)
অনুকারী জোড়:
এতে যে কোনো শব্দের সঙ্গে তার অনুকারী শব্দ জুড়ে দিয়ে সাধারণভাবে 'এবং অন্যান্য' অর্থটি মূল শব্দটির পেছনে যোগ করে দেওয়া হয়। যেমন জল-টল, ভাত-টাত, চা-টা মন্ত্রী-টন্ত্রী, খাবার-টাবার ইত্যাদি।
(৮) বিন্দুযোগ:
বাংলা ভাষায় মানবশরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বোঝানোর জন্য যত শব্দ আছে (যেমন মাথা, কপাল, চোখ, কান, নাক, মুখ, জিভ, দাঁত, গাল, গল, ঘাড়, বুক, হাত, আঙুল, পেট, পা ইত্যাদি) তাদের প্রত্যেকের সম্পর্কিত ধারণাধারী অর্থও তাতে নিহিত আছে। এখন ঐ শব্দের পিছনে অন্য শব্দ জুড়ে নতুন ধারণা প্রকাশ করা হয়। এ যেন বিন্দুতে সিন্ধু দর্শন করে তার কথা বিন্দুর সাহায্যে বলা। যেমন মাথা-খাওয়া, মাথা-কোটা, মাথা-ঘামানো, মাথা-চালা, মাথা-চুলকানো, মাথা-ঠেকানো, মাথা-তোলা, মাথা-নোয়ানো, মাথা-কাটা যাওয়া ইত্যাদি বেশ কিছু শব্দ। একেবারে স্বতন্ত্র কিন্তু অদৃশ্য সত্তা বিষয়ক ধারণাকে প্রকাশ করার ক্ষমতা রাখে এইরকম শব্দজোড়। ইংরেজিতে অতি সামান্য পরিমাণে এরকম শব্দ আছে যেমন heading towards, handing over ইত্যাদি।
(৯) সন্ধিযোগ:
এই প্রকরণে দুই বা ততোধিক শব্দকে জুড়ে কিভাবে অগণিত নতুন শব্দ বানানো যায় পাঠক মাত্রেই তা জানেন। তাই কলিম খানের সেদিনের বক্তৃতার মতোই এখানে তার বিস্তারিত লেখা হল না। ইংরেজি ভাষায় সন্ধিযোগে নতুন শব্দ সৃষ্টি হওয়ার শব্দ-প্রকরণ নেই বললেই চলে।
(১০) সমাসযোগ:
এ হল সম্পূর্ণ একটি বাক্যকে একত্রিকরণের মাধ্যম। বাংলা ভাষার সমগ্র শব্দসমুদ্রের একটি বিশাল অংশ এই প্রক্রিয়ায় বানানো হয়ে থাকে। কলিম খানের পথ অনুসরণ করে উদাহরণ দিয়ে আর ব্লগ ভারাক্রান্ত করব না। ইংরেজিতেও বাংলা সমাসের মতো compound words আছে যেখানে দুটি শব্দ জুড়ে গিয়ে বিশেষ্য (railway, workshop, breakfast, handbook, shoemaker, farewell, welcome, salesman,afternoon ইত্যাদি) বা ক্রিয়া (browbeat, hoodwink, safeguard, overhear, whitewash ইত্যাদি) গঠিত হয়।
(১১) বাগধারা:
বাগধারা হল প্রকৃষ্টরূপে বানানো এক বা একাধিক শব্দের জ্ঞানমূলক শব্দবন্ধ বা বাক্যাংশ যাতে কথা বলা জাতিমাত্রেই তাঁদের অর্জিত অভিজ্ঞতা বা উচ্চমানের জ্ঞানকে ধরে রেখে জনশ্রুতির মাধ্যমে প্রবাহিত রাখেন। বাংলা ভাষায় এগুলির সংখ্যা প্রচুর। যথা পুকুর চুরি, মাথায় আকাশ ভেঙে পড়া, আঙুল ফুলে কলা গাছ, কলা দেখানো, বুদ্ধির ঢেঁকি, খাল কেটে কুমির আনা, ইত্যাদি। চেতনার এই হাতিয়ারগুলি শুধুমাত্র গভীর জ্ঞানমূলক ধারণাকেই ধরে রাখে না, ইতিহাসকেও বহন করে। তাছাড়া, এই বাগধারাগুলিতে কথিত শব্দের দৃশ্যগত অর্থ প্রায় থাকেই না, বা থাকলেও তার সাথে অত্যন্ত বাস্তব এবং জ্ঞানমূলক প্রতিপাদ্য অর্থটি একেবারেই মেলে না। 