Monday 30 August 2021

সাবেক মিডিয়ার কৌলিন্য হরণ

দুনিয়াদারির নতুন পর্ব

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


একুশ শতকে মিডিয়ার পরিবর্তন নিয়ে ‘একক মাত্রা’ কতকগুলি উল্লেখযোগ্য সংখ্যা প্রকাশ করেছিল। আজ সেই পরিবর্তনের মাত্রা ও অনুষঙ্গ এতটাই তীব্র, বিবিধ ও আচম্বিত যে তা নিয়ে কিছু একটা ভাবতে ভাবতেই নতুনতর কোনও পরিসরে আমরা প্রবেশ করে যাচ্ছি। কারা একে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, নব কলেবরের দিশারীই বা কে- এইসব ভাবনারও যেন ফুরসত মিলছে না। আমরা এসে পৌঁছে গিয়েছি এমন এক বাতায়নে যেখানে মিডিয়ার নতুন নতুন আঙ্গিকের উদ্ভব সময়ের অপেক্ষা মাত্র, আর তাতে সংযোগ-সওয়ারী হয়ে বার্তা, বিষয় অথবা সংবাদ আদানপ্রদান করছি।

একুশ শতকের গোড়ায় আশঙ্কা ছিল, টেলিভিশন আমাদের মনকে হরণ করছে। টিভি’র মন যেন হয়ে উঠছে আমাদের স্বপ্ন। আমরা তখন সবে এক দশক পার করেছি উদারিকরণের হাওয়ায়। নানা কিসিমের ভোগ্যবস্তুতে ভরে উঠছে মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত এমনকি নিম্ববিত্ত-গরিব মানুষের ঘরদোর। আয়ের থেকে ব্যয় বেড়ে গেলে আছে ‘সহজ কিস্তিতে’ নানাবিধ ঋণ-প্রকল্প। ইএমআই’এর ভরসায় ঝকঝকে দোকানের চকচকে ভোগ্যবস্তুগুলি এসে ঘরের স্থান দখল করে নিচ্ছে। টেলিভিশনের সিরিয়ালের চরিত্রগুলি হয়ে উঠছে আরাধ্য দেবতার মতো। তাদের নাম-মাহাত্ম্য, পোশাকের বাহার হয়ে উঠছে জীবনধারণের অতি-প্রয়োজনীয় দৈনন্দিন বাস্তব। খবরের কাগজের দিকে তরুণ প্রজন্ম যেন আর ফিরে তাকাতে চাইছে না। ভিজ্যুয়াল-ধর্মই হয়ে উঠছে মুখ্য। ক্যামেরা হাতে অনেকেই বেরিয়ে পড়ছে রাস্তাঘাটে আর টিভি’র দুনিয়ায় হরেকরকম দৃশ্য-বিষয় ছেয়ে ফেলছে নাগরিকের মন-মেজাজ।

ঠিক এই সন্ধিক্ষণেই এসে এবার প্রবেশ নেবে সোশ্যাল মিডিয়ার অবতারদ্বয়- প্রথমে অর্কুট (২০০৪) ও পরে ফেসবুক (২০০৮)। গোটা পটটাই যেন এবার উলটে গেল। যা এতদিন ছিল একমুখি- আপনি শ্রোতা, পাঠক অথবা দর্শক- এবার তা হয়ে উঠল দ্বিমুখি, যেখানে আপনি বক্তা, লেখক ও কুশীলবও। এমন এক উন্মুক্ত, বিনি পয়সার প্ল্যাটফর্ম যে সামাজিক পরিসরে আদপে গড়ে উঠতে পারে, তা দশ বছর আগে গড়পড়তা মানুষ কল্পনাও করতে পারেনি। আর তা হতেই শুরু হয়ে গেল তুলকালাম কাণ্ড- দেশে ও বিদেশে। ফেসবুকের দেওয়াল জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল মানুষের আপন আত্মিক বার্তা- জন্ম নিল ঐতিহাসিক তাহরির স্কোয়ার, কিছুদিন পরে শাহবাগ। এ দেশেও ‘লোকপাল’এর দাবিতে দিল্লিতে আন্না হাজারের আন্দোলন, রাজ্যে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের ঐতিহাসিক কালজয়ী পর্ব। তখনও সোশ্যাল মিডিয়ার নেতিবাচকতা ততটা প্রকাশ পায়নি, বহু সরকারও তাদের অবজ্ঞা করছে। শুরু হয়েছে টেলিভিশনের পিছিয়ে পড়ার কাল। খবরের কাগজ আগেই স্তিমিত হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ার প্ল্যাটফর্মগুলি হয়ে উঠল লেখা, পড়া, দেখা ও শোনার এক চণ্ডীমণ্ডপ। ইমেল, অর্কুট, ফেসবুক’এর পিছু পিছু ধেয়ে এল হোয়াটসআপ, ইন্সটাগ্রাম, ট্যুইটার ও ইউটিউব’এর দঙ্গল।

বলাই বাহুল্য, এই সর্বজনীন ও সার্বিক পরিবর্তন এ তাবৎকালের সমস্ত হিসেবপত্রকে ওলটপালট করে দিল। তা শুধু মিডিয়ার খোলনলচে বদলে দেওয়াই নয়, রাজনীতি, অর্থনীতি, শাসনব্যবস্থা মায় রাষ্ট্রের ভূমিকাকেই বড়সড় প্রশ্নের মুখে ফেলে দিল। উপরন্তু, সোশ্যাল মিডিয়া ও ভার্চুয়াল দুনিয়ার কর্পোরেটকুল ক্রমশই হয়ে উঠল এমন এক সর্বংসহা যা সাবেক রাষ্ট্রের অস্তিত্বকেই বিপন্ন করে তুলল। এই পরিপ্রেক্ষিতেই আজকের মিডিয়ার বাস্তবতাকে আমরা অবলোকন করতে পারি।

প্রথমত, ‘গোদি মিডিয়া’ বলে আমরা বিগ মিডিয়ার কুৎসিত স্বার্থবাহী মিডিয়াকুলকে যতই গাল পাড়ি না কেন, বাস্তবতা হল, এদের প্রভাব ও কার্যকারিতা প্রায় শূন্যের ঘরে এসে ঠেকেছে। অর্ণব গোস্বামী জাতীয় সঞ্চালকেরা যতই চিল-চিৎকার জুড়ে গালিগালাজ ও নৌটঙ্কি করে আমজনতার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করুন না কেন, চিড়ে আর ভিজছে না। ইতিমধ্যেই এসে গেছে নানা ধরনের ইউটিউব চ্যানেল যেখানে এক বা একাধিক ব্যক্তিরা মিলে ভিডিও-ভাষ্য বানিয়ে ও তা পেশ করে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে গেছেন। যেমন, এই মুহূর্তে চোখ বুজে ধ্রুব রাঠি, সাক্ষী যোশী, আকাশ ব্যানার্জি, অজিত অঞ্জুম সহ বহু সঞ্চালকের নাম করা যায় যাদের ইউটিউব-ভিডিও’র জনপ্রিয়তা সমস্ত টিভি চ্যানেলগুলিকে রীতিমতো লজ্জায় ফেলে দেবে। কারও সাবস্ক্রিপশন ৫ লক্ষ তো কারও বা ৫০ লক্ষ। ‘The Lallantop’ বলে একটি হিন্দি ইউটিউব চ্যানেলের সাবস্ক্রিপশন তো ১ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। এনারা যখন কোনও বিষয়ের ওপর কোনও ভিডিও আপলোড করেন, দেখা যায়, পাঁচ মিনিটের মধ্যে সেই ভিডিও’র ভিউয়িং ১০,০০০ কি ২০,০০০ ছাড়িয়ে গেছে। আর ভিডিও’র নিচে পড়তে থাকে অগুনতি মন্তব্য যা থেকে স্পষ্ট হয় যে এঁদের বক্তব্যকে মানুষ সমাদর করছেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সমালোচনা ও গালিগালাজও থাকে, যা উপাদেয় ও স্বাস্থ্যকর। এনারা মূলত দেশের সমসাময়িক রাজনীতি, অর্থনীতি, মানুষের নানাবিধ আন্দোলন, নির্বাচন এইসব নিয়েই নিজেদের মতামত রাখেন, কখনও কখনও প্যানেল-আলোচনা বা সাক্ষাৎকারও থাকে, কখনও ঘটনাক্ষেত্র থেকে বাস্তব প্রতিবেদন।

বাংলা ভাষাতেও কতকগুলি চ্যানেল বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। যেমন, ‘হঠাৎ যদি উঠল কথা’ এবং ‘এন কে ডিজিটাল’। এরা ঘটতে থাকা নানাবিধ বাস্তবতা নিয়ে দশ-পনের কি বিশ মিনিটের ভাষ্য তৈরি করে ইউটিউব চ্যানেলে আপলোড করে দেন। এদেরও সাবস্ক্রিপশন লাখের ওপর। মাস দুয়েকের বেশি হল, ‘শত ফুল’ নামে নতুন একটি ইউটিউব চ্যানেল ভিন্ন আঙ্গিকে এমন এক উপস্থাপনা হাজির করেছে যার দ্রুত জনপ্রিয়তা বাংলা ভাষী দর্শকদের মধ্যে নিঃসন্দেহে এক নতুন প্রবাহের জন্ম দেবে। তা এই অর্থে যে, শুধুমাত্র বাস্তব ঘটনাবলীকে আশ্রয় করে ভাষ্য-নির্মাণ নয়, বরং ঈষৎ গভীরে প্রবেশ করে চারপাশে বদলে যাওয়া পরিসর ও নতুন চিন্তার ভূমিকে উদ্ভাসিত করা। এই কাজ নিঃসন্দেহে এক চ্যালেঞ্জ। এর সাফল্যের ওপর নির্ভর করছে বাংলা ভাষী মানুষের মৌলিক চিন্তার ক্ষেত্রটির উর্বর হয়ে ওঠার প্রসঙ্গ।

দ্বিতীয়ত, একাডেমিক পণ্ডিত ও পশ্চিমমুখি নানা ধরনের আঁতেলদের ভাবনাচিন্তার পাশাপাশি সাধারণ মানুষজনও যে মৌলিক ও উন্নত ভাবনায় জারিত, তা মিডিয়ার এই নতুন পরিসরে শুধুমাত্র যে জানা গেল তাই নয়, এই মানুষেরা তাঁদের বক্তব্যের প্রাসঙ্গিকতা ও বিচক্ষণতায় বহুজনের কাছে ভরসাযোগ্যও হলেন। এতদিন প্রভাবশালীরা ‘যত্তসব’ নচ্ছার ও ফ্যাতাড়ুদের বড় জোর কবিতা লেখা অবধি সহ্য করেছেন, এমনকি কবিতার জগৎ’টা মূলত এদেরই- এই পর্যন্ত মান্যতাও দিয়েছেন। আরও সামান্য প্রসারিত করে গল্প-উপন্যাস অবধিও আসতে বলেছেন। কিন্তু প্রবন্ধ? সমাজ নিয়ে ভাবনাচিন্তা? নৈব নৈব চ! অলিখিত বিশ্বাস হল, পেছনে বিশ্ববিদ্যালয়ের বড়সড় ছাপ না থাকলে সমাজ-ভাবনায় হাত দেওয়া যাবে না! অথচ মজার ব্যাপার, সমাজ নিয়ে যারা সোরগোল ফেলেছেন, সমাজকে ওলটপালট করে দিয়েছেন, তাদের কারও পেছনে কিন্তু তেমন বিশেষ বিশ্ববিদ্যালয় বা একাডেমিক প্রতিষ্ঠানের ছাপ্পা নেই। বরং উল্টে, তাঁদের চিন্তাভাবনাই আজ বহু একাডেমিক পাঠ্য ও গবেষণার বিষয়। এমনতর নাম পরপর আসতেই থাকবে- স্বামী বিবেকানন্দ, গান্ধী, সুভাষচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, জয়প্রকাশ নারায়ণ, চারু মজুমদার প্রমুখ। এনারা অনেক বড় পরিধি জুড়ে ব্যাপ্ত। স্বভাবতই, ছোট পরিধিতেও এরকম নাম-না জানা বহু মানুষ ছড়িয়ে আছেন। আজকের মিডিয়া সুযোগ দিয়েছে এইসব অজানা মানুষের চিন্তাভাবনাকেও বহুজনের কাছে পৌঁছে দেওয়ার, স্বীকৃতি পাওয়ার এবং গৃহীত হওয়ার। বলতেই পারি, চিন্তার একাধিপত্যের ওপর এ এক সবল আঘাত।

তৃতীয়ত, সোশ্যাল মিডিয়ার দুনিয়াই এখন রাজ করবে, অন্তত কিছুকাল তো বটেই। এর অনেক টানাপোড়েনও আছে। কিন্তু আপাতত এর দুটি অভিঘাত অতীব তীব্র। এক, সাবেক মিডিয়ার যে ঘরানা ছিল- খবরের কাগজ-টিভি ইত্যাদি সহযোগে লেখক-পাঠক এবং কুশীলব-দর্শক প্যাটার্নে একমুখি গ্রহণের একটি সম্পর্ক- তা আজ অবসানের পথে। এটি যদি প্রথম অভিঘাত হয় তাহলে দ্বিতীয়টি হল, লেখক ও পাঠক এবং কুশীলব ও দর্শক এক দেহে লীন হয়ে এক সর্বজনীন রূপ পরিগ্রহ করেছে যেখানে যে লেখক সেই পাঠক অথবা যে কুশীলব সেই দর্শক (ও তদ্বিপরীত)। নতুন সৃষ্ট এই পরিসরটি শুধুমাত্র বোধ ও চর্চার জগতেই আমূল পরিবর্তন আনেনি, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ-সংস্কৃতির খোলনলচে’টাকেই বদলে দেওয়ার পথ ধরেছে। তাই, গোদি মিডিয়া যতই যা হল্লা করুক, অথবা গেরুয়া আইটি সেলের মিথ্যাচার চলুক, আজ ভবী আর অত সহজে ভোলার নয়! অবশ্য, কথাগুলি যত সহজে ও অনায়াসে পেশ করলাম, বাস্তবতা তেমন নিশ্চয়ই নয়। কিন্তু, প্রবণতাটি স্পষ্ট।

চতুর্থত, তাহলে কি আমাদের পাঠ, দর্শন, শ্রবণ সবই ভার্চুয়াল জগতের মাধ্যমেই হবে? সোশ্যাল মিডিয়াই কি আমাদের বিচরণের একমাত্র মাধ্যম হয়ে উঠবে? এমনটা বললে তা হবে অতি-সরলীকরণ। প্রত্যেক মিডিয়ার নিজস্বতা আছে, আকর্ষণ ও বিনোদন আছে। যখন চলচ্চিত্র এসেছিল, অনেকে ভেবেছিলেন নাট্যশালা বুঝি উঠে যাবে। ঠিক একইভাবে, টিভি’র আগমনের সময় বহুজনে চলচ্চিত্র শিল্পের অশনি সঙ্কেত দেখেছিলেন। কিন্তু অমন সরলরেখায় কিছু হয়নি। সব মাধ্যমই তার নিজ বৈশিষ্ট্য গুণেই টিকে থাকে; কিন্তু হ্যাঁ, অবশ্যই নতুন মাধ্যমের আগমনে পুরনো মাধ্যমে কিছু পরিবর্তন আসে। যেমন, রেডিও’র সেই পুরনোকালের ‘ক’, ‘খ’, ‘গ’ স্টেশনগুলির আর জনপ্রিয়তা নেই, কিন্তু এফএম’এর হাত ধরে রেডিও আবার পুনর্জাগরিত। এও বাস্তব, বহু ছবিঘর আজ বন্ধ হয়ে গেছে, আবার নতুন ধরনের ছবিকক্ষের উদ্ভবও ঘটেছে। আজ ভার্চুয়াল জগতে সোশ্যাল মিডিয়ার উত্থানে ও সেখানে জনবিস্ফোরণের কারণে, মনে হতেই পারে যে সাবেক মাধ্যমগুলি বুঝি অচল হয়ে গেল। কিন্তু বাস্তবতা সে কথা বলে না। এত চেষ্টা করেও তো ই-বুক এখনও মুদ্রিত বইয়ের বিকল্প হতে পারেনি। ওটিটি প্ল্যাটফর্ম জনপ্রিয় হলেও ভাল ছবি দেখতে এখনও তো আমরা সেই ছবিঘরেই যাই (হতে পারে আইনক্স)! নাটকের মঞ্চও তো অদৃশ্য হয়ে যায়নি।

তাই আছে, বহু মাত্রিকতার মাধুর্য, আকর্ষণ ও বিষয়াদি আছে। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়া যে একমাত্রিক দাতা-গ্রহীতার কৌলিন্য হরণ করে তাকে সর্বজনীনতা দিয়েছে- গ্রামের কোণে পড়ে থাকা অজানা মেয়ের প্রতিভাকে বিশ্বের দরবারে পেশ করার সাধ্যি, দেহাতি কৃষকের ভাবনার গভীরতায় লুকোনো সমাজ-উন্নয়নের অভিনব পথকে উদ্ভাসনের সুযোগ- তাকে অস্বীকার করি কী উপায়ে? 

