Tuesday 30 June 2020

দিন যাপন!

আড়ালের প্রতিবেশীরা
সোমনাথ গুহ

বড় রাস্তার মোড়ে বহুতলের নিচে একটা নতুন লোক সবজি বিক্রি করছে। তখন লকডাউনের প্রথম দফা পেরিয়ে দ্বিতীয় দফা চলছে। ব্যাধির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের সদিচ্ছা ফিকে হতে শুরু করেছে। সংক্রমণ বাড়ছে। প্রতিদিন বহু মানুষ কর্মচ্যুত হচ্ছে। ক্ষুধার জ্বালায় মানুষ পথে নেমেছে। এরই মধ্যে ওই মানুষটির আগমন। কথায় একটা টান থাকলেও বাংলা ভালোই বলেন, বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। দেখা গেল, সবজি বেশ টাটকা, দামও কম। নতুন তো তাই খরিদ্দার তৈরি করছে, সবাই ভাবল। তিনি বাদামতলায় থাকেন, কাঠের মিস্ত্রি ছিলেন, কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। বহুতলের এক দারোয়ানের প্রতিবেশী। তারই সুপারিশে এখানে এসে বসা। ফ্ল্যাটবাড়ির লোকেরাও খুশি, তারা হাতের কাছে সবজি পেয়ে যাচ্ছে। পাড়ায় হঠাৎ সবজিওয়ালা বেড়ে গেছে, কিছু মাছওয়ালা। মিনিবাসের ড্রাইভার মাছ বিক্রি করছে, হেল্পার আলু, পেঁয়াজ নিয়ে ফুটপাতে বসে গেছে। 

রামনাথ প্রায় পঁচিশ বছর ধরে আমাদের পাড়ায় আছে। সে জামাকাপড় ইস্তিরি করে এবং সেই সুবাদে প্রায় প্রতিটি বাড়িতে তার আসাযাওয়া। মাঝেমধ্যে টুকটাক কথা হয় কিন্তু এর বেশি কিছু নয়। রামনাথের বাড়ি উত্তরপ্রদেশের বালিয়া জেলায়। এর আগে ওর দাদুদের নেতাজিনগর গাছতলায় দোকান ছিল, এখনও ওর চাচেরা ভাইদের আছে। পাড়ায় আসার পর তার আবাস একটা নড়বড়ে ছোট গুমটি, যেটার চেহারায় ক্ষণস্থায়িত্ব অনিবার্য ভাবে লেপটে আছে। থাকবারই তো কথা, সেটা যে কতবার স্থানান্তরিত হয়েছে তা তো কহতব্য নয়! পাঁচ ফুট বাই তিন ফুট উঁচু একটা টেবিল যেটার ওপর সে ইস্তিরি করে, যেটার ওপর সে শোয়, যেটার ওপর বাবু হয়ে বসে সে আহার করে আর ওটারই পেটের ভিতর পাট করা জামাকাপড় রাখা থাকে। এই গুমটির ওপর অ্যাজবেস্টাসের চাল, একপাশে একটা মাটির উনুন। পাশেই একটা বাতিস্তম্ভ যেটার দোসর বহু পুরনো একটা কদম গাছ। আমপানের রাতে গাছটা শিকড় ছিঁড়ে পুরনো বন্ধুকে জড়িয়ে ভূপতিত হয়, খুঁটিটার হ্যালোজেন বাতিটা কোনও দৈব আদেশে রামনাথের ঘরের চালের মাত্র এক ফুট ওপরে ঝুলতে থাকে।

এই রামনাথকে সবার প্রয়োজন কিন্তু কোনও সামাজিক দরকারে জায়গা অকুলান হলে তার গুমটি সরানোর কথাই সবার মনে আসে। নতুন টিউবওয়েল বসবে রামনাথকে সরাও, প্যান্ডেলে ঢোকার জায়গা অপ্রশস্ত রামনাথকে সরাও, গাড়ি ঘোরানোর জায়গা কম রামনাথকে সরাও। লকডাউনের কারণে তার ব্যবসায় তালা, ছোটখাটো ইস্তিরির ব্যবসাও বন্ধ। বেশির ভাগ লোকই এই মারির সময়ে বাইরে থেকে ইস্তিরি করার পক্ষপাতী নয়। কয়েক জন বেপরোয়া, ওকে সাহস দেওয়ার চেষ্টা করে, তোমার তো গলির মধ্যে ওইটুকু ঘর, কে দেখতে আসবে। আরে না দাদা, ক্লাবের ওখান থেকে একজনকে তুলে নিয়ে গেছে পুলিশ, কে রিস্ক নেবে? মাসখানেক নিজের পয়সায় কোনওরকমে চালানোর পর তার অবস্থা সঙ্গীন। অগত্যা এ বাড়ি ও বাড়ি যায় সাহায্য চাইতে। একটা মানুষ যে খেটে খেয়ে অভ্যস্ত, তার পক্ষে ভিক্ষা চাওয়া একটা মানসিক নির্যাতন। সে কুন্ঠিত হয়ে পড়ে, তার বিবেক কুঁকড়ে যায় অবমাননার জ্বালায়। আমাদের সুব্যবস্থিত জীবনে আমরা ভাবতেও পারি না স্বাভাবিক জীবনের শৃঙ্খল যখন ভেঙে পড়ে নিতান্ত ছোটখাটো ব্যাপারেও, নিম্নবিত্ত মানুষ কী সমস্যায় পড়তে পারে। পাড়ার মোড়েই পেট্রল পাম্পে একটা বাথরুম আছে যেটা মিনিবাসের স্টাফ, পাম্পের কর্মচারীরা, আশেপাশের দোকানদারেরা এবং রামনাথের মতো মানুষেরা ব্যবহার করে। তালাবন্দির কারণে সেই বাথরুমেও তালা পড়ে গেছে। শৌচকর্ম করতে তাকে এখন রথতলা বাজারের পাশে সুলভে যেতে হয়। সেখানে পয়সা লাগে, তাতেই রামনাথের দিনে দশ পনেরো টাকা বেরিয়ে যায়। কাজ বন্ধ, ওই টাকাই বা সে পাবে কোথায়? তাই রোজই এর তার কাছে হাত পাতে। 

বাদামতলায় বাড়ি বলে মানুষটার নাম হয়ে গেছে বাদল। রোজ কেনাকাটার ফলে তার সাথে ভালোই পরিচয় হয়ে গেছে। একদিন বলে, আর বলো না দাদা, লোকে এত দরাদরি করে আমার আর কী থাকবে বলো তো? না দিলে আবার রেগে যায়, গালাগালি করে। কাঠের কাজ করে পাঁচশো টাকা রোজ থাকত, এখন তার আধাও হয় না। বাদল বিহারের মানুষ, বেগুসরাই জেলা। পঁয়ত্রিশ বছর আগে এসেছিলাম  বিহার থেকে তখন ব্রহ্মপুরে একটা মান্ডি ছিল, তারপর থেকে যত ফ্ল্যাট হয়েছে তত মান্ডি বেড়েছে, সে গড়গড় করে বলে। বাড়ি যাও না? ঐ ছঠের সময় আর সাদীটাদি হলে। হঠাৎ এখানে চলে এলে? পিতাজী ছিল তো, কাঠের কাজ করত, তখন আর আমার কত বয়স! আমিও বড় হয়ে একই কাজে লেগে গেলাম। এই কাজ ভালো লাগে না দাদা। এই ভ্যানের জন্য পঞ্চাশ টাকা, পাল্লা দশ টাকা, তার ওপর লোকের গালি! 