'পুকুর চুরি'র ক্ষেত্রে কলিম খান যেমন বুঝিয়ে দেন যে একটি আস্ত পুকুরকে জল সমেত লুকিয়ে কাঁধে করে বয়ে নিয়ে যাওয়ার উপায় আজও আবিষ্কার হয়নি। কার্যত এটা অসম্ভব; অর্থাৎ এই বাগধারাটির দৃশ্যগত কোনও অর্থই হয় না। কিন্তু বাংলা ভাষার ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থবিধি চর্চার দৌলতে কলিম খান ও রবি চক্রবর্তী দেখিয়েছেন 'পুকুর চুরি'র ধারণাটি একটি ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার। সংক্ষেপে, প্রাচীন ভারতে সমাজের যৌথসম্পদ রাখা হত মহর্ষির এক্তিয়ারে এবং মহর্ষি-রক্ষিত সেই সম্পদভাণ্ডারকে বলা হত ঋষিকুল্যা বা ঋষির পুকুর। সমাজে ব্যক্তিমালিকানার আবির্ভাবের পর সেই যৌথসম্পদ বা পুকুর থেকে চুরি হতে শুরু করে। তারই উত্তরাধিকার বাংলার এই 'পুকুর চুরি'। যেহেতু একালে যৌথসম্পদ বলতে সরকারি সম্পত্তিকে বোঝায়, সে কারণে সরকারি সম্পদ যথেচ্ছ লুঠ হলেই তাকে 'পুকুর চুরি' বলা হয়ে থাকে। ওদিকে ইংরেজি ভাষাতেও বাগধারার বিপুল সম্ভার অবহেলিত হয়ে পড়ে আছে : pound of flesh, Pandora's box, Trojan horse, apple of discord, a bull in a China shop, bolt from the blue ইত্যাদি। কিন্তু কর্পোরেট-পুঁজি শাসিত বর্তমান যুগে ইংরেজি ভাষা কাজের ভাষায় পরিণত হওয়ায় সুললিত এইসব বাগধারাগুলি কার্যত গুরুত্বহীন হয়ে পড়ছে। অবশ্য ব্যাপারটি একালের অ্যাকাডেমিক্স বা প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাচর্চার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বাংলা ভাষার ক্ষেত্রেও কমবেশি ঘটছে।
(১২) প্রবাদপ্রবচনযোগ:
প্রকরণগতভাবে বাগধারার মতোই প্রবাদ বা প্রবচনগুলি হল প্রকৃষ্টরূপে বানানো ও জনশ্রুতিতে প্রবাহিত অর্ধবাক্য বাক্যাংশ বা পূর্ণবাক্য যা বহু যুগের বহু মানুষের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানকে বাণীস্বরূপ ধারণ করে আছে। 'অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ', 'চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে', 'বুদ্ধি যার বল তার', 'অতি চালাকের গলায় দড়ি', 'অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট', 'অল্প বিদ্যা ভয়ঙ্করী' ইত্যাদি। সাধারণত অত্যন্ত উচ্চমানের অদৃশ্য সত্তা বিষয়ক ধারণাকে এই প্রবাদগুলি তার অভিধার্থ, লক্ষণার্থ ও ব্যঞ্জনার্থসহ বহন করে চলে। রবীন্দ্রনাথ গ্ৰামবাংলার চণ্ডীমণ্ডপের জ্ঞানচর্চার যে উচ্চ প্রশংসা করতেন তা এই কারণেই। এখনও গ্ৰামবাংলায় এমন বহু মানুষকে দেখতে পাওয়া যায়, যাঁরা বলতে গেলে, কথাবার্তা চালান প্রবাদপ্রবচনের মাধ্যমে। এমনকি শহুরে শিক্ষিত বাংলা ভাষীদের মধ্যেও এখনও এই প্রবাদপ্রবচনের ব্যবহার কম পরিমাণ হলেও বেঁচে আছে। সাম্প্রতিক অতীতে বৈদ্যুতিন গণমাধ্যমে বহুল প্রচারিত মন্ত্রী রেজ্জাক মোল্লা উবাচ 'হেলে ধরতে জানে না, কেউটে ধরতে গেছে' স্মরণ করা যেতে পারে। অবশ্য যাঁরা অ্যাকাডেমির ইংরেজি আর আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত ও অত্যন্ত প্রভাবিত হয়ে ভাষাকে কেজো হাতিয়ারে বদলে ফেলেছেন তেমন বাঙালিদের ক্ষেত্রে এ কথা খাটে না। তবে মনে রাখতে হবে শিল্পবিপ্লবের আগের ইংরাজী ভাষাতেও এরকম প্রবাদপ্রবচন বহুল পরিমাণে ব্যবহৃত হতো : A bird in hand is worth two in the bush; Nearest to the church, furthest from God; Every dog has its day; All roads lead to Rome; Too many cooks spoil the food ইত্যাদি; এবং সাহিত্যেও তার যথেষ্ট প্রমাণ মেলে। কিন্তু শিল্পবিপ্লবোত্তর পশ্চিমি আধুনিকতা সাধারণ মানুষের এইরূপ জ্ঞানচর্চাকারী ভাষা ব্যবহারের ঘোরতর বিরোধী হওয়ায় ইংরেজ জনসাধারণের মধ্যে প্রবাদপ্রবচনের ব্যবহার কমে গেছে।
