Tuesday 30 March 2021

শীর্ষ আদালতের সিঙ্গুর রায়

কর্মসংস্থানের মিথ্যাচার

প্রবুদ্ধ বাগচী

 


ফেসবুক জুড়ে রব উঠেছে, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে কারখানা করতে না দিয়ে এবং প্রকারান্তরে 'ষড়যন্ত্র' করে পশ্চিমবঙ্গকে নাকি শিল্পায়নে পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং এক দশকে একটা প্রজন্মের ভবিষ্যৎ নাকি ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। কিন্তু এটুকু অন্তত সকলেই জানেন, সিঙ্গুর নিয়ে দীর্ঘ আইনি লড়াই হয়েছিল যা সুপ্রিম কোর্ট অবধি গড়িয়েছিল। সর্বোচ্চ আদালতের সেই রায়ে কী কী বলা হয়েছিল তার দু-একটা নমুনা দেখা যেতে পারে:

১) টাটা মোটর প্রথমে ৬০০ একর জমি নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল, পরে তা বেড়ে হয় ১০০০ একর- এতখানি বাড়তি জমি কেন তাদের দরকার হল তার সপক্ষে কোনও উপযুক্ত কারণ তারা দেখাতে পারেনি। রাজ্য সরকার ও তাদের আধিকারিকদের কাজকর্ম দেখে মনে হয় তারা বিষয়টা আদৌ মনোযোগ দিয়ে খুঁটিয়ে দেখেননি এবং টাটা মোটরস'এর পক্ষে জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে আদৌ কতটা জমি লাগতে পারে রাজ্য মন্ত্রীসভাও সে বিষয়ে কোনও হিসেব নিকেশ করেনি।

('TML had submitted a proposal of requirement of 600 acres of land, which was subsequently increased to 1000 acres without any justification for seeking such vast extent of lands in favour of TML. This action of the State Government and its officers shows a complete non application of mind on the part of the cabinet while assessing how much land is needed for the project, before acquiring lands at the behest of TML.')

২) বিভিন্ন তথ্য প্রমাণ, নথি ও প্রকৃত অধিগ্রহণের ফাইল পরীক্ষা করে দেখা যাচ্ছে যে, জমি অধিগ্রহণ আইনের ৪ নম্বর ধারা অনুসারে অধিগ্রহণের নোটিশ দেওয়ার আগেই  জমির মালিকদের পক্ষে প্রচুর আপত্তি জমা পড়েছিল। আইনের ৫-এ/২ ধারা মাফিক সেগুলি ঠিক ঠিক ভাবে বিচার করে দেখা হয়নি। আপত্তি যারা জানিয়েছিলেন, তাঁদের ব্যক্তিগত ভাবে নোটিস দেওয়া হয়েছিল কিন্তু যে জমি অধিগ্রহণ করা হবে সেই জমির মালিক বা যারা সেগুলি চাষ করেন তাঁদের নোটিশ দিতে পারা যায়নি। 

('From a perusal of the materials on record and original acquisition files, it is evident that a large number of objections were filed by the land owners before the notification was issued under Section 4 of the L.A. Act. The same were not considered properly under Section 5-A (2) of the L.A. Act. Notices were issued to the objectors individually but the same could not be served upon the owners/cultivators of the proposed lands to be acquired.' (p/97)) 

৩) জমি অধিগ্রহণ আইনের ৩(এফ) ধারায় যে জনস্বার্থে জমি অধিগ্রহণের কথা বলা আছে সেখানে খুব স্পষ্টভাবেই জানানো হয়েছে কোনও কোম্পানির জন্য জমি অধিগ্রহণ জনস্বার্থের মধ্যে পড়ে না।  

('Section 3(f) of the L.A. Act, which defines what public purpose is for the purpose of acquisition of land, clearly indicates that the acquisition of land for companies is not covered within the public purpose.')

৪) সাধারণ মানুষের কল্যাণ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা স্বাধীনতার পর থেকে বিপুলভাবে বেড়ে যাওয়ায় জনস্বার্থে জমি অধিগ্রহণ, শিল্প বা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান করা ইত্যাদি সংখ্যায় অনেক বেড়ে গেছে। এগুলো অনিবার্য হলেও, জনস্বার্থের সঙ্গে সঙ্গে যাদের জমি নেওয়া হবে সেইসব ব্যক্তিগত মানুষের অধিকারের বিষয়টারও সামঞ্জস্য রাখা দরকার, কারণ তাঁরা তাঁদের জীবিকা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এবং ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে জমি অধিগ্রহণের সঙ্গে জনস্বার্থে জমি অধিগ্রহণের বিষয়টা একই বিচারে দেখলে চলবে না।

('With the enormous expansion of the State's role in promoting public welfare and economic development since independence, acquisition of land for public purposes, industrialisation, building of institutions, etc., has become far more numerous than ever before. While this is inevitable, promotion of public purpose has to be balanced with the rights of the individual whose land is acquired, thereby often depriving him of his means of livelihood. Again, acquisition of land for private enterprises ought not to be placed on the same footing as acquisition for the State.' (p/29)) 

৫) সর্বোপরি, সুপ্রিম কোর্ট প্রকল্প বিষয়ে টাটা মোটরস'এর জমা দেওয়া হলফনামা থেকে পর্যবেক্ষণ করেছিল: 

এই প্রকল্পে সরাসরি চাকরি হতে পারে ১৮০০ জনের এবং বাড়তি ৪৭০০ জন কাজ পেতে পারেন বিভিন্ন সরবরাহকারী ও পরিষেবা প্রদানের ক্ষেত্রে ।

('The employment potential of this project was assessed at 1,800 employees in direct employment by TML and a further 4,700 employees through vendors and service providers.' (p/7))

এই ৬৫০০ জনের চাকরির জন্য আইনকে উপেক্ষা করে প্রায় ১৭০০০ জনকে উচ্ছেদ করার ব্যবস্থা হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্ট বলেছিল, এটাকে শিল্পায়নের স্বার্থ বলে কোনওভাবেই বিবেচনা করা যায় না। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ঠিক কত লোকের কর্মসংস্থান হতে পারে সেই বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য কখনই দিতে পারেননি। শিল্পমন্ত্রী বারবার বলেছিলেন, অধিগৃহীত জমি কোনওভাবেই আর ফিরিয়ে দেওয়ার আইনি সংস্থান নেই। ফেসবুকে অনেকেই নানা পুরনো খবর/ ভিডিও পোস্ট করছেন। খুঁজলে এইসব কথাও তারা পেতে পারেন। 

যাই হোক, কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে!

সুপ্রিম কোর্টের রায় পাওয়া যাবে এই লিঙ্কে: 

http://www.indiaenvironmentportal.org.in/content/434997/judgement-of-the-supreme-court-of-india-regarding-acquisition-of-land-by-tata-motors-ltd-singur-district-hooghly-west-bengal-31082016/


Saturday 27 March 2021

নতুন শ্রম কোড

শ্রমিকের স্বার্থ ও সুরক্ষার নামগন্ধ নেই

শোভনলাল চক্রবর্তী


যে কোনও সরকারি পরিকল্পনার সঙ্গে বহু মানুষের স্বার্থ পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ ভাবে যুক্ত থাকে। ওই প্রকল্পের কেন্দ্রে যদি উপযুক্ত প্রতিনিধি না থাকে তবে পরবর্তী কালে সিদ্ধান্তের ভালো মন্দ বিচারে বিভ্রান্তি তৈরি হওয়া স্বাভাবিক। ভারতে গত পাঁচ বছরে এই সমস্যা প্রায় পদে পদে মানুষ টের পেয়েছেন। বিমুদ্রাকরণ হয়েছিল, কিন্তু যে বিরাট পরিমাণ অসংগঠিত ক্ষেত্রের মানুষ এর ফলে প্রভাবিত হবেন তাঁদের অন্ধকারে রেখে। জিএসটি চালু করার আগে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের আশঙ্কা কেউ ধর্তব্যের মধ্যে আনেননি। লকডাউন হলে পরিযায়ী শ্রমিকদের আর্থিক অবস্থার কী হবে তা শাসন ব্যবস্থার এত বিকেন্দ্রীকরণ সত্ত্বেও কেউ জানতে চাননি। কৃষি বিলে অসংখ্য কৃষকের চাহিদার প্রতিফলন হয়নি, কারণ কেউ তাঁদের সঙ্গে কথা বলেননি। 

একই ভাবে শ্রম আইন সংশোধনের ক্ষেত্রে শ্রমিক সংগঠনের প্রস্তাব চলে গেছে বাতিল কাগজের ঝুড়িতে, কেউ তা নিয়ে মাথা ঘামাননি। সংসদীয় গণতন্ত্রে এত সব গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গও যে যথোচিত আলোচনার জায়গা পাচ্ছে না, যাদের নিয়ে আইন তারাই সেখানে ব্রাত্য হয়ে পড়ছেন, নোয়াম চমস্কি যাকে বলেছেন 'ভয়েস অফ স্টেক হোল্ডার'- সেটা না থাকা কিন্তু এক গভীর সংকটের অশনি সংকেত। 

জানুয়ারি ২০২১-এ গৃহীত শ্রম আইনের চারটি কোডের মধ্যে নাকি ৩৯টি পূর্বতন আইন মিশে গিয়েছে। এই চারটি কোড হল: (১) বেতন কাঠামো বিষয়ক (২) শিল্প সম্পর্ক বিষয়ক (৩) সামাজিক সুরক্ষা বিষয়ক এবং (৪) কর্মক্ষেত্রে সুরক্ষা ও কাজের পরিবেশ বিষয়ক। আগামী এপ্রিলে এই নতুন  শ্রম কোড চালু করার পরিকল্পনা করছে কেন্দ্রীয় সরকার। অনেকে ভেবেছিলেন, আর্থিক সংকটের কথা মাথায় রেখে নতুন কোডে শ্রমিকদের সুবিধা দেওয়া হবে। বাস্তবে হয়েছে ঠিক বিপরীত। বিশেষ করে এমন একটা সময়ে যখন কর্মসংস্থান তলানিতে। এর উপরে স্ট্যান্ডিং কমিটির সুপারিশ মেনে শিল্প সম্পর্ক নামক কোডে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে কোম্পানির তরফে স্থায়ী ভিত্তিতে কী নির্দিষ্ট নীতিগত সংস্থান রয়েছে, সেই বিষয়টিও। নতুন ব্যবস্থায় অন্তত ৩০০ কর্মী না থাকলে সরকারের কাছে নীতি ঘোষণার আর কোনও প্রয়োজন নেই। এই সংস্থাগুলোতে প্রায় যে কোনও ব্যবস্থা চলতে পারে। অথচ, দেশে এই ধরনের প্রতিষ্ঠানই যে সব থেকে বেশি তা তো অজানা নয়। আর আছে ইন্সপেক্টর ব্যবস্থা যারা গিয়ে দেখবে যে সংস্থা নিয়ম মানছে কিনা। যেমন, বেতনের ক্ষেত্রে একটা সর্বনিম্ন হার ঠিক করে দেবে কেন্দ্র এবং তার সাহায্যে কোম্পানি নির্ধারণ করবে ন্যূনতম বেতন, কিন্তু তা বাস্তবায়িত হওয়া প্রশ্নাতীত নয়। এই পদ্ধতি যে আবার ইন্সপেক্টর রাজ তৈরি করবে তা এক প্রকার নিশ্চিত, আর তার সঙ্গে বাড়বে দুর্নীতি আর ঘুষের প্রসার। এই সরকারই নাকি আবার দুর্নীতি দমন করবে! 

অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের জন্যে কর্পোরেট সংস্থা সামাজিক দায়িত্ব তহবিল থেকে ১-২ শতাংশ হারে অনুদান দেবে, কিন্তু সামাজিক সুরক্ষা বিষয়ক খরচ তো প্রদেয় কর নয়, এতে যা বিচ্যুতি লক্ষ করা যায় তা মুনাফা করতে চাওয়া কোম্পানির পক্ষে স্বাভাবিক আচরণ। দাতাকর্ণের তো আর তেল পরিশোধনের ব্যবসা ছিল না! যে সংস্থাগুলো অন্তত ৫০ জন চুক্তিভিত্তিক কর্মী রাখে তারা কর্মীর ১৫ দিনের বেতন দান করবে কর্মীর দক্ষতা বাড়ানোর লক্ষে, তবে যদি ছাঁটাই করে দেওয়া হয় তবেই। এই উদ্দেশ্যে অন্য সাহায্য নাকি দেওয়া হবে, যার না আছে নিশ্চয়তা, না নির্দিষ্ট কোনও হার। সরকারের মন্ত্রকগুলোর মধ্যে যে সমন্বয়ের কত অভাব তা বোঝা যায় যখন বাজেট বক্তৃতার কোথাও শ্রম আইন বিষয়ক কোনও আলোচনা উপস্থাপিত হয় না এবং বেসরকারি ব্যবসার অনুদান নির্ভর না হয়ে সামান্য ট্যাক্সের সাহায্যে এই সব লক্ষপুরণের কোনও সদিচ্ছা দেখা যায় না। 

গত দু' দশকে ভারতের উৎপাদন সংস্থাগুলোতে মিলিত ভাবে মোট কর্মীদের বেতন কমেছে ৩০ শতাংশ আর মুনাফা বেড়েছে প্রায় সমপরিমাণ। স্পষ্টতই বৃদ্ধির সুফল সরকারি মধ্যস্থতায় হাত বদলেছে। এসবকে উন্নত দেশের পরিচয় ভেবে যারা উঁচু গলায় সওয়াল করছেন তাঁদের জেগে ঘুমোনোর দিন কিন্তু দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। ভাবতে অবাক লাগে, পরাধীন দেশের প্রথম শিল্প ধর্মঘট হয়েছিল হাওড়া স্টেশনে ১৮৬২ সালে আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে, আর তার ১৫ বছর পর নাগপুর এমপ্রেস মিলে বেতন বৃদ্ধির দাবিতে। আজ দেড়শো বছর পর, শিল্প ধর্মঘট করতে গেলে স্বাধীন ভারতের সমস্ত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের ৬০ দিনের আগাম নোটিস দিতে হবে সংস্থাকে, যা ধর্মঘট করতে না পারার সামিল। যেহেতু বেতন কাঠামো বাদ দিয়ে বাকি তিনটি বিষয় পার্লামেন্টের স্ট্যান্ডিং কমিটিতে পাঠানো হয়েছিল মতামতের জন্য, ফলে তাদের সিদ্ধান্ত এখানে জানানো উচিত। স্ট্যান্ডিং কমিটি জানায় যে, জল, বিদুৎ, স্বাস্থ্য, টেলিফোন ইত্যাদি অপরিহার্য পরিষেবা ছাড়া ধর্মঘট করার অধিকার অন্য সব ক্ষেত্রে থাকা উচিত। তা যে সরকার কানে তোলেনি তা বলাই বাহুল্য। দক্ষিণপন্থী দেশগুলোতেও এই ধরনের প্রস্তাব সরকারি খাতায় থাকে না কারণ মনে মনে চাইলেও কোনও সরকার শ্রমিকের অধিকার সম্পূর্ণ খর্ব করার পক্ষপাতী নয়। 

