Sunday 28 November 2021

'গানে ভুবন ভরিয়ে দেব'

'গান কই?'

প্রবুদ্ধ বাগচী


 

হীরক সাম্রাজ্যের কোষাগারে পৌঁছে গুপী-বাঘা যখন দেখল সেই ঘরের মণিমুক্তো ভরা প্রকাণ্ড সিন্দুক পাহারা দিচ্ছে এক অতিকায় বাঘ, তাদের মুখে আর কথা সরছিল না অথচ ভূতের রাজার দেওয়া বরে একমাত্র গান গেয়েই বশ করা সম্ভববাঘমামাকে তখন আতঙ্কিত গুপী নিজেই বলে ওঠে,গান কই?’- সমান সন্ত্রস্ত বাঘা তাকিয়ে থাকে গুপীর দিকে গান কই? অবশ্য ফিল্মে ওই টেনশন পেরিয়ে শেষ অবধি গান আসে গুপীর গলায় আমরা সবাই জানি সেই অনবদ্য গানটি

কিন্তু এইগান কই?’ জিজ্ঞাসাটা সম্প্রতি আমায় খুব উত্তেজিত করে চলেছে ভিতরে ভিতরে সরকারিভাবে উৎসবের মরশুম সদ্য শেষ হল দুগগা পুজো থেকে কালী পুজো হয়ে জগদ্ধাত্রী, কার্তিক- সবই আজকাল একেকটা মেগা ইভেন্ট হয়ে উঠেছে সারা রাজ্য জুড়ে নইলে জগদ্ধাত্রী বা কার্তিক পুজো মূলত রাজ্যের কিছু বাছাই এলাকায় প্রচলিত ছিল কালী ঠাকুরও বারোয়ারি হিসেবে কলকাতায় তেমন চালু ছিল এমন নয় এমনকি ইদানিং ছট পুজোও আমাদের উৎসবের অঙ্গীভূত, যার অনুষঙ্গে তেমন কোনও প্রতিমা বা  মণ্ডপ নেই উত্তর-বিশ্বায়ন পর্বে পুঁজি পুজো দুয়েরই অবাধ চলাচলের রাস্তায় হয়তো বা আজকাল সবুজ বাতি জ্বলে থাকে সব সময়গ্রিন করিডরদিয়ে ছুটে চলা এই মাতোয়ারা উৎসব নিয়ে আমাদের কিছু বলার নেই

