Sunday 30 August 2020

অতিমারির মিথ্যাচার

তবলিগি জামাত ও একটি মামলার রায়
সুমন কল্যাণ মৌলিক

করোনা অতিমারি, অপরিকল্পিত লকডাউন, দেশজোড়া শ্রমজীবী মানুষের হাহাকার, অন্যদিকে বেচারামদের গল্পকথা আর সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলির গৈরিকীকরণ– এই দমবন্ধ করা জীবনে অবশেষে কিছু তাজা হাওয়ার সন্ধান পাওয়া গেল। প্রথমটি অবশ্যই স্বনামধন্য আইনজীবী প্রশান্তভূষনের সাহসী টুইট ও মেরুদণ্ডী অবস্থান যা আমাদের প্রাণিত করছে। দ্বিতীয়টি তবলিগি জামাত মামলায় মুম্বই হাইকোর্টের ঔরঙ্গাবাদ বেঞ্চের মাননীয় বিচারপতি টি ভি নালওয়াদে ও এম জি সিউলিকরের গুরুত্বপূর্ণ রায় যা বর্তমান নিবন্ধের বিষয়বস্তু। এই মামলায় বিচারপতিদ্বয় ২৯ জন বিদেশি ও ৬ জন ভারতীয় তবলিগি জামাতের সদস্যদের বিরুদ্ধে করা এফআইআরগুলি শুধু খারিজই করেননি, একই সঙ্গে করোনা সংক্রমণের যে অভিযোগগুলি তাঁদের বিরুদ্ধে আনা হয়েছিল সে সবকে ভিত্তিহীন আখ্যা দিয়েছেন। একই সঙ্গে মিডিয়া ও সরকারের পক্ষ থেকে অভিযুক্তদের বলির পাঁঠা বানাবার নিন্দা করা হয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের বিভিন্ন ধারায়, এপিডেমিক ডিজিস অ্যাক্ট, মহারাষ্ট্র পুলিশ অ্যাক্ট, বিপর্যয় নিয়ন্ত্রণ আইন ও ফরেনার্স অ্যাক্টে অভিযোগ আনা হয়েছিল।

মূল বিষয়ে প্রবেশ করার আগে আমরা লকডাউনের প্রথম পর্বের ঘটনাগুলির দিকে চোখ ফেরাই, যখন করোনা নিয়ন্ত্রণে সরকারের পর্বতপ্রমাণ ব্যর্থতা ও অপরিকল্পিত লকডাউন সঞ্জাত জনবিক্ষোভকে সামাল দিতে কর্পোরেট মিডিয়া ও বিষাক্ত আইটি সেলের সাহায্যে তবলিগি জামাতের দিল্লি সম্মেলনকে করোনা সংক্রমণের জন্য দায়ী করার নীল নকশা তৈরি করা হয়। বিষয়টা প্রথমে তবলিগি জামাতের ঘটনা দিয়ে শুরু হলেও স্বাভাবিক ভাবেই এক-দু দিনের মধ্যে সমস্ত মুসলমান সম্প্রদায়কে 'গণশত্রু' হিসেবে দেগে দেওয়া হয়।

তবলিগি জামাতের ঘটনাটিতে উদ্যোক্তা ও দিল্লি প্রশাসনের (সমস্ত অনুমতি তারা দিয়েছিল কারণ তখন লকডাউনের কোনও গল্পই ছিল না) তরফে একটা মাত্রা পর্যন্ত দায়িত্ববোধের অভাব ছিল, এ কথা প্রমাণিত। একই সঙ্গে এটাও সত্যি যে এই ধরনের বহু ধর্মীয় জমায়েতের ঘটনা সেই সময় বিভিন্ন হিন্দু মন্দিরে ঘটেছিল। করোনা সংক্রমণের প্রথম ঘটনা (কেরলে) জানার পরেও আহমেদাবাদে ট্রাম্পের সভায়  কোনওরকম স্বাস্থ্যবিধি না মেনে হাজার হাজার মানুষ জমায়েত হয়েছিলেন, যাদের অনেকেই ছিলেন বিদেশি। কিন্তু জামাতের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের সহযোগিতায় কর্পোরেট মিডিয়া ও বিজেপির আইটি সেল এক চক্রান্তের তত্ত্ব দাঁড় করায় যার আনুষ্ঠানিক নামকরণ হয় 'করোনা জেহাদ'। এই তত্ত্বের উপজীব্য হল, ভারতে করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে দেবার জন্য একটি গোষ্ঠী নাকি সক্রিয়। এদের পেছনে আন্তর্জাতিক মদত রয়েছে। সেই চক্রান্তের অংশ হিসেবে ইসলামি ধর্মগুরুরা লকডাউনের নিয়মবিধি ভঙ্গ করার ফতোয়া দিয়েছেন। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের হকার/ বিক্রেতারা নাকি তাঁদের থুতু, প্রস্রাবের মাধ্যমে করোনা ছড়িয়ে দিচ্ছেন।

এই তত্ত্বের বাস্তবতা প্রমাণ করতে গিয়ে শুরু হয় বিষোদ্‌গার ও ফেক নিউজের  দ্বিমুখি আক্রমণ। গবেষক সৌমেন্দ্র আইয়ার (ফ্রেঞ্চ ইন্সটিটিউট অফ পন্ডিচেরি) ও শৈবাল চক্রবর্তী (ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যাট দি ইন্সটিটিউট অব সায়েন্স) মিডিয়া রিপোর্ট বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, ২০ মার্চ থেকে ২০ এপ্রিল (২০২০) এই  এক মাসে ২৭১টি মিডিয়া সোর্স থেকে তবলিগি জামাত সংক্রান্ত ১১,০৭৪টি 'খবর' প্রকাশিত হয়েছে। সেই হাজার হাজার কুৎসাবাহী প্রচারের গুটিকয়েক এখানে উপস্থিত করছি:

১) ৪ এপ্রিল জনৈক শিবাংশু শুক্লা ফেসবুকে একটি ভিডিও শেয়ার করেন যাতে 'জয় যোগীরাজ' শিরোনামে দেখা যায় উত্তরপ্রদেশ পুলিশ করোনা জেহাদিদের গুলি করছে। যেটা আসলে ছিল উত্তরপ্রদেশ পুলিশের এক পুরনো মক ড্রিলের ছবি।

২) বান্দ্রা স্টেশনে ট্রেন ছাড়বে এই খবর পেয়ে মুম্বইয়ের পরিযায়ী শ্রমিকরা ঘরে ফেরার তাগিদে জমায়েত হন। সেই জমায়েতকে ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ নির্মমভাবে লাঠি চালায়। এবিপি নিউজ খবর করে যে পার্শ্ববর্তী মসজিদ থেকে গণ্ডগোলের প্ররোচনা দেওয়া হয়। যদিও পরে খোদ এবিপি নিউজের অ্যাঙ্কর রুবিয়া লিয়াকত চ্যানেলের ফেসবুক লাইভে খবর প্রচারকদের মিথ্যাবাদী আখ্যা দেন। মুম্বই পুলিশ পরে বিবৃতি দিয়ে বান্দ্রার ঘটনায় ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব খারিজ করে।

৩) ২ এপ্রিল 'নমো অলওয়েজ' ফেসবুক পেজে একটা ভিডিও পোস্ট করা হয় যাতে দেখা যায় একজন মুসলিম ভেন্ডার খাবারে থুতু দিচ্ছেন। যা আসলে ২০১৮ সালের একটা পুরনো ভিডিওকে বিকৃত করে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ানোর জন্য তৈরি করা হয়েছে।