             

Friday 27 August 2021

গোঙানি

যন্ত্রণাকর সময়ের উচ্চারণ

সোমা ঘোষ বিশ্বাস


মানুষের গভীরের এক শব্দ- গোঙানি। গভীর যন্ত্রণার শব্দ। সে শব্দের কোনও শ্রোতা নেই। তার কোনও বৈচিত্র্য নেই। তার আঘাত আছে। বারবার বুকে এসে লাগা ঢেউয়ের মতো, পৌনঃপুনিক অস্তিত্ব আছে। 

আইসিইউ'এর বাইরে বসে সারাদিন গোঙানির শব্দ শুনেছি। তার মধ্যে একজন ছিলেন আমার মা। এখনও সেই গোঙানির শব্দ হঠাৎ কখনও কখনও মনের অদৃশ্য কোনও কোণ থেকে জেগে ওঠে। স্তব্ধ হয়ে যাই ক্ষণিকের তরে। গভীর দুঃখ আরও একবার নিজেকে জানিয়ে মিলিয়ে যায়। বলে যায়, আমিও আছি। 

গোঙানির কোনও মানে নেই। প্রকাশ আছে। সেই প্রকাশে সুখ আছে। মানুষ শব্দের কাছে এতটাই ঋণী। সব শেষ হতে হতে এইটুকুকেও অন্তত সে আঁকড়ে থাকতে চায়। যন্ত্রণা যেন সেইটুকুতেই নিজেকে জানান দেয়। ওতে যন্ত্রণা কমে না, কিন্তু মনের মধ্যে একটা আরাম হয়। আত্মপ্রকাশের আরাম। 

যে মানুষ দীর্ঘদিন কথা বন্ধ হয়ে পড়ে আছে বিছানায়, তার পাশে বসে থেকেছি। গোঙানির শব্দই তার অবশিষ্ট ভাষা। সেই তার প্রকাশ। চোখ বন্ধ করে কী এক অদ্ভুত শব্দ জন্ম দিয়ে চলেছে। ওইটুকুই তার সম্বল। সুস্থ মানুষ গোঙানির শব্দে বিরক্ত হয়। তার কাছে তো অনেক শব্দ। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এটা সেটা নিয়ে থাকলেই হল। কিন্তু যে মানুষ প্রান্ত সময়ে এসে ঠেকেছে অথবা যার যন্ত্রণায় দিক ভুল হয়েছে, সে কী করবে? তার ওটুকু যে না থাকলেই নয়। এমন অনেক বয়স্ক মানুষ দেখেছি, সারাদিন শুয়ে শুয়ে গোঙিয়ে যান। তাঁর বাড়িতে তিনি ও অন্যান্যদের সঙ্গে দেখা করে রাস্তায় নেমেছি, জানালা দিয়ে তাঁর গোঙানির শব্দ আসছে। অটোর জন্যে অপেক্ষা করছি। আশপাশে কাকের ডাক, রিকশা-সাইকেল-গাড়ি কত কিছুর শব্দ। মানুষের কত কথা। তার মধ্যে একজন কেউ গোঙিয়ে যাচ্ছে। অর্থহীন শব্দ। কিন্তু কী গভীর যন্ত্রণা! অসহায়তা। কারও সময় নেই শোনার।

হাসপাতালে এ অভিজ্ঞতা হয় সব চাইতে বেশি। মাথার কাছে মা বসে, বাচ্চাটা গোঙিয়ে যাচ্ছে। মা অসহায়ের মতো অন্যদিকে তাকিয়ে বসে। সারা পৃথিবীর সব শব্দ অর্থহীন সেই মুহূর্তে তাঁর কাছে। তাঁর কানে শুধু ওই একটি গোঙানির শব্দই অক্ষরব্রহ্ম। মাঝে মাঝে বাচ্চাটার মাথায় হাত রাখছেন। আবার বাইরের দিকে তাকাচ্ছেন। এক করুণাহীন সময়ের আবর্ত ঘুরেই চলেছে। যার একমাত্র বাঙ্ময় প্রকাশ গোঙানি।

সবার ভাগ্যে গোঙানিতে সাড়া দেওয়ার মানুষ থাকে কই? মানুষ যখন আর কোনও মানবিক শব্দ না পেয়ে শুধুমাত্র একটি আদিম শব্দ উচ্চারণ করে যাচ্ছে, যে শব্দের মানে খুঁজতে কোনও অভিধান লাগে না, যে শব্দের অর্থ মানুষ কিছুতেই ভোলে না, সে শব্দের যে অসহায় হাত, সেটা ধরার মানুষ কি সবাই পায়? গোঙানি তাই ব্যর্থ হয়ে ফিরে ফিরে তারই কাছে আসতে থাকে।

শুধু কি মানুষ? গোঙানিতে আমরা সবার সমান। রাস্তার পাশে পা ভেঙে কুকুরের গোঙানি শুনেছি। কাতরভাবে তাকাচ্ছে এদিক ওদিক। যদি কেউ সাহায্য করে। অথবা, হয়তো কোনও সাহায্যই চায় না। শুধু জানিয়ে যাচ্ছে গোঙানিতে নিজের গভীরতম যন্ত্রণার কথা। জানি না। তবে সে গোঙানির শব্দ ভুলেছি কই? সব কান্না শেষ হলে জন্মায় গোঙানি। কান্নার তবু কিছু দাবি থাকে, অভিমান থাকে, কিন্তু গোঙানির সেটুকুও থাকে না। তার নিঃসঙ্গতাতেও কোনও ক্ষোভ নেই। তার অভিমান নেই। সে শুধু আছে। 

উপনিষদের ঋষিরা জেনেছিলেন, সমস্ত সৃষ্টির আদিতে ছিল এক শব্দ। সেই নাকি আদি সত্য। বুদ্ধ বললেন, দুঃখ, সেই সত্য। তবে কি বুদ্ধ সৃষ্টির গভীরে কোনও গোঙানির শব্দ শুনেছিলেন? এক গভীর যন্ত্রণা, এক অব্যক্ত ব্যথা থেকে মুক্তির আকুতি। গোঙানি মুক্তি চায়। দুঃখ আছে- এ সত্য নিয়ে সংশয় জাগে না। তাই, পৃথিবীর গভীরে এক গোঙানিও আছে। আদি অথবা অন্তিম শব্দ।


Thursday 26 August 2021

ক্রুসেড'এর ধারাবাহিকতা

তালিবান, তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ?

শোভনলাল চক্রবর্তী


জগদীশচন্দ্র বসু তাঁর 'অব্যক্ত' গ্রন্থের 'ভাগীরথীর উৎস-সন্ধানে' প্রবন্ধে যখন নদীকে প্রশ্ন করেছিলেন, 'নদী তুমি কোথা হইতে আসিতেছ?', তখন উত্তর পেয়েছিলেন, 'মহাদেবের জটা হইতে।' আমাদের শিরোনামের এমন সহজ উত্তর পেলে বড় ভালো হত। কিন্তু এ এক রক্তবীজ, যার জন্মান্তর ঘটে বারবার। গেলাম আর বোমা মেরে নিশ্চিহ্ন করে এলাম- সে প্রতিপক্ষ এরা নয়। এদের দেখলে মাইকেল হয়তো রামচন্দ্রের জায়গায় এদের বসিয়ে দিয়ে বলতেন, মরিয়া না মরে, এ কেমন বৈরী। 

ইতিহাস সন্দেহাতীত ভাবে নির্মম। সেই ইতিহাস বলে, মধ্য ও ভারতীয় উপমহাদেশের ইসলামি সন্ত্রাস আসলে আমেরিকা ও তার লেজুড় দেশগুলির অন্ধ, নির্বিচার আঘাতের বিরুদ্ধে এক ধরনের অন্ধ ও নির্মম প্রত্যাঘাত। ব্রিটিশ-মার্কিন মিলিত বাহিনী ইরাকে যে অপপ্রয়াস চালায়, তাকেই ইসলামি জঙ্গি সংগঠনের ধাত্রী বলা যেতে পারে। ২০১৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিদায়ী প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে যখন ইসলামি জঙ্গি সংগঠন নিয়ে প্রশ্ন করা হয়, তখন তিনি তাদের সম্পর্কে এক আপাত অবজ্ঞা প্রকাশ করেন, যা আসলে ছিল ওই জঙ্গি সংগঠনগুলিকে বোমা মেরে উড়িয়ে দিয়ে তাদের বিষদাঁত উপরে ফেলতে না পারার দরুণ এক চরম ব্যর্থতার হতাশা। ওবামা বর্ণিত সামান্য কয়েকজন 'খুনি'র জন্য আমেরিকাকে লড়তে হয়েছে প্রায় একটা বিষযুদ্ধ। সারা দুনিয়া জুড়ে ঘুরে ঘুরে জোটাতে হয়েছে সঙ্গী। এত করেও শেষ করা যায়নি ইসলামি জঙ্গি সংগঠনের ক্রিয়াকলাপ। 

রাজনৈতিক স্বৈরাচারই রাজনৈতিক ইসলামের নিয়তি কিনা, সে বিচার করবে সময়। বর্তমানে তালিবান সহ ইসলামি জঙ্গি সংগঠনগুলি আদতে একটি ইসলামি খিলাফতের স্বপ্ন রচনা করেছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে  অটোমান খলিফার পরাজয়ের পর থেকে মুসলিম বিশ্বে ইসলামের হারানো সুদিন ফিরে পাওয়ার যে আকুতি ছিল, তাকে উসকে দিয়েছে। দেশে দেশে মুসলিম যুবকরা যে ভাবে সেই স্বপ্নের টানে ইসলামি জঙ্গি সংগঠনে যোগ দিয়েছে তার হিসেব করা শক্ত। যে ভাবে এই যুবকরা জেহাদে অংশ নিয়ে শহিদ হতে ঝাঁকে ঝাঁকে দৌড়েছে, তা সেই মিলেনারিয়ান স্বপ্নের অমোঘ আকর্ষণকেই প্রতিপন্ন করে। দশম- একাদশ শতাব্দীর ধর্মযুদ্ধের যুগে যা ইসলামকে প্রাণিত, তাড়িত করেছিল। এই যোগদানের পেছনে অতিরিক্ত তাড়না হিসেবে সক্রিয় থেকেছে ইসলাম আতঙ্ক এবং অবশ্যই নাগরিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত, দারিদ্র পীড়িত, ধর্মীয় বৈষম্যে জর্জরিত, আত্মপরিচয় উন্মুখ এক জনগোষ্ঠীর মরিয়া প্রতিকারকামিতা। 

কেন রাষ্ট্রীয় সমানাধিকারের ঢক্কানিনাদ এবং সাম্য, স্বাধীনতা, সৌভ্রাতৃত্বের গালভরা বুলির চেয়ে ইসলামের সাম্যাদর্শ এই তরুণদের কাছে বেশি আকর্ষণীয় মনে হচ্ছে, সেই আত্মসমীক্ষা করার সময় এসেছে। আসলে এদের বর্বরতাকে ধিক্কার জানানো খুব সহজ। সত্যিই হাত, পা, গলা কাটা, কিংবা নির্বিকার চিত্তে মানুষ খুনের ভিডিওগুলি ভয়ঙ্কর। কিন্তু একবার মনে করে দেখুন তো, মার্কিন বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্রে যখন মেসোপটেমিয়া, সুমের ও ব্যাবিলন ধূলিসাৎ হচ্ছিল, যখন আফগানিস্তানকে বোমায় বোমায় প্রস্তর যুগে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখন পশ্চিমি মিডিয়ার ক্যামেরাগুলো কোথায় লুকনো ছিল? 

আচ্ছা, মেসোপটেমিয়াকে কে ইরাক বানালো? কে গড়ে তুলল ইসলামের দুই পবিত্রতম তীর্থ মক্কা, মদিনার দখল নিয়ে তৈরি কাল্পনিক ভূখণ্ডে সৌদি আরব এবং তার শাসক হিসেবে বৈধতা দিল সৌদি সর্দারদের, যাঁরা সবচেয়ে গোঁড়া? প্রতিক্রিয়াশীল সুন্নি ইসলামকে পরবর্তী একশো বছর ধরে ওয়াহাবি ও সালাফি মতাদর্শে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে দূষিত করে ইসলামের মধ্যযুগীয় উদারনীতি ধ্বংস করে দিল কারা? অবশ্যই ইউরোপিয় পাশ্চাত্য, বিশেষত ব্রিটেন এবং ফ্রান্স, যারা পরাজিত অটোমান খলিফার সাম্রাজ্যকে ইচ্ছেমতো টুকরো করে মানচিত্রে পেন্সিল দাগিয়ে সম্পূর্ণ একতরফা ভাবে পশ্চিম এশিয়ার এক একটি মুসলিম রাষ্ট্রের ভূখণ্ড ও সীমানা নির্ধারণ করার অনুমতি আদায় করেছিল লিগ অফ নেশনস'এর কাছ থেকে। 

এখনও যে  তালিবান সহ ইসলামি জঙ্গি সংগঠনগুলির তীর শুধুই শিয়া ইসলামের দিকে তাক করা, তার পেছনে কি সৌদি পেট্রো ডলারের হাত নেই? যে পশ্চিমি সভ্যতা ইসলাম ধর্মকে প্রাচীনতর অন্যান্য সেমেটিক ধর্ম থেকে টুকে মেরে দেওয়া বলে অপবাদ দিয়েছিল, একশো বছরেরও বেশি সময় ধরে ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ লড়েছিল, তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার কোনও দায় এদের নেই। এরা গোটা পশ্চিমকে, তাদের সমাজ, সংস্কৃতি, শিক্ষা সব কিছুকে 'হারাম' বলে ঘৃণা করে। মুশকিল এই যে, গুলি মেরে খিলাফতের স্বপ্ন মুসলিম মানস ও চৈতন্য থেকে ঘুচিয়ে দেওয়া অসম্ভব। স্যামুয়েল হাটিংটনের 'সভ্যতার সংঘাত' বিষয়ক তত্ত্বটি এ ক্ষেত্রে এখনও দীর্ঘকাল বৈধ থাকবে বলে মনে হয়। 

