Sunday 26 November 2023

ডিপফেক ও AGI

যাহা পাই তাহা গিলি?

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


 

কিছুদিন আগেও বিশ্ব জুড়ে DeepFake বা গভীর ছলনা নিয়ে এক ঝড় বয়ে গেল। ফটোশপ বা সুপার-ইমপোজিশনের যুগ পেরিয়ে আমরা চলে এসেছি এমন এক নিখুঁত ও নির্ভুল ছলনার জগতে যেখানে সত্য-মিথ্যার সমস্ত সূক্ষ্ম রেখাগুলিও বোধহয় অযাচিত হয়ে পড়েছে। যেন কোনও উপায় নেই, ফাঁকিটুকু বুঝে ওঠার! ‘আশার ছলনে ভুলি কী ফল লভিনু, হায়, তাই ভাবি মনে?’- এ তো আশার ছলনে ভুলি নয়, বাটপাড়ির ষোলআনা। ‘ছিল বেড়াল হয়ে গেল রুমাল’এর মতো হাঁটছিল কলকাতার গলি ধরে, চলে গেল বাকিংহাম প্রাসাদের সদর দরজায়। হামেশাই হচ্ছে।

সোরগোল উঠল, যখন এই মাসের গোড়ায় কন্নড় অভিনেত্রী রশ্মিকা মানদানা’র একটি ফেক ভিডিও ইন্টারনেটে তুমুল ভাইরাল হল এবং অভিনেত্রী স্বয়ং তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়লেন। ব্রিটিশ অভিনেত্রী জারা প্যাটেলের একটি খোলামেলা ভিডিও’তে রশ্মিকা’কে প্রতিস্থাপন করে নকলটিকে ভাইরাল করা হয়। যতক্ষণ না সেই ভিডিও রশ্মিকা’র দৃষ্টিগোচর হয়েছে ও তিনি প্রতিবাদ জানিয়েছেন, ততক্ষণ অবধি কেউ ঘুণাক্ষরেও বুঝতেই পারেননি যে ভিডিও’টি ফেক। এই অবধি না হয় কিছুটা বোঝা গেল। কিন্তু সেই ফেক ভিডিও’টি কে তৈরি করে সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড করেছে, তা আজও জানা যায়নি। কারণ, দিল্লি পুলিশের তদন্তে মেটা জানিয়েছে, ইতিমধ্যে সেই ভিডিওটি হৈচৈ শুরু হওয়ার পরে শুধুমাত্র ডিলিট করা হয়নি, যে অ্যাকাউন্ট থেকে পোস্ট করা হয়েছিল তাও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আর অ্যাকাউন্ট’টি যেহেতু বানানো হয়েছিল ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক (ভিপিএন)’এর মাধ্যমে ভুয়ো পরিচয় দিয়ে, তাই তার নাগাল পাওয়া আর সম্ভব নয়।

এরপর দেখা গেল, বিনোদন জগতে ক্যাটরিনা কাইফ, কাজল প্রমুখদের ছাপিয়ে ডিপফেক ভিডিও তৈরি হল এমনকি রতন টাটা’র নামেও, যেখানে একটি অনলাইন বেটিং’এ অংশ নেওয়ার জন্য তাঁকে সকলকে আহ্বান জানাতে দেখা গেল। সাম্প্রতিক ইজরায়েল-হামাস সংঘাতের আবহেও দেখা দিল এমনতর নানাবিধ ফেক ভিডিও’র রমরমা যা দিয়ে জনমতকে প্রভাবিত করার প্রবল চেষ্টা। অর্থাৎ, সোশ্যাল মিডিয়ায় অসত্য প্রচার এখন এমন গভীরতা পেয়েছে যাকে সাদা চোখে সত্য বলে মেনে নেওয়া অতীব সহজতর হয়েছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তার প্রাথমিক স্তর পেরিয়ে এখন এসে পৌঁছেছে ‘generative AI’এর স্তরে; যেখানে তার তথ্য ভাণ্ডার আরও স্ফীত হয়েছে এবং গণনা সক্ষমতা এমন উচ্চতায় পৌঁছেছে যে সে নিত্য নতুন ‘সৃষ্টিশীল’ নির্মাণেও সক্ষম। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ডিজিটাল ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ হ্যানি ফারিদ জানাচ্ছেন, ‘প্রতি ১২ মাসে প্রযুক্তি দ্বিগুনতর সক্ষম ও দ্রুততর হয়ে উঠছে।’ এই প্রবণতা আমাদের কোন ভবিষ্যৎ পানে নিয়ে চলেছে, আমরা জানি না, কিন্তু চ্যাটজিপিটি’র উদ্গাতা ওপেনএআই’এর প্রতিষ্ঠাতা স্যাম অল্টম্যান’কে নিয়ে গত এক সপ্তাহ ধরে যা হয়ে গেল, তাও এক আশ্চর্যজনক ঘটনা বৈকি! ডিপফেক’এর সঙ্গে এই ঘটনার কি কোনও সংযোগসূত্র আছে?

আচম্বিতে দেখা গেল, স্যাম অল্টম্যানকে ‘ওপেনএআই’এর পরিচালন বোর্ড বরখাস্ত করেছে এই অভিযোগে যে, তিনি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে বাণিজ্যিক লাভালাভের বাসনায় এমন এক পর্যায়ে নিয়ে চলেছেন যেখানে সমগ্র মানবজাতির সামনে এক সমূহ বিপদ উপস্থিত। সেই বিপদ কী, তা নিয়ে ততটা বিস্তৃত না হলেও বলা হল, Project Q* নামক এমন এক অ্যালগরিদমের উদ্ভাবন করা হয়েছে যার দরুণ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কোনও প্রশিক্ষণমূলক তথ্য ব্যতিরেকেই নিজের সক্ষমতাতে প্রাথমিক গণনার সমস্যাগুলোকে সমাধান করতে পারে। তা যদি পারে, তাহলে আজকের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা পৌঁছে যাবে Artificial General Intelligence (AGI)’এর এমন এক স্তরে যা তাকে মানব মস্তিষ্কের সমকক্ষ করে তুলতে পারে। এই AGI হল মানুষের যুক্তি-তর্ক সমতুল্য এক পরিণত সক্ষমতা। তেমন হলে, মনুষ্যজাতির পক্ষে তা এক চরম বিপদের কারণ হতে পারে- এই অনুমানে ওপেনএআই’এর একদল গবেষক বোর্ডের কাছে চিঠি দিলে ভীত-চকিত বোর্ড তাদের কর্ণধার স্যাম অল্টম্যানকে সংস্থা থেকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত নেয়।

