Friday 8 May 2020

মহামারির সুলুক সন্ধান

মহামারি ও ভারতের সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্ৰামের উত্থান
অরুণাভ বিশ্বাস
প্লেগ আক্রান্ত পুনা শহরের কিছু দৃশ্য

এই লেখা যখন পড়ছেন তার আগে নিশ্চয়ই টিকিয়াপাড়ায় রাজ‍্য পুলিশের ওপর জনতার হামলার ভিডিও সোশাল মিডিয়ায় দেখে ফেলেছেন। পুলিশ‌ও বেশ কয়েকজনকে গ্ৰেফতার করেছে। ওদিকে জনরোষে পাঞ্জাব পুলিশের এক কর্মী‌র হাত কাটা পড়লেও তা সফল শল‍্যচিকিৎসায় জোড়া লেগে গিয়েছে। দুটো ঘটনা ভারতের দু’প্রান্তে হলেও দুটি ক্ষেত্রেই নাগরিকদের একাংশের মনে হয়েছে করোনা অতিমারি জনিত কারণে বলবৎ থাকা লকডাউন বিধি কার্যকরী করতে গিয়ে পুলিশ অনাবশ‍্যক বাড়াবাড়ি করেছে। তাই টিকিয়াপাড়ায় পুলিশের ওপর ইটবৃষ্টি হয়েছে, পুলিশকে জোড়াপায়ের লাথিও খেতে হয়েছে। আবার পাঞ্জাবে পুলিশ কর্মীর হাত‌ই তলোয়ারের কোপে কেটে নেওয়া হয়েছে।

দুটি ঘটনাই প্রমাণ করে মানুষ মন থেকে না মানলে কেবলমাত্র রোগের ভয় দেখিয়ে মানুষকে ঘরবন্দী থাকতে বাধ‍্য করা সম্ভবপর নয়। শুধু টিকিয়াপাড়া বা পাঞ্জাব নয়, উন্নত বিশ্বেও কোয়ারেন্টিন থেকে পালানো, লকডাউন বিধি অমান‍্য করা, সামাজিক দূরত্ব (যদিও কথাটা ‘শারীরিক দূরত্ব’ হ‌ওয়া উচিত) না মানার ঘটনা দেখা যাচ্ছে আকছার। লকডাউন বিধি অমান‍্য করতে গিয়ে পুলিশ বা সরকারি কর্মীদের ওপর পাল্টা আঘাত ভারতের ইতিহাসে নতুন কিছু নয়। বরং বলা চলে ভারতের সশস্ত্র বৈপ্লবিক সংগ্ৰাম তথা ইংরেজ শাসকের হাতে প্রথম শহীদ হ‌ওয়ার ঘটনা এই ইতিহাসের সাথেই সম্পৃক্ত। আসুন ১২৩ বছর পিছিয়ে পুনা শহরে যাওয়া যাক।

উনিশ শতকের শেষ দশকে মারাঠি ব্রাহ্মণ বাল গঙ্গাধর তিলকের উত্থান। ইংরেজি‌তে ‘মারাঠা’ এবং মারাঠিতে ‘কেশরি’ নামের দুটি পত্রিকায় নানান বিষয়ে জ্বালাময়ী লেখা লিখে খুব তাড়াতাড়ি তিলক সকলের নজরে আসেন। প্রসঙ্গত এই সময় রুখমাবাই মামলায় বিবাহিতা নারী বিচ্ছেদের অধিকার পাবে কিনা এবং বিবাহে সম্মতিদানের বয়স মেয়েদের ক্ষেত্রে কত হবে সে ব‍্যাপারে তিলক নিজের গোঁড়াপন্থী অবস্থান সুস্পষ্ট করেন। আসলে তিলক বুঝেছিলেন, বোম্বাই প্রদেশের প্রগতিশীল হিন্দুরা তখন‌ও গোখলের প্রতি ঝুঁকে থাকায় তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ভিত্তি হতে হবে হিন্দুসমাজের অনগ্ৰসর অংশ। জ্ঞানালোক বঞ্চিত এই অংশের মন পেতে তিলক‌ই প্রথম ভারতের ইতিহাসে রাজনীতি ও ধর্মকে একাসনে নিয়ে আসেন। ১৮৯৩ সালে বোম্বেতে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার বছরেই তিলক গণপতি উৎসব ও শিবাজী উৎসব শুরু করেন। রায়গড়ে শিবাজী উৎসব চলাকালীন প্রকাশ‍্য জনসভায় তিনি গীতার উল্লেখ করে বলেন শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন যদি নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন‍্য না হয় তাহলে মানুষ তার শিক্ষাগুরু বা পরিজনকেও হত‍্যা করতে পারে, তাতে দোষের কিছু নেই। বলা বাহুল‍্য, তিলকের এই ধরণের কর্মকাণ্ড মুসলিম জনগোষ্ঠী তথা ইংরেজ শাসক দুয়ের মধ‍্যেই যথেষ্ট ভীতির সঞ্চার করেছিল। এর সপক্ষে প্রমাণ রয়েছে ১৯১৮ সালের Sedition Committee'র রিপোর্টে।

