যখন বিচারের এক চোখে ঠুলি
মালবিকা মিত্র
সূক্ষ্ম মান-অপমান বোধ সকলের থাকে না। আবার কারও কারও থাকে। আমার দিদিমা বিদ্রূপ করে বলতেন, এত সূক্ষ্ম যে 'আছে নাকি নাই হেইয়াই বোঝা যায় না'। কথাটা উঠল, নির্বাচন কমিশন পশ্চিমবাংলার স্বঘোষিত দাপুটে বিজেপি নেতা দিলীপ ঘোষকে কিছুদিন আগে 'সেন্সর' করায় ও তাঁকে 'নজরবন্দী' রাখায়। কমিশনের এই ঘোষণাকে তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে দিলীপ ঘোষ তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দিয়েছিলেন এই বলে যে, 'মেসোমশাইকে' নালিশ করেছে, 'মেসোমশাই' ব্যবস্থা নিয়েছে। এরপরেও দিলীপবাবু নির্বিকার ভাবে তুড়ি মারা ভঙ্গিতে অনর্গল কুকথা বলে চলেছেন।
এদিকে প্রাক-নির্বাচনী পরিস্থিতিতে রামনবমীর সশস্ত্র মিছিল সামাজিক ও রাজনৈতিক উত্তেজনার কারণ হতে পারে- এই আবেদনকে বিবেচনা করে হাইকোর্ট রায় দিয়েছিল, দুশো জনের বেশি রামনবমীর জমায়েত করা যাবে না; আর সশস্ত্র জমায়েত কখনই নয়। কী আশ্চর্যের ব্যাপার, উত্তরবঙ্গে সভা করতে এসে মোদীজী স্বয়ং বলে গেলেন, এবারের রামনবমী হবে অনেক বেশি জাঁকজমক ও ধূমধাম করে, কারণ, এই বছর রাম মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়েছে। দিলীপ ঘোষ সংবাদমাধ্যমকে সরাসরি বললেন, মানুষের আবেগ বলে কথা, পঞ্চাশ হাজার মানুষের জমায়েত হবে; যা হয় আমি দেখে নেব, আমি দিলীপ ঘোষ, সেই মিছিলে থাকব। অক্ষম অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র (নির্বাচন কমিশন) এসব কিছুই শোনেন না, দেখেন না। হাওড়ায়, বীরভূমে সশস্ত্র মিছিলের ছবি দেখলাম টিভি'তে। প্রায় সর্বত্রই সশস্ত্র মিছিল, দুশোর অনেক বেশি জমায়েত, ডিজে বাজিয়ে নৃত্য, প্ররোচনামূলক শ্লোগান ও অন্য ধর্মের প্রার্থনা-গৃহের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় হামলা অথবা কটূক্তি। মুর্শিদাবাদের বেলডাঙ্গা অঞ্চলে সশস্ত্র সংঘর্ষও হল- তা নিয়ে এখন নির্বাচন কমিশনের তরফে সিআইডি তদন্তের নির্দেশও দেওয়া হয়েছে। তো, এই যে ব্যাপক ভাবে আদালত অবমাননা হল, তার বিরুদ্ধে আদালত কি কোনও ব্যবস্থা নিল? ভো-কাট্টা! এত সূক্ষ্ম মান-অপমান বোধ যে বোঝাই গেল না।
২০১৯ সালে ভোটের প্রাক্কালে নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহ অন্তত পাঁচটি ক্ষেত্রে আদর্শ আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছেন বলে মনে করেছিলেন নির্বাচন কমিশনার অশোক লাভোস। এরপর আর এমন দৃঢ়তা চোখে পড়েনি। যদিও কমিশনের বাকি দুই সদস্য তাঁর সঙ্গে সহমত পোষণ করেননি। প্রাতিষ্ঠানিক গোপনীয়তার যুক্তিতে লাভোসের বক্তব্য প্রকাশ করা হয়নি। যে ইন্দিরা গান্ধী এবং তাঁর শাসনকাল নিয়ে এত নিন্দামন্দ, এলাহাবাদ হাইকোর্টের বিচারপতি জগমোহন সিনহা সেই ইন্দিরা গান্ধীর বিরুদ্ধে রায় দিয়েছিলেন। দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। এমনকি তাঁর নির্বাচন খারিজ করে দেওয়া হয়। অভিযোগ ছিল, প্রশাসনকে কাজে লাগানো ও সরকারি অর্থ খরচ এবং দলীয় কাজে সরকারি আধিকারিকদের ব্যবহার। প্রধানমন্ত্রীর দফতরের একজন আধিকারিক ছিলেন যশপাল কাপুর। তিনি ইন্দিরা গান্ধীর নির্বাচনী এজেন্ট হওয়ার আগেই ওই পদে ইস্তফা দিয়েছিলেন। কিন্তু নির্বাচনী জনসভায় ইন্দিরা গান্ধীর ভাষণের আগে তাঁর ইস্তফাপত্র আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়নি। এই কারণে ইন্দিরা গান্ধী অপরাধী ঘোষিত হয়ে ছয় বছরের জন্য নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে নির্বাসিত হন।
এইসব আইন কিছুই লুপ্ত হয়নি। আজও আছে। কিন্তু সংবিধান প্রণেতা আম্বেদকরের বক্তব্যটি খুবই প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, ভালো সংবিধান খারাপ সংবিধান বলে কিছু হয় না, সংবিধানটা কাদের হাতে রয়েছে সেটাই আসল কথা। অর্থাৎ, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কলঙ্কিত শাসনেও বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন যে দৃঢ়তায় শিরদাঁড়া সোজা রাখার ক্ষমতা দেখিয়েছিল, আজ সেই ক্ষমতাটুকু বুঝি উধাও। হবে নাই বা কেন, বিজেপি'র বড় থেকে চুনোপুটি নেতা সকলেই বুঝে গেছেন, বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, সিবিআই, ইডি এসব আসলে প্রহসন। বিজেপি নেতাদের কেশাগ্র স্পর্শ করার ক্ষমতা এদের নেই। একজন বিজেপির নেতা যদি রাজভবনে দাঁড়িয়ে সংবাদমাধ্যমের সামনে বলতে পারে, 'আমাদের রাজ্যপাল, আমাদের কেন্দ্রীয় বাহিনী, আমাদের কেন্দ্রীয় এজেন্সি, দেখি কীভাবে এরা সরকার চালায়!', এই বলার মধ্য দিয়ে কর্মীদের মনে রাষ্ট্রের এই স্তম্ভগুলিকে উপেক্ষা ও অবজ্ঞা করতে শেখানো হয়। রঞ্জন গগৈ যে ভাবে হাতে গরম পুরস্কার লাভ করে তৃপ্ত থাকেন, একজন বিজেপি কর্মীর কাছে তখন সমগ্র বিচার ব্যবস্থার ভাবমূর্তি ভেঙে পড়ে।
চেয়ারে থাকাকালীন হাইকোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় যে সমস্ত কথাবার্তা বলেছেন, এমনকি তাঁর একটি রায়কে সুপ্রিম কোর্ট স্থগিত রাখার পর প্রকাশ্যে ব্যঙ্গ করে বলেন 'সুপ্রিম কোর্ট যুগ যুগ জিও'। এসব কথার পর সেই বিচারপতি ঠিক লোকসভা নির্বাচনের মুখে নিজ পদে ইস্তফা দিয়ে বিজেপির প্রার্থী হলেন। এবার বলুন দেখি, তাঁর কোন কোন রায়গুলি 'নিরপেক্ষ' বা ন্যায়ের পক্ষে ছিল আর কোনগুলি তাঁর দলের রাজনৈতিক সুবিধা করে দেওয়ার জন্য? তদুপরি, তমলুক সহ সারা পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি কর্মীদের কাছে হাইকোর্টের বিচারপতিদের ভাবমূর্তিটা কী দাঁড়ালো? দুশো টাকা নিয়ে মিছিলে যাওয়া বিজেপি কর্মী, অথবা দু' হাজার টাকা নিয়ে ভোট দিতে যাওয়া বিজেপি কর্মীর চোখে অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় বা রঞ্জন গগৈ তাঁদের সমকক্ষ হয়ে পড়ে। বাড়তি মর্যাদা লুপ্ত হয়।
শুধু তো এখানেই শেষ নয়, অশোক লোভাস শিরদাঁড়া সোজা রাখার জন্য কী কী মূল্য চুকালেন, সেটাও মনে করে দেখুন। স্ত্রী নাভেল, পুত্র আবির, ভগিনী শকুন্তলা প্রত্যেকের ওপর চলেছে এজেন্সির পীড়ন ও হয়রানি। এ প্রসঙ্গে অশোক লোভাসের মন্তব্যটি প্রণিধানযোগ্য-- এমন প্রত্যাশা ঠিক নয় যে, যাদের বিরোধিতা করা হচ্ছে, তারা নম্রভাবে বিরুদ্ধতার উত্থান মেনে নেবে। তারাও প্রত্যাঘাত করবে। সততার মূল্য দিয়ে পেতে হয় একাকিত্বের যন্ত্রণা বোধ ও প্রকাশ্য বিচ্ছিন্নতা। বন্ধু বা শত্রু- উভয়ের কাছে সততা ত্যাজ্য।
সততার পথে প্রাপ্ত ২০১৬ সালের রাজ্য শিক্ষা দফতরের প্যানেলের প্রায় ২০,০০০ শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মীদের চাকরি (দোষী ও নির্দোষ আলাদা না করতে পারার অপারগতায়) যখন আদালতের এক ভয়ঙ্কর রায়ে বাতিল হয়ে গেল, তখন এই বাচনটিই তো আরেকবার সাব্যস্ত হয় যে, সততা সততই ত্যাজ্য। কারণ, ন্যায় দণ্ড হাতে আদালতই যখন দোষী আর নির্দোষকে আলাদা করতে পারে না, তখন নির্দোষদের নির্বিচার দণ্ড দিতে তাদের হাত বা কলম কাঁপবেই বা কেন! অথচ, কত আদিখ্যেতা করে বলা হয়, দশজন দোষী যদি পার পেয়েও যায়, তবুও যেন একজন নির্দোষ সাজা না পায়।
কিন্তু বিপদ আরও গভীর ও নির্মম। যখন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বিচারব্যবস্থা সাঁট করে চলে, তখন তাকে আর বিচারব্যবস্থা বলা যায় না! এক সামগ্রিক ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থায় তা পর্যবসিত হয়। বিরোধী দলনেতা গত সপ্তাহের শুক্রবার বললেন, আগামী সপ্তাহে একটি বোমা বিস্ফোরণের জন্য প্রস্তুত থাকুন যা শাসক দলকে তছনছ করে দেবে; এ সপ্তাহের ঠিক সোমবারই আদালতের রায়ে ২৫,৭৫৩ জনের চাকরি বেমালুম লোপাট হয়ে গেল। আবার বিজেপি'র এক এমএলএ দু' দিন আগে জোর ঘোষণা দিয়েছেন যে খুব শিগগির ৫৯,০০০ প্রাইমারি শিক্ষকের চাকরি যাবে। সেই ঘোষণাকে সমর্থন করে বিরোধী দলনেতাও তালি মেরে বলেছেন, আগামী সপ্তাহেই তা হবে। যুক্তিগ্রাহ্য মনে প্রশ্ন উঠছে, রায়গুলি আসলে কে লিখছে?
এ কি এক যুদ্ধ? বাংলাকে ভাতে মারার, কর্মহীন করার এক নৃশংস অভিসন্ধিমূলক যুদ্ধ? বাংলাকে ভাতে ও কাজে মারতে পারলে তবেই দেশ জুড়ে ফ্যাসিবাদ সম্ভব হতে পারে! এ কথা কিছুটা ঘুরিয়ে অমিত শাহ ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পর এইভাবে বলেছিলেন যে, তাঁদের 'ভারত জয়' এখনও সম্পূর্ণ হয়নি এবং তা সেদিনই হবে যেদিন তাঁরা বাংলাকে জয় করতে পারবেন। মনে রাখবেন, যাঁদের চাকরি গেল, তাঁদের মধ্যে অনেকেই কিন্তু ছিলেন 'অন্ধভক্ত', তবুও তাঁরা রেহাই পাননি!