ইউরোপিয় ও মার্কিন নয়া-উপনিবেশবাদীরা মুসলিম প্রাচ্যকে নিজের প্রয়োজনে শোষণ করার ধনবাদী প্রবণতা রোধ করতে অপারগ। আর এই প্রবণতা যতদিন সক্রিয় থাকবে, এডওয়ার্ড সাঈদ কথিত প্রাচ্যবাদী বাচন যত দিন পাশ্চাত্য মেধা ও মননকে ইসলামের প্রতি তাচ্ছিল্য ও ঘৃণার মনোভাব নিয়ে তাকাতে প্ররোচিত করবে, ইউরোপিয় চেতনার আনাচে-কানাচে লুকিয়ে থাকা ক্রুসেড মানসিকতা যত দিন ইসলামোফোবিয়ায় রূপান্তরিত হতে থাকবে, ততদিন নিছক আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার আঙিনা থেকে রাজনৈতিক ইসলামের হিংসাত্মক ও নাশকতামূলক বিবর্তন রুদ্ধ করা যাবে না।


Wednesday 25 August 2021

জাতীয় সম্পদের নগদ লুঠ

বিমুদ্রাকরণের পর এখন মুদ্রাকরণ

সোমনাথ গুহ


এক বিমুদ্রাকরণের ঠ্যালায় মানুষের এখনও নাভিশ্বাস উঠছে, এবার এল মুদ্রাকরণ- সরকারি সম্পদের মুদ্রাকরণ বা নগদিকরণ। এটা সরকারি সম্পদ বেহাত করার একটা নতুন কল- অ্যাসেট মনেটাইজেশন প্ল্যান। সরকারি অভিধান অনুযায়ী ‘বেহাত’ কথাটা ব্যবহার করা ঠিক নাও হতে পারে, কারণ, কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী পরিষ্কার বলেছেন, কোনও সম্পদ বিক্রি করা হচ্ছে না, মালিকানা সরকারের থাকবে। তিনি এই সম্পদগুলিকে বলছেন de-risk brownfield assets। ব্রাউনফিল্ড অর্থে, অব্যবহৃত বা অল্প ব্যবহৃত সম্পদ যেগুলি ঠিক মতো ব্যবহার না করার ফলে অপচয় হচ্ছে। আয়ের উপায় খুঁজে বার করার জন্য সেগুলিকে বেসরকারি কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়া হবে। উদ্দেশ্যটা হচ্ছে, সে সবের মধ্যে যে বিনিয়োগ তালাবন্দি হয়ে পড়ে আছে তা উন্মুক্ত করা। তারা সেই অব্যবহৃত সম্পদ ব্যবহার করে নতুন উদ্যোগ গড়ে তুলবে। 

মনে করা হচ্ছে যে, স্টার্ট-আপ'এর কোনও খরচ বা নতুন নির্মাণের খরচ না লাগার কারণে বেসরকারি সংস্থা এই সম্পদগুলিকে ব্যবহার করতে উৎসাহী হবে। ডি-রিস্ক মানে বোঝাই যাচ্ছে, ঝুঁকি কমানো, কোনও সম্পদকে নিরাপদ করা, যাতে কোনও ক্ষতি না হয়। একটা সাম্প্রতিক উদাহরণ দেখা যেতে পারে। যেমন, প্রভিডেন্ট ফান্ডে যে লক্ষ কোটি টাকা থাকে সেটা বিশ বছর আগেও সরকারের তহবিলে পড়ে থাকত এবং কর্মচারীরা একটা স্থায়ী হারে তার ওপর সুদ পেত। সরকার মনে করল, এটা ঝুঁকিপূর্ণ। সুতরাং, সেটা সে শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করতে শুরু করল। বিশ বছর আগে এটা ভাবাই যেত না, ইউনিয়ন হল্লা করে দিত। এখন সে রামও নেই অযোধ্যাও নেই! সরকারের একটা আয়ের উপায় খুলে গেল। অপর দিকে কর্মচারীদের সারা জীবনের কষ্টার্জিত উপার্জনের টাকা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেল। এখন সুদ বাজারের সাথে ওঠানামা করে। ২০০০ সালেও পিএফ সুদ ১২ শতাংশ ছিল, এখন ৮.৫ শতাংশ (সুদ কমার অন্য কারণও আছে যেটা এখানে আলোচ্য বিষয় নয়)। পিএফ'এ গচ্ছিত টাকা কর্মচারীদের কিন্তু তহবিলের মালিকানা সরকারের হাতে। কীসে ঝুঁকি আছে, কীসে নেই- সেটা সরকার নিজের মাপকাঠিতে ঠিক করছে। শেয়ারে টাকা খাটানোর ফলে সরকারের লাভ, কিন্তু কর্মচারীর ঝুঁকি। অনেক প্রাইভেট কোম্পানি পেনশনের গচ্ছিত টাকা সিনেমা প্রযোজনায় লাগিয়ে দেয়। যদি দু' চারটে ছবি ফ্লপ হয় তবে পেনশন হরিবোল হয়ে গেল!  

ধরা যাক আমার ফলতার কাছে একটা বাগানবাড়ি আছে। ছুটিছাটাতে সেখানে যাওয়া হয়, বাকি সময় সেটা ফাঁকা পড়ে থাকে। তো আমি সেটাকে ফেলে না রেখে AIRBNB'এর সাথে চুক্তি করলাম। গঙ্গার ধারে সুন্দর মনোরম ব্যবস্থা। AIRBNB সেটা চড়া দামে পর্যটকদের ভাড়া দেওয়া শুরু করল, আমাকে লাভের ২৫ শতাংশ দিল। আমি ভাবলাম, ভালোই তো সম্পত্তিটা পড়ে ছিল, সেটা থেকে এখন ঘরে বসে কিছু উপার্জন হচ্ছে। আমার বন্ধু যেমন তার মারুতি ইকো গাড়ি ছাত্রছাত্রী পরিবহনে কাজে লাগায়। এমনিতে তার পরিবার মাসে কয়েকটা দিন মাত্র সেটা ব্যবহার করত, বাকি সময় সেটা গ্যারেজে পড়ে থাকত। এখন সেটা থেকে তার ভালো আয় হচ্ছে, ব্যাংকের ঋণও চটজলদি শোধ হচ্ছে। 'ওয়ার্ক ফ্রম হোম' চালু হওয়ার পর থেকে বহু কোম্পানির, বিশেষ করে আইটি সেক্টরের অফিস, খালি পড়ে আছে। এই খালি স্পেস ফেলে না রেখে তারা এখন ছোট কোম্পানিকে সেগুলি ভাড়া দিচ্ছে। 

এগুলি সবই ব্যক্তিগত বা বেসরকারি সম্পত্তি ফেলে না রেখে উপার্জনক্ষম করে তোলার কয়েকটি উদাহরণ। শুনে মনে হয় ভালোই তো, সম্পদ ফেলে না রেখে সেটা থেকে যদি উপার্জন হয় তাতে ক্ষতি কী? এই যে গঙ্গার পাড় ধরে আদিম প্রেতাত্মার মতো চটকলগুলো পড়ে আছে, সেগুলি থেকে যদি আয়ের ব্যবস্থা করা যায় তো মন্দ কী?  কিংবা যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন শ্বেতহস্তীর মতো পড়ে থাকে, বছরে মেরেকেটে দশটা খেলা হয়, সেটাকে যদি অন্য কোনও ভাবে ব্যবহার করে ওতে যা বিনিয়োগ হয়েছে তা উশুল করা যায় তাহলে তো ভালোই। কিন্তু সরকার যেটা করছে সেটা হল, অর্থনীতির যে মূল চালিকাশক্তিগুলি যেমন, সড়ক, রেল, জাহাজ বন্দর, বিমানবন্দর, খনি, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও পরিবহন ইত্যাদি- লিজ, ভাড়া, কনসেশনমূলক নানা মডেলের ভিত্তিতে বেসরকারি কোম্পানির হাতে তুলে দিচ্ছে। এটা ভয়ঙ্কর।    

৬ লক্ষ কোটি টাকা বাজার থেকে তোলার জন্য সরকার এই প্রকল্প শুরু করতে চাইছে, যেটা তারা বলছে পরিকাঠামো তৈরি করতে ব্যবহার হবে। দেখা যাক তারা কী কী সম্পদ হস্তান্তর করতে চাইছে:

ক) সড়ক (২৭ শতাংশ) যার থেকে আয় হবে ১,৬০,২০০ কোটি টাকা। এর জন্য ২৬,৭০০ কিমি রাস্তা বেসরকারি কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়া হবে। তারা টোল আদায় করবে, রাস্তার দু' ধারে বাহারি বিপণি, রিসর্ট, ধাবা, বার খুলবে, উপার্জন করবে, একটা লভ্যাংশ সরকারকে দেবে;

খ) রেল (২৫ শতাংশ)- আয় ১,৫২,৪৯৬ কোটি টাকা, ৯০টা প্যাসেঞ্জার ট্রেন, ৪০০টা স্টেশন (নিউ দিল্লি, মুম্বাই সহ) প্রাইভেট কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়া হবে;

গ) টেলিকম (৬ শতাংশ)- আয় ৩৫,১০০ কোটি টাকা, যার জন্য ২,৮৬,০০০ কিমি ভারত নেট ফাইবার নেটওয়ার্ক এবং BSNL ও MTNL'এর ১৪,৯১৭টা মোবাইল টাওয়ার বেসরকারি টেলিকম কোম্পানিকে হস্তান্তর করা হবে;

ঘ) এছাড়া বন্দর, বিমানবন্দর, তেল ও গ্যাসের পাইপলাইন, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও পরিবহন, খনি এমনকি খেলার স্টেডিয়ামও আছে। আশা করা হচ্ছে, আগামী চার বছরে এই প্রকল্প থেকে আয় হবে: 

২০২২: ৮৮,০০০ কোটি টাকা

২০২৩: ১,৬২,০০০ কোটি টাকা

২০২৪: ১,৭৯,০০০ কোটি টাকা

২০২৫: ১,৬৭,০০০ কোটি টাকা। 

এই সব সম্পদই কি অব্যবহৃত? যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনের মতো কিছু স্টেডিয়াম অব্যবহৃত, নিউ দিল্লি স্টেশনও কি তাই? রেলের কোনও হিসাব আছে এই স্টেশন থেকে কত আয় হয়? রাজধানী বা শতাব্দী এক্সপ্রেস কি অলাভজনক? লখনউ থেকে দিল্লি তো বেসরকারি তেজাস এক্সপ্রেস চালু হয়েছে, সাধারণ ট্রেনের থেকে ভাড়া প্রায় ৩০০-৩৫০ টাকা বেড়ে গেছে। এই সব ট্রেন হবে পয়সাওয়ালা মানুষের জন্য, সাধারণের ধরাছোঁয়ার বাইরে। লক্ষাধিক কিমি কেবল লাইন, বিএসএনএল'এর টাওয়ার প্রাইভেট কোম্পানিকে দেওয়া হচ্ছে। অতীতে আমরা দেখেছি, সরকারি নীতির ফলে কী ভাবে বিএসএনএল'কে রুগ্ন করে পুরো টেলিকমের বাজার জিও, এয়ারটেল, ভোডাফোনের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। বিএসএনএল এতদিনে 4G'ও চালু করতে পারল না অথচ তার পরিকাঠামো ব্যবহার করে প্রাইভেট কোম্পানিগুলি রমরমিয়ে চলছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন, পরিবহনের দায় যদি বেসরকারি হাতে যায় তাহলে যে বিদ্যুতের বিল আকাশছোঁয়া হবে এটা নিশ্চিত। এমনিতে কৃষকরা সংশোধিত বিদ্যুৎ বিল ২০২০'র বিরোধিতা করছেন। এই সংশোধনের ফলে বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে বেসরকারি কোম্পানির প্রবেশ ঘটবে, ভর্তুকি রদ হবে এবং সেচের খরচ ৫০০ শতাংশ বেড়ে যাবে। 

প্রকল্পটি একেবারেই স্বচ্ছ নয়, বহু ধূসর জায়গা আছে। প্রথম কথা, সরকার বলছে টাকা নেই; সরকারি সম্পদ ও বেসরকারি পুঁজির মেলবন্ধনে উন্নয়নে জোয়ার আসবে। টাকা নেই কথাটা ক্লিশে হয়ে গেছে। এই অজুহাত দিয়ে রিজার্ভ ব্যাংকের টাকাতেও সরকার হাত দিয়েছে। কিছুদিন আগে বিদেশি মুদ্রা ব্যবহার করারও প্রস্তাব উঠেছিল, যা একমাত্র অর্থনৈতিক জরুরি অবস্থাতেই ব্যবহার করা হয়। হৈ চৈ পড়ে যাওয়াতে ব্যাপারটা ধামাচাপা পড়ে যায়। কোনও স্টেডিয়াম যদি অব্যবহৃত হয়ে পড়ে থাকে, সরকার নিজে সেটা ব্যবহার করে লাভজনক করুক। নিউ টাউনে নিত্য নতুন অফিস হচ্ছে। সেটা না করে চটকলগুলির (এর মধ্যে অধিকাংশরই পুনরায় চালু হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই) যে বিপুল রিয়েল এস্টেট ফেলনা পড়ে আছে, সেগুলো অফিস হিসাবে কেন ভাড়া দেওয়া হয় না! এসব তো সরকার অনায়াসে করতে পারে, বেসরকারি সংস্থার দ্বারস্থ হওয়ার প্রয়োজন কী? উপার্জন বাড়ানোর জন্য আজকে আমেরিকাও কর্পোরেট ট্যাক্স বসাচ্ছে, ভারত সরকারের এ ব্যাপারে এত দ্বিধা কেন? 

দ্বিতীয়ত, এই প্রকল্প কি বিদেশি কোম্পানির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য? ২০০৭ সালে ভোডাফোন উড়ে এসে হাচিনসন এসারকে কিনে নিয়েছিল। এখন টেসলা কোম্পানি যদি বলে হিন্দ মোটরের পরিকাঠামো ব্যবহার করে তারা গাড়ি তৈরি করবে তাহলে কি তাদের অনুমতি দেওয়া হবে? নির্মলা সীতারমন বলছেন, একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য চুক্তির ভিত্তিতে সম্পদ হস্তান্তর হবে। চুক্তিটা ঠিক কী হবে, সরকারের কী লাভ, সম্পদটির রক্ষণাবেক্ষণ কে করবে, নির্দিষ্ট সময়ের পর সম্পদটি যে পুনরায় সরকারের কাছে ফেরত আসবে- এর কী গ্যারান্টি আছে? 