কর্মীদের অধিকার নিয়ে ভারতের অবস্থান এই মুহূর্তে কোন মেরুতে তাতে কারওর সন্দেহ নেই। প্রচলিত শ্রম আইন কেন্দ্র রাজ্য যৌথ তালিকায় থাকার দরুণ এতদিন রাজ্যগুলো নিজেদের স্বার্থ ও আর্থিক পরিকল্পনা অনুযায়ী কেন্দ্রীয় আইন সম্পূর্ণ রূপে মেনে বা সংশোধন করে নিত। গৃহীত আইন শ্রমিকের স্বার্থ রক্ষা করছে নাকি পুঁজি মালিকের, তার ভিত্তিতে রাজ্যগুলিকে পুঁজি দরদি অথবা শ্রমিক দরদি আখ্যা দেওয়া হত। পশ্চিমবঙ্গ আর কেরালাকে  শ্রমিক দরদি বলা যায় কারণ শ্রমিকের স্বার্থে কেন্দ্রীয় আইনের প্রয়োজনীয় সংস্কার করা হয় এখানে। অন্য দিকে গুজরাট, মহারাষ্ট্র যে পুঁজি দরদি, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ, এই রাজ্যগুলোতে শ্রমিকের অধিকার ন্যূনতম রেখে ব্যবসার সুবিধা করে দেওয়াই সরকারের উদ্দেশ্য। ব্যবসায় সুবিধা করে দেওয়ার মধ্যে অবশ্যই অন্যায় কিছু নেই, কিন্তু তা শ্রমিকদের অধিকাংশ সুযোগ-সুবিধা বিসর্জন দিয়ে করা যায় না নিশ্চয়ই। ফলে, কোন রাজ্যে অসংগঠিত ক্ষেত্র কতটা সৃষ্টি হবে তার একটা ধারণা তৈরি হয়েছিল আগেই। যে রাজ্য শ্রমদরদি, সেখানে সহজে পুঁজির বিনিয়োগ করবে না পুঁজিপতিরা, কারণ শ্রমিকের মাথাপিছু খরচ বেশি পড়তে পারে, প্রাপ্য পরিবেশ কিংবা অধিকার নিয়ে আন্দোলন হতে পারে, এমনকী ধর্মঘটও। সুতরাং, কম পুঁজিনিবেশ মানেই প্রথাগত সংগঠিত ব্যবসা কম হবে আর কাজের জন্যে হয় অসংগঠিত ক্ষেত্র পরে থাকবে না হলে অন্য রাজ্যে পাড়ি দিতে হবে। অন্যদিকে, যে রাজ্য পুঁজিদরদি সেখানে শ্রমিক স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে পুঁজি মালিকের উপকার করা হয় বলে পুঁজিনিবেশ অঢেল, সংগঠিত শিল্প গড়ে ওঠে, যদিও শ্রমিক সংগঠন নখ দন্তহীন হয়ে থাকে কিন্তু স্রেফ বাঁচার তাগিদে ফুটপাথের দোকানের ভরসায় থাকতে হয় না। 

যেটা অবাক করে সেটা হল, এত পুঁজিনির্ভরতা সত্ত্বেও কিন্তু গুজরাট ও মহারাষ্ট্রে অসংগঠিত ক্ষেত্র বহরে পশ্চিমবঙ্গ বা কেরালার থেকে বিন্দুমাত্র কম নয়। আসলে, ব্যবসার ধরন যদি এমন হয় যে ছোট- মাঝারি আয়তনেই অনেক কর্মী না রেখে কোম্পানি চূড়ান্ত মুনাফা করতে পারে, তাহলে বাড়তি কর্মসংস্থানের দায় কেন নেবে তারা? তাছাড়া, অটোমেশন-এর দরুন কোম্পানিগুলোতে এমনিই কমছে কর্মী ও চাকরির সংখ্যা। এমন পরিস্থিতিতে নতুন শ্রম কোড যেন খাঁড়ার ঘায়ের উপরে নুনের ছিটে। 

তা হলে কি কোনও সুবিধে হয়নি? হয়েছে। পরিযায়ী শ্রমিকরা এই আইনের আওতায় দেশের বাড়ি থেকে যাতায়াত করার জন্য এককালীন ট্রেন কি বাস ভাড়া পাবে মালিকের কাছ থেকে। ফলে, আবার যদি লকডাউন হয় তা হলে অন্তত হেঁটে বাড়ি ফিরতে হবে না তাদের। এই তো অনেক পাওয়া ওদের কাছে।


Tuesday 23 March 2021

দেশ বিপন্ন বিপর্যস্ত!

সরকারি সম্পত্তি লুট চলছে

সোমনাথ গুহ


সরকারের আর ব্যবসা বাণিজ্যে থাকার কোনও প্রয়োজন নেই; Government has no business to be in business- ফেব্রুয়ারি মাসে ‘ডিপার্টমেন্ট অফ ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড পাবলিক অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট’এর একটি ওয়েবিনারে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এ কথা বলেন। ঐ একই অনুষ্ঠানে তিনি ঘোষণা করেন যে সরকার ১০০টি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা, যার মূল্য ২.৫ লক্ষ কোটি, বেচে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেই টাকা দিয়ে গরিবের মাথার ওপর ছাদ করে দেওয়া হবে, পরিকাঠামো তৈরি হবে ইত্যাদি বাগাড়ম্বর। ভবিষ্যতে কেবল মাত্র চারটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে সরকারের যৎকিঞ্চিত উপস্থিতি থাকবে। এই চারটি ক্ষেত্র হল- নিরাপত্তা ও আণবিক শক্তি; যানবাহন ও টেলিকম; বিভিন্ন জ্বালানি যেমন তেল, কয়লা, ইত্যাদি; বিমা, ব্যাঙ্কিং এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক পরিষেবা। এর বাইরে সমস্ত সরকারি সংস্থা বেসরকারি করে দেওয়া হবে, আর যদি সেগুলির কোনও ক্রেতা না পাওয়া যায় তো বন্ধ করে দেওয়া হবে। এর অর্থ, অন্তত ২৫০টি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার ওপর খাঁড়া ঝুলছে, লাখো কর্মচারীর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। প্রধানমন্ত্রী বলছেন, এতদিন এই সংস্থাগুলি চালু ছিল বলেই সেগুলোকে আগামী দিনেও চালিয়ে যেতে হবে এর কোনও অর্থ নেই। আমাদের দেখতে হবে সরকারি সম্পদ যত বেশি মানুষের স্বার্থে কাজে লাগানো যায় এবং আমাদের দক্ষ আধিকারিকদের কর্মক্ষমতা কত বেশি সেই লক্ষ্যে ব্যবহার করা যায়। 

রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র ছাড়া বেসরকারিকরণের তাৎক্ষণিক তালিকায় আছে দুটি ব্যাঙ্ক, একটি বিমা সংস্থা, ৯০টি রেল স্টেশন। ছটি বিমানবন্দর এর মধ্যে আদানিদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে, অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরির বেসরকারিকরণ শুরু হয়ে গেছে। ধ্বনি ভোটে বিল পাস করে বিমা সংস্থায় বিদেশি বিনিয়োগ ৪৯ শতাংশ থেকে ৭৪ শতাংশ করে দেওয়া হয়েছে। সরকারি ব্যবসায় অংশগ্রহণ করার ক্ষেত্রে বেসরকারি ব্যাঙ্কের ওপর যে নিষেধাজ্ঞা ছিল সেটা এখন তুলে নেওয়া হয়েছে। সরকারি ব্যবসা বলতে এখন কর জমা নেওয়া, পেনশন দিতে পারা, অপেক্ষাকৃত লাভজনক সুদে সরকারের সেভিংস স্কিম চালু করা ইত্যাদি। মোদ্দা কথায় সরকার বলতে চাইছে, অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে এখন বেসরকারি ক্ষেত্রকে সমান দায়িত্ব নিতে হবে। আরেক মন্ত্রী বলছেন যে দেশ গড়ার কাজ শুধু সরকার নয় কর্পোরেট সংস্থাগুলিকেও নিতে হবে। শুনে মনে হবে, এই অতিকায় সংস্থাগুলিকে তারা কাঠগড়ায় চড়াচ্ছে; বাস্তবে দেশ গড়ার মহান দায়িত্বের ধুয়ো তুলে যাবতীয় সরকারি সম্পত্তি তারা এদের হাতে তুলে দিচ্ছে। 

সরকারি ব্যবসায় বেসরকারি ব্যাঙ্ককে অংশগ্রহণ করতে দেওয়ার অর্থ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিকে আরও রুগ্ন করে দেওয়ার পথ প্রশস্ত করা। প্রাইভেট ব্যাঙ্ক কর জমা নেবে, পেনশন দেবে কিন্তু তারা কি জিরো ব্যাল্যান্সে জনধন অ্যাকাউন্ট খুলবে? মুদ্রা ঋণ (যার অঙ্ক মাত্র ৫০০০০-১০০০০০০ টাকা) যার থেকে আয় সামান্যই সেটা দিতে রাজি হবে? কৃষি লোন দেবে, বিশেষ করে ক্ষুদ্র, প্রান্তিক চাষিদের? প্রায়ারিটি সেক্টরের (অর্থাৎ যে ক্ষেত্রগুলিকে অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়োজন) বিধি অনুযায়ী ৪০ শতাংশ ঋণ কৃষি, শিক্ষা, সমাজের দুর্বল মানুষদের প্রাপ্য। আরবিআই রিপোর্ট অনুযায়ী গ্রামে শাখা খুলতেই প্রাইভেট ব্যাঙ্কের অনীহা আছে, দুঃস্থ মানুষদের লোন দেওয়া তো অনেক দূরের কথা। অর্থ দফতরের প্রতিমন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুরের বক্তব্য অনুযায়ী রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক এবং গ্রামীণ ব্যাঙ্ক একত্রে ৪০.৪৮ কোটি জনধন খাতা খুলেছে যেখানে বেসরকারি ব্যাঙ্ক খুলেছে মাত্র ১.২৭ কোটি। মোট মুদ্রা ঋণের ৩৫ শতাংশ সরকারি ও গ্রামীণ ব্যাঙ্ক থেকে, ২০ শতাংশ বেসরকারি। এর অর্থ শাসক দলের আনুকূল্যে সরকারি ব্যবসার ক্ষীরটা তারা খাবে, ঝুঁকিপূর্ণ, কল্যাণমূলক প্রকল্পগুলির দায়ভার সরকারি ব্যাঙ্ককেই বহন করতে হবে। এতদিন যাবৎ কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের হাজারও বিভাগের যে বিপুল তহবিল তা সরকারি ব্যাঙ্কের কাছেই গচ্ছিত থাকত। এখন বসরকারি ব্যাঙ্ক যে তাতে ভাগ বসাবে শুধু তাই নয়, এই বিশাল অঙ্কের আমানত কেন্দ্রের নেতানেত্রীদের অঙ্গুলি হেলনে তাদের করায়ত্ত হবে, এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। সরকারি ব্যাঙ্কের ব্যবসা আরও কমে যাবে। সমাজকল্যাণমূলক কাজকর্ম- ঠিক যে উদ্দেশ্যে ব্যাঙ্ক রাষ্ট্রীয়করণ করা হয়েছিল- তা থমকে যাবে। 

অথচ ইদানিং কালে বারবার দেখা গেছে, বিভিন্ন বেসরকারি ব্যাঙ্কই  লাটে ওঠার জোগাড় হয়েছে। যেমন, ইয়েস ব্যাঙ্ক, পিএমসি ব্যাঙ্ক, লক্ষ্মীবিলাস ব্যাঙ্ক। প্রথম দুটি ব্যাঙ্ক তো ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের চূড়ান্ত উদাহরণ। দুটি ক্ষেত্রেই মালিক নিজের পরিবারের লোকজনদের ঋণ দিয়ে সাধারণ মানুষদের টাকা লুটপাট করেছে। ইয়েস ব্যাঙ্ককে উদ্ধার করতে এসবিআইকে ব্যবহার করা হয়েছে তাদের শেয়ার কিনতে। একই ভাবে আইডিবিআই ব্যাঙ্ককে উদ্ধার করতে ব্যবহার করা হয়েছে এলআইসিকে। এটাই গল্প। কোনও বেসরকারি সংস্থা লুটপাট হলে সরকারি সংস্থাকে ব্যবহার করা হয় সেটাকে উদ্ধার করতে। এর ফলে ঐ সংস্থাগুলি নিজেই যে রুগ্ন হয়ে যেতে পারে তাতে সরকারের কিছু যায় আসে না। যখন সেটা হবে তখন বলা হবে কর্মচারীরা কামচোর, আধিকারিকরা অদক্ষ, পেশাদারিত্বের অভাব, অতএব বেসরকারি করো। অন্যান্য ক্ষেত্রেও তাই। লকডাউনের পরে বিদেশে আটকে যাওয়া ভারতীয়দের উদ্ধার করতে কোনও ইন্ডিগো বা স্পাইসজেট নয়, ব্যবহার করা হয়েছে সুপরিকল্পিত ভাবে রুগ্ন করে দেওয়া, বহু অবহেলিত এককালের মহারাজ এয়ার ইন্ডিয়াকে। বিএসএনএল'কে এখনও 4G চালু করার অনুমতি দেওয়া হয়নি, যেখানে প্রাইভেট টেলিকম সংস্থাগুলি 5G চালু করার পথে। টেলিকম ক্ষেত্রে জিও'র উত্থান অভুতপূর্ব যেখানে ভোডাফোনের মতো একটি শক্তিশালী কোম্পানিও কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। সীমাহীন সরকারি প্রশ্রয় ও বাণিজ্যিক ছলচাতুরি করে এই সংস্থা টেলিকম ক্ষেত্রে প্রায় একাধিপত্য কায়েম করেছে। 