৪) ২৮ এপ্রিল জনৈক ঋষি রাজপুত হিন্দি চ্যানেল 'নিউজ নেশন'এর একটা খবরের শিরোনাম পোস্ট করে যাতে লেখা ছিল রাজস্থানের ঝালওয়ারে ১০০ জন নার্স পদত্যাগ করেছেন। ঋষির বক্তব্য ছিল, ঐ হাসপাতালে থাকা তবলিগি জামাতের সদস্যরা খাবারে বিরিয়ানি না পেয়ে নার্সদের গায়ে থুতু ছিটিয়ে দিয়েছে। খবরটা নিয়ে চারিদিকে হৈচৈ পড়ে যায়, পরে দেখা যায় ব‍্যাপারটা অন‍্য। নার্সরা আসলে খুব কম বেতন ও পিপিই না পাওয়ার কারণে পদত্যাগ করেছেন।

৫) এপ্রিল মাসের গোড়া থেকে  বিভিন্ন ছবি ও ক্লিপিংস সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে যার মূল বক্তব্য কোথাও মুসলমানরা লকডাউন বিধিকে অমান্য করে নামাজ পড়ছে, কোথাও তারা বাজারে জমায়েত হচ্ছে। প্রত্যেকটি ভিডিও যে পুরনো তা পরে ফাঁস হয়ে যায়।

এই বিষাক্ত প্রচারের ফল হয় মারাত্মক। প্রকাশ্যে মুসলিম হকার, ভেন্ডারদের বয়কট ও নিগ্রহ করা হতে থাকে। উত্তরপ্রদেশে বিজেপির একজন প্রতিনিধি বাজারে সবজি বিক্রেতাদের গায়ের চামড়া ছাড়িয়ে নেওয়ার হুমকি দেন। সমস্ত সাংবিধানিক রীতিনীতিকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক একটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় সম্প্রদায়কে করোনা সংক্রমণের জন্য দায়ী করে। হটস্পটগুলির নামকরণ মসজিদের নামে করা হয়। ভারতে করোনাকে সেই সময় যে ভাবে সাম্প্রদায়িক রূপ দেওয়া হয় তাতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পর্যন্ত বলতে বাধ্য হয় যে কোভিড রোগীকে ধর্ম বা জাতির ভিত্তিতে ভাগ করা অন্যায়।

এই প্রেক্ষাপটে বিচারপতিদের রায়ে উল্লেখিত কিছু গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ এখানে তুলে ধরছি:

ক) একটি রাজনৈতিক সরকার অতিমারি বা বিপর্যয়ের সময় তবলিগি জামাতের সদস্যদের বলির পাঁঠা করার চেষ্টা করেছে। এই বিদেশিদের পরিকল্পিত ভাবে লক্ষ্যবস্তু বানানো হয়েছে। সামগ্রিক পরিস্থিতি ও সংক্রমণের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান থেকে এটা পরিষ্কার যে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলি ধোপে টেঁকে না। সরকারের ভুল পদক্ষেপের ফলে যে ক্ষতি হয়েছে তার জন্য অনুতপ্ত হওয়া ও তা সংশোধন করার সময় এসেছে।

খ) দিল্লি মারকাজে যে বিদেশিরা এসেছিলেন তাঁদের বিরুদ্ধে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচার চালানো হয়েছে। একটা চেষ্টা হয়েছে এটা প্রমাণ করার যে এই বিদেশিরাই ভারতে কোভিড সংক্রমণের জন্য দায়ী।

গ)  সমস্ত সাক্ষ্য ও তথ্য থেকে এটা পরিষ্কার যে 'বিদেশি ও ভারতীয় মুসলমানরা নানান ভাবে কোভিড সংক্রমণ ছড়িয়ে দিচ্ছে' এমন অভিযোগ সর্বৈব মিথ্যা। এই ধারণাটা পরিকল্পিত ভাবে তৈরি করার চেষ্টা হয়েছিল।

ঘ) আদালতের কাছে যে সমস্ত তথ্য উপস্থিত করা হয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে সরকার শুধু বিদেশি মুসলমানদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নিয়েছে, অন্য ধর্মের বিদেশিদের বিরুদ্ধে কোন‌ও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

ঙ) মুসলমানদের বিরুদ্ধে সরকারের এই শাস্তিদানের কারণ হিসাবে মহামান্য বিচারপতিরা দেশ জোড়া এনআরসি ও সিএএ বিরোধী আন্দোলনে তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণের প্রশ্নটি তুলে এনেছেন। প্রসঙ্গত  উল্লেখযোগ্য, হাইকোর্টের এই বেঞ্চই ২০২০ সালের ফ্রেবুয়ারি মাসে অন্য একটি মামলার পর্যবেক্ষণে বলেছিল, নাগরিকত্ব আইন বিরোধী আন্দোলনকারীদের কখনই দেশদ্রোহী বলা যায় না।

এই রায়ের ফলে তবলিগি জামাতের সদস্য বিদেশি নাগরিকরা হয়তো দ্রুত বাড়ি ফিরে যাবেন। কিন্তু তাতে মূল সমস্যার কোনও সমাধান হবে না। আজ এ কথা পরিষ্কার যে করোনা অতিমারির সময় নিজেদের অপদার্থতা ঢাকতে একটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় সম্প্রদায়কে সংক্রমণের জন্য দেগে দেওয়া এক পরিকল্পিত চক্রান্তের অংশ। সেই চক্রান্তের হোতাদের শাস্তির দাবি আমরা তুলব না? প্রশ্ন করব না সরকারের বিভেদকারী নীতিকে? আমরা যদি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী হই তাহলে সাম্প্রদায়িকতার ব্যাপারীদের শাস্তির দাবি আমাদের করতেই হবে, এবং তা এখনই।
 

Friday 28 August 2020

শিক্ষার হনুকরণ?

পিছনদিকে এগিয়ে যান

ভাস্কর গুপ্ত 

 

করোনা মহামারীতে যখন সারা ভারতবর্ষ চরম উদ্বিগ্ন ও উদ্ব্যস্ত ঠিক সেই সময়ে হঠাৎ বিনা প্রস্তাবনায় ঘোষিত হল নতুন শিক্ষানীতি (New Education Policy), 2020। মাত্র 66 পৃষ্ঠার একটি নথি। কিন্তু প্রশ্নের জন্ম দিল অনেক। প্রশ্ন, সংশয়, উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ, অবিশ্বাস- এত সম্ভাবনাময় একটি রাষ্ট্রের জাতীয় শিক্ষানীতি যেগুলো থেকে শতহস্ত দূরে থাকা উচিত তারই যেন চাষ হল। কেন এমনটা হল? স্বাধীনতার পর থেকে শিক্ষা কমিশন তো অনেক হল। 1948-র রাধাকৃষ্ণন কমিশন, 1954-র মুদালিয়ার কমিশন, 1966-র কোঠারি কমিশন, 1986-র জাতীয় শিক্ষানীতি, 1992-তে আচার্য রামমূর্তির নেতৃত্বে শিক্ষা কর্মসূচি (Program of Action) তারা কি প্রত্যেকটি এমনই বিতর্কিত? তা না হলে বর্তমান শিক্ষানীতি ভিন্ন হল কিসে? 