দেখা যাচ্ছে, ভাষাপ্রকরণের ১২ রকম হাতিয়ারের মধ্যে ইংরেজি ভাষায় ৩ রকম হাতিয়ার একেবারেই নেই, ৫ রকম হাতিয়ার রয়েছে প্রায় না থাকার মতো, বাকি ৪ রকম হাতিয়ার ইংরেজি বাংলা উভয় ভাষাতে থাকলেও বাংলা ভাষায় রয়েছে পরিমাণে বেশি এবং সজীব। সুতরাং কলিম খানের মতে, 'ধারণা'ধারী চেতনার হাতিয়ার বা শব্দ তৈরির চলমান প্রকৌশল ইংরেজি ভাষার তুলনায় বাংলা ভাষায় যে অনেক বেশি তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই; এবং সেই সুবাদে বাংলা সবচেয়ে শক্তিশালী ভাষা। এতই শক্তিশালী যে ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থবিধি তার অন্তরে নিহিত (tacit) থাকতে থাকতেই তা বাংলাদেশ নামে এক রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে। অন্যদিকে কলিম খান ও রবি চক্রবর্তীর গবেষণা ঐ শব্দার্থবিধিকে ব্যক্ত (explicit) করে ফেলায় বাংলা ভাষার প্রকৃত সম্পদ সম্পর্কে বাঙালি তার আত্মবিস্মরণ থেকে আত্মগৌরবের পথে পা বাড়াতে সক্ষম হতে পেরেছে।
কলিম খান
বক্তৃতা শেষে বিমুগ্ধ ও বিমোহিত শ্রোতাদের আব্দার মেটাতে গিয়ে তাঁদের ছোঁড়া একের পর এক শব্দকে ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থবিধি অনুযায়ী ব্যাখ্যা করতে থাকেন কলিম খান। একে একে উন্মোচন করেন হি-হিম-হিমালয়, তীর্থ-সতীর্থ-কাব্যতীর্থ, ময়-ময়না-ময়দান-ময়নাতদন্ত, স্নান-স্নাতক, বাব-বাবু-বাবলা ইত্যাদি শব্দসহ বিভিন্ন স্থাননাম যেমন বরাহনগর, চট্টগ্ৰাম। সব দেখেশুনে কলিম খান ও রবি চক্রবর্তীর এই ভাষাদর্শনকে বিমল দেব বিশিষ্ট ব্রাজিলীয় শিক্ষাবিদ পাওলো ফ্রেইরীর নিপীড়িতের শিক্ষাবিজ্ঞানের প্রতিতুলনায় প্রান্তিক মানুষের ভাষাদর্শন বলে অভিহিত করেন।
ধন্যবাদ জানালেন পুলক লাহিড়ী
সব শেষে পুলক লাহিড়ী কলিম খান তথা রবি চক্রবর্তীর বয়সোচিত প্রজ্ঞাকে সম্মান জানিয়ে এবং অগ্ৰজ সুহৃদের প্রতি কলিম খানের বিনয় ও কৃতজ্ঞতাবোধকে উপযুক্ত স্বীকৃতি দিয়ে প্রশ্ন করেন বাংলা ভাষার পরিভাষাজনিত সমস্যা কীভাবে তাঁদের দেখানো পথে মেটানো সম্ভব। জবাবে কলিম খান জ্যোতিবাবুর আমলে যে পরিভাষা কমিটি গঠিত হয়েছিল তার কাজের একটি নমুনা পেশ করেন। সে সময় লরি (lorry)-র বাংলা পরিভাষা হয়েছিল 'ষড়চক্র মালবাহী শকট' ! বলা বাহুল্য, ধুরন্ধর রাজনীতিবিদ জ্যোতি বসু পত্রপাঠ সেই কাজের ফাইল অন্য ফাইলে চাপা দেন। এর বিপ্রতীপে রবি চক্রবর্তীর বাড়িতে ফাইফরমাস খাটে এমন এক সাঁওতাল যুবতীর কথা কলিম খান বলেন যিনি রবি চক্রবর্তীর খুঁজে না পাওয়া স্টেপলার (stapler)-টি এনে দেন "এই নাও তোমার গাঁথনাকল" বলে। 'গাঁথনাকল' অর্থাৎ (একাধিক পৃষ্ঠাকে) গাঁথে যে কল -- পুরোপুরি ক্রিয়াভিত্তিক শব্দপ্রকরণ।
কলিম খান ও রবি চক্রবর্তী'র গ্রন্থ সমূহ
এইভাবে পরমা ভাষার ছটায় আলোকিত হওয়া 'একক মাত্রা'র লেখক-পাঠক-সংগঠকদের এক পরম প্রাপ্তি। বেশ কিছু শহুরে শিক্ষিত পাঠকের কাছে ভাষার পরম আলো পৌঁছে দিতে ক্ষুদ্র কাঠবিড়ালীর ভূমিকা নিতে পেরে 'একক মাত্রা'র এই ব্লগও গর্বিত। সেদিন উপস্থিত শ্রোতাদের ধন্যবাদ কলিম খান ও রবি চক্রবর্তীর বঙ্গযান প্রকাশনীর বই দরাজ হস্তে কেনার জন্য। আর 'একক মাত্রা'র নতুন পুরোনো সংখ্যা আর বইপত্র যে ভালোই বিক্রি হয়েছিল সে তো বলাই বাহুল্য।