আর শুধু যে অলাভজনক সংস্থাকে ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে এমনটাও তো নয়। তাহলে তো ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণ করার কোনও যুক্তি ধোপে টেঁকে না। মার্চ ২০২০ অবধি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের লাভ ১৭৪০০০ কোটি টাকা। অনুৎপাদক সম্পদ আছে ২০০০০০ কোটি টাকা। কিন্তু এই খারাপ হয়ে যাওয়া ঋণগুলির জন্য দায়ী কারা? এআইবিএ (ব্যাঙ্ক কর্মচারীদের সর্ববৃহৎ কর্মচারী ইউনিয়ন) সরকারি ব্যাঙ্কে উইলফুল ডিফল্টারদের (যারা ইচ্ছাকৃত ভাবে ঋণ পরিশোধে অক্ষম) একটি তালিকা প্রকাশ করেছে। ২৪২৬টি এই ধরনের সংস্থার থেকে ব্যাঙ্কের মোট পাওনা ১.৪৭ লক্ষ কোটি টাকা। এদের সর্বাগ্রে কুখ্যাত মেহুল চোক্সির গীতাঞ্জলী জেমস লিমিটেড। এই বিপুল অঙ্ক উদ্ধারে সরকার সচেষ্ট হোক। সরকার কেন এইসব সংস্থাগুলির থেকে ব্যাঙ্কের টাকা উদ্ধারের চেষ্টা করছে না। সরকারের এই অনীহার ফলে পুরো সরকারি ব্যাঙ্ক ব্যবস্থা আজ বিপন্ন হয়ে পড়েছে। থিরুবনন্তপুরম বিমানবন্দরও লাভজনক। সেখানে কর্মচারী, অফিসার, কেরালা সরকারের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও সেটা আদানিদের হাতে তুলে দেওয়া হল। নতুন মালিকদের বলা হয়েছে অন্তত ৬০ শতাংশ কর্মচারী তাদের পুনর্নিয়োগ করতে হবে। তাহলে বাকি ৪০ শতাংশের কী হবে? যে সংস্থাগুলি বেচে দেওয়া বা বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে সেগুলির কর্মীদের যে কী অসহায়, অনিশ্চিত অবস্থা তা সংবাদমাধ্যম তুলে ধরছে না। 

বেসরকারিকরণ করলেই যে অর্থনীতি চাঙ্গা হয়ে ওঠে না এটা তো প্রমাণিত। প্রাইভেট ব্যাঙ্কেও অনুৎপাদক সম্পদের হার উর্ধ্বমুখি। গত অর্থবর্ষে তারা ৫৩৯৪৯ কোটি টাকা রাইট অফ করেছে, অর্থাৎ ব্যাল্যান্স শিট থেকে মুছে ফেলা হয়েছে। এর পুরোটাই কর্পোরেট লোন। সরকার কি এটা জানে না? আসলে সরকার ও সমাজের মধ্যেকার আন্তঃসম্পর্ক বর্তমান শাসক দল আমূল পালটে ফেলছে। এতদিন ছিল সরকার সমাজের দুর্বল, অনগ্রসর মানুষদের স্বনির্ভর হতে সাহায্য করবে। এখন বলা হচ্ছে সরকার শুধু উপার্জন করার আবহ তৈরি করে দেবে, এবার তুমি করে খাও। কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের ধারণা আজ বিশ্ব জুড়ে তামাদি হয়ে গেছে। এখন বল্গাহীন, লাগামছাড়া পুঁজির আধিপত্যের যুগ। নির্লজ্জ ক্রোনি ক্যাপিটালিজম! মনে রাখতে হবে, সরকারি ব্যাঙ্কের আমানত প্রায় ১৪০ লক্ষ কোটি টাকা। এই বিপুল অঙ্ক ব্যাঙ্কের অতি উচ্চপদস্থ আধিকারিক, আমলা, IBA, RBI এবং সুযোগসন্ধানী রাজনৈতিক নেতানেত্রীদের লালফিতেতে বাঁধা। এখন যা ব্যবস্থা রয়েছে তাতে এটা করায়ত্ত করতে অনেক বাধা ডিঙোতে হয়। তাই, লাল ফিতে ছিন্ন করে এই বিশাল তহবিল মুক্ত করার জন্য বেসরকারিকরণ আবশ্যিক। এর ওপর নিরঙ্কুশ আধিপত্য কায়েম করা কেন্দ্রীয় সরকার এবং তার প্রিয় দুই সাঙাতের বিশেষ প্রয়োজন। রেল, বিমানবন্দর এবং অন্যান্য সংস্থাকে বেসরকারিকরণের উদ্দেশ্যও তাই। আজ আমাদের বুঝতে হবে, ব্যাঙ্ক কর্মচারীরা শুধু তাঁদের মাইনে বাড়ানোর জন্য আন্দোলন করছেন না, তাঁরা আমাদের যে গচ্ছিত ধন ব্যাঙ্কে সঞ্চিত রয়েছে তাকেও সুরক্ষিত রাখার জন্য পথে নেমেছেন। আমাদের তাঁদের পাশে দাঁড়ানো প্রয়োজন। 


Monday 22 March 2021

প্রশান্ত কিশোরের রাজনীতি

নতুন সময়ের অভিব্যক্তি?

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য

 

সম্প্রতি ইন্ডিয়া টুডে টিভি চ্যানেলে রাহুল কানওয়াল’এর এক প্রশ্নের উত্তরে নির্বাচনী কৌশলবিদ প্রশান্ত কিশোর খুব সপ্রতিভ ভাবে জবাব দেন: দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার থেকেও তিনি আরও বেশি উচ্চাকাঙ্ক্ষী। এতে স্বভাবতই নড়েচড়ে বসেন প্রশ্নকর্তা এবং বারবার জিজ্ঞেস করতে থাকেন, সে উচ্চাশাটা কী? প্রতিবারই সে প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে গিয়ে প্রশান্ত বলতে থাকেন, আজ নয়, পরে কখনও তিনি এ বিষয়ে বলবেন। এমনতর একটি দুর্লভ উচ্চাশা মনে মনে পোষণের কথা জানিয়েও তিনি সে বিষয়ে আর বিশদে কিছু বলতে চাননি।

তাই বিষয়টি কৌতূহলোদ্দীপক। কিন্তু একেবারে আন্দাজ যে পাওয়া যাচ্ছে না, তাও নয়। বরং, এর আগ মুহূর্তেই প্রশ্নকর্তার অন্য এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি এমন কিছু বলেছেন যার থেকে তাঁর উচ্চাশার একটা ধরন তো বোঝাই যাচ্ছে। আর তিনি যে বিষয়টিকে একান্তই গোপন রাখতে চাইছেন, তাও নয়। তিনি ইঙ্গিত দিচ্ছেন, কিন্তু এই মুহূর্তে অকপটে বলতে চাইছেন না, বলার মতো আরও খানিকটা আত্মবিশ্বাস অর্জন করে নিতে চাইছেন হয়তো। কারণ, এ উচ্চাশা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ স্রেফ এই কারণেই যে তা প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হওয়ার থেকেও বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ।

অতএব, এ নিয়ে শূন্যে আলটপকা ঢিল ছুঁড়ে আপাতত কোনও লাভ নেই। বরং, চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে, প্রশান্ত কিশোরের রণকৌশলের ধরনটা কেমন ও তা কেন প্রায় ১০০ শতাংশ সাফল্য এনে দিচ্ছে (একমাত্র ব্যতিক্রম ২০১৭ সালে উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের কৌশলী হিসেবে ব্যর্থতা)। ইন্ডিয়া টুডে’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে প্রশান্ত স্পষ্টতই বলেছেন, তাঁর সংস্থার কাজ মোটেই এমন নয় যে, যে দলের জেতার কোনও সম্ভাবনা নেই তাকেও তারা জিতিয়ে দিতে পারে। মূলত তাদের কাজ নির্দিষ্ট (যে দলের দায়ভার তারা নেয়) দলীয় নীতি ও অনুশীলনের পরিসীমায়, যেখানে দলের জেতার সম্ভাবনা আছে বা মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে তারা অবস্থানরত, তার জয়কে তারা নিশ্চিত করতে পারে, দুর্বলতা ও অক্ষমতার জায়গাগুলিকে মেরামতি করে এবং নির্বাচনী প্রচারকৌশলকে আরও আকর্ষণীয়, বাস্তবমুখি ও তীক্ষ্ণ করে। দলের পরিসীমা প্রান্তরে কিছু উপাদান জুগিয়ে ও কৌশল এঁটে কোনও দলের জয়কে সুনিশ্চিত করার এই যে অব্যর্থ বটিকা, তার মূল রহস্যটিকে তাহলে বোঝার চেষ্টা করা যাক। কারণ, সেখানেই প্রশান্ত কিশোরের উচ্চাকাঙ্ক্ষার বীজ হয়তো লুকিয়ে আছে।

এ পর্যন্ত রাজ্য নির্বাচনগুলিতে প্রশান্ত কিশোরের টিম যে যে দলগুলিকে পরামর্শ দিয়েছে তারা হল- বিজেপি, জনতা দল (ইউনাইটেড), কংগ্রেস, ওয়াইএসআর কংগ্রেস, আপ, তৃণমূল ও ডিএমকে। একমাত্র ২০১৭ সালে উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস বাদে আর কোনও পরামর্শেই তারা এখনও পর্যন্ত ব্যর্থ হয়নি। তাদের যাত্রা শুরু ২০১২ সালে গুজরাত বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে বিজেপি’র পরামর্শদাতা হিসেবে। ২০১৩ সালের গুজরাত নির্বাচনে সাফল্যের পর তারা Citizens for Accountable Governance (CAG) নামে একটি সংগঠন তৈরি করে ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি ও বিজেপিকে লোকসভা নির্বাচনে বৈতরণী পার হতে সাহায্য করে। এরপর একের পর এক বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলিকে তারা পরামর্শ দিয়েছে, তাদের জন্য রাজনৈতিক রণকৌশল সাজিয়ে দিয়েছে ও জয়ের পথ সুনিশ্চিত করেছে। পরে CAG’কে তারা পুনঃসংগঠিত করে Indian Political Action Committee (I-PAC) গঠন করে। এই আই-প্যাক ধীরে ধীরে হয়ে দাঁড়ায় ভারতীয় রাজনীতিতে এক যুগান্তকারী দিকবদলের কাণ্ডারী। কথাটা এতটা উচ্চরবে বলার কারণ হল, তাদের হস্তক্ষেপ ও পরামর্শের ফলে দেশের রাজনৈতিক-অর্থনীতিতে এক পালাবদলের ইঙ্গিতও বেশ স্পষ্ট হয়েছে। কারণ, পরাজয়ের আশঙ্কায়, অন্যথায় জেতার প্রবল সম্ভাবনাকে নিশ্চিত করতে যে দলগুলি আই-প্যাক’এর দ্বারস্থ হচ্ছে, তাদের অতএব এমন এক রাজনৈতিক অনুশীলনের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে যা অভিনব এবং অবশ্যই ব্যতিক্রমী। নিজেদের আত্মবিশ্বাসে এবং দেয় প্রতিশ্রুতি ও কাজের নিরিখে যদি দলগুলির জেতার ব্যাপারে ষোলআনাই ভরসা থাকত তাহলে তারা কি আর দায়ে পড়ে আই-প্যাক’এর দ্বারস্থ হত? যে মুহূর্তে আই-প্যাক’এর সঙ্গে একটা রফা হল, আই-প্যাক’ও কিন্তু নেমে পড়ল সব থেকে প্রাথমিক কাজটিতে: সমীক্ষা। একেবারে তৃণমূল স্তরে সটান পৌঁছে এমন নিবিড় ও গভীর সমীক্ষা যেখানে ধরা পড়ে যাবে পাণিপ্রার্থী দলটির সমস্যা ও অসুবিধাগুলি কোথায়। এই সমস্যাগুলিকে চিহ্নিত করে মেরামতির উদ্যোগ নেওয়া এবং এমন ভাবে দলগুলির উপস্থাপনাকে হাজির করা যে মানুষের হারিয়ে যাওয়া আস্থা যেন আবার ফিরে আসতে পারে।

আই-প্যাকের এই অনুশীলনের প্যাটার্ন ও উপলব্ধ প্রজ্ঞা থেকে আমরা দেখতে পাব, এক বিশেষ ধরনের পরামর্শই (যদিও বিভিন্ন রাজ্যের নির্দিষ্ট পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে তার কিছু বিশিষ্টতা আছে) আই-প্যাক’এর তরফ থেকে দেওয়া হয়ে থাকে এবং তা দিয়েই বাজিমাত করার প্রচেষ্টা। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে, এর অর্থ এই নয় যে শুধুমাত্র কিছু গিমিক দিয়ে বা কারসাজি করে কোনওক্রমে পার পাওয়ার চেষ্টা। এর অন্দরে সুদূরপ্রসারী কিছু বদলেরও অভিসার আছে।

খেয়াল করে দেখুন, ২০১৩ সালের গুজরাত বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির নির্বাচনী বরাত নিয়ে ‘চায়ে পে চর্চা’র অভিনব অনুশীলন দিয়ে যার শুরু, আজ পশ্চিমবাংলায় ‘বাংলা তার নিজের মেয়েকেই চায়’ আওয়াজে এসে আপাতত পৌঁছনো। এই শ্লোগান ও প্রেরণার মধ্যে নিছক ফাঁপা আবেদন ও ভাবাবেগ আছে- এমনটা মনে করলে কিন্তু ভুল হবে। এর মধ্যে অবশ্যই একটা নির্দিষ্ট ধরনের রাজনৈতিক অন্তর্বস্তু ও অনুশীলন আছে যা আই-প্যাক’কে সাফল্য এনে দিচ্ছে। এক কথায় বললে তা হল, শাসনরীতিকে জনমুখি করে তোলা ও হরেক কিসিমের সমাজকল্যাণমূলক প্রকল্প হাতে নেওয়া। প্রত্যেকটি পরামর্শের মধ্যেই কিন্তু এই মোদ্দা সারবস্তুটি অন্তর্লীন হয়ে আছে। অর্থাৎ, এমনটা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, শাসনপ্রণালী ও জনকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলিকে মানুষের কাছাকাছি নিয়ে আসা ও উপযুক্ত করে তোলার মধ্য দিয়ে যে রাজনৈতিক অনুশীলনটি সাব্যস্ত হয় তাকেই শিরোধার্য করে ভারতীয় সংসদীয় গণতন্ত্রে একটি পাকাপোক্ত সড়ক নির্মাণে ব্রতী প্রশান্ত কিশোরের আই-প্যাক টিম। যদিও প্রশান্ত কিশোরের বক্তব্য হল যে তিনি আই-প্যাকের কোনও শেয়ারহোল্ডার বা তার মালিক নন এবং এই সংস্থা কোনও বাণিজ্যিক উদ্যোগও নয়। এটা এক ধরনের মিশন। তর্কের খাতিরে প্রশান্ত কিশোরের বক্তব্যকে গ্রাহ্য করলে এটা পরিষ্কার হয় যে, তারা স্পষ্টতই ভারতীয় ব্যবস্থায় জনকল্যাণমূলক রাজনীতির ব্যাপক সম্প্রসারণ ও অনুশীলনের মধ্য দিয়ে একটি নতুন ধরনের রাজনৈতিক-অর্থনীতির উদ্ভাবন ও প্রসারণ চাইছে। গত সাত-আট বছরে তাদের অভিজ্ঞতার নিরিখে এটা অস্বীকার করা যাবে না যে তারা এ ব্যাপারে নিঃসন্দেহে কতকটা অগ্রসর হয়েছে। আর তার বাস্তব কারণ ও পরিস্থিতিও বিদ্যমান।