ধরা যাক হাওড়া স্টেশন আম্বানিদের লিজ দেওয়া হল। তাহলে স্টেশনে যাঁরা কাজ করেন তাঁরা কি রেল কর্মচারীই থাকবেন না আম্বানির কর্মচারী হিসাবে গণ্য হবেন? হকারদের কী হবে? ইতিমধ্যে ট্রেনে, স্টেশনে হকার নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব উঠেছে। কোনও সন্দেহই নেই যে সরকার সেদিকে এগোচ্ছে। হাওড়া স্টেশনের ভিতরে এখন খবরের কাগজ খুঁজুন, পাবেন না। কুড়ি টাকা দিয়ে পুরি-তরকারি খাওয়ার হকার খুঁজুন, পাবেন না। বাহারি কাফেতে চেয়ার টেবিলে বসে অন্তত শ' দুয়েক টাকা গচ্চা দিয়ে জলখাবার খেতে হবে। 

কী আহামরি পরিকাঠামো সরকার তৈরি করছে যার জন্য এত টাকার প্রয়োজন? নাগপুরে কুড়ি তলা স্টেশন তৈরি হয়েছে। ট্রেন তো চলবেই এছাড়া দুটো তলা বরাদ্দ মেট্রো রেলের জন্য, বাকি মল, মাল্টিপ্লেক্স, জিম ইত্যাদি। সমাজের কত অংশের মানুষের কাজে লাগবে এসব। সবার মাথার ওপর আচ্ছাদন কি নিশ্চিত হয়েছে? দু' বেলা খাবার, শিক্ষা, স্বাস্থ্য? কথাগুলো হয়তো তামাদি হয়ে গেছে কিন্তু চিরকাল সত্যি। 


Tuesday 24 August 2021

বাইক বহ্নিমান

গতির আনন্দ ও আত্মহনন

প্রদ্যুম্ন বন্দ্যোপাধ্যায়


ইদানীং বেপরোয়া বাইকারদের নিয়ে সরকারি-বেসরকারি নীতি নির্ধারকেরা, নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ, সমাজবিদ এবং এমনকি নাগরিক সমাজও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। প্রতিনিয়ত বাইক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর খবর চোখের সামনে, খবরের কাগজের পাতায়, টিভির সংবাদে এখন প্রায় গতানুগতিক। সরকারের তরফে বেপরোয়া বাইক নিয়ন্ত্রণের নানা কঠোর নিদান দেওয়া হলেও তা কমার কোনও লক্ষণ চোখে পড়ে না। শহর-গঞ্জ-গ্রামে, এখানে-ওখানে ঘটে চলা মৃত্যু সত্ত্বেও এই ভয়ঙ্করের যাত্রাপথে কমবয়সীদের কেনই বা বারবার যাওয়া? 

টিভি'র নিয়মিত সান্ধ্যবাসরে দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান নিয়ে আলোচনা বসে, প্রায় শিল্পকর্মের আদলে রঙ-বেরঙের পাই-চার্টের মাধ্যমে পথ-দুর্ঘটনার ধরতাই দেওয়া হয়। রাস্তাঘাটে দুর্ঘটনা আর তা নিয়ে অনিশ্চয়তার মাত্রা যত বাড়ে, ততই পরিসংখ্যানের ধরন-ধারণ আর রেখাচিত্রের গতিবিধি পালটে পালটে যায়। সর্বভূতে যার গতি- সেই সঞ্চালকের প্রগাঢ় ছত্রছায়ায় বিশেষজ্ঞরা আলোচনা করেন। রাস্তাঘাটের পরতে পরতে গতি রুদ্ধকারী বন্দোবস্ত, প্রযুক্তির নজরদারি, পুলিশি তৎপরতা আর এর পাশাপাশি বেপরোয়া বাইকবাজদের আত্মলালনের সঠিক পন্থা বারবার উল্লেখ করা হয়। নাগরিক আবেদন আর ললিত বাণীর অবিরাম প্রচার সত্ত্বেও বাইকের গতি তরঙ্গ কমে না। পুলিশি তৎপরতা বাড়লে হয়তো এর প্রকোপ খানিকটা কমে, কিছুদিন পরে আবার শুরু হয়। রাত-বিরেতে শহরের রাস্তাঘাট আর নানা শুনসান তল্লাট জুড়ে চলে বাইকারদের বিপদজনক কেরামতি আর কসরত। বাইকারদের এই চূড়ান্ত গতি স্বাভাবিক ভাবেই নাগরিক সমাজের চোখে অযাচিত, অহৈতুকী। এই গতির কোনও মানে নেই, কোনও ঠিকঠাক গন্তব্যও বোধহয় নেই। আলাপচারী বিশেষজ্ঞরা এর সমাধানে নিদান দেওয়ার পাশাপাশি ব্যস্ত থাকেন অসহায় অতীত চারণায়। 

বাইকের ইতিবৃত্ত: বঙ্গে এবং পশ্চিমে

এই বঙ্গে, বিশেষ করে এই সাধের শহরে মোটর বাইক চালানো আর তা নিয়ে রোমান্টিকতার ইতিহাসও হয়ে গেল তা বেশ কয়েক দশক। ‘সপ্তপদী’ ছবিতে নায়ক বাইকের পিলিয়নে নায়িকাকে বসিয়ে শহর ছাড়িয়ে উধাও হয়ে যাওয়ার দৃশ্য বোধহয় মধ্যবিত্ত বাঙালিকে বাইক ব্যবহারের উপকারিতা সম্পর্কে সচেতন করেছিল। সমাজ সংসারের চেনা চেনা নিষেধাজ্ঞার তর্জনীকে উপেক্ষা করে প্রেমিক যুগলের আত্মপ্রকাশের পিছনেও সেই বাইক। স্কুটারের উল্লেখ এই প্রসঙ্গে চলে আসতে পারে। কারণ, শহরের প্রেক্ষাগৃহে ‘রোমান হলিডে’ ইতিমধ্যে মুক্তি পেয়েছে, আর বাঙালি তা দেখে উচ্ছ্বসিত। তবে স্কুটারের আবেদন বোধহয় ষাট-সত্তরের দশকে অনেকটাই কমে আসে।

গত কয়েক দশকের মধ্যে বাইক বিচরণের সেই পেলব রোমান্টিকতায় দ্রুত ছেদ পড়তে শুরু করে। আশির দশকের প্রথম দিকে মুক্তি পায় 'ম্যাড ম্যাক্স'এর মতো তুমুল জনপ্রিয় ছবি। বাইকের দৃশ্য-তাণ্ডব ছিল এই ছবির উপজীব্য। বেপরোয়া ভাবে দুর্দান্ত গতিতে সশব্দে এগিয়ে যাওয়ার দিন আসে। নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা না করাই হয়ে ওঠে দস্তুর। কলকাতা শহর ছাড়িয়ে গ্রামে-গঞ্জে এর এখন চূড়ান্ত রমরমা। এই বাইক চালনা বোধহয় আলাদা জীবনচর্যার ভূমিকা নিয়েছে। 

বিদেশে সমাজবিদ আর জীবনযাত্রা চর্চাকারীদের চোখে আধুনিক যুব-সংস্কৃতির এটি একটি অন্যতম ভিন্ন প্রকরণ, এক ধরনের ‘সাব-কালচার’, যা স্পষ্টতই এক ভিন্নতর জীবনযাপনের ইঙ্গিত দেয়। পশ্চিমে এই বাইক বাহিত ভিন্ন সংস্কৃতি অনেক দিন ধরেই জনপ্রিয়। গত শতকের ষাটের দশকেই তা তুঙ্গে ওঠে। বেশ কয়েকটি হলিউডি ছবিতে তা ধরাও পড়ে। সমাজ গবেষকরা বেপরোয়া এই জীবনযাত্রার অভিজ্ঞতা বোঝার চেষ্টা করেন। বাইকারদের পোশাক-আশাক, ভীতিপ্রদ ভঙ্গিমা আর বিচিত্র শব্দ ব্যবহার ষাটের দশকেই পশ্চিমি দুনিয়ার বিভিন্ন শহরের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠে। আদ্যন্ত পুরুষালি ক্ষমতা জাহির করার এমন মাধ্যম আর কিই বা আছে! মূলত গরিব-গুর্বো পরিবার থেকে উঠে আসা উঠতি বয়সীদের এ এক ধরনের আত্মপ্রকাশের অদম্য প্রয়াস। এই বাইকার গোষ্ঠীতে সবাই স্বাগত। প্রয়োজন শুধু একটা বাইক আর চূড়ান্ত বেপরোয়া গতিতে বাইক চালানোর সদিচ্ছা। আর দুর্ঘটনায় মৃত্যু তো শেষ পর্যন্ত তাদের নায়কোচিত জীবনযাত্রারই চূড়ান্ত স্বীকৃতি, অন্তত তাদের কাছে। গবেষকরা লক্ষ করেছেন যে, অচেনা এই জগতে নানা ভাবে জুটে যাওয়া তাদের সতীর্থদের বীরত্বব্যঞ্জক মৃত্যুর স্মৃতি তারা জীইয়ে রাখে একদম নিজস্ব ‘রিচুয়াল’এর মধ্য দিয়ে। তাদের নিজেদের লোককথা সমৃদ্ধ হয়। 

অশ্বারোহী: একা কিংবা কয়েকজন

বঙ্কিমচন্দ্রের ‘দুর্গেশনন্দিনী’তে মান্দারনের পথে অশ্বারোহী সেই পুরুষের একাকী গমনের আধুনিক সংস্করণ এই মোটর বাইক স্বভাবতই অনেক বেশি অশ্বশক্তি সম্পন্ন। তার গতিও এখন সর্বত্র। ব্যক্তিগত অথবা গোষ্ঠীর ক্ষমতা জাহির করার অতুলনীয় এই মাধ্যম ইদানীং ভারতীয় দৈনন্দিন রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। সংগঠিত রাজনৈতিক দলগুলি স্থানীয় স্তরে তাদের রাজনৈতিক উপস্থিতির জোরদার ভাবে জানান দিতে দলীয় পতাকা শোভিত বাইক বাহিনীর উপযোগিতা সম্পর্কে খুবই সচেতন। এলাকায় সশব্দ রাজনৈতিক উপস্থিতি, নজরদারি, ভিজিল্যানটিজম'এর এই প্রকরণ গোটা ভারতবর্ষ জুড়ে সমস্ত ধরনের কেজো রাজনীতির অঙ্গ। 

মহারাষ্ট্রে শিবসেনার বাইক-বাহিত চূড়ান্ত রাজনীতি নিয়ে একাধিক গবেষণা চোখে পড়ে। বঙ্গে বাম আমলে প্রচারের বিশেষ ক্ষণে লাল পতাকা সজ্জিত বাইক বাহিনীর তুর্য নিনাদ আর তার দৃশ্য-তাণ্ডবের অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। দৈনন্দিন কেজো রাজনীতির এই চেনা প্রকরণ বামোত্তর আমলেও একইরকম ভাবে আছে। যে কোনও নির্বাচনের প্রাক্কালে ভোট-প্রচারে বাইক বাহিনী ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞাও জারি করে নির্বাচন কমিশন। যুবশক্তি জাহিরের এমন প্রতীক আর কীই বা আছে! বয়োঃবৃদ্ধ নেতা-নেত্রীদের নানা তত্ত্ব-তাবিজ জনমানসে গেঁথে দিতে এমন উচ্চকিত মাধ্যমের জুরি নেই। কঠিন বর্তমান আর অজানা ভবিষ্যতের আশঙ্কায় আকুল নিম্নবিত্ত স্তর থেকে উঠে আসা কমবয়সীদের একটা বড় অংশই সক্রিয় হওয়ার সুযোগ পায় এই বাহিনীতে সামিল হয়ে। এও এক ধরনের ক্ষমতায়ন বৈকি!

এভাবেই কি ফিরে আসা?

সংগঠিত রাজনীতির চৌহদ্দির বাইরে দলছুট বাইকার, যাদের নিয়ে এই সমস্যা, তারাই বা কেন ফ্লাইওভার থেকে ফ্লাইওভার আর হাইওয়ে জুড়ে দুর্দান্ত গতিতে বাইক চালায়? মনে হয়, ক্রমাগত পালটে যেতে থাকা শহরগুলিকে তারা বুঝে নিতে চায় নিজেদের মতো করে সশব্দে। নতুন নাগরিক জীবনের হাল হকিকতকে তোয়াক্কা না করেই তাদের এগিয়ে চলা। তারা মোটেও ‘শাপমোচন’ ছবির নায়কের মতো 'প্রাণহীন শহরের দারুণ মর্মব্যথা' নিয়ে বেদনা-বিধুর হতে রাজি নয়। বরং তারা তাদের চাল-চলন, বেশ-ভূষা, বাইকি-কেরামতি দিয়ে ক্রমাগত অচেনা হতে থাকা শহরকে যুঝতে চায়। হাইওয়ে, বাইপাস, সুপার এক্সপ্রেসওয়ে চলে আসে তাদের বেপরোয়া হাতের মুঠোয়। চলে স্টান্টবাজি, সামনের বা পিছনের চাকা তুলে চালানো, রাস্তায় আগুনের ফুলকি তোলা অথবা পিছনের চাকার উপর ভর করে বাইক ক্রমাগত ঘোরানো। হাইওয়ে, বাইপাস আর অসংখ্য ওভারব্রিজের আশেপাশে রাত-বিরেতে তাদের জমায়েত। চলে বাজি ধরা, জুয়া খেলা, কখনও কখনও কোনও অপরাধ ঘটানো। প্রতিযোগিতাও থাকে কখনও সখনও। নানা ভীতিপ্রদ শর্ত দেওয়া হয়। যেমন, হেলমেট না পরে আশি-একশো কিলোমিটার বেগে নিরন্তর বাইক চালানো। এখানে তারা আত্মমগ্ন অচেনা গতিকে খোঁজার আনন্দে। বাপ-মা, পরিবার-পরিজনদের হা-হুতাশ, প্রতিদিনের অজানা আশঙ্কা আর তাদের চেনা চেনা স্বপ্ন প্রকল্পকে নস্যাৎ করেই চলে এই অনিকেত যাত্রা। 

নাগরিক আর প্রশাসনের নজরদারির বাইরে নবীকৃত শহরের নানা ফাঁক-ফোকর, আনাচকানাচ আবিষ্কার করে গড়ে ওঠে বিচিত্র নামের সব বাইকার ক্লাব। ধ্বংস হয়ে যাওয়ার নানা আশঙ্কা সত্ত্বেও তারা ধাবমান। নিজেদের অকিঞ্চিৎকর জীবনযাপনকে নস্যাৎ করেই এমন বিপদজনক গতি তোলার মধ্যে যে অনির্বচনীয় আনন্দ, সেখানেই বোধহয় আছে মুক্তির হাতছানি। কোনও মায়ার বন্ধনেই এরা বাঁধা পরে না। প্রশাসনিক কড়া বন্ধনের দাবি ওঠে, ধরপাকড় চলে। কোনও সুভাষ মুখোপাধ্যায় এদের জন্য নিশ্চয় ‘ছেলে গেছে বনে’র মতো কবিতা লেখেন না। দলছুট হয়ে যাওয়ার দরুণ ‘শহীদ’ বনে যাওয়ার সুযোগও তাদের নেই। নিতান্ত ছাপোষা পরিবার থেকে উঠে আসা বাইকার গোষ্ঠীর সদস্যরা রসদ জোগাড় করে নানা বিক্ষিপ্ত কাজ-কারবার থেকে। অর্থ উপার্জনের নানা আলো-আঁধারি উপায়ও এরা খুঁজে বার করে। 

দশ ফুট বাই দশ ফুটের উপচে পরা আলগোছ পরিবারের আওতা থেকে তারা বোধহয় ক্ষণিক মুক্তি খোঁজে ধূ ধূ কালো রাস্তায়। সমাজ, সংসার, পড়শী জীবনের যাবতীয় হিসেব-নিকেশ ভেঙে ভেঙে যায়। ভেঙে পরার অভিজ্ঞতা এরা বোধহয় বহন করে নিজেদের শরীরে, জীবন যাপনে। দুর্দান্ত গতির আনন্দ আর আত্মহনন মিলে মিশে যায়।

 

Monday 23 August 2021

মহিলা হকি দলের অলিম্পিক লড়াই

ঘরে ঘৃণা ও বিদ্বেষ

সুমন সেনগুপ্ত


এবারের টোকিও অলিম্পিক ভারতের হকির জন্য নবজাগরণের বছর। ৪১ বছর পরে পুরুষেরা তৃতীয় স্থান পেয়েছেন আর মহিলারা অল্পের জন্য ব্রোঞ্জ পদক পেতে অসফল হয়েছেন। মহিলা দল পদক জিতে আসতে পারেননি, কিন্তু তাঁরা আপামর ভারতবাসীর হৃদয় জিতে নিয়েছেন। জাতীয় সঙ্গীতের সঙ্গে বিজয়ীর মঞ্চে তাঁদের দেখা যায়নি বটে, কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁরা বিজয়ী। সম্মান, অনুপ্রেরণা, লড়াই সমস্ত কিছুতে তো তাঁরাই জয়ী। 

