Sunday 17 May 2020

'যেন অন্ধও পড়ে ফেলে'

দিল্লির দাঙ্গায় করোনা-গ্রহণ
আশিস দত্ত

কোভিড-১৯'এর ত্রাসে দিল্লির দাঙ্গার খবরে গ্রহণ লেগেছে। একেবারে পূর্ণ-গ্রাস। সংবাদমাধ্যম এমনকী সোশ্যাল মিডিয়া থেকেও উধাও হয়ে গেছে দাঙ্গার খবর। প্রায় পঞ্চাশ দিন লকডাউনের পর মোটামুটিভাবে বোঝা গেল, করোনা সমাজ থেকে উধাও হয়ে যাবে না। আর পাঁচটা সংক্রামক রোগের মতো করোনাও আমাদের নিত্য সঙ্গী হয়েই থাকবে। ইনফ্লুয়েঞ্জা, যক্ষ্মা, ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়ার মতো করোনা আরও একটা রোগ হিসাবে সমাজে স্থায়ী জায়গা করে নেবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ক্ষেত্রে সমাজে হয়তো বেশ কিছু পরিবর্তন আসবে। ভবিষ্যতে জ্বর হলে ডাক্তারের প্রেসক্রিপশনে আরও একটা টেষ্ট যোগ হবে- কোভিড ১৯ RT-PCR। কিন্তু করোনা-পূর্ব দিল্লির দাঙ্গায় যে পরিবারগুলি আশ্রয় হারালো, সংসারের রোজগেরে পুরুষটিকে হারিয়ে যে পরিবারগুলির দিনগুজরান নিত্য সমস্যা হয়ে দেখা দিল বা যে শিশুগুলি অনাথ হয়ে এক অন্ধকার ভবিষ্যতের মুখোমুখি হল, তারা এখন কোথায় আছে, কীভাবে আছে? মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই জুটেছে তো? পেটের ভাতের জোগাড় হচ্ছে তো? এই প্রশ্নগুলো এখন আর গুরুত্ব পাচ্ছে না। 

জাফারাবাদ, সিলামপুর, মৌজপুর, বাবরপুর, কারাওয়াল নগর, ব্রহ্মপুরি, মুস্তাফাবাদ, খাজুরিখাস ঘনবসতিপূর্ণ উত্তর-পূর্ব দিল্লির এই মহল্লাগুলিতে হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের পাশাপাশি বাস। এমনও বাড়ি আছে যেখানে একটিই সাধারণ দেওয়ালের দুই পাশে হিন্দু-মুসলিম দুই পরিবারের সংসার। মন্দির মসজিদ দুইয়েরই সহাবস্থান পাড়ায় পাড়ায়। অনেক ক্ষুদ্রশিল্পের অবস্থানের জন্য কয়েক হাজার পরিযায়ী শ্রমিকেরও আবাসস্থল এই উত্তর-পূর্ব দিল্লি। মুসলিম মালিকের কারখানায় কাজ করে পরিযায়ী হিন্দু-শ্রমিক বা উল্টোটা। পেটের টানে ধর্ম বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি কখনও। ধর্ম আলাদা হলেও দৈনন্দিন জীবন যাপন ছিল দ্বন্দ্বহীন প্রীতিপূর্ণ। বিশ্বাস ছিল মানুষে মানুষে। বিপদে আপদে পাড়া পড়শি, কী হিন্দু কী মুসলিম, এগিয়ে আসত সাহায্যের হাত বাড়িয়ে। এটাই তো ছিল রবীন্দ্রনাথের ভারত, নেহেরু-গান্ধির ভারত। কিন্তু আজ সেই বিশ্বাসে ফাটল ধরেছে। মহল্লায় মহল্লায় সন্দেহের চোরা চোখ ঘোরাফেরা করে। ধর্ম অনুসারে নানা জনে দল বেঁধে থাকে, রাত-পাহারা দেয়। হয়তো গোপনে গোপনে অস্ত্রও শানিয়ে রাখে। কী সেই শক্তি যা দয়া-মায়া-ভালবাসা-সমবেদনার মতো মানবিক মূল্যবোধগুলিকে চিরে চিরে ফালা ফালা করে দেয়! মানুষ তখন আর মানুষ থাকে না। এই অপশক্তিকে চিনতে না পারলে মানবজাতির সমূহ বিপদ। করোনার বিপদ তবু এড়ানো যায় কিন্তু সাম্প্রদায়িক-বিষের ছোবলে সমাজ নীল হয়ে যাবে। তার লক্ষণগুলি ক্রমশ প্রকট হয়ে উঠছে। 

