Wednesday 6 May 2020

কঠিন সময়ে

সেনা হেলিকপ্টারে‌র গোলাপ যে কথা বলে না
সুমন  কল্যাণ মৌলিক

মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে সেনা হেলিকপ্টার। বোমা  নয়, রাশি রাশি বুলেট নয়, নেমে আসছে গোলাপের পাপড়ি। নিচে দাঁড়িয়ে উল্লসিত, অভিভূত, পিপিইহীন কোভিড যোদ্ধারা। টিভিতে সঞ্চালক বুক চাপড়ে জানিয়ে দিচ্ছেন, নোভেল করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে এই মহাযুদ্ধে 'আমরা' সবাই ঐক্যবদ্ধ। আর আমরা, এই দেশের জনগণ উর্ধ্ববাহু হয়ে নৃত্য করছি, স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছি এই ভেবে যে হেডমাস্টারমশাইয়ের দেওয়া তৃতীয় টাস্কটি সফল ভাবে সম্পন্ন হল। করোনার বিরুদ্ধে  লড়াইয়ে আমরাই বা কম কীসে! আমরাই তো সামাজিক দূরত্বের নিষেধাজ্ঞাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে থালা বাটি বাজিয়ে সৃজন করেছি করোনা জয়ের অর্কেস্ট্রা। পটকা ফাটিয়ে এ দেশে নিয়ে এসেছি অকাল দেওয়ালি। গোমূত্র পার্টিতে খুঁজেছি জীবনের মানে। প্রশ্নহীন আনুগত্যে নতজানু হয়ে মেনে নিয়েছি মহামহিম সম্রাটের অমৃত বচন। আকালের এই দিনগুলিতেও তাই সব কিছু যেন কেমন পিকচার পারফেক্ট।

এই নির্বোধ যুক্তিহীন গণউল্লাস দেখলে মাঝে মাঝে বড় ভয় হয়। ভাবি, এই গণ হিস্টিরিয়ার শেষ কোথায়? টিভিতে সেনা হেলিকপ্টারে‌র গর্বোদ্ধত উড়ে যাওয়া দেখতে দেখতে হঠাৎ চোখ চলে যায় টেবিলে পড়ে থাকা সংবাদপত্রে। কংক্রিট মিক্সিং মেশিনে লুকিয়ে বাড়ি ফিরতে চাওয়া ব্যাগ হাতে অসহায় ভাবে বসে থাকা ১৮ জন পরিযায়ী শ্রমিকের ছবি। ছত্তিসগড়ের সেই কিশোরী সহ অজস্র মৃত শ্রমিকের লাশ যেন দুয়ো দিতে থাকে আমাদের অস্তিত্বকে। আমরা কি একবার বলতে পারতাম না যে এই অতিমারির সময় আকাশ থেকে ব্যয়বহুল পুষ্পবৃষ্টি বা হাসপাতালের দরজায় ব্যান্ড বাজানো সেনাবাহিনীর কাজ নয়? যথার্থ কাজের কাজ হত যদি সেনাবাহিনী তাদের পরিকাঠামো ব্যবহার করে ক্ষুধার্ত, কাজ হারানো পরিযায়ী শ্রমিকদের বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ নিত। এই বৈভব প্রদর্শনের চেয়ে অনেক বেশি দরকার ছিল চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মীদের জন্য পিপিই'র ব্যবস্থা করা। আমরা কি নীতি প্রণেতাদের চোখে চোখ রেখে বলতে পারতাম না যে এই দরিদ্র, নিরন্ন পরিযায়ী  শ্রমিকদের  কাছে ট্রেনের টিকিটের পয়সা চাওয়া এক জঘন্য পাশবিকতা? তথ্য ও যুক্তিতে ভর দিয়ে দেখিয়ে দিতে তো পারতাম যে এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানে সরকার ৬ কোটি টাকা  খরচ করে ১০০০ জন অভিবাসী ভারতীয়কে চিন, জাপান ও ইতালি থেকে  ফিরিয়ে এনেছে। সেই ডলার উপার্জনকারী মানুষদের  নিজেদের পকেট থেকে একটা টাকাও খরচ করতে হয়নি।

আসলে শুধু প্রশ্ন করার সহস নয়, 'আচ্ছে দিনের' এই নির্লজ্জ সময়ে আমরা হারিয়েছি ক্রোধ, ভালবাসা, সহানুভূতি সহ যাবতীয় মানবিক গুণাবলীকে। সরকার ও মিডিয়ার যুগলবন্দীতে গড়ে ওঠা বন্দনা গানে তালি বাজানো ছাড়া আজ আর আমাদের কোনও দায়িত্ব অবশিষ্ট নেই। না হলে ঐক্যের নামে গড়ে তোলা বজ্জাতির ফানুস চুপসে দিয়ে চিৎকার করে বলতাম, একটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় সম্প্রদায়কে করোনা সংক্রমণের জন্য দায়ী করে, তাদের করোনা জেহাদি আখ্যা দিয়ে, ২৪x৭ ফেক ভিডিও'র মাধ্যমে বিষ ছড়িয়ে করোনার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ ভারত গড়ে তোলা যায় না। কোনও সভ্য, গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ দেশ করোনা আক্রান্তদের বিরুদ্ধে জাতীয় সুরক্ষা আইনে মামলা সাজায় না। হটস্পটগুলোর নামকরণ মসজিদের নাম বিজ্ঞাপিত করে হয় না। করোনাকে এ দেশে যেভাবে সাম্প্রদায়িক রূপ দেওয়া হচ্ছে তাতে হু পর্যন্ত বলতে বাধ্য হয়েছে: 'Having covid-19 is not anybody's fault. Every case is a victim. It is important that we do not profile the cases on the basis of racial, religious and ethnic lines.'

অপরিকল্পিত লকডাউন লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিকের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনল। কিন্তু  তাতেও আমরা অবিচলিত থেকেছি। কারণ, আমরা বিশ্বাস করেছি প্রতিটি পরিযায়ী  শ্রমিক আসলে 'potential carrier of corona virus'। আমাদের মধ্যবিত্ত শ্রেণি-অবস্থান রোজ আমাদের শেখায় 'আপনি বাঁচলে বাপের নাম'। তাই দুই-তিন মাসের আর্থিক নিরাপত্তায় বলীয়ান হয়ে আমরা লকডাউনের সপক্ষে গলা ফাটাই। কিন্তু দিন আনা দিন খাওয়া গরিব মানুষের কী হবে? আজ পর্যন্ত দু' খেপে এক হাজার টাকা  জনধন অ্যাকাউন্টে দেওয়া ছাড়া কেন্দ্রীয় সরকার কোন‌ও আর্থিক সাহায্য দেয়নি। লকডাউনের তিন দিনের মাথায় মাননীয়া অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন রেশনে বিনামূল্যে ডাল দেওয়া হবে কিন্তু আজ পর্যন্ত কোথাও ডাল বিতরণ করা হয়নি। আর্থিক সাহায্যের প্রস্তাব নিয়ে বহু আলোচনা চলছে কিন্তু সরকার নীরব। অন্যদিকে মিউচুয়াল ফান্ডগুলোকে বাঁচাতে সরকার টাকার ব্যবস্থা করছে। করোনার এই কঠিন সময়ে ধনকুবেরদের উপর কর বসিয়ে টাকার সংস্থানের প্রস্তাব দিয়েছিলেন রেভেনিউ সার্ভিসের অফিসাররা। সেই অপরাধে তাঁদের অনেককে শো কজ করা হয়েছে। এই নিরন্ন সময়ে সংসদ ভবন, প্রধানমন্ত্রীর আবাস ও রাষ্টপতি ভবন তথা নয়া দিল্লির সৌন্দর্য বর্ধনে হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা হচ্ছে। কেনা হচ্ছে বহু কোটি টাকা দামের প্লেন যাতে চড়বেন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী।

আজ একদিকে লকডাউনের সময়সীমা বাড়ছে, অন্যদিকে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। টিভি চ্যানেলগুলিতে সুনামির মতো আছড়ে পড়া চিকিৎসকের দল নিত্যনতুন ছকের মাধ্যমে লকডাউনের  কার্যকারিতা বোঝাচ্ছেন। কিন্তু কেউ বলছেন না কেন সরকার যথেষ্ট পরিমাণে পিপিই সরবরাহে ব্যর্থ। টেস্ট কিটের অভাবে কেন সারা দেশে র‍্যাপিড টেস্ট বন্ধ! টেস্ট ছাড়া অনন্তকাল লকডাউন যে এক নির্বোধ তামাশা সে কথা আজ বলবার কেউ নেই। এ রাজ্যে কো-মর্বিডিটি নামে এক শব্দের আড়ালে মৃত্যুর সংখ্যা কমিয়ে দেখানো হচ্ছে, করোনা সংক্রান্ত সরকারি তথ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে, রেশন নিয়ে মানুষের বিক্ষোভ বাড়ছে কিন্তু রাজরোষে পড়ার ভয়ে আমরা চুপ করে থাকছি। হোমো সেপিয়েন্স'এর শিরদাঁড়া থাকে, এটা  প্রাণিবিদ্যার বইতে লেখা আছে বটে কিন্তু সব শিরদাঁড়া সমান নয়, এই যা।

