Tuesday 11 February 2020

অভূতপূর্ব জয়!

দিল্লিবাসীকে অন্তরের অভিনন্দন
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য
ওদের শেষ অস্ত্র ছিল দাঙ্গা। সে কথা দু’ একটা সোশ্যাল মিডিয়া গ্রুপে জানিয়েওছিলাম। শাহিনবাগে দুর্বৃত্ত পাঠিয়ে বারবার গুলি চালিয়ে যদি ‘দুর্ঘটনাবশত’ দু-একজনকে মেরে দেওয়া যায় আর সে ঘটনার যদি পালটা হিংসা-প্রতিক্রিয়া হয় তাহলে দাঙ্গা ছিল অবধারিত। এও বলেছিলাম, যদি দাঁতে দাঁত চেপে দিল্লির শ্রমজীবী মানুষ ও প্রগতিশীল মধ্যবিত্ত শ্রেণি এই প্রয়াস রুখে দিতে পারেন তাহলে আপ’এর সর্বব্যাপ্ত জয় কেউ রুখতে পারবে না। সে কথা রাখা গিয়েছে। সমস্ত মিথ্যাচার ও নিষ্ঠুর বিভাজনের রাজনীতিকে পর্যদুস্ত করে দিল্লির মানুষ দু হাতে ঐক্য ও প্রগতির পথে রায় দিয়েছেন। বিকৃত হিন্দুত্বের যে রথ সারা দেশে ছুটছিল তা বহু রাজ্যে আটকে পড়লেও দিল্লিতে একেবারে ভূলুন্ঠিত হয়েছে। ২০০-র ওপর সাংসদ, অর্ধশতক মন্ত্রী, প্রায় সমস্ত শীর্ষ নেতাদের অলিগলিতে নামিয়ে, তার ওপর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ৪২টি রোডশো ও জনসভা, প্রধানমন্ত্রীর ডজনখানেক সভা - এই সার্বিক প্রয়াসও মুখ থুবড়ে পড়েছে। এমনকি দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীকে 'নকশাল', 'সন্ত্রাসবাদী' ইত্যাদি আখ্যা দিয়ে ও দিল্লির নির্বাচনকে 'ভারত বনাম পাকিস্তান' এই অভিধায় ভূষিত করেও কিচ্ছুটি নড়ানো যায়নি। বরং, জনতা উগ্রবাদীদের মুখে আরও বেশি ঝামা ঘষে এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেন। এই রায় তাই একটি টার্নিং পয়েন্ট। এই রায়ের বয়ান ধরেই ভারতবর্ষের ইতিহাস এবার অন্য পথে এগোবে। এই রায় বিভাজনকারী দাঙ্গাবাজদের বিরুদ্ধে বিজলী, পানি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ঐক্য ও সুশাসনের পক্ষে রায়।

এ দেশে বিজেপি’র উত্থান কোনও আকস্মিক ঘটনা ছিল না। তথাকথিত উদারবাদী ও ভেক গণতন্ত্রীদের দুরাচার ও ব্যর্থতা মানুষের জীবনযাত্রাকে অসহনীয় ও ব্যতিব্যস্ত করেছিল। সেই অনাচারের ফাঁক দিয়েই লৌহবর্মের আড়ালে নির্মাণ করা হয়েছিল এমন এক পুরুষমানব ও কল্পিত শত্রুর (মুসলমান) আশঙ্কামূলক অবয়ব, যে সেই শত্রুর বিরুদ্ধে সেই পুরুষমানবের অনিবার যুদ্ধই যেন হবে রাজনীতির অক্ষ ও সমস্ত মুশকিল আসানের যাদুমন্ত্র; যার অন্তিমে আসবে ‘আচ্ছে দিন’। অলীক সেই যুদ্ধ শেষেই নির্বাপণ হবে দারিদ্র, অবিচার ও গ্লানির যাবতীয় ক্লেশ। সে আশ্বাসে আপাত বিশ্বাস রেখেছিলেন দেশের এক বড় অংশের মানুষ। তা ব্যতিক্রমী কিছু নয়। কারণ, তার আগে এক নচ্ছাড়তন্ত্র দেশ ও মানুষকে কম ভোগায়নি।

অর্থনৈতিক দুর্ভোগকে বাদ দিলেও সামাজিক ও রাজনৈতিক বলয়ে এই নচ্ছাড়তন্ত্র প্রগতি ও ঐক্যকে নিজেদের সংকীর্ণ স্বার্থে নিমজ্জিত করেছিল। নানা রূপে, নানা ভাবে। ধর্মীয় মৌলবাদের বিচারে ইসলামীয় মৌলবাদকে হাল্কা করে দেখেছিল, বিবর্ণ বাবরি মসজিদের তালা খুলে দিয়ে হারিয়ে যাওয়া ধর্মীয় বিবাদকে উন্মত্ততায় পৌঁছতে ও হিন্দু মৌলবাদী শক্তিকে সংহত হতে সহারা দিয়েছিল, সংরক্ষণের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে উত্তর ভারত ও বিহারে 'যাদবতন্ত্র'এর মাফিয়ারাজ কায়েম করেছিল, পশ্চিমি একাডেমিক শিক্ষার দম্ভে সাধারণের জ্ঞানগৌরবকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার রীতি চালু করেছিল, পশ্চিমবঙ্গে এক নিষ্ঠুর পার্টিতন্ত্র মানুষের জীবনকে অতিষ্ঠ করছিল; সর্বোপরি, এক ভয়ঙ্কর আমলাকুল-রাজনীতিবিদ'এর জোটে প্রশাসনের এক নিষ্ঠুর অবয়ব ও কার্যপ্রণালী সমাজের ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো চেপে বসেছিল। এছাড়াও ছিল আপাদমস্তক দুর্নীতিতে ভরপুর এক রাজনৈতিক শ্রেণির রমরমা যারা সাধারণজনকে কুকুর-বিড়ালের দৃষ্টিতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল। স্বভাবতই এই অনাচারের বিরুদ্ধে সমাজ জুড়ে ক্ষোভ ধূমায়িত হয়েছে।
কিন্তু আজ আশার জায়গা হল, যে নচ্ছাড়তন্ত্রের বিরুদ্ধে সাধারণের ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে জায়গা করে নিল সর্বগ্রাসী নিষ্ঠুর বিভাজনের রাজনীতি, দেশ জুড়ে এক দমবন্ধ, ভয়ঙ্কর পরিসর নির্মাণ করে চলল ও ভেবে রেখেছিল সেইভাবেই তা চলবে, তা যে ভারতবর্ষের মাটিতে অত আয়েসে হওয়ার নয় সে কাণ্ডজ্ঞান তাদের ছিল না। অবশ্য থাকার কথাও নয়। কারণ, ভারতবর্ষের আত্মা অমন স্থূল হিন্দু-মুসলমান বিভাজনের ওপর দাঁড়িয়ে নেই (যদিও ধূর্ত ক্ষমতালিপ্স রাজনীতির অনুশাসনে হিন্দু-মুসলমানের হিংস্র দ্বৈরথ আমরা সময়বিশেষে প্রত্যক্ষ করেছি)। সেই ভারত আত্মাই যখন বুঝেছে, দৈনন্দিন সহবাসের প্রতি ছত্রে লেপে দেওয়া হচ্ছে উন্মত্ত হিংসা আর ঘৃণা, তখন তা আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। আর তার উদ্ভাসন হয়েছে ছাত্র-যুবদের হাত ধরে। শুধু কি তাই? পর্দানসীন নিতান্ত আটপৌরে মহিলারাও রাস্তায় এসে বসেছেন দিনের পর দিন। শাহিনবাগ এক উদাত্ত উচ্চারণে প্রতিভাত হয়েছে। এর অন্তর্নিহিত শক্তিকে বোঝার সাধ্য শাসকের নেই।

তাহলে এতসবের পরে অন্তিমে আমরা কি আবারও ব্যাক টু স্কোয়ার ওয়ান? হবুচন্দ্রকে সরিয়ে আবার কি সেই গবুচন্দ্র? একেবারেই নয়। এখানেই ভারতীয় গণতন্ত্রের (শীর্ণ হলেও) প্রাণশক্তি নিহিত। অর্থাৎ, আমাদের প্রতিটি সংকটেই আমরা পেয়েছি কিছু উত্তরণের দিশাও। আর তা প্রতিটি দিনাবসানে প্রকটতর হয়েছে। তাহলে এবার আমাদের প্রাপ্তি কী? তা হল, উত্থিত এক অনন্য স্বাধীন নাগরিক সমাজের নির্মাণ। এমন এক নাগরিক সমাজ যা রাজনৈতিক দল ও শাসককে প্রতি পদে সবক শেখাতে সক্ষম; যা কোনও ক্ষমতাশীল গোষ্ঠী বা বুদ্ধিজীবীকুল অথবা এলিট শ্রেণির ধামাধরা একবগগা, অলস, অক্ষম পরিসর নয়; যা সমস্ত অন্যায়কে একযোগে প্রতিহত করার মন্ত্র জানে। অতএব, প্রাপ্তি এও, আগামী সমস্ত শাসকের বয়ানে অবশ্যম্ভাবী বিবিধ পরিবর্তন। কিন্তু সেই পরিবর্তনগুলি আশ্বস্তপ্রদ নাও হতে পারে যদি নাগরিক সমাজ তাদের অর্জিত ঐক্য ও স্বাধীন চেতনাকে হারিয়ে ফেলে। তাই, দল-মত নির্বিশেষে নাগরিক সমাজ পথে নেমে যে বয়ান নির্মাণ করেছে তাকে নিত্য উড্ডীন রাখতে হবে। যার মন্ত্র রয়েছে আজাদ হিন্দ বাহিনী উচ্চারিত ‘ইত্তেহাদ’ (ঐক্য)’এর বীজে। নচ্ছাড়তন্ত্র ও ধর্মীয় বিভাজনের উন্মত্ততা- দুইয়ের বিরুদ্ধেই আমাদের সজাগ প্রহরা।

ঝাড়খণ্ডের পর দিল্লির নির্বাচনও কুৎসিত সিএএ-এনআরসি'র বিরুদ্ধে প্রবল রায়। এবার বিহার। একে একে চলুক বিভাজন রাজনীতির পতন অভিসার।  

৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০
(যে অভিনন্দন নির্বাচন হওয়ার আগেই দিল্লিবাসীকে জানানোর জন্য লেখা হয়েছিল তাঁদের ওপর অগাধ ভরসা রেখে)