হল তার চরিত্রে। তার মূলগত দৃষ্টিভঙ্গিতে এবং সেটা হবারই ছিল। লক্ষ করে দেখুন, এই শিক্ষা কমিশনের নেতৃত্বে ছিলেন শ্রী কস্তুরীরঙ্গন। বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক সন্দেহ নেই, কিন্তু শিক্ষাক্ষেত্রের সঙ্গে কোনওদিন কোনও সম্পর্কই তাঁর ছিল না। এর আগে প্রতিটি শিক্ষা কমিশনেরই শীর্ষে ছিলেন অভিজ্ঞ এবং সুপ্রতিষ্ঠিত শিক্ষাবিদরা। কারণ, সংস্কৃতে 'অব্যাপরেষু ব্যপারঃ' কটাক্ষপাতেরই বিষয় হয়ে থেকেছে চিরকাল। বাংলা প্রবাদটা তো আরও সোজা। 'যার কাজ তার সাজে, অন্যজনে লাঠি বাজে।' এই প্রথম এই সহজ জ্ঞানকে ইচ্ছা করে কাঁচকলা দেখানো হল। ফলে যা হবার ছিল তাই হয়েছে। এমন শিক্ষানীতি এল যার মূল কথা মিনিবাস চলার মন্ত্র- 'পিছনদিকে এগিয়ে যান'। 

অথচ প্রত্যাশা ছিল বিশাল। প্রত্যাশার কারণটা ভারতবর্ষে শিক্ষার বর্তমান চালচিত্রটা দেখলেই বোঝা যাবে। এত কমিশন, এত সুপারিশের পরেও সেটা যথেষ্ট হতাশাব্যঞ্জকই রয়ে গেছে। সাম্প্রতিক অতীতে তা আরও খারাপ হয়েছে উত্তরোত্তর। 2015-য় ভারত সরকারের বাজেটে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ ছিল 4.14%, 2019-এ তা নেমে এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র 3.60%-তে। অথচ শিক্ষায় বরাদ্দ এই মুহূর্তে কিউবায় জাতীয় মোট সম্পদ (GDP)-র 12.9% বা নরওয়েতে 8.0%। দুটি মাত্র দেশের উদাহরণ এখানে দেওয়া হল। কিন্তু তাতেই পরিষ্কার যে সার্বজনীন শিক্ষায় আমরা ঠিক কতটা পিছিয়ে আছি। স্বাধীনতাপূর্ব শিক্ষা কমিশনগুলোকে আমরা আলোচনার আওতায় আনিই নি। কিন্তু ইতিহাসের খাতা খুললে দেখতে পাব যে 1944-এ সার্জেন্ট কমিশন ভারতে 100% সাক্ষরতার জন্য লক্ষ্যবর্ষ স্থির করেছিল 1984। তারপর আরও ছত্রিশ বছর কেটে গেছে। এখনও আমাদের দেশে সাক্ষরতার হার 74.04%। মহিলাদের মধ্যে তা আরও করুণ, মাত্র 65.46%। অর্থাৎ, এক-চতুর্থাংশের উপর নাগরিক আজও নিরক্ষর। এই পরিপ্রেক্ষিতে নয়া শিক্ষানীতির কাছে চাহিদা ছিল অবশ্যই বিশাল। 

বেশ কিছু মনভোলানো চটকদারি কথাও বলেছে এই শিক্ষানীতি। যেমন প্রত্যেকটি কমিশনই যে শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্যয়বরাদ্দ বাড়িয়ে 7 থেকে 10% করার কথা বলেছে অরণ্যে রোদন করে, তা স্বীকার করে এই নীতিতেও সরকার কর্তৃক শিক্ষাব্যয়কে GDP-র 6% (তাই তো! GDP-র কিন্তু কেন্দ্রীয় বাজেটের নয় কেন?) করতে হবে বলা হয়েছে। 'লাও তো বটে, কিন্তু আনে কে?' শরৎচন্দ্রের এই প্রশ্নটাই আবার করতে ইচ্ছে করছে। কারণ, কেমন করে কোথায় কোন্ কোন্ খাতে কী পদ্ধতিতে এই বাড়তি বরাদ্দের লক্ষ্যভেদ করা যাবে তার কোনও দিশাই নেই এই গুরুগম্ভীর নথিতে। এমনি করেই পরতে পরতে অনেক আপাতমুগ্ধকর ঘোষিত উদ্দেশ্যের পিছনে এই নীতিতে লুকিয়ে আছে এক গভীর ষড়যন্ত্রের আভাস। আপাত অর্থহীন বাগাড়ম্বরের চেয়েও যা ভয়ানক। ভাবা দরকার আসলে কি এই নীতি প্রণেতাদের উদ্দেশ্য তবে সাধু ছিল? অভিজ্ঞতার অভাবে শিব গড়তে বাঁদর হয়ে গেল? আসুন না একটু তলিয়ে দেখি। দেখলে মনে হচ্ছে যে তা কিন্তু নয়। এই অসময়ে এই নীতি নিয়ে আসার পিছনে অনেক গভীর অসাধু উদ্দেশ্য রয়েছে। কথাটা কেন বলছি বুঝতে এবার একটু গভীরতর আলোচনায় যাব। প্রসঙ্গত বলে নিই, অতীত কমিশনগুলো যে সব প্রগতিশীল সুপারিশ করেছিল (যেমন কোঠারি কমিশনের আনা 'Neighbourhood School'-এর ধারণা) তাদের রূপায়ণ কেন হল না সে সম্বন্ধে কস্তুরীরঙ্গন মশাই হিরণ্ময় নীরবতার পথকেই শ্রেয় মনে করেছেন। 

প্রথমেই দেখা যাক এই নথির মূলনীতি প্রসঙ্গে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে সে দিকে। স্কুল ও কলেজ শিক্ষার পর্যায়ভাগ এতদিন ছিল 10+2+3 বছর। 10 বছরের মাধ্যমিক বিদ্যালয় শিক্ষার প্রথম 4 বছর প্রাথমিক আর 10 বছরের শেষে 2 বছরের উচ্চমাধ্যমিক (যখন ছাত্র নিজের শিক্ষার মূল ধারাকে বেছে নেয়)। নতুন প্রস্তাবে স্কুল শিক্ষা হবে প্রাক প্রাথমিক স্তর থেকে শুরু করে 5+3+3+4 বছর ধরে। একেবারে হুবহু মার্কিন মডেল Kindergarten Elementary-Middle School- High school। অতিরিক্ত দু-বছরের পরিকাঠামো তৈরির সংস্থান কোথা থেকে আসবে সে প্রশ্ন না হয় বাদই দিলাম অবান্তর বলে। মার্কিন মডেলকে এখানে নির্বিচারে গ্রহণ করা হয়েছে দাঁড়ি কমা সমেত। মুজতবা আলীর ভাষায় অনুকরণ নয় - হনুকরণ। কিন্তু পাব কী তার বিনিময়ে? 

