বর্ধমানে ছাত্রীছাত্র আন্দোলন চলছে...
অমিতাভ মিত্র
টানা ৪-মাস
ব্যাপী চলা যাদবপুরের ছাত্র-আন্দোলন সমাজের বড় একটা অংশে যে গভীর প্রভাব ফেলতে
পেরেছিল, তা ক্রমশ প্রকাশ্য হয়েছে যাদবপুরের সংহতিতে নানা জায়গায় সেই সময়ে চলা
কর্মসূচিগুলির মধ্যে দিয়ে। তার পরবর্তীতে এসএসসি-প্যারাটিচার-হোমিওপ্যাথি কলেজের
আন্দোলন প্রভৃতির ক্ষেত্রেও দেখা গেছে যাদবপুরের কায়দায় আন্দোলনে ঘুরে দাঁড়াতে, কোনও
ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক শক্তির সাহায্য নিরপেক্ষভাবেই। সমাজের মূলত ছাত্র-যুব অংশের
মধ্যে চলতে থাকা ধারাবাহিক এই আন্দোলনগুলিতে নবতম সংযোজন বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের
ছাত্র আন্দোলন। মিডিয়ার বুম থেকে অনেকটাই দূরে, তাই প্রাণকেন্দ্রের নাগরিক পরিসরে
এখনও সেভাবে এসে পৌঁছচ্ছে না ‘হোক প্রতিবাদ’-এর গর্জন। ২০শে সেপ্টেম্বর-এর
‘কলরবী’-মহামিছিল আগল ভেঙ্গে দিয়েছে অনেক দিনের জমে থাকা ক্ষোভগুলোর। আম
ছাত্রী-ছাত্রর স্বার্থের সাথে বিশ্বাসঘাতকতাকারী সমস্ত রাজনৈতিক শক্তিকে বর্জন করে
বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯৩টা কলেজের ছাত্রী-ছাত্ররা নিজেদের শক্তিতে সংগঠিত
হবার চেষ্টা করছেন... নিজেদের কথা বলার
চেষ্টা করছেন... শিক্ষা-ব্যবস্থা নিয়ে ছেলেখেলা করা কর্তৃপক্ষের অবসান চাইছেন গণতান্ত্রিক-শান্তিপূর্ণ
কিন্তু নাছোড় আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে।
দ্বিতীয় বর্ষের
পরীক্ষার্থীদের ফলাফল প্রকাশ হতে সময় লেগেছে ১০ মাস, তৃতীয় বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষার
মাত্র কিছুদিন আগে। রেজাল্ট ছাড়াই তাদের অন্তর্ভুক্তি ঘটেছিল তৃতীয় বর্ষের
শিক্ষাক্রমে। আর দীর্ঘ ১০ মাস পর যখন আন্দোলনের চাপে রেজাল্ট হাতে পাওয়া গেল তখন
দেখা গেল মাত্র ৫ শতাংশের মতো রেজাল্ট ‘ঠিকঠাক’ এসেছে। বাকিদের কেউ ২০০-তে পেয়েছেন
২ আর কেউ ২০০-তে ২০২! কেউ ভালো পরীক্ষা দিয়েও চূড়ান্ত হতাশাজনক ফলাফল হাতে পেয়েছেন
আর অন্য কারুর ক্ষেত্রে ঠিক উল্টো। প্রথম বর্ষের প্রাপ্ত নম্বর হুবহু কপি-পেস্ট
হয়েছে অনেক মার্কশিটেই। অসমাপ্ত রেজাল্টের ছড়াছড়ি। কেউ পেয়েছেন @, কেউ বা # ( জনৈক ছাত্রের উক্তি, ‘এরপর
নাম্বারের জায়গায় স্মাইলি দেবে’) । রাজ্যের অন্যতম প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়ের
পরীক্ষা-ব্যবস্থার চিত্রটা আর এর থেকে কত খারাপ হতে পারত। পার্শ্ববর্তী কোনও কোনও
রাজ্যের শিক্ষা-চিত্র প্রায়ই আমাদের আমোদের বিষয় হয়ে ওঠে হাসি-ঠাট্টায়-সোস্যাল
সাইটে লাইক-কমেন্টে। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের এই চিত্র তাহলে কোন সত্যের সামনে
আমাদের দাঁড় করাচ্ছে! এটা কি নেহাতই ‘বিচ্ছিন্ন’ ঘটনা নাকি এটাই বাস্তব যা এতদিন
চাপা দিয়ে রাখা ছিল সরকারি ও নানান রাজনৈতিক দাদাগিরি দিয়ে?