গত শতকের নব্বইয়ের দশকে উত্থিত বিশ্বায়নের পরিপ্রেক্ষিতে নব উদারবাদী অর্থনীতির যে আগুয়ান রথ এ দেশ ও সারা বিশ্ব জুড়ে ছুটতে শুরু করেছিল তার প্রথম ধাক্কা আসে ৯০'এর দশকের একেবারে শেষ ভাগে চার এশিয়ান টাইগারের (হংকং, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ান) মুখ থুবড়ে পড়ার মধ্য দিয়ে। আর দ্বিতীয় সর্বগ্রাসী মোক্ষম ধাক্কাটি ছিল ২০০৮’এর সাব-প্রাইম সংকট থেকে। ইতিমধ্যে, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির অভিনব বিকাশ এসে পৌঁছেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার গভীর গহ্বরে যেখানে যন্ত্র প্রায় সর্বাংশেই যে কোনও কাজের দায়িত্ব নিতে সক্ষম, অতএব, মনুষ্য শ্রমের প্রয়োজনীয়তাও প্রথমে আংশিক ও পরে সম্পূর্ণতই কমে আসার শুরু। এই শতকের দ্বিতীয় দশকের গোড়ায় পুরনোকালের ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্প যুগের অন্তে এসে আমরা পৌঁছলাম যেখানে দেখা গেল নতুন শিল্প হিসেবে জায়গা করে নিচ্ছে অনলাইন-ডিজিটাল ভিত্তিক বিকিকিনি ও নব্য বহরে বিস্তৃত এক পরিষেবার জগৎ। যেটুকু কর্মী নিয়োগ তা এই নতুন জগতেই ঘটছে, পুরনো শিল্প জগতে যা অত্যন্ত নগণ্য। জমি অধিগ্রহণ করে বড় বড় শিল্প স্থাপনার যুগও অস্তপ্রায় কারণ অনলাইন শিল্পে বস্তুগত সম্ভারের প্রয়োজন নিতান্তই সামান্য।

এমন এক পরিস্থিতিতে খুব স্বাভাবিক যে পরিকাঠামো বলতে যে আয়োজনের কথা আগে শিল্প মহল থেকে বোঝানো হত, যেমন, আট লেনের রাস্তা কিংবা বড় বড় বিমানবন্দর অথবা সুবিশাল হাইওয়ে বা মস্ত ফ্লাইওভার নির্মাণ করা– সে সবের কার্যকারিতা ক্রমেই ফুরিয়ে আসছে। কারণ, নতুন অনলাইন-ভিত্তিক শিল্পে গতায়াতটা এখন একেবারেই প্রায়-ভার্চুয়াল, সত্যি সত্যি নয়। সাম্প্রতিক কোভিড পরিস্থিতিতে মানুষের ঘরবন্দী জীবন সে সম্ভাবনাকে আরও ত্বরান্বিত করেছে। আর এই সুবাদে ‘গিগ’ (স্বল্পস্থায়ী) অর্থনীতির উদ্ভবের ফলে সেভাবে স্থায়ী চাকরির সম্ভাবনাও আর নেই। তাই, জনকল্যাণমূলক প্রকল্পের সাহায্যে সাধারণ মানুষের জীবনযাপনকে কতকটা ঠেকা দেওয়া ছাড়া শাসকের কাছে আর কোনও পথও খোলা নেই। এই পরিপ্রেক্ষিত থেকেই ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকামের (ইউবিআই) প্রস্তাব সর্বতোভাবে আলোচনায় আসছে; তা এখুনি কার্যকর করা না গেলেও অন্তত আংশিক ইউবিআই’এর কর্মসূচি লাগু হতে শুরু করেছে। এবারের নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের ইশতেহারে ১.৬ কোটি পরিবারকে মাসিক ৫০০/১০০০ টাকা আয় সরাসরি দিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব এই ভাবনাকে মাথায় রেখেই।

বোঝাই যাচ্ছে, যেহেতু ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্প-অনুকূল পরিকাঠামো গড়ে তোলার আর তেমন প্রয়োজনীয়তা থাকছে না, তাই সে খাতে অর্থ বরাদ্দ না করে জনকল্যাণমূলক খাতে তা ঘুরিয়ে দিয়ে নতুন এক রাজনৈতিক-অর্থনীতির পথকে প্রশস্ত করাই এখন সাব্যস্ত হচ্ছে। তবে, চরম দক্ষিণপন্থী ও চরম বামপন্থী দলগুলি এই ধরনের কার্যাবলীর বিরুদ্ধে (যদিও এই দুই পক্ষের বিরুদ্ধে থাকার কার্যকারণ একেবারেই বিপরীতমুখি)। চরম দক্ষিণপন্থী দল হিসেবে আজকের বিজেপি’কে দেখে তা বোঝাও যাচ্ছে, যখন চাঁদ সদাগরের বাঁ হাতে মনসা পুজোর মতো করে তারা কিছু জনমুখি যৎসামান্য এটা-সেটা ছুঁড়ে দিচ্ছে বটে কিন্তু তাদের মূল অভিমুখ নির্লজ্জ ভাবে কর্পোরেট কুলের (বিশেষত দুটি হাউজ) স্বার্থ রক্ষা করা। যে কারণে, ২০১৩-১৪ সালে বিজেপি প্রশান্ত কিশোরের পরামর্শ নিয়ে গুজরাত ও কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসীন হলেও ক্রমেই নিজেদের কদর্য চেহারাটাকে আরও উন্মুক্ত করেছে এবং আই-প্যাকের সঙ্গে তাদের মধুচন্দ্রিমারও অবসান হয়েছে। তাদের পক্ষে এই নতুন পথে চলা তাদের মতাদর্শের কারণেই সম্ভব নয়।

বলাই বাহুল্য, প্রশান্ত কিশোরের আই-প্যাক নবতর রাজনৈতিক-অর্থনীতির এই জায়গাটিকেই ধরেছে। আর নির্বাচনে একেকটি দলের দায়িত্ব নিয়ে এই পথকে পাথেয় করেই তারা সাফল্য এনে দিচ্ছে। এই যে নতুন এক পথের ধারণা ও তার অনুশীলন, তা আরও কিছু সাফল্য অর্জনের মধ্য দিয়ে আগামী দিনে হয়তো এক দিগদর্শন হিসেবে স্বীকৃতি পাবে। এই মত ও পথের তত্ত্বায়ন ও সাফল্যই সম্ভবত প্রশান্ত কিশোরের উচ্চাকাঙ্ক্ষা। তা কালের বিচারে নিয়মতান্ত্রিক প্রধানমন্ত্রীর পদ অলংকরণ করার থেকেও অনেক পরিব্যাপ্ত, সৃজনশীল এবং অমূলকও কিছু নয়।

      

Wednesday 17 March 2021

ভোটের হিসেব!

বিজেপি পেরে উঠবে না

অশোকেন্দু সেনগুপ্ত


ঘাড়ের ওপর এসে পড়েছে কয়েকটি রাজ্যের নির্বাচন। সারা দেশের মূল আকর্ষণ দক্ষিণ ভারতের কেরালা ও তামিলনাডু আর পূর্ব ভারতের পশ্চিমবঙ্গ আর অসম নির্বাচন। শুধু আকর্ষণ নয়, আশঙ্কাও। বিজেপি এখন অসমের তখতে, বাকি কোথাও নেই, অন্য রাজ্যে সে যা পাবে তাই তার লাভ। এর মধ্যে তার সম্ভবত বিশেষ লক্ষ্য পশ্চিমবঙ্গ। 

তা রাজনৈতিক দল তো চাইবেই তার প্রভাব বাড়াতে, কতটা বাড়বে সেটাই প্রশ্ন। আর বিজেপি বিরোধী শক্তির আশঙ্কা প্রধানত দুটো: ১) বিজেপি কি আরও শক্তি বাড়াবে এই দেশে অন্য কোনও মন্ত্রে; ২) কংগ্রেস দলটা কি ধুয়ে-মুছে যাবে? 

বিজেপি যদি শক্তি বাড়ায় ক্ষতি কী? ক্ষতি অনেক। এই সেই দল যা সংবিধান মানে না, টাকা আর ক্ষমতার লোভ দেখিয়ে গণতন্ত্র ধ্বংস করতে চায়। তবু দেশে গণতন্ত্র আছে, ক্রমাগত পিছিয়ে পড়লেও অর্থনীতি তার বেশ পোক্ত আজও। 

'ওরা রাজ্যে রাজ্যে 'ডবল ইঞ্জিন' সরকার প্রতিষ্ঠা করলে সব ভণিতা ত্যাগ করে নাকি দেশে রাম রাজত্বের নামে আধুনিক ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা করবেই।' আজ যারা এসব বলছে বা আজ যারা তাদের অপছন্দ করে তাদের একাংশ কিন্তু এই সেদিনও বিজেপির পাশে ছিল, সে দলটিকে বিপুল ভোটে জয়যুক্ত করে কেন্দ্রের সিংহাসনে বসিয়েছে। তারা এখন যেন বুঝেছে এই দলটির চলনে বলনে হিটলারি তথা নাৎসি বাহিনির ছায়া। এরা দেখছে বিজেপি যেন সেই শক্তি হয়ে উঠেছে যার মন্ত্র: 'যার শিল যার নোড়া, তারই ভাঙ্গি দাঁতের গোড়া'! ওই দলের নাগরিকত্ব নিয়ে হম্বিতম্বি যেন সে কথাই বলে চলেছে। ওরা আরএসএস'কে পাশে নিয়ে চাইছে একটা হিন্দু রাষ্ট্র। ওরা রামমন্দির বানাবে  আর মুসলিমদের দেশছাড়া করবে। 

অসমে যে ডিটেনশন ক্যাম্প তা  আরও মনে  করাচ্ছে নাৎসি কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের কথা। নাগরিকত্ব হারাতে বসেছে হিন্দুরাও, এবং কী আশ্চর্য, তারাই সংখ্যায় বেশি! অনেক অনেক বেশি।  এরপরও অসমে ওরা জিতবে?

উত্তর ভারতের ভীত, সন্ত্রস্ত কৃষকরা রাস্তায় নেমে পড়েছেন আর কোনও রাস্তা না পেয়ে। তিনটি কৃষি আইন তাঁদের রুটি কেড়ে নেবার ভয় দেখাচ্ছে। ওঁদের সামনে বিধানসভা বা লোকসভা নির্বাচন নেই, আছে স্থানীয় নির্বাচন। তাই সই। আর দেশ তো একটাই, বিজেপি দেশদ্রোহী বলে তো বলুক। ওই কৃষকরা সারা দেশের নির্বাচকমণ্ডলীর কাছে বলে চলেছেন: 'No Vote to BJP'। ওদের ধাক্কায় উত্তর ভারতে টলমল বিজেপি। 

এদিকে, সারা দেশ, বিশেষত তামিলরা চিন্তিত জাতীয় শিক্ষানীতি নিয়ে। যার আড়ালে ফণা তুলে রয়েছে 'হিন্দি আগ্রাসন'। রয়েছে সরস্বতী বিদ্যামন্দিরের 'সুশিক্ষা'। কেরালাও সুখে নেই। তাদের স্মৃতিতে আছে হিটলারি কায়দা যা প্রাণ কেড়েছে ইহুদি আর কম্যুনিস্টদের। আমার বাংলাও তো সুখে নেই নিশ্চয়। নানা কৌশলে বিজেপি নামের দলটি বাংলা ভাষা আর সংস্কৃতির মূলোচ্ছেদ করতে উদ্যত - অনেকের তেমন আশঙ্কা।

কৃষকদের আন্দোলন শুরু হবার আগেই তারা পেয়েছে ত্রিপুরা আর বিহার। বাংলা না পেলে আর অসম খোয়ালে আয়ারাম-গয়ারামের এই দেশে বিহার কি থাকবে বিজেপি-ছায়ায়? তাই বাংলা তার চাইই।  প্রয়োজন হলে এখানেও ঘোড়া কেনাবেচা হবে। তাই বিজেপির জয়রথ থামাতে এখানে বিজেপিকে গো-হারা হারাতে হবে। দেখতে হবে যেন ওরা ঘোড়া কেনাবেচারও সুযোগ না পায়। 

কে পারে ওই দলকে তেমনভাবে হারাতে? অসমে কংগ্রেস আছে, তামিলনাডুতে ডিএমকে আছে, কেরালায় বামপন্থীরা আছে, কিন্তু এই বাংলায় কে ঠেকাবে ওদের।  যেন আমাদের বাস জলে কুমির আর ডাঙ্গায় বাঘ নিয়ে। কোনদিকে যাব? ওদের রথ থামাতে এগোব না পিছোব? এই প্রশ্নটি বিবেচনার আগে বিবেচনা করি ফেলে আসা অন্য প্রশ্নটি - এই দেশ থেকে কংগ্রেস দলটা কি ধুয়ে-মুছে যাবে?

এই দলটি কম অপরাধ করেনি। তারাও ধর্ম নিয়ে বিস্তর খেলেছে। উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব বা কর্মসংস্থান নিয়ে তারা কম খেলেনি। আজও যে দেশে নিরক্ষর রয়েছে, আছে দারিদ্র তার দায় ওরা অস্বীকার করতে পারে না।  বিচারব্যবস্থাকে সম্মান দেখালেও বিচারক নিয়োগে তারা কম কৌশল করেনি। তবু তারা মুছে যায়নি, যাবার নয়। এবং তা যে হবার নয় উত্তর ভারতে বিজেপির কুশাসন তা বুঝিয়ে দিচ্ছে। বুঝিয়ে দিচ্ছে বিকল্প কংগ্রেসই। অসমে, কেরালাতেও তাই। আর, মনে হচ্ছে, তামিলনাডু তার ট্রাডিশন মেনে এবার ডিএমকে দলটিকে শাসন করার অধিকার দেবে। কিন্তু এই রাজ্যের কী হবে?