সনাতন বাড়ি বাড়ি জল দেয়, ভারি, পুরনো কলকাতায় বলা হত ভিস্তিওয়ালা। ভিস্তি অর্থে জল বয়ে নিয়ে যাওয়ার চামড়ার থলি। অল্প বয়সে দেখেছি বড় ডালডার টিনে জল ভরে বাঁকে করে কাঁধে বয়ে নিয়ে যেত। এখন এসেছে ঘিয়ের জার যা তাঁরা সাইকেলে ঝুলিয়ে দূরদূরান্তে চলে যেতে পারে। সনাতনরা পাঁচজন একসাথে দুটো ছোট ঘরে ভাড়া থাকে। তিনজন সময় থাকতে উড়িষ্যায় চলে গেছে, সনাতন এবং আর একজন আটকা পড়েছে। জল দেওয়ার কাজ তালাবন্দির আওতায় নেই, লোকে নিচ্ছেও জল। সুতরাং পয়সা সনাতনের চিন্তা নয়, তার চিন্তা দেশে তার পরিবার কেমন আছে। এমনিতে কম কথা বলে, কোনও প্রশ্ন করলে শুধু ঘাড় নাড়ে। হঠাৎ একদিন শুনি সে সাইকেলে করে ভদ্রক জেলায় তার গ্রামে রওনা হয়ে গেছে। তার ভাই খবর দিল। তখন রটে গেছে বাংলা থেকে যারা যাচ্ছে তারা উড়িষ্যায় সংক্রমণ ছড়াচ্ছে, তাই অনেককে সীমান্তে আটকে দিচ্ছে। কী হবে যদি পুলিশ ধরে? বাড়ি পৌঁছলেও তো পনেরো দিন আলাদা থাকতে হবে, খারাপ কিছু হলে ভুবনেশ্বর নিয়ে যাবে! তার ভাইয়ের গলায় অসহায়তা। 

সেদিন দুপুর বারোটা নাগাদ দেখলাম বাদল গোছগাছ করে বাড়ি ফেরার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে।
- কি,তোমার কাঠের কাজ কবে শুরু হবে? 
- কি জানি দাদা, কোনও খবর নেই।
আজকে তার মুড বেশ ভালো।
- তোমাদের আশীর্বাদে বিক্রি বেশ হচ্ছে।
গামছা দিয়ে গলা মুছতে মুছতে বলল। বাদলের চার মেয়ে, এক ছেলে। এটা বলতে গিয়ে সে একটু লজ্জিত হল, যার অর্থ ও হয়তো বোঝে যে এটা ঠিক নয়। রেশন ওর বড় ভরসা। পরিবারের সাতটা কার্ড আছে। দু' টাকা দরে মাথাপিছু দু কিলো চাল এবং তিন কিলো গম পায়। 
- চাল খাওয়া যায় না দাদা, গলা দিয়ে নামে না।
বাদল  বুকের ওপর নিম্নগামী আঙুল দিয়ে বোঝাল।
- ওটা চোদ্দ টাকায় বিক্রি করে দি। 
- দু টাকার চাল চোদ্দ টাকায়! 
- ভ্যান ভাড়াটা ধরে। রেশন দোকান থেকে মাল নিয়ে যেতে পঞ্চাশ টাকা ভাড়া পড়ে যায়। 

তাতেও ওর ভালোই লাভ থাকে। আর এর অর্থ, এইরকম মানুষও আছে যে ওই চাল যা গলা দিয়ে নামে না তা চোদ্দ টাকায় কিনে নেয়। হতে পারে সে আরও গরিব, কিংবা তার রেশন কার্ড নেই আবার বাজার থেকে এর থেকে বেশি দাম দিয়ে কিনবে সেই সঙ্গতিও নেই। গরিবের কত স্তর, তলানি খুঁজে পাওয়া ভার! 

১৯ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের পরের দিন সাগর ফোন করে বলে, দাদা, একটা সুযোগ পেয়েছি, বাড়ি পালাচ্ছি, অবস্থা সুবিধার মনে হচ্ছে না। ব্যাটার দূরদৃষ্টি আছে বলতে হবে, সেই যে গেছে এখনও ফিরতে পারেনি। সাগর ক্ষৌরকার, দেশ বিহার, মজঃফরপুর জেলা। চুল কাটার সময় তার সাথে রানার নানা কথা হয়। সন্ধ্যাবেলায় সে একটা মণিহারী দোকানে কাজ করে, মাসকাবারি মাল খদ্দেরের বাড়ি পৌঁছে দেয়। এতে তার প্রায় হাজার তিনেক টাকা ইনকাম আছে। দেশে গেলে সে আর ফিরতে চায় না তাই দোকানের মালিক তাকে মাঝেমধ্যেই ছাড়িয়ে দেয়, তখন সে ঠিক অন্য কোনও কাজ জুটিয়ে নেয়। বয়স্ক মানুষকে রাস্তায় হাঁটায়, কিংবা সন্ধ্যাবেলায় টিভি দেখায় তাঁকে সঙ্গ দেয়। এর জন্য সে পঞ্চাশ টাকা রোজ পায়।

বাদল আবার রেশন পেয়েছে। এটা হয়তো কেন্দ্রীয় সরকারের: পঞ্চাশ কিলো চাল, একুশ কিলো গম। পঞ্চাশ কিলো মানে একেক জন পিছু কত করে দিয়েছে, গম না হয় বোঝা গেল জনপ্রতি তিন কিলো!
- হিসাব করে দেখ না দাদা কত হয়?
হিসাবের মাথামুণ্ডু কিছু বোঝা গেল না, পাঁচ করে সাত জনের হয় পঁয়ত্রিশ কিলো, দশ করে সত্তর কিলো... কিছু একটা গরমিল মনে হয়!

- চাল কেমন?
- ওই দাদা, নরম, আঠার মতো।
- যাই হোক, তোমার তো এখন খাবারের অভাব নেই?
- না দাদা মিথ্যা কথা বলব না, কোনও অভাব নেই।

আনলক শুরু হয়ে গেছে কিন্তু তার আর পুরনো কাজে ফিরে যাওয়ার উৎসাহ নেই।
- মিথ্যা কথা বলব না দাদা, খারাপ বিক্রি হচ্ছে না, কিন্তু দুবেলা বসতে পারলে ভালো হয়। দেখ, ছিল ছুতোর মিস্ত্রি, হয়ে গেল সবজিওয়ালা! 

Saturday 27 June 2020

আগামীর আশঙ্কা!