শিক্ষাক্ষেত্রে
একচেটিয়া রাজনৈতিক গুন্ডামি চালানোর মডেলটি বিগত-শাসকের জমানার। কারুর পিতৃপুরুষের
ক্ষমতায় কুলোতো না অনাচারগুলির বিরুদ্ধে টুঁ-শব্দটি করার। কলকাতার
প্রেসিডেন্সী-যাদবপুরের ছাত্রী-ছাত্রদের সাথে সেই জমানার শাসক দল-তার পোষ্য শিক্ষক
সংগঠন এবং পোষ্য ছাত্র সংগঠনের সংঘাতের ঘটনা বারবারই ঘটেছে। এই ক্যাম্পাসগুলির
স্বাধীন আন্দোলনের একটা দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য এবং শহরের প্রাণকেন্দ্রে থাকার
রাজনৈতিক-সামাজিক সুবিধা ক্যাম্পাসের ছাত্রী-ছাত্রদের সাহায্য করেছে সরকারি-দলীয়-কর্তৃপক্ষীয়
ছাত্রীছাত্র স্বার্থবিরোধী আন্দোলন সংগঠিত করতে। সেখানে অন্য কলেজগুলিতে দাদাগিরি
অব্যাহত ছিল। কেউ কোনওদিন সেখানকার ছাত্রীছাত্রদের কাছে জানতেও চাননি তাদের
সুবিধে-অসুবিধের কথা। এই জমানাতেও অবস্থার খুব কিছু ‘পরিবর্তন’ হয়নি।
শিক্ষাক্ষেত্রে দলীয় একচেটিয়াকরণের জন্য প্রয়োজনীয় সাংগঠনিক শক্তি, বর্তমান শাসক
দলের না থাকলেও কায়দাটি অনবদ্য আয়ত্ত করেছে বিগত শাসকের থেকে। তাই ছাত্রীছাত্ররা
অভিযোগ জানাতে গেলে শুনতে হয়— ‘তোমাদের এক বছর ক্ষতি হয়েছে তো কী হয়েছে? এক বছর বেশি
পড়ে পরীক্ষা দেবে’। লেলিয়ে দেওয়া হয়েছে
পুলিশ। তারপরেও ছাত্রীছাত্ররা জোট বেঁধে প্রতিবাদে সামিল হয়েছেন।
আন্দোলন শুরু
হয়েছিল দ্বিতীয় বর্ষের রেজাল্ট বের করবার দাবিতে। ‘হোক কলরব’ আন্দোলনে গণ-বৈঠকের
(জিবি) মধ্যে দিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার যে ধারা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল সেভাবেই এই
আন্দোলনের শুরুতেও বেশ কিছু ছাত্রীছাত্র একটি মাস-জিবির ডাক দিয়েছিলেন। সিদ্ধান্ত
অনুযায়ী একটি মিছিলও করা হয়। ফেসবুকের মধ্যে দিয়ে প্রচার চলতে থাকে। ‘হোক কলরব’
আন্দোলনের সূত্রে নানা জায়গার ছাত্রীছাত্রদের মধ্যে যে যোগাযোগের সূত্রপাত ঘটেছিল,
তার মাধ্যমেই বর্ধমানের ঘটনা ক্রমশ ভাইরাল হয়ে ওঠে। ‘#হোকপ্রতিবাদ’ নামে
ছাত্রীছাত্ররা সম্মিলিত হয় একটি মিছিলে। যোগ দেয় ‘কলরবী’
যাদবপুর-প্রেসিডেন্সী-মেডিক্যাল কলেজ-বিদ্যাসাগর-স্কটিশ সহ নানা কলেজ
বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বহিরাগতরা’। শাসক দলের দাদাগিরি-হুমকি-বাইকবাহিনীর দাপট অগ্রাহ্য
করে বর্ধমান স্টেশন থেকে কার্জন গেট অবধি মিছিল হয় প্রায় ৮০০ ছাত্রীছাত্রর। আন্দোলনের
চাপে পড়ে কর্তৃপক্ষ তড়িঘড়ি প্রকাশ করে রেজাল্ট এবং সেই রেজাল্টের নমুনা আগেই
বিস্তৃত করেছি। মানকর কলেজের এক ছাত্রী আত্মহত্যা করেন। ক্রমশ আন্দোলন বিস্তৃত হতে
শুরু করে মানকর-ধনেখালি-আরামবাগ-কামারপুকুর-ব্যান্ডেল-চুঁচুড়া-বৈদ্যবাটি-তারকেশ্বর-বোলপুর-কাটোয়ায়
ছড়িয়ে থাকা বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীছাত্রদের মধ্যে। প্রায় প্রতিদিনই শাসক
দলের পোষ্য ছাত্রবাহিনীর হুমকি অগ্রাহ্য করে চলতে থাকে মিছিল-মিটিং-গণবৈঠক-অবরোধ
ইত্যাদি। বর্ধমান মেইন লাইনে ট্রেন ক্যাম্পেনে ব্যাপক সাড়া পান আন্দোলনকারীরা।
পাশাপাশি সোস্যাল সাইটে প্রচারেও সংহতি জানাতে থাকেন নানান মানুষ-ছাত্রীছাত্র অংশ।
এলাকাভিত্তিকভাবেও ছাত্রীছাত্ররা শুরু করেছেন নানা কর্মসূচি নেওয়া। সাধারণ সভা
থেকে দাবি উঠেছে...