কিন্তু যে ভারতের তাঁরা প্রতিনিধিত্ব করেন, সেই ভারতে লিঙ্গানুপাত হিসেবে প্রতি হাজার পুরুষ পিছু মহিলার সংখ্যা ৯৪৩। উত্তর ভারতে এই সংখ্যা আরও কম। ঘটনাচক্রে এমন এক দেশের তাঁরা প্রতিনিধি, যেখানে কন্যা ভ্রূণ হত্যা, গাহর্স্থ্য হিংসা, পদে পদে জাত-ধর্ম নিয়ে লাঞ্ছনা নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। এমনকি ‘মেয়েরা কি হকি খেলবে’- এই মনোভাব অধিকাংশের। সে ক্ষেত্রে এই মানসিকতাকে পিছনে ফেলে যে লড়াইটা তাঁরা দিলেন তা কি কোনও অংশে ‘চক দে ইন্ডিয়া’ ছবিটির থেকে আলাদা? কিন্তু ছবি তো ছবিই। সেখানে ভারতীয় মহিলা হকি দল সোনা জেতে, আর বাস্তবে এই সময়ে কোনও পদক জিততে না পেরে লাঞ্ছিত হতে হয় অধিনায়ক বন্দনা কাটারিয়ার পরিবারের মানুষজনকে। এমন কথাও শুনতে হয় ‘উচ্চ’ জাতের মানুষদের থেকে- অতিরিক্ত সংখ্যায় দলিত ক্রীড়াবিদ থাকার কারণে ভারত নাকি অসফল হয়েছে। শুধু তাই নয়, যে সময়ে মহিলা হকি দলের পারদর্শিতা নিয়ে সারা ভারত মগ্ন হয়ে আছে, ঠিক সেই সময়ে আরও একটি ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় আমরা যতই মুখে বলি না কেন ‘বেটি পড়াও বেটি বাঁচাও’, আমাদের মানসিকতা এতটুকুও বদলায়নি। 

দিল্লির বুকে একটি নয় বছরের দলিত বালিকা আক্রমণের শিকার হওয়ায় লজ্জায় আমাদের মাথা নিচু করতে হয়। সেই ২০১২ সালের ‘নির্ভয়া’ থেকে আজ ৮ বছর পরেও দেশ এক বিন্দুও অগ্রসর হয়নি। শুধুমাত্র রাজনৈতিক পালাবদলের জন্য ‘নির্ভয়া’র উদাহরণকে সামনে রেখে মহিলা নিরাপত্তা কতটা তলানিতে তার প্রচার করা হয়েছিল। শুধু ৮ বছর কেন, স্বাধীনতার ৭৫ বছরে এসেও কি এটা বলা যায় যে মহিলারা স্বাধীনতা পেয়েছেন? পুরুষদের মানসিকতায় কি এতটুকুও অগ্রগতি এসেছে? না হলে, গোয়াতে সম্প্রতি যে ঘটনা ঘটেছে, যার প্ররিপ্রেক্ষিতে গোয়ার মুখ্যমন্ত্রীর উক্তি, ‘চৌদ্দ বছরের মেয়েটি অত রাতে সমুদ্রের পাড়ে কী করছিল?’ কি সেই পুরুষতান্ত্রিকতার দিকেই দিকনির্দেশ করে না? 

হয়তো ভারতীয় মহিলা হকি দলের গল্প আমাদের পরের প্রজন্মকে অনুপ্রেরণা জোগাবে, হয়তো বা আবার ‘চক দে ইন্ডিয়া’র পরবর্তী ছবি তৈরি হবে, হয়তো অনেক পরিবার যাঁরা ছোট স্কার্ট পরে খেলতে দেওয়ার বিরোধী ছিলেন, তাঁরা তাঁদের কন্যা সন্তানদের এই দিকে উৎসাহিত করবেন। কিন্তু তাতেও কি মানসিকতার বদল হবে? হয়তো রাজনৈতিক নেতা-মন্ত্রীরা এই ক্রীড়াবিদদের সম্বর্ধনা দেবেন, হয়তো প্রচুর পুরস্কার ঘোষণা করবেন, কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁদের আচরণ কি আমরা ভুলে যাব? আমরা কি ভুলে যাব এই কিছুদিন আগেই উত্তরপ্রদেশে একটি ১৭ বছরের মেয়েকে জিন্স পরার অপরাধে তাঁর পরিবারের মানুষেরা মেরে ফেলেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে? 

আজ অনেক রাজনৈতিক নেতা-মন্ত্রীরা হয়তো আসবেন এই অলিম্পিকে যাওয়া এবং পদক পাওয়া বা না-পাওয়া মহিলাদের কৃতিত্বে নিজেদের সামিল করতে। কিন্তু তার মধ্যে থেকে কি আমরা আসল-নকল চিনব না? এই নেতা-মন্ত্রীরাই কিন্তু এখনও বিধানসভা বা লোকসভায় মহিলাদের ৩৩ শতাংশ সংরক্ষণের বিরোধী। এই মানুষেরাই কিন্তু মহিলাদের সামাজিক এবং রাজনৈতিক অগ্রগতির একমাত্র প্রতিবন্ধক। আমরা কি ভুলে যাব কিছুদিন আগে উত্তরাখণ্ডের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ছেঁড়া জিন্স পরা নিয়ে কি বলেছিলেন? আমরা কি হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রীর সেই বিখ্যাত উক্তি- মহিলারা যদি ‘ভদ্র সভ্য’ পোশাক পরেন তাহলেই পুরুষদের চাহনি থেকে বাঁচতে পারেন- ভুলে যাব? তাঁকে কি আমরা উল্টে প্রশ্ন করব না- ৯ বছরের মেয়েটি কী পোশাক পরেছিল যার ফলে ধর্ষিতা হতে হল তাকে? 

রোজ সামাজিক মাধ্যমে বিভিন্ন মহিলারা যে আক্রমণের শিকার হন, তাতে কি দেশের সম্মান বাড়ে? রোজ বিভিন্ন ভাবে ঘরে এবং বাইরে যে ভাবে মহিলারা অসম্মানিত হন, তাতে কি এটা প্রমাণিত হয় না যে আমাদের মানসিকতা এতটুকুও বদলায়নি? সেই জন্যেই পদক কিংবা পুরস্কার নয়, এখন যা প্রয়োজন তা হল মানসিকতার বদল। শুধু মহিলাদের প্রতি নয়, দলিতদের প্রতিও। নির্বাচনের আগে কোনও দলিত পরিবারের সদস্যের পা ধুইয়ে দেওয়ার মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর চমকই কাজ করে; কিংবা ‘বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও’ এর বিজ্ঞাপনে প্রধানমন্ত্রীর মুখের ছবি দেওয়ার মধ্যে শুধু প্রচারের মানসিকতাই থাকে, ভিতর থেকে সমাজকে বার্তা দেওয়ার মানসিকতা থাকে না। যদি তা থাকত তাহলে বন্দনা কাটারিয়ার বাড়িতে গিয়ে- যাঁদের পরিবার বংশানুক্রমে উঁচু জাতের কাছে অপমান সহ্য করেছেন- আজকে অলিম্পিকে এইরকম অভিনব পারদর্শিতা দেখানোর পরেও ওইরকম টিটকিরি দেওয়া হত না। যদিও মহিলা হকি দলের পক্ষ থেকে অধিনায়ক রানি রামপাল খুব কড়া ভাবে এই আচরণের নিন্দা করেছেন। বলেছেন, ‘যখন তাঁরা তাঁদের সর্বস্ব বাজি রেখে দেশের জন্য খেলছেন, তখন তাঁদেরই এক সহ ক্রীড়াবিদের বাড়িতে এই রকম হামলা অত্যন্ত নিন্দনীয়।’ কিন্তু তাতেও কি দৃষ্টিভঙ্গির বদল হবে?  তিনি বলেছেন, ভারতের নানান প্রান্ত থেকে নানা ভাষা, নানা জাতি, নানা ধর্মের মানুষ মিলেমিশে আজ যখন এক হয়ে দেশের জন্য অলিম্পিকের ময়দানে নামছেন, তখন কিছু মানুষের এ হেন আচরণ অবিলম্বে বন্ধ হওয়া জরুরি। 

কিন্তু বললেই তো আর হয়ে যাচ্ছে না। মানুষের মধ্যে অন্তর্নিহিত যে ঘৃণা ও বিদ্বেষ রয়েছে, তা কখনও এক ধর্মের সঙ্গে অন্য ধর্মের বা এক জাতের সঙ্গে অন্য জাতের এমনকি এক ভাষাভাষী মানুষের সঙ্গে অন্য ভাষার মানুষের, তা কি সহজে কমবে? এই জাতি বিদ্বেষ এতটাই গভীরে যে, জনগণনাতে কেন জাতি সংক্রান্ত বিষয় আনা হবে না তা নিয়ে সংসদে বিতর্ক উঠে গেছে। শাসক বিজেপি শুধুমাত্র এসসি এবং এসটি ছাড়া আর কোনওরকম জাতি আছে বলে মান্যতা দিতে রাজি নয়। কিন্তু তা করলে কি সমস্যার সমাধান হবে? মানুষে মানুষে যে জাতপাত সংক্রান্ত বিভেদ আছে, তা কি শুধু রাজনৈতিক কাজের মধ্যে দিয়ে কমানো সম্ভব, নাকি সামাজিক কিছু উদ্যোগেরও প্রয়োজন আছে তা ভেবে দেখারও কি সময় হয়নি? যদিও বিজেপির যুক্তি যে এই জাত সংক্রান্ত জনগণনা যদি কার্যকরী করা হয়, তাহলে সমাজে বৈষম্য বাড়বে এবং তার মধ্যে দিয়ে আম্বেদকরের যে স্বপ্ন (জাতিভেদ প্রথার বিলোপ) তা ধাক্কা খাবে। 

কিন্তু সত্যকে আড়াল করে কি কোনও মহৎ লক্ষ্যে পৌঁছনো সম্ভব? যদিও তাঁরা শুধু কত সংখ্যক দলিত এবং আদিবাসী আছে তা প্রকাশ করতে ইচ্ছুক, কিন্তু তার মধ্যে দিয়ে তাঁদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ হওয়া ছাড়া অন্য কিছু হবে কী? বরং কত ধরনের জাত এই মুহুর্তে ভারতে আছে, তাদের কার কী সামাজিক অবস্থান, কতজন শিক্ষিত হয়েও রোজ লাঞ্ছনার শিকার হন- তা জানা কি জরুরি নয়? না হলে, রোজ কোথাও না কোথাও বন্দনা কাটারিয়া এবং তাঁদের পরিবারের মানুষজন নিগৃহীত হবেন, আর আমরা ভাবব যে আমাদের দেশে জাত সংক্রান্ত কোনও বিদ্বেষ নেই, আমাদের দেশে মহিলারা যথেষ্ট সম্মান পাচ্ছেন। 


Saturday 21 August 2021

স্বাধীনতার স্বপ্ন

'...স্বর্গ খেলনা গড়িব-না ধরণীতে'

অশোকেন্দু সেনগুপ্ত


'নীড় ছোট, ক্ষতি নেই, আকাশ তো বড় ....'

এই ব্লগে স্বাধীনতার ৭৫ বছর সম্পর্কিত লেখাটি পড়ে অনেকেই জানতে চেয়েছেন করণীয় কী? উত্তর একেবারেই জানা নেই এমন নয়। তা নিয়েই আমার আজকের এই কিছু কথা। অনেকেই একমত হবেন না জেনেও মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস রেখে বলি এবং পাঠকদের প্রতিক্রিয়াতেও যেন মতপ্রকাশের সেই স্বাধীনতাই অনুরণিত হয়, এই আমার প্রার্থনা।

সকলেই বোঝেন ও মানেন যে দেশ এগিয়েছে। একটা সেফটিপিনও তখন বিদেশ থেকে আসত। সেদিন গিয়াছে। তবে এও সত্য যে, দেশের মানুষের এগোনোর হার কাঙ্ক্ষিত মানে পৌঁছয়নি। কাঙ্ক্ষিত মান বলতে বুঝি সসম্মানে বাঁচার অধিকার। সসম্মানে বাঁচতে হলে সুস্বাস্থ্য, সুশিক্ষা ও যাবতীয় মানবাধিকার চাইই। সেই সঙ্গে অবশ্যই চাই জীবিবৈচিত্র আর পরিবেশের ভারসাম্য।

অধিকার চাইলে কে দেয়? কাকেই বা দেয়? সবার আগে প্রস্তুত হতে হবে অধিকার পেতে। কর্তব্য সম্পর্কে উদাসীন হলেও চলবে না। কর্তব্যও করব, অধিকারও চাইব। কার কাছে চাইব? চাইব, সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে নিশ্চয়। সমাজ নিশ্চয় তার সব দায়িত্ব রাষ্ট্রের পাতে তুলে দেয়নি। রাষ্ট্রও ভুলে থাকতে পারে না তার দায়িত্ব। সুশিক্ষার আয়োজন নিশ্চয় রাষ্ট্রের দায়। তার প্রতিশ্রুতিও তেমন। রাষ্ট্র এখন যে নীতির রূপায়ণ চাইছে তাও যদি সে কার্যকর করে! এতেও যে মন ভরে না, প্রশ্ন থাকে- এই আয়োজন কী সুশিক্ষা নিশ্চিত করবে? সুশিক্ষার লক্ষ্য যদি হয় সুনাগরিক তৈরি, তবে তো মানতেই হয় যে বর্তমানে রাষ্ট্রীয় নীতিতে তা প্রতিফলিত নয়। 

সকলের জন্য আরও চাকরি, আরও কর্মসংস্থান? তাও যে নিশ্চিত নয়। তবে, যদি চাকরির ব্যবস্থা করতে পারলে কর্তাদের পকেট ভারী হয়, পরের নির্বাচনে জয় নিশ্চিত হয় (আরও চাকরি, আরও কর্মসংস্থানের লোভ দেখাতে পারলে!) তবে তো সে পথে দৌড়তেই হয়। সকলের জন্য আরও কর্মসংস্থান সম্ভব করে তুলতে আমরা চাইছি দ্রুত হারে উন্নয়ন। চাইছি শিল্পোৎপাদন বাড়াতে। কেবল এ দেশ বলে নয়, প্রায় সব উন্নয়নশীল দেশই সেই সব্বনেশে পথে। সে সমাধান আবার প্রকৃতির পছন্দ নয়। সুপরিবেশের দাবি মেনে যথেচ্ছ শিল্পোৎপাদন সম্ভব নয়। অন্তত এ দেশে এখন যা হচ্ছে। তাহলে বিকল্প কী? নেই নাকি? 

দেশের বহু মানুষ হতাশ। তাঁরা ভাবেন যে, এ পোড়া দেশের অভাগা মানুষের কিছু হবে না। সে মানুষগুলো কেবল মার খাবে আর মরবে। করোনায় মরলে শ্মশানেও ঢুকতে দেবে না। অর্থাৎ, বাঁচলেও বিপদ, মরলেও। যেমনটা দেখেছিলেন শরৎচন্দ্র- বর্মা মুলুকে প্লেগ-কালে। সত্যিই কী তাই- বাঁচলেও বিপদ, মরলেও? ঘুরে দাঁড়ালে হয় না? যাবে না ঘুরে দাঁড়ানো? নিশ্চয় যাবে। যদি চাই। যদি চাই পরের প্রজন্মের জন্য বিকল্প পথে হাঁটতে তবে তার জন্য আমাদের বদলাতে হবে মানসিকতা।

ভূটানের দিকে তাকালে বুঝি সমাধান আছে। সে দেশ তো শিল্পোন্নত নয় আজও। পরিবেশ বাঁচিয়ে সমাধান পেতে সবার আগে প্রয়োজন শিল্পে যথেচ্ছ ও নিয়মিত উৎপাদন বাড়িয়ে জিডিপি বাড়ানোর ধারণাটি ত্যাগ করা। এর অর্থ এই নয় যে শিল্প স্থাপন করা যাবে না। নিশ্চয় যাবে, কিন্তু তা যথেচ্ছ বা অপরিকল্পিত হলে চলবে না। যেমন আশু লাভের কথা ভেবে আমরা বড় বড় নদীবাঁধ বা মাটির তলা থেকে জল তুলে নিতে পারি না। স্বামীনাথন এখন স্বীকার করছেন যে তাঁর 'সবুজ বিপ্লব'এর পরিকল্পনায় ভুল ছিল। ভুল স্বীকার করে তিনি ফের আমাদের আর এক সর্বনেশে পরিকল্পনার অংশীদার (দ্বিতীয় 'সবুজ বিপ্লব') করতে চাইছেন। আমরা যদি তা গ্রহণ না করি?

তবে আর জিডিপি দ্রুত হারে বাড়বে কেমন করে? মানতেই হবে যে, তা বাড়বে না তেমন দ্রুত হারে। মেনে নিতেই হবে যে, কেবল দ্রুত জিডিপি বাড়াটাই সুলক্ষণ নয়। আবারও বলি, এর মানে এই নয় যে উন্নয়ন চাই না। চাই, অবশ্যই চাই। পৃথিবীতে এমন দেশও তো আছে যারা কেবল সামুদ্রিক উদ্ভিদ বেচে উন্নতির শিখরে, কোনও কোনও দেশ ভ্রমণকে শিল্পে পরিণত করে দ্রুততালে এগিয়ে চলেছে। কিন্তু এ দেশের মতো এশীয় দেশবাসীর একাংশ 'লুক ইস্ট' নীতির অনুগামী কিছু মার্কিনী বেওসায়ীদের নজরে থাকায় (জিডিপির কলে পড়ে, সেই কল যাকে সুকুমার রায় বর্ণনা করেছেন 'খুড়োর কল' রূপে) এগোচ্ছে একালের বিচারে। তারা পরিবেশ বিপন্ন হচ্ছে জেনেও দূষণ-প্রধান গাড়ি বা রসায়ন শিল্পকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত।  ঠিক হচ্ছে টা কী? 

পরের প্রজন্মকে চাকরির লোভ দেখালেও হবে তো উদ্দেশ্যসিদ্ধ? পরিবেশ-বিশেষজ্ঞরা যে বলছেন আর বড় জোর ৫০ বছর, তারপর আমরা পানীয় জল পাব না, গরমে সেদ্ধ হব, গ্লোবাল ওয়ার্মিং পৃথিবীর স্থলভাগ কেড়ে নেবে। স্পষ্ট উচ্চারণের সময় এসেছে, সময় এসেছে এই কথা বলার যে, এমন আত্মঘাতী উন্নয়ন চাই না, তার চেয়ে মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় পেয়েই তুষ্ট থাকব। 

এমন পরিস্থিতিতে পৌঁছতে চাই যেখানে সুশিক্ষা যা সমাজকে নিছক কিছু হাত-পা বিশিষ্ট মানুষ দেবে না, দেবে সুনাগরিক। যে নাগরিক চর্চা করবে এমন এক সমাজের ও এমন এক রাষ্ট্রব্যবস্থার যেখানে ধর্ম বা লিঙ্গের ভিত্তিতে ভাগ হওয়ার সুযোগই থাকবে না, নিশ্চিত হবে মানুষের মর্যাদার সঙ্গে বাঁচার অধিকার। নিশ্চিত হবে মানুষের খাদ্য, বস্ত্র, আহার্য, শিক্ষার অধিকার। সুশিক্ষিত হলে এমন এক রাষ্ট্রব্যবস্থা আমরা চাইব যেখানে একবার ভুল করে বা কোনওভাবে কোনও অত্যাচারী স্বৈরাচারীকে যদি ডেকে আনা হয়ও তাকে কুলোর বাতাসে বিদায় দিতে পারব। 

এই সব স্বপ্ন সার্থক হতে পারে যে আবহে, যে সংস্কৃতিতে তা আমাদের আছে। যে কাঠামোতে এমন  সব স্বপ্ন সার্থক হতে পারে তাও আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আছে। তাই স্বপ্নগুলি দিবাস্বপ্ন বলে উড়িয়ে দেবার নয়। পৃথিবীকে পথ দেখানোর পথে আমরা এগিয়ে চলি, আসুন।


Friday 20 August 2021

আফগান ডায়েরির প্রথম পাতা

'রক্তচোষা পলাতক' প্রেসিডেন্ট গনি 

ও হিংস্র তালিবানি দাপট

শোভনলাল চক্রবর্তী


দেশের মানুষকে ভয়ঙ্কর সঙ্কটে রেখে আফগান প্রেসিডেন্ট আশরফ গনি ঘনিষ্ঠ কয়েকজন সহচরকে নিয়ে হেলিকপ্টার ও চারটি গাড়ি ভর্তি টাকাপয়সা সহ দেশত্যাগ করেছেন কাবুল পতনের আগেই। ফেসবুকে তিনি জানিয়েছেন, রক্তপাত এড়াতেই তাঁর এই দেশত্যাগ। গনি যে শেষমেশ আমেরিকাতে গিয়েই উঠবেন তাতে কারওর কোনও সন্দেহ নেই। আপাতত তিনি সংযুক্ত আমিরশাহী থেকে ভিডিও বার্তায় জানিয়েছেন যে দেশে থাকলে তাঁকে নাজিবুল্লা'র মতো ফাঁসি দেওয়া হত, তাই তিনি দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। জীবনের বড় একটা সময় তিনি আমেরিকায় কাটিয়েছেন। আমেরিকার 'পুতুল' হিসেবেই তিনি আফগানিস্তানের শাসনভার চালিয়েছেন, বহু মানুষের অপছন্দ সত্ত্বেও। দেশের চরমতম বিপদে গনি'র পলায়নে তাঁর প্রতি বিদ্বেষ আরও বেড়েছে। তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা বলছেন, 'ঈশ্বর তাঁকে ক্ষমা করবেন না।' সাংবাদিক আনিশা শাহিদ গনিকে বলেছেন বিশ্বাসঘাতক। তীব্র ঘৃণায় টুইটারে তিনি  লিখেছেন, 'দেশের রক্ত চুষে একদল বিশ্বাসঘাতক দেশত্যাগ করেছে দেশবাসীকে ফ্যাসিস্টদের হাতে সঁপে! এই বিশ্বাসঘাতকদের কি শিং আর লেজও আছে।' 

২০১৪ এবং ২০২০'এ দু' দফায় প্রেসিডেন্ট হলেও গনি কোনওদিনই দেশবাসীর আপন হতে পারেননি। লেবানন ও আমেরিকায় শিক্ষা ও কর্মজীবনের বেশির ভাগটা কাটানোর পর বাহাত্তর বছরের গনি দেশে ফেরেন আমেরিকান সেনা আফগানিস্তানের দখল নেওয়ার পর। দেশ গঠনের নামে গনি এবং তাঁরই মতো বিদেশে বড় হওয়া কয়েকজন এলিটের সে ঘরে ফেরাকে দেশের মানুষ সন্দেহের চোখে দেখেছিলেন। দেশের মানুষ বুঝেছিলেন যে আমেরিকা পুতুল সরকার গঠনের ঘুঁটি সাজাচ্ছে। দু' দফা নির্বাচন জয়েও তাঁর বিরুদ্ধে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ উঠেছে। তিনি জাতীয় সংসদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কথা কানে তুলতেন না বলে অভিযোগ। তাঁর সরকারের আমলে চলে দেদার লুঠ ও দুর্নীতি। নিজের ভাই থেকে শুরু করে বিদেশ ফেরত বন্ধুদের যাবতীয় বরাত বিলির মধ্যে দিয়ে আফগানিস্তান পুনর্গঠনের জন্য আসা আন্তর্জাতিক সাহায্য নয়ছয় করেছিলেন তিনি। 

বস্তুত, চার দশকের যুদ্ধবিধ্বস্ত, অতীতের সামন্ততান্ত্রিক কাঠামোয় পড়ে থাকা দেশটার জন-পরিষেবা ক্ষেত্রে আর্থিক ব্যয়ের ৭৫ শতাংশই বিদেশি সাহায্য। সরকারে থাকার সুবিধায় সেই অর্থের বিলি ব্যবস্থার দায়িত্বে ছিলেন গনি। তাঁর দেশবাসীদের মতে দেশ পুনর্গঠনে সব শক্তিকে নিয়ে চলার মনোভাব ও যোগ্যতাতেই ছিল ফাঁকি। নিজের ছোট্ট বৃত্তে আটকে থাকা এলিট সুলভ আত্মঅহঙ্কারি, দুঃসময়ে শেকড়হীন নেতার পলায়নই যে চেনা চিত্রনাট্য তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। আফগানরা এখন তাঁদের পালিয়ে যাওয়া প্রেসিডেন্টকে বলছেন, 'রক্ত চোষা পলাতক'। আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারে মরিয়া আমেরিকা গনি'র কাঁধে বন্দুক রেখে নিজেদের 'সেফ প্যাসেজ'এর শর্তে তাঁকে বাধ্য করে ৫০০০'রও বেশি গুরুতর অপরাধে বন্দী তালিবান জঙ্গিকে মুক্তি দিতে। 

নব্বইয়ের দশকের শেষে তালিবান বলতে যেমন পাহাড়ি, খালি পা, শুষ্ক চেহারা, পুশতু ভাষায় কথা বলা জঙ্গি গোষ্ঠীকে দেখা যেত, সেই গোষ্ঠীই এখন হাতে রকেট লঞ্চার নিয়ে শহরে ঢুকছে অত্যাধুনিক সমরসাজের 'হামার' চড়ে। চোখে নাইটভিশন গগলস, সঙ্গে অটোমেটিক মেশিনগান, গলায় দামি ম্যাগাজিনের মালা। ইংরেজিতেও চোস্ত অনেকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের জার্মানির সমরকৌশল 'ব্লিৎজরিগ'এর থেকেও বেশি গতিতে চলেছে এবারের তালিবান আগ্রাসন। 

যে তালিবানকে ২০০১ সালে আমেরিকার বোমারু বিমান কার্যত নিশ্চিহ্ন করে দেয়, তারা কোন জাদুবলে রক্তবীজের মতো ফের ছড়িয়ে পড়ল কাবুলিওয়ালার দেশে? তাও আবার রাষ্ট্র দখলের শক্তি নিয়ে। দামি অস্ত্র, দামি গাড়ি, দামি সজ্জা- এত বিপুল টাকা এল কী করে তালিবানের হাতে? এর পেছনে রয়েছে পাকিস্তানের অবদান। অতীতে আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসনের সময়ে দেশ ছাড়া আফগানদের সীমান্ত এলাকায় মাদ্রাসা ও গ্রামে আশ্রয় দিয়েছিল পাকিস্তান। সঙ্গে চলেছিল মৌলবাদী শিক্ষা ও অস্ত্রের ট্রেনিং। সেই প্রশিক্ষিত তালিবান জঙ্গিরাই আফগানিস্তানের দখল নিয়েছিল নব্বইয়ের দশকে। ২০০১ সালে মার্কিন হানার পর তালিবানরা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলেও বন্ধ হয়নি পাকিস্তান সীমান্ত এলাকায় জঙ্গি ট্রেনিং। বরং, আফগান কিশোরদের তুলে এনে মগজধোলাইয়ের কাজ চলেছে পুরোদমে। তাদের শুধু আফগানিস্তানে নয়, টাকার বিনিময়ে আল-কায়দা, জৈশ-ই-মহম্মদের মতো জঙ্গি গোষ্ঠীর মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল ইরান সহ পশ্চিম এশিয়ার বহু যুদ্ধক্ষেত্রে। ন্যাটোর রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৬ সালে আফগান সীমান্তবর্তী একটি মাদ্রাসায় পাক সরকারের বার্ষিক অনুদান ছিল ৩০ কোটি টাকা। ২০১৬-১৭ সালে এমন কয়েকটি মাদ্রাসার বার্ষিক বাজেট ছিল আকাশচুম্বী ১৫০ কোটি মার্কিন ডলার! পাক মাদ্রাসায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত তালিবান জঙ্গিরা আফগানিস্তানের বিভিন্ন দুর্গম প্রদেশে নিজেদের জায়গা তৈরি করছিল গত পাঁচ বছর ধরেই। 

একে তো বিশ্বের প্রধান আফিম উৎপাদক দেশ আফগানিস্তান। ফলে, আফিমের জমি দখলে রাখতে পারলেই বিদেশি মুদ্রা নিশ্চিত। আর তা থেকে সস্তায় হেরোইন তৈরি করতে পারলে তো কথাই নেই। তালিবান সেই ব্যবসা থেকে বিরাট মুনাফা করেছে গত কয়েক বছরে। পাহাড়ি এলাকায় পরের পর ল্যাব বানিয়ে হেরোইন বেচেছে তালিবানরা। তার ফলেই, ২০১৬ সালে ফোর্বস'এর তালিকায় বিশ্বের পঞ্চম ধনী জঙ্গি গোষ্ঠী হিসেবে নাম ওঠে তালিবানের। তখন তাদের বার্ষিক লেনদেনের পরিমাণ ছিল ৪০ কোটি মার্কিন ডলার! মাদক ব্যবসা, চোরাচালান, অপহরণ, হুমকিতে সিদ্ধহস্ত তালিবানের হাতে এমন মোটা অঙ্কের অর্থ তখনই ছিল, যখন আফগানিস্তানে তারা দ্বিতীয়বার সে অর্থে দাঁত ফোটাতেও পারেনি। ২০১৯ সালে তালিবানের সেই বার্ষিক লেনদেন বেড়ে দাঁড়ায় ১৬০ কোটি মার্কিন ডলার, মানে আগের চেয়ে প্রায় ৪০০ শতাংশ বেশি! কারণ, দেশের দুর্গম অঞ্চলে বিদ্যুৎ সংস্থা, মোবাইল পরিষেবা সংস্থাকে কাজ করতে হত তালিবানকে 'তোলা' দিয়েই। নইলে টাওয়ার উড়ে যাবে, খুঁটি উপড়ে যাবে। কিছুই করতে পারবে না পুতুল আফগান সরকার। 

১৯৯৪-এর সেপ্টেম্বরে মাত্র ৫০ জন নিয়ে মোল্লা মহম্মদ ওমরের হাতে তৈরি জঙ্গি গোষ্ঠী তালিবান ২ বছরে লক্ষাধিক হয়ে আফগানিস্তানে ক্ষমতা কেড়ে মৌলবাদী শাসন চালু করেছিল ঠিকই, কিন্তু দেশের ৩৪টি প্রদেশের ৯০ শতাংশ জায়গায় নিজেদের ঝাণ্ডা ওড়াতে তাদের লেগে গিয়েছিল আরও দুটো বছর। অথচ এ বার এপ্রিলে আমেরিকা সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণার পর কেটেছে মাত্র সাড়ে তিন মাস। তাতেই মার্কিন বাহিনীর হাতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আফগান সেনা সম্পূর্ণ রূপে পর্যুদস্ত। টাকায় কিছুটা হয়, তাই বলে সবটা?