এটা প্রায় সর্বজনবিদিত যে মার্কিন শিক্ষা ব্যবস্থার জোর বিস্তারের (breadth) উপর, গভীরতার (depth) উপর নয়। তাই মার্কিন দেশে পল্লবগ্রাহী তৈরিতেই স্কুল শিক্ষায় দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়। উচ্চশিক্ষা দেখা যায় মূলত অভিবাসী ছাত্রদের উপর নির্ভরশীল, অন্তত উচ্চশিক্ষায় উৎকর্ষ তো বটেই। এই পদ্ধতিতে কোনও বিষয়ের প্রাকপ্রস্তুতি (prerequisite) সম্পর্কে ধারণার মান্যতা নেই। মুদি দোকানে কেনাকাটার মতো যে বিষয় খুশি খামচা মেরে কিনলেই হল। এ ব্যবস্থার অবশ্যম্ভাবী পরিণতিতে আমেরিকায় functionally literate মোট পূর্ণবয়স্ক জনসংখ্যার 21%, অর্থাৎ এই বিশাল সংখ্যক মানুষ সাধারণ লেখাপড়ার কাজটুকু করতেও অসমর্থ। (সূত্র: National Centre for Educational Statistics, USA)। আমাদের দেশে এবার ধরা যাক, একটি ছেলে স্কুল পাশ করল সংস্কৃত, রসায়ন ও সঙ্গীত নিয়ে। তার জীবনে অতঃ কিম্? সে তো না ঘরকা, না ঘাটকা। শুধু তাই নয়, এই নীতির মধ্যে ধারাবাহিকতা (continuity) ধারণারও মূলে কুঠারাঘাত করা হয়েছে। স্কুলে সেমেস্টার প্রথা আনা হচ্ছে সমস্ত নমনীয়তা সমেত। ফলে কোনও ছাত্র হয়তো ছ' মাস সংস্কৃত পড়ে, পরের ছ' মাস তার বদলে শিখল ছবি আঁকা। কোনও বিষয়েরই গভীরে পৌঁছল না সে - সর্ববিষয়ে অর্ধপক্ক জ্ঞান (!) নিয়ে সে দরকচা মেরে গেল। এই প্রক্রিয়াতে এবং এতগুলো ধাপের মাধ্যমে এসে যে স্কুলছুট (dropout) কত বেড়ে যাবে তা কি কেউ বুঝতে পারছেন না? না কি বুঝতে চাইছেন না, কারণ সেটা সুনিশ্চিত করাই এই নীতির উদ্দেশ্য? অর্থাৎ শিক্ষা প্রসার নয়, শিক্ষা সংকোচন! 

আরও আছে। খুব সুন্দরভাবে বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে মূল শিক্ষাধারার অঙ্গীভূত করার কথা বলা হয়েছে এখানে। শুনতে অতি ভালো। কিন্তু যদি ভাবি যে ছুতোরের সন্তানকে ইতিহাস বা বিজ্ঞান না শিখিয়ে বলা হল যে তার বংশানুক্রমিক দক্ষতা এবারে কাগজে-কলমে স্বীকৃতি পেল তবে তাকে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত করা হল কি হল না? আসলে এই মানুষদের বেশি শিক্ষিত করার একটা ভয় আছে যে! তাই প্রচলিত বৃত্তিমূলক শিক্ষাতে গুরুত্ব না বাড়িয়ে এইসব সূক্ষ্ম খেলা! 

হনুকরণ তো শিক্ষায় তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারে এত উৎসাহ দেওয়ায়ও। যে দেশে 18.2% মানুষের কোনও স্মার্টফোন নেই, 2 কোটি 30 লক্ষ বাসস্থানে নেই এমনকি বিদ্যুৎ সংযোগ - সে দেশে শিক্ষায় প্রযুক্তির ব্যবহারের কথা বলা শুধু বদ রসিকতা নয়। এটা আসলে সুপরিকল্পিত ভাবে তৈরি Digital Divide-কে আরও চওড়া করে শ্রেণি বিভাজনকে আরও বাড়িয়ে তোলার একটা ঘৃণ্য চক্রান্ত। 

দ্বিতীয়ত, এই শিক্ষানীতি ভারতবর্ষের যুক্তরাষ্ট্রীয় চরিত্রের বিরোধী এবং তাকে সুস্পষ্টভাবে আঘাতকারী। যেভাবে একে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা মানল তাতেই তা পরিষ্কার। সংসদের কোনও কক্ষে, কোনও রাজ্যের বিধানসভায় এই শিক্ষানীতি আলোচিত হল না। কোনও রাজ্য সরকারকে করা হল না এই প্রক্রিয়ার অংশীদার, অথচ শিক্ষা না কি কেন্দ্র ও রাজ্যের যৌথ তালিকাভুক্ত বিষয়! ঘুরপথে হিন্দি সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদকে চাপিয়ে দেওয়াই তো মনে হচ্ছে এই নীতির অঘোষিত উদ্দেশ্য। স্কুলে অনুসৃত হবে যে ভাষানীতি তাতে তো আমরা এই আশ্বাসও পাচ্ছি না যে উঁচু ক্লাসে মাতৃভাষাকে এখনকার মতোই শিক্ষা বা পরীক্ষার মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করা যাবে। বিপরীতে পাচ্ছি 'light but tight' (!) কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের কথা, যার জন্য HECI, PARAKH ইত্যাদি অনেক নয়া ব্যবস্থাপনার কথা বলা হয়েছে। এদের মাধ্যমে কেন্দ্রীভূত পাঠক্রম, কেন্দ্রীভূত পরীক্ষণ ইত্যাদি আনা হচ্ছে অর্থাৎ ঝোঁক থাকছে সার্বিক কেন্দ্রীকরণের। শুধু স্কুল শিক্ষায় নয়, উচ্চশিক্ষা সম্পর্কেও এ নথির বক্তব্যে তা স্পষ্ট প্রতীয়মান। উচ্চশিক্ষা প্রসঙ্গে আরও বিস্তারিত আলোচনার ইচ্ছা রইল বারান্তরে। আপাতত এটা দেখেই যথেষ্ট হাসি পাচ্ছে যে দেশের ধ্রুপদী ভাষার তালিকায় শ্রী কস্তুরীরঙ্গন ওড়িয়াকে (যা কিনা বিতর্কসাপেক্ষে বাংলার একটি উপভাষাও হতে পারে) ঠাঁই দিয়েছেন, কিন্তু জাতীয় সঙ্গীতের ভাষা বাংলা সেখানে জায়গা পায়নি। এত বাঙালি বিদ্বেষ কেন? 

প্রসঙ্গান্তরে না গিয়ে বরং জাতীয় শিক্ষানীতি ও উচ্চশিক্ষা প্রসঙ্গে যৎকিঞ্চিৎ আলোচনা করা যাক। কলেজ পর্যায়ের সময়সীমা নিয়ে কমিশনের সুপারিশ 3 থেকে 4 বছর। যদিও পছন্দ 4 বছরই। আবার সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হনুকরণ। শিক্ষা যেখানে দারিদ্র্যমুক্তির পথ হিসাবেই পরিচিত সেই দেশে এক বছর অতিরিক্ত শিক্ষার জন্য অর্থ ব্যয়ের দায় দরিদ্র বা স্বল্পবিত্ত পরিবারে চাপালে যে তা শিক্ষা সংকোচনকেই ত্বরান্বিত করবে তা বুঝতে মস্ত মেধার দরকার হয় না। পছন্দের কথা বলে সুবিধামতো ব্যবস্থাকে কৌশলে চাপিয়ে দেবার ভড়ং এই নীতিতে আরও বহু জায়গায় আছে। আসলে এই নীতির প্রধান উদ্দেশ্যই হচ্ছে বেনামে শিক্ষার পণ্যায়ন (commercialization) এবং প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ (corporatization)। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন থেকে কলেজকে বার করার কথা বলা হয়েছে, তাই বলা হয়েছে শিক্ষায় বেসরকারি বিনিয়োগে জোর দেবার কথা। এমনকি বিদেশের বাছাই বিশ্ববিদ্যালয়দের ক্যাম্পাস খোলার এবং কোনও নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই নিজেদের শিক্ষাক্রম বেলাগাম চালানোর অনুমতিও না কি দেওয়া হবে। এটা কি সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদের নতুন চেহারা নয়? সেখানে যদি ভারত বিরোধিতার চর্চা হয় তবে ঠিক কী হবে কেউ বলতে পারেন? 