১) বিনা খরচে Mass-RTI করতে দিতে হবে।
২)
ছাত্রছাত্রীদের ফলাফলের ‘Spot-Review’-এর ব্যবস্থা করতে হবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে কার্যকরী
করতে হবে।
ছাত্রীছাত্রদের
এই সম্মিলিত প্রতিবাদের রূপটি কিন্তু সম্পূর্ণ দলীয় পতাকাবিহীন, এমনকি ব্যতিক্রমী
র্যাডিক্যালদের কোনও যৌথ কর্মসূচিও ‘#হোকপ্রতিবাদ’ নয়। একেবারেই আত্মশক্তিতে
বলীয়ান, স্বতঃস্ফূর্ত এবং স্বাধীন। ছাত্রীছাত্রদের স্বতঃস্ফূর্ততা দেখে বিগত শাসক
দলের ছাত্রশাখা ‘হোক আলোড়ন’ নামে একটা সমান্তরাল আন্দোলন শুরু করতে চেয়েছিল,
কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ স্বাধীন আন্দোলনের পথেই আস্থা রেখেছে।
বিবেকানন্দ কলেজের এক প্রতিবাদী ছাত্রকে তার কলেজে মারধোর করে, আই-কার্ড ছিঁড়ে
দেয় শাসক দলের ছাত্রশাখা। বাঁচাতে
গিয়ে প্রহৃত হয় ‘#হোকপ্রতিবাদ’-এ সংহতি জানাতে যাওয়া বেশ কয়েকজন ছাত্র। শাসক দলের চাপে
সংহতি জানাতে যাওয়া ঐ ছাত্রদের গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। এর প্রতিবাদে পরের
দিন আবারও মিছিল করে প্রতিবাদ জানায় বর্ধমান। আন্দোলনের চাপে
পড়ে কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়েছে পিছু হঠতে। রেজাল্ট ভুলের দায় নিয়েছে।
রিভিউ-এর ব্যবস্থা করতে বিশেষ সেল খোলার
সিদ্ধান্ত নিয়েছে। রিভিউ-এর মূল্য ৫০০ থেকে ১০০ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যদিও
বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীছাত্রদের ক্ষোভের আগুন এতে প্রশমিত হচ্ছে না।
আন্দোলন কত দূর এগোবে, তা কত দূর বদলে দিতে পারবে বিশ্ববিদ্যালয়ের জড়ভরত-উদাসীন
প্রশাসক ও শিক্ষানীতিকে তা ভবিষ্যৎ বলবে।
কলকাতার যাদবপুর
অন্তত বিগত কয়েক দশক ধরে ছাত্র আন্দোলনের একটি পীঠস্থান। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের
ভূমিকা, অন্তত ছাত্র আন্দোলনের প্রসঙ্গে সেভাবে যে খুব উজ্জ্বল তা খুব জানা নেই।
সেই বর্ধমানেই স্বাধীনভাবে এতজন ছাত্রীছাত্রের পথে নামা সত্যিই কি কিছুর
ইঙ্গিতবাহী নয়! রাজনীতির-রাজনৈতিক সংগঠনের একনায়কতন্ত্র দিয়ে এতকাল যেভাবে
ছাত্র-শিক্ষক, তাদের স্বার্থ, তাদের দাবিদাওয়াকে ছাঁচে ঢেলে কেটে ছেঁটে চালানোর
চেষ্টা চলেছে, যেভাবে শিক্ষা-বিরোধী রাষ্ট্রের নীতিগুলোর বিরুদ্ধে কথা বলতে চাওয়া
কন্ঠস্বরগুলোকে চেপে ধরা হয়েছে, যেভাবে ছাত্র-সংগঠনগুলো পার্টির বকলমে রাষ্ট্রের
কর্পোরেট-ফ্রেন্ডলি শিক্ষানীতির পক্ষে ছাত্রছাত্রীদের রাশ টেনে ধরতে চেয়েছে তার
বিরুদ্ধে ‘# হোকপ্রতিবাদ’ একটা প্রতিস্পর্ধা।
নাগরিক পরিসরের
এলিট আন্দোলন বলে যে ‘হোক কলরব’কে কটাক্ষ করেছিলেন অনেক বুদ্ধিজীবী সেই কলরবই ‘#হোকপ্রতিবাদ’
হয়ে এখন শহর পেরিয়ে ঢুকে পড়ছে গ্রাম-বাংলার অভ্যন্তরে। শাসক দলের, বিরোধী দলের,
কর্তৃপক্ষের, পুলিশের... মোদ্দায় রাষ্ট্রের আচরণ তাই দেখিয়ে দিচ্ছে ‘ওরা ভয়
পেয়েছে’।