বরং বলার কথা এইটাই, বাঙালির পুজোয় গানের একটা ভূমিকা আছে বরাবরই- কথাটা তা নিয়েই দুর্গা পুজো বাঙালিরসেরা উৎসবএমন বলতে গেলে নিশ্চয়ই ঢোঁক গিলতে হবে- তবে বাংলার সমাজ দুর্গাপুজোকে যেভাবে বিবাহিত বাঙালি মেয়েরবাপের বাড়িফিরে আসার সঙ্গে সাংস্কৃতিক ভাবে চিহ্নিত করেছে তা অস্বীকার করা উচিত নয় আর এই ভাবনার সঙ্গেই জুড়ে যায় আগমনী গান, যা বাংলা গানের একটা বহু প্রাচীন ধারা শরৎ ঋতুর উঁকিঝুঁকির সঙ্গে সঙ্গেই আগমনী গান এক সময় ছড়িয়ে পড়ত বাংলার গ্রামে-গঞ্জে অনেক পল্লী গায়ক/গায়িকা এই গান গেয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে জীবিকা নির্বাহ করতেন। প্রচলিত গানের পাশেপাশে অনেক আগমনী গান রচিত হয়েছিল এক সময়, রেকর্ড কোম্পানি তা রেকর্ড হিসেবে প্রকাশ করেছে আটাত্তর আরপিএম ডিস্কে ধীরেন্দ্রনাথ দাসের গাওয়া শঙ্খে শঙ্খে মঙ্গল গাও/ জননী এসেছে দ্বারেএক সময় প্রবল জনপ্রিয় হয়েছিল প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই গান রেকর্ড করেছে সেই জনপ্রিয়তাকে মাথায় রেখেই পাশাপাশি রয়েছে আরও নানা গানের দৃষ্টান্ত খেয়াল রাখতে হবে, এইসব গান কিন্তু ঠিক পাড়ার পুজো প্যান্ডেলে বাজার মতো গান নয় এগুলো মানুষ শুনতেন নিজের বাড়িতে প্যান্ডেলে বাজার জন্য যে গান বরাদ্দ ছিল তা হল বাংলা আধুনিক গানের পুজোর সম্ভার রেকর্ড কোম্পানিগুলো সারা বছর ধরে চেষ্টা করত কে কত ভাল পুজোর গান প্রকাশ করতে পারে- যে গান হিট হলে লক্ষ্মীলাভ নিশ্চিত এইসব গানের সঙ্গে কিন্তু পুজোর পুরাণ-অনুষঙ্গ কোনওদিনই ছিল না মান্না দে- গাওয়াললিতা, ওকে আজ চলে যেতে বল না মতো প্রেমের গান একদা পুজোর গান হিসেবেই বাজার মাত করেছিল এমন ভুরি ভুরি দৃষ্টান্ত আছে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখের এর সঙ্গে তুলনা করা যায় অনেকটা পত্রপত্রিকায় বেরনো শারদ উপন্যাসের অর্থাৎ কিনা, দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতি বিনোদনের যে জগৎ, এগুলোকে সেখানে অনায়াসে জায়গা দেওয়া যায় কিন্তু আগমনী গান নির্দিষ্টভাবে দুর্গা-কেন্দ্রিক রচনা যার কেন্দ্রে আছে উমার সপরিবার বাপের বাড়ি আসা, ভোলানাথ মহাদেবের সঙ্গে তার টানাপোড়েন, মা মেনকার দুশ্চিন্তা বেদনা ইত্যাদি

ঠিক একইভাবে বাংলা গানের আরেকটা ধারা হল শ্যামা-বিষয়ক গান, যাকে আমরা শ্যামাসংগীত বলে চিনে নিয়েছি দেবী হিসেবে দুর্গার উল্লেখ পুরাণে যত প্রত্যক্ষ বা তাঁকে ঘিরে পৌরাণিক আখ্যানের কাহিনি যত সুবিস্তৃত, কালী- ক্ষেত্রে ব্যাপারটা তেমন নয় অনেক নৃতাত্ত্বিক মনে করেন, কালী আসলে অনার্য গোষ্ঠীর পূজিত দেবী- পরে যা আর্যদের সংস্কৃতির মধ্যে আত্মীকৃত হয়েছে রূপক হিসেবে তাই দুর্গার প্রতিমায় যত স্নিগ্ধতা থাকে, তুলনায় কালী প্রতিমার সঙ্গে যুক্ত থাকে কিছুটা শক্তি হিংস্রতাপশুবলি এখনও এই পুজোর প্রায় অনিবার্য অঙ্গ, আজও মনে না পড়ে উপায় নেই, ‘প্রথম আলোউপন্যাসে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বিজ্ঞান সাধক ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকারের মুখে কালী ঠাকুর বিষয়েসাঁওতালি মাগীশব্দ ব্যবহার করেছিলেন বলে তাঁকে মৌলবাদীদের হাতে আদালতেকেসখেতে হয়েছিল কিন্তু এগুলো মনে রাখলেও কালী সাধনা বাংলার এক পুরনো রীতি যা জন্ম দিয়েছে শ্যামাসংগীতের সাধক রামপ্রসাদ সেন-এর শ্যামাবিষয়ক গানগুলি তাই বাংলা গানের মানচিত্রে আলাদা একটা যোজক শুধু নয় তার সুরগত স্বাতন্ত্র্য আলাদা করে চোখে পড়ে রামপ্রসাদী সুর বাংলা গানের সুরের একটা ধারা মনে পড়তে পারে, ‘দেবীছবিতে সত্যজিৎ রায় এই সুরে একটি গান নিজেই রচনা করে ছবিতে ব্যবহার করেছিলেন সিলেবাসে থাকায় রামপ্রসাদের গান বিষয়ে বাংলা ভাষা সাহিত্যের পড়ুয়াদেরও চর্চা করতে হয়   

এখন কথাটা হল, দুর্গাপুজোর আবহে আগমনী গান তৈরি হলেও বারোয়ারি পুজোর প্যান্ডেলে তা সচরাচর বাজানো হয় না আর বিপরীতটা হল, কালীপুজোর বারোয়ারি প্যান্ডেলে মূলত বাজানো হয় শ্যামাসংগীত, সেখানে আধুনিক বাংলা গান বাজানোর উদাহরণ কার্যত নেই সমীক্ষা করলে দেখা যাবে, এই প্যান্ডেলগুলিতে আজও বেজে চলে মূলত পান্নালাল ভট্টাচার্যের স্বর্ণকন্ঠে রেকর্ড করা কিছু চেনা গান এগুলি প্রকাশ হয়েছিল এইচএমভি' একটি লং প্লেয়িং রেকর্ডে, আজ থেকে অনেক বছর আগে রামপ্রসাদ সেন, সাধক কমলাকান্ত প্রমুখদের লেখা কিছু গান এই অ্যালবামে ধরা আছে সাম্প্রতিক কালে কিছু শিল্পী ওই গানগুলিকেই নতুন করে রেকর্ড করে গাইছেন কিন্তু নতুন গান কই? কাজী নজরুল ইসলাম এক সময় কিছু চমৎকার শ্যামাসংগীত লিখেছিলেন- মৃণালকান্তি ঘোষ সেগুলি কিছু কিছু রেকর্ড করেছিলেন, কিন্তু সেইসব গান আজ লুপ্তপ্রায় আজ আমরা প্রায় ধরেই নিয়েছি, কালীপুজোর প্যান্ডেলে অনিবার্য ভাবে শোনা যাবে পান্নালাল ভট্টাচার্যেরঅল টাইম হিটওই গানগুলি কেন এমন হবে? শ্যামা বিষয়ক গান তো বাংলা গানের একটি ধারা- সেই ধারাস্রোত যদি নতুন সুরের প্লাবনে সঞ্জীবিত না হয় তবে কি আর তাতে কোনও প্রাণ থাকে? আমরা যারা পুজো প্যান্ডেলের ধারকাছ না মাড়ালেও মাইক-বাহিত গান শুনতে পাই বা কিছুটা শুনতে বাধ্য হই, তারা যদি নতুন কোনও শ্যামাসংগীতের পিয়াসী হই নিছকই সংগীতের উপভোক্তা হিসেবে তা কি খুব দোষের ব্যাপার?

অথচ গত তিরিশ বছরের মধ্যে আমাদের অভিজ্ঞতার মধ্যে মাত্র একটা শ্যামাসঙ্গীতকে খুব জনপ্রিয় হতে দেখেছি- মান্না দে- কন্ঠে রেকর্ড হওয়াআমায় একটু জায়গা দাও/ মায়ের মন্দিরে বসি’। গানের কথা লিখেছিলেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় আজ অনেক বছর হল পুলকবাবু বা মান্নাবাবু দুজনেই চলে গেছেন কিন্তু তার মানে কি আর নতুন গান হবে না? গান তো একটা ধারাবাহিক সত্তা, সময়ের বাঁকে বাঁকে তার নতুন চেহারায় ফিরে আসার কথা অন্তত ধর্মীয় অনুষঙ্গ যে সব বারোয়ারি পুজোর মৌলিক ভিত্তি আর যে পুজোর প্রচার প্রসার(সেইসঙ্গে জাঁকজমক ) ক্রমশ জ্বালানি তেলের দামের মতোই ঊর্ধ্বমুখি, সেই পুজো-সংস্কৃতির সঙ্গে জুড়ে থাকা গান নিছকই এক পুরনো ইতিহাসের চর্বিতচর্বণ হয়ে থাকলে কোথাও একটা আড়ষ্ট বোধ হয় তার মানে কি এই যে, শুধু সরকারি অনুদান, কর্পোরেট চাঁদা, জাঁকালো মণ্ডপসজ্জা, আলো, প্রতিমা- এইটুকুই শুধু পুজো? বাকি আর কিছু নয়?

বাংলা আধুনিক গানের চর্চা ভাল হোক মন্দ হোক, কিছু একটা আজও হচ্ছে, যদিও দুর্গাপুজোর মণ্ডপে সেইসব গান বাজানো হয় না কিন্তু গানের এই কঙ্কালসার ফসিল হয়ে যাওয়া চেহারাটা সব থেকে প্রকট হতে দেখি অন্য পুজোয় ইদানিং এমনকি জগদ্ধাত্রী পুজোর প্যান্ডেলেওমায়ের পায়ে জবা হয়ে ওঠ না ফুটে মনবেজে চলতে দেখেছি- একেবারে কালী প্রতিমা কেন্দ্রিক গান দিব্যি চালানো হচ্ছে জগদ্ধাত্রী পুজোয়, আসলে যিনি নাকি মা দুর্গারই একটা রূপ! কী চূড়ান্ত গুরুচণ্ডালী ব্যাপারস্যাপার বলুন দেখি? জগদ্ধাত্রীর আরাধনা করার মতো কেউ একটা গান বানাতে পারেনি আজও, পারেনি দেবসেনাপতি কার্তিকের জন্যও সব প্যান্ডেলেই আজও প্রক্সি দিতে হচ্ছে সেই পান্নালাল ভট্টাচার্যকে- এতে পুজোর তুলসীতলা অশুদ্ধ হয় না বুঝি?

পাশাপাশি আরেকটা অভাবের কথাও অনেকদিন ধরেই আমার মনে হয়, ভয়ে ভয়ে বলেই ফেলিমহিষাসুরমর্দিনীগীতি-আলেখ্যটি নিঃসন্দেহে হিন্দু বাঙালি সংস্কৃতির পক্ষে একটি শ্লাঘার বিষয়, যাকেকালজয়ীবললেও খুব বাড়িয়ে বলা হয় না কবীর সুমন বলেছেন, এই আলেখ্যের সুরে কোথাও কোথাও পঙ্কজ কুমার মল্লিক ফজরের আজানের সুরও ব্যবহার করেছেন, তাই সুর সৃষ্টির দিক দিয়ে এটি একেবারেসেকুলার সবই ঠিক আছে কিন্তু যে কোনও ভাল জিনিসও তার অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারে স্বাভাবিক ঔজ্জ্বল্য হারায় যতদিন মহালয়ার ঊষালগ্নে বেতারবাহিত হয়ে তা বাঙালি হিন্দুর ঘরে ঘরে পৌঁছত ততদিন তার একটা আলাদা আবেদন ছিল যেদিন থেকে ওই রেকর্ডিং বেতারকেন্দ্রের আওতার বাইরে বাজারে ক্যাসেট হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে, সেইদিন থেকেই তার আবেদন ফিকে হয়ে গেছে যে কোনও সময় যে কোনও উপলক্ষেমহিষাসুরমর্দিনীযেখানে সেখানে বেজে উঠতে শুনি আমরা- কখনও বা পুজোয় উদ্বোধন হওয়া কোনও ছিট কাপড়ের দোকানে অথবা সন্ধ্যের ভিড় ঘেরা অটো স্ট্যান্ডে বা রক্তদান শিবিরের ঘোষণায় বা কারও মোবাইলের কলার টিউনে স্থান-কাল-পাত্র একাকার হয়ে গেলে কোনও উৎকৃষ্ট শিল্পও তার আস্বাদনের দিক থেকে যাকে বলেঘেঁটে হয়ে যায়’- শুনতে খারাপ লাগলেও বাঙালির সাধেরমহালয়ারও এখন সেই দশা নতুন নতুন গান হোক না, হোক না আরেকটামহিষাসুরমর্দিনী’- তাতে তো বাংলা ধর্মীয় গানের ধারাবাহিকতারই একরকম উদযাপন হতে পারে যতদিন না হয় ততদিন আমরা ওর মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করেই যাব: গান কই?