এই ফাঁকে বলে রাখা ভালো, তিলকের গণপতি উৎসব ও শিবাজী উৎসবকে ঘিরে মহারাষ্ট্রের জাতীয়তাবাদ ও বৈপ্লবিক স্বাধীনতা সংগ্ৰামের প্রচেষ্টা বিস্তার লাভ করলেও শুরুটা কিন্তু করেছিলেন বাসুদেও বলবন্ত ফাড়কে। ফাড়কে সেই ১৮৭৯ সালেই কোল ভীল ধাঙড় প্রভৃতি উপজাতি এবং মুসলমান রোহিল্লা তরুণদের নিয়ে শ’ তিনেক সদস‍্যের একটি দল গড়ে প্রথমে অত‍্যাচারী সুদখোর মহাজন ও সাহুকার এবং পরে ইংরেজদের বিরুদ্ধে গেরিলা আক্রমণ চালান। ১৮৮০ সালে ফাড়কে গ্ৰেফতার হন এবং এডেন জেলে বারবার অনশন করতে থাকায় ১৮৮৩ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি মৃত‍্যুবরণ করেন। ফাড়কেকে ভারতের সশস্ত্র বিপ্লববাদের জনক বলা হয়। কিন্তু ফাড়কে আর তিলকের লক্ষ‍্য এক‌ হলেও মাধ‍্যম আলাদা ছিল। তিলকের মাধ‍্যম ছিল হিন্দু জাগরণ। আসলে পুনা ছিল মহারাষ্ট্রের মারাঠি জীবনাদর্শ ও সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র আর পুনার চিৎপাবন ব্রাহ্মণ‌রা ছিল এর ধারক ও বাহক। চিৎপাবনদের মধ‍্যে এই গ্লানি সদা বিদ‍্যমান ছিল যে তাঁদের‌ই পূর্বপুরুষ পেশোয়া বা নানা ফড়নবীশের কাছ থেকে ইংরেজরা স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছে। এই গ্লানির প্রতিক্রিয়ায় তাঁরা শিবাজীর স্মৃতি ও হিন্দু রাজ‍্য স্থাপনের আদর্শ বহন করতেন। এই ব‍্যাপারটি তিলক ভালোমতো অনুধাবন করেছিলেন। তাই খুব সহজেই তিলকের গণপতি উৎসব ও শিবাজী উৎসব জনপ্রিয়তা পায় এবং বোম্বাই পুনা ও নাসিকে ছোট ছোট সংগঠন গড়ে উঠতে থাকে। ১৮৯৫ সালে তিলকের দুই শিষ‍্য দামোদর চাপেকর ও বালকৃষ্ণ চাপেকর বহু ছোট ছোট যুব সংগঠনকে একত্র করে ‘হিন্দু ধর্মের অন্তরায় বিনাশক সংঘ’ নামে একটি সংগঠন তৈরি করেন। এটিই মহারাষ্ট্রের প্রথম সুগঠিত ও কেন্দ্রবদ্ধ সংগঠন। এই সংঘের সদস‍্যদের শারীরিক ব‍্যায়াম লাঠিখেলা ছোরাখেলা ইত‍্যাদি শিখতে হত। এছাড়াও প্রকাশ‍্যে ধর্মীয় মিছিল বার করে ব্রিটিশ বিরোধী স্লোগান দিয়ে, গান গেয়ে, আবৃত্তি করে ও পুস্তিকা বিলি করে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে হত।

গণপতি বাপ্পার পুজো থেকে শিবাজীর হিন্দুরাজ‍্য স্থাপন— হিন্দুসমাজের আবেগকে ভালোভাবেই কাজে লাগাত চাপেকরদের সংগঠন। ইংরেজদের গোমাংস ভক্ষণকেও তারা প্রচারে এনে গোমাতা ও গোবৎস রক্ষার ডাক দিত। তবে তিলকের কৃতিত্ব এটাই ছিল যে শুরুতে হিন্দু সম্প্রদায়গত আবেগকে কাজে লাগালেও অচিরেই তিলকের কর্মকাণ্ড চরমপন্থী জাতীয়তাবাদের পথ প্রশস্ত করে। তিলকের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এইভাবে মহারাষ্ট্রের রাজনৈতিক আবহ যখন ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে উঠছে তখন‌ই ১৮৯৬ নাগাদ উপকূলীয় অঞ্চলে ঘনিয়ে এল প্লেগের মহামারী। দু’ বছর পেরনোর আগেই দ্রুত ঘটে গেল ভারতের মাটিতে প্রথম রাজনৈতিক হত‍্যা এবং তার কারণে ফাঁসির ঘটনা। আর তিলক হয়ে উঠলেন নতুন নায়ক। বলতে গেলে সব‌ই ঐ প্লেগের মহামারির কারণে।

১৮৯৬ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর বোম্বে গেজেট পত্রিকায় প্রথম বোম্বাই শহরে বিউবোনিক প্লেগে আক্রান্ত হ‌ওয়ার খবর মেলে। আর এটি অন‍্যত্র ছড়িয়ে পড়ে মহামারীর আকার নেয় পরের বছর জানুয়ারিতে। পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে ৮ ফেব্রুয়ারিতে বোম্বাই প্রেসিডেন্সির গভর্নর একটি সরকারি হাসপাতাল ঘুরে দেখেন। ফেব্রুয়ারিতে মোট ৬৫৭ জনের মৃত্যু হয় যা ছিল পুনা শহরের মোট জনসংখ‍্যার ০.৬ শতাংশ, এবং শহরের প্রায় অর্ধেক লোক‌ই শহর ছেড়ে অন‍্যত্র পালাতে বাধ‍্য হয়।  পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপ হতে থাকলে ইংরেজ সরকার দ্রুত কিছু কড়া পদক্ষেপ গ্ৰহণ করে। মার্চের ৮ তারিখে এক সরকারি আদেশনামায় পুনা শহর, শহরতলি এবং পুনা ক‍্যান্টনমেন্টের জন‍্য স্পেশাল প্লেগ কমিটি (SPC) স্থাপন করা হয় যার শীর্ষে থাকেন আইসিএস অফিসার ওয়াল্টার চার্লস র‍্যান্ড।

স্পেশাল প্লেগ কমিটি স্থাপনের পাশাপাশি পুনার বাসিন্দাদের জন‍্য অবশ‍্য পালনীয় কিছু নিয়মকানুন বা বিধিনিষেধ বলবৎ হয়। এই নিয়মবিধিগুলোতে আগে একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক:

১) পুনার প্রতিটি গৃহের বাসিন্দারা প্লেগ হতে পারে এমন সদস‍্যের ব‍্যাপারে এবং বাড়িতে কার‌ওর মৃত্যু হলে কর্তৃপক্ষকে জানাতে বাধ‍্য থাকবেন।
২) বলা হয়, প্লেগ কমিটিই স্থির করবে যে প্লেগে মৃত ব‍্যক্তির দেহের সৎকার কোথায় করা হবে। অন‍্য কোন‌ও জায়গায় সৎকার নিষিদ্ধ হয়।
৩) মৃত্যু রেজিস্ট্রিকৃত না করে কোন‌ওপ্রকার পারলৌকিক ক্রিয়া নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়।
৪) কোন‌ওপ্রকার দেশিয় পদ্ধতিতে প্লেগের চিকিৎসা নিষিদ্ধ করা হয়।
৫) উপরের বিধিগুলি না মানলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ‍্য হয়।

এসবের পাশাপাশি প্লেগের প্রাদুর্ভাব দমনের জন‍্য প্লেগ কমিটির হাতে বিশেষ কিছু ক্ষমতা দেওয়া হয়। সেগুলি হল:

১) প্লেগে আক্রান্ত ব‍্যক্তির খোঁজে বাড়িতে বাড়িতে বলপূর্বক প্রবেশ করে তল্লাশি করা।
২) বাড়ির বাসিন্দাদের দেহতল্লাশি করা।
৩) আক্রান্ত সন্দেহে ব‍্যক্তিকে সরকারি হাসপাতালে নিয়ে আসা।
৪) প্রয়োজনবোধে আক্রান্ত ব‍্যক্তিকে সবার থেকে আলাদা করে সেগ্ৰিগেশন ক‍্যাম্পে রেখে দেওয়া।
৫) আক্রান্ত ব‍্যক্তির ব‍্যবহৃত জিনিসপত্র ও জামাকাপড় বাড়ি থেকে বার করে এনে নষ্ট করে ফেলা।
৬) প্লেগে আক্রান্ত কোন‌ও ব‍্যক্তিকে শহর থেকে বেরতে বা শহরে ঢুকতে না দেওয়া।

এই ধরনের আরোপিত বিধিনিষেধ বা গৃহীত ব‍্যবস্থাপনাগুলো পরপর পড়ে পাঠকের নিশ্চয়‌ই চেনা লাগছে। ১২৩ বছর পরেও কোভিড-১৯ মহামারী সামাল দিতে আমাদের দেশ তথা সারা পৃথিবীতে প্রায় এক‌ইরকম বিধিনিষেধ আরোপিত হয়েছে। অর্থাৎ, অবস্থাটা আগেও যা ছিল এখন‌ও তাই আছে। বরং সেই আমলের ব‍্যবস্থাপনা ছিল আর‌ও চরম। আজকে পুলিশকে বারবার মানবিক হতে অনুরোধ করা হচ্ছে প্রশাসন থেকে। বলা বাহুল‍্য, ঔপনিবেশিক প্রভুর সেই দায় ছিল না। তবুও অন্তত প্রশাসনের তরফ থেকে কমিটিকে মানবিক হতে অনুরোধ করা হয়। বলা হয় মুসলিম জেনানা এবং উচ্চবর্ণের হিন্দু মহিলাদের দেহতল্লাশি করা হবে না; গৃহতল্লাশির সময় মহিলাও উপস্থিত থাকবেন এবং মানুষ‌কে বোঝাতে হবে যে যা কিছু ব‍্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে তা তাদের ভালো‌র জন‍্য‌ই নেওয়া হয়েছে। সেইসাথে এটাও বলা হল যে তল্লাশির সময় বা হাসপাতালে বর্ণব‍্যবস্থা তথা ধর্মাচারকে গুরুত্ব দেওয়া হবে।

কমিটি কাজ শুরু করলে প্রথমদিকে র‍্যান্ড কিছু প্রয়োজনীয় ব‍্যবস্থা নেন। যেমন নতুন একটি হাসপাতাল স্থাপন, কোয়ারেন্টিন ক‍্যাম্প স্থাপন, রোগ ছড়িয়ে পড়েছে এমন এলাকাকে জীবাণুমুক্তকরণ ইত‍্যাদি। কিন্তু এখানেই তিনি থেমে থাকেননি। দায়িত্ব পাওয়ার পর মার্চের ১২ তারিখে ডারহ‍্যাম লাইট ইনফ‍্যান্ট্রির মেজর পেজেট'এর তত্ত্বাবধানে একটি বিশেষ দল গঠন করেন। লক্ষণীয়, ৮৯৩ জনের এই দলে কোন‌ও ডাক্তার না থাকলেও সেনাবাহিনীর ব্রিটিশ ও ভারতীয় সদস‍্যরা ছিলেন। মার্চের ১৩ তারিখ থেকে মে মাসের ১৯ তারিখ পর্যন্ত এই দল বাড়ি বাড়ি গিয়ে তল্লাশি চালায়। তল্লাশির নামে যা হয় তা এক কথায় চরম বাড়াবাড়ি। তল্লাশির সময়ে অপমানজনক কথাবার্তা বা ব‍্যঙ্গবিদ্রুপ করা, গলাধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বাইরে বার করা, নারীপুরুষ নির্বিশেষে প্রকাশ‍্যে নগ্ন করে দেহতল্লাশি করা, আক্রান্ত ব‍্যক্তির ব‍্যবহৃত জিনিসপত্র নষ্ট করতে গিয়ে ঘরের আসবাব বা সাংসারিক জিনিসপত্র তছনছ করা এবং দামী জিনিস হাতে পড়লে পকেটস্থ করা, ঠাকুরঘর বা গৃহদেবতার বিগ্ৰহের পবিত্রতা নষ্ট করা ইত‍্যাদি নানা অভিযোগ উঠতে থাকে। একদিকে পুনায় মৃত‍্যুর সংখ‍্যা ২০৯১ ছোঁয়। আর এক দিকে প্লেগ কমিটির চরম বাড়াবাড়ি‌র জন‍্য র‍্যান্ডের বিরুদ্ধে ক্ষোভ জমতে থাকে।

এ কথা অনস্বীকার্য যে বিউবোনিক প্লেগের প্রধান লক্ষণ ছিল কুঁচকি ও বগলের গ্ৰন্থি ফুলে প্রদাহ হ‌ওয়া। এখন পুনার মানুষ তাদের ভারতীয়সুলভ স্বভাবকে অতিক্রম করে নিজে থেকে এই ধরনের রোগলক্ষণ নিয়ে ইংরেজ পরিচালিত সরকারি হাসপাতালে যাবে সেটা ভাবাই বাহুল‍্য। তারাশঙ্করের 'সপ্তপদী' উপন‍্যাসের নায়ক কৃষ্ণেন্দুর অভিজ্ঞতাও প্রায় এক‌ই। তার পর্যবেক্ষণ ছিল অ্যাংলোরা যত সহজে নিজের রোগলক্ষণ নিয়ে ডাক্তারের কাছে আসে, সেভাবে কিন্তু ভারতীয় রোগীরা তার কাছে আসে না। তাই একপ্রকার বাধ‍্য হয়ে র‍্যান্ডকে এই ধরনের পদক্ষেপ নিতে হয় বলে মনে করা যেতে পারে। কিন্তু তার আগে পুনার বিশিষ্ট ব‍্যক্তিদের সাহায‍্যে সচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়োজন ছিল। সার্চ পার্টির অধিকাংশই আর্মির লোক হ‌ওয়ায় তাদের মানবিক হ‌ওয়ার‌ দায় ছিল না তা স্পষ্ট বোঝা যায়। এই দুটি র‍্যান্ডের মস্ত ভুল। আর র‍্যান্ডের দোষ ছিল নিজের সেই ভুল স্বীকার না করা। প্লেগ কমিটির প্রশাসনিক রিপোর্টে তিনি লেখেন, 'It is a matter of great satisfaction to the members of the Plague Committee that no credible complaint that the modesty of a woman had been intentionally insulted was made either to themselves or to the officers under whom the troops worked।' র‍্যান্ডের এইরূপ বক্তব‍্যের পাশাপাশি সেই সময় নিউ ইয়র্ক টাইম্‌সে প্রকাশিত রেভারেন্ড রবার্ট পি ওয়াইল্ডারের একটি লেখাকে রাখা যেতে পারে। এই লেখায় ভারতে প্লেগের প্রাদুর্ভাবের জন‍্য ভারতীয়দের খালি পায়ে হাঁটার ‌অভ‍্যাস, সরকারি সেগ্ৰিগেশন ক‍্যাম্পে যাওয়ায় অনীহা, মৃতদেহকে ঘরেই রেখে দেওয়া এবং বছরের পর বছর ধরে শস‍্যভাণ্ডারে ইঁদুরের বাড়বৃদ্ধিকে নিয়ন্ত্রণে না আনাকে দায়ী করা হয়।