এমনভাবে যে তিন ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়ের (শিক্ষা, শিক্ষা/ গবেষণা ও গবেষণাভিত্তিক) কথা অবতারণা করা হয়েছে তাতে সন্দেহ করার সঙ্গত কারণ আছে যে গবেষণাকে ক্রমেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ থেকে মুক্তি দিয়ে নবরূপধারী উন্নত (?) মানের গবেষণাকেন্দ্রগুলোর ওপর নির্ভরশীল করে তোলা হবে। শিক্ষার সার্বিক উন্নতি বিধান ভিন্ন বিচ্ছিন্নভাবে এরকম উৎকর্ষ কেন্দ্র গড়ে তোলা যে কোনও সুষ্ঠু ফল দিতে অপারগ তা ঐতিহাসিকভাবে বহুবার প্রমাণিত হয়ে গেছে। সর্বশেষ উদাহরণ জেলাওয়ারি নবোদয় বিদ্যালয়। তবুও কেন শেষ পর্যন্ত আবার একই পথে চলা? 

আসলে যে সত্যটা আমরা এতক্ষণ বলিনি আরও পাঁচটি আঙ্গিকের মতো শিক্ষানীতিতেও তাই বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের চালিকাশক্তি। অর্থাৎ গৈরিকীকরণ। গৈরিক শিবিরের সমস্ত তাত্ত্বিক ধারণা আর তার প্রয়োগের রূপ দেবার চেষ্টা হয়েছে এই নীতিতে। তাই ভারতীয় সংস্কৃতির নামে হিন্দু সংস্কৃতিকে সর্বত্র সর্বস্তরে চাপিয়ে দেবার আকাঙ্ক্ষা এর ছত্রে ছত্রে অথচ পরিবেশ শিক্ষা নিয়ে, মানবাধিকার নিয়ে, দারিদ্র্যের সঙ্গে শিক্ষার আন্তঃসম্পর্ক নিয়ে বা এমনই আরও অনেক অপরিহার্য বিষয় নিয়ে এই নথিতে একটি শব্দও ব্যয়িত হয়নি। অলমিতি বিস্তরেণ। 

 

Thursday 27 August 2020

মগজে দিন শান...

আন্তর্জালে 'একক মাত্রা'

সঞ্জয় মজুমদার 

 

https://www.ekakmatra.org/p/about-us.html
 

২৫ মার্চ ২০২০। ভারতে লকডাউন প্রক্রিয়া চালুর পর থেকে 'একক মাত্রা'র বর্তমান ভূত ভবিষ্যত নিয়ে পত্রিকা কর্মীরা গভীর উদ্বেগের মধ্যে কাটিয়েছি। একটাই প্রশ্ন আমাদের মনের কোণাখামচিতে ঘুরঘুর করছিল: আবার মাথা তুলে দাঁড়াতে পারব তো? 


প্রশ্ন নিয়ে চুপচাপ বসে থাকেনি 'একক মাত্রা'। করোনা, লকডাউন, সামাজিক দূরত্বের ঘোর কাটতে মাস তিনেক লেগে গেলেও চোয়াল শক্ত হচ্ছিল আস্তে আস্তে। মেরুদণ্ড সোজা রেখে মগজে শান দেওয়ার অঙ্গীকার করা আছে যে। অতএব, মিলিয়ে যাওয়ার প্রশ্নই নেই। 


প্রথম ধাপেই 'একক মাত্রা'র মুদ্রণ সংক্রান্ত কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত কর্মীদের, যারা তালাবন্ধের অনিবার্য উদ্বেগে দিন কাটাচ্ছিলেন, তাঁদের পাশে সাধ্যমতো আর্থিক সাহায্যে নিয়ে দাঁড়ানো হয়। হয়তো প্রয়োজনের তুলনায় তা অকিঞ্চিৎকর, তবু বিপদে 'পাশে আছি'র উষ্ণ বার্তাটুকু পৌঁছে দেওয়ার আন্তরিক চেষ্টা। এর মধ্যেই আমফানের বিষাক্ত ছোবল খেয়েছি সবাই, যা সামলাতে আবার মাসখানেকের নীরবতা। উদ্বেগ তখন মিলিয়ে যাওয়ার ভয়াবহ আশঙ্কার চেহারা নিয়েছে। 


'একক মাত্রা' এরপরেও হার মানেনি। পরিবার পরিজন প্রতিবেশী কর্মস্থল এইসব নানান স্বাভাবিক অস্বাভাবিক ম্যাও সামলানোর পাশাপাশি পত্রিকার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সমান্তরালে চালিয়ে গিয়েছি আমরা। এত কিছুর অবতারণা শুধুমাত্র 'একক মাত্রা'র লড়াইকে প্রচারের আলোয় আনার উদ্দেশ্যে নয়, লিটল ম্যাগাজিনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত সকল উদ্যোক্তা ও কর্মীদের জন্যই বলা- একটু সাহস করে এগিয়ে আসুন, লিটল ম্যাগাজিনের ভবিষ্যৎ শেষ হয়ে যায়নি, যাবেও না। করোনা, অনলাইন-ডিজিটাল মাধ্যম, মুদ্রণ মাধ্যম, সোশ্যাল মিডিয়া ইত্যাদি মিলিয়ে আমরা সকলেই ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করি। স্পিড ব্রেকার এসে গেলে বা গাড্ডায় পড়লে গাড়ি ফার্স্ট গিয়ারে নামিয়ে আনতে হয়, এ তো জানাই আছে, পরিস্থিতির বিচারে কিছুটা পথ স্টার্ট বন্ধ করেই গড়াতে হয়। ভয় পেলে চলবে না, ইচ্ছাশক্তির ইগনিশন চাবি তো হাতেই আছে, শুধু মনটা দরকার।


প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পরিকল্পনার আঁচ দ্বিতীয় ধাপে এসে বাস্তবায়নের পথে এগোল। আমাদের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক অনিন্দ্য ভট্টাচার্যের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় 'একক মাত্রা' ব্লগপোস্টে নিয়মিত লেখা শুরু হল। পাঠকেরা তাঁদের লেখা উৎসাহের সাথে পাঠাতে শুরু করলেন। ইতিউতি আগেও হচ্ছিল এসব। তবে কঠোর লকডাউনের সময়ে, খড়কুটোর মতো ব্লগপোস্টকেই 'একক মাত্রা' আঁকড়ে ধরল। অর্থাৎ, গাড়ি অন্তত গড়াতে থাকল। অনিন্দ্যদার উদ্যোগে 'একক মাত্রা'র গ্রাহকেরা এবং আপাত অপরিচিতরাও দ্বিগুন উৎসাহে বহমান সময়ের সাথে ঘটতে থাকা বিভিন্ন বিষয় ভিত্তিক লেখা পাঠালেন। 'একক মাত্রা'র ব্লগপোস্ট আরও জনপ্রিয় হল এবং তার ঢেউ আমাদের, মানে পত্রিকা কর্মীদের মনে বেশ আশা-ভরসা জোগাল। আক্ষরিক অর্থেই প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদকের গুরুদায়িত্ব পালন করলেন অনিন্দ্যদা।