এই অনাচারের বিরুদ্ধে সরব হওয়ার সাহসটা আজ আমরা হারিয়েছি। আমাদের এই হিরন্ময় নীরবতা সরকারগুলিকে নিশ্চিন্তি জোগায়। রাষ্ট্রহিতের ধ্বজা উড়িয়ে রাতের অন্ধকারে পুলিশ হানা দেয় এনআরসি বিরোধী আন্দোলনের পরিচিত মুখগুলোর বাড়িতে। দানবীয় ইউএপিএ আইনে বন্দী মানুষের সংখ্যা দীর্ঘায়িত হয়। রাষ্ট্র প্রস্তুতি নেয় কর্পোরেট স্বার্থে শ্রমিককে ১২ ঘন্টা খাটানোর। বিপর্যয় মোকাবিলা আইন ও আরোগ‍্য সেতু অ্যাপের আড়ালে রাষ্ট্রের নজরদারি বাড়তে থাকে। কোন‌ও কিছুতেই আজ আমাদের রাগ হয় না, কারণ শ্মশানের শান্তিকে ভবিতব্য মেনেছি আমরা। অথচ এটাই তো সময় ছিল প্রশ্ন করার, সহ নাগরিকদের অবর্ণনীয় দুঃখ কষ্ট দেখে ক্ষোভে জ্বলে ওঠার। রাষ্ট্রকে মনে করিয়ে দেওয়ার যে সরকার ও নাগরিকের সম্পর্ক দাতা-গ্রহীতার নয়, বিষয়টা অধিকারের। এই কঠিন সময় দাবি করে নাগরিক সক্রিয়তার। আমরা কি এখনও মুখে কুলুপ এঁটেই থাকব?

4 comments:

  1. নীতিহীন রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য জনগণকেই চরম মূল্য দিতেইহয়। বৃহত্তরপ্রজাতন্ত্রের দেশে যেখানে রাজনীতি জাতিগতভাবে সততা,মূল্যবোধ, আদর্শ বিসর্জন দিতে দিতে পড়ে পাওয়া স্বাধীনতার ৭৩ বছর কাটিয়ে দিতে পারে দ্বিধাহীনভাব, সেখানে এসব ভাববার চাইতে লকডাউননে ছাড় দেওয়া মদের দোকানে লাইন দিয়ে মদ্যপান করে গুলতানি ও মাতলামো করাটা জরুরি! সর্বগ্রাসীধনতন্ত্র আজ গরীব মানুষের বেঁচে থাকার ন্যূনতম অধিকার হরণ করেছে। নির্লজ্জ নির্লিপ্ত সমাজ অসচেতনতার অন্ধকারে নিমজ্জিত। তবু, প্রতিবাদহীন হয়ে সচেতন শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরা বাঁচতে চাইনা। এই যুক্তিনির্ভর প্রতিবেদনের প্রতিবাদে আমিও সহমত পোষণ করছি।

    ReplyDelete
  2. পুরো বিষয়টির সঙ্গেই একমত কিন্তু প্রতিবাদ হচ্ছে।
    কেন্দ্র ও রাজ্য দুই সরকারই এই সময়ে প্রয়োজনীয় কাজটা করছেন না।দুই সরকার শুধু ঘোষণাই করছেন সেই ঘোষনা কার্যকরী হচ্ছে না। রেশন, পরিযায়ী শ্রমিকদের বিষয়ে বা কালোবাজারির মত বিষয়ে সমাজিক মাধ্যম সহ অন্যান্য ক্ষেত্রেও লাগাতারপ্রতিবাদ হয়েছে।এমনকি রাস্তায় নেমেও। প্রতিবাদী কন্ঠস্বর কিন্তু থেমে নেই।

    ReplyDelete
  3. প্রয়োজনীয় সুন্দর লেখা। Fools can be fooled by ফুল।

    ReplyDelete
  4. এই অনাচারের বিরুদ্ধে মানুষজন সরব হয়েছেন.. হচ্ছেন আপনার লেখাটি আরো একটি তার প্রমান। পরিযায়ী শ্রমিকদের উপর কীটনাশক ছড়ানোর প্রতিবাদ হয়েছে. তাঁদের কাছ থেকে ট্রেনের ভাড়া নেওয়ার সমালোচনা হয়েছে দেশজুড়ে। কিন্তু অসুবিধা হচ্ছে এই রাজ্যে দিনের পর দিন মানুষ তার ন্যায্য রেশন পাচ্ছেন না সেই কথা উল্লেখ থাকলে ভালো হতো. পরিযায়ী শ্রমিকদের উপর যোগী রাজ্যের মতো নিন্দনীয় কীটনাশক স্প্রে করার নিন্দা আপনার আগামী লেখাতে থাকবে এই আশা রাখি।

    ReplyDelete