কার বদলে কী

প্রবুদ্ধ বাগচী

গত বছর মে মাসে যখন লোকসভা নির্বাচন চলছিল তখন সংবাদমাধ্যমে ও সোশ্যাল মিডিয়ায় একদল সাংবাদিক নির্বাচনী ফলাফলের সম্ভাব্যতা নিয়ে নানারকম আলোচনা করছিলেন। নির্বাচনের কিছু আগে থেকেই নানা নির্বাচনী সমীক্ষা প্রকাশও চলছিল পুরোদমে। মনে আছে, নির্বাচন চলাকালীন অন্তত দুজন নামী সংবাদপত্রের সাংবাদিক ফেসবুকে লিখেছিলেন, তাঁরা কিছুতেই বিজেপি জোটকে দুশো থেকে দুশো তিরিশের বেশি আসন দিতে পারছেন না। সর্বভারতীয় অনেক সমীক্ষায় কিছু কিছু ক্ষেত্রে এইরকম একটা সম্ভাবনার কথাই বলা হয়েছিল। কিন্তু ফল বেরতে দেখা গেল সবটাই উলটপুরাণ। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিজেপি ফিরে এল ক্ষমতায়।

সেফোলজি বিষয়টা বৈজ্ঞানিক নয় এটা বলব না। রাশিবিজ্ঞানের সাহায্য নিয়ে অনেক ক্ষেত্রে সম্ভাব্যতার কিছু কিছু ধারণা পাওয়া সম্ভব। কিন্তু ভোটের ফলাফল বিচার করার সঙ্গে আর পাঁচটা আকাডেমিক বিষয়ের কিছু তফাত আছে, যা অস্বীকার করলে ভুল হবে। ভোটের সম্ভাব্য ফলাফল ভোটারদের কাছে প্রকাশিত হয় এবং তাঁদের প্রভাবিত করে। তাই কোনও একপক্ষের দিকে ঝুঁকে থেকে যখন সেফোলজির দোহাই দেওয়া হয় তখন তাকে আর বিজ্ঞান বলা যায় না। সম্ভবত আমরা কেউই দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারব না যে এ দেশে সেফোলজি নামে যা চলে তার সবটাই খুব বিশুদ্ধ গাণিতিক হিসেবনিকেশ।

কথাটা উঠল এই কারণে যে সম্প্রতি আমাদের রাজ্যের আগামী রাজনীতি নিয়ে খুব শোরগোল উঠেছে যা মাঝে মাঝে খুব অশ্লীলতার পর্যায়ে উপনীত। আগামী বছর বিধানসভা নির্বাচনে ফলাফল কী হবে তার বিশ্লেষণ করতে গিয়ে এমন সব ঘটনা ঘটছে, এমন সব কথা বলা হচ্ছে যা বেশ অস্বস্তির উদ্রেক করে। যার একটা হল, এই ফলাফলের প্রাক-সম্ভাব্যতা বিচার। গণতান্ত্রিক দেশে যে কেউ যা খুশি করতে পারেন, তাতে বাদ সাধার কিছু না থাকলেও আপত্তি জানানোর জায়গা নিশ্চয়ই লোপাট হয়ে যায়নি। বিশেষ করে, এই মুহূর্তে যে রাজ্য করোনা-অতিমারি ও আম্ফান-ঝড়ের প্রকোপে বিপর্যস্ত, রাজ্যের অর্থনীতি বাকি দেশের মতোই দুর্বল, সেখানে রাজনীতির কারবারীরা একটু দায়িত্বশীল হবেন এটা খুব বড় মাপের আশা বলে মনে হয় না ।

এই আশার গোড়ায় শুরুতেই জল ঢেলেছে রাজ্য বিজেপির রাজনীতির অভিমুখ। পরীক্ষার ফল আগাম ঘোষণা করে দিলে যা হয় আর কি! গত লোকসভায় আঠারো আসন লাভ করে তাদের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ঢাক পিটিয়ে ঘোষণা করে দিয়েছিলেন, পরের বিধানসভায় তাঁরাই জিতে আসছেন। লোকসভা আর বিধানসভা ভোটের মধ্যে যে যোজন ফারাক, তাতে যে পরিপ্রেক্ষিত বদলে যায়, এইসব তাঁরা প্রকাশ্যত ধর্তব্যের মধ্যে আনেননি, নিজেদের সমর্থকদের তাতিয়ে তোলার জন্য নানা হুংকার দিয়েছেন। যদিও লোকসভা ভোটের পরেই বিধানসভার উপনির্বাচনে নিজেদের জেতা আসন তাঁরা ধরে রাখতে পারেননি। এর পরে এনআরসি/ সিএএ নিয়ে দেশজোড়া বিক্ষোভ এই রাজ্যেও তাদের মাটি কেড়ে নিয়েছিল। করোনা পরিস্থিতি সেদিক থেকে তাদের পক্ষে শাপে বর বলা যায়। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে প্রকাশ্য রাজনৈতিক কাজকর্ম করা সম্ভব নয়, অথচ সেটা না করতে পারলে ক্ষমতার কাছে আসার বৃত্ত সম্পূর্ণ হওয়া মুশকিল। এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সব থেকে আগ্রাসী ভূমিকা আমরা দেখতে পেলাম তাদেরই পক্ষ থেকে।

রাজ্যের মানুষের কষ্ট ও কঠিন পরিস্থিতির দিকে নজর না দিয়ে তাঁরা একতরফা ভাবে নিশানা করতে লাগলেন শাসক দলকে। বছর কুড়ি আগে ফিরে গেলে আমরা দেখতে পাব, ২০০১ বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে তৃণমূল নেত্রীও ‘এবার নয় নেভার’ ডাক তুলে দলকে একটা তীক্ষ্ণ প্রত্যাশার মুখে তুলে এনেছিলেন। ২০০০ সালের সেপ্টেম্বরে রাজ্য জুড়ে বন্যার পরে তিনি বলেছিলেন এটা ‘ম্যানমেড’ বন্যা এবং এই সূত্রে রাজ্য যাতে কোনওরকম কেন্দ্রীয় সাহায্য না পায় তাতে তাঁর পুরো সমর্থন ছিল। এবারের পরিস্থিতির সঙ্গে কেউ কেউ তার মিল খুঁজে পেতে পারেন। কিন্তু তফাত হল, তৃণমূল কংগ্রেস একটি রাজ্য স্তরের দল আর বিজেপির অবস্থান সর্বভারতীয়- তাদের পুঁজিপাটা ও সব দিকের জোর অনেক বেশি, বিশেষত, কেন্দ্রের শাসনক্ষমতা তাদের হাতে থাকায় আরও বাড়তি সুবিধে তাদের ঝুলিতে। এই সুবিধার ফায়দা তুলতে তারা মরিয়া।