সম্পাদকমণ্ডলী ও পত্রিকার কাজের সঙ্গে যুক্ত কর্মীদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে নিয়মিত পরবর্তী পর্যায়ের পরিকল্পনা ও চিন্তাভাবনার আদান-প্রদান জারি রইল। অমিত চৌধুরী, তুষার চক্রবর্তী, সুমিত ঘোষ, অরূপ ভট্টাচার্য, সোমনাথ গুহ, ভাস্কর গুপ্ত, সোমা বিশ্বাস, মনসিজ দত্ত ও আরও সকলে এবং সুদীর্ঘ বছর ধরে 'একক মাত্রা'র সময়ে দুঃসময়ে যারা চিন্তাভাবনা সহ বিভিন্ন সক্রিয় সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন, প্রত্যেকের সুপরামর্শ এই সময়ে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এরই ফলশ্রুতি, পরীক্ষামূলকভাবে সম্পূর্ণ নিজেদের উদ্যোগে গুগল প্লাটফর্মে নিখরচায় 'একক মাত্রা' ওয়েবসাইট তৈরির প্রচেষ্টা। উদ্দেশ্য একটাই, 'একক মাত্রা'র যাবতীয় কর্মকাণ্ডকে পরিপূর্ণভাবে আন্তর্জাল মাধ্যমে কেন্দ্রীভূত করে ফেলা। 


তৃতীয় এবং 'এই-শেষ-নয়' পর্যায়ে 'একক মাত্রা' ২৬ আগস্ট ২০২০ বুধবার রাত্রি ৮টায়  'করোনা: ভয়-ভীতি ও আশ্বাস' শিরোনামে ভার্চুয়াল আড্ডায় 'একক মাত্রা'র ওয়েবসাইট www.ekakmatra.org-এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হল। সম্পূর্ণ সামাজিক দূরত্ববিধি মেনেই 'একক মাত্রা' আঞ্চলিকতার গণ্ডি ছাড়িয়ে গ্লোবাল অস্তিত্বে রূপান্তর পেল। শুরুতে কী কী রইল এই ওয়েবসাইটে?


১) ২০১৯-এ বিশ বছর অতিক্রান্ত  'একক মাত্রা'র সাম্প্রতিক এবং পুরনো সংখ্যার মুদ্রিত কপির কেনাবেচার অনলাইন ব্যবস্থা।


২) এ যাবৎ 'একক মাত্রা'র ঘরোয়া আড্ডায় যা কিছু ভিডিও করা সম্ভব হয়েছিল এবং হতে থাকবে, সেইসব অমূল্য রত্নে সাজানো ভিডিও গ্যালারীর লিঙ্ক। 


৩) বিগত বছগুলি এবং ভবিষ্যতের 'একক মাত্রা'র বহুধা-বিস্তৃত কর্মকাণ্ডের স্থিরচিত্রের প্রদর্শনীর ভাণ্ডার। আসলে, 'একক মাত্রা'র শিকড় সময়ের সাথে কতটা গভীরে পৌঁছেছে তারই প্রমাণস্বরূপ এই স্থির ও চলমান চিত্র গ্যালারী বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য তোলা থাকবে। একটি পত্রিকার প্রবহমান সংস্কৃতিকে বুঝতে তা পাঠক ও উৎসাহীদের অবশ্যই সাহায্য করবে। স্থিরচিত্র গ্যালারীতে রাখা ছবিগুলোর একটা অন্যতম বৈশিষ্ট্য উল্লেখ না করে পারছি না‌। আমাদের আরেক কার্যনির্বাহী সম্পাদক তরুণ তুর্কি অরুনাভ বিশ্বাসের পাহাড় থেকে সমুদ্র, লিটল ম্যাগাজিন মেলায় 'একক মাত্রা'র উজ্জ্বল উপস্থিতি কেন্দ্রীক অদম্য উৎসাহের কোলাজ এই গ্যালারিতে ধরা আছে। অরুণাভই এইসব ছুটোছুটির প্রধান কাণ্ডারী। লকডাউনে আপাতত সে সব বন্ধ আছে। তবে লিটল ম্যাগাজিন মেলা পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে আবার হতে শুরু করবে এবং যথারীতি অরুণাভর নেতৃত্বে আমরা আবার এইসব ছোটাছুটি সোৎসাহে শুরু করে দেব।


৪) 'একক মাত্রা' ব্লগপোস্টে পাঠানো সমস্ত লেখা বা বলা ভালো পোস্ট-এর উজ্জ্বল সংগ্রহ।


৫) 'একক মাত্রা' ফেসবুক রিডার্স গ্রুপের লিঙ্ক। অর্থাৎ, ব্লগ এবং ফেসবুক মিলিয়ে 'একক মাত্রা'র সোশ্যাল মিডিয়ায় পদচিহ্ন। শারীরিকভাবে দূরে থেকেও 'একক মাত্রা' পরিবারে অঙ্গীভূত হওয়ার অনস্বীকার্য অনুভূতি।


৬) ইউটিউবের সৌজন্যে 'একক মাত্রা'র নিজস্ব ভিডিও চ্যানেল, যার মাধ্যমে ভার্চুয়াল আড্ডার বাস্তবায়ন ঘটছে এবং নিয়মিত ব্যবধানে ঘটবে।


এ যেন 'একক মাত্রা'র নিজস্ব মাল্টিপ্লেক্স। আধুনিক গদ্য ও প্রবন্ধের উন্মুক্ত ক্যানভাস। মগজের শান দেওয়ার উজ্জ্বল মাধ্যম। অনলাইন আর অফলাইন অস্তিত্বের একটাই ছাতা।


৭) ই-সংস্করণ (পিডিএফ নয়) এখনও কিছুটা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার গর্ভে, যদিও এর উত্তর 'একক মাত্রা'  পেয়ে গেছে। খুব শীঘ্রই আমরা উৎসাহী পাঠকদের 'একক মাত্রা'র ই-সংস্করণ পড়ানোর পরিকাঠামো ও পরিষেবা প্রদান করতে পারব।


সবশেষে বলার, চুঁচুড়া লিটল ম্যাগাজিন মেলায় জনৈক বিশিষ্ট ব্যক্তি উল্লেখ করেছিলেন, লিটল ম্যাগাজিন চালানোয় স্পর্ধা থাকা চাই। একদম সঠিক বলেছিলেন। কারণ, ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর স্পর্ধা থাকতেই হবে। ভদ্রলোকের চেহারা আবছা মনে আছে, নামটা মনে করতে পারছি না। তবে, সাক্ষাৎ হলে নিশ্চয়ই বলতে পারব 'একক মাত্রা' স্পর্ধা দেখাতে পেরেছে। 


ভাল থাকুন, সুস্থ থাকুন। লকডাউনের শারীরিক বিধি-নিষেধ মেনে যতটা সম্ভব সামাজিক হোন। 'একক মাত্রা' পড়ুন ও পড়ান। ধন্যবাদ।

 

Tuesday 25 August 2020

একটি চলচ্চিত্র ও ভবিষ্যৎ

এলিজিয়মের চুনসুরকি ও কিছু সাদৃশ্যের মঞ্চনিনাদ

অর্ধেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়

 

 “নাকি এ শরীরে পাপের বীজাণুতে

কোন প্রাণ নেই ভবিষ্যতের

আমারই বর্বর জয়ের উল্লাসে

মৃত্যুকে ডেকে আনি নিজের ঘরে।”

 