Thursday 19 August 2021

তালিবান রাজ

স্বাধীনতা ও সন্ত্রাসের দোলাচলে আফগানিস্তান

সোমনাথ গুহ


আমেরিকা যে দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যায় হস্তক্ষেপ করেছে সেখানেই নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছে। ইতিহাস এটাই বলে। গত শতাব্দীতে ফিরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই, মাত্র কুড়ি বছর আগের ঘটনাবলী তাই প্রমাণ করে। 

৯/১১'র মর্মান্তিক ঘটনার পর ক্রোধে উন্মত্ত আমেরিকা আফগানিস্তান আক্রমণ করল এবং ওসামা বিন লাদেন ও তাঁর সঙ্গীদের খুঁজে বার করার জন্য পুরো দেশটাকেই ধ্বংসস্তুপে পরিণত করে দিল। কাজের কাজ কিছুই হল না, লাদেন বা তৎকালীন তালিবান নেতা মোল্লা ওমর কারও টিকিটাও তারা খুঁজে পেল না। কিন্তু কিছু একটা তো করতে হবে, দেশবাসীকে তো দেখাতে হবে যে টুইন টাওয়ারের ওপর আক্রমণের প্রতিশোধ নেওয়া হয়েছে। অতএব, আফগানিস্তান থেকে সরে গিয়ে সাদ্দাম হোসেনকে বলির পাঁঠা করা হল, যে সাদ্দাম লাদেন ও আল কায়েদা'র লাগাতার বিরোধিতা করে এসেছেন, ইরাকের মাটিতে তাঁদের কোনওদিনও স্থান দেননি। সাদ্দামের কাছে প্রচুর ডব্লিউএমডি (উইপন্স অফ মাস ডেস্ট্রাকশন) আছে- এই মিথ্যা অজুহাতে বিধ্বংসী আক্রমণে আমেরিকা দেশটাকে ছারখার করে দিল। ২০১১'এ যখন যুদ্ধের সমাপ্তি ঘোষণা করা হল এবং বেশির ভাগ মার্কিনি সৈন্য বাড়ি ফিরে গেল, দেখা গেল প্রাক্তন শাসক দল বাথ পার্টি ইসলামিক স্টেট বা দায়েশে রূপান্তরিত হয়ে সারা দেশে ছেয়ে গেছে, বাগদাদের দুর্বল সরকারের কোনও ক্ষমতা নেই তাদের নিয়ন্ত্রণ করার। একই গল্প লিবিয়া, সিরিয়াতে। লিবিয়াতে গদ্দাফির পতনের ফলে সেখানে জঙ্গি গোষ্ঠীগুলির বাড়বাড়ন্ত। সিরিয়ায় মরণপণ গৃহযুদ্ধ চলছে। প্রেসিডেন্ট বাশার-আল-আশাদ কোণঠাসা, তবুও তিনি নাছোড়বান্দা; কিছু এলাকা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া সত্ত্বেও নিজের শাসন এখনও অটুট রেখেছেন। প্রতিটি দেশে যেখানে আমেরিকা এবং তার দোসর ন্যাটো হস্তক্ষেপ করেছে, সেগুলি জঙ্গি গোষ্ঠীগুলির মৃগয়া ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ফলে সন্ত্রাসবাদেরই আরও বৃদ্ধি হয়েছে। 

সন্ত্রাসবাদ নির্মাণ করার এই প্রক্রিয়া আফগানিস্তান থেকেই শুরু। ২০০১ সালের অক্টোবর মাসে ইঙ্গ-মার্কিন সেনা ঐ দেশে বম্বিং শুরু করে। ডিসেম্বর মাসে তালিবান সরকারের পতন ঘটে, লাদেন ও আল কায়দা পলায়ন করে। হামিদ কারজাইয়ের নেতৃত্বে একটা পেটোয়া সরকার তৈরি হয়। নতুন সংবিধান তৈরি হয়। জঙ্গিদের মোকাবিলা করার জন্য বিভিন্ন দেশের একটা মিলিত বাহিনী মোতায়েন করা হয়। বিদেশি সেনাদের আদলে আফগান সেনাদের ট্রেনিং দেওয়া হয়, অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করা হয়। ২০০৬-০৭ নাগাদ আমেরিকার শ্যেন দৃষ্টি ইরাকের ওপর নিবদ্ধ হয়, ঘোষণা করা হয় যে আফগানিস্তানে যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে। আক্রমণের তীব্রতায় তালিবানরা এতদিন পালিয়ে বেড়াচ্ছিল, গুহা গহ্বরে সেঁধিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বিশ্বের সর্বশক্তিমান দেশের অত্যাধুনিক অস্ত্রসম্ভারের দাপটও তাদের কোনওদিনও সম্পূর্ণ নিকেশ করে দিতে পারেনি। মৌলবাদের শেকড় দেশটায় গভীর ও বিস্তৃত। শহরগুলো মার্কিনিদের সহায়তায় আফগান সেনাদের কব্জায় থাকলেও, বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চল ও প্রত্যন্ত পাহাড়ী এলাকাগুলোতে তালিবানরাই রাজ করেছে, আমেরিকান সেনাও সেখানে দাঁত ফোটাতে পারেনি। ইরাক যুদ্ধ শুরুর আগে যখন মার্কিনিদের দাপট, হিংস্রতা সবচেয়ে বেশি ছিল, সেই সময়েও গ্রামেগঞ্জে মেয়েদের গোপনে স্কুল করতে হয়েছে, তালিবানিদের নজরদারি তখনও ঐ সব অঞ্চলে ছিল এতটাই তীক্ষ্ণ ও প্রখর। 

ইরাক যুদ্ধের ফলে আমেরিকানদের দৃষ্টি সরে গেল যা তালিবানদের দম ফেলার সুযোগ করে দিল। তারা আবার সংঘবদ্ধ হতে শুরু করল। চোরাগোপ্তা আক্রমণ শুরু হল, সরকারি অফিস, সেনা দফতরকে নিশানা করা হল। আমেরিকা প্রমাদ গুণল। ২০০৯ সালে প্রেসিডেন্ট ওবামা আরও ৩০,০০০ সৈন্য মোতায়েন করল। আফগান সেনাদের দক্ষতা বাড়াতে তাদের বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া হল যাতে কিছু সময় বাদে তাদের হাতে দেশের নিরাপত্তা অর্পণ করা যেতে পারে। আট বছরের যুদ্ধে এই প্রথম সৈন্য অপসারণের কথা উল্লিখিত হল। জুলাই ২০১১'তে অপসারণের প্রথম পর্বের দিনক্ষণ ঠিক হল। দশ বছরের যুদ্ধে দেখা গেল ১৮০০ মার্কিন সেনা প্রাণ হারিয়েছেন, ৪৪৪ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে। কত হাজার আফগান মানুষ বা তালিবান যে মারা গেছেন তার হিসাব রাখার কেউ কোনও প্রয়োজন বোধ করেনি। ২০১২'র জানুয়ারিতে তালিবান কাতারে তাদের একটা অফিস খোলার চুক্তি করল। এ থেকে বোঝা গেল যে দেশে একটা নির্বাচিত সরকার থাকা সত্ত্বেও আমেরিকা উপলব্ধি করতে পেরেছে যে তালিবানের সাহায্য ছাড়া আফগানিস্তান থেকে সম্মানজনক অপসারণ অসম্ভব। 

ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর তাঁর স্বভাবসুলভ বাগাড়ম্বর শুরু করলেন। বললেন, যুদ্ধ চলবে, সৈন্য তুলে নিয়ে সন্ত্রাসবাদীদের শক্তি সঞ্চয় করার সুযোগ দেওয়া বরদাস্ত করা হবে না। এই প্রথম একজন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট আফগানিস্তানের পুনর্নির্মাণে ভারতের ভূমিকাকে গুরুত্ব দিলেন এবং একই সাথে পাকিস্তানকে জঙ্গিদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য তুলোধোনা করলেন। ট্রাম্পের নির্দেশে মার্কিন সৈন্য গ্রামীণ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ল, বিমান আক্রমণ তীব্র করা হল। তালিবানরা তৈরি ছিল। তারা প্রত্যাঘাত করল। কাবুলে সন্ত্রাসবাদী হানায় ১১৫ জন নিহত হলেন, সারা দেশ জুড়ে হিংসা ছড়িয়ে পড়ল। ট্রাম্পের বাগাড়ম্বর থমকে গেল, তিনি আলোচনার প্রস্তাব দিলেন। দু' পক্ষের দরাদরি শুরু হল যা থেকে পরিষ্কার হয়ে গেল যে কুড়ি বছরের দমনপীড়নের পরেও তালিবানদের সেভাবে শক্তিক্ষয় হয়নি। 

২০১৯'এর ফেব্রুয়ারি মাসে দোহাতে আমেরিকা ও তালিবানের মধ্যে উচ্চ পর্যায়ের আলোচনা হল। আমেরিকা সৈন্য সরিয়ে নেবে, তার পরিবর্তে তালিবানকে নিশ্চিত করতে হবে যে কোনও জঙ্গি সংগঠন আফগানিস্তানে ঘাঁটি গাড়বে না কিংবা সেখান থেকে আমেরিকাকে আক্রমণ করার পরিকল্পনা করবে না। মার্কিন দূত জালমাই খালিলযাদ বললেন যে তাঁরা চেষ্টা করবেন, তালিবান, আফগান সরকার এবং অন্যান্য গোষ্ঠীর মধ্যে যেন সমঝোতামূলক কথাবার্তা হয়। তাঁরা যুদ্ধবিরতিরও চেষ্টা করবেন। ঠিক এক বছর বাদে খালিলযাদ এবং তালিবান দূত মোল্লা আবদুল গনি বারদার (যাঁর তালিবান শাসনে রাষ্ট্রপতি হওয়ার সম্ভাবনা আছে) দোহাতে শান্তি চুক্তি সই করলেন। চুক্তির মূল পয়েন্টগুলি হল: 

(১) তালিবান গ্যারান্টি দিল তাদের দেশকে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের জন্য ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না; 

(২) আমেরিকা ধাপে ধাপে সৈন্য সরিয়ে নেবে; 

(৩) পরের মাস থেকে আন্তঃ-আফগান আলোচনা শুরু হবে কিন্তু আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি প্রস্তাব দিলেন যে আলোচনায় বসার আগে তালিবানদের কিছু শর্ত মানতে হবে; 

(৪) আশ্চর্যজনক ভাবে চুক্তিতে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করার কোনও প্রস্তাব নেই। তাই চুক্তির পরেই আক্রমণ প্রতি-আক্রমণ চলতে থাকল। সেপ্টেম্বর মাসে আন্তঃ-আফগান আলোচনা হল। সরকার প্রায় ৫০০০ তালিবান বন্দীদের মুক্তি দিল। সরকার যুদ্ধবিরতির আর্জি জানাল। তালিবান এর বিপরীতে ইসলামিক রীতিতে দেশ পরিচালনার ডাক দিল। 

২০২১'এর এপ্রিল মাসে প্রেসিডেন্ট বাইডেন ঘোষণা করলেন যে আন্তঃ-আফগান আলোচনায় যদি কোনও সন্তোষজনক সমাধান নাও হয়, যদি তালিবান আফগান সেনা এবং নাগরিকদের ওপর আক্রমণ অব্যাহত রাখে, তবুও ১১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে আমেরিকা সমস্ত সৈন্য সরিয়ে নেবে। 'আমেরিকার দীর্ঘতম যুদ্ধ শেষ করার সময় হয়ে গেছে', তিনি পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন। এর চেয়ে দায়িত্বজ্ঞানহীন কোনও সিদ্ধান্ত হতে পারে! যুদ্ধ শুরু করেছিল আমেরিকা, যুদ্ধবিরতি যাতে হয় সেটার জন্য তারা কোনও চেষ্টাই করল না। একটা দেশকে গৃহযুদ্ধের মধ্যে ঠেলে দিয়ে তারা স্রেফ পলায়ন করল। তালিবান এর সুযোগ নিল। তারা পরিষ্কার জানিয়ে দিল যে বিদেশি সৈন্য সম্পূর্ণ অপসারণ না হওয়া পর্যন্ত তারা কোনও আলোচনায় বসবে না। 

২০১২ থেকেই আমেরিকা বুঝে গিয়েছিল যে আফগানিস্তানের ভাগ্য তালিবানের হাতে, আফগান সরকারের জনভিত্তি দুর্বল। তাই তারা মৌলবাদী হলেও তালিবানদের গুরুত্ব দিয়েছে। তারা নিজেদের দেশ ও নাগরিকদের নিরাপত্তা ছাড়া কোনও কিছুকে পাত্তা দেয় না। তাই তাদের স্বার্থ এবং সুরক্ষা যাতে কোনও ভাবেই বিঘ্নিত না হয় সেটা তারা তালিবানদের দিয়ে সাদা-কালোয় চুক্তিতে সই করিয়ে নিয়েছে। এরপর আফগানিস্তানে মানবাধিকার বা নারী স্বাধীনতা রক্ষা হল কি হল না, তা নিয়ে তাদের বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। নারী স্বাধীনতাকে বিশ্বের সর্বশক্তিমান দেশ কি কোনওদিনও অগ্রাধিকার দেয়? যদি দিত তাহলে সৌদি আরবে মহিলাদের শুধুমাত্র গাড়ি চালানোর অধিকার পাওয়ার জন্য বহু বছর অপেক্ষা করতে হত না। সেখানকার রাজ পরিবারের সঙ্গে আমেরিকার রাষ্ট্রপতিদের তো ওঠাবসা, তার জন্য কি সৌদিদের নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিকে তারা এতটুকুও প্রভাবিত করতে পেরেছে? তাদের এবং আফগান সিভিল সোসাইটি'র সরব উপস্থিতির কারণে শহরাঞ্চলে নারীরা গত কুড়ি বছর স্বাধীন জীবনের স্বাদ পেয়েছে। এর বাইরে যে বিশাল প্রত্যন্ত অঞ্চল, সেখানে নারীরা যে তিমিরে ছিলেন সেই তিমিরেই আছেন। মৌলবাদ, পুরুষতন্ত্রের দাপট সেখানে সীমাহীন। 

তালিবান কি এই কুড়ি বছরে পাল্টেছে? নব্বইয়ের দশকে তারা টিভি, সিনেমা, মেয়েদের স্কুল, কাজ নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল, এবারও নিশ্চিত তাই করবে। তারা কাবুল দখল করার পরই আতঙ্ক ছড়িয়েছে, মানুষ দেশ ছেড়ে পালাচ্ছেন, মহিলাদের ওপর অত্যাচার হচ্ছে, তাঁরা  ঘরবন্দী হয়ে গেছেন। তবে তাদের মেলামেশার গণ্ডি প্রসারিত হয়েছে। নব্বইয়ের দশকে তাদের সরকারকে মাত্র তিনটি দেশ স্বীকৃতি দিয়েছিল। এবার চিন, রাশিয়া, পাকিস্তান, ইরান সহ কিছু দেশের স্বীকৃতি পাওয়া শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষা। এটাই একমাত্র আশা। আন্তর্জাতিক চাপের ফলে যদি তাদের শাসনব্যবস্থা শিথিল হয়, নারীদের শ্বাস নেবার একটা পরিসর তৈরি হয়। 


Tuesday 17 August 2021

ভবিষ্যনীতির ছাঁচেই শিক্ষানীতি ২০২০

'আমাদের নিজস্ব বলে কিছুই থাকবে না'

গৌতম দাস

 

স্টিম ইঞ্জিন আবিষ্কারের পর উদীয়মান শিল্প ক্ষেত্রে সৃষ্টি হয়েছিল নতুন উৎপাদন ব্যবস্থা একেই আমরা শিল্প বিপ্লব বলে জানি পরবর্তী দুই-তিন শতকে এর নানা ভোল বদলের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে আমরা শেষ পর্যন্ত পৌঁছে গেলাম চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে শাসকরা তাদের নতুন শিক্ষানীতিতে (নয়া শিক্ষানীতি ২০২০) এই বিপ্লবের কথাই আমাদের শুনিয়েছে। কিন্তু এই বিপ্লবের সারমর্ম আমরা বুঝতাম না, যদি ওয়ার্ল্ড ইনমিক ফোরাম'এর সর্বময় কর্তা ক্লস্ সোয়াস দুটি বই লিখে আমাদের অন্ধ মননে আলো না ফেলতেন