করোনা পরিস্থিতিতে রাজ্যের সমস্যা ছিল প্রধানত দুটো। লকডাউনে কাজ হারানো বা বিপন্ন মানুষের কাছে প্রতিদিনের খাবার ও আর্থিক ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া। রাজ্যের সরকার একেবারে গোড়াতেই সেই উদ্যোগ নিতে পেরেছিল। পরের সমস্যা হল পরিযায়ী শ্রমিকদের পুনর্বাসন। এই বিষয়ে সকলেই অবহিত আছেন, কেন্দ্রের অপরিকল্পিত লকডাউন নীতি কী গভীর বিপর্যয় ডেকে এনেছে সারা দেশে। সমস্যাটা কেবল এই রাজ্যের নয়। তবু রোগ-সংক্রমণ সামলাবার জন্য রাজ্য সরকার যে সব প্রস্তাব দিয়েছিল কেন্দ্র তাতে ভ্রূক্ষেপ করেনি, কিন্তু এই রাজ্যের বিজেপি নেতারা সম্পূর্ণ নীতিহীনভাবে সেই ভুলের দায় রাজ্যের ওপর চাপিয়ে দিয়ে রাজ্যের বিরোধিতা করলেন একটানা। অথচ করোনা-কাণ্ডের জেরে রাজ্যের অর্থনীতিকে সচল করতে যে কেন্দ্রীয় প্যাকেজ দরকার তা নিয়ে তাঁদের মুখে কিছু শোনা গেল না। শোনা গেল না তাঁদের রাজভবনের প্রতিনিধির মুখেও। বরং তথ্য গোপন, লাশ পাচার- এইসব দায়িত্বজ্ঞানহীন গল্প ফেঁদে তাঁরা নিত্যদিন টিভিতে মুখ দেখাতে লাগলেন। রাজ্যের অন্য বিরোধী নেতারা প্রথমে এত আগ্রাসী ছিলেন না, তারা জানেন আগামী বিধানসভা ভোটে তাঁদের সম্ভাবনা খুব দুর্বল, কিন্তু বিজেপির সুরে সুর মিলিয়ে তাঁদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ পাল্টে যেতে দেখলাম আমরা। কোভিড মোকাবিলায় প্রতিটি সরকারি পদক্ষেপ শতকরা একশো ভাগ সঠিক ছিল এই কথা কেউ বলে না, এমন এক অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতির জন্য কেউ প্রস্তুত ছিলেন না এটাও সত্যি। কিন্তু তিলকে তাল করার এই খেলায় বিজেপি যে খলনায়ক সেই বিষয়ে সন্দেহ নেই।

আম্পান পরবর্তী অবস্থায় এই খেলা আরও নিচু স্তরে নেমে গেছে। আড়াইশো বছরে একবার যে মাপের ঝড় হয় তার জন্য কোনও প্রস্তুতিই যথেষ্ট বলে কেউ মনে করতে পারে না। কিছুটা আগাম প্রস্তুতি নিয়ে মৃত্যু এড়ানো গেছে অনেকটাই কিন্তু ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো যায়নি। বিপুল বিপুল ক্ষতি, চারটে জেলা আক্রান্ত, উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ-পরগণার বিস্তৃত অঞ্চল কার্যত ধূলিস্যাৎ। সরকারি হিসেবে এক লক্ষ কোটি টাকা দরকার, প্রধানমন্ত্রীর হেলিকপ্টারে চড়ার পর এসেছে মাত্র হাজার কোটি। কেন্দ্রীয় দল ঘুরে যাওয়ার পরেও বাকি সাহায্য কবে আসবে কেউ জানে না। সাম্প্রতিক খবর অনুযায়ী, বাকি আর্থিক সাহায্য বিশ বাঁও জলে। বিজেপির আঠারো জন সাংসদ একবারের তরেও রা কাড়েননি, অর্থ সাহায্যের দাবি তোলেননি। উল্টে এই রাজ্যের বিজেপি নেতারা বেশি বেশি প্রচার করছেন ত্রাণে দলবাজি বা দুর্নীতি নিয়ে। দলবাজি বা দুর্নীতি হচ্ছে না এটা সত্যি নয়। হচ্ছে নিশ্চয়ই একটা শতাংশ- ত্রাণে দলবাজি বা দুর্নীতি কোনও নতুন ব্যাপার নয়- কিন্তু দলবাজি বা দুর্নীতি হচ্ছে বলে আর্থিক ত্রাণ বন্ধ করে দিতে হবে এটা অভিনব, যে প্যারাডাইমটা বিজেপি আমদানি করতে চাইছে দিনেরাতে। দেশের প্রতিরক্ষা খাতে যুদ্ধাস্ত্র কেনার জন্য প্রচুর টাকা কিকব্যাক দিতে হয়, তাই বলে কি প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বন্ধ করে দিতে হবে?

এইরকম একটা আবহে এমন একটা উচ্চারণ ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে যে বর্তমান রাজ্য সরকারের মেয়াদ ফুরিয়ে গিয়েছে, আসন্ন বিধানসভায় তাদের পরাজয় প্রায় সময়ের অপেক্ষা। কোনও কোনও চ্যানেল আবার ইতিমধ্যেই পরবর্তী সরকারের মুখ্যমন্ত্রী কে হবেন তা নিয়েও জল্পনা শুরু করে ফেলেছেন। লাগাতার একটা সরকার বিরোধী প্রচার চলছে যার ভিত্তিটা যে খুব মজবুত নয় তাই মাত্র নয়, এর মধ্যে একটা বিপজ্জনক ইশারা আছে। তৃণমূল নেত্রীর এ যাবৎ বড় সৌভাগ্য যে তাঁর দলের উত্থানের সঙ্গে রাজ্যের সাংবাদিককুল ও চ্যানেল কর্তৃপক্ষের একটা সহজ সম্পর্ক আছে। গোড়ার থেকেই তিনি কিছু করলেই সেটা বিরাট কভারেজ পেয়ে এসেছে, সরকারে আসার পরেও তাকে প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া ছেড়ে চলে যায়নি। তিনি সাংবাদিকদের বেছে বেছে রাজ্যসভায় পাঠিয়েছেন, তাঁর ছবি ছাড়া কোনও কোনও সংবাদপত্রের দৈনিক সংস্করণ ছাপাই হয়নি, কিছু চ্যানেল তাকে সামনে রেখেই বেড়ে উঠেছে এবং এখনও চালিয়ে যাচ্ছে। যে দুয়েকটা সংবাদমাধ্যম কিছুটা নিরপেক্ষ অবস্থান নিতে চেয়েছে তাদের তিনি ভাল চোখে দেখেননি, তাঁর দলের নেতারা সেইসব চ্যানেল নিয়ে বিষোদ্গার করেছেন, কারও কারও জন্য সরকারি বিজ্ঞাপন বন্ধ হয়ে গেছে। এগুলো যে ঘটেছে তা নিয়ে দ্বিমত নেই।

কিন্তু তৃণমূলের সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বিজেপিকে আদর করে ক্ষমতায় আহ্বান করে আনার মধ্যে একটা বিপজ্জনক ইঙ্গিত আছে। তা দু' দলের সাংস্কৃতিক তফাত। বাম দলগুলি গত লোকসভা নির্বাচনের আগে তৃণমূল-বিজেপির গোপন সমঝোতার কথা বারে বারে বলত, মানুষ সে কথা বিশ্বাস করেনি। উল্টে তৃণমূল'এর ওপর ক্ষোভ জানাতে গিয়ে বাম ভোট বিজেপির বাক্সে পড়েছে এটা এখন সকলেই জানেন। আদপে তৃণমূল দলটি কংগ্রেস দলের ঐতিহ্যে লালিত, এই দলের যারা গুরুত্বপূর্ণ নেতা তারা আদিতে কংগ্রেস করতেন এবং তাঁদের ভাবধারাতেই তাঁদের বড় হয়ে ওঠা। দুর্নীতি বা স্বৈরী ক্ষমতার প্রতিপালনে কংগ্রেস দলের খুব সুনাম নেই কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে তাদের একটা গড়পড়তা অবস্থান আছে যার মধ্যে একটা উদারতা আছে। আর কংগ্রেসের যেহেতু কোনও সুনির্দিষ্ট আদর্শগত অবস্থান নেই ফলে নানা রকমের মানুষ তাদের দলের মধ্যে অ্যাকোমোডেটেড হয়ে যেতে পারেন। চরিত্রগত ভাবে তৃণমূল তার থেকে আলাদা নয়।

কিন্তু বিজেপি সব দিক দিয়ে একটা চরম সাম্প্রদায়িক দক্ষিণপন্থী দল এবং ইদানিং হালে পানি পাওয়ায় তারা প্রকাশ্যে তা ঘোষণা ও চর্চা করে। খুব সাম্প্রতিক সময়ে ফেব্রুয়ারিতে দিল্লি দাঙ্গার সময় আমরা সেই হিংস্র মুখ দেখেছি। দেখেছি, গুজরাত দাঙ্গার সময় তাদের নজিরবিহীন ভায়োলেন্সে। এর উপর দলটি সম্পূর্ণ ভাবে বড়লোকদের স্বার্থে পরিচালিত এবং ধর্মের নামে যাবতীয় তামসিকতার ঘোর সমর্থক যাদের পরিসরে মুক্তচিন্তার আধছটাক জায়গাও নেই। সেই রীতি মেনেই একদিকে যেমন তারা একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থে যাবতীয় সরকারি সিদ্ধান্ত নেয় অন্যদিকে জেএনইউ বা যাদবপুরের ছাত্রছাত্রীদের দেশদ্রোহী বলে বা করোনা নিরাময়ে গোমূত্র সেবনের পরামর্শ দেয়। হালের কেন্দ্রীয় সরকারের গত ছয় বছরের কাজেকর্মে এর থেকে বেশি আমরা কী দেখেছি? যাদের ঐতিহ্যে কোনও দেশনেতা নেই, কোনও মুক্তচিন্তক নেই, যাদের মানসিকতায় সর্বদা সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, যাদের চেতনায় গণতান্ত্রিকতার লেশমাত্র নেই, নেই পরমতসহিষ্ণুতা- বিপরীতে তারা মুক্তচিন্তকদের বেছে বেছে খুন করে, মানবাধিকার কর্মীদের মিথ্যে মামলায় জড়িয়ে প্রতিশোধ নেয়, দেশের সাধারণ মানুষের স্বার্থের সঙ্গে তাদের বিন্দুমাত্র যোগ নেই। করোনা নিয়ে লকডাউনের সময় যে পরিযায়ী শ্রমিকদের কথা একবারের জন্যও ভাবা হয়নি এটা তার হাতে-গরম প্রমাণ, প্রমাণ লক ডাউনের সুযোগে তারা সিএএ বিরোধী আন্দোলনের নেতাদের মিথ্যে মামলায় গ্রেফতার করে চলেছে।

আমাদের রাজ্যে আমরা খুব সুখে আছি এটা কেউ বলে না। কিন্তু রাজ্যের গরিব মানুষরা নানা সরকারি সুবিধা পেয়েছেন, গ্রামীণ এলাকায় পঞ্চায়েত খুব ভাল কাজ না করলেও উন্নয়নমূলক কাজ একেবারে হয়নি তা নয়। তার থেকেও বড় কথা, সরকারের অভিমুখের মধ্যে একটা মানবিক মুখ আছে সেটা মুখ্যমন্ত্রীর দীর্ঘ গণ আন্দোলনের ফল, তিনি মানুষের পালস খুব ভাল বোঝেন, এটা পোড় খাওয়া বিরোধী নেতারাও স্বীকার না করে পারেন না। তাছাড়া সাংস্কৃতিক ভাবে আমরা কি খুব খারাপ আছি? একটা দুটো অনীক দত্ত নিশ্চয়ই আছে, সেটা অন্যায়- কিন্তু এর থেকে উন্নত ন্যায় কি আমরা কল্পিত বিজেপি জমানায় আশা করব? আশা করব বাংলার যে একটা দীর্ঘলালিত সংস্কৃতি আছে তা রামবাবুদের জমানায় আরও বিকশিত হবে?

পাশের রাজ্য ত্রিপুরায় বিধানসভা জয়ের পরের দিনই লেনিন মূর্তি ভেঙে দেওয়া হয়েছিল, সেই রাজ্যের সরকারি কর্মীদের পেনশন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, পঞ্চায়েতে আটানব্বই শতাংশ আসন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে ফেলা হয়েছে। এখানে সরকারে না এসেই বলা হচ্ছে সব সরকারি স্কুল বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়া হবে, শিক্ষকদের বেতন কমিয়ে দেওয়া হবে।  ক্ষমতায় না থেকেই বিদ্যাসাগর মূর্তি ভেঙে ফেলা হল, যাদবপুরের ছাত্র ইউনিয়নের অফিস পুড়িয়ে দেওয়া হল- তাহলে হাতে ক্ষমতা পেলে কী হবে? এই রাজ্যে যেখানে সাম্প্রদায়িক অশান্তির সামান্য ধোঁয়া সেখানেই আরও আগুন জ্বালাতে পৌঁছে যাচ্ছে বিজেপি বাহিনী, গুজরাতের হাসপাতালে হিন্দু মুসলমান আলাদা ওয়ার্ড- বাংলাতেও তাই হতে দিতে চাই আমরা?

ব্যক্তিগতভাবে আমার মতকে মানতে হবে এমন বলছি না। কিন্তু যারা খুল্লম খুল্লা বিজেপির ক্ষমতা লাভের আশায় প্রচারে নেমেছেন তারা নিজেদের ল্যাজে আগুন দিয়ে ফেলছেন না তো? তবে একটা আশার কথা আছে। প্রবীণ সাংবাদিক সুমন চট্টোপাধ্যায় এক জায়গায় লিখেছিলেন, খবরের কাগজে লিখে যদি সত্যি সরকার ফেলে দেওয়া যেত তাহলে বামফ্রন্ট সরকারের চৌত্রিশ বছর থাকবার কথা নয়, কারণ একেবারে প্রথম দিন থেকেই রাজ্যের সব সংবাদপত্র তাদের বিরুদ্ধে লাগাতার লিখে এসেছে! সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম লালগড় পরবর্তী বাম সরকারের অবস্থা (২০০৬-১১) একেবারে সামনে থেকে দেখার অভিজ্ঞতা আছে বলেই বলছি, সেটা সত্যিই একটা ‘পুতুল’ সরকার হয়ে গিয়েছিল শেষের দিকে। মন বলছে, ভোটের এক বছর আগে এখনও বর্তমান রাজ্য সরকার সেই অবস্থায় যায়নি- ভুল হলে এক বছর পর মানুষ তা সংশোধন করে দেবেন।


Sunday 21 June 2020

নবতর সমাজ

রাষ্ট্রের অস্তরাগ!
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য

যেন দুটি ক্ষমতাধারী সত্তা মুখোমুখি আজ। একটি অতি-পুরাতন, পরিচিত, চিরায়ত: রাষ্ট্র। অন্যটি নব-উত্থিত, আপাত অদৃশ্য, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত: ভার্চুয়াল দুনিয়া। প্রথম সত্তাকে টিকে থাকতে দরকার পড়ে অস্ত্র, সেনা-পুলিশবাহিনী, যুদ্ধ-বিগ্রহ, কয়েদখানা, কিছু কড়া আইন, গণতন্ত্র বা স্বৈরাচার। দ্বিতীয় সত্তার প্রয়োজন তথ্য, নজরদারি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত সমাজ-অর্থনীতি। কিন্তু দুইয়েরই অস্তিত্বের সারসত্য: মুনাফা। এই দুই সত্তা আজ দ্বৈরথে সামিল। সম্মুখ সমর। যেন এক নব বিপ্লবের উপান্তে আমরা এসে হাজির। ফরাসি বা রুশ বিপ্লব থেকে যা কম তাৎপর্যপূর্ণ নয়।

গত প্রায় এক দশকের এই দ্বৈরথে চিরায়ত রাষ্ট্রের ধারণা ক্রমশ বিলীন হচ্ছে। দৃশ্যত, ভার্চুয়াল দুনিয়ার সামনে জাগতিক রাষ্ট্রীয় দুনিয়া কার্যত পশ্চাদপসরণ করছে। কোভিড পরিস্থিতিতে সে গতি আরও ত্বরান্বিত হয়েছে। বিশ্ব অর্থনীতি বাঁধা পড়ছে এক প্রসারিত ভার্চুয়াল ডোরে। আরও তীব্রভাবে। এ তাবৎকালের দেশ-বিদেশের যা কিছু বাস্তব সীমানা, ক্রমেই মলিন হয়ে উঠছে।

এই পরিবর্তনের আবহ, বলা বাহুল্য, ইউরোপ ও আমেরিকার উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলিতেই ক্রমপ্রকটমান। কিন্তু তা অচিরেই বাকী দুনিয়াকেও ছাড়বে না মোটে। পুঁজিবাদের আজ আর একটাই ধরন নেই- তার নানা স্তর, বিবিধ আঙ্গিক ও নানান রকমফের। যদি আমেরিকা, বৃটেন, ব্রাজিল, ভারত, চীন বা ফ্রান্স কিছুটা রক্ষণশীল ও উগ্র জাতীয়তাবাদী মোড়কে পুঁজিবাদের অনুশীলনে নিয়োজিত থেকে থাকে তবে তাদের কাছে রাষ্ট্রের অপরিহার্যতা এখনও অটুট। অন্যদিকে, ফিনল্যান্ড, নরওয়ে, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড বা বেলজিয়াম হয়তো খোলামেলা পুঁজিবাদের অনুশীলনে রাষ্ট্রের অতটা কঠোরবিধি মেনে চলার পক্ষে নয়। কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সর্বগ্রাসী প্রকোপে পুঁজিবাদী দুনিয়ার আরও বেশি বেশি ভার্চুয়াল-অনুশীলন তাকে (সব ধরনের পুঁজিবাদী দেশগুলিকেই) ঠেলে নিয়ে চলেছে চিরাচরিত রাষ্ট্রের দুনিয়া থেকে ভার্চুয়াল জগতের যাপনরীতিতে। তা প্রায় সব দেশেই আজ কমবেশি প্রত্যক্ষত দৃশ্যমান।

আমেরিকায় অচল হয়ে পড়ছে রাষ্ট্রপ্রধানের বয়ান। ট্রাম্পকে দেখে এক অসহায় ক্লাউনের মতো লাগছে। রাস্তায় নেমে লক্ষ লক্ষ মানুষ নির্মাণ করছে এক অন্যতর সমাজরীতি। সেখানে অন্যতম মুখ্য ভূমিকায় অবতীর্ণ ভার্চুয়াল দুনিয়ার কার্যাবলী ও প্রক্রিয়া। ট্যুইটার আজ নির্দ্বিধায় বর্ণবৈষম্যের দায়ে বাতিল করে দিচ্ছে মহামতি ট্রাম্পের পোস্ট। শহরে শহরে রাস্তায় রাস্তায় লুটিয়ে পড়ছে অতীত বর্ণবৈষম্যবাদীদের মর্মর মূর্তি। পুলিশ হাঁটু গেড়ে ক্ষমা চাইছে জনতার ওপর তাদের বর্বরতার জন্য। ব্রাসেলস'এ রাস্তায় পুলিশের দল সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে হাত থেকে ছুঁড়ে ফেলছে হ্যান্ডকাফ- অনেক হয়েছে, আমরা বর্বরতার ইতি টানতে চাই। সিয়াটলে স্থানীয় জনতা দিনের পর দিন রাস্তা অবরোধ করে 'স্বশাসিত এলাকা'র ঘোষণা দিয়ে পুলিশি ব্যবস্থা তুলে 'কমিউনিটি ব্যবস্থা' গড়ে তোলার দাবি জানাচ্ছে। রাজনৈতিক অর্থনীতির রশি দ্রুত হাতবদল হচ্ছে। রাষ্ট্র ও নীতিকারেরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই কর্মসংস্থানে জোয়ারভাটা হয়ে যাচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়া, জনতার জমায়েত, নানা ধরনের অজস্র সংগঠন হয়ে উঠছে যোগাযোগ এবং যাপনের প্ল্যাটফর্ম ও ভাষা। চিরায়ত রাজনৈতিক দল, আমলাতন্ত্র, পুলিশ-সেনা, ক্ষমতার স্মারকগুলি ভেঙ্গে পড়তে পড়তে জায়গা করে দিচ্ছে নতুন প্রতীক, ভাবনা ও উত্থানকে। সেগুলি কেমন তা আরেকটি লেখায় বিস্তারিত বলা যাবে। তা গিগ অর্থনীতির নতুন গল্প যেখানে রাজনৈতিক-অর্থনীতির নতুন ভাষ্য নির্মিত হচ্ছে।

বিশ্ব অর্থনীতির শৃঙখলে বাঁধা আমাদের দেশের রাজনৈতিক অর্থনীতিও এই পরিবর্তনের অভিঘাত থেকে সরে থাকতে পারবে না। তার ইঙ্গিত ও সূত্র যথেষ্ট প্রকটিত। আজ দেশের প্রায় প্রতিটি রাজ্য সরকার তাদের কোষাগার উন্মুক্ত করতে বাধ্য হচ্ছে সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পে। কেন্দ্রীয় সরকারও পিছিয়ে থাকতে চাইছে না। বহু স্বর, বহু দলের টানাপোড়েনে কেন্দ্রে-রাজ্যে বা স্থানীয় ক্ষমতায় আরোহন নিয়ে এক তীব্র প্রতিযোগিতামূলক আবহ তৈরি হয়েছে। কারণ, সোশ্যাল মিডিয়া ও ভার্চুয়াল দুনিয়ার সর্বব্যাপ্ত উপস্থিতি এক বর্ণময় ও জটিল জনমত গড়ে ওঠার পরিসরকে বাস্তবায়িত করেছে। ফেক ও রিয়েল নিউজের দড়ি টানাটানিতে মানুষের বোধ ও অনুভূতিগুলি আরও প্রখর হয়ে উঠছে। এই আলোআঁধারি উন্মেষে জনমত কখন কোনদিকে যাবে তার আভাস পাওয়ার সম্ভাবনা রাজনৈতিক দলগুলির কাছে তাই আজ আরও বেশি কঠিন। অতএব, তাদের তরফে আরও জনমুখি ও হুঁশিয়ার হওয়া এখন বাধ্যবাধকতা। এছাড়া তাদের আর কোনও উপায়ও নেই।

তবে নিজেদের জনমুখিতাকে সাব্যস্ত করতে রাষ্ট্রবাদী ও উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতি, রাষ্ট্রের উগ্র ধ্বজা তুলে ও বর্ণ-জাতি-ধর্মগত ঘৃণা ছড়িয়ে কিছুদিন অবধি হয়তো সচল থাকবে। কিন্তু সে রাজনীতিরও পতন সমাগত। কারণ, ভার্চুয়াল দুনিয়ার বিশ্ব পরিসরে তথ্য সম্ভার ও অর্থনৈতিক লেনদেনই মুখ্য কার্যক্রম; তা যে উপায়েই হোক না কেন: বিনোদন, শিক্ষা, নজরদারি, বিক্রিবাট্টা, সোশ্যাল মিডিয়া, যোগাযোগ, স্ব-উদ্যোগ আর যা যা কিছু। আর এই ভার্চুয়াল দুনিয়াকে চালিত করছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যে অ্যালগরিদম তার কোনও একক প্রভু নেই। এ কোটি কোটি দেবতার নিত্য প্রয়াসের ফল, যে দেবতারা জন্ম নিচ্ছেন আবার বিলুপ্তও হচ্ছেন আমার-আপনার ঘরে, প্রায় প্রতি মুহূর্তে। এই নবতর আঙ্গিকে যে নতুন সমাজের উত্থান তার গতিপ্রকৃতি কোনদিকে তাই এখন দেখার। কিন্তু পুরনো রাজনীতি ও রাষ্ট্রের নির্বাণকাল যে সমাগত তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই 'মিথ্যা অস্ত্রশস্ত্র ধরে' যুদ্ধ এখন ক্রমেই এক অলীক স্বপ্নবিলাস মাত্র।

Friday 19 June 2020

মানুষের অধিকার!

সিদ্ধান্তহীনতার মহা গেরো?
অশোকেন্দু সেনগুপ্ত

অথবা প্রশ্নটা এভাবেও করা যায়: পথিক তুমি কি পথ হারাইয়াছ? সেও এক সিদ্ধান্তহীনতা বা দিশাহীনতা মুখ্যমন্ত্রীকেও আজ দিশাহীন লাগছে কেন? উদাহরণ অনেক যেমন, পরিবহন ক্ষেত্র মুখ্যমন্ত্রীর দলের একজন নেতা এক টিভি চ্যানেলে বললেন, মুখ্যমন্ত্রীর কাছে হয়তো কোনও খবর আছে গণ-পরিবহন বিষয়ে হতে পারে, গোপন খবর (নাকি, কেন্দ্রের চোরা কিল?)। আমরা জানি না, দেখছি শুধু এই যে লোকাল ট্রেন বা মেট্রো রেল চালু হয়নি এমতাবস্থায় অফিসে কর্মচারীরা আসবেন কী করে? সড়কপথে (জলপথে অতি সামান্য মানুষই আসা-যাওয়া করতে পারেন)? তার জন্য তিনি কখনও নির্দেশ দিচ্ছেন, কখনও পরামর্শ দিচ্ছেন, কখনও অনুরোধ করছেন কিন্তু কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না যে! মুখ্যমন্ত্রী বারবার তাঁর নির্দেশ বা পরামর্শ পাল্টাচ্ছেনও 

একে তো সরকার সচল রাখতে কেন্দ্রের পরামর্শ মেনে সব অফিস খুলতে হয়েছে, অন্যদিকে রয়েছে করোনা আমফানের বিষ-থাবা আসছে নাকি ডেঙ্গি! সরকার কোনদিকে যায়?

বাস পরিষেবা দিয়ে সকল অফিসযাত্রীকে অফিসে আনা সম্ভব নয়, আর সরকারের হাতেও নেই যথেষ্ট বাস ধীরে ধীরে পরিবহন ব্যবস্থা, কলকাতা শহরেও, বেসরকারি হাতে গেছে। তাহলে? মানতেই হয় যে মুখ্যমন্ত্রী ঠকে গেছেন, বেসরকারি পরিবহন মালিকরা লাভের অঙ্ক না দেখে কেবল তাঁর কথায় জনসেবায় নামবেন না আসরে, এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে এবং সেটাই স্বাভাবিক তারা তো পুণ্যলোভে ব্যবসায় নামেননি জরুরি পরিষেবা বেসরকারিকরণ করলে যা হবার তাই হয়েছে

যারা বিরোধী তারা বলছেন, সরকার তো বাস দখল করে নিয়ে চালাতে পারত পারত বৈকি, সরকারের সে ক্ষমতা আছে কিন্তু সে বাস চালাবে কে? বিরোধীরা সে বিষয়ে কিছু বলেনি, সরকারপক্ষের কেউ তেমন প্রশ্ন তোলেনি কেন? সরকারপক্ষের সমস্যা হচ্ছে এই যে, দল প্রশাসন বলতে একটিই মানুষ তার নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তিনি দল চালাচ্ছেন যাদের সাহায্যে তাদের অযোগ্যতা অপদার্থতা যেমন, তেমন তাদের দুর্নীতিতে ঝোঁক মন্ত্রী থেকে কর্মী সবাই যেন ব্লটিং পেপার হয়ে আছে দল চালানোর যোগ্য যথেষ্ট লোক নেই একই কথা খাটে প্রশাসনিক কর্তাদের ক্ষেত্রেও

কয়েকটি বিষয় তাঁকে এখনই বুঝতে হবে, মানতে হবে মানতে হবে যে, এই রাজ্যের লোভী, কর্তাভজা প্রশাসনিক কর্তারা মাথা ঘামিয়ে, নড়েচড়ে কিছু কাজের কাজ করে ফেলবে এমন হবার নয় তেমন যোগ্যতাই তাদের নেই তাই এই মুহূর্তে অত্যন্ত জরুরি প্রয়োজন যোগ্য রাজনৈতিক নেতৃত্বের নিজ দলে যোগ্য রাজনৈতিক নেতৃত্বের অভাব থাকলে তো তাঁকে বাইরে তাকাতেই হবে সে পথটা ভেঙ্গে বা ব্রিজটা পুড়িয়ে এসেছেন মুখ্যমন্ত্রী নিজেই তাহলে কোনও উপায় কী নেই?

নিশ্চয় আছে তিনি চাইলে এখনও নিশ্চয় কাছে অনেকে আসবে সব দুঃখ ক্ষোভ ভুলে, আসবে বামপক্ষ (বামফ্রন্টের বাইরেও কিছু বামমনস্ক দল আছে) কংগ্রেস (রাজ্য বিজেপি আসবে না, না আসাই মঙ্গল, কারণ তারা স্পষ্টতই ভারতীয় তথা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিরুদ্ধে এবং এক অতি অযোগ্য প্রধানমন্ত্রীর ভক্ত) অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে তাদের আসতেই হবে যদিও আত্মহত্যার অধিকার আছে সব বিরোধীদের, তবু বলব, দোকান যখন খুলেছেন তাঁরা নিশ্চয় চিরতরে দোকানের ঝাঁপ ফেলতে চান না আপনারা নিশ্চয় জানেন মানেন (যদি না জানেন বা না মানেন তো আপনাদের জন্য নিশ্চয় শোকবার্তা লিখে ফেলা যায়) যে আপনারা কোনওভাবেই আর ক্ষমতায় ফিরতে পারবেন না এখনই তবে আপনাদের অন্তত এটুকু আশ্বাস পেতেই হবে যে ক্ষমতায় মদমত্ত হয়ে গায়ের জোরে কোনওপক্ষই অন্য পক্ষের জমি কেড়ে নিতে ব্যস্ত হবেন না আর ছাড়তে হবে দখলদারির নোংরা রাজনীতি

সব পক্ষকেই কিছু কিছু অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে, নতুন করে শিখতে হবে কিছু যেমন, সব রাজনৈতিক কর্তাদের বুঝতে হবে যে সাধারণ মানুষ, নিজেরা কখনও দাম্ভিক বা মিথ্যা পথে হাঁটলেও, দম্ভ মিথ্যা পছন্দ করে না এই দ্ম্ভ মিথ্যা যে বামফ্রন্টের পতনের প্রধান কারণ তা অস্বীকার করার অর্থ সত্যকে অস্বীকার করা তৃণমূল কংগ্রেসি মতাদর্শ মেনে গড়ে ওঠা দলকে বুঝতে হবে যে, তোষণের রাজনীতি বা ধনী সম্প্রদায়ের দালালি আর চলবে না এতে কিছু মানুষ কিছুদিনের জন্য খুশি হলেও বহু মানুষ চিরদিন বা বহুদিনের জন্য বিমুখ থাকেন অন্তত এই রাজ্যে কৃষি অসংগঠিত কৃষক বা শ্রমজীবী মানুষকে ঠকানোর কোনও চেষ্টা কোনও শ্রেণির মানুষই মেনে নেবে না এখানে বহু সংগ্রামের ভিতর দিয়ে গড়ে উঠেছে মানবাধিকারের ধারণা, তা কেউ হারাতে চায় না ভুললে চলবে না যে বাঙালিরা স্বভাবত বামপন্থী 

আরও আছে এই রাজ্যের মানুষ ধমকও যেমন পছন্দ করেন না, তেমনই পছন্দ করেন না চমক এই দুটো দোষ থেকে শাসককে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করতেই হবে কে করবে তা? কোনও একজন প্রশান্তকুমারের সাধ্য নেই সে কাজ করার এই সমস্যার সমাধান খুঁজতে ফিরে যেতে হবে বাম শাসনকালে সে আমলের শেষের দিকে মমতার পাশে যাঁরা ছিলেন প্রধানত সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের জমি আন্দোলনে, তাঁদের উপস্থিতিই দলের অন্য নেতা-কর্মীদের অনেক কিছু শেখাত তাঁরা কই? অনেকেই আজ তাঁরা পাশে নেই। কেন? কেউ পরপারে, কেউ অসম্মানিত কিন্তু সন্দেহ নেই যে তারা সকলেই বহুস্বর গণতন্ত্রের পূজারী তাই তাঁরা প্রায় কেউই শত প্রলোভনেও শিবির বদলাতে চাননি বদলে যারা এসেছেন তাদের লোকে সে সম্মান দেয় না, বিশ্বাস করে না শিক্ষক সম্প্রদায় সরকারি কর্মচারীদের যে সমর্থন পরিবর্তনের পালে হাওয়া জুগিয়েছিল, তাদের আজ দূরে ঠেলার চেষ্টায় সদাব্যস্ত পার্থবাবুরা তাঁরা ট্রোজান হর্স কিনা তা দলই বলতে পারবে, কিন্তু শিক্ষক সম্প্রদায় সরকারি কর্মচারীদের সংশয় বেড়েই চলেছে দলের মধ্যেও অসন্তোষ বেড়ে চলেছে             

এসব করলেই কি পরিবহন সমস্যা মিটবে? কমবে মানুষের দুঃখকষ্ট? থামবে সমালোচনা? নিশ্চয় না কিন্তু যা বাড়বে তা হল শাসক দলের বাইরে মমতার কাজগুলির প্রশংসার লোক তিনি যে অনেক ভালো কাজ করেছেন তা তো অস্বীকার করা যায় না তারপরও যেন সরকারটা অচল হয়ে রয়েছে কেন? মমতার সংশয়, দিশাহীনতা, আত্মবিশ্বাসের অভাব কী এর জন্য দায়ী নয়?

সরকার পরিচালনায় যে ঘাটতি চোখে পড়ছে তার কিছুটা মেটাতে পারে এমন লোকজনকে মাঠে নামতে দেখলে দলীয় সমর্থকরাও উজ্জীবিত হবে, তাদের আর নিত্য বলে দিতে হবে নাঅনুপ্রেরণা কথা কেবল কৌশল বা ভঙ্গিতে সরকার চলে না, সরকারের দৃঢ়তা চাই আশা করতে পারি যে, বাড়তি সমর্থন নিয়ে মমতা হারানো আত্মবিশ্বাস ফিরে পাবেন আরও জোর দিয়ে মোদীদের চোখে চোখ রেখে বলতে পারেন,নিজের চরকায় তেল দিন, আচমকা সিদ্ধান্ত নিয়ে আমাদের অপ্রস্তুত করার খেলা থামান।’ বিরুদ্ধ পক্ষকে বলতে পারবেন, আপনাদের পরামর্শ মেনে বাসের দখল নেব, আপনারা বাস চালাতে ড্রাইভার ইত্যাদি দিন বাস মালিকদের তিনি বলতে পারবেন, আপনাদের পরামর্শ মেনে ভাড়া পুনর্নির্ধারণের জন্য কমিটি গড়ে দিয়েছি আপনাদের আর কোনও দাবি আর কোনও আবদার এখন মানব না, মানতে পারব না বাস নামান নয়তো তা কেড়ে নেব রাজনীতির জন্য বন্দীদের জেলখানায় না পুরে এইসব লোভাতুর স্বার্থমগ্ন মালিকদের যদি তিনি ধরে ধরে জেলে পোরেন মানুষ খুশিই হবে

মানুষ চাইছে দেশটা চলুক, চাইছে করোনা আতঙ্ক থেকে মানুষ বাঁচুক আরও আছেআমফান, ডেঙ্গি ইত্যাদি কোনও সমস্যাই তুচ্ছ নয়, সরকারকে সবদিকই দেখতে হবে এখন সরকারের প্রধান যদি দিশা হারান বা সংশয়ে ভোগেন তবে তো দানবেরই লাভ