২০১৩ সাল। একটি মার্কিন কল্পবিজ্ঞানভিত্তিক চলচ্চিত্র প্রেক্ষাগৃহে উন্মোচিত হয়েছিল। নাম ‘এলিজিয়ম’। বাস্তবতার সঙ্গে সমান্তরাল ভবিষ্যতের যাপনচিত্র ও বিপ্লবীয়ানার ভাষ্যে উদ্ভাসিত এক ক্যানভাস- কখনও যেন মিশে যায় পরাবাস্তবতায়, কখনও আবার হারিয়ে যায় চেতনার অতলস্পর্শী বিষন্নতায়। আজ কোভিড-১৯ অতিমারী যখন একদিকে মানবজীবনে থাবা বসিয়েছে, অন্যদিকে রাষ্ট্রনেতাদের ভিন্নতর মনোভাব নানাপ্রকারের শাসনযন্ত্রগত প্রকরণের মধ্যে দিয়ে রোজ নিজের দানবীয় চেহারা প্রকাশ করছে, তখন কোথাও না কোথাও অকিঞ্চিৎকর সঙ্গোপনে ‘এলিজিয়ম’ ছবিটির কথা বারেবারে স্মৃতিকে নাড়া দিচ্ছে। ছবিটিতে ২১৫৪ সালের কল্পনা করা হয়েছে। দেখানো হয়েছে এক অন্য পৃথিবীর গল্প। এই পৃথিবী ডিস্টোপিয়ান। চারিদিকে অভিবাসনজনিত মারদাঙ্গা, অতিরিক্ত জনসংখ্যার দুর্বৃত্তপ্রবণ নোংরা জীবন, ট্রান্সহিউম্যানিজমের প্রতিস্পর্ধা, পঙ্গু স্বাস্থ্য-পরিষেবা, শ্রমিক শোষণ ও অত্যাচার, লাচার বিচার ব্যবস্থা এবং মুখেচোখে যন্ত্রণার অভিব্যক্তি নিয়ে ইতস্তত ভ্রাম্যমান মানুষের মুখগুলি। দেখলেই মন বলবে, এর চেয়ে মৃত্যু ঢের ভাল।

 

কিন্তু, এটা সার্বিক অবস্থা নয়। এমন নরকের পাশেই আছে স্বর্গের অবস্থান। পৃথিবীর কক্ষপথে অবস্থিত মানুষের তৈরি কৃত্রিম দুনিয়া– স্বপ্নের দুনিয়া– এলিজিয়ম। এখানে চারিদিক সবুজ গাছে ঘেরা, পরিষ্কার নীল জল, সুগন্ধময় পরিবেশ, নির্ঝঞ্ঝাট প্রাতিজনিক জীবন, বঞ্চনা-অভাব-অভিযোগহীন বিনোদনময়তা এবং সর্বোপরি ‘মেড-বেইজ’ নামক একটি অত্যাধুনিক প্রযুক্তি যা মানুষের যাবতীয় রোগ-যন্ত্রণা নিমেষে নির্মূল করে, বয়স কমিয়ে দেয় ও কোষের পুনর্নিমাণ করে মৃতদেহেও প্রাণের সঞ্চার করে। অর্থাৎ, একেবারে ইউটোপিয়ান। জন কার্লাইল নামের একজন মানুষের মস্তিষ্কপ্রসূত এই নতুন পৃথিবী। এই পৃথিবী সৃষ্টিতে অর্থব্যয় করেছেন একচেটিয়া বড়োলোকরা। ফলে এখানে কেবল তাদেরই অধিকার– প্রবেশের ও বসবাসের। এ যেন একইসঙ্গে একদিকে ডিস্টোপিয়া, অন্যদিকে ইউটোপিয়া

 

চলচ্চিত্রে এই দুয়ের মধ্যে অভিঘাতের মূল বীক্ষা হল অর্থবান বনাম দরিদ্রের সামাজিক অবস্থানঅন্য কথায়, পুঁজিবাদ বনাম সাধারণ্যের কিংবা শাসক বনাম শোষিতের। পৃথিবীর মানুষকে জীবনযাপনের নিমিত্ত কিছু অর্থপ্রদান করে এরা, বদলে রোজনামচার অধিকারগুলিকে সম্পূর্ণ দমন করে রাখে এলিজিয়ম। এই কাজে সহায়তা করেছে আর্মাডাইনের অস্ত্র কারখানা। এখানে অত্যাধুনিক রোবট প্রস্তুত করা হয় যা পৃথিবীর মানুষের ওপরে নজরদারি চালায়, একটুও টুঁ-শব্দ বা বেচাল দেখলেই: গুলি। চলচ্চিত্রের প্রটাগনিস্ট চরিত্র ম্যাক্স ডি কোস্টা একসময় আর্মাডাইনে কাজ করত। কিন্তু একদিন তেজস্ক্রিয় বিকিরণের একটা দুর্ঘটনার ফলে যখন ম্যাক্সের জীবন বিপন্ন, মাত্র কয়েক দিন আর আয়ু, তখন কারখানার মালিক জন কার্লাইল ম্যাক্সকে ‘মেড-বেইজ’-এ পাঠিয়ে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করতে অস্বীকার করে। এতদিন ম্যাক্সের মধ্যে দুই-পৃথিবীর বৈরিতা নিয়ে কোনও প্রতিক্রিয়া ছিল না। এবার সে বেসামাল হয়ে পড়ে। স্পাইডার নামের একটি চরিত্র যে নানা রকমের কায়দায় এলিজিয়মে বেআইনিভাবে লোকজন পাঠানোর কৌশল আবিষ্কার করে থাকে। এলিজিয়ম এই কাজকে হিউম্যান স্মাগলিং বলে অপরাধী ঘোষণা করেছেকিন্তু, এটাই স্পাইডারের পেশা কিংবা অন্য চোখে গেরিলাযুদ্ধ। অনন্যোপায় ম্যাক্স স্পাইডারের শরণাপন্ন হলে স্পাইডার না করে দেয়। কেননা কদিন আগেই সে তিনটি জাহাজ উড়িয়েছিল এলিজিয়মের উদ্দেশ্যে, লক্ষ্য ছিল রোগাক্রান্ত মানুষগুলোর চিকিৎসা করানো। কিন্তু এলিজিয়মের নিরাপত্তা বিষয়ক কর্তৃপক্ষ গুলি-বোমা মেরে সেগুলিকে মহাকাশেই ধ্বংস করে ফেলেফলে, স্পাইডার এখন ঝুঁকি নিতে নারাজ। পক্ষান্তরে এলিজিয়মের মধ্যে ক্ষমতা দখলের একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতা চালু হয়েছে, এ খবর স্পাইডার জানতসেখানেও যে কোনওদিন যা খুশি তাই হয়ে যেতে পারে। এদিকে ম্যাক্স নাছোড়বান্দা। স্পাইডার ভেবেচিন্তে একটা উপায় বের করে। উপায়টা কী, না, কার্লাইলের মস্তিষ্কে যান্ত্রিকভাবে এলিজিয়মের প্রোগামের একটা কার্বন কপি স্টোর করে রাখা আছে, যদি কোনওভাবে সেটাকে হাতানো যায়- যদিও সেটা নিতে গেলে কার্লাইলের মৃত্যু ঘটবে- তবেই কেল্লাফতে। সেই কোডিং পালটে দিয়ে, পৃথিবীর সব নাগরিককে এলিজিয়মের মেম্বার করে দিতে পারলেই এই পৃথিবীতেও ‘মেড-বেইজ’ চলে আসবে, পৃথিবীর মানুষ পুনর্জন্ম লাভ করবে, ক্ষমতার সমস্ত আঙ্গিক বদলে যাবে এক লহমায়– যেন এক নিভৃত বিপ্লব রচিত হবে। এরপরে ঘটনার টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে চলচ্চিত্রের শেষে বিপ্লব সফল হবার আশাপ্রদ অঙ্গীকার দেখানো হয়েছে। পৃথিবী আবার নতুন রূপে নিজের মহিমা ফিরে পাবে, এমনই প্রত্যাশায় অবগাহন করেছেন পরিচালক নীল ব্লমক্যাম্প  

 