বই দুটির একটি হল- 'কোভিড ১৯: দ্য গ্রেট রিসেট' অন্যটি, 'ফোর্থ ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভল্যুশন'। দুর্বল চিত্ত হলে বইটি পড়ে কারও লোমহর্ষক আতঙ্ক কাহিনী বলে ভ্রম হতে পারে প্রযুক্তির দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে, তার ফলে আমাদের পরিচিত দুনিয়াটা হঠাৎ এমনভাবে বদলে যাবে যে আমরা শুধু জীবনযাপনের পদ্ধতি বদলাতে বাধ্য হ তাই নয়, বদলে যাবে জীবন সম্পর্কে আমাদের ধারণা…২০৩০এর মধ্যে আমাদের নিজস্ব বলে কিছুই থাকবে না, অথচ আমরা সুখেই মজে থাকব।’

অর্বাচীনের প্রলাপ বলে মনে হচ্ছে? একেবারেই নয় প্রযুক্তি বলতে ক্লস সোয়াস বুঝিয়েছেন, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ন্যানো টেকনোলজি, থ্রিডি প্রিন্টিং, সিন্থেটিক বায়োলজি, ইন্টারনেট অফ থিংস অর্থাৎ আন্তর্জালে আবদ্ধ সমস্ত পরিষেবা, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং ও এমনতর হরেক কিসিমের ডিজিটাল প্রযুক্তি কৃত্রিম বিপর্যয় ঘটিয়ে প্রকৃত ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতির জায়গা দখল করে নেবে ডিজিটাল অর্থনীতি প্রকৃত মুদ্রার বদলে আসবে ডিজিটাল মুদ্রা লগ্নি পুঁজির ধনকুবেররা নেতৃত্ব দেবে তার সাগরেদ হবে তথ্য প্রযুক্তির অতিকায় সংস্থা, ডিজিটাল লেনদেনের বৃহত্তর কর্পোরেট এবং দানবীয় শক্তির অধিকারী বহুজাতিক ওষুধ নির্মাতারা সারা বিশ্বকে নতুন অনুশাসনে বেঁধে ফেলতে পুঁজির এক নতুন অবতার ছড়ি ঘোরাবে সর্বত্র তার নাম ফিলানথ্রপিক ক্যাপিটালি ট্রোজানের ঘোড়ার মতো মানব হিতৈষীর পোশাক পরে, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গবেষণা প্রতিষ্ঠান এমনকি প্রশাসনের অন্দরে ঢুকে পড়বে প্রবল ক্ষমতাশালী এই পুঁজি ডিজিটাল প্রযুক্তির অভাবনীয় পরিবর্তনের কারণে ব্যবসায়িক লেনদেন বা বাণিজ্যের খরচ প্রায় শূন্যের কাছে পৌঁছে যাবে শ্রমের মূল্য এমন একটি স্তরে নেমে যাবে যা অভাবনীয় শ্রমের বাজার ভয়ঙ্কর ভাবে সংকুচিত হবে এবং তা দুটি চরম স্তরে দ্বিধা বিভক্ত হবে এর এক প্রান্তে থাকবে আধুনিকতম প্রযুক্তিতে প্রশিক্ষিত অত্যন্ত উচ্চ মজুরির শ্রমিক, অন্য প্রান্তে গায়ে-গতরে খাটনির কাজে যুক্ত থাকা দাস মজুর ধাপে ধাপে সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত হবে মধ্যবর্গীয় কাজের বাজার ক্লস্ সোয়াস নিজেই বলেছেন, এমন একটি সমাজব্যবস্থা যে কোনও জনগোষ্ঠীর কাছেই বিভীষিকা হতে বাধ্য তবুও কোনওভাবেই চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ও ডিজিটাল অশ্বমেধের ঘোড়াকে আটকানো যাবে না নতুন প্রযুক্তির দৌলতে রাষ্ট্রের নজরদারি হবে অনেক বেশি তীক্ষ্ণ ও অভ্রভেদী বিক্ষোভ ও বিদ্রোহ দমনে রাষ্ট্র হবে অনেক বেশি নিখুঁত এবং পারদর্শী

এই যদি ভবিষ্যৎ পৃথিবীর প্রতিচ্ছবি হয়, তাহলে ডিজিটাল একাধিপত্যের যারা মালিক সেই শাসকবর্গ, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এই ব্যবস্থার পক্ষে মানানসই ছাঁদেই গড়ে তুলবে; এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। এই কারণেই নতুন শিক্ষানীতিকে একুশ শতকের উপযোগী বলে ঘোষণা করা হয়েছে উল্টোভাবে বলা যায়, শাসক তার অর্থনীতি ও রাষ্ট্রনীতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে শিক্ষাক্ষেত্রকে গড়ে তুলবে- এতে কোনও সন্দেহের অবকাশ থাকে কী? থাকে না, থাকতে পারে না সে কথাটাই জোরের সঙ্গে শিক্ষানীতির ১১.৪ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে: সমগ্রতার ভাবনায় সৃষ্ট এবং বহু শাখায় বিভক্ত এই শিক্ষাব্যবস্থা ভারতকে একুশ শতকের দিকে এবং চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের অভিমুখে চালিত করবে।’

কোনও রাখঢাক না রেখেই ক্লস্ সোয়াস বলেছেন,চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সবচেয়ে নৈরাশ্যবাদী এবং অমানবিক চেহারাটা এমন হতে পারে যে রোবট নিয়ন্ত্রিত গোটা মানবজাতি তাদের হৃদয় ও মনকে নির্বাসনে পাঠাতে পারে।’ এটাই যদি শাসকের উচ্চারিত অভিলাষ হয়, তবে রোবটতন্ত্রের অধীন, চিন্তার দাসত্বের পক্ষে মানুষের মনকে গড়ে তুলতে হবে একেবারে গোড়া থেকে শিক্ষা ও সমাজের পরতে পরতে সেই ভাবনাই চারিয়ে দিতে হবে যা কিছু মানবিক বা সামাজিক মূল্যবোধের অনুসারী হবে, সেগুলোকে সেকেলে এবং একুশ শতকের অনুযোগী বলে আস্তাকুঁড়েয় ছুঁড়ে ফেলা হবে সেই দায় থেকেই নয়া শিক্ষানীতির প্রণেতারা বলছেন,শিক্ষার লক্ষ্য হবে এমন এক সমগ্র এবং সর্বাঙ্গীন চরিত্র গঠন করা যার মাধ্যমে কোনও ব্যক্তি একুশ শতকের উপযোগী দক্ষতা অর্জন করবে...পাঠ্যসূচি এবং শিক্ষণ পদ্ধতির খোলনলচে বদলে ফেলে সম্পূর্ণ নতুনভাবে গড়ে তুলতে হবে যাতে এই অতি প্রয়োজনীয় লক্ষ্যে পৌঁছনো যায় একেবারে প্রাক-প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত, প্রতিটি স্তরে কীভাবে এই নতুন মূল্যবোধ এবং নতুন দক্ষতা পঠন-পাঠনের সঙ্গে নিবিড় ভাবে জুড়ে দেওয়া যায়, সেই পথ বাতলে দেবে এনসিইআরটি।’ (অনু: ৪.৪)

তাহলে এতদিন যে বিজ্ঞানের মৌলিক শিক্ষা, অর্থনীতি ও ভূগোলের পাঠ, মানব সমাজ ও ইতিহাসের ধারণা, ভাষা ও সংস্কৃতির চর্চাকে আধুনিক শিক্ষার ভিত হিসেবে ধরা হ, সে সবের কী হবে? এক কথায় সেগুলি জাহান্নামে যাবেকারণ, রোবট নিয়ন্ত্রিত মানবতাহীন অর্থনীতিতে এসব শুধু মূল্যহীন নয়, দারুণ ভাবে প্রতিবন্ধক এমনকি বিপদজনকও বটে তাই পাঠ্যসূচিতে এইসব বিষয়কে একেবারে কোর এসেন্সিয়াল পর্যায়ে নামানো হবে অর্থাৎ নিম্নতম স্তরে সংকুচিত করা হবে তাহলে ছাত্র-ছাত্রীদের পঠন-পাঠনের বিষয়টা কী থাকবে? শিক্ষানীতির ভবিষ্যৎদ্রষ্টারা বলছেন, বর্তমানে প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত সার্বিকভাবে মাত্র ৫ শতাংশ ছাত্র-ছাত্রী বৃত্তি শিক্ষা নেয় সংখ্যাটাকে তারা অন্ততপক্ষে ৫০ শতাংশ করতে চাইছেন কিন্তু, কোন বৃত্তি বা পেশার জন্য দেওয়া হবে এই শিক্ষা? শিক্ষার সমস্ত স্তরে, যে সমস্ত বিষয়ে দক্ষতা বাড়ানোর দিকে নজর দেওয়া হবে সেগুলো হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ত্রিমাত্রিক নির্মাণ, ভেষজ পদ্ধতিতে সামগ্রিক স্বাস্থ্যের ধারণা, পরিবেশের শিক্ষা এবং অবশ্যই বিশ্ব নাগরিক হয়ে ওঠার পাঠ।’ ( অনু: ৪.২৪)

নতুন বিশ্ব ব্যবস্থার ভবিষ্যৎ নাগরিকরা কোন মাপকাঠিতে সফল বা অ-সফল বলে নির্বাচিত হবেন? পাশ-ফেলের কড়াকড়ি আর থাকবে না মুখস্থবিদ্যার উপর নির্ভরতা বিদায় নেবে কমে যাবে কোচিং প্রতিষ্ঠানগুলোর রমরমা অভিভাবকদের গাঁটের পয়সা অপ্রয়োজনীয় টিউশন দিতে খরচ হবে না বন্ধ হবে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ হ্যাঁ, এটাই দাবি করছেন শিক্ষানীতির প্রণেতারা

তাহলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো চালাবে কে বা কারা? মাধ্যমিক থেকে উচ্চশিক্ষা, সমস্ত স্তরেই লাল কার্পেট বিছিয়ে স্বাগত জানানো হবে পুঁজির নতুন অবতারদের, যাদের পোশাকি নাম ফিলানথ্রপিক ক্যাপিটালিজম আমরা জানি, বিশ্ব জুড়ে বিভিন্ন ফাউন্ডেশনের নামে এই পুঁজি কীভাবে ছড়ি ঘোরায় নিয়ন্ত্রণ করে উচ্চতম গবেষণার প্রতিষ্ঠানগুলোকে একুশ শতকের যে নতুন প্রযুক্তির ডালি সাজিয়ে তারা নতুন অর্থব্যবস্থা স্থাপন করতে চাইছে, তার জন্য যে প্রশিক্ষিত মজুর দরকার, তার পাকাপাকি একটা ব্যবস্থা চাই ভবিষ্যতের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো হবে সেই মজুর তৈরির কারখানা যন্ত্রের অনুশাসন শিখে, ক ভালো ভবিষ্যতের মজুর তাঁরা তৈরি হবেন, তার নিরিখে স্থির হবে পাশ-ফেলের মানদণ্ড সেই মানদণ্ড বিচারের ভার কার ওপর বর্তাবে? সেটাও যন্ত্র।

‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উপর নির্ভর করে যে সফটওয়্যার গড়ে তোলা হবে সেটাই বিদ্যালয়ের প্রতিটি শিক্ষাবর্ষের ছাত্রদের মূল্যায়নের ভিত্তি হবে।’ কিন্তু পড়াবেন কারা? নীতি নির্ধারকরা বলছেন, প্রচলিত ব্যবস্থায় যারা ভাল শিক্ষক, তাঁরা অপাংক্তেয়। নতুন ব্যবস্থাতেও তাঁরা ভালো শিক্ষক হবেন, এটা ধরে নেবার কোনও কারণ নেইতাই তাঁদের জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগে গড়ে তোলা হবে নতুন শিক্ষণ পদ্ধতি যারা শাসকের এই নতুন পদ্ধতি সফলভাবে রপ্ত করবেন, যন্ত্রবৎ শিক্ষার নতুন অর্থ ছাত্র-ছাত্রীদের মাথায় ঢুকিয়ে দেবেন, তাঁদের জন্য ইনামে ব্যবস্থা থাকবে ভদ্র ভাষায়, নসেন্টিভ তাঁদের মাইনে এবং চাকরির ভবিষ্যৎ সবই নির্ভর করবে এই মূল্যায়নের উপর তাই 'আর দেরি নয়, আর দেরি নয়' সমস্ত বাড়ি এবং স্কুলে ইন্টারনেট সংযোগ পৌঁছে গেলে, স্মার্টফোন বা ট্যাবলেট সবার হাতে এসে গেলে, পাঠ্যসূচির অন্তর্গত বিষয়গুলো অনলাইন অ্যাপএর মাধ্যমে চালানো সম্ভব হবে।’ বিদায় নেবে খাতাপত্র ও ছাপানো বই

চালু হবে একাডেমিক ক্রেডিট স্কোর প্রশাসকের কড়া নজরদারি এড়িয়ে কোনও বেয়াদব ছাত্র-ছাত্রী শিক্ষার চৌকাঠ ডিঙোতে পারবে না বিরুদ্ধ মত বা বিতর্ক- এসবে ধাত্রী ভূমি হিসেবে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে পরিচিতি ছিল, তা অতীতের গর্ভে বিলীন হবে কিন্তু অনলাইন সফটওয়্যার নির্ভর উচ্চ প্রযুক্তির শিক্ষাব্যবস্থায় সমাজের কতজন অংশ নিতে পারবেন? নিশ্চিত ভাবেই তাঁরা সংখ্যায় হবেন অনেক কম তাই অত বেশি স্কুলেরও দরকার হবে না প্রতি ৫ বা ১০ কিলোমিটার ব্যাসার্ধ জুড়ে কোনও এলাকায় একটি মাত্র মাধ্যমিক স্তরের স্কুল থাকবে তাকে ঘিরে থাকবে ছোট কয়েকটি প্রাথমিক স্কুল এটাকেই বলা হবে স্কুল কমপ্লেক্স বা স্কুল ক্লাস্টার (অনু: ৭) তাহলে, রি, নিম্নবিত্ত এবং দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা মানুষজনের সন্তানরা কোথায় পড়াশোনা করবে? 

আর্থিক ভাবে অবহেলিত এই বিশেষ শ্রেণির জন্য শিক্ষানীতির চিন্তকরা মাথা ঘামিয়ে দারু একটি রাস্তা বার করেছেন তাদের জন্য থাকবে কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য পরিচালিত মুক্ত বিদ্যালয় সেখানে আরও নিম্নশ্রেণির মজুর তৈরির প্রচেষ্টা থাকবে এটাই হবে হোলিস্টিক বা সমগ্র ভাবনায় অনুপ্রাণিত শিক্ষা সর্বশিক্ষা অভিযান সমগ্র শিক্ষা প্রকল্পের অতিকায় হাঁ-মুখে বিলুপ্ত হবে।’ এই অনিবার্য বিলুপ্তির দৃশ্যকল্প ভেবে কেউ কেউ হয়তো আত্মহারা হবেন মিডিয়ার বাজনদাররা আরও বেশি উন্মত্ত হবেন তবু একটি প্রশ্ন কখনই চাপা পড়বে না- আমাদের শিক্ষার ইতিহাসে শাসকের দিশা বদলায় কী?