দেশ ও কালের পরিবর্তন হয়ে গেছে কিন্তু গেস্টাপো ও গোয়েবলসরা অন্য রূপে এখনও সমাজে রাজনৈতিক-আশ্রয়ে ঘুরে বেড়ায়। জার্মান জাত্যাভিমানের বদলে এখন হিন্দু জাত্যাভিমান। তাই গেস্টাপোদের দেখা যায় বিএইচইউ, জেএনইউ, জামিয়া মিলিয়ার মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। এদের দেখা যায় মুসলিম বাড়িতে গো-মাংস মজুত আছে কি না দেখার জন্য উঁকি মারতে, ভীমা কোড়েগাঁওতে দলিত জমায়েতে চড়াও হতে, পেশাগত কারণে ভাগাড়ে মরা গরুর চামড়া ছাড়ানোয় রত দলিতেরই চামড়া ছাড়িয়ে নিতে। এরাই বেছে বেছে উত্তর-পূর্ব দিল্লির মুসলিমদের ওপর হামলা চালায়। আইন এদের স্পর্শ করতে পারে না বা চাপের মুখে কেউ কেউ গ্রেফতার হলেও অবিলম্বে তাদের জামিন হয়ে যায়। 

সাত দশকে প্রযুক্তির অনেক উন্নতি হয়েছে, তাই গোয়েবলসদের বদলে তৈরি হয়েছে 'আইটি সেল'। বিজেপি’র আইটি সেল-এর এক প্রাক্তন সদস্যের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে জানা যায়, সারা দেশে বিশ হাজারের বেশি মানুষ এই সেল-এর সদস্য (এখন আরও বেড়েছে)। এরা বিভিন্ন হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে ঢুকে আছে। এটা অনেকটা ‘পাবলিক রিলেশন’ কোম্পানির মতো। এই কোম্পানির কোর গ্রুপের সদস্য দেড়শ জন। এরা সরাসরি মোদীজি ও অমিতজি’র সাথে দেখা করে পরামর্শ করতে পারে। এদের কাজ হল দেশের গণ্যমান্য ব্যক্তির (এর মধ্যে সেনাবাহিনীর উচ্চপদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিরাও আছেন) ছবি ও নাম ব্যবহার করে ফেক ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলে মিথ্যা খবর প্রচার করা যাতে সেই খবর সাধারণ মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে। আক্রমণাত্মক কোন টুইটারকে এরা মুহূর্তে হাজার হাজার 'কপি-পেস্ট' করে ভাইরাল করে দেয় মানুষ খেপিয়ে তোলার উদ্দেশ্যে। হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে গ্রুপে ভুয়ো খবর ছড়িয়ে দেয় এরা। বৈদ্যুতিন এবং মুদ্রিত সংবাদমাধ্যমের আগেই সেই খবর সারা বিশ্বে ছড়িয়ে যায়। দেশাত্মবোধের জিগির তোলার জন্য, বালাকোটের 'সার্জিক্যাল স্ট্রাইক'-এর বানানো সংবাদ এভাবেই ছড়িয়ে পড়েছিল। 

‘হিন্দু-রাষ্ট্র গঠন’ ও ‘ব্রাহ্মণ্য-ধর্মের প্রসার’ এই দুটি হল সংঘ পরিবারের এজেন্ডা। বিজেপি হল তার রাজনৈতিক মুখ। যে-কোনও ঘটনাকে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের কাজে লাগিয়ে ক্ষমতার প্রসার ও লক্ষ্যের অভিমুখে পা বাড়ানোই এদের উদ্দেশ্য। তাই CAA, NRC, NPR বিরোধী আন্দোলন বা সম্প্রতি ভারতে কোভিড-১৯ ভাইরাসের সংক্রমণের মতো বিষয়কেও এরা রাষ্ট্রক্ষমতা ও প্রচারক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে মুসলিম-বিরোধী করে তোলে ও দমন-পীড়ন চালায়। গত সপ্তাহেই হুগলির তেলেনিপাড়ায় মুসলিম মহল্লায় আগুন দেওয়া হয়। মুসলিম মাত্রই করোনা-আক্রান্ত এই জিগির তুলে খেপিয়ে তোলা হয় মানুষকে। দিল্লির দাঙ্গা তাই শুধুমাত্র একটি নিছক দাঙ্গা নয়, এটি ছিল সুপরিকল্পিতভাবে রাষ্ট্রীয় মদতে সন্ত্রাস।  একই সন্ত্রাস ২০০২ সালে ভারতবাসী দেখেছিল গুজরাতে। নরেন্দ্র দামোদর মোদী তখন ছিলেন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী। সেনাবাহিনী ও প্রশাসনকে পঙ্গু করে সাতদিন ধরে রাষ্ট্রীয় মদতে চলেছিল মুসলিম নিধন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ীজী সেদিন গুজরাতে ছুটে গিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রীকে 'রাজধর্ম' বিষয়ে শিক্ষা দিতে। সেই মুখ্যমন্ত্রীই এখন ক্ষমতার সিঁড়ি বেয়ে পৌঁছে গেছেন প্রধানমন্ত্রীর আসনে। গুজরাতের সেদিনের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এখন দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। আর সেই একই কায়দায় সন্ত্রাস এখন রাজ্যের সীমানা ছাড়িয়ে রাজধানীতে পৌঁছে গেছে। 