তবে ভারতে প্লেগের প্রাদুর্ভাব যে কারণেই হোক সেই সময় পুনা তথা বোম্বাই প্রদেশবাসী ভারতীয়রা র‍্যান্ডের স্পেশাল প্লেগ কমিটির আচরণে যারপরনাই বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন। তার উপর যেভাবে ট্রেনের ফার্স্ট ক্লাসের যাত্রীদের বাদ দিয়ে বাকিদের স্বাস্থ‍্যপরীক্ষা হতে থাকে তাতে অনেকেই অসন্তুষ্ট হন। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব‍্যক্তিকে সেগ্ৰিগেশন ক‍্যাম্পে নিয়ে গেলে অনেক দরিদ্র পরিবার দিশাহারা হয়ে পড়ে। মিল এবং সুতোকলেও শ্রমিকের ঘাটতি হয়। শহরে যেভাবে জীবাণুনাশক ধোঁয়া ছড়ানো হতে থাকে তাতে সুতোকল এবং শস‍্যের আড়তদাররা কাপড়ের সুতো ও শস‍্যদানা নষ্ট হ‌ওয়ার ভয়ে প্রমাদ গোনেন। রটনা হয় যে সরকার প্রজাবিরোধী তাই খাবারে কুয়োর জলে ওষুধে বিষ মেশানো হচ্ছে। এক মহিলাকে জোর করে চিকিৎসা‌র জন‍্য নিয়ে যাওয়ার গুজবে ১৮৯৬ সালের ২০ অক্টোবরে প্রায় এক হাজার মিলশ্রমিক বোম্বের আর্থার রোড হাসপাতাল আক্রমণ করেন। ১৮৯৭ সালের ২ জুলাই অমৃতবাজার পত্রিকায় লেখা হয় যে সাধারণ মুসলিমরা মনে করেন, হজ-যাত্রা বন্ধ করে দেওয়ার প্রকৃত কারণ হল যাতে মুসলিমরা মক্কায় না যেতে পারে এবং সুলতানের সৈন‍্যসমেত ফিরে এসে আক্রমণ না করতে পারে। গুজরাটের খেড়া পরগণার চাকলাসি গ্ৰামে ১৮৯৭ সালে দাঙ্গা হয় এই গুজবের ভিত্তিতে যে প্লেগ সংক্রান্ত সতর্কতা ও বিচ্ছিন্নতা-নীতির আসল উদ্দেশ‍্য হল মহানদীর দক্ষিণে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পতনের খবর যাতে উত্তরে না পৌঁছায়। সারা ভারতবর্ষ জুড়ে এমনকী কলকাতাতেও এই ধরনের অজস্র গুজব রটতে থাকে। রাষ্ট্রের জুলুম এবং অধার্মিক ইংরেজের অনাচারের কথা হল গুজবগুলির মূল বিষয়। ব্রিটিশ আমলে মহামারীর ইতিহাস আমাদের মনে করায়, ‘সমাজ’এর চোখে রাষ্ট্র অনেক সময়েই একটি বহিরাগত অনুপ্রবেশকারী শক্তি। তাই জনমানসের মহামারী-চিন্তায় এমন একটি রাজনৈতিক বিষয় থাকে যার প্রকাশ অনায়াসেই রাষ্ট্র‌-বিরোধিতা হতে পারে।

খুব তাড়াতাড়ি গোখলে বা তিলকের মতো নেতারা বুঝতে পারেন, ১৮৯৭ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি পাশ হ‌ওয়া মহামারি নিয়ন্ত্রণ আইন ও প্লেগ কমিটির কার্যাবলীর বিরোধিতা‌কে ব্রিটিশ বিরোধিতায় পর্যবসিত করার সুযোগ রয়েছে। এর সাথে পুনা তথা বোম্বাই প্রদেশের চিৎপাবন ব্রাহ্মণদের স্বাজাত‍্যবোধ মিশিয়ে গণপতি উৎসব ও শিবাজী উৎসবকে সামনে রেখে গণবিক্ষোভ মাথা চাড়া দিতে থাকে। এইসব বিক্ষোভ কর্মসূচি‌তে চাপেকর ভাইদের সংগঠন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে থাকে। পিছন থেকে তাত্ত্বিক নেতার ভূমিকা নেন গোখলে, তিলক, কেলতকর প্রমুখ বিশিষ্ট‌জন। গোখলে ইংল‍্যান্ডে গিয়ে অভিযোগ করে আসেন যে মহামারী নিয়ন্ত্রণে নিয়োজিত ইংরেজ পুলিশ বাহিনী ভারতীয় ভাষা রীতিনীতি ও আবেগের তোয়াক্কা না করে শহরের যত্রতত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে। নারীর সম্ভ্রম‌ও তারা রক্ষা করছে না। মারাঠা পত্রিকায় তিলক লেখেন, 'Her Majesty the Queen, the Secretary of State and his Council, should not have issued the orders for practising tyranny upon the people of India without any special advantage to be gained....[T]he government should not have entrusted the execution of this order to a suspicious, sullen and tyrannical officer like Rand।' তিলকের মতে, প্লেগের আদি সংস্করণ হচ্ছে প্লেগ কমিটি যার তুলনায় প্লেগ ছিল অনেক বেশি ক্ষমাশীল। এই কমিটির অত‍্যাচারে সম্ভ্রান্ত মানুষের শ্বাসরোধ হয়ে আসছে। এইভাবে বিক্ষোভ চরম পর্যায়ে পৌঁছলে চাপেকর ভাইরা ঠিক করেন প্লেগ কমিটির বাড়াবাড়ির প্রতিশোধ নিতে হবে, এবং তা নিতে হবে কমিটির শীর্ষকর্তা র‍্যান্ডকে হত‍্যা করে।

১৮৯৭ সালের ২২ জুন। রাণী ভিক্টোরিয়া‌র রাজত্বের হীরক জয়ন্তী। পুনার গভর্নমেন্ট হাউসে সেই উপলক্ষে ভোজসভা সেরে নিজের ঘোড়ার গাড়িতে চেপে কোয়ার্টারে ফেরার রাস্তা ধরেছেন র‍্যান্ড। পিছন পিছন আরেকটি ঘোড়ায় টানা গাড়িতে আসছেন লেফ্‌টেন‍্যান্ট আয়ার্স্ট। ওদিকে পূর্ব-পরিকল্পনা অনুযায়ী দুই ভাই দামোদর ও বালকৃষ্ণ গণেশখিন্ড রোডের একটি সুবিধা‌জনক জায়গায় অপেক্ষমান। দুই ভাইয়ের‌ই কাছে রয়েছে তলোয়ার ও পিস্তল। বালকৃষ্ণের কাছে অতিরিক্ত একটি ভোজালি। একটু তফাতে রয়েছেন ছোটভাই বাসুদেব। র‍্যান্ডের গাড়ি দেখামাত্র দামোদর পিছু নেন এবং ১০-১৫ গজ পিছু ধাওয়া করে গভর্নমেন্ট কোয়ার্টার অবধি চলে এসে ‘গোন্ডিয়া আলা রে আলা’ (শিকার চলে এসেছে) বলে সঙ্কেত দেন। অন‍্যদিকে বালকৃষ্ণ যতক্ষণে দামোদরের সঙ্কেত শুনতে পান ততক্ষণে তিনি নিজে কিছুটা পিছিয়ে পড়েছেন, এবং আরেকটি ঘোড়ার গাড়ি‌ও চলে এসেছে। মুহূর্তে‌র সিদ্ধান্তে বালকৃষ্ণ পিছনের গাড়ির দরজা খুলে ভিতরের আরোহীকে গুলি করেন। আরোহীর তৎক্ষণাৎ মৃত‍্যু হলে বালকৃষ্ণ বুঝতে পারেন র‍্যান্ড নয়, নিহত হয়েছেন আয়ার্স্ট। ওদিকে ছোটভাই বাসুদেব ধাওয়া করেছেন র‍্যান্ডের গাড়িটিকে। দামোদর তাড়াতাড়ি ছুটে যান এবং কালবিলম্ব না করে সামনের গাড়ির দরজা খুলে ভিতরে বসা র‍্যান্ড‌কে গুলি করেন। আহত র‍্যান্ড‌কে সাসুন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে ৩ জুলাই তিনি মারা যান।
চাপেকর ভ্রাতৃত্রয়

প্রথমে চাপেকর ভাইরা পালাতে সক্ষম হলেও এই মামলার প্রধান সাক্ষী রামচন্দ্র দ্রাবিড় ও গণেশ শংকর দ্রাবিড় নামের দুই ভাইয়ের বিশ্বাসঘাতকতায় দামোদর চাপেকার গ্ৰেফতার হন। ৮ অক্টোবর দামোদরের বয়ান নথিভুক্ত করা হয় যাতে দামোদর অভিযোগ করেন যে ঘরে ঘরে তল্লাশির সময় গোরা পল্টনরা ঠাকুর ঘর বা বিগ্ৰহের পবিত্রতা নষ্ট করেছে, তাই এর প্রতিশোধ নেওয়া তাঁর কাম‍্য বলে মনে হয়েছে। এই বয়ানকে দামোদরের স্বীকারোক্তি হিসেবে ধরে নিয়ে বিচার চলে এবং পিনাল কোডের ধারা ৩০২ অনুযায়ী ১৮৯৮ সালের ১৮ এপ্রিল তাঁর মৃত‍্যুদণ্ড কার্যকরী হয়। পরের বছর জানুয়ারিতে বালকৃষ্ণ ধরা পড়েন। এদিকে ছোটভাই মহাদেব চাপেকর ও তাঁর দুই সহযোগী মহাদেও বিনায়ক রানাডে এবং খাণ্ডেরাও বিষ্ণু সাঠে বিশ্বাঘাতক দ্রাবিড় ভাইদের হত‍্যা করেন। তারপর হেড কনস্টেবল রামা পাণ্ডুকে গুলি করতে গেলে পুলিশ তাঁদের সবাইকেই গ্ৰেফতার করে এবং বিচারে ১৮৯৯ সালের মে মাসের ৮ তারিখে বাসুদেব চাপেকর, ১০ তারিখে মহাদেও বিনায়ক রানাডে ও ১২ তারিখে বালকৃষ্ণ চাপেকরের ফাঁসি হয় এবং খাণ্ডেরাও সাঠের ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়। র‍্যান্ড হত‍্যার সাথে তিলকের সরাসরি কোন‌ও যোগাযোগ আদালতে প্রমাণিত না হলেও উস্কানিমূলক বিবৃতি লেখার অভিযোগে তিলককে ১৮ মাস সশ্রম কারাদণ্ড হয়। বলা বাহুল‍্য, এতে তিলকের‌ই লাভ হয়। জননেতা হিসেবে তাঁর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়।
স্মরণে ডাকটিকিট

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্ৰামের চরমপন্থী পর্বের ইতিহাসে‌র সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা না হলেও র‍্যান্ড হত‍্যা মামলা তিনটি কারণে অমর হয়ে থাকবে। প্রথমত, এটিই প্রথম সশস্ত্র বৈপ্লবিক রাজনৈতিক হত‍্যার মামলা। দ্বিতীয়‌ত, এই মামলাতেই সর্বপ্রথম বিপ্লবীরা বিশ্বাসঘাতক রাজসাক্ষীদের হত‍্যা করে। তৃতীয়ত, নিদারুণ বিচারে এক‌ই পরিবারের তিন ভাইয়ের‌ই ফাঁসি হয়। তবে এত কিছুর পিছনে যে প্লেগের মহামারির প্রেক্ষাপটটি রয়েছে সেটা অনেকের‌ই অনেক সময় খেয়াল থাকে না। কোভিড-১৯ অতিমারির প্রেক্ষিতে তাই আরেকবার ইতিহাস ঝালিয়ে নেওয়া যেতেই পারে।

4 comments:

  1. The history of maratha worior & religious sentiments worked together to achieve success.

    ReplyDelete
  2. খুব ভাল লেখা। এই চাপেকর ভাইদের ফাঁসির পরে সিস্টার নিবেদিতা পুনায় গিয়ে তাঁদের পরিবারের সঙ্গে দেখা করেন এবং তাঁদের পারিবারিক পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেন। স্বামীজি অবশ্য এই উদ্যোগকে ভাল চোখে দেখেননি ।

    ReplyDelete
  3. রীতিমতো পড়াশুনো করা লেখা। বেশ লাগল। তোমার উপস্থাপনও বুধ্বিদীপ্ত,দারুন অরুনাভ। ক্যারি অন-----

    ReplyDelete