২০২০ সালের পৃথিবীতেও নেমে আসছে ডিস্টোপিয়ার কালো ছায়া। অতিমারী, দুর্যোগ, জলবায়ু পরিবর্তন-বিশ্বউষ্ণায়ন, দুর্ভিক্ষ ও সামাজিক বৈষম্যের সঙ্গে গণতন্ত্রের প্রত্যেকটি স্তম্ভ আজ বিপন্ন। সাধারণ মানুষের সাংবিধানিক অধিকারগুলি রোজ ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে শুধু তাই-ই নয়, সাবলীল বেঁচে থাকার নিত্যপ্রয়োজনীয় উপাদানগুলিও ক্রমাগত বেহাত হয়ে পড়ছে। ধনী-দরিদ্রের মধ্যেকার রেখাগুলি স্থূল থেকে স্থূলতর হচ্ছে। মানুষ রোজ একটু একটু করে নরক যন্ত্রণার অভিঘাতে দীর্ণ হচ্ছে। অনুসন্ধিৎসু বক্ষালয় শান্তি চাইছে দু' দণ্ড। খুঁজছে, এলিজিয়ম। ‘এলিজিয়ম’ কথাটা আজকের নয়। মহাকবি হোমার, তাঁর ‘ওডিসি’-তে লিখেছেন,But for thyself, Menelaus, fostered of Zeus, it is not ordained that thou shouldst die and meet thy fate in horse-pasturing Argos, but to the Elysian plain and the bounds of the earth will the immortals convey thee, where dwells fair-haired Rhadamanthus, and where life is easiest for men. No snow is there, nor heavy storm, nor ever rain, but ever does Ocean send up blasts of the shrill-blowing West Wind that they may give cooling to men; for thou hast Helen to wife, and art in their eyes the husband of the daughter of Zeus” অক্সফোর্ড ডিকশনারির মতে, ‘এলিজিয়ান’ কথাটির অর্থ হল, A place or state of perfect happiness অর্থাৎ, পরমতম সুখযাপনের আবাসভূমি। সেখান থেকেই এসেছে ‘Elysium’ কথাটা। পরবর্তীকালে ভার্জিল লিখেছিলেন, “Night speeds by, And we, Aeneas, lose it in lamenting. Here comes the place where cleaves our way in twain. Thy road, the right, toward Pluto's dwelling goes, and leads us to Elysium. But the left Speeds sinful souls to doom, and is their path To Tartarus th' accurstআর দান্তে বিখ্যাত ‘দ্য ডিভাইন কমেডি’-তে লিখেছিলেন, “With such affection did Anchises' shade reach out, if our greatest muse is owed belief, when in Elysium he knew his sonকিন্তু বর্তমানের অভিধা বদলে যাচ্ছে, কিংবা গেছে অর্থনীতির বৈভবের একচোখা বন্টনে।  

 

বিজ্ঞানের ও প্রযুক্তির অকল্পনীয় ঔদার্যে, ন্যানোটেকনোলজি, মলিকুলার এসেম্বলস, রোবটিক্স ও আর্টিফিসিয়াল ইনটেলিজেন্সের অভাবনীয় উন্নতিতে দ্রুত বদলে যাচ্ছে চারপাশ। মোটা দাগে এখনও তা ধরা পড়ছে না ঠিকই কিন্তু যারা দেখার ঠিক দেখতে পাচ্ছেন। এ বছরে মঙ্গল গ্রহে তিনটি যাত্রার কথা বলা হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চিন ও ইউএই– এই লড়াইয়ে এগিয়ে। প্রাণের সন্ধানের সঙ্গে সঙ্গে অন্য গবেষণাও চলছে লাগাতার। ভারতও এ ব্যাপারে পিছিয়ে নেই। বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স এবং ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশনের বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন যে, চাঁদের মাটিতে ইট তৈরি করার পদ্ধতি তাঁরা আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছেন। চাঁদের মাটির সঙ্গে ইউরিয়া মিশিয়ে তৈরি হবে এই ইট জাতীয় উপাদান আর সিমেন্টের বদলে ‘গুয়ার গাম’ নামক বিশেষ আঠা ব্যবহৃত হবে এই প্রযুক্তিতে। প্রকৃতপ্রস্তাবে, চাঁদের জমিতে বসবাসোপযোগি ঘরবাড়ির স্বপ্ন আর অধরা থাকবে না কিছুদিন পরে
 

 

অন্যদিকে, আর্কটিক অঞ্চলে দ্য সভালবার্ড গ্লোবাল সীড ভল্ট-এ রাখা হয়েছে দুনিয়ার অত্যাবশ্যকীয় শস্যের বীজগুলিকে। দ্য গিটহাব আর্কাইভ প্রোগ্রাম ২১ টিবির ফিল্মে সঞ্চিত করেছে সারা দুনিয়ার যাবতীয় বুদ্ধিমত্তার ডিজিটাল ভার্সন। আর্কটিক অঞ্চলে গভীর মাটির তলায় এগুলো জমানো শুরু হয়েছে। পরমাণু বোমা ফেটে গেলেও এগুলি সংরক্ষিত হবে আগামি ১০০০ বছরের জন্য। কিন্তু প্রশ্ন হল, একদিকে মঙ্গল-চাঁদ, অন্যদিকে আর্কটিক অঞ্চলের অতন্দ্র প্রহরিত সংগ্রহশালা– অদ্ভুতদর্শন এইসব হুড়োহুড়িতে ‘এলিজিয়ম’-এর সন্দেহজনক গন্ধ কোথাও নেই তো? কেননা বাড়ি বানানোর উপকরণ জোগাড় হলেও, কারা কিনবে বা বানাবে সেই বাড়ি? খাদ্য-সংস্থানের উৎস থেকে উন্নত প্রযুক্তিগুলিকে আবার নতুন করে রূপায়িত করার চাইতে, উপলব্ধ সম্ভারকে বহন করার অধিকার কাদের? আজকের পৃথিবীতে কী পরিচয় তাদের, পদবিগুলি কি আমাদের খুবই পরিচিত, নাকি অন্য কিছু? অনুমানের ভিত্তিতেই ঝাঁপাতে হয় পরীক্ষার অন্দরমহলে। আজ যদি এই অনুমানগুলি নিয়েই বাস্তবতায় শতরঞ্চি পাতি, তবে কি আমরা অপেক্ষা করব কোনও ম্যাক্স ডি কোস্টার নাকি প্রশান্ত ভূষণের কথাগুলিকে ভেবে দেখব, সাহায্যপ্রার্থী হব স্পাইডারের নাকি নিজেদের মধ্যে থেকেই থুনবার্গের সমর্থনে ঐক্যবোধ জাগ্রত করার কাজে নিয়োজিত করব বিবেকবোধকে– এসব নানা প্রশ্ন আকাশে বাতাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অনন্ত অভিসন্ধির নির্নিমেষ পরাকাষ্ঠায় উন্মীলিত নয়নে খুঁজে নিতে হবে উত্তর, নিজেকেই– নইলে থালা-বাটির বাদ্যি আর মোমবাতির চিতায় ধীরে ধীরে ব্যর্থ প্রার্থনা মিহি হয়ে যাবে, ফিসফিসানিগুলো এসে বলবে, 

“এই তো জানু পেতে বসেছি, পশ্চিম

আজ বসন্তের শূন্য হাত

ধ্বংস করে দাও আমাকে যদি চাও

আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক।”

 

তথ্যসূত্র:

1.    https://www.ndtv.com/science/indian-scientists-make-space-bricks-with-urea-for-buildings-on-moon-2279695

2.    https://www.ndtv.com/bengali/indian-scientists-make-space-bricks-with-urea-for-buildings-on-moon-news-bengali-2279813