এখানে বহুদিনই কার্যত কংগ্রেস নেই। তবে কংগ্রেস ঘরানার দল তৃণমূল কংগ্রেস আছে। তারা কি পারবে বিজেপিকে ঠেকাতে? চেষ্টা করছে তারা খুব। তবু প্রশ্ন জাগে - তারা একাই পারবে, না কারও হাত ধরতে হবে। এমন নয় যে তারা কখনও কারও হাত ধরেনি। অন্যের হাত ধরেছে বারবার - বাম, ডান, সাম্যবাদী বা জাতীয়তাবাদী  - কখনও ব্যক্তি, কখনও দল পাশে নিয়ে তারা লড়েছে। এবার তারা কার্যত একা লড়ছে। একা কি পারবে একালের ওই ফ্যাসিবাদী দলটির রথের চাকা রুখে দিতে? পারবে এই ভরসা নিয়েই তারা লড়ছে। তবু, বিশেষত শহরাঞ্চলের গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষের দুঃশ্চিন্তা দূর হয় না। যদি না পারে? তারা বিজেপির হাত ধরবে না তো! নাকি হাত বাড়াবে অন্যদের দিকে? মমতা-নিন্দায় রত বামশক্তি তখন কী করবে?

রাজ্যের তথা দেশের বামশক্তির সামনে এ এক জটিল প্রশ্ন। ১৯-এর নির্বাচনে প্রধান বিরোধী বাম দল সিপিএম নাকি ভেবেছিল 'এবার রাম' হলে 'পরের বার বাম' নিশ্চিত। তেমনটা ঘটেনি, ঘটার নয়, সোনার পাথরবাটি হয় না। সাধারণের আশা, অন্তত এবার তারা তা বুঝেছে। তবে, তারা রাজ্যপাট হারানোর শোক এখনও ভুলতে পারেনি। তাই, এরপরও তারা আদর্শ জলাঞ্জলি দিয়ে জোট গড়তে ব্যস্ত হয়েছে, কোলে টেনেছে চিরশত্রু কংগ্রেস আর সিদ্দিকীর সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকেও। তবু হাত মেলায়নি তৃণমূলের সঙ্গে।  ভালো করল কী? মন্দ নয় বলার উপায় নেই যদি কারও চোখ থাকে কেবল মসনদে। সিপিএম নিজেকে বামপন্থী দল বলে দাবি করে অথচ তারও নজর সেই সিংহাসনের দিকেই! তাই তারা গালমন্দ, কুৎসা, সমালোচনায় ভরিয়ে তুলছে রাজ্যের বর্তমান শাসক দলকে। এরা তার হাত ধরতে পারে না। ফল ঘোষণার পরেও না?  বিজেপি নিশ্চয় তাদের দিকে হাত বাড়াবে না, বাড়াতে পারে তৃণমূল। বাড়াবে তেমন প্রয়োজন হলে। রাজনীতিতে সবই সম্ভব, খেলা যে এখনও অনেক বাকি। তবে, তেমন প্রয়োজন হবে কী? সেটাই তো লাখ বা কোটি টাকার প্রশ্ন।

এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার দায় নেই সাধারণ নির্বাচকদের। তাদের একটাই প্রার্থনা- যেন ঘোড়া কেনাবেচার নোংরা খেলাটা তাদের না দেখতে হয়। এই ফাঁকে একবার দেখে নি' বাকি দলগুলির অবস্থান। 

কংগ্রেস:

আগেই বলেছি, এই রাজ্যে কার্যত বহুদিনই কংগ্রেস নেই। তাদের প্রভাব রয়েছে মাত্র দুটি জেলায় - মুর্শিদাবাদ ও মালদা। অল্পস্বল্প তারা আছে উত্তর দিনাজপুর আর পুরুলিয়ার কিছু পকেটে। ব্যস। বাকিটুকু চলে গেছে তৃণমূলে। এখন তৃণমূল এই রাজ্যে হয়ে উঠেছে তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী, তারা তাই মনে করে (নির্বাচকরা যা ভাবে ভাবুক)। ওদিকে তৃণমূলও চায় ওদের যেখানে যেটুকু জমি আছে তা কেড়ে নিতে। এই নিয়েই প্রধানত তৃণমূল আর কংগ্রেসের দ্বন্দ্ব। ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দও আছে।

সিপিএম তথা সংযুক্ত মোর্চা:

ব্যক্তির অপছন্দও আছে বলেই এখনও সংযুক্ত মোর্চা জোট দানা বাঁধতে পারেনি। মহঃ সেলিম দলটাকে নিজ স্বার্থে ব্যবহার করতে সিদ্দিকীর সঙ্গে গলাগলি করতে চান এবং তাতে যদি বাধা হয় অধীরের মতো কেউ তো তার পরোয়া তিনি করেন না। 

সিপিএম দলের আরও কিছু সমস্যা আছে। তারা বাধ্য হয়ে ফেলে আসা বদ-অভ্যাসগুলি ভুলতে পারে না আজও। ভুলতে পারে না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অগণতান্ত্রিক উপায়ে পঞ্চায়েত দখলের কেরামতি। অক্ষম তারা আজ শূন্যে হাত-পা ছোড়ে। অথচ তারা দিব্যি ভুলেছে নিজেদের অপকীর্তি। যে পথে মমতা হেঁটেছেন সে পথ যে তাদেরই গড়া তা ভুলে মমতাকে তারা প্রধান শত্রু বলে দেগে দিয়েছেন। এতে যে নিজেদের ক্ষতি সর্বাধিক তা তারা দেখেও দেখছেন না, বিজ্ঞ বা অভিজ্ঞজনের কথা শুনেও শুনছেন না।

তবু সে জোট ভোট বা জনসমর্থন পাবে। কারণ অনেক। প্রথম কারণ কৃষক সমর্থন, দ্বিতীয় বিজেপি নামক শাসক দলটির প্রতি ঘৃণা, তৃতীয় কারণ গণ-আন্দোলনে পুলিসের মারে হত (তর্ক সাপেক্ষ) যুবকের মুখ। তাছাড়া বাঙালি স্বভাবত বামপন্থী, আর একদল (সংখ্যায় তারা কম নয়) মুখোশ পরা সাম্প্রদায়িক (আইএসএফ তাদের বিজেপি সমর্থক হওয়া ঠেকাবে)। এই অঙ্কেই মমতা ও বিজেপিকে পরাস্ত করতে বামপন্থীরা সাম্প্রদায়িক ও তথাকথিত জাতীয়তবাদীদের সাথে হাত মেলাতে দ্বিধা করছে না। তবে ক্ষমতার ভাগ পেতে, তেমন সুযোগ এলে অন্তত আইএসএফ নৌকা বদলাতেই পারে। তবে তেমন সুযোগ তারা পাবে কী? পেতে পারে যদি কোনও দলই নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পায়। তবে সে ক্ষেত্রে একা আইএসএফ নয়, আয়ারাম থেকে গয়ারাম হবে কে কে তা বলা শক্ত। কয়েকজন ছাড়া বাকি সবাই তো বিক্রি হবার জন্য সেজেগুজে তৈরি  থাকবে।

তৃণমূল:

এই সব সমস্যা ও সম্ভাবনা তৃণমূলের জানা। তাই, তাদের চেষ্টা একক ভাবে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের। তারা একইসাথে বিজেপি আর জোটকে আক্রমণ করে চলেছে। তবু তাদের সংশয় যায় না। পাবে কি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা?

মানুষের জন্য এত কাজ করেছে যে দল তাকেও ভাবতে হচ্ছে। এই তো গণতন্ত্র বা নির্বাচনের মজা। কন্যাশ্রী থেকে স্বাস্থ্যসাথী, দুয়ারে সরকার - পিছিয়ে পড়া মানুষের মঙ্গলের জন্য কী করেনি এই দলের সরকার? কিন্তু এই সরকার তো নিশ্চয়ই অগণতান্ত্রিক পথেও হেঁটেছে - সামান্য কার্টুন আঁকার জন্য শাস্তি দিয়েছে, জোর করে দখল নিয়েছে পঞ্চায়েত ও পুরসভার। এই সরকারই তো দল ভাঙ্গার খেলা খেলেছে (সিপিএম'এর দেখানো পথে)। 

তবু মানুষ ভুলতে পারে না যে এই দল কখনও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাবাজদের প্রশ্রয় দেয়নি, নারীদের সম্মানরক্ষায় এগিয়ে গেছে, আদানি-আম্বানিদের হাতে সঁপে দেয়নি রাজ্যটাকে, চেষ্টার ত্রুটি রাখেনি কর্মসংস্থানের। কৃষক আন্দোলন থেকে শাহিনবাগ (এখানে পার্কসার্কাস ময়দান) - প্রতি ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের সমর্থন মিলেছে। এই সরকারের ভুল পদক্ষেপও মানুষের নজরে আছে বৈকি। মানুষ তো দেখেছে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মতো শিকড়হীন উদ্ধত নেতাদের কুপরামর্শে শিক্ষা ক্ষেত্রে অরাজক অবস্থা ও সিপিএমপন্থীদের দাপাদাপি, দেখেছে নিজ কর্মচারীদের প্রতি সরকারের অবহেলা ও অবজ্ঞা।

সব থেকে দুর্বল বা হাস্যকর অবস্থা সংযুক্ত জোটের। ওটা জোট নাকি নিছক আসন সমঝোতা তাই বোঝা গেল না এখনও। তবু তাদের কিছু আসন জুটবে, অবাক হব না যদি এই জোট বিজেপিকে পিছনে ফেলে দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসে। এ পর্যন্ত যত বিশেষজ্ঞ মত দিয়েছেন বা যত সমীক্ষা হয়েছে কেউই সে কথা বলেনি। তাদের অনুমান পুরো কাল্পনিক এমনও বলছি না। অন্তত এটুকু মানতে দ্বিধা নেই যে তৃণমূল কংগ্রেস একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল রূপে আবার ফিরছে শাসকের আসনে। তবে এমন হবে না যে তারা আগের মতো জনসমর্থন পাবে বা তাদের আসন সংখ্যা ২০০ পেরবে। ভোট শতাংশে তারা বিজেপির মতোই কিছুটা পিছু হটবে। তবু, তারা হয়তো ১৭০-১৮০'তে থামবে। 

তৃণমূল কংগ্রেস একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল রূপে আবার ফিরছে এটা যেমন সত্য তেমনই সত্য যে এই রাজ্যে অন্যান্য দলের ক্ষমতা দখলের কোনও সম্ভাবনা  নেই। তারা সাকুল্যে ৪-৫ টি আসন পেতে পারে। লড়াই হবে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান নিয়ে। গোষ্ঠী কোন্দলে দীর্ণ বিজেপি ৪৫-৫০টি আসন পেয়ে তৃতীয় স্থান পেতে পারে বলে আমার অনুমান। নির্বাচনের মুখে সব দলের অন্তরের কম-বেশি ক্ষোভ বাইরে আসে। ওসব কিছু নয় সাধারণভাবে। তবে, বিজেপির অন্তর্কলহ সাধারণ বা সামান্য নয়। তাই সম্ভবত তাদের তৃতীয় হতে হবে।  ৫০-৫৫টি আসন পেয়ে দ্বিতীয় স্থানে থাকতে পারে জোট যদি তারা জোটধর্ম পালন করে। যদি বামেরা তাদের রামপ্রীতি ত্যাগ করে।

এখনও খেলা অনেক বাকি। গোঁজ প্রার্থীদের খেলা, ইভিএমের খেলা, টাকার খেলা, কাদা ও বোমা নিয়ে সব পক্ষের খেলা, সশস্ত্র কেন্দ্রীয় বাহিনির খেলা (যার মধ্যে কেন্দ্রের ও রাজ্যের গোয়েন্দা সংস্থাগুলিও আছে)! তবে সব বিবেচনায় রেখেই অনুমান প্রকাশ করেছি। মে মাসের গোড়ায় দেখব কতটা মিলল এই হিসেব।


Tuesday 16 March 2021

হাতের সুখ!

কফি হাউজ নিপাত যাক

সত‍্য বল


আসলে শিক্ষিতদের টার্গেট করা খুব সহজ। এই যেমন ধরুন কফি হাউসের বাঁদরামি। কফি হাউসে যারা যায়, তারা কেউ স্বাধীনতা-উত্তর ভারতবর্ষের তথ্যগত দিক থেকে অপদার্থতম সরকারকে ভোট দেবেন না সেটা বলাই বাহুল্য। বিশ্ব ক্ষুধা সূচক, মহিলা সুরক্ষা, বেকারত্ব, গণতন্ত্র সূচক- এসব জায়গায় বর্তমান সরকার কী কী পদ্ম ফুটিয়েছেন সেটুকু জানতে সামান্য গুগ্‌ল করলেই চলে। সত্তর বছরের দোতলা বাড়ি কী করে বিক্রি করে কুলাঙ্গার ছেলে বিদেশে ট্রাম্পের পোস্টার বয় হয় সেও দেখা হয়ে গেছে। কিন্তু সামনে ভোট। বাংলা তো চাইই চাই! এক কালে দেশের নবজাগরণের কেন্দ্র। প্রেস্টিজ ইস্যু।

সুতরাং টার্গেট করো শিক্ষিতদের। এদের ভোটের সংখ্যা আর কতই বা হবে! একটা করে শিক্ষিত ডাণ্ডা খাবে, আর একশো'টা অশিক্ষিত হুররে বলে চিল্লিয়ে উঠবে। ওই দেখ, এত পড়াশোনা শিখে ওরা ক্যালানি খাচ্ছে আর পদ্ম ব্যাজ পরে আমি 'জয় মিথ্যেবাদীর জয়' বলতে বলতে ধোকলা খাচ্ছি! আর কে না জানে, গণতন্ত্রে একটা শিক্ষিত ভোট একশো'টা অশিক্ষিতের ভোটের চেয়ে ঠিক ঠিক নিরানব্বইটা কম আর একশো ভাগ হালকা।

সুতরাং, আজ কফি হাউস, কাল প্রেসি, পরশু যাদবপুর, তরশু জেএনইউ- যেখানে শিক্ষিত দেখবে রামপাট কেলাও। এসব হয়ে গেলে বিকেলে যারা বাড়িতে এখনও হারমোনিয়াম নিয়ে 'বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহার' বাজায় তাদের ওপর চড়াও হওয়া যাবে। ডাণ্ডা মেরে ঠাণ্ডা করতে হবে এদের। আর অবশ্যই সংখ্যা বাড়াতে হবে। দিলুদা নিদান দিয়েই দিয়েছেন। আগে সংখ্যা। তারপর সব কিছু। এরা যত বেশি জানে, তত কম মানে।

অতএব ছয় পার্সেন্ট শিক্ষাখাতে কমে গেল। চোলায় চোলায় জয়ের ভেরি বেজে উঠল এবং কফি হাউসের মতো জায়গায় কয়েকটা জানোয়ার দাপিয়ে বেড়ালো। এরপরেও কিছু বাঙালি ১৯৪৭ দেখাবে, গোপাল পাঁঠা দেখাবে। মোটামুটি পঞ্চাশ বছর আগে থাইয়ের ধারে যে ফোঁড়াটা হয়েছিল সেটা এখন সেফটিপিন দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তুলতে হবে। বিষ ওগরাতে না জানলে কীসের দেশপ্রেমিক ভাই!

সুতরাং, নিউ কলকাতায় আপনাকে স্বাগত। নেতাজীর লাথি খাওয়া, রবিদাদুর খিস্তি খাওয়া, স্বাধীনতা সংগ্রামে ব্রিটিশদের পোঁদ চাটা, ধর্ষকদের সমর্থনে একাধিক মিছিল বের করা দেশের অপদার্থতম সরকারকে সমর্থন করে নিজের দেশপ্রেমের পরিচয় দিন। বাঙালি হলে লাথি অবশ্যই পুরস্কারস্বরূপ পেয়ে যাবেন। ত্রিপুরায় যেমন দেশপ্রেম এবং বাঙালি প্রেমের নমুনা দেখলেন। ও, ভক্তদের তো আবার তথ্যের ওপর অ্যালার্জি আছে। একটু ক্ষমাঘেন্না করে গুগ্‌ল করে নেবেন আর কি।

সুতরাং কফি হাউসে গুন্ডামি হয়েছে, বলুন বেশ করেছে। আঁতেল পাবলিক যত্তসব! দেশের কোন কাজে লাগে এরা! সিয়াচেন গেছে কোনওদিন! সুনীল গাঙ্গুলি, শক্তি চাটুজ্জে এরা কেন গিয়ে পড়ে থাকত এসব জায়গায়! খালি বাঙালিদের পেছনে টেনে রেখেছিল এরা। সাহিত্য গান এসব করে কী হবে! দুটো নোবেল আসবে, তাতে দেশের কী আসবে যাবে! রাজাবাজারে লোকে হেলমেট পরবে? সুতরাং স্বাধীনতা সংগ্ৰামে যাদের প্রতি ঘর থেকে একজন করে শহীদ হয়েছে, যাদের লেখা গল্প কবিতা সঙ্গীত ট্রাম্পের দেশেও আলোড়ন ফেলে, সেই মিথ‍্যেবাদী বেনিয়াদের শরণে আসতেই হবে। তবেই প্রতি পাড়ায় একজন করে বিপ্লবী আর দুজন করে সাহিত্যিকের কলকাতা আবার জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে। যেমন কাশ্মীর নিয়েছে বা সব কালো টাকা ধুমধাম করে সাদা হয়ে গেছে।

আসলে ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি বাপ ঠাকুর্দার সম্পত্তি যে ছেলে রাখতে পারে না সে কুলাঙ্গার। এমন শিক্ষের ক‍্যাঁতায় আগুন! এই ছেলে হল সাচ্চা দেশপ্রেমী! কী বলছেন? হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন। এই শিক্ষা রেখেই বা কী হবে! দে বেচে দে! বিএইচইউ'এর প্রফেসর নীতা আম্বানি। এরপরেও বলবেন ভক্তরা পড়াশোনা করে না!

কী বললেন? বেসরকারি হলে পরিষেবা ভালো হবে? সাধু সাধু। যবে থেকে এই ধোঁয়া উঠেছে, দেশের প্রধান দেশপ্রেমিক আম্বানি এবং আদানিদের সম্পত্তি গ্যাসের দামের চেয়েও তীব্রগতিতে বেড়ে চলেছে! এক শতাংশ মানুষের হাতে দেশের ৫৮.৪ শতাংশ সম্পদ। দশ শতাংশের হাতে ৮০.৭ শতাংশ। শুধু তাই নয় রে ভাই, ২০১৪'তে পৃথিবীর পঞ্চম দ্রুততম বৃদ্ধিশীল অর্থনীতি ২০২০'তে এসে ১৬৪। কী ভালো লোক মশাই!

এখন তো আবার ব্যাপারটা কুইনাইন খাওয়ার মতো হয়ে যাচ্ছে। দেশ এবং দশের ভালোর জন্য সরকার উত্তমমধ্যম আইন করছে আর যাদের জন্য করছে, তারা রাস্তায় বসে পড়ছে! কেজরিওয়ালকে বললাম, সাতখানা স্টেডিয়াম জেল বানিয়ে দে! দেশদ্রোহী বলে শুনল না। এখন তো ব্যাঙ্কের দেশদ্রোহীগুলোও ধর্মঘট ডাকছে! তবে চিন্তার কিছু নেই। ডাণ্ডা মেরে সবাইকে ঠান্ডা করে দেওয়া হবে। কফি হাউসে গুন্ডামি তো সবে শুরু! তারপর সেডিশন আছে যার সংখ্যা বেকার সংখ্যার মতোই চড়চড় করে বেড়ে চলেছে।

যাক গে, ওসব বেফালতু কথা ছাড়ুন। ও, বলছিলাম ছেলের চাকরিটা হয়ে গেলে বলবেন কাশ্মীরে জমিটা যেন এবার কিনে রাখে। কী বললেন? চাকরি খুঁজছে? গত অক্টোবরে বেকারত্বের হার ৩৭.৮ শতাংশ ছিল? ২০১৯-২০'তে ৩৯.৪ শতাংশ? ফাটিয়ে দিলেন তো মশাই! কী বলছেন? সব ওদের জন্য? হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিকই বলছেন। সব ওদের জন্য। গণ্ডা গণ্ডা বাচ্চা পয়দা করবে, হুটপাট ঢুকে এসে আমাদের দেশের জনসংখ্যা বাড়িয়ে দেবে! যত নষ্টের গোড়া ওইগুলো! কী বলছেন? হতাশায় হাত পা নিশপিশ করছে?

ওই দেখুন শিক্ষিতদের দল। ওদের কানের গোড়ায় দিলে পাল্টা গান গাইতে পারবে, যুক্তি দিতে আসবে। কিন্তু পাল্টা মার দিতে পারবে না। সুতরাং হাতের সুখ করে আসুন। জীবনে এভাবেই শান্তি ফিরে আসবে।

জোরসে বলুন, ভারত মাতা কি জ্যায়!!

Tuesday 9 March 2021

বিভাজনকারীদের রুখতে

এই মুহূর্তে কেন বৃহত্তর বাম জোট জরুরি

শোভনলাল চক্রবর্তী


বাম-কংগ্রেস ও ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্টের (আইএসএফ) মধ্যে হওয়া জোট নিয়ে বামপন্থী সহ অন্যান্য মানুষের মনে অনেক প্রশ্ন উঠেছে, সেগুলির উত্তর পাওয়া জরুরি। বিশেষ করে আজ যখন একটা ফ্যাসিস্ট শক্তি আমাদের দরজায় এসে  কড়া নাড়ছে। কে বা কারা এই শক্তিকে বাংলার মাটিতে খাল কেটে কুমির আনার মতো করে এনেছে, সে সব কূটকচালি এখন  থাক। কারণ, বিপদ আজ ঘাড়ের উপর। তাই পুরনো কাসুন্দি ঘেঁটে কোনও সুরাহা হবে না। বরং সরাসরি প্রসঙ্গে আসা যাক। 

শুরুতে দুটি প্রশ্ন রাখতে চাই। প্রথম প্রশ্ন, আপনারা কি মনে করেন, রামকৃষ্ণ মিশন, রাম মন্দির ন্যাস, ইসকন, ভারত সেবাশ্রম- এরা সবাই আলাদা প্রতিষ্ঠান নাকি মনে করেন এরা সবাই এক? উত্তরে বেশির ভাগই বলবেন যে আলাদা; তবে সবগুলিই হিন্দু ধর্মের অনুসারী, অতএব বৃহত্তর ক্ষেত্রে অভিন্ন। এবার দ্বিতীয় প্রশ্ন, সিপিএম, সিপিআই, লিবারেশন এই দলগুলি কি আলাদা না এক? এর উত্তরেও ওই একই কথা বলতে হয় যে, আলাদা, তবে বৃহত্তর বামপন্থার ছাতার তলায় এক। এখানে একটা সামান্য পার্থক্য আছে। রামকৃষ্ণ মিশন, ইসকন ইত্যাদি যেমন সবাই এককাট্টা যে  'মোদি হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়', বামপন্থী দলগুলি কিন্তু আজও একটি কমন মিনিমাম প্রোগ্রামে এক হতে পারেনি। তাদের লাল ঝাণ্ডাগুলো এক জায়গায় আনতে পারেনি। দেশে যদি অন্তত একটি ঐক্যবদ্ধ বাম শক্তি থাকত তাহলে এই অবান্তর জোট ইত্যাদির প্রশ্ন উঠত না। 

এটা কোনও হাসি বা মজার কথা নয় যে, নির্বাচনের আগে বামেদের ব্রিগেড না হলে নির্বাচনের মানহানি হয়। আসলে ব্রিগেড এক অন্য আবেগ। বড় পবিত্র আবেগ। এই ব্রিগেডের প্রস্তুতিতে ফ্ল্যাশ মব হল, নাচ, গান হল। এমনকি তেলেঙ্গানার প্রসঙ্গ উঠল, যে তেলেঙ্গানার নেতা বি টি রনদিভে'কে নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দিয়ে বর্জন করা হয়েছিল তেলেঙ্গানা লাইন। সবই ওই পবিত্র আবেগের বশে। আসলে ক্রমশ পিছিয়ে পড়তে পড়তে একটা বড় লাফ মারার চেষ্টা। যারা ব্রিগেডের ভিড়ে ছিলেন, তাঁরা কি জানতেন না বামফ্রন্ট ক্ষমতায় এলে অনেকটাই থাকবে কংগ্রেসের হাতে, আইএসএফ'এর হাতে? নিশ্চয়ই জানেন। তাহলে? আসলে তাঁরা দেখতে চান সেই দলটির পতন যারা তাঁদের ২৩৫ থেকে নামিয়ে দিয়েছিল ৩৫-এ। সুজন-সেলিম পেরেছেন তৃণমূলের বিরুদ্ধে এই প্রতিহিংসার আগুন সমর্থকদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে। তারা যে কোনও মূল্যে মমতার শাসনের অবসান চায়। সেই মূল্যেই তারা টুম্পা সোনা লিখে ফেলতে পারে, সেই মূল্যেই তারা আব্বাস ভাইজানের কথায় উদ্বেল হয়ে উঠতে পারে। এর মধ্যে কোনও রাজনীতি নেই। গতবার তারা ভেবেছিল আব্বাস যথেষ্ট শক্তিশালী নয়, তাই ভোট সরে গিয়ে পড়েছিল বিজেপির ঘরে। সংসদীয় গণতন্ত্রে কে কখন কার হাত বা আঁচল বা কোঁচা ধরবে তার কোনও ব্যাকরণ নেই। ক্ষমতা দখল যখন পাখির চোখ তখন কার সঙ্গে জোট করছি তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে না। কেউ কি কস্মিনকালেও ভেবেছিলেন, কংগ্রেস-শিবসেনা জোট হবে বা বিএসপি-বিজেপি? কিংবা অটলজি প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন তৃণমূল-বিজেপি জোট? সংসদীয় গণতন্ত্রের এটাই মজা, এই ব্যবস্থাটা সর্বংসহা। দেখবেন, টুম্পা সোনা থেকে আব্বাস সিদ্দিকি সব সহ্য হয়ে যাবে সময়ের সাথে। 

পরস্পর বিপরীত মতের, দলের, মানুষ কীভাবে হাত ধরাধরি করে চলেন, সেটা দেখার আদর্শ জায়গা পার্লামেন্ট। লড়াইটা যখন মসনদের গদির, তখন কোনও স্থায়ী শত্রু বা বন্ধু বলে কেউ নেই। এক ঝটকায় আব্বাস এসে পড়ায় এত কথা উঠছে, তবে ওই যে, সব সয়ে যাবে। এখন প্রশ্ন হল, তাহলে সেই সব স্বপ্নগুলোর কী হবে? সেই যে যৌথ খামার, গরম ভাত আর লাল ঝাণ্ডা? খেতে পাওয়ার প্রাচুর্যের সঙ্গে না খেতে পাওয়া ভুখা পেটের লড়াইয়ের কী হবে? সেই আলোর পথযাত্রীরা নিশ্চয় আছেন, তবে তার সঙ্গে এই আব্বাস আর টুম্পা সোনা মিশিয়ে ফেলবেন না, দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন পথ। 

একবার দেখা যাক এই রাজ্যে বাম শক্তির অবস্থাটা কেমন। প্রথম বড় শক্তি বামফ্রন্ট। তাঁদের অবস্থান পার্লামেন্টে একরকম, সেখানে নোটবন্দি থেকে কৃষি বিল, সব ক্ষেত্রে বামপন্থী আর তৃণমূলের সাংসদরা এককাট্টা। কিন্তু রাজ্যে বামেদের অবস্থান তৃণমূল বিরোধী। গত ১৫ দিনের 'গণশক্তি' ওল্টালেই দেখতে পাবেন- সেখানে ৮০ শতাংশ লেখা তৃণমূল বিরোধী আর ২০ শতাংশ বিজেপি বিরোধী। দলের ঘোষিত নীতি বিজেপি-তৃণমূল, মানে বিজেমূল হাটাও। এই রাজ্যের দ্বিতীয় শক্তিশালী বামপন্থী সিপিআইএমএল লিবারেশন, যারা বিহার নির্বাচনে আরজেডি'র সঙ্গে জোট করেছিল। লিবারেশন মনে করে তৃণমূলের হাজারও ত্রুটি বিচ্যুতি আছে, তথাপি বিজেপি'র সঙ্গে আগে লড়াই করা দরকার। বিহারে যাঁরা মহাজোটে ছিলেন, এখানে বামজোটে তাঁরা নেই। তাঁরা জানিয়েছেন, স্বল্প সংখ্যক আসনে তাঁরা সরাসরি প্রতিযোগিতা করবেন, বাকি আসনে যে যেখানে জিততে পারেন, তাঁকে সেখানে জেতানোর আবেদন করবেন। একই আবেদন রাখবেন সিপিআইএমএল রেড স্টার। এখানে লক্ষণীয়, এই শেষোক্ত দুই দল কিন্তু একসঙ্গে মোর্চা করতে পারেনি এবং ভাঙর পাওয়ার গ্রিডের আন্দোলনের মধ্য পর্যায় থেকে সিপিএম-এর সঙ্গে রেড স্টারের যে সখ্য তৈরি হয়েছিল, তা আপাতত উধাও। এছাড়াও বামফ্রন্টের বাইরের বহু বাম সংগঠনের একটা বড় অংশ 'নো ভোট টু বিজেপি' প্রচার চালাচ্ছে এবং তাদের পরিধি উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে চলেছে। সর্বভারতীয় স্তরের কৃষক আন্দোলনের নেতারা এই প্রচারে নিজেদের যুক্ত করেছেন। ফ্যাসিবাদকে চিহ্নিত করে আরএসএস-বিজেপির বিরুদ্ধে তাঁরা একজোট হতে সহমত হয়েছেন। এই হচ্ছে এবারের ভোটে বিভিন্ন বামশক্তির অবস্থান। 

এর বিপরীতে প্রতিটি পুজো, রাসমেলা, নাম সংকীর্তন-এ সারা বছর ধরে বিজেপি-আরএসএস নিবিড় প্রচার চালিয়েছে- 'হিন্দু খতরে মে হ্যায়'। এই প্রচার তারা মজ্জায় ঢুকিয়ে দিয়েছে, তাদের কোনও বিভেদ নেই, কোনও মতান্তর তাদের প্রচার প্রসারের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে না। এই শক্তি যদি বামজোটের থাকত তবে নিশ্চিত করে বলা যেত যে বাংলায় বিজেপি খতরে মে হ্যায়। কিন্তু এই বিজেপি নামক দলটিকে যাঁরা চেনেন তাঁরা জানেন, ভোট জেতার জন্য নীতি নৈতিকতার যে কোনও অতল গহ্বরে নামতে এরা প্রস্তুত। সুতরাং, বাংলায় দল ভাঙিয়ে, নির্বাচন কমিশনকে চাপে রেখে যদি কাজ না হয় তাহলে দাঙ্গা, জঙ্গি আক্রমণ অথবা প্রশান্ত কিশোর যেমন বলেছেন, কেন্দ্রীয় বাহিনীর উপর আক্রমণ পর্যন্ত হতে পারে। এই সব ঘটনা ঘটিয়ে একটা জাতীয়তাবাদী সুরসুরি দিয়ে জনগণকে দলে টানার শেষ চেষ্টা হবে। বামপন্থীদের তাই উচিত, অবিলম্বে বৃহত্তর জোট তৈরি করে আগে এই ফ্যাসিস্ট শক্তি বিজেপি'কে ঠেকানো, তৃণমূলের সঙ্গে ইগোর লড়াই পরে লড়া যাবে।


Sunday 7 March 2021

সদুপদেশ

গুরু-শিষ্য সংবাদ

অরুণাভ ঘোষ


আড়াই হাত লম্বা সাদা দাড়ি নিয়ে গেরুয়া বসনে সন্ন্যাসী মোদিজি উচ্চাসনে বসে আছেন। নিচে পদতলে বসে ভক্তগণ মোদিজীর দিনের বাণী শোনার জন্য। তাদের মধ্যে থেকে মুহুর্মুহু উঠে আসছে 'জয় শ্রীরাম' স্লোগান।

দিনের বাণী শুরু করতে গিয়ে ভক্তগণের উদ্দেশ্যে মোদিজী বললেন,

'হে ভক্তগণ,

আপনাদের মধ্যে একটি অশুভ গুঞ্জন প্রায়ই শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। তা হল, যুক্তির পথে নেতাদের, বিশেষ করে আমার, কার্যকলাপ বুঝতে গিয়ে আপনারা নাকি আজকাল খেই হারিয়ে ফেলছেন। তাই আপনাদের সামনে আজ রাজনীতি এবং ধর্মনীতির গোড়ার কথা একটু খুলে বলব যাতে আপনাদের যুক্তিবাদী মন আমাদের মুখ থেকে মাঝে মাঝে বিপরীত কথা শুনে বিভ্রান্ত না হয়ে পড়ে।

আপনাদের মধ্য থেকে প্রায়ই অভিযোগ শোনা যায় যে আমি নাকি কথায় যা বলি বাস্তবে তার ঠিক বিপরীত কাজটাই করে থাকি। যেমন চীনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কোলাকুলি করার কিছুদিন পরেই ওদের সঙ্গে আমাদের সীমান্ত নিয়ে ঝামেলা বেঁধে গেল। পাকিস্তান আমাদের শত্রু দেশ বলে চিহ্নিত। অথচ আমি ওদের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের মেয়ের বিয়েতে বিনা আমন্ত্রণে চলে গিয়েছিলাম  এবং জনসমক্ষে ঘনিষ্ঠ কোলাকুলি সেরে ফেলি। বেশ কিছুদিন আগে আমি ঘোষণা করেছিলাম যে রেল ছোটবেলা থেকে আমার জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। তাই রেলওয়ে বিলগ্নিকরণ করার কোনও প্রশ্নই উঠে না। এখন আমার সরকার ভারতীয় রেলের এক বৃহৎ অংশকে ব্যক্তিগত মালিকানার কাছে বিক্রি করে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। একদিকে যখন চীনাদের  হাতে আমাদের কুড়িজন ভারতীয় সেনা নৃশংস ভাবে মারা গেলেন আমাদেরই জমিতে, তখন আমি বলেছি যে চীনারা আমাদের ভূখণ্ডে পা রাখেনি। মহাত্মা গান্ধীকে একদিকে আমি যখন বলছি 'জাতির জনক' তখন একই সঙ্গে পাশাপাশি আমার দলের লোকেরা নাথুরাম গডস'এর নামে জয়ধ্বনি দিচ্ছে। 

প্রধানমন্ত্রী হবার আগে আমি বলেছিলাম জিএসটি ভারতবর্ষে সর্বনাশ ডেকে আনবে, এখন বলছি জিএসটি'ই শেষ কথা ভারতবর্ষের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য। ক্ষমতায় আসার আগে মনমোহন সিং সরকারের ৫১ শতাংশ বিদেশি বিনিয়োগ করার সিদ্ধান্তকে ধিক্কার জানিয়ে আমি বলেছিলাম যে এতে দেশের সর্বনাশ হবে। এখন বলছি, দেশের উন্নতি সাধনে ১০০ শতাংশ বিদেশি বিনিয়োগ দরকার যা আমার সরকার অনুমোদন করেছে। 

আমার নামে অভিযোগ যে আমার নাকি দুটি জন্মতারিখ। প্রথমটা ২৯ আগস্ট ১৯৪৯ যা আমার গ্রাজুয়েশন সার্টিফিকেটে লেখা আছে, বিরোধীরা যাকে জাল বলে অভিহিত করে; দ্বিতীয় তারিখটি হল ১৭ সেপ্টেম্বর, যা আমি আমার নির্বাচনী হলফনামায় দাখিল করেছিলাম। আমার বিরুদ্ধে বিরোধীদের অভিযোগ হল, আমি যখন ৬ বছর বয়সে ভাঁড়ে চা বিক্রি করতাম ট্রেনের কামরার বাইরে ভবনগর রেল স্টেশনে, সেখানে ওই নামে কোনও স্টেশনই ছিল না। ভারতীয় রেলের রেকর্ড অনুযায়ী ভবনগর স্টেশনটির উদ্বোধন হয় ১৯৭০ সালে, যখন আমার বয়স ছিল ২১ কি ২২। ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৭৭ সাল অবধি আমি দেশে জরুরি অবস্থার সময় গ্রেফতার এড়াতে  আত্মগোপন করেছিলাম। ১৯৭৮ সালে আমি স্নাতক হই। বিরোধীরা প্রশ্ন তোলে, দু' বছর আত্মগোপন করার পর, কোনও ক্লাস না করে আমি কী করে পরীক্ষায় বসলাম এবং পাস করে গেলাম। এটা কী করে হয়? ১৯৮৩ সালে আমি গুজরাত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে 'Entire Political Science'এ স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পাই যা পৃথিবীর কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয় না। অভিযোগ, এমন কোনও মানুষকে আমি দেখাতে পারিনি যারা এসে বলবে যে তারা আমায় পড়িয়েছেন অথবা আমার সঙ্গে  স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ক্লাসে পড়াশোনা করেছেন। এটা ঠিক যে আমি একটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বলেছি, আমি ক্লাস টেন'এর গণ্ডি পেরোইনি ঘর থেকে পালিয়ে যাবার কারণে। তাই অনেকে আমাকে 'নন ম্যাট্রিক গ্রাজুয়েট' বলে থাকে। প্রধানমন্ত্রী হবার পর যখন প্রশ্ন উঠল আমার শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে, তখন মন্ত্রী অরুণ জেটলি আমার স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর পরীক্ষার দুটি মার্কশিট প্রকাশ করেন যা মাইক্রোসফট কম্পিউটারে ছাপা, যে কম্পিউটার ১৯৯০ সালে ভারতে আসে। প্রশ্ন ওঠে, ১৯৭৮ ও ১৯৮৩ সালের পরীক্ষার সার্টিফিকেট কী করে ছাপা হয় সেই সময়ে ১৯৯০ সালের বিদেশি মাইক্রোসফট কম্পিউটারের মাধ্যমে?

এবার আমি বলি?

আমার এই কথা আর কাজের ফারাকের ব্যাপারটা হল গিয়ে টাকার এ-পিঠ আর ও-পিঠের মতো। এ-পিঠে একরকম ছাপ আবার ও-পিঠে আরেক রকম ছাপ। কিন্তু ছাপ আলাদা বলে তো টাকাটা আলাদা নয়। এ-পিঠেও টাকা, ও-পিঠেও সেই টাকা। আপনারা যে মুহূর্তে যুক্তির ছুরি শানিয়ে চুলচেরা বিচারে বসবেন, তখনই বস্তুর খণ্ড রূপটি চোখের সামনে বড় হয়ে দেখা দেবে। অমনি ভ্রান্তি আসবে। মায়ের বাঁ বুকের দুধে পুষ্টি বেশি, না ডান বুকের দুধে বেশি, খিদের সময় ছেলে যদি তার মায়ের বুক ফালাফালা করে চিরে বিচার করতে যায় তাহলে কি তার খিদে মেটে? নাকি শেষ পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে? ছেলের খিদে মেটা নিয়ে কথা, তা এ বুকের দুধেও মিটবে, ও বুকের দুধেও মিটবে। তার আবার অত চুলচেরা হিসাবে যাওয়া কেন? বিচার নয়, বিশ্বাস চাই। বিচারের পথ বড় শক্ত পথ। ও বড় কঠিন পথ। ও পথে চলতে গেলে বিদ্যে চাই, বুদ্ধি চাই, নিজের ওপর আস্থা চাই। ওটা হল কাকের পথ। কাক ডিমে তা দেবে, তার কত আয়োজন। খড় আনো, কুটো আনো, শক্ত জায়গায় ভালো করে বাসা বাঁধো। তবে ডিম পেরে তা দিতে বসো। কিন্তু কোকিলের অতশত বালাই নেই। সে কাকের বাসায় ডিম পেড়ে রেখে এসেই খালাস। তার অটল বিশ্বাস, এ ডিম ফুটে বাচ্চা হবেই, যেই তা দিক। এটা হল সহজ পথ। বর্তমানে আমাদেরও এই রকম সহজ পথ- 'বিশ্বাসের পথ'।

পূজারী বামুন নারায়ণ শিলাকে কখনও চাদরের খুঁটে বেঁধে, কখনও বা ফুলের সাজিতে বসিয়ে নিয়ে যায়। তারপর বাড়িতে গিয়ে সেই শালগ্রামটিকে টাটে বসিয়ে দেয়। আমি হচ্ছি সেই শালগেরাম। আমাকে টাটে বসানোই হল আপনাদের কাজ। তা আপনারা 'জয় শ্রীরাম' স্লোগান তুলেই বসান বা অন্য কোনও পথে বসান, তাতে শালগ্রামের কিছু এসে যায় না। তিনি গদিতে বসতে পেলেই খুশি। এর মধ্যে বিভ্রান্তি ঘটার  অবকাশ কোথায়? বরের লক্ষ্য ছাদনাতলা। তা আপনারা বরকে মোটরে করেই নিয়ে যান, নৌকো করেই নিয়ে যান আর পালকি করেই পৌঁছে দিন, বর গিয়ে ছাদনাতলায় দাঁড়াতে পারলেই হল। এর মধ্যে বিভ্রান্তিটা আসছে কোথায়?

পোয়াতির ব্যথা উঠেছে। একেবারে এখন তখন। তাকে হাসপাতালে নিতে হবে। তখন কি অ্যাম্বুলেন্স আসছে না বলে তাকে ঘরে ফেলে রাখবে? আমার গদিতে বসার ব্যাপারটাও ওই পোয়াতির গর্ভযন্ত্রণার মতোই আর্জেন্ট। কবে জনগণ চাইবে তার জন্য অপেক্ষা করা মূর্খতা। আদর্শের ভিত্তিতে ক্ষমতা দখল হলে ভালো, যদি তা না হয় তাহলে বিপরীত আদর্শের কোলে চেপেই ক্ষমতায় আমাকে বসিয়ে দিতে হবে।

আশা করি এই রূপ সদুপদেশ পেয়ে আপনাদের ভ্রান্তি দূর হয়েছে। এবার হৃষ্টচিত্তে যে যার এলাকায় ফিরে গিয়ে মনোযোগ সহকারে কাজে নেমে পড়ুন। জয় শ্রীরাম।

গৌরকিশোর ঘোষের 'গুরু শিষ্য সংবাদ'এর ছায়া অবলম্বনে।

 

Friday 5 March 2021

একুশের ভোট

কিছু বেয়াদপি কথা

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


পশ্চিমবঙ্গের আগামী বিধানসভা নির্বাচনের প্রস্তুতি ও প্রচারে এবারে এমন কিছু নতুন বৈশিষ্ট্য ধরা দিয়েছে যার এক সুদূরপ্রসারী প্রভাব তৈরি হচ্ছে। সারা দুনিয়া এবং এ দেশও যে বিবিধ সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, এই নবতর বৈশিষ্ট্যগুলি নানা অর্থে তারই স্বাক্ষর বহন করে। যেমন,

এক) এবারে টিভি সিরিয়াল ও চলচ্চিত্র অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অতি বেশি পরিমাণে এ দল সে দলে যোগ দিতে দেখা যাচ্ছে। এরা সকলেই কম-বেশি গড় মাপের অভিনেতা, মুখশ্রী দিয়ে পরিচিত এবং ব্যতিক্রমী কয়েকজনকে বাদ দিলে অধিকাংশই প্রার্থী হতে অথবা কোনও পদ অভিলাষে মুখর। একজন তো বেশ জোর গলায় জানালেন যে তিনি সমাজকে বুঝতে বুঝতে ও যুঝতে যুঝতে প্রথমে সিপিএম, তারপর তৃণমূল এবং অবশেষে বিজেপি'তে এসে ভিড়েছেন। এবং ভেড়ার সময়গুলি, খেয়াল করে দেখুন, বেশ মোক্ষম; ঠিক পালাবদলের সন্ধিক্ষণে যখন একটা ধারণা দেওয়ার চেষ্টা চলেছে যে এবারে আরেকটি পরিবর্তন আসতে চলেছে। সে তেনারা তাঁদের মতো হিসেব-নিকেশ বুঝে যা করার করুন, কিন্তু প্রশ্নটা হল, কী এমন সময় বা আবহ এল যে এইভাবে কাতারে কাতারে অভিনেতারা রাজনৈতিক দলগুলির প্রতি এতটা অনুরক্ত হয়ে পড়লেন?

এক সময় শোনা যেত, গ্রামের মানুষেরা নাকি ‘মাছভাত’এর লোভে ব্রিগেডের সভায় ভিড় জমাতেন। এও জানি, এ পোড়া বাংলায় কোনও বাঙালি কাউকে একবেলা দু’ মুঠো খাওয়াতে কখনও কার্পণ্য করেনি। পেটে টান বুঝি, কিন্তু নাড়ি ধরে টান? গরিবের দু’ মুঠো মাছভাত খাওয়ার বাসনায় ‘লোভ’ দেখলে, ‘নীচতা’ দেখলে, কিন্তু কতটা লোভে নাড়ির টান উগড়ে হঠাৎ রামভক্ত হয়ে পড়া, তা দেখলে কী?

এ এখন দিনের আলোর মতো পরিষ্কার যে আজকের দিনে ক্ষমতাধারী পার্টি করা বা কাউন্সিলর, এমএলএ-এমপি হওয়ার অর্থ এমন এক বিপুল ও অকল্পনীয় রোজগার এবং সামাজিক-রাজনৈতিক প্রতিপত্তি অর্জন যা নিজ পেশা থেকে (দু-একজন কৃতী বাদে) সকলে করতে সক্ষম হন না। তাই ইদানীং রাজনৈতিকে দলে ভেড়া ও প্রার্থী হওয়ার এত হিড়িক। কিন্তু আশ্চর্যের হলেও ঘটনা হল, রাজনৈতিক দলগুলির কাছে অভিনয় জগতের মানুষেরা একটা অতি-বাড়তি গুরুত্ব পাচ্ছেন। কেন? সম্ভবত, তাদের গ্ল্যামার, মুখশ্রী ও কারও কারও ক্ষেত্রে কোনও বিশেষ চরিত্রে অভিনয়ের গুণে একটা আলাদা কদর গড়ে ওঠার কারণে। মনে করা হচ্ছে, এই বিশেষ বৈশিষ্ট্য, গুণাবলী ও সুশ্রী মুখায়ব হেতু ভোটের গুনতিতে উর্ধ্বগতি আসবে।

অর্থাৎ, ধরে নেওয়া হচ্ছে, ভোট পাওয়া-না পাওয়া হল এক মায়া-মোহের খেলা। কতটা ইল্যুশন তৈরি করা গেল অথবা কতটা স্বপ্নসম অনুষঙ্গে ধরে ফেলা গেল ভোটারের মন – খেলাটা যেন সেইখানে। কিন্তু বলি কী, যদি সেভাবে কেউ ভেবে থাকেন, তাহলে গুড়ে বালি। যদিচ, আজকের রাজনৈতিক-অর্থনীতির পরিধিতে দলগুলির তরফে কিছু জনকল্যাণমূলক ও সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প দেওয়া ছাড়া বিশেষ কিছু করার নেই (কেন, সে আলোচনায় পরে আসব); বরং, বহু কিছুকে (গণতান্ত্রিক অধিকার, অর্থনৈতিক সুরক্ষা, সামাজিক-সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা) আইনি বা বেআইনি উপায়ে বাতিল করার অভিসন্ধি ও উদ্যোগ রয়েছে, এমতাবস্থায়, রাজনীতির ময়দানকে চটকদার, চমকদার বা ‘রহস্য-রোমাঞ্চে’ ভরপুর করে না তোলা ছাড়া তাদের কাছে কি আর কোনও রাস্তা আছে? কিন্তু এখানেই কিছুটা গোল বেঁধেছে। সাধারণ, শ্রমজীবী মানুষ (যারা ভোটারও বটে) কিন্তু এই রঙ্গ-তামাসা বোঝেন। তাঁদের একটা ভোট-প্রতিক্রিয়া বেশ সজোরে ও সবলে আছে। ২০১৯’এর লোকসভা নির্বাচনে এ রাজ্যে কিন্তু তেমন প্রতিক্রিয়ার আঁচ শাসক নেতারা পেয়েছেন। এসব কেউ কেউ বুঝছেন, কেউ বা হয়তো এখনও নয়! হঠাৎ রাজনৈতিক দলে যোগ দেওয়া অভিনেতাদের দিয়ে শেষ পর্যন্ত কতটা কী হাসিল হবে সে কথাটি কিন্তু আমজনতা সম্ভবত ভালই জানেন।

দুই) প্রশ্ন উঠেছে, যে দলের প্রার্থীকে ভোট দিলাম, তিনি জেতার পর সে দলে থাকবেন তো? ধরা যাক, চরম বিভাজনকারী দল বিজেপিকে হারাতে ভোটাররা তাদের প্রতিপক্ষকে বেশ জোরালো ভাবে ভোট দিলেন, শুধু ভোট দিলেন না, অন্যান্য ভোটারদের মধ্যে প্রচারও করলেন এবং বেশ কিছু ভোট সংগ্রহও করে দিলেন। কিন্তু যিনি জিতলেন, দেখা গেল তিনি ভোটের পর সদলবলে বিজেপি’তেই যোগ দিলেন। তাহলে হাতে কি পেন্সিলটুকুও থাকবে?

দল বদল যখন ছেলেখেলার মতো হয়ে উঠেছে; দলগুলির এক বড় অংশের নেতারা মনে করছেন, এ দল থেকে সে দলে যাওয়া-আসা দুপুরে লাঞ্চ, রাতে ডিনার করার মতো, তখন ভোটাররাই বা তেমন করে ভাবতে গররাজি থাকবেন কেন? অর্থাৎ, দলগুলির মধ্যে কার্যত কোনও ফারাক নেই- যে কারণে কোনও ব্যক্তির দল বদলে কোনও মতাদর্শগত বা রাজনৈতিক সমস্যা হচ্ছে না। এমনকি বামপন্থী দলগুলি থেকেও দল বদল এত আকছার হচ্ছে যে আজ আর তাকে নিতান্তই দু-একটি ব্যতিক্রম মাত্র, বলা যাচ্ছে না।

অতএব, স্পষ্ট করে নিন যে, রাজনৈতিক-অর্থনীতির পরিসরটা এতটাই একীভূত ও নির্দিষ্ট হয়ে উঠেছে, সেখানে এই রাজনৈতিক দলগুলির আর বিশেষ কিছু করার নেই; তা চলেছে এমন এক আপন আত্মহারা গতিতে, তখন খুব স্বাভাবিক, তাদের তরফে একে অন্যের থেকে আলাদা করে নতুন কিছু আর বলার থাকছে না। তাই দল বদলও হয়ে গেছে ডাল-ভাত- যাদের চক্ষুলজ্জা একেবারেই নেই তারা অনায়াসে কাজটি করে ফেলতে পারছেন। অন্যরা রয়ে সয়ে।

তিন) ইতিমধ্যে ইন্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রন্ট (আইএসএফ) নামে একটি নতুন দলের জন্ম হয়েছে এবং তারা বামফ্রন্ট ও কংগ্রেসের সঙ্গে মিলে একটি জোট (সংযুক্ত মোর্চা) তৈরি করেছে। এই দলের আবির্ভাবে এবং বিশেষত এদের মুখ্য কাণ্ডারী ৩৪ বছর বয়সী আব্বাস সিদ্দিকি’কে নিয়ে রীতিমতো সোরগোল শুরু হয়ে গিয়েছে। কেউ বলছেন এরা মৌলবাদী শক্তি- এ কথা বলতে গিয়ে আব্বাস সিদ্দিকি’র কিছু পুরনো ভিডিও-বক্তৃতা তাঁরা সামনে আনছেন। অপর পক্ষ বলছেন, ওনার কিছু বেফাঁস কথাবার্তা আছে বটে, কিন্তু সে সব পুরনো (আর এমন কথা তো বহু রাজনৈতিক নেতারাও বলে থাকেন), নতুন দল তৈরি করার পর তিনি অনেক পরিণত ও সতর্ক এবং তেমন কোনও বিপজ্জনক কথাবার্তা আর শোনা যায়নি। উপরন্তু, যে ভাবে আইএসএফ’কে মুসলমান মৌলবাদীদের একটি দল হিসেবে দেখানো হচ্ছে, তাও যথার্থ নয়। কারণ, এ দল ঘোষিত ভাবে নিপীড়িত দলিত, আদিবাসী ও মুসলমানদের মিলিত একটি দল যাদের অন্যতম মুখ্য উদ্দেশ্য- গরিব মানুষের হক তাঁরা নিজেরাই বুঝে নিক।

আইএসএফ’এর উত্থান নিঃসন্দেহে এ রাজ্যে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। এই দলের গড়ন ও কার্যাবলীতে হিন্দু উচ্চবর্ণের আধিপত্যকামী মানসিকতা জোর ধাক্কা খেয়েছে বলে মালুম হচ্ছে। এই প্রথম এমন একটি দল এ রাজ্যে তৈরি হয়ে মূলধারার রাজনীতিতে প্রবেশ পেল যাদের সভাপতি একজন আদিবাসী (শিমুল সোরেন) এবং সম্পাদক একজন মুসলমান (নৌসাদ সিদ্দিকি)। স্বাধীনতার ৭৩ বছর ধরে মূলধারার রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতৃত্বে আমরা বরাবর উচ্চবর্ণ হিন্দুদের একচেটিয়া দখলদারি ও আধিপত্য দেখে এসেছি। তা বামপন্থী দলগুলির ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য। যেন, দলিত, আদিবাসী, মুসলমানেরা ততটা শিক্ষিত নন, ততটা পারদর্শী নন, অতশত বুঝবেন না– এমন একটি সর্বজনীন ধারণাকে বহমান রাখা হয়েছে। তার সঙ্গে এই আতঙ্কও প্রসারিত হয়েছে, উচ্চবর্ণ হিন্দুদের হাতে যদি নেতৃত্ব না থাকে তাহলে ‘ঘোর কলি’! আইএসএফ’এর উত্থান এই প্রবল বর্ণাশ্রম-পীড়িত হিন্দুবাদী মানসিকতাকে সজোরে আঘাত করেছে।

ভবিষ্যতে এই নতুন রাজনীতি কোন খাতে, কীভাবে বইবে তা দেখার আছে। কিন্তু এটা মনে করা অমূলক হবে না যে, মূলত কৃষি ব্যবস্থা থেকে উত্থিত ও নিপীড়িত শ্রমজীবী মানুষের অংশগ্রহণে এই নতুন দলের চলমানতায় এ রাজ্যের অর্থনৈতিক বিকাশে কতকগুলি নতুন ধারণার উদয় হতে পারে যা শ্রমদানকারীদের দিক থেকে সদর্থক। এর পাশাপাশি, এক নতুন ধারার সামাজিক-সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনেরও সূত্রপাত হতে পারে যা এ তাবৎকালের বিভাজনকারী রাজনীতির বিপ্রতীপে একটা সবল ধারা হয়ে উঠতে পারে।

চার) শেষে এসে এই কথাটিই বলার যে (উপরে যার ইঙ্গিত রেখেছি), এ দেশ ও রাজ্য জুড়ে এমন এক এক-মাত্রিক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উদয় হয়ে চলেছে যার রাশ রাজনৈতিক নেতাদের হাতে সে ভাবে আর নেই। এ নিয়ে অন্যত্র আমি বিশদে আলোচনা করেছি। ভবিষ্যতেও করব। এই ছোট পরিসরে এইটুকুই বলার যে, রাজনৈতিক দলগুলির কাছে এখন দুটি মাত্রই সর্বজনীন আয়ুধ আছে যা দিয়ে তারা নিজেদের গ্রহণযোগ্যতাকে সাব্যস্ত করতে পারে: ১) জনকল্যাণমূলক কর্মসূচি (মুখে বলা আর কাজে করার মধ্যে ফারাক রেখেও) ও ২) রাজনৈতিক বাগাড়ম্বরতা (তা উগ্র রক্ষণশীল কর্মধারা থেকে উদারবাদী কার্যসূচি অথবা যা খুশি হতে পারে)। এই দুই আয়োজনের বাইরে তাদের কারও হাতেই নতুন অর্থনৈতিক নীতিসমূহ গড়ে তোলার কোনও উপায় নেই। যেমন, তারা মনে করলেই কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারবে না। তাদের ইচ্ছে-অনিচ্ছের ওপর ভর করে বহু-চর্বিত তথাকথিত শিল্পায়নের ঘোড়াও ছুটবে না। কারণ, রাষ্ট্র বা শাসন-পরিচালনার গোটা অবয়বটাই আজ সাবেকি ভূ-সামরিক-রাজনৈতিক বলয় থেকে ক্রমেই চলে আসছে ভার্চুয়াল-তথ্যভিত্তিক-প্রযুক্তিগত বলয়ে। এর নিয়ন্ত্রণ পুরনো রাষ্ট্রকর্তাদের হাতে আর নেই, তা প্রায়-সম্পূর্ণতই এখন কতিপয় দৈত্যাকার কর্পোরেটদের হাতে। সাবেকি রাষ্ট্রকে মুছে দিয়ে জন্ম নিচ্ছে এক নতুন রাষ্ট্র। এই দুই রাষ্ট্রের মধ্যে, অতএব, আপাতত এক দ্বন্দ্ব-সমাস বিরাজমান। কিন্তু নিকট ভবিষ্যতে সে দ্বন্দ্বের অবসান হবে যখন আরও উন্নত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় আসীন হয়ে নতুন ভার্চুয়াল রাষ্ট্র তার পূর্ণাঙ্গ দখলদারিকে সম্পন্ন করবে।

তবে এই মুহূর্তে এ দেশের আধা-সাবেকি রাষ্ট্রের শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত যে দলটি উগ্র রক্ষণশীল ধর্মীয়-জাতীয়তাবাদের জাঁতাকলে এক সর্বগ্রাসী বিভেদকামী ও অকল্যাণমূলক যাত্রাপথে রয়েছে, তার রথকে পশ্চিমবঙ্গে থামাতে হবে। এ কথা অনস্বীকার্য। কিন্তু সে লড়াই অত সহজ নয়। ‘বিজেপিকে কোনও ভোট নয়’ বলে যারা ভোট নিলেন তারা যেন ভোটে জিতে বিজেপি না হয়ে যায়, সেই বিপদটিকেও মাথায় রাখা অতীব জরুরি।