অটলজী আজ প্রয়াত তাই বিচার ব্যবস্থাকেই এগিয়ে আসতে হয় 'রাজধর্ম'-এর পাঠ দিতে। এজলাসে বসে চার চারটি ভিডিও ফুটেজ দেখার পর বিচারপতি মুরলিধর দিল্লি-পুলিশের দিকে অভিযোগের আঙ্গুল তোলেন। তিনি বলেন, 'এ তো ভয়ংকর। দিল্লি পুলিশের হাল দেখে আমি বিস্মিত। কেন বিজেপির চার নেতা কপিল মিশ্র, অনুরাগ ঠাকুর, পরবেশ বর্মা ও অজয় বর্মার বিরুদ্ধে এফআইআর করা হয়নি? উপযুক্ত সময় কখন আসবে? গোটা শহর পুড়ে ছাই হয়ে গেলে?' তিনি একদিনের মধ্যে পুলিশকে এফআইআর করার নির্দেশ দেন। এফআইআর না হলে কী হবে তাও ভেবে দেখতে বলেন পুলিশকে। সুপ্রিম কোর্টের তোপের মুখেও পড়তে হয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ’র অধীন দিল্লি পুলিশকে। বিচারপতি জোসেপ বলেন, 'পুলিশ নির্দেশের অপেক্ষা করবে না। (দাঙ্গার সময়) সম্মতি নেওয়ার জন্য এ ওর মুখের দিকে তাকাবে না।' কিন্তু একটা রাতও কাটল না। মধ্যরাতেই বিচারপতি মুরলিধর বদলি হয়ে গেলেন। দিল্লির দাঙ্গা সংক্রান্ত মামলা চলে গেল প্রধান বিচারপতি ডি এন পটেলের বেঞ্চে। দায়িত্ব পেয়ে পটেল বলেন, 'এখন এফআইআর করার উপযুক্ত সময় নয়।' শুনানির সময়সীমা তিনি চার সপ্তাহ পিছিয়ে দিলেন। 

রাষ্ট্রশক্তির বিকট হা-মুখ বিচারব্যবস্থাকেও গিলে ফেলতে উদ্যোগী হয়েছে। গণতন্ত্রের স্তম্ভগুলিতে ভাঙ্গন ধরানোর পরিকল্পনা শুরু হয়ে গেছে। এই সন্ত্রাসের অভিমুখ এখন মুসলিম-বিরোধী। ভারতের সাধারণ মানুষ যদি এখনই সচেতন না হয় তবে এমন দিন আসবে যখন যে-কোনও সরকার-বিরোধী ব্যক্তি বা দলের ওপর নেমে আসবে এই সন্ত্রাস। চারদিকের এই ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক হিংসার পরিমণ্ডলেও দুই সম্প্রদায়েরই কিছু মানুষ তাদের মনুষ্যত্ব হারাননি। খবরে প্রকাশ, কিছু মুসলিমকে তাদের প্রাণরক্ষার জন্য হিন্দু-বাড়িতে আশ্রয় দেওয়া হয়, গুরুদ্বোয়ারা খুলে দেওয়া হয়। অপরদিকে, পাল্টা আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য মন্দির ঘিরে দাঁড়িয়ে পড়েন মুসলিমরা। এই শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষেরাই ভারতবর্ষকে অন্ধ তিমির থেকে আলোর দিকে নিয়ে যাওয়ার দিশারী।

'...তোমরা এফআইআর লেখো, আমরা প্রস্তুত
তোমাদের হত্যাকাণ্ডের সব প্রমাণ লিখব…
বলব এমন জোরে যেন বধিরও শোনে
এমন স্পষ্ট লিখব যেন অন্ধও পড়ে ফেলে…
সব মনে রাখা হবে
সব কিছু মনে রাখা হবে…'

1 comment: