Tuesday 2 April 2024

বঙ্গে লড়াই ত্রিমুখি?

জোট না হওয়াই যখন 'ইন্ডিয়া'র পক্ষে লাভ

কল্যাণ সেনগুপ্ত



ত্রিমুখি লড়াই হলে সাধারণত যে কেন্দ্রে যার সাংগঠনিক ক্ষমতা বেশি, তার জয়ের সম্ভাবনাই অধিক। কিন্তু ব্যতিক্রমের সম্ভাবনাও আছে সীমিত ক্ষেত্রে, তবে নিশ্চিত গোপনীয়তা রক্ষা করে। এ রাজ্যে সে সম্ভাবনা আছে শুধুই সিপিএম, কংগ্রেস ও বিজেপির মধ্যে, যেখানে তৃণমূলের সাংগঠনিক ক্ষমতা প্রশ্নাতীতভাবে অনেক বেশি। 

আবার উল্টো সম্ভাবনাও আছে। যথা, যেখানে তৃণমূল অপেক্ষাকৃত দুর্বল এবং তাদের বিরোধী দু' পক্ষের মধ্যে গোপন বোঝাপড়া করে জয়ের সম্ভাবনাময় আসনগুলো যদি নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেওয়া যায়, ফলে তিন দলেরই প্রধান শত্রু তৃণমূল সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু এমন সম্ভাবনায় সবচেয়ে বড় বাধা হল জাতীয় রাজনীতির বাধ্যবাধকতা এবং ভোট শতাংশে সিপিএম ও কংগ্রেসের সাংগঠনিক অস্তিত্ব প্রমাণের দায়। কারণ, ২০১৯'র ভোটে বিজেপির হঠাৎই ১৮টি আসন প্রাপ্তি ও সিপিএম-কংগ্রেসের ভোট শতাংশে অভাবনীয় ধস নামা দু' দলেরই নেতৃত্বের মুখ পুড়িয়েছে, বিশেষভাবে সিপিএমের। ফলে, এবার তাদের দিক থেকে প্রাধান্য পাওয়া উচিত সাংগঠনিক জমি পুনরুদ্ধারের বিষয়টি। তার সঙ্গে আর একটি ব্যাপারও মাথায় রাখা উচিত- বহরমপুর ও মুর্শিদাবাদ আসন দুটি জয়লাভে এবার দু' দলেরই মুখ্য নেতা অধীর চৌধুরী ও মহঃ সেলিমের পক্ষে পরিস্থিতি কিন্তু বেশ খানিকটা সম্ভাবনাময়।

জাতীয় ক্ষেত্রে জোট 'ইন্ডিয়া' প্রথম দিকে যথেষ্ট উৎসাহ-উদ্দীপনার সৃষ্টি করলেও পরবর্তীকালে তা খানিকটা হতাশায় পর্যবসিত হয় কংগ্রেস নেতৃত্বের খামখেয়ালিপনা ও দলীয় স্বার্থবাদী চিন্তায়। অপরদিকে, মোদী তাঁর ভাবনার রূপায়ণে রামমন্দির সহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ড চালাতে শুরু করেন এবং এমন এক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে সমর্থ হন যে, দেশের আপামর জনসাধারণের মধ্যে খানিকটা বদ্ধমূল ধারণা তৈরি হয়, মোদীর জয় সুনিশ্চিত ও তিনিই তৃতীয়বারের জন্য ক্ষমতায় ফিরতে চলেছেন। এমতাবস্থায়, জোট ইন্ডিয়ার অন্যতম পুরোধা নীতিশ কুমার নিজের প্রধানমন্ত্রী হবার সাধ পূরণ হবে না বুঝতে পেরে মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সি'টি রক্ষায় অধিক মনোযোগী হয়ে সম্ভবত শেষবারের মতো পাল্টি খেয়ে মোদীর শরণাগত হলেন এবং আশ্বাস দিলেন, ভবিষ্যতে আর কোনও এদিক-ওদিক করবেন না। শুনে মুচকি হাসি চাপতে পারলেন না মোদীও। এরপর জোট ইন্ডিয়াকে দুর্বল করতে ও নিজের শিবিরকে শক্তিশালী করতে চেষ্টার কোনও ত্রুটি রাখলেন না মোদী-শাহ জুটি। কিন্তু কংগ্রেস নেতৃত্ব নির্বিকার, জোটের বৈঠক ডাকার কোনওরকম প্রয়োজনীয়তাই বোধ করল না তারা। ব্যস্ত রইল 'ন্যায় যাত্রা' নিয়ে। এই যাত্রার সময়জ্ঞান নিয়ে নানা মুখরোচক গল্প বাজারে চালু হল। যেমন, এক ছাত্রের যেই পরীক্ষার দিন ঘোষিত হয়েছে অমনি সে দ্রুত এক জিমে গিয়ে ভর্তি হল, কারণ সে শুনেছিল আগে স্বাস্থ্যরক্ষা জরুরি। জোটের বৈঠক ডাকায় কংগ্রেস নেতৃত্বের অনীহার বিষয়টি সত্যিই চূড়ান্ত রহস্যজনক। যৌথ উদ্যোগে পাটনা ও দিল্লির সভায় মানুষের মধ্যে বিপুল সাড়া কি জমিনি বাস্তবতার ইঙ্গিত করছে না? যৌথ প্রতিবাদ ও প্রচার শুরু করতে পারলে মোদীর পরাজয় যে সুনিশ্চিত, তা অনেকেরই দৃঢ় বিশ্বাস।

এ রাজ্যের চিত্রটি অতএব বেশ জটিল। জাতীয় ক্ষেত্রে জোট ইন্ডিয়ার শরিক কংগ্রেস, তৃণমূল ও বাম তথা সিপিএম সবাই। এমনকি জোটের নামকরণেও মমতার প্রস্তাবই গৃহীত হয়। ফলে, মোদী শিবিরে প্রচণ্ড অস্বস্তি ও বিরোধ দেখা দেয়। এমনকি সরকারি অনুষ্ঠানেও প্রথম দিকে দিশেহারা হয়ে শাসকের তরফে ইন্ডিয়ার বদলে ভারত ব্যবহারের ছেলেমানুষী লক্ষ করা যায়। পরে ধীরে ধীরে মোদীর সম্বিত ফেরে ও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। এখন বিজেপি নেতৃত্ব ব্যঙ্গ করে বলে 'ইন্ডি জোট'। অর্থাৎ, জোটের নামকরণে যে প্রবল অস্বস্তি মোদী শিবিরে পরিলক্ষিত হয়, তা নিঃসন্দেহে নামকরণে সাফল্যেরই পরিচায়ক।

এ রাজ্যে জোট গঠনের আলোচনার শুরুতেই সিপিএম জানিয়ে দেয়, এ রাজ্যে তাদের পক্ষে তৃণমূলের সঙ্গে জোট গঠন সম্ভব নয়, বরং তারা আগ্রহী কংগ্রেস ও আইএসএফের সঙ্গে জোট গড়ায় এবং তারা তৃণমূল, বিজেপি দু' দলের অন্যায় শাসনের বিরুদ্ধেই লড়াই করতে চায়। এরপর রাজ্য কংগ্রেস নেতৃত্বও সাফ জানিয়ে দেয় যে, তৃণমূলের সঙ্গে জোট তারাও চায় না। কিন্তু কংগ্রেসের জাতীয় নেতৃত্ব ক্রমাগত জানাতে থাকে, জোট আলোচনা চলছে ও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি এখনও। এমনই চরম বিভ্রান্তির মধ্যে ফয়সালার জন্য তৃণমূল সময় বেঁধে দেয় ৩১ জানুয়ারি। সময় পেরিয়ে যায়, কোনওরকম সদর্থক পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয় কংগ্রেস। অবশেষে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে তৃণমূল সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে যে তারা ৪২টি আসনেই প্রার্থী দেবে অর্থাৎ জোটের সম্ভাবনায় ইতি ঘটে। তৃণমূলের এই সিদ্ধান্তের ফলে সিপিএম দলে খুশির হাওয়া বয়ে যায়। নিশ্চিন্ত হন অধীরও। 

এ রাজ্যে জোট হওয়া বা না হওয়ায় দু'রকমেরই সুবিধা বা অসুবিধে আছে।  প্রথমত, এ রাজ্যে জোট হলে কিছুটা রাজনৈতিক সুবিধা নিশ্চয়ই হত কিন্তু অঙ্কের হিসেবে খুব বেশি লাভ হওয়ার সম্ভাবনা ছিল না। এখানে জোট বলতে ধরে নিচ্ছি শুধুই তৃণমূল ও কংগ্রেসের জোট, সিপিএম ব্যতিরেকেই। কারণ, সিপিএম অনেক আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিল যে, কোনও অবস্থাতেই তৃণমূলের সঙ্গে কোনও জোট নয়। যেমনটা কেরলে কংগ্রেসের সঙ্গে কোনও জোট নয়। এ রাজ্যে যেমন সিপিএম তৃণমূল'কে বিজেপির দোসর বলে থাকে, ঠিক তেমনই কেরলে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে বলে থাকে। সম্প্রতি কেরলের মুখ্যমন্ত্রী বিজয়নের মুখ থেকেও কংগ্রেসের বিরুদ্ধে অভিযোগ শোনা গেল বিজেপির সঙ্গে গোপন আঁতাতের। ভোটের লড়াইয়ে এসব অভিযোগ গুরুত্বহীন। তবে অঙ্কের হিসেব মাথায় রাখতেই হয়। এ রাজ্যে জোট হলেও কংগ্রেসের কর্মী-সমর্থকদের ভোট আদৌ তৃণমূলের পক্ষে পড়ত কিনা, যথেষ্ট সন্দেহ আছে এবং অনুরূপ ভাবনা পারস্পরিক তিক্ততায় সর্বত্রই থাকার সম্ভাবনা প্রবল। ফলে, জোটের যথেষ্ট সদর্থক পরিবেশ এ রাজ্যে ছিল না।

এ রাজ্যের ভোট এখন মোটামুটি ভাবে দুটি শিবিরে বিভক্ত- তৃণমূল বনাম বিজেপি। তবে তৃতীয় পক্ষ আছে, যদিও বেশ কিছুটা পিছিয়ে, যেমন, সিপিএম ও কংগ্রেস। বাস্তব পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে বলা যায়, এ রাজ্যে ভোটের অঙ্কে জোট হওয়ার চেয়ে না হওয়াটাই হয়তো তৃণমূল তথা জোট ইন্ডিয়া'র পক্ষে অধিক লাভজনক হতে চলেছে। ২০১৯'র ভোটে- সিপিএম ও কংগ্রেস- এই দু' দলেরই ভোট শতাংশ প্রচুর ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছিল। এখন দেখার, সেই হারানো ভোট কতখানি ফিরে আসে। বাস্তবতা হল, এই দু' দলের ভোট যদি গড়ে ১২-১৪ শতাংশ বাড়ে তবে বিজেপির আসন প্রাপ্তিতে যথেষ্ট ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কার আসন সংখ্যা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, তা জানতে আমাদের অপেক্ষা করতেই হবে ৪ঠা জুন পর্যন্ত।


3 comments:

  1. ISF নির্বাচিত কিছু packets এ উল্লেখযোগ্য থাবা বসাতে পারে। Solidarity of minority community votes is going to be challenged,
    atleast in selected areas. এই বৈশিষ্ট্য তো আগর কোন নির্বাচনে ছিল না। তার প্রভাব তো সহজে ধরা যাবে না আগে থেকে।

    ReplyDelete
  2. এই যে ইন্ডিয়া জোটটা ঠিকমত দানা বাঁধলো না, এটা মোদি শাহর পক্ষে আশাব্যঞ্জক নয়। বিজেপি জানতো জোট হলেও তৃণমূলকে সিপিআইএম কর্মী সমর্থকরা হৈ হৈ করে সমর্থন করবে অথবা জোট হলেই তৃণমূল কর্মীরা সিপিএম আইএসএফ কংগ্রেস সবাইকে নিজের আসন বন্টন করে দেবে এমনটা ঘটবে না। সেক্ষেত্রে সর্বত্র দুটি তিনটি গোঁজ প্রার্থী দাঁড়িয়ে যাবে। এটা বিজেপির পক্ষে সুবিধা হত।

    কিন্তু আঞ্চলিক দল হিসেবে প্রধান শক্তিশালী দলগুলি নিজে এককভাবে লড়াই করার অর্থ, বিজেপির সমূহ বিপদ। কারণ প্রথমত আঞ্চলিক শক্তি জয়ের জন্য নিজের সর্বশক্তি নিয়োগ করবে। দ্বিতীয়ত সিপিএম কংগ্রেস এরা আন্তরিকভাবে লড়াই করলে, নিজেদের যতটুকু ভোট বৃদ্ধি করবে, সেটা সম্পূর্ণই বিজেপির ভোটে ভাগ বসাবে। অতএব জোট না হওয়া আর এক নিরাপত্তাহীনতার কারণ। আর সেই অসুখ থেকেই ধরপাকড় ইডি সিবিআই। না জানি আরো কি কি ভুল পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। আর মনে রাখা দরকার, মানুষ যদি মনে মনে একটা সিদ্ধান্ত ইতিমধ্যেই নিয়ে ফেলে থাকে, তাহলে কিন্তু কোন নিরাপত্তাই নিরাপদ নয়। এক দশক ব্যাপি জমে থাকা অসন্তোষ, যা প্রকাশ হতে পারে নি, ২০১৯ সালেও ওটা প্রকৃত জনমত ছিল না। সত্য পাল মালিকের ঝাঁপি খোলার পর এটা স্পষ্ট যে পুলওয়ামা ও পরবর্তী নির্বাচন ছিল ম্যানুফ্যাকচারড পাবলিক ওপিনিয়ন। সেই মানুষ দশ বছর ধরে শাসকের অ্যাসেসমেন্টের বাইরে। অনিবার্য ভাবে তারা একটি পরিবর্তন ঘটিয়ে দিতে পারে। সেটা বিরোধী নেতাদের নেতৃত্বের অপেক্ষায় থাকবে না। নিজেরাই যা করার করবে। এটাই ভয়ংকর বিপদের আশঙ্কা। ইতিহাসে অনেকবারই নেতৃত্বের অপ্রস্তুত অবস্থা সত্ত্বেও মানুষ প্রস্তুত থেকেছে। এমনকি পরিবর্তন ঘটিয়েছে, এমন নজির আছে।

    ReplyDelete
  3. খুব সুন্দর ও grass root পর্যালোচনা।

    ReplyDelete