এরপর আমরা জানি, জল অনেক দূর অবধি গড়ায়। মাইক্রোসফট বরখাস্ত হওয়া স্যাম অল্টম্যানকে তাদের কোম্পানিতে নিয়োগ করে এবং পাশাপাশি, ওপেনএআই’এর প্রায় ৭০০ কর্মচারী স্যামকে নিজেদের কোম্পানিতে পুনর্বহালের জন্য পরিচালন বোর্ডের কাছে আবেদন জানায়। স্যাম ফিরে আসেন এবং যে বোর্ড তাকে বরখাস্ত করেছিল, তা তৎক্ষণাৎ ভেঙ্গে দেন। আপাতত স্যাম আবার ওপেনএআই’এর সিইও হিসেবে পুনর্নিয়োজিত হয়েছেন। তাহলে কি AGI সম্পর্কিত যে আশঙ্কা ঘনীভূত হয়েছিল তা অমূলক ছিল, নাকি, সেই লক্ষ্যেই আবার নতুন করে ওপেনএআই তাদের অভীষ্ট লক্ষ্যে এগোতে থাকবে?

এই প্রসঙ্গের উত্থাপন এই কারণেই যে, ‘ডিপফেক’ প্রবণতা বা AGI- এমন এক সম্ভাবনা ও আশঙ্কার ইঙ্গিত দিচ্ছে, যেখানে সত্য-মিথ্যার সমস্ত রসায়ন দ্রবীভূত হয়ে এক আশ্চর্য মায়াজগৎ নির্মাণ করে চলেছে। সাদা চোখে দেখে বোঝার উপায় থাকবে না, কোন তথ্যটা মিথ্যে বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। সাধারণজনের কাছে সেইসব উন্নত টুল’ও নেই যা দিয়ে তারা দুধ থেকে জলকে আলাদা করতে পারে। সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানিগুলোও মিথ্যাচারের উৎস সন্ধানে সদা বাধ্য নয়। তার ওপর, এমন সব প্রযুক্তিরও উদ্ভাবন হয়েছে, যা দিয়ে মেঘনাদের মতো মেঘের আড়াল থেকে তীর বর্ষণ করা যায়, যাদের নাগাল পাওয়া কখনও কখনও নিতান্তই দুষ্কর।

আমরা এসে উপস্থিত হয়েছি এমন এক কঠিন বাতাবরণে যেখানে বহু এলেমদার প্রযুক্তিবিদদেরও মাথার ঘাম ছুটে যাচ্ছে যথাযথ তথ্যের নাগাল পেতে। উল্টোদিকে, ডিপফেক তৈরি করতে এমন সব সহজ টুল এসে গিয়েছে যে তা যে কোনও সামান্য স্মার্ট ফোনে আঙ্গুল চালানো প্রতারকের পক্ষে একেবারেই আয়াসসাধ্য। সেলিব্রিটিদের ভিডিও ও অডিওকে একশো শতাংশ নিখুঁত রেখে যে কোনও পণ্যের প্রমোশনে ডিপফেক বানানো এখন জলভাত। কোনও কোম্পানির কর্ণধার আরেক কোম্পানির কর্ণধারের কাছ থেকে এমন সব ‘বিশ্বাসযোগ্য’ কল পাচ্ছেন যে সেই সুবাদে কোটি কোটি টাকার প্রতারণামূলক ট্রান্সফারের মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনাও এখন আকছার দেখা যাচ্ছে। অভিভাবকদের কাছে তাদের কচি বাচ্চাদের ‘অপহরণ’ হয়ে যাওয়ার এমন সব কল ও ইমেজারি আসছে যে তারা বিশ্বাস করে ‘মুক্তিপণ’ দিয়ে ফেলছেন। এরপর AGI আমাদের কোথায় নিয়ে ফেলতে পারে, তা ভাবতে গিয়েও শিউরে উঠছেন কেউ কেউ। আর সে কারণেই স্যাম অল্টম্যানকে নিয়ে এত হাঙ্গামা হয়ে গেল।

তাহলে উপায়? অবশ্য এমনও নয় যে, জামতারার মতো ডিপফেক, প্রতারণা ও রোজগারের এক সর্বজনীন উপায় হয়ে উঠবে অথবা AGI’এর ‘স্বাধীন’ যুক্তি-তর্ক আমাদের সর্বদাই ভুল পথে নিয়ে যাবে। তা সত্ত্বেও পরিস্থিতিটা এই যে, এক নতুন লড়াইয়ের জমিতে এসে আমরা উপস্থিত হয়েছি যেখানে সত্য-মিথ্যার প্রাথমিক বয়ানটুকুও হয়তো হারিয়ে যেতে বসেছে। হ্যানি ফারিদ বলছেন, ‘সোশ্যাল মিডিয়া থেকে দূর হঠো। সংবাদ পরিবেশনের জন্য সোশ্যাল মিডিয়া নির্মিত হয়নি; তা হয়েছিল বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ এবং অবসর যাপনের জন্য। অতএব, আমাদের অলস প্রবৃত্তিকে ত্যাগ করতে হবে। ‘যাহা পাই তাহা গিলি’ নয়, যা পেলাম তাকে যদি যথার্থই দেখতে-বুঝতে হয় তাহলে চিন্তাশক্তিকে প্রখর করতে হবে, অন্যান্য সমজাতীয় তথ্য ও সংবাদের সঙ্গে তাকে মিলিয়ে নিতে হবে। জগৎ বড়ই জটিল, তাকে ৩০ সেকেন্ডের টিকটক ভিডিও’তে বন্দী করে ফেললে নিজেরই মুশকিল।’

এ এক মহারণ বটে। এতদিন প্রযুক্তি ছিল মানুষের সহায়ক হিসেবে। এখন উলটো পথে বরং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সহায়ক হিসেবেই মানুষ কাজ করতে পারদর্শী হয়ে উঠছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দুরন্ত অভিঘাত প্রযুক্তির হাতে মহাকালের রথের ঘোড়ার রশিকে অর্পণ করেছে। AGI হয়তো সেই প্যারাডাইম শিফটকে আপাত এক সম্পূর্ণতা দেবে। হয়তো এটাই ভবিতব্য। কিন্তু মানুষের লড়াই তো চৈতন্যের ভূমিতে নির্মিত হয়। একদিন প্রকৃতির খামখেয়ালিকে নিজ চৈতন্যে অধিষ্ঠিত করেই মানুষ তার নিয়ম ও সূত্রকে বুঝে নিজের সভ্যতা নির্মাণ করেছে। আজও সেই চৈতন্যের আলোকেই সে বুঝে নেবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সামগ্রিক সত্তাকে। সেদিনও যেমন উদ্বৃত্তভোগী ও প্রতারকেরা সমকালের প্রযুক্তির সহায়তায় মানুষের বৃহৎ অংশকে বঞ্চিত করেছে, আজও সে প্রক্রিয়া সমভাবেই সক্রিয়। একইভাবে সেই বঞ্চিত বৃহৎ অংশ যেমন প্রতিরোধের লড়াই দিয়েছে, নতুন পথ নির্মাণ করেছে, আজও সে লড়াই অব্যাহত। প্রশ্নটা আদপে তাই প্রযুক্তির নয়, নিজ নিজ চৈতন্যের। 

     

Tuesday 21 November 2023

দেশপ্রেমের উন্মত্ত চাপ?

খানিক অ-ক্রিকেট চর্চা

মালবিকা মিত্র



পাড়ার ছেলেরা রোহিত-বিরাট-শামির পোস্টার পতাকা জায়ান্ট স্ক্রিন টিভি সব আয়োজন সারছে ভোটের মরশুমের ব্যস্ততা, তৎপরতায়। শনিবার, ফাইনাল খেলার আগের দিন। মৃদু স্বরে বললাম, বাবারা, এত আনন্দ আয়োজন করছিস, সবই যেন পণ্ড না হয় দেখিস। কিছু আবেগ উত্তেজনা বাঁচিয়ে রাখতে হয়। যদি হেরে যাস, তখন এই চেয়ার, এই ছাউনি সব গোছানোর সামর্থ্য থাকবে তো? 

ছেলেপুলেরা সমস্বরে প্রতিবাদ জানালো, হারের প্রশ্নই নেই। 'আন বিটন আন বিটন, ক্যাঙারুদের লিগের ম্যাচে হারিয়েছি, ফাইনালেও হারাব'... 'আর অস্ট্রেলিয়া তো বাদ যেতে যেতে টিঁকে গেছে কপালের জোরে'। আমি যে নিয়মিত সব খেলা দেখেছি তা নয়। বরং বেশির ভাগ দেখিনি। তাই খেলার পোস্ট-মর্টেম করলাম না। আমি আমার সমাজ চর্চার অভ্যেস উগরে দিলাম। 

∆ একবারও না হারার ফলে প্রতিটি ছোট-বড় বিপর্যয়ের সামনে কীভাবে হাল ধরতে হয় তা অজানা থাকাই স্বাভাবিক। ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট শিক্ষা অসমাপ্ত। টিমের সামান্য বিপর্যয়ে দিশেহারা দেখাবে। মনে নেই, স্থল যুদ্ধে অপরাজেয় নেপোলিয়ন স্পেনের মাটিতে প্রথম প্রতিরোধের সামনে দিশেহারা হয়ে গেলেন। দরকার ছিল একটু বিরাম, একটু আত্মবিশ্লেষণ। পরিবর্তে তিনি আরও দ্বিগুণ আক্রমণাত্মক হলেন ও একের পর এক বিপর্যয় ডেকে আনলেন। 

∆ প্রথম দুটো খেলায় পরাজিত হয়ে সংশয় ও অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যে দলটা প্রথম চারে উঠে এল, সেই দল বাড়তি সমীহ দাবি করে। সমর্থকদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলাম ১৯৯২'এর ক্রিকেট বিশ্বকাপ। প্রথম পাঁচ ম্যাচে মাত্র তিন পয়েন্ট পাকিস্তানের। মোট আটটি খেলা। পরের তিনটি ম্যাচ জিতে, নয় পয়েন্ট নিয়ে, কোনওমতে সেমিফাইনালে চার নম্বর দল। ওই বিশ্বকাপ পাকিস্তানের ঘরে গিয়েছিল। 

∆ আর ওই বিশ্বকাপের লিগ টেবিলে শীর্ষে  নিউজিল্যান্ড শেষ ম্যাচ হারলো পাকিস্তানের কাছে। সেমিফাইনালে এক নম্বরের সাথে চার নম্বরের খেলায় পুনরায় হারলো পাকিস্তানের কাছে। ফাইনালে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে পাকিস্তান চ্যাম্পিয়ন। এমন ঘটনা খেলার জগতে বড় বেশি দেখেছি। ইতিহাসেও কম নজির নেই। 

∆ গাভাস্কারের একটি মন্তব্য খেলা, রাজনীতি, পরিবার, সমাজ সব ক্ষেত্রেই মনে রাখি। রোহিত শর্মার প্রথম ODI ছিল ২০০৭ সালে আয়ার্ল্যান্ডের বিরুদ্ধে। কিন্তু সেই ম্যাচে রোহিতের ব্যাট করার প্রয়োজন হয়নি। সেই বিচারে প্রথম ODI দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে, যেখানে তিনি প্রথম রান করলেন ৮ (আট)। গাভাস্কার অসাধারণ নিখুঁত ওই আট রান দেখেই বুঝতে পারেন রোহিতের মধ্যে লুকানো প্রতিভাকে। মন্তব্য করেন, ওকে শুধু জানতে হবে, কোন বলকে সমীহ করে ছেড়ে দেবে। নিখুঁত ব্যাটিং, কিন্তু আউট হল যে বলে, সেটাও ছিল মারাত্মক নিখুঁত। 

∆ হ্যাঁ, সমীহ দাবি করে। ওসব হার্ভার্ডওয়ালা জানি না, চিনি না। আমি হার্ড-ওয়ার্কে বিশ্বাসী। এই উদ্ধত বিশ্বাস মূল্যবান মতামতকে অগ্রাহ্য করে। এই মনোভাব ছাড়ার বলকে মেরে বসে। 

∆ রোহিতের মধ্যে সেই সমস্যা থেকেই গেল। অসাধারণ ব্যাটসম্যান কিনা হিটম্যান হিসেবে পরিচিত হল। ২০২৩'এর বিশ্বকাপ স্কোর বোর্ড দেখুন, একটাই সেঞ্চুরি। বাকি সব ৪৭, ৪০, ৬১, ৮৭ এইরকম। রোহিতের মতো ব্যাটসম্যান দশ ওভার ক্রিজে থাকলে এমনিতেই রান আসবে। পরিবর্তে অ্যাডভেঞ্চারিজম দেখলাম সব খেলায়। বিপদ ঘটেনি, কারণ, বিরাট, শুভমন, শ্রেয়াস, রাহুল, জাদেজা মেক-আপ দিয়েছে। যেদিন দেবে না? রোহিতের মধ্যে দায়িত্ব নিয়ে ম্যাচ ফিনিশ করার মানসিকতা দেখলাম না। 

∆ মহম্মদ শামি প্রতি খেলায় ৪/৫টি উইকেট পাচ্ছে। সেমিফাইনালে ৭টি। বুঝতে পারছিলাম, বোলিং সাইড শামি নির্ভর হয়ে যাচ্ছে। যেদিন শামি ম্যাজিক কাজ করবে না? 

∆ অধিকাংশ ম্যাচে ইন্ডিয়া মিডল অর্ডার ও টেল এন্ডারদের ছাড়াই ৪/৫ উইকেট হারিয়ে জয়ী হয়েছে। ফলে, বিশ্বসেরা ব্যাটিং লাইন আপ কার্যত রিজার্ভ বেঞ্চেই বসে থেকেছে। 

∆ সর্বোপরি বলি, খেলা পাগল দর্শক একপ্রকার। ওটা সব দেশে থাকে। কিন্তু খেলার সঙ্গে রাজনীতি, দেশপ্রেম, ২০২৪'এর নির্বাচন, জয়শ্রীরাম, ১৪২ কোটি আশা জুড়ে খেলোয়াড়দের ওপর প্রত্যাশার বিপুল বোঝা। 'নরেন্দ্র মোদী স্টেডিয়াম' ও এক লক্ষ বত্রিশ হাজার দর্শকের সিংহনাদ- এ সবই নেতিবাচক চাপ তৈরি করে। অন্য দেশগুলির সমর্থকেরা তো ভয়ঙ্কর ভাবে এবার অনুপস্থিত। জামায় 'ফ্রি প্যালেস্টাইন' লেখা এক অস্ট্রেলিয়া নিবাসী মাঠে নেমে বিরাটের কাছে চলে যাওয়ায় তাকে গুজরাতের পুলিশ বেধড়ক মেরে দেশপ্রেমের 'সবক' শিখিয়েছে। বিপরীতে, অস্ট্রেলিয়ার কাছে ফাইনাল খেলা নিছক আরও একটি খেলা। যাদের সেমিফাইনালে পৌঁছনো ছিল অনিশ্চিত। ফলে, চাপ মুক্ত।

∆ একবার যদি খেলার সাথে তথাকথিত দেশপ্রেম জুড়ে যায়, তখন খেলায় জেতার অর্থ তারা দেশনায়ক। আর হারের অর্থ দেশদ্রোহী। জাহির খান, আজহার, মহম্মদ শামি, রাহুল দ্রাবিড়, শচীন কেউ এই জাতীয় আগ্রাসন থেকে রেহাই পাননি। সেই চাপ যথেষ্ট ছিল। 

∆ আমরা যে ক্রিকেটকে দায়িত্ববোধ বলে থাকি, সেটা টি-টোয়েন্টি'র যুগে অচল। আগে ব্যাট করে দল ১২৫ রান করার পর গাভাস্কার বলতে পারতেন, একশো পঁচিশ রান কম কীসের, শূন্য তো নয়। মার কাটারি সনৎ জয়সূর্য-কালুভিথরন জুটি প্রথম দুই ওভারে আউট হবার পর অরবিন্দ ডি সিলভা আর রোশন মহানামার অবিস্মরণীয় জয়সূচক ইনিংস ভুলতে পারি না। এখন ব্যাটিং মানসিকতাই পাল্টে গেছে। 

∆ ম্যাচ যখন কার্যত হাতের বাইরে তখন বিরাট গ্যালারির দিকে দুই হাত তুলে সিংহনাদ তুলতে চাইছেন। তখন সিংহ বাস্তবিকই মৃত। মাঠে বিরাট কোহলির আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে সমালোচনা আছে। ওয়ার্নার আউট হবার পর সেটা দেখলাম। কিন্তু তারপর? খেলা যত গড়ালো আগ্রাসন উধাও। আগ্রাসন, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ ওসব পরিস্থিতি সাপেক্ষ। নিউজিল্যান্ড ম্যাচে সেমিফাইনালে দুটি পর্বে ভারতীয় ফিল্ডিং বোলিং'কে হতাশ করেছে, জলে ভেজা মুড়ি হতে দেখেছি। তখনই অনুভব করেছিলাম অঘটন ঘটতে চলেছে। মহম্মদ শামি সে যাত্রা বাঁচিয়েছে। 

কোথাও একটা অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস কাজ করছিল মনে হয়। মোদি হ্যায় তো মুমকিন হ্যায় গোছের।


Sunday 19 November 2023

পুরুষ আত্মহত্যার কড়চা!

লিঙ্গ নিরপেক্ষ আইনের খোঁজে

পার্থ হালদার



কতকটা বহু জনের অগোচরে 'আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবস' বলে ১৯ নভেম্বর দিনটিকে কেউ কেউ চিহ্নিত করেন। ধরে নেওয়া হয়, পুরুষদের ক্ষমতা অপরিসীম; সেই হেতু এমনতর দিবসের উত্থাপন কেন, তা নিয়ে কৌতূহল ও ধিক্কারেরও হয়তো অন্ত নেই। কিন্তু বাস্তবিক, এমন একটি দিন আজকাল বেশ সোরগোল তুলে উদযাপন চলে। এর সুত্রপাত ১৯৯৯ সালে ত্রিনিদাদ ও টোবাগো'তে; ইতিহাসের অধ্যাপক ডাঃ জেরম তিলক সিং'এর হাত ধরে। বর্তমানে পৃথিবীর ৯০টি দেশে এই দিনটি পালিত হয়। এ বছরেও এই দিনটি সাড়ম্বরে পালিত হচ্ছে। এ বছরের থিম 'ZERO MALE SUICIDE'। আজকাল 'পুরুষ অধিকার আন্দোলন' বলেও একটি ধারা উত্তরোত্তর শক্তিশালী হয়ে চলেছে, যেখানে বহু নারী এই আন্দোলনের সম্মুখ সমরে এসে দাঁড়িয়েছেন। যেমন, পূজা বেদী, দীপিকা ভরদ্বাজ, নন্দিনী ভট্টাচার্য'দের নাম এই মুহূর্তে বেশ জনপ্রিয়।

আমাদের সমাজে 'পুরুষতন্ত্র'  শব্দটির এক অন্যরকম গুরুত্ব আছে। এই শব্দটা শুনলেই পুরুষদের মনে হয়, পুরুষ হয়ে জন্মে বোধহয় কোনও অপরাধ হয়ে গেছে এবং দীর্ঘদিন ধরে নারীদের বিভিন্ন বিষয় থেকে বঞ্চিত রাখার যে সামাজিক চক্রান্ত তাতে অজান্তেই তাদের সকলেরই বোধহয় কিছু ভূমিকা আছে। অন্যদিকে নারীদের একাংশ ভাবে, তাদের জীবনের যা কিছু সমস্যা তার অধিকাংশই পুরুষ শাসিত সমাজের কারণে। অতএব, তাদের এখনও কিছু পাওনা বাকী আছে, তাই পুরুষতন্ত্রকে সমূলে উৎখাত না করা পর্যন্ত কোনও সমাধান নেই। 

১৭৬০-১৮৪০ সালের ব্যাপ্তিতে মানব সভ্যতার এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় রচিত হয়েছিল যার নাম 'শিল্প বিপ্লব'। এর সবচেয়ে লক্ষণীয় দিক বাষ্পশক্তি ও কয়লার ব্যবহার, যা ধীরে ধীরে মানুষের শ্রমশক্তির লাভজনক বিকল্প হিসাবে সমাজে স্থান করে নিল এবং নারীদের পক্ষেও বেশ কিছু উৎপাদনশীল কাজের সাথে যুক্ত হওয়ার সুযোগ এসে উপস্থিত হল। পরবর্তী দিনগুলিতে বিদ্যুৎ ও কম্পিউটারের আবিষ্কার এবং বর্তমানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিকাশ বহু কাজেই আজ নারীকে পুরুষের সমকক্ষ করে তুলেছে। রাজনৈতিক ভাবে গণতান্ত্রিক দেশগুলিতে পুরুষ ও নারীর সকলরই সমানভাবে সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে এগিয়ে আশার সদিচ্ছা এবং শুভবুদ্ধি সম্মত মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টাই জন্ম দিয়েছে নারী স্বাধীনতা চেতনার। 

ভারতের মতো দেশও নারী স্বাধীনতার আন্দোলনকে উপযুক্ত গুরুত্ব দিয়েছে। নারীদের বিশেষ অধিকার সংবিধানের ধারা ১৫'র উপধারা ৩'এ বিশেষ ভাবে স্বীকৃত। কিন্তু গত তিন দশকের ইতিহাসে এর সুফলের সাথে যুক্ত হচ্ছে কিছু কুফল; কাজেই আমার বিশ্বাস, এ নিয়ে সমাজের সর্বস্তরে আলোচনা ও সদর্থক জনমত গঠন না হলে আমাদের হয়তো আরেকটি সামাজিক অবক্ষয়ের সাক্ষী হতে হবে। স্বাধীনতা ও তার বিপ্রতীপে পক্ষপাতমূলক আইনকে হাতিয়ার করে যে স্বেচ্ছাচার, তার মধ্যে কিছু সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে। 'ডিসকভারি অফ্ ইন্ডিয়া' গ্রন্থে পণ্ডিত জহরলাল নেহেরু এর একটি সুন্দর ব্যাখ্যা দিয়েছেন- স্বাধীনতা চিরকালই 'Live and Let Live' নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত, তাই যে কোনও প্রকৃত স্বাধীনতাই অন্যের স্বাধীনতার উপর সম্পূর্ণ শ্রদ্ধাশীল। অপর দিকে স্বেচ্ছাচারিতা চিরকালই আত্মকেন্দ্রিক যা অন্যের স্বাধীনতার প্রতি সম্পূর্ণ উদাসীন। তাই যে নারী স্বাধীনতা দেশের পক্ষে আবশ্যিক, একবার ভেবে দেখা উচিত, তা কি কখনও আইনের সহজ সহায়তা পাওয়ার সুযোগ নিয়ে প্রতিহিংসা মেটানোর অবলম্বন হয়ে দাঁড়াচ্ছে? 

এ বিষয়ে সর্বাধিক চর্চিত আইনের ৪৯৮এ ধারা। আমাদের দেশের সংসদ এই আইনটি তৈরি করে মহিলাদের পণ প্রথার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য। কিন্তু দুর্ভাগ্য, এই আইনটির অপব্যবহার এমন ভাবে শুরু হয় যে বহু নির্দোষ পরিবার অভিযোগের শুরুতেই (বিনা বিচারে) সাজা পেতে থাকে এবং বহু মানুষ সামাজিক ও মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। শীর্ষ আদালতও স্বীকার করতে বাধ্য হয় যে, আইনের এই ধারার অপপ্রয়োগ হয়েছে এবং তারা এর কড়া প্রয়োগে কিছু শিথিলতা প্রণয়নের পরামর্শ দেয়। এ নিয়ে পুরুষ অধিকার আন্দোলনের কর্মী দীপিকা ভরদ্বাজের 'India's Sons' ছবিটি বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য যা সারা দেশ জুড়ে ব্যাপক আলোড়ন ফেলেছে। এ কথা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই যে পণ প্রথার  বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো প্রয়োজন কিন্তু তার মানে তো এই নয় যে এই আইনের সুযোগ নিয়ে শ্বশুরবাড়ির বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ এনে লক্ষ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ আদায় করার মাধ্যমে নিয়মিত একটা বন্দোবস্ত গড়ে তোলা যেতে পারে।

আসলে এর মধ্যে একটা ভয়ঙ্কর ফ্যালাসি লুকিয়ে আছে। যে কোনও কারণেই হোক, আমাদের সমাজে নারীর চাহিদাকে 'আবদার' আর পুরুষের চাহিদাকে 'টর্চার' হিসেবে গ্রহণ করার এক প্রবণতা রয়েছে। কিছুদিন আগে অবধি কোনও বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে ভরণপোষণ বাবদ কোনও পুরুষকে তার বিচ্ছেদপ্রাপ্ত স্ত্রীকে যে পরিমাণ ক্ষতিপূরণ দিতে হত তা অকল্পনীয় এবং এখানেও একটি ফ্যালাসি লুকিয়ে ছিল। এটা ধরে নেওয়া হত, একজন পুরুষ এবং নারী তাদের শ্রম দিয়ে একটি পরিবার গড়ে তুলেছে তাই সেই সংসারে আর্থিক সমৃদ্ধির সমান স্বীকৃতি তাদের উভয়েরই পাওনা। কিন্তু যেখানে বিবাহের মেয়াদই ৩ মাস বা বড়জোর ৬ মাস, সেখানে লক্ষ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ একজন পুরুষ বা তার পরিবারের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া কতটা যুক্তিযুক্ত? আসলে, প্রচলিত সনাতনী বিশ্বাসটি হল, পুরুষ বিবাহের মাধ্যমে দেশের বেকার সমস্যার সমাধান করে। তাই বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে মহিলার আর্থিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করাই তার মূল উদ্দেশ্য, তা সে যেনতেন প্রকারেণ হলেও চলবে। তবে বর্তমানে এই অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। এতদিনের যে ধারণা- আমাদের সমাজে শিক্ষার গণ্ডি পেরলে বেকারত্বের লাঞ্ছনা কেবল পুরুষদের, শিক্ষিত নারী কোনও কিছু না করলেও তাকে কর্মহীন বেকার বলে ধরা হয় না- তা বদলাচ্ছে। নারীরা সমস্ত জায়গায় সমান হলেও পরিবারের আর্থিক দায়িত্বের ক্ষেত্রে তারা কেন সমান হবে না- এই অপ্রিয় বিতর্কটা কিছু মানুষের মধ্যে উঁকি দিচ্ছে।

ভারতের সংবিধান মৌলিক অধিকার হিসাবে প্রতিটি নাগরিককে সসম্মানে বেঁচে থাকার অধিকার দিয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, আমাদের আইনসভা হয়তো মনে করে শরীর ও মন কেবলমাত্র নারীরই আছে, পুরুষদের নেই। তাই আমাদের দেশের ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স প্রতিরোধক আইনটির নাম 'প্রোটেকশন অফ উইমেন ফ্রম ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স অ্যাক্ট'। এখানে পুরুষদের কোনও স্থান নেই এবং তাদের উপর যেন কোনও শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন হতেই পারে না। কিন্তু তথাকথিত চিন্তাবিদদের চিন্তাভাবনা সব গোলমাল হয়ে গেল যখন মনুয়া কাণ্ড সামনে এল, শাক দিয়ে আর মাছ ঢাকা গেল না। সম্প্রতি, বেইরিলি'তে ২৬ বছরের এক মহিলা তার ঘুমন্ত স্বামীর গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে তাকে খুন করেছে। কারণ, সেই মহিলার মতে, তার স্বামী 'কালো' ও 'কুৎসিত' দেখতে। আদালতের বিচারে মহিলা দোষী সাব্যস্ত হয়েছে এবং যাবজ্জীবন সাজা পেয়েছে। প্রশ্নটা এই, আজকের সময়ে ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স কি শুধুই নারীদের ওপরে হয়? 

পুরুষের ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের ইতিহাস কিন্তু কম পুরনো নয়। মনুয়া কাণ্ড না হয় চরম একটি ঘটনা, কিন্তু এর নিচেও তো বিভিন্ন স্তর আছে। পুরুষের উপার্জন বা চাকরির বহর অন্যের সাথে তুলনার মানসিক নির্যাতন তো আমাদের সকলের আশেপাশেই চোখে পড়ে। এছাড়া সব নির্যাতন মুখে বলাও যায় না। বিবাহিত জীবনের ক্ষেত্রে শারীরিক সম্পর্ক থেকে বহু ক্ষেত্রেই পুরুষেরা বিভিন্ন কারণে বঞ্চিত হয় কিন্তু প্রকাশ করতে পারে না। শারীরিক সম্পর্ক ঠিক থাকলে শরীরে কিছু প্রয়োজনীয় ভাল হর্মোন নির্গত হয়, যেমন ডোপামিন, অক্সিটোসিন, টেস্টোস্টেরন, সেরেটোনিন ইত্যাদি। এগুলি শারীরিক ও মানসিক ভাবে বেঁচে থাকার অন্যতম উপাদান। তাই স্বাভাবিক নিয়ম মেনে শারীরিক সম্পর্ক থেকে একজন পুরুষ যদি বঞ্চিত হয়, তা কি সুস্থ শারীরিক ও মানসিক জীবন যাপনের ক্ষেত্রে সুখকর? তাছাড়াও, একজন পুরুষ যদি তার স্ত্রীর প্রতি সমস্ত দায়িত্ব পালন করে সে কি পিতৃত্বের অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে পারে? যদি হয় তাহলে তার করণীয় কী? 

উপরন্তু, আজকের দিনে পৈতৃক সম্পত্তিতে মেয়েদের অধিকার স্বীকৃত কিন্তু বয়স্ক বাবা-মা'র প্রতি কর্তব্যের অধিকার কি স্বীকৃত? যদি কোনও কন্যা তার বৃদ্ধ পিতা-মাতার দায়িত্ব সমান ভাবে ভাগ করে না নেয়, পুত্রের কি কিছু করণীয় আছে? তাছাড়া অবিবাহিত নারী-পুরুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনও পুরুষ যদি তার সঙ্গিনীকে বিবাহ করতে অস্বীকার করে, আমাদের আইন অনুযায়ী সেই সম্পর্কে সম্মত যৌন মিলন 'ধর্ষণ' বলে সাব্যস্ত হয় (যদিও কোনও কোনও আদালত এ বিষয়ে আজকাল তা বলতে অস্বীকার করেছে)। কিন্তু যদি ঘটনাটি বিপরীত হয়, অর্থাৎ, সঙ্গিনী যদি পুরুষের হাত ছেড়ে দেয়, সে ক্ষেত্রে পুরুষটির মানসিক ভাবে ভেঙে পড়া ও অনেক ক্ষেত্রে লেখাপড়া বা পেশাগত জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ছাড়া আর কোনও উপায়ন্তর থাকে না।

এও দেখা গেছে, পদস্থ পুরুষ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যৌন উৎপীড়নের অভিযোগ আসে কিন্তু বহু ক্ষেত্রেই তদন্তে দেখা যায় যে অভিযোগের কোনও সারবত্তা নেই, অন্য উদ্দেশ্যে তাকে ষড়যন্ত্রের শিকার হতে হয়েছে। উলটোদিকে, পদস্থ মহিলা কর্মকর্তা যখন তার অধস্তন পুরুষ কর্মীকে যৌন নির্যাতন করে? এ ধরনের ঘটনা কি আজ যথেচ্ছ নয়? ফলত, আইন যদি ঢালের কাজ না করে তরবারির কাজ করতে থাকে তাহলে এগুলিকে কেন্দ্র করে ক্ষমতার যে নতুন সমীকরণ তৈরি হয় তা লিঙ্গ সাম্যের বিরুদ্ধেই সরব থাকে। তাই, ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স অ্যাক্ট লিঙ্গ নিরপেক্ষ হওয়া বাঞ্ছনীয়। পৃথিবীর বহু দেশে এর উদাহরণ আছে।

এখনও পুরুষদের অধিকার রক্ষার্থে আমাদের দেশে একটিও আইন আছে বলে আমার অন্তত জানা নেই। যা কিছু আছে তা প্রথাগত। যদি পুরুষদের অধিকার মাপার স্কেলটা সত্যিই থাকত তাহলে তারা কতটা বঞ্চিত হচ্ছে বা হচ্ছে না সেটা বোঝা যেত। কেবলমাত্র অধিকার বোধের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা পরিবার বা সমাজ কতটা মূল্যবান বা সহায়ক তা আমার জানা নেই। রবীন্দ্রনাথ তাঁর এক প্রবন্ধে একটি সুন্দর উপমা দিয়েছেন- সমতলের মৃত্তিকা কণার একের অপরের প্রতি টান আছে বলেই তার থেকে সৃষ্ট গাছের ফল রসালো হয় কিন্তু মরুভূমিতে বালুকা কণাগুলির মধ্যে টান কম থাকে বলে এর উপর যে গাছ হয় তা কাঁটাযুক্ত। আমাদের পরিবার ও সমাজ বোধেও ঠিক তেমনি যদি আমাদের একে অপরের প্রতি দায়িত্ববোধ এবং অধিকারবোধ দুটোই থাকে তবেই পরবর্তী প্রজন্মের শিশুদের অন্তঃকরণও রসালো হতে পারে; বিপরীতে, একই পরিবার ও সমাজে আমরা কেবল যদি অধিকারবোধ নিয়েই চলি, একে অপরের সাথে দূরত্ব তৈরি হতে বাধ্য। এতে সব থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিশুদের মানসিকতা। একটি শিশুর সবচেয়ে প্রিয় পছন্দ হল পরিবারের সবার থেকে ভালোবাসা নিয়ে আনন্দে বেঁচে থাকা।

আমাদের দেশে পুরুষদের কোথাও অভিযোগ জানানোর জায়গা নেই বলেই মহিলাদের থেকে পুরুষদের আত্মহত্যার সংখ্যা দ্বিগুনেরও বেশি। লিঙ্গ নিরপেক্ষ আইন প্রণয়ন করেই হয়তো আগামী দিনে সামাজিক ও পারিবারিক অন্যায়ের হাত থেকে বাঁচা সম্ভব। তবে এবারের 'আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবস'এর মূল ভাবনা যেহেতু 'Zero Male Suicide', তাই, একবার দেখে নেওয়া যাক আমাদের দেশে পুরুষদের আত্মহত্যার তথ্যাবলী। এনসিআরবি'র তথ্য বলছে, ২০২২ সালে সারা দেশে ৩০ থেকে ৪৫ বছর বয়সীদের মধ্যে যেখানে ৪০,৪১৫ জন পুরুষ আত্মহত্যা করেছে, সেখানে মহিলাদের আত্মহত্যার সংখ্যা ১১,৬২৯। অনুপাত প্রায় ৪:১। এই ৩০ থেকে ৪৫ বছরই হল কর্মক্ষমতার উচ্চতম শিখর। পাশাপাশি, জীবনে ৪৫ থেকে ৬০ বছর বয়সে যখন কিছুটা থিতু হয়ে বসার কথা, তখন সেই বয়সীদের মধ্যে ২০২২ সালে সারা দেশে ২৪,৫৫৫ জন পুরুষ আত্মহত্যা করেছে, যেখানে মহিলাদের সংখ্যা ৫৬০৭। অনুপাত ৫:১।

এক কাঁধে জীবনের সমস্ত ভার বহন করার হারকিউলিয়ান শক্তি যখন পুরুষদের থেকেই আশা করা হয় তখন আকাশের মতো অমলিন উদার মনও শুধুমাত্র তাদেরই থাকবে তা আর অতিকথা হবে কেন? অতএব, তাদের মরণের কথা কে আর স্মরণে রাখে!


Sunday 12 November 2023

পঞ্চ প্রাণ

'রোজ কত কী ঘটে যাহা-তাহা'

কৌশিক চিনা



চাবিতালা  

বেড়াতে গিয়েছিলাম চুইখিম। হিমালয়ের কোলে এক  আশ্চর্য গ্রাম। নদী আর পাখির সঙ্গে গাছেরা সেখানে গল্প করে।

আশ্চর্য সেখানকার মানুষও। দূষণমুক্ত পরিবেশের মতোই! 

হোমস্টে'তে  যখন অবিশ্বাসের অভ্যাসে সুটকেসে চাবিতালা দিচ্ছি, তখন পার্বত্য অধিবাসীরা তাদের ঘর আমাদের  উন্মুক্ত করেছে 'অতিথিদেব ভব' জ্ঞানে। 

চুইখিমে ফোনের টাওয়ার পাওয়া যায় না। 

অপ্রয়োজনীয় বলে  পাওয়া যায় না চাবিতালাও।


অরণ্য মানব

অসমের ব্রহ্মপুত্র নদের দ্বীপ মাজুলিতে ছেলেটার ঘর। একদিন বন্যায় ভেসে গেল। মারা গেল মানুষ, গবাদি পশু, পাখি, প্রজাপতিও।

ছেলেটা খুঁজেছিল প্রকৃতিকে শান্ত করার পথ। পেয়েও ছিল। গাছ, গাছ আর গাছ। বাঁচার একমাত্র পথ। প্রতিদিন বীজ বপন আর চারা রোপণ। একটাই কাজ। 

মরুভূমি আজ অভয়ারণ্য। 

মরুবিজয়ের কেতন ওড়ানা মানুষটি- যাদবমোলাই পায়েং।


প্রায়শ্চিত্ত  

অটো থেকে নেমেই সুজনবাবু দেখলেন স্টেশন থেকে ন'টা কুড়ির ট্রেনটা ছেড়ে যাচ্ছে। পড়িমরি করে দৌড়ে  কামরায় উঠলেন। পুজোর ছুটির পর আজ প্রথম দিন স্কুল খুলবে। মান্থলিও শেষ। টিকিটও কাটা হল না। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নিয়ে চোরের মতো স্টেশন পার হলেন।

স্কুলেও পড়ানোতে মন ছিল না। 

ফেরার পথে সুজনবাবু দুটো টিকিট কেটে স্বস্তির শ্বাস ফেললেন।


ন্যাড়া

ক্যান্সার আক্রান্ত বিদিশা কেমোথেরাপি শেষে  স্কুলে আসবে। মাথায়  চুল নেই। 

'ন্যাড়া - ন্যাড়া - ন্যাড়া 

বেঞ্চের উপর দাঁড়া। 

বেঞ্চ গেল নড়ে

ন্যাড়া গেল পড়ে।'

বিদিশা স্কুলে এলেই সহপাঠীরা এই ছড়া ব'লে পরিহাস করবে। খুব কষ্ট পাবে বিদিশা। 

অভিন্নহৃদয়  বন্ধু  সুনন্দা পার্লারে গিয়ে ন্যাড়া হয়ে এল। সুনন্দা'র থেকে  বিদিশা পেল প্রকৃত বন্ধুর সহমর্মিতা।


কেন? 

ছেলেটা  লাজুক আর মুখচোরা। মিশতে বা খেলাধুলা করতে পারে না সমবয়সী বন্ধুদের সঙ্গে। মন নেই লেখাপড়াতেও। 

ঘরকুনো ছেলেটা জন্মদিনে কাকার  থেকে  উপহার পেল একটা কম্পাস। কিমাশ্চর্যম! যতই ঘোরাও কম্পাসের কাঁটা যে সব সময় উত্তরে-দক্ষিণে! 

'কেন?'

এই ছোট্ট প্রশ্নের উত্তর সন্ধানে মাথামোটা ছেলেটা চঞ্চল হয়ে উঠল। 